মৎস্য খাতের মধ্যে চিংড়ি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে চিংড়ি বেশ সমাদৃত, ফলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশে চিংড়ি চাষে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি। সরকারি উদ্যোগে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা ২০১৪ এর আওতায় পরিবেশ-বান্ধব চিংড়ি চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও লাগসই সম্প্রসারণ সেবা প্রদান, চাষি উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে প্রদর্শনী খামার পরিচালনা, উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ২০২২ সালে একটি অন্যতম ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাতের অবদান বিবেচনায় এনে মৎস্যসম্পদের স্থায়িত্বশীল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, মৎস্যচাষ ও মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ও সমাজবান্ধব নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর, গ্রামীণ বেকার ও ভূমিহীনদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রসারিত করা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে মৎস্যজীবীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় এবং সম্প্রসারিত সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
জলজসম্পদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশে বন্ধ জলাশয় আছে ৮.৪৪ লক্ষ হেক্টর এবং মুক্ত জলাশয় রয়েছে ৩৮.৬০ লক্ষ হেক্টর। বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার তটরেখার কাছাকাছি বেইজলাইন থেকে সাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রায় ১,৬৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের সামুদ্রিক জলসম্পদ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এ দেশের স্বাদুপানিতে ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও লোনা পানিতে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আধা লোনা বা স্বল্প লোনাপানিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। এ অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু ও পানির গুণাবলি বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে- অভ্যন্তরীণ জলজসম্পদ ও সামুদ্রিক এলাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ির খামারে উত্তম চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি ও পোস্ট লার্ভার (পিএল) পরিচর্যার মাধ্যমে ঘেরে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি সম্পদ বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। সত্তর দশকের দিকে বিশ্ব বাজারে চিংড়ির চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে চিংড়ির উৎপাদন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত বেড়ি বাঁধের অভ্যন্তরে প্রথমে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এর পূর্বেও বাংলাদেশে সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হত। চাষ প্রযুক্তি হিসেবে খামারের অভ্যন্তরে উপযুক্ত সময় অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ও প্রতিপালিত অধিক পোনা সমৃদ্ধ মোহনা অঞ্চলের পানি নালা কেটে প্রবেশ করিয়ে চিংড়ির পোনা পালনের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। খামারে নির্দিষ্টভাবে বা নির্দিষ্ট সংখ্যক পোনা মজুদ না করে মূলত জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসা পোনা সংরক্ষণের মাধ্যমেই চিংড়ি চাষ করা হত। এ কার্য সম্পাদনে বাগদা চিংড়ির প্রজনন মৌসুমে (মার্চ- নভেম্বর) পূর্ণিমার সময়ে জোয়ারের পানি খামারে প্রবেশ করানো হত এবং তিন-চার মাস পর খামারের পানি বের করে দিয়ে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ আহরণ করা হত। এ সময়ে হেক্টর প্রতি চিংড়ির গড় উৎপাদন ছিল। প্রায় ২০ থেকে ৫০ কেজি।
মূলত সত্তর দশকে চিংড়ির বাজার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে সত্তর থেকে আশি দশকের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিংড়ি চাষি ও খামার স্থাপনের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সত্তর দশকের শেষের দিকে খুলনা অঞ্চলের সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে প্রথমে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। অধিক লাভজনক শিল্প হিসেবে চিংড়ি সম্পদ জনসাধারণের কাছে বিবেচিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে চিংড়ির চাষ খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী ও যশোর অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তার লাভ করে ।
বিগত ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ি চাষে মোট জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫১.৮১ হাজার হেক্টর এবং হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল প্রায় ৮৫ কেজি/উৎপাদন চক্র। পঞ্চাশ দশকের দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাদুপানিতে গলদা চিংড়ির চাষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুরু হলেও আমাদের দেশে শুরু হয় সত্তর দশকের শেষ দিকে। এ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জাপান, হাওয়াই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানে গলদা চিংড়ি চাষের উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পূর্বে গলদা চিংড়ির চাষের কোনো স্বতন্ত্র এলাকা ছিল না বললেই চলে এবং বাগদা চিংড়ি মাত্র আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হত। এ সময় গলদা চিংড়ির গড় উৎপাদন ছিল হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ১০০ কেজি। বাংলাদেশে সমগ্র উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে চিংড়ি চাষ ব্যাপক প্রসার লাভ করে মূলত আশি থেকে নব্বই দশকের দিকে। বর্তমানে বেশিরভাগ খামারে সনাতন পদ্ধতি পরিহার করে অনেকটা উন্নত চাষ প্রযুক্তির মাধ্যমে চিংড়ি চাষাবাদ হচ্ছে।
চিত্র- ১.১ একটি আদর্শ ঘের
উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১,৭০,০০০ হেক্টর জমিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চিংড়ির চাষ হচ্ছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার এলাকায় বাগদা চিংড়ি চাষের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি বর্তমানে এ ৪টি জেলার বিভিন্ন এলাকায় আধা-নিবিড় এবং নিবিড় পদ্ধতির খামার গড়ে উঠছে এবং প্রতি নিয়ত বাগদা চিংড়ি চাষের প্রযুক্তি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, হেক্টর প্রতি ৫-৮ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের সাথে সাথে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, উন্নত মানের পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ, সময়মত লবণপানি সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ, প্রদর্শনী খামার স্থাপন এবং বিশ্ব বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য গুণগত মানসম্পন্ন বাগদা উৎপাদন এবং বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ বর্তমান সময়ের দাবী।
রপ্তানি বাণিজ্যে পোশাক শিল্পের পরেই চিংড়ি শিল্পের অবদান। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত হিমায়িত মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের মধ্যে চিংড়ির অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ। আমাদের জাতীয় আয়ের ৩.৫৭ শতাংশ ও কৃষি আয়ের ২৬ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বাংলাদেশে এই শিল্পে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরাক্ষেভাবে মৎস্য পেশা, যেমন- আহরণ, চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি বাণিজ্য এবং অন্যান্য মৎস্য বিষয়ক সহায়ক কাজে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ হতে মোট রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ চিংড়ি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। বিগত ১০ বছরের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ এবং অর্জিত আয় প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে হিমায়িত কারখানার সংখ্যা ৯৭ থাকলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৩৩টি। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামুদ্রিক জলজসম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। চাষের এলাকা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেসরকারিভাবে হ্যাচারির সংখ্যা ও শ্রিম্প খাদ্য কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
শতাব্দীকাল থেকেই আমাদের দেশের চিংড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশে লালিত-পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চিংড়ি সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ সম্পদের গুরুত্ব আজ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। উপকূলীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ বছরের প্রায় ৬ থেকে ৮ মাস বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার কাজে নিয়োজিত। এক গবেষণায় দেখা যায়, সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষক পরিবারের ৭০-৭৫ শতাংশ সদস্য পোনা ধরার মৌসুমে পোনা ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কাজেই বলা যায়, পোনা সংগ্রহের ফলে দুস্থ বিধবা মহিলারা অনেকাংশেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ থেকে এই অতিরিক্ত আয়ের ফলে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থায় কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা দেখা দিয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষ, ধান চাষ ও লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভূমির ব্যবহার নিয়ে গ্রামীণ জনপদে অনেক সময় সামাজিক কলহ-বিবাদের সৃষ্টি হয়। চিংড়ি চাষ অত্যন্ত লাভজনক বিধায় চিংড়ি বড় করার জন্য চিংড়ি চাষিরা খামারের লোনা পানি ধান চাষকালীন সময়েও আটকিয়ে রাখে ফলে ক্রমান্বয়ে চিংড়ি চাষের জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ধানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, এমনকি ধান চাষিদের আমন বীজতলাও নষ্ট হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দরিদ্র বর্গাচাষি ও প্রান্তিক চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে একই জমিতে ধান ও চিংড়ি চাষ এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে একই জমিতে লবণ ও চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। কক্সবাজার অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা অধিক বিধায় ধান চাষ সুবিধাজনক নয়। এসব জমিতে নভেম্বর-এপ্রিল মাসে লবণ উৎপাদিত হয়।
চিংড়ি চাষের জমিতে আপাত দৃষ্টিতে ধানের উৎপাদন কিছুটা কমে গেলেও চিংড়ি চাষই উৎপাদন হ্রাসের একমাত্র কারণ নয়। বরং চিংড়ি চাষিদের ধান চাষের জন্য দেরিতে জমি ছেড়ে দেয়া, দেরিতে ধানের বীজ রোপন করা কিংবা আগাম ধান কেটে নেয়া প্রভৃতি কারণে ধানের স্বাভবিক উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাগদা চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ার পূর্বে ধান উৎপাদন ও লবণ চাষের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু চিংড়ি চাষ অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। পরিকল্পিত চাষ ব্যবস্থাপনা ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হলে দীর্ঘমেয়াদীভাবে পরিবেশের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা দরকার।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সাতক্ষীরা অঞ্চলে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৫৮ হাজার লোক (প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক) প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকে। সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রত্যেক পোনা সংগ্রহকারী বাগদা চিংড়ির লার্ভা বা পোনা সংগ্রহ করতে ৩৮টি অন্যান্য চিংড়ি প্রজাতি, ৬টি মাছের প্রজাতি ও ৫৬টি মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাণিকণা (জুপ্লাংকটন) বিনষ্ট করছে। বাগেরহাট অঞ্চলে ১৪টি অন্যান্য প্রজাতির চিংড়ি, ৬টি মাছের প্রজাতি ও ২১টি মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাণিকণা বিনষ্ট করছে। চিংড়ি চাষের ফলে অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- উপকূলীয় এলাকার জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী, স্থলজ পাছপালা ইত্যাদির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলেও গবেষণায় দেখা যায়। উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষের ফলে বিভিন্ন পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাচুর্যতাও হ্রাস পেয়েছে।
আমাদের দেশে চিংড়ি চাষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। বাগদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি প্রধান উৎপাদন উপকরণ হিসেবে বিবেচিত। চিংড়ি চাষের অন্যান্য উপকরণসমূহের মধ্যে চিংড়ি পোনার প্রাপ্যতা, সম্পূরক খাদ্য ও লাগসই প্রযুক্তি অন্যতম। চিংড়ি উৎপাদনে চিংড়ির জীব-পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যসমূহের সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে উপরোক্ত উৎপাদন উপকরণ সমূহের সমন্বয়ের অভাব ও চিংড়ি চাষ পদ্ধতির উপর প্রযুক্তিগত ধারণা না থাকার কারণেই বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। নিচে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিংড়ি উৎপাদনের প্রধান প্রধান সমস্যাসমূহ বর্ণনা করা হলো :
ক. সামাজিক সমস্যা: চিংড়ির অর্থনৈতিক মূল্য বেশি ও চিংড়ি ধরা সহজ হওয়ার কারণে চিংড়ি চাষ এলাকায় সামাজিক সমস্যাও বেশি। ফলে অনেক সময় অধিকাংশ চাষি ও উদ্যোক্তার চিংড়ি চাষে আগ্রহ কমে যায়। উপকূলীয় এলাকার জনসাধারণ তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত হওয়ায় আর্থ-সামাজিক সংঘাত অনেক সময় খুব প্রকট হয়ে উঠে। চিংড়ি চাষ ব্যয়বহুল হওয়ার সাথে সাথে আয়ের হার বেশি হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলাকার মহাজন বা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ চিংড়ি চাষে সংশ্লিষ্ট এলাকার দরিদ্র চিংড়ি চাষিদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলাকার চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে দরিদ্র চাষিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় না। এছাড়াও চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাও অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চিংড়ি চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, দ্রুত ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা, জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে জটিলতা ইত্যাদি অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
খ. পরিবেশগত সমস্যা: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষ করার ফলে নানা ধরনের পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। চিংড়ি চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে অনেক সময় উপকূলীয় বন ভূমি, কৃষি জমি ও পানীয় জলের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য ও গোচারণ ভূমি হ্রাস পাচ্ছে এবং কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে প্রাণির বিচরণ ক্ষেত্রও নষ্ট হচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।
গ. প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা: সত্তরের দশকে আমাদের দেশে চিংড়ির চাষ শুরু হলেও এখনো আধুনিক চাষ ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। এর প্রধান কারণগুলো হলো চিংড়ি চাষের ওপর সাধারণ চাষিদের মাঝে প্রযুক্তিগত ধ্যান-ধারণার অভাব, আধানিবিড় বা নিবিড় চাষ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা, সময়মত চিংড়ির পোনার অভাবে চিংড়ি খামারে পরিমিত পোনা মজুদ না করা, ইত্যাদি।
ঘ. চিংড়ি বিপণনগত সমস্যা: আমাদের দেশে এখনও চিংড়ি সম্পদ বিপণনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি বললেই চলে। মূলত চিংড়ি উৎপাদনকারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবহণ ব্যবস্থা, সংরক্ষণ সুযোগ সুবিধা ও মধ্য সুবিধাভোগীদের (ফড়িয়া, আড়তদার ও ব্যাপারি) উপর ভিত্তি করে এ বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। খুব কম পরিমাণ চিংড়িই উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা ধারাবাহিক পর্যায়ের মাধ্যমে বাজারে আসে। বর্তমানে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় রপ্তানি একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে সংশ্লিষ্ট সকল ক্রেতার চাহিদানুযায়ী চিংড়ির গুণগতমান উন্নতকরণের জন্য চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়াকে অধিকতর কার্যক্ষম করা একান্ত অপরিহার্য। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়াকে অধিকতর কার্যক্ষম করা একান্ত অপরিহার্য। চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপসমূহের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চিংড়ি বিপণন নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে চিংড়ি চাষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উৎপাদন উপকরণসমূহের অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হলেও চিংড়ি চাষ উন্নয়ন সম্ভাবনাকে ফলপ্রসু করার জন্য কতিপয় সুপারিশ নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক) স্থিতিশীলভাবে চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যে আধানিবিড় পদ্ধতিতে খামারে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ টির অধিক বাগদা এবং ৮টির অধিক গলদা চিংড়ির পোনা মজুদ করা উচিত নয়।
খ) প্রতিটি ফসল তোলার পর বা চিংড়ি আহরণের পর চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের জন্য বাগদা ও গলদা চিংড়ির খামারের তলদেশে সঞ্চিত কালো মাটি বা বর্জ্য পদার্থ তুলে ফেলে পরবর্তী চাষের পুর্বে লাঙ্গল দিয়ে চাষ দেয়া।
গ) আধানিবিড় খামার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্যাডেল চালিত বায়ু সঞ্চালন যন্ত্রের ব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে যাতে খামারের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ এলাকা পরিষ্কার করা যায় এবং অক্সিজেনজনিত সমস্যা না হয়।
ঘ) খামারের পানির পিএইচ ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে রাখা উচিত এবং প্রতিদিন পানির পিএইচ- এর পরিবর্তন বা উঠানামা ০.৪ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও হাইড্রোঅক্সাইডের পরিবর্তে ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট ব্যবহার করা যেতে পারে। চুন প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই পানি এবং মাটির পিএইচ পরিমাপ করা।
ঙ) চিংড়ি পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হ্যাচারি স্থাপন কার্যক্রমকে অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন এবং এ প্রেক্ষাপটে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে হবে। এ লক্ষ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট এলাকায় বাগদা চিংড়ি হ্যাচারি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করাসহ হ্যাচারি মালিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
চ) উৎপাদনকারীদের নিকট প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন- খাবার, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট, চা বীজের খৈল ও রোটেননসহ অন্যান্য জীবাণুনাশকের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
ছ) চিংড়ি উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট বায়ু সঞ্চালন যন্ত্র, পাম্প ও খামারের অন্যান্য উপকরণ উৎপাদনের জন্য সরকারি পর্যায় থেকে উৎসাহিত করা।
জ) মাঠ পর্যায়ে চিংড়ি চাষিসহ বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান নিশ্চিত করা।
ঝ) চিংড়ি চাষের বর্তমান সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে সংশ্লিষ্ট সকল সুফলভোগীদের সমন্বয়ে নিয়মিতভাবে আলোচনা সভা/ কর্মশালা / সেমিনার আয়োজন করা।
ঞ) চিংড়ি চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্ভূত সমস্যার আশু সমাধানকল্পে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রাপ্ত ফলাফল দ্রুত কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ট) আধানিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি খামার স্থাপনের ক্ষেত্রে অভীষ্ট এলাকার কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
(ঠ) চিংড়ি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী স্বাদুপানির শামুক ও ঝিনুকের অনিয়ন্ত্রিত আহরণ বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ড) বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণের সময় যাতে অন্যান্য মাছের বা প্রাণীর পোনা নষ্ট না হয়, সেজন্য চিংড়ির পোনা আহরণকারীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং চিংড়ির পোনা আহরণকারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় অধিক স্থায়িত্বশীল সমন্বিত চিংড়ি চাষের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা।
ঢ) অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ বন্ধ ও উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান রক্ষা করার লক্ষ্যে সকল চিংড়ি খামার, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইত্যাদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদারকরণ।
ণ) চিংড়ি চাষের দ্রুত সম্প্রসারণ ও স্থায়িত্বশীল করার লক্ষ্যে আগ্রহী চাষিদের নিকট সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা।
নিচে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোনা ও স্বাদুপানির চিংড়ির প্রাপ্তিস্থান ও পরিচিতি বর্ণনা করা হলো:
বাগদা চিংড়ি (Penaeus monodon): বাংলাদেশের উপকূলীয় ও মোহনা অঞ্চল, যেমন বাগেরহাটের ঊর্ধ্ব মোহনা, চালনা মোহনা, খুলনার পশুর নদীর মুখে নিম্ন মোহনা, পটুয়াখালীর রাঙাবালী, খেপুপাড়া মোহনা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা এবং বঙ্গোপসাগর। তাছাড়া ভোলা জেলার লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলা সংলগ্ন মেঘনা নদী ও বুড়গৌরাঙ্গা নদীর মোহনায় পাওয়া যায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকা ও লোহিত সাগরে এদের পাওয়া যায়।
বাগদা চিংড়ি দেখতে বাদামি থেকে সবুজ রঙের হয়ে থাকে। এদের পায়ে বাঘের মত কালচে ডোরাকাটা দাল থাকে বলে এদেরকে জায়ান্ট টাইলার শ্রিম্প (giant tiger shrimp) বলা হয়। এই চিংড়ির ইউরোপডে দু'টি ঘন নীল বর্ণের ডোরাকাটা দাগ থাকে। বাগদা চিংড়ির পোনার দেহের সম্মুখভাগ থেকে পশ্চাৎভাগ পর্যন্ত লাল রেখা দেখা যায়। রোস্টীম বাঁকা ও প্রশস্ত এবং দেখতে অনেকটা তরবারীর মত। রোস্টামের উপরের দিকে ৭-৮টি ও নিচের দিকে ৩-৪টি দাঁত থাকে। টেনসন খাঁজযুক্ত, যকৃত দেশিয় কেরিনা সোজা আকৃতির এবং ৫ম পেরিওপডে এক্সোপোডাইট নেই।
চিত্র-১.২: ৰাগদা চিংড়ি
ঢাকা চিংড়ি (Pemnaeus indicus): বাংলাদেশের খুলনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায়। পালঙ্ক অফ এডেন, মাদাগাস্কার, আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নিউগিনি, ভারত ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় এই চিংড়ি দেখা যায়। ঢাকা চিংড়ির দেহে হালকা বাদামী রঙের ফোটা ফোটা দাগ থাকে। এর রোস্টাম খাড়া ও বাঁকা রোস্টানের উপরিভাগে ৮-১০টি এবং নিচের দিকে ৪-৬টি শীত থাকে। শুড় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পা কখনও কখনও লালচে বর্ণের হয়ে থাকে।
চিত্র- ১.৩: ঢাকা চিংড়ি চিত্র- ১.৪: ৰাগতার চিংড়ি
বাগতারা চিংড়ি (Penaeus semirulcatus): বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন মোহনা অঞ্চল এবং পটুয়াখালী জেলায় এই চিংড়ি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় উত্তরাঞ্চল, ফিলিপাইন, ভারতের পূর্ব উপকূল, নিউগিনি ও মালয়েশিয়াতে এই চিংড়ি পাওয়া যায়। এই চিংড়ি দেখতে অনেকটা হালকা সবুজ বর্ণের এবং এদের দেহে অসংখ্য বাদামি রঙের ফোঁটা দাগ থাকে। রোস্ট্রামের দুই পাশে ভাঁজ দেখা যায়। রোগ্রামের উপরিভাগে ৫-৮টি এবং নিচের দিকে ৩টি দাঁত থাকে। এদের পঞ্চম চলন পদে ছোট এক্সোপোডাইট বৰ্তমান।
হরিণা চিংড়ি (Melapenaeus monoceros) : হরিণা চিংড়ি লোনা পানিতে বাস করে। সাধারণত সমুদ্রের ১০-৩০ মিটার গভীরে এদের বিচরণক্ষেত্র। বাগেরহাটের ঊর্ধ্ব মোহনা, চালনা মোহনা, কুমারখালী মোহনা, ভুলা, চরচাপলি, খুলনার পশুর নদীর মুখে নিম্ন মোহনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগর এলাকা এই চিংড়ির বিচরণ ক্ষেত্র। দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত মহাসাগর, মালয়েশিয়া, মালরা স্টেইট ও ভারতের সমগ্র সমুদ্র উপকূল এলাকায় এদের পাওয়া যায়। এই চিংড়ির রোস্টাম সোজা এবং শুষ্প বাগামি রঙের হয়ে থাকে। রোহামের উপরিভাগে ৮-১২টি বীজ থাকে এবং নিচের ভাগে কোনো দ্বীজ থাকে না। ফ্লাজেলা উজ্জ্বল লাল রঙের এ কারণে এদেরকে হরিণা চিংড়ি বলে। ইউরোপড হালকা লাল বর্ণের হয়ে থাকে।
চিত্র ১.৫: হরিণা চিংড়ি চিত্র- ১.৬: হরি চিংড়ি
হল্লি চিংড়ি (Metapenaeus brevicornis): বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মোহনা অঞ্চলে এই চিংড়ি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের সমুদ্র উপকূলে এদের পাওয়া যায়। পকিস্তান ও ভারতে এটি বাণিজ্যিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ি। আঁশযুক্ত দেহের উপরিভাগে বাসামি ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে এবং এই ফোঁটা দাগ লেজের দিকে বেশি থাকে। রোস্টামের পিছনের অংশে উঁচু শৃঙ্গ বা ঝুঁটি থাকে। রোস্টামের উপরিভাগে ৫-৭টি দাঁত থাকে কিন্তু নিচের দিকে কোনো দাঁত থাকে না।
ডোরাকাটা চিংড়ি (Penaeus japonics): গভীর সমুদ্রে এই চিংড়ি পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে ০-৯০ মিটার গভীরতায় এই চিংড়ি পাওয়া যায়। জাপান, ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা, আফ্রিকা ও ভারতে এই ডোরা কাটা চিংড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। এই চিংড়ির দেহে ডোরাকাটা দাগ থাকে। রোস্ট্রাম সোজা ও রোস্টামের উপরিভাগে ৯-১০টি এবং নিচের দিকে ১টি দাঁত থাকে। স্ত্রী চিংড়ির খেলিকামের সম্মুখ অংশের মাথা গোলাকার।
চিত্র- ১.৭: ডোরাকাটা চিংড়ি চিত্র- ১.৮: ৰাধাতারা চিংড়ি
ৰাধাতারা চিংড়ি (Parapenaeopsis stylifera) : বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলাধীন মহেশখালী এলাকা এবং সুন্দরবন সংলগ্ন নিম্ন মোহনায় এই চিংড়ি পাওয়া যায়। তাছাড়া কুয়েত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়াও এদের বিচরণ এলাকা। এই চিংড়ির রোস্ট্রাম ও উপর খন্ডে ছাই রঙের আড়াআড়ি দাল বিদ্যমান। টেলসন ও লেজে পাখনা এবং বক্ষ ও সন্তরণ পদ লাল রঙের হয়ে থাকে। খাটো রোস্টামের উপরিভাগে ৭-৯টি দাঁত থাকে।
বাগচাষা চিংড়ি (Penaeus hiergensis): ঈষৎ লবণাক্ত পানি ও লোনা পানিতে বাগাচামা চিংড়ি বাস করে। সমুদ্রের ১০-৪৫ মিটার পানির গভীরে এদের পাওয়া যায়। বৃহত্তর খুলনা ও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের নিম্ন মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরে বাঘাচামা চিংড়ি পাওয়া যায়। দক্ষিণ চীন সাগর, মালয় আর্কিপেলাগো, অস্ট্রেলিয়া, এরাবিয়ান গালফ, পাকিস্তান ও ভারত এদের বিচরণ ক্ষেত্র। এই চিংড়ির গায়ের রং সাদাটে। রোস্ট্রাম শৃঙ্গ ক্রিকোণাকৃতির। রোস্টমের উপরিভাগে ৬-৭টি এবং নিচের দিকে ২-৪টি দাঁত থাকে।
গলদা চিংড়ি (Macrobrachium rasenbergia): বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বিশেষ করে কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চাঁনপুর, চট্টগ্রামের হালদা নদী ও ভোলা জেলায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ভারতের দক্ষিণ- পশ্চিম সমুদ্র উপকূল, পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় অঞ্চল, উড়িষ্যা ও অন্ধ প্রদেশ, পূর্ব আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, শ্রীলংকা ও মায়ানমারে এই চিংড়ি পাওয়া যায়। এছাড়াও পশ্চিম গোলার্ধের ইন্দো তেলটা এলাকায় এদের পাওয়া যায়।
গলদা চিংড়ি দেখতে সাধারণত হালকা নীল কিংবা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। উদর খোলসের সংযোগস্থলে নীল বন্ধনী থাকে। এই চিংড়ির ক্যারাপেসের খোলসে ২-৫টি কালচে আড়াআড়ি লম্বা দাগ দেখা যায়। রোস্ট্রাম পদ্মা ও বাঁকানো। রোস্টাসের উপরিভাগে ১১-১৪টি এবং নিচের অংশে ৮-১৪টি খাঁজ বা দাঁত থাকে। অন্যান্য চিংড়ির তুলনায় গলদা চিংড়ির শিরোক্ষ (cephalothromax) অংশ বেশ বড়। এই চিংড়ির দ্বিতীয় চলনপদ তুলনামূলকভাবে বড় এবং নীল ও কিছুটা কালচে রঙের হয়ে থাকে। গলদা চিংড়ির উদরের দ্বিতীয় গ্লিউরা প্রথম ও তৃতীয় প্রিউরাকে আংশিকভাবে আবৃত করে রাখে। ব্রাঙ্কিওস্টিলে কাঁটা নেই, তবে যকৃত কাঁটা আছে।
চিত্র ১.৯: গলদা চিংড়ি
ছটকা চিংড়ি (Macrobrachium malcolmsonii): বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বিশেষ করে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুর, ফরিদপুর, ফেনী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চট্টগ্রামে এই চিংড়ি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ও বোর্ণিওতে এই ছটকা চিংড়ি পাওয়া যায়। এই চিংড়ির পৃষ্ঠদেশ ও তলদেশ হালকা নীল কিংবা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। দেহে বাদামি কিংবা কমলা বর্ণের ফ্যাকাশে হালকা টান টান দাগ থাকে। রোস্টামের পোড়া উত্তল এবং রোস্টামের উপরিভাগে ৯-১৪টি ও নিচের দিকে ৫-৯টি দাঁত থাকে। দ্বিতীয় চলন পদের কারপাস চিলার চেয়ে ছোট।
চিত্র- ১.১০: ছটকা চিংড়ি
ডিসুয়া চিংড়ি (Macrobrachium villosimana): বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বিশেষ করে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রাম জেলার হালদা নদীতে এদের বিচরণ এলাকা। এছাড়া ভারত ও বার্মায় এদের পাওয়া যায়। এদের পারের রং স্বচ্ছ এবং ফ্লাজেলার অগ্রভাগ বাদামি লালচে রঙের। বাঁকানো ও সুদৃঢ় রোহামের উপরিভাগে ১২-১৩টি এবং নিচের দিকে ৮-৯টি দাঁত থাকে।
শুল চিংড়ি (Macrobrachiurn birmanicum): বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র কমবেশি এই চিংড়ি পাওয়া যায়। তবে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিগ্রা ও সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে শুল চিংড়ি পাওয়া যায়। মিঠাপানির এই চিংড়ির পায়ের রং হলদে সবুজ, বক্ষ হালকা নীলাত রঙের এবং সক্ষরণ পদ নীলাভ রঙের হয়ে থাকে। ছোট ও উত্তল রোস্টানের উপরিভাগে ৮-১৪টি এবং নিচের অংশে ৪-৬টি দাঁত থাকে।
গোদা চিংড়ি (Macrobrachium rude): বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামের হালদা নদীতে পাওয়া যায়। ভারত, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার ও শ্রীলংকাও এদের বিচরণ এলাকা।
চিত্র- ১.১১: গোদা চিংড়ি চিত্র- ১.১২: চিকনা চিংড়ি
চিকনা চিংড়ি (Macrobrachium idella): বাংলাদেশের সর্বত্রই বিদ্যমান। পূর্ব আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, মালয় আর্কিপেলাগো, ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মোহনা ও নদীতে বিশেষ করে পূর্ব সমুদ্র উপকূল এদের বিচরণ ক্ষেত্র।
লটিকা চিংড়ি (Macrobrachium mirabile) : বাংলাদেশের মেঘনা নদী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও খুলনা অঞ্চলে এই চিংড়ি বাস করে। ভারতের গাঙ্গেয় অঞ্চল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও বোর্ণিওতে পাওয়া যায়।
লালিয়া চিংড়ি (Metapenaeus spinulatus): লোনাপানির এই চিংড়ি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা, পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালি ও খেপুপাড়া মোহনা এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার উপকুলীয় অঞ্চলসহ বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায়। এই চিংড়ির রোস্ট্রাম উত্তল ও অগ্রভাগ সূঁচালো। রোস্ট্রামের উপরিভাগে ৫-৬টি দাঁত থাকে। এন্টিনাল স্পাইন হেপাটিক স্পাইনের চেয়ে ছোট আকৃতির এবং টেলসনের পার্শ্বে দুই জোড়া স্পাইন থাকে। এই চিংড়ির এন্টিনিউলার ফ্লাজেলা ক্যারাপেসের চেয়ে লম্বা হয়ে থাকে।
সারণি : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন চিংড়ির নাম
ক্রম | স্থানীয়/বাংলা নাম | বৈজ্ঞানিক নাম | ইংরেজি নাম |
০১ | গলদা চিংড়ি, বড় ইচা, গলদা ইচা | Macrobrachium rasenbergi | Fresh water giant prawn |
০২ | ছটকা চিংড়ি, ছোট গলদা, বটি গলদা | Macrobrachium malacolmsoni | Mon soon river prawn |
০৩ | ডিমুয়া চিংড়ি, কাঠালিয়া ইচা | Macrobrachium villosimanus | Dimua river prawn |
০৪ | গদ্দল চিংড়ি, ঠেঙ্গা চিংড়ি, নজরী ইচা | Macrobrachium birmanicum | Birma river prawn |
০৫ | গোদা চিংড়ি, পাইটা চিংড়ি | Macrobrachium rude | Fresh water giant prawn |
০৬ | গেদা চিংড়ি, ব্রাহ্মনী চিংড়ি | Macrobrachium dolichodactylus | Fresh water giant prawn |
০৭ | লটিয়া চিংড়ি, লইটা ইচা | Macrobrachium mirabile | Shortleg river prawn |
০৮ | কৃষ্ণ চিংড়ি, গুড়া ইভা | Macrobrachium lamarrei | Kuncho river prawn shrimp |
০৯ | বাগদা চিংড়ি, বাগদা ইচা | Penaeus monodon | Giant/Jumbo tiger prawn |
১০ | চাকা চিংড়ি, চাপনা চিংড়ি, চামা চিংড়ি, সাদা ইচা | Penaeus inducus | Indian white shrimp |
১১ | স্বাগতারা চিংড়ি, হেড়ে বাগদা | Penaeus semisulcatus | Green tiger shrimp |
১২ | ডোরোকাটা চিংড়ি, খুরমা চিংড়ি, জাপানি চিংড়ি | Penaeus japonicus | Kuruma shrimp |
১৩ | চাপদা চিংড়ি, বড় চামা চিংড়ি | Penaeus orientalis | White shrimp |
১৪ | বাগা চিংড়ি, কোৱা চিংড়ি | Penaeus merguiensis | Banana shrimp |
১৫ | লাল চামা ইচা, চামা ইচা | Penaeus penicillatus | Red tail shrimp |
১৬ | হরিণা চিংড়ি, খরখরিয়া চিংড়ি | Metapenaeus monoceros | Yellow shrimp |
১৭ | হরি চিংড়ি, সাগা চিংড়ি | Metapenaeus brevicornis | Kadal Shrimp |
১৮ | লাপিয়া চিংড়ি | Metapenaeus spinulatus | Brown shrimp |
১৯ | কেরাণী চিংড়ি | Metapenaeus affinis | Indian brown shrimp/ Pink/ Ginga shrimp |
২০ | কুচো চিংড়ি | Metapenaeus lysianassa | Bird shrimp |
সারণি: গলদা ও বাগদা চিংড়ির শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য
ক্রম | গলদা চিংড়ি | বাগদা চিংড়ি |
০১ | বহিঃকঙ্কালের দ্বিতীয় উদর খন্ডকের প্লিউরা ১ম ও ৩য় উদর মস্তকের গ্লিউরাকে আংশিক আবৃত করে। | বহিঃকঙ্কালের দ্বিতীয় উদর খন্ডকের প্রিউরা শুধুমাত্র ৩য় উপর মস্তকের প্লিউরাকে আংশিক আবৃত করে |
০২ | ১ম দুইটি বক্ষ উপাঙ্গ চিলেটে রুপান্তরিত হয় এবং ২য় চিলেট উপাঙ্গটি তুলনামুলকভাবে বড় হয়। | ১ম তিনটি বক্ষ উপাঙ্গ চিলেটে রূপান্তিরত হয়। |
০৩ | শুক্রকীট স্থানান্তরের জন্য পুংজননাঙ্গ পেটাসমা বা স্ত্রী জননাঙ্গ থেলিকাম থাকে না। | শুক্রকীট স্থানান্তরের জন্য পুংজননাঙ্গ পেটাসমা বা স্ত্রী জননাঙ্গ থেলিকাম থাকে। |
০৪ | স্ত্রী চিংড়ি ডিমগুলো পুচ্ছাকারে প্লিওপডের মাঝখানে বহন করে। | স্ত্রী চিংড়ি প্লিওপড়ে ডিম বহন করে না, বরং সরাসরি পানিতে ছাড়ে। |
০৫ | মাথা দেহের ওজনের প্রায় অর্ধেক। | মাথা দেহের ওজনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ |
০৬ | রোস্টামের নিম্নাংশে দাঁতের সংখ্যা বেশি। | রোস্ট্রামের নিম্নাংশে দাঁতের সংখ্যা তুলতামূলকভাবে কম । |
০৭ | আবাসস্থল মিঠা পানি, তবে প্রজননের সময় কিছু প্রজাতি ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে চলে আসে | আবাসস্থল সমুদ্র এবং ঈষৎ লবণাক্ত পানি। প্রজননের সময় অধিকাংশ প্রজাতি সমুদ্রের লোনা পানিতে চলে যায় এবং লার্ভা অবস্থায় উপকূলীয় পানিতে চলে আসে। |
০৮ | স্ত্রী গলদার চেয়ে পুরুষ গলদা আকারে বড় ও ওজনে বেশি হয়। | পুরুষের চেয়ে স্ত্রী বাগদা আকারে বড় হয় ও ওজনে বেশি হয়ে। |
০৯ | গলদা চিংড়ি মেরুদন্ডহীন মিঠাপানির বড় চিংড়ি। | বাগদা চিংড়ি মেরুদন্ডহীন লোনাপানির বড় চিংড়ি। |
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন- জাপান, আমেরিকা, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে চিংড়ির সিস্টেমেটিক শ্রেণিবদ্ধতার ওপর ব্যাপক কাজ হয়েছে এবং নতুন নতুন চিংড়ি প্রজাতি শনাক্তকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে চিংড়ির সিস্টেমেটিক শ্রেণিবদ্ধকরণের উপর গবেষণা শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। বাংলাদেশের মিঠাপানিতে ২৪টি ও লোনাপানিতে ৩৬টিসহ মোট ৬০টি প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া গেলেও সারা বিশ্বে ৩৫১ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায় বলে প্রাপ্ত তথ্যে প্রতীয়মান হয়। মিঠাপানির চিংড়ি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ জলাশয় যেমন- পুকুর-ডোবা, দিঘী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও নদীতে এবং লোনাপানির চিংড়ি খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার জেলায় সাগরের লোনাপানি ও উপকূলীয় অঞ্চলের ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে পাওয়া যায়।
বাগদা চিংড়ির বহিঃঅঙ্গসংস্থান গলদা চিংড়ির অনুরূপ। তবে বাগদা চিংড়ির প্রথম ৩টি এবং পলদা চিংড়ির প্রথম ২টি বড় বক্ষ উপাঙ্গ চিলেটে রুপান্তিরিত হয় এবং গলদা চিংড়ির বহিঃকঙ্কালের ২য় উদর খন্ডকের প্লিউরার মত বাগদা চিংড়ির ২য় উদর খন্ডকের প্লিউরা ১ম ও ৩য় উদর খন্ডকের প্রিউরাকে আবৃত করে না। তাছাড়া গলদা চিংড়ির তুলনায় বাগদা চিংড়ির শিরোবক্ষ অঞ্চল তুলনামূলকভাবে উদর অঞ্চলের চেয়ে ছোট।
চিংড়ির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, অভ্যন্তরীণ অঙ্গের বৈশিষ্ট্য, স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি শনাক্ত করা হয়।
চিংড়ির শ্রেণিবিন্যাস
সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রাণীকে একটি স্বাভাবিক নিয়মে কতকগুলো স্তরে সাজানোর এক নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিকে শ্রেণিবিন্যাস বলে। চিংড়ির শ্রেণিবিন্যাসের ফলে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি শনাক্তকরণ, প্রজাতি বিন্যস্তকরণ ও অন্যান্য প্রাণীর সাথে জাতিগত সম্পর্ক নিরুপণ করা যায়। চিংড়ি প্রজাতিগুলোকে সাধারণত দু'ভাবে ভাগ করা যায়, যথা- পিনাইড (penacid) ও পিনাইড বহির্ভূত (non-penacid)। এই দুই দলভুক্ত চিংড়িকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পিনাইড বহির্ভূত চিংড়ির বহিঃকঙ্কাল-এর ২য় প্লিউরা ১ম ও ৩য় প্লিউরাকে আংশিক ঢেকে রাখে। কিন্তু পিনাইড দলভুক্ত চিংড়িতে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। তাছাড়া পিনাইড চিংড়ির ১ম তিনটি বক্ষ উপাঙ্গ এবং পিনাইড বহির্ভূত চিংড়ির ১ম দুইটি বক্ষ উপাঙ্গ চিলেটে রুপান্তরিত হয়। পিনাইড পুরুষ চিংড়িতে জননাঙ্গ পেটাসমা এবং স্ত্রী চিংড়িতে জননাঙ্গ থেলিকাম বিদ্যমান থাকে। পিনাইড বহির্ভূত স্ত্রী চিংড়িগুলো গুচ্ছকার ডিমগুলো প্লিওপডদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে বহন করে থাকে কিন্তু স্ত্রী পিনাইড চিংড়ি ডিম সরাসরি পানিতে ছাড়ে।
চিংড়ি আর্থোপোডা পর্বের ক্রাস্টেসিয়া শ্রেণির ডেকাপোডা পর্বের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। এই বর্গের কিছু চিংড়ি মিঠাপানিতে এবং কিছু চিংড়ি লোনা পানিতে বাস করে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চিংড়িকে সাধারণ পিনাইটি, পেলিমনিডি, প্যানডেলিডি, হিপোলিটিডি, এলফিডি ও সারপেটিডি এই ৬টি গোত্রে ভাগ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাগদা ও গলদা চিংড়ির শ্রেণিবিন্যাস হলো:
পর্ব (Phylum) : আর্থোপোডা (Arthropoda)
শ্রেণি (Class) : ফ্রাস্টেসিয়া (Crustacea)
বর্গ (Order) :
১. পিনাইডি (Penaeidae)
২. পেলিমনিডি (Palaemonidae)
গণ (Genus)
১. পিনিয়াস (Penaeus)
২. ম্যাক্রোগ্রাকিয়াম (Macrobrachium)
প্রজাতি (Species)
১. বাগদা (Penaeus monodon)
২. গলদা (Macrobrachium rosenbergii)
বাগদা চিংড়ির বাহ্যিক গঠন
এদের দেহ, দ্বিপার্শ্বীয়, লম্বাকৃতি, প্রভিসন ও বঞ্চিত। দেহ মস্তক ও উদরে বিভক্ত। চিংড়ির মাথাকে দেহ থেকে আলাদা করা হয় না বলে মাথা ও বুককে একসঙ্গে বলা হয় শিরোবক বা সেফালোথোরাঙ্গ (cephalothorax)। উদর (abdomen) ক্রমান্বয়ে পিছনের দিকে শুরু হয়ে লেজ (telson) এর সাথে মিশেছে।
চিত্র-১.১৩ : বাগদা চিংড়ির বাহ্যিক অঙ্গসমূহ
শিরোক্ষে ১৩টি ও উদরে ৬টি উপাঙ্গ আছে। চিংড়ির দেহ কাইটিন নামক খোলস দিয়ে আবৃত, যা ক্যালসিয়াম উপাদান দিয়ে গঠিত। মস্তকের সম্মুখভাগে করাতের ন্যায় কাইটিন আবরণকে রোম্মাম (rostrum) বলে।
চিংড়ির খোলস দেহের প্রতিটি অংশকে ঘিরে রাখে এবং একটি খোলস অপর খোলসের সাথে সন্ধিল পর্দা (arthrodial membrane) দিয়ে সংযোগ রক্ষা করে, যার ফলে খোসাগুলো সহজে নড়াচড়া এবং প্রয়োজনে লম্বা হয়ে যেতে পারে। বাগদা চিংড়ির বাহ্যিক অঙ্গসমূহ হলো- ১. রোস্টাম, ২. রাস্ট্রোল কাটা, ৩. পোষ্ট অর্বিটাল কাটা, ৪. হেপাটিক কাটা, ৫. কেরাপাস, ৬. প্রথম উদর উপাঙ্গ, ৭. ষষ্ঠ উদর উপাঙ্গ, ৮. টেলসন, ১. ইউরোপড, ১০. গ্লিওপড, ১১. পঞ্চম পেরিও পড়, ১২. প্রথম পেরিওপড, ১৩. এন্টেনা, ১৪. এ্যান্টেনাল কাঁটা ১৫. এন্টেনাল ব্লেড ও ১৬ এ্যান্টেনাল ফ্লাজেলা।
বাগদা চিংড়ির অভ্যন্তরীণ গঠন ও অঙ্গসমূহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও অম্লতন্ত্রের কার্যকারিতার ফলে বাগদা চিংড়ি জীবনধারণ করে থাকে। বাগদা চিংড়ির অভ্যন্তরীণ অঙ্গসংস্থান প্রধানত পরিপাকতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সংবহনতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র নিয়ে গঠিত।
চিত্র-১.১৪: বাগদা চিংড়ির অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ
ক. পরিপাকতন্ত্র
বাগদা চিংড়ি সর্বভুক্ত ও নিশাচর প্রাণী। এরা সাধারণত রাতের বেলায় খাদ্য গ্রহণ করে। দিনের বেলার কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ৰাগদা চিংড়ি চিমটাযুক্ত পা দিয়ে খাদ্যকণা মুখের ভিতরে নিক্ষেপ করে। অতঃপর খাদ্যকণা ম্যাক্সিলিপেডের দিকে অগ্রসর হয় এবং মুখের অভ্যন্তরের বিভিন্ন উপাম্পের সাহায্যে খাদ্যকণা আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাতে পরিণত হয়ে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। বাগদা চিংড়ির পরিপাকতন্ত্র মূলত পরিপাকনালি ও হেপাটোপ্যানক্রিয়াস গ্রন্থি সমন্বয়ে গঠিত। পরিপাকনালি মুর্খগহবর থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত। অগ্র পরিপাকনালি ও পশ্চাৎ পরিপাকনালি থেকে সহজেই মধ্য পরিপাকনালিকে আলাদা করা যায়। কারণ অগ্র ও পশ্চাৎ পরিপাকনালিতে কাইটিনের সারি বিদ্যমান কিন্তু মধ্য পরিপাকনালিতে এ ধরনের কোন কাইটিন সারি থাকে না।
চিত্র-১.১৫: বাগদা চিংড়ির পরিপাকতন্ত্র
খ. রেচন
অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রে রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে প্রধানত দু'টি কাজ সম্পাদন হয়ে থাকে। প্রথমত রেচনতন্ত্র বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বর্জ্য পদার্থ বা দুষিত পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশন করে থাকে এবং দ্বিতীয়ত দেহ অভ্যন্তরস্থ লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। চিংড়ির ক্ষেত্রে প্রধান নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ হচ্ছে অ্যামোনিয়া। প্রসাব হিসেবে এই অ্যামোনিয়া ম্যাক্সিলারি গ্রন্থির মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত হয়। এই গ্রন্থিটি ম্যাক্সিলার পোড়ায় অবস্থিত। বাগদা চিংড়ির এই অর্শটি তেমন একটা উন্নত নয় এবং কিছু কিছু অ্যামোনিয়া বা নাইট্রোজেনঘটিত দুষিত পদার্থ ফুলকার সাহায্যে নির্গত হয়। বাগদা চিংড়ির ক্ষেত্রে ম্যাক্সিলারি গ্রন্থি অসমোরেগুলেশন প্রক্রিয়ায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। ফ্রাস্টেসিয়ার অন্তর্গত অধিকাংশ প্রাণী যে বর্জ্য পদার্থ উৎপাদন করে থাকে তার ঘনত্ব ও রক্তের ঘনত্ব একই থাকে। তথাপি এই গ্রন্থি পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম সংরক্ষণে সম্পৃক্ত থাকে এবং অতিরিক্ত ম্যাগনেসিয়াম সালফেট নির্গমনে সহায়তা করে। সাধারণত চিংড়ির ক্ষেত্রে লবণের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ফুলকাই এর প্রধান অঙ্গ। যে সকল প্রাণীর রক্তের লবণের ঘনত্ব এবং এদের চতুর্পার্শ্বের পানির লবণের ঘনত্ব বিভিন্ন রকম তাদেরকে অসমোরেগুলেটর বলা হয় এবং যাদের ঘনত্ব একই রকম তাদেরকে অসমোকনফরমারস বলে।
গ. শ্বসনতন্ত্র
চিংড়ির শ্বসনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে ফুলকা। এই ফুলকার সাহায্যে চিংড়ি অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে থাকে। পেরিওপডের কক্সা থেকে থলের ন্যায় এই ফুলকার উৎপত্তি হয় অর্থাৎ এপিপোডাইটের উন্নত অবস্থাই ফুলকা হিসেবে পরিচিত। বক্ষের উভয় পার্শ্বের ব্রাঙ্কিওল প্রকোষ্ঠের সাথে ফুলকা সংযুক্ত থাকে। ব্রাঙ্কিওল প্রকোষ্ঠে পানি প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ আছে কিন্তু মূলত স্ক্যাফোগন্যাথাইটের সাহায্যে এই কাজ সম্পাদিত হয়ে থাকে। ম্যাক্সিলার এক্সোপোডকেই স্ক্যাফোগনাইট বলা হয়। এই স্ক্যাফোগনাইট পানিকে প্রকোষ্ঠে প্রবাহিত করে থাকে। চিংড়ির রক্তের শ্বাস রঞ্জককে হেমোসায়ানিন বলে। চিংড়ির রক্ত সাদা বা বর্ণহীন হয়ে থাকে। তবে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত দেখতে কিছুটা নীলাভ।
ঘ. স্নায়ুতন্ত্র
চিংড়ির স্নায়ুতন্ত্র যথেষ্ট উন্নত। বিভিন্ন স্নায়ু অঙ্গ এবং উপাঙ্গের সাথে সেরিব্রাল গ্যাংলিয়ন সংযুক্ত থাকে। চক্ষু স্ট্যাটোসিস্টস, প্রোপ্রাওরিসিপ্টরস, ট্যাক্টাইল রিসিপ্টর এবং কেমোরিসিপ্টরস চিংড়ির স্নায়ু অঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে। চিংড়ির কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে সুপ্রা ইসোফেজিয়াল গ্যাংলিয়ন বা মস্তিষ্ক বলে। অগ্রবর্তী মন্তক উপাঙ্গের গোড়ার পশ্চাৎ দিকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র অবস্থিত। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র তিনটি অংশে বিভক্ত, যথা- ১. অগ্রবর্তী প্রোটোসেরিব্রাম, ২. মধ্য ডিউটোসেরিব্রাম এবং ৩. পশ্চাৎবর্তী ট্রাইটোসেরিব্রাম।
ঙ. রক্ত সংবহনতন্ত্র
চিংড়ির হৎপিন্ড দেখতে অনেকটা সাধারণ নালির মত। হৃৎপিন্ডটি চিংড়ির বুকের পৃষ্ঠদেশীয় অঞ্চল বরাবর পরিপাকনালির উপরে এবং পেরিকার্ডিয়াল সাইনাসের সাথে সংযুক্ত থাকে। চিংড়ির রক্ত সংবহণ প্রণালির প্রধান অঙ্গ অগ্রবর্তী এওটা হৃৎপিন্ড থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত। চিংড়িতে কোনো শিরা থাকে না। অনেকগুলো সাইনাসের মধ্য দিয়ে রক্ত হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে। ধমনি ও সাইনাসের ভাষ রক্তকে পিছনের দিকে প্রবাহিত হতে বাধা দেয়। চিংড়ির রক্তে দু'ধরনের কোষ থাকে, যথা- ছোট হাইয়ালিন এবং বড় দানাদার এ্যাসিৰোষাইটিস। সপ্তক বক্ষ অঞ্চলের স্টীয়েটেড পেশী এবং অক্ষীয় স্নায়ু কর্ডের মধ্যবর্তী অংশে সাইনাস অবস্থিত। প্রতিটি দেহ শক্ষকের সাথে প্রত্যেকটি ব্যাংলিয়নকে সংযুক্ত দেখা যায়।
চ. প্রজননতন্ত্র
সাধারণত একই বয়সের পুরুষ চিংড়ি, স্ত্রী চিংড়ি অপেক্ষা আকারে ছোট হয়। বাগদা চিংড়ি সাধারণভাবে ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যে পরিপক্বতা লাভ করে। এ সময় প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গসমূহ খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়।
চিত্র-১-১৬: সমবয়সী পুরুৰ চিংড়ি (উপর) ও স্ত্রী চিংড়ি (নিচ)
পুংপ্রজননতন্ত্র
পুরুষ চিংড়ির প্রথম ঘোড়া সন্তরণ পদে একজোড়া পেটাসমা এবং পঞ্চম জোড়া চলন পদের গোড়ায় এক জোড়া গুং জননেন্দ্রিয়ের ছিদ্র থাকে। চিংড়ির দ্বিতীয় পর্যায়ের বা গৌণ যৌনাঙ্গ সঙ্গমে সহায়তা করে। দ্বিতীয় সন্তরণ পদে এপেনডিক্স ম্যাসকুলিনা থাকে। পেটাসমা ও এপেনডিক্স ম্যাসকুলিনা স্পার্মাটোফোর বা বীর্য স্থানান্তরে সহায়তা করে থাকে। চিংড়ির পুং জননতন্ত্র এক জোড়া টেসটিস, ভাস ডিফারেন্সিয়া এবং এক জোড়া প্রান্তিক বীর্য থলে দ্বারা গঠিত। বীর্য হুলে পুং জননেন্দ্রিয়ের ছিদ্র পথে বের হয়ে আসে। পেটাসমা স্ত্রী চিংড়ির মেলিকামে বীর্য স্থানান্তরের কাজ করে থাকে।
স্ত্রী প্রজননতন্ত্র
স্ত্রী চিংড়ির জননেন্দ্রিয় একজোড়া ডিম্বাশয় ও ডিম্বনাদি দ্বারা গঠিত। পরিপক্ক চিংড়ির ডিম্বাশয় লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ডিম্বনালী তৃতীয় জোড়া চলন পদের পোড়ায় উন্মুক্ত হয়। স্ত্রী চিংড়ির ৪র্থ ও ৫ম জোড়া চলন পদের মধ্যবর্তী স্থানে থেলিকাম ও ৩য় জোড়া চলন পদের গোড়ায় এক জোড়া স্ত্রী জননেন্দ্রিয়ের ছিদ্র থাকে। গ্রী চিংড়ি সঙ্গমকালে পুরুষ চিংড়ির বীর্য নির্গত হলে বেলিকানের মধ্যে ধারণ করে রাখে এবং ডিম ছাড়ার সময় পানিতে এ বীর্য ছেড়ে দেয়। স্ত্রী চিংড়ির বেলিকামের রত্ন বা ছিদ্র সাধারণ অবস্থার বন্ধ থাকে। তবে খোলস বদলানোর পর খোসা শক্ত হওয়ার মুহুর্ত পর্যন্ত এ ছিদ্র খোলা থাকে। তাই স্ত্রী চিংড়ি খোলস বদলানোর পর পরই পুরুষ চিংড়ির সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। পুরুষ চিংড়ি বন্ধ জলাশয়ে পরিপক্বতা লাভ করে কিন্তু স্ত্রী চিংড়ি বন্ধ জলাশয়ে পরিপক্বতা লাভ করে না।
স্ত্রী চিংড়ির চোখের বোটায় এক্স অঙ্গ ও সাইনাস গ্রন্থি থাকে। এক্স অঙ্গ ডিম্বাশয় পরিণলতা লাভ রোধের হরমোন উৎপাদন করে এবং সাইনাস গ্রন্থি তা মজুদ রাখে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এই হরমোন উৎপাদিত হলেও পরিবেশগত কারণেই উৎপাদিত হরমোনের পরিমাণ কমে যায় এবং স্ত্রী চিংড়ি পরিপক্বতা লাভ করে। কিন্তু বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদিত হরমোন চিংড়ি শরীরেই থেকে যায়, ফলে ডিম্বাশয় পরিপক্বতা লাভ করে না। তাই হ্যাচারিতে স্ত্রী চিংড়ির ডান অথবা বাম চোখের বোটা কেটে বা অন্য কোন পদ্ধতিতে উক্ত চোখের বোটার কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিলে হরমোন উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। এবং ডিম্বোশয় পরিপক্বতা লাভ করে। স্ত্রী চিংড়ির চোখের বোটার কার্যক্ষমতা নষ্ট করার পদ্ধতিকে eye stalk ablation বলে।
গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের আধা বা ঈষৎ লবণাক্ত জলাশয় পর্যন্ত বাগদা চিংড়ি জীবনচক্র বিস্তৃত। বাগদা চিংড়ির জীবনের কিছু পর্যায়ে গভীর সমুদ্রে এবং কিছু পর্যায় মোহনা অঞ্চলের নদীসমূহে সমাপ্ত হয়। বাগদা চিংড়ির জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো: ভিন (egg), গ্রুপ (embryo), লাভা (larvae) (নরিয়াস লার্ভা, জুইয়া লার্ভা ও মাইসিস লার্ভা), পোস্ট লার্তা বা পিএল (post larvae- PL), জুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি ((juvenile) এবং পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি (adult)।
ক. ডিম
প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে পূর্ণ বয়স্ক বাগদা চিংড়ি অভিগমন করে গভীর সমুদ্রের পরিপূর্ণ লবণাক্ত পানিতে (ন্যূনপক্ষে ৩০পিপিটি) চলে আসে এবং এখানে ডিম ছাড়ে। প্রাকৃতিক পরিবেশে স্ত্রী বাগদা চিংড়ি সাগরের ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় ডিম পাড়ে। ডিমগুলো আকারে খুব ছোট এবং এদের বর্ণ সবুজ হলুদাভ বা স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে। ডিম পাড়ার সময়েই শুক্রকীট দ্বারা ডিমগুলো নিষিক্ত হয় এবং এই নিষিক্তকরণ চিংড়ির দেহের বাইরে ঘটে থাকে। ডিম ফোটার ঠিক আগে পরিণত নপ্রিয়াসকে ডিমের মধ্যে নড়াচড়া করতে দেখা যায়। ডিমের ভ্রুণ বিভাজন শুরু হয়। প্রথমে ২ কোষ, পরে ৪ কোষ, মরুলা এবং শেষে নপ্রিয়াস ধাপে পৌঁছায়। ডিম ছাড়ার আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিমের মধ্যে ভ্রূণ দেখা যায়। ২ কোষ, ৪ কোষ, মরুলা এবং শেষে নগ্নিয়াস ধাপে আসতে সময় লাগে যথাক্রমে ০.৫, ১০, ১.৮ ও ১১.০ ঘন্টা। একটি স্ত্রী-চিংড়ি একবারে ২ থেকে ৮ লক্ষ (ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ১ থেকে ১২ লক্ষ) পর্যন্ত ডিম ছাড়তে পারে। নিষিক্ত ডিম সমুদ্রের পানি অপেক্ষা সামান্য ভারী বিধায় পানিতে ডুবে যায়।
খ. লার্ভা
লার্ভা অবস্থার প্রথম দশাকে নগ্নিয়াস বলে। এই নগ্নিয়াস দশার ৬টি অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে। নপ্রিয়াসের পরের দশাকে প্রটোজুইয়া বলে। এই দশার অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৫ দিন সময় লাগে। প্রটোজুইয়ার পরের দশাকে মাইসিস বলে। এই দশার ৩টি অন্তর্দশা সম্পূর্ণ হতে ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগে। মাইসিস-এর পরবর্তী দশাকে মেগালোপা বলে। মেগালোপা পর্যায়ে দেহ স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে এবং শুঙ্গের গোড়া থেকে টেলসনের প্রাপ্ত পর্যন্ত একটি পাড় বাদামী লম্বা টানা রেখার মত দাগ থাকে।
চিত্র-১.২২: জুইয়ার বিভিন্ন দশা (১, ২ ও ৩)
চিত্র-১.২৩: মাইসিস-এর বিভিন্ন দশা (১২৩৩)
প. পোস্ট লার্ভা (পিএল)
এই ধাপের প্রথম পর্যায়ে দেহ স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে এবং অক্ষীয় দেশে মেগালোপা ধাপের মত পাঢ় বাদামী দাগ থাকে। এই পর্যায়ের মাপকে প্রাথমিক পর্যায়ে পোস্ট লার্ভা (পিএল) বলে এবং শেষ পর্যায়ের ধাপকে আপীলোনা বলা হয় । উদর খন্ড নিরোধক খন্ডের চেয়ে ছোট হয়। এই সময় দেহ, রোস্ট্রীমের দাঁত ফুলকার আবির্ভাব ঘটে। শিরোবক্ষের খোলস ২.৭ মিনি লম্বা হলে এদের দেহ কালো বর্ণ ধারণ করে এবং খোলস ২.২-২১.০ মিমি লম্বা হলে রোম্মামের উপরিভাগে ৭টি এবং নিচে ৩টি দাঁত থাকে। এই পর্যায়ে চিংড়ি হামাগুড়ি ও সাঁতার দিতে শুরু করে।
ঘ. মুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি
এই পর্যায়ে চিংড়ির দেহের আকৃতি প্রায় পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির মতো কিংবা কিছুটা বড় হয়। শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ১১ সিসি হলে এদের জননেন্দ্রিয় শনাক্ত করা যায়। কিশোর চিংড়ির শিরোৰক্ষের দৈর্ঘ্য ১১ থেকে ৩৪ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুরুষ চিংড়ির শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ৩০ মিমি হলে এরা পুরুষ জননাঙ্গ যুক্ত পেটাসমা ধারণ করে এবং স্ত্রী চিংড়ির শিরোৰক্ষের দৈর্ঘ্য ৩৭ মিনি হলে স্ত্রী জননাঙ্গে খেলিকাম দেখা যায়।
চিত্র-১.২৫: জুভেনাইল বা কিশোর চিংড়ি
৫. ভরুপ চিংড়ি
চিংড়ি এই পর্যায়ে পরিপক্কতা লাভ করে। শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য ৩০ মিমি হলে পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়ির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে এবং এই পর্যায়ে স্ত্রী চিংড়ির আকার পুরুষ চিংড়ির চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এই সময় তরুণ চিংড়ি মোহনা থেকে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পুরুষ চিংড়ি ও স্ত্রী চিংড়ির শিরোবক্ষের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩৭ মিমি ও ৪৭ মিমি এ পৌঁছালে এরা প্রথম যৌন মিলনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এই • মিলনক্রিয়া সাধারণত সমুদ্রে যাওয়ার পূর্বে মোহনা অঞ্চলে সংঘটিত হয়ে থাকে।
চ. পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি
এই পর্যায়ে চিংড়ি যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। স্ত্রী চিংড়ি ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্রে চলে যায়। সমুদ্রের ১৬০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এদের বিচরণক্ষেত্র। পরিপক্ক পুরুষ চিংড়ি পঞ্চম চলন পদের গোড়ায় পুংজনন ছিদ্রে শুক্রকীটের মোড়ক (spermatophores) দেখা যায়। পরিপক্ক শ্রী চিংড়ির ডিম্বকোষের উন্নতি বাইরে থেকে দেখা যায়। স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়ের আকার ও রং এবং ডিম্বাণুর মাপের ওপর নির্ভর করে ডিম্বাশয়ের পূর্ণতা।
চিত্র-১.২৬: পূর্ণাঙ্গ বাগদা চিংড়ি
পরিপত্র স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়কে ৫টি দশার ভাগ করা যায়, যথা-
প্রথম দশা (Immature stage): এই অবস্থায় ডিম্বাশয় খুব পাতলা ও স্বচ্ছ এবং পিঠের খোলসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় না। এই সময় ডিম্বাণু খুব ছোট থাকে এবং ফলিকল সেল (follicle cell) এর ঘরে ঢাকা থাকে।
দ্বিতীয় দশা (earty developing stage): এই অবস্থায় ডিম্বাশয়ের কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ডিম্বাশয় ঢলঢলে এবং সাদা থেকে ফিকে জলপাই রঙের একটি লম্বা ফিতার মতো পৃষ্ঠদেশে খোলসের নিচে দেখা যায়।
তৃতীয় দশা (nearly ripe stage): বর্ধিত ও হালকা নীল বর্ণের ডিম্বাশয় সহজেই দেখা যায়। এ সময় উদর অঞ্চলের ১ম ভাগে ডিম্বাশয়ের দুই পার্শ্ব একটু বেড়ে কিছুটা ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে।
চতুর্থ দশা (ripe stage): গাঢ় সবুজ জলপাই রঙের পরিপক্ক ডিম্বাশয় পরিষ্কার দেখা যায়। এ সময় উদর অঞ্চলের ১ম ডিম্বাশয় পরিপূর্ণ ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে।
পঞ্চম দশা (spent stage): এই অবস্থায় ডিম ছাড়ার পর ডিম্বাশয় প্রায় প্রথম দশার মতো দেখায়। তবে আংশিক ডিম ছাড়লে দ্বিতীয় দশার মতো দেখায়। একটি পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ি বছরে প্রায় ৩.০-৭.৫ লক্ষ ডিম ধারণ করে থাকে। বাগদা চিংড়ির প্রজনন গভীর সমুদ্রে ঘটে থাকে। এদের প্রজনন ক্রিয়া সাধারণত রাতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাগদা চিংড়ির মিলন কাল ৩ থেকে ৪ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রথমে পুরুষ চিংড়ির উপর সমান্তরালভাবে স্ত্রী চিংড়ি অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়ি একে অপরকে অঙ্কীয় দেশে আকড়িয়ে ধরে এবং পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ির দেহের নিচে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। অবশেষে পুরুষ চিংড়ি দেহের উদরের অংশ বাঁকিয়ে স্ত্রী দেহের মাঝখানে U আকৃতির বেষ্টনি তৈরি করে।
বাগদা চিংড়ির জীবন চক্রের বিভিন্ন ধাপসমূহ নিচের সারণিতে দেখানো হলো:
সারণি: বাগদা চিংড়ির জীবন চক্রের বিভিন্ন ধাপের বৈশিষ্ট্যসমূহ।
পর্যায় | শুরু হয় | সময়কাল | শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য (মিমি) পুরুষ | শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য (মিমি) স্ত্রী | খাদ্যাভাস | আবাসস্থল |
ডিম (সুণ) | নিষিক্তকরণ | ১২ ঘন্টা | - |
| / | সাগরের তলদেশ |
লার্ভা | ডিম থেকে ফোটা | ২০ দিন | - | ০.৫-২.২ | প্রাকটনিক | সাগরের |
জুভেনাইল | ফুলকা অঙ্গের পূর্ণাঙ্গতা | ১৫ দিন | - | ২.২.১১ | বেনাধিক | মোহনা |
কিশোর চিংড়ি | জননেন্দ্রিয়ের উপস্থিতি | ৪ মাস | ১১.`৩ | ১১-৩৭ | বেনাধিক | মোহনা |
তরুণ চিংড়ি | জননেন্দ্রিয়ের পূর্ণতা এবং প্রথম সঙ্গম | ৪ মাস | ৩০.৩৭ | ৩৭-৪৮ | বেনাধিক | অভ্যন্তরীণ ও বাইরের লিটোরাল এলাকা |
পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি | দেহের সব অঙ্গের উপস্থিতি ও পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি | ১০ মাস | ৩৭.৭১ | ৪৭-৮১ | বেনাধিক | অভ্যন্তরীণ ও বাইরের লিটোরাল এলাকা |
সারণি: বাগদা চিংড়ির জীবদ্দশায় বিভিন্ন ধাপের খাদ্যভ্যাস
ক্রম | ধাপ | খাদ্য |
০১ | ডিম থেকে নগ্নিয়াস পর্যন্ত ৬টি ধাপ | দেহে সঞ্চিত কুসুম থলি থেকে খাদ্য যোগায়। |
০২ | জুইয়া | ডায়াটম জাতীয় উদ্ভিদ কণা, স্কেকেলেটোনমা, নিটসিয়া, কিঠোরোস ইত্যাদি খাদ্য । |
০৩ | মাইসিস | রটিফার, কপিপড, আর্টিমিয়া ও উদ্ভিদ কণা জাতীয় খাদ্য। |
০৪ | পোস্ট লার্ভা | রটিফার, কপিপড, আটিমিয়া ও উদ্ভিদ কণা জাতীয় খাদ্য। |
০৫ | পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি | ছত্রাক ও শৈবাল, গলিত জৈব পদার্থ, ছোট ছোট কুচো চিংড়ি, মশার লার্ভা, শামুকের ডিম, ক্রাস্টেসিয়ানস ইত্যাদি খাদ্য। |
সারণি: পুরুষ ও স্ত্রী বাগদা চিংড়ির মধ্যে শনাক্তকরণ বৈশিষ্টসমূহ
ক্রম | পুরুষ বাগদা | স্ত্রী বাগদা |
০১ | পুরুষ বাগদায় পেটাসমা নামক জননেন্দ্রিয় বিদ্যামান । | স্ত্রী বাগদায় থেলিকাম নামক জননেন্দ্রিয় বিদ্যমান । |
০২ | প্রথম জোড়া সন্তরণ পদের মধ্যবর্তী স্থানে পেটাসমা অবস্থিত | চতুর্থ ও পঞ্চম জোড়া সন্তরণ পদের মধ্যবর্তী স্থানে থেলিকাম অবস্থিত। |
০৩ | পুরুষ বাগদার শেষ দুই জোড়া চলন পদ বড় এবং ডেকটাইলাম সুচালো। | স্ত্রী বাগদার শেষ দুই জোড়া চলন পদ ছোট এবং ডেকটাইলাম সুচালো নয়। |
বাগদা চিংড়ি চাষ এলাকার যেকোন একটি বাগদা চিংড়ির খামার পরিদর্শন কর। খামার ভালোভাবে পরিদর্শন শেষে নিম্নোক্ত ছক পুরণ কর-
পরিদর্শনকৃত এলাকার নাম | |
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি খামারের নাম | |
জলাশয়ের মালিকানা | |
খামারের অবস্থান বা ঠিকানা | |
জলাশয়ের ভৌত অবস্থা | ১. ২. ৩. |
চাষকৃত প্রজাতির নাম | ১. ২. ৩. |
খামারে কর্মরত জনবলের সংখ্যা | |
খামারে কর্মরত কর্মীগণ কর্তৃক কাজের সময় ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামগুলোর নাম | ১. ২. ৩. ৪. ৫. |
পরিদর্শনকৃত খামারটির সার্বিক উন্নয়নে ৫টি পরামর্শ প্রদান কর। | ১. ২. ৩. ৪. ৫. |
নাম | |
শ্রেণি | |
রোল নং | |
প্রতিষ্ঠানের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ: | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১ টি |
০২ | হ্যান্ড গ্রোভস্ | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১ টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (টুলস, ইকুইপমেন্টস, মেশিন)
ক্রম | যন্ত্রপাতির নাম | স্পেসিফিকেশন | পরিমাণ |
০১ | প্লাস্টিকের গামলা | ১৫ লিটার | ১ টি |
০২ | প্লাস্টিকের বালতি | ১৫ লিটার | ১ টি |
০৩ | পাতিল | ১০ লিটার | ১ টি |
০৪ | স্থপনেট | ছোট মাপের | ১ টি |
০৫ | ট্রে | ছোট মাপের | ১ টি |
০৬ | চিমটা | মাঝারি মাপের | ১ টি |
০৭ | আঁতশ কাঁচ | ৫ সেমি | ১ টি |
০৮ | মিটার স্কেল | ০.৫ মিটার | ১ টি |
(গ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
১ | বিভিন্ন চিংড়ি | প্রমান সাইজের | প্রতি প্রজাতির ৫টি |
২ | গামছা/তোয়ালে | মাঝারি মাপের | ১ |
৩ | টিস্যু পেপার | মাঝারি মাপের | ১ |
৪ | খাতা, পেন্সিল | মাঝারি মাপের | ১ |
(ঘ) কাজের ধারা
১. নিকটস্থ বাজার/খামার থেকে প্রতিটির ৪-৫টি করে তাজা বা সদ্য আহরিত চিংড়ি সংগ্রহ কর । ২. পাতিল বা ব্যাগে যথাযথ সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে চিংড়ি পরিবহণ নিশ্চিত করো।
৩. আহরিত চিংড়ি যথাযথ স্থান বা রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করো।
৪. চিংড়ি চিহ্নিতকরণের জন্য নির্ভরযোগ্য ক্যাটালগ ব্যবহার করো।
৫. পুরো কার্যক্রমটি ধৈর্য্য সহকারে করো। ৬. গৃহীত কার্যক্রমটি ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করো।
কাজের সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
চিংড়ি শনাক্তকরণ কৌশল অনুশীলন করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১ টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস্ | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১ টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (টুলস, ইকুইপমেন্ট, মেশিন)
ক্রম | যন্ত্রপাতির নাম | স্পেসিফিকেশন | পরিমাণ |
০১ | প্লাস্টিকের গামলা | ১৫ লিটার | ১ টি |
০২ | প্লাস্টিকের বালতি | ১৫ লিটার | ১ টি |
০৩ | পাতিল | ১০ লিটার | ১ টি |
০৪ | স্কুপনেট | ছোট মাপের | ১ টি |
০৫ | ট্রে | ছোট মাপের | ১ টি |
০৬ | চিমটা | মাঝারি মাপের | ১ টি |
০৭ | আতশ কাঁচ | ৫ সেমি | ১ টি |
০৮ | মিটার স্কেল | ০.৫ মিটার | ১ টি |
(গ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
০১ | বাগদা চিংড়ি | প্রমান সাইজের | ৮-১০টি |
০২ | গামছা/তোয়ালে | মাঝারি মাপের | ১টি |
০৩ | টিস্যু পেপার | কিচেন টিস্যু প্যাকেট | ১ টি |
০৪ | খাতা, পেন্সিল | পরিমাণ মতো | ১ টি করে |
(ঘ) কাজের ধারা
১. নিকটস্থ বাজার/খামার থেকে ৮-১০টি করে তাজা বা সদ্য আহরিত বাগদা চিংড়ি সংগ্রহ করো।
২. পাতিল বা ব্যাগে যথাযথ সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে চিংড়ি পরিবহণ নিশ্চিত করো।
৩. বাগদা চিংড়ির বাহ্যিক অঙ্গসমূহ আঁতশ কাঁচ ও নিডল ব্যবহার করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করো।
৪. ব্যবহারিক খাতায় চিংড়ির ছবি এঁকে বাহ্যিক অঙ্গসমূহ চিহ্নিত করো।
৫. পুরো কার্যক্রমটি ধৈর্য্য সহকারে সম্পন্ন করো।
৬. অনুশীলনের পর চিংড়িগুলোকে স্পেসিমেন জারে সংরক্ষণ করো।
কাজের সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
বাগদা চিংড়ির বাহ্যিক অঙ্গসমূহ শনাক্ত করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | স্পেসিফিকেশন |
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১ টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস্ | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (টুলস, ইকুইপমেন্ট, মেশিন)
ক্রম | যন্ত্রপাতির নাম | স্পেসিফিকেশন | পরিমাণ |
০১ | প্লাস্টিকের গামলা | ১৫ লিটার | ১ |
০২ | প্লাস্টিকের বালতি | ১৫ লিটার | ১ |
০৩ | পাতিল | ১০ লিটার | ১ |
০৪ | স্কুপনেট | ছোট মাপের | ১ |
০৫ | ট্রে | ছোট মাপের | ১ |
০৬ | চিমটা | মাঝারি মাপের | ১ |
০৭ | আতশ কাঁচ | ৫ সেমি | ১ |
০৮ | মিটার স্কেল | ০.৫ মিটার | ১ |
(গ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
০১ | বাগদা চিংড়ি | প্রমান সাইজের | ৮-১০টি |
০২ | গামছা/তোয়ালে | মাঝারি মাপের | ১টি |
০৩ | টিস্যু পেপার | কিচেন টিস্যু প্যাকেট | ১ টি |
০৪ | খাতা, পেন্সিল | পরিমাণ মতো | ১ টি করে |
(ঘ) কাজের ধারা
১. নিকটস্থ বাজার/খামার থেকে ৮-১০টি করে তাজা বা সদ্য আহরিত বাগদা চিংড়ি সংগ্রহ করো।
২. পাতিল বা ব্যাগে যথাযথ সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে চিংড়ি পরিবহণ নিশ্চিত করো।
৩. অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ আতশ কাঁচ, ফরসেপ ও নিডল ব্যবহার করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা ।
৪. ব্যবহারিক খাতায় চিংড়ির ছবি এঁকে বাহ্যিক অঙ্গসমূহ চিহ্নিত করো।
৫. পুরো কার্যক্রমটি ধৈর্য্য সহকারে সম্পন্ন করো।
৬. অনুশীলনের পর অবশিষ্ট চিংড়িগুলোকে স্পেসিমেন জারে সংরক্ষণ করো।
কাজের সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
বাগদা চিংড়ির অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ শনাক্ত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের আয়তন কত?
২. বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকায় কয়টি প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়?
৩. বাংলাদেশে বর্তমানে মোট আহরিত চিংড়ির পরিমাণ কত?
৪. বাংলাদেশে বর্তমানে মোট মাছের উৎপাদন কত?
৫. চিংড়ির শিরোবক্ষ পৃষ্ঠদেশের আবরণ কি নামে পরিচিত?
৬. বাগদা চিংড়ির দেহে সর্বমোট কয় জোড়া উপাঙ্গ রয়েছে?
৭. চিংড়ির রক্তের রং কি?
৮. বাগদা চিংড়ির ডিম ফোটাতে মোট কত সময় লাগে ?
৯. বাগদা চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম কি?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন ৫ টি চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম লেখ ।
২. বাগদা চিংড়ির অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহের নাম লেখ।
৩. পরিপক্ক চিংড়ির ডিম পরিস্ফুটনের বিভিন্ন ধাপের নাম লেখ।
৪. বাগদা চিংড়ির শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য লেখ।
৫. বাগদা চিংড়ির শ্রেণিবিন্যাস লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চিংড়ি সম্পদের গুরুত্ব বর্ণনা করো।
২. বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ উন্নয়নে বিরাজমান সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানগুলো বর্ণনা করো।
৩. বাগদা চিংড়ির জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপসমূহ বর্ণনা করো।
৪. গলদা ও বাগদা চিংড়ির শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করো।
আরও দেখুন...