ব্যবসায়কে বা একজন ব্যবসায়ীকে কেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে? এর সহজ উত্তর হলো সমাজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ব্যবসায় পরিচালনা করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সহযোগিতাকারীর প্রতি সাহায্যগ্রহীতা কৃতজ্ঞ হবে, বিনয়ী হবে- এটাতো স্বাভাবিক বিষয় । একজন ডাক্তার কেন সমাজের মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হবে? এর জওয়াব যদি এটা হয় যে, তার বাবা-মা তাকে পড়িয়েছেন তাই তাদের প্রতি দায়িত্বশীল হলেই চলবে- সেটা কখনই যথার্থ উত্তর হতে পারে না । তার এ ডাক্তার হওয়ার পিছনে রাষ্ট্র খরচ করেছে । সেই খরচের টাকা কাদের পকেট থেকে এসেছে? দেখা যাবে তার এই ডাক্তার হতে হাজারো মানুষের শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয়িত হয়েছে। একজন ব্যবসায়ী রাস্তার মোড়ে, বিদ্যুত ও গ্যাস সুবিধা বিবেচনা করে, নিরাপত্তার কথা ভেবে ব্যবসায় গড়ে তুলেছে । এগুলোর ব্যবস্থা করেছে কে? তার শ্রম, মূলধন, মালামাল ইত্যাদি কারা সরবরাহ করছে? তার উৎপাদিত পণ্য ও সেবা কারা কিনছে- তাদের প্রতি কী তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়? এমনতো নয় যে তার আর কোনো সহযোগিতা লাগবে না । তাই ভবিষ্যতে ভালো করার জন্যও একজন ব্যবসায়ীকে সামাজিক দায়বয়দ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসায় চালাতে হয়। নিম্নে ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. সামাজিক বিপর্যয় রোধ (Prevent to social disaster): দরিদ্র বাবা-মা কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছেন । এখন সেই সন্তান যদি বাবা-মার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা না ভাবে তাহলে ঐ পরিবারটার কী দশা হবে? সরকার যদি জনগণের ওপর অধিক ট্যাক্স বসিয়ে, বিদেশ থেকে ঋণ এনে দেশের ব্যবসায় অবকাঠামো গঠন করে, ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয় আর যদি ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় গড়ে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দেয়, সরকারের সাথে অসহযোগিতা করে তবে সরকার চলবে কিভাবে? যে ক্রেতা ও ভোক্তা ব্যবসায়ীর সৌভাগ্যের ধন তাদেরকে যদি ঠকায়, প্রতারণা করে, ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্যে বাজার ছেয়ে ফেলে তাহলে ঐ ক্রেতা বা ভোক্তাদের দশা কী? সমাজের যে মানুষগুলো তাকে সহযোগিতা করে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে যদি সে ঐ সমাজেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে তবে ব্যবসায়ীও কী এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে । তাই সমাজ বাঁচাতে ব্যবসায়ীদের অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে হবে ।
২. সহযোগিতার উন্নয়ন (Development of co-operation) : 'সহযোগিতায় মধুরতা আছে' এ আপ্তবাক্যটি সর্বত্রই প্রযোজ্য । একটা পরিবারে, সমাজে বা রাষ্ট্রে সবাই যদি একে অন্যের সহযোগী হয় তবে তার যে সৌন্দর্য, দৃষ্টিনন্দন ভাব ও ফলাফল তা নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ । সমাজ বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ব্যবসায় সমাজ সম্পৃক্ত একটা প্রতিষ্ঠান । সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এটি বিকশিত হয় । ব্যবসায়ী, ভোক্তা, শ্রমিক- কর্মচারী, মধ্যস্থ ব্যবসায়ী, ঋণদাতা, সরবরাহকারী, কৌশলগত মিত্র, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, সরকার ইত্যাদি পক্ষসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতাতেই একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা দেশের ব্যবসায় খাত এগিয়ে যায়। পারস্পরিক কর্তব্যবোধ ও দায়বদ্ধতাই শুধুমাত্র এরূপ সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে ব্যবসায়ের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে ।
৩. ব্যবসায়ের সুনাম প্রতিষ্ঠা (Establishment of goodwill of business) : সুনাম ব্যবসায়ের একটা মূল্যবান সম্পদ । এই সম্পদ দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু এর ফল অত্যন্ত বেশি ও সুদূরপ্রসারী । এই সুনাম অর্জনে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সবারই সুধারণা ও সহযোগিতার প্রয়োজন । একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । গ্রাহকদের আগ্রহও বেড়েছে । কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে না, শ্রমিক কর্মীদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বাড়ায় না, মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা দেয় না তাহলে দেখা যাবে ব্যবসায়টির ঋণ খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, শ্রমিক-কর্মীরা আন্দোলন করায় উৎপাদন বন্ধ হতে পারে, পণ্যমান কমে যাওয়ায় বাজার হারাতে হতে পারে, মধ্যস্থ ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা না করায় পণ্য বাজারে না যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে । তাই বিভিন্ন পক্ষের সুধারণা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই একটা ব্যবসায়ের সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয় । যার মূলে থাকে সকল পক্ষের প্রতি ব্যবসায়ের দায়বদ্ধতা ।
আরও দেখুন...