জীবিকা অর্জনের জন্য যারা ব্যবসা করে তাদের কার্যাবলি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সবাই একই ধরণের ব্যবসায়ে নিয়োজিত নয়। তাদের কেউ শুধু পণ্য ক্রয় বিক্রয় করে, কেউ পণ্যদ্রব্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে, আবার কেউ গ্রাহকের কোনো জিনিস মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করে ।
ধরণ অনুযায়ী ব্যবসাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : যথা :
১. ক্রয়-বিক্রয় জাতীয় ব্যবসা
২. সেবামূলক ব্যবসা
৩. উৎপাদনমূলক ব্যবসা
নিম্নে ব্যবসার ধরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. ক্রয়-বিক্রয় জাতীয় ব্যবসা: তৈরি পণ্য উৎপাদক, পাইকার বা অন্য কোনো মধ্যস্থ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য কিনে এনে ক্রেতাদের কাছে বিক্রয় করার মধ্যে সীমিত ব্যবসাকে ক্রয়-বিক্রয় জাতীয় ব্যবসা বলে। এক্ষেত্রে পণ্যের গুণ বা আকৃতিগত কোনো পরিবর্তন করা হয় না। এ জাতীয় ব্যবসায়ের উদাহরণ মুদি দোকান, ওষুধের দোকান, কাপড়ের দোকান, মনিহারি দোকান ইত্যাদি। এ জাতীয় ব্যবসা খুচরা বা পাইকারি উভয় ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ।
২. সেবামূলক ব্যবসা: পণ্য বা দ্রব্যের গুণ পরিবর্তন করে কিংবা অন্য কোনো ধরনের সেবা প্রদানের মাধ্যমে আয় উপার্জনে নিয়োজিত ব্যবসাকে সেবামূলক ব্যবসা বলা হয় । উদাহরণস্বরূপ একজন টেলিভিশন বা রেডিও মেকানিক একটি নষ্ট হয়ে যাওয়া টেলিভিশন বা রেডিওকে তার কারিগরি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে সারিয়ে তুলে । এজন্য অনেক সময় তার টুলস এবং যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয় যা সে নিজেই সরবরাহ করে । এ কাজের বিনিময়ে সে পারিশ্রমিক পায়। এক্ষেত্রে তার কাজটি সেবামূলক ব্যবসায়ের অন্তর্গত। এছাড়া হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, ট্রাভেল এজেন্সি, ফটোকপিয়ার ইত্যাদি সেবামূলক ব্যবসায়ের অন্তর্গত ।
৩. উৎপাদনমূলক ব্যবসা: যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সাহায্যে কাঁচামালের আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধন করে নতুন পণ্য তৈরি করার কাজে নিয়োজিত ব্যবসাকে উৎপাদনমূলক ব্যবসা বলে। এ ধরনের ব্যবসায়ে কাঁচামালকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করে উৎপাদিত পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রয় করা হয় । যেমন- কাঠ থেকে আসবাবপত্র তৈরি, গম থেকে আটা, এমএস শিট থেকে আলমারি তৈরি, প্লাস্টিক দানা থেকে বলপেন তৈরি ইত্যাদি । উৎপাদনমূলক ব্যবসাকে শিল্প নামে আখ্যায়িত করা হয় । পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসার ধরন মূলত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক কার্যাবলির উপরই নির্ভরশীল।
ব্যবসায় সাংগঠনিক কাঠামো:
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছোট বা বড় আকারের হতে পারে। ব্যবসার জন্য যেসব আইনানুগ সাংগঠনিক কাঠামো সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. একমালিকানা ব্যবসা
২. অংশীদারি ব্যবসা
৩ । যৌথ মূলধনি ব্যবসা
৪. সমবায় সমিতি
৫. রাষ্ট্রীয় ব্যবসা
১. একমালিকানা ব্যবসা
একজন মাত্র ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে একমালিকানা ব্যবসা বলে ।
ব্যাপক অর্থে একমালিকানা ব্যবসা হলো এমন এক ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যার মালিক, পরিচালক, সংগঠক ও পুঁজি সরবরাহকারী একজন মাত্র ব্যক্তি, যিনি এককভাবে সকল ঝুঁকি বহন করেন এবং সমুদয় মুনাফা ভোগ করেন । গ্লেস ও বেকার-এর মতে, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একক ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসায়ই হলো একমালিকানা ব্যবসা। ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে একমালিকানা ব্যবসায়ই সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমাদের দেশে মুদি দোকান, কনফেকশনারি, রেস্তোরা এবং যাবতীয় খুচরা দোকান একমালিকানার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ।
২. অংশীদারি ব্যবসা (Partnership Business )
সাধারণ অর্থে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে কারবার গঠন ও পরিচালনা করে মুনাফা অর্জন করলে তাকে অংশীদারি ব্যবসা বলে ।
ব্যাপক অর্থে: কমপক্ষে দুজন এবং সর্বোচ্চ বিশজন (ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন) ব্যক্তি মুনাফা অর্জন ও তা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তাকে অংশীদারি ব্যবসা বলে ।
বাংলাদেশে প্রচলিত ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪ ধারায় অংশীদারি ব্যবসার নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, ‘সকলের দ্বারা বা সকলের পক্ষে একজন দ্বারা পরিচালিত ব্যবসার মুনাফা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের নিমিত্তে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয় তাকে অংশীদারি, যারা এরূপ সম্পর্ক সৃষ্টি করে তাদের প্রত্যেককে অংশীদার এবং সম্মিলিতভাবে তাদের ব্যবসাকে অংশীদারি ব্যবসা বলে ।
৩। যৌথ মূলধনি ব্যবসা ( Joint Stock Business )
সাধারণ অর্থে কোম্পানি আইন অনুযায়ী যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে যে ব্যবসা গঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে যৌথ মূলধনি ব্যবসা বলে ।
ব্যাপক অর্থে কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় যৌথভাবে মূলধন সরবরাহ করে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট আইনের আওতায় কোনো ব্যবসা গঠন ও পরিচালনা করলে তাকে যৌথ মূলধনি ব্যবসায় বলে ।
১. ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১ ঘ) ধারায় বলা হয়েছে যে, কোম্পানি বলতে কোম্পানি আইনের অধীনে গঠিত ও নিবন্ধিত অথবা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বোঝায় ।
কোম্পানির মোট মূলধনকে কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা হয় । এক একটি অংশকে শেয়ার বলে । শেয়ার ক্রেতারাই কোম্পানির মালিক । যৌথ মূলধনি কোম্পানি দুই প্রকারের । যথা-
i. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি
ii. পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি
৪. সমবায় সমিতি (Co-operative Society)
সাধারণ অর্থে নিজেদের অর্থনৈতিক কল্যাণ অর্জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে সমবায় সমিতি বলে ।
ব্যাপক অর্থে সমাজের স্বল্প আয়ের লোকেরা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য স্বেচ্ছায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে সংগঠন গড়ে তুলে তাকে সমবায় সমিতি বলে ।
মি. হেনরি কালভার্ট-এর মতে, 'সমবায় হলো এমন একটি সংগঠন যাতে সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে একত্রিত হয় ।
সমাজের বিত্তহীন বা একই পেশাভুক্ত ব্যক্তিরা পারস্পরিক সমঝোতা, সহযোগিতা ও সম-অধিকারের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। সমবায় সমিতিতে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকে । একজন সদস্য একাধিক শেয়ার ক্রয় করতে পারে কিন্তু একটি বেশি ভোট দিতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমান ২০০১ সালের সমবায় আইন ও ২০০৪ সালের সমবায় সমিতি বিধিমালার আওতায় এরূপ সমিতি গঠন ও পরিচালনা করতে হয় ।
৫. রাষ্ট্রীয় ব্যবসা (State business )
রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র কর্তৃক স্থাপিত বা পরবর্তী সময়ে জাতীয়করণকৃত কোনো ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব ও মালিকানা সরকারের অধীনে থাকলে তাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা বলে। এ ব্যবসায়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ করা, স্বয়ং রাষ্ট্রই এ ব্যবসার মালিক । সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্তৃক এ ধরনের ব্যবসা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে এরূপ ব্যবসার সৃষ্টি হয়। মোট কথা, জনসাধারণের কল্যাণ ও স্বার্থের প্রতি খেয়াল রেখে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা গড়ে ওঠে। যেমন- ডেসকো, ওয়াপদা, বিটিসিএল, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, সার কারখানা ইত্যাদি ।
আরও দেখুন...