হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের পর চাচা আবু লাহাবের দাসী সোয়েবা তাঁকে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। তারপর তখনকার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের প্রথা অনুসারে বানু সাদ গোত্রের বেদুঈন মহিলা হালিমার হাতে তাঁর লালনপালনের ভার দেওয়া হয়। সোয়েবা যদিও তাঁকে অল্পদিন লালন-পালন করেছেন, তবুও তিনি প্রথম দুধমাতা ও তাঁর পরিবারের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। অনেকদিন পরেও তাঁদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং উপহার উপঢৌকন দিয়েছেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত বিবি হালিমা নিজের সন্তানের মতো শিশু মুহাম্মদ (স) কে লালনপালন করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মদ (স)-এর চরিত্রে ইনসাফ ও ত্যাগের একটি অনুপম দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। তিনি হালিমার একটি স্তন থেকে দুধ পান করতেন, অন্যটি দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন। তিনি বেদুঈন পরিবারে থেকে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিখেন ও মরুভূমির মুক্ত পরিবেশে সু— স্বাস্থ্যের অধিকারী হন।
পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। আদর-সোহাগে মা তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। কিন্তু মায়ের আদর তাঁর কপালে বেশি দিন স্থায়ী হলো না। তাঁর ছয় বছর বয়সে মাও ইন্তিকাল করেন। এবার তিনি পিতা-মাতা দুজনকেই হারিয়ে এতিম হয়ে যান। এরপর তিনি দাদা আব্দুল মুত্তালিবের আদর-স্নেহে লালিত-পালিত হতে থাকেন। কিন্তু আট বছর বয়সের সময় তাঁর দাদাও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন ৷
আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। কিশোর মুহাম্মদ (স) ছিলেন কর্মঠ। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি চাচার অসচ্ছল পরিবারে নানাভাবে সাহায্য করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাখালদের সাথে ছাগল-মেষ চরাতেন । রাখাল বালকদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ। তাদের সাথে তিনি সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। রাখালদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন। তিনি চাচার ব্যবসা-বাণিজ্যেও সাহায্য করতেন। একবার চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায়ও গিয়েছিলেন। এ সময় বহিরা নামক এক পাদ্রির সাথে তাঁর দেখা হয়। বহিরা তাঁকে অসাধারণ বালক বলে মন্তব্য করেন এবং শেষ নবি বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি আবু তালিবকে তাঁর ব্যাপারে সাবধানও করেন। কারণ শত্রুরা তাঁর অনিষ্ট করতে পারে।
সিরিয়া থেকে ফেরার পর বালক মুহাম্মদ (স) ফিজার যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে আঁতকে ওঠেন। ওকায মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এ যুদ্ধ হয়েছিল । কায়স গোত্র অন্যায়ভাবে এ যুদ্ধ কুরাইশদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এজন্য একে ‘হারবুল ফিজার’ বা অন্যায় সমর বলা হয়। এ যুদ্ধ চলে একটানা পাঁচ বছর। অনেক মানুষ আহত-নিহত হলো। যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ দৃশ্য দেখে, আহতদের করুণ আর্তনাদে তাঁর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠল। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন ।
তিনি শান্তিকামী উৎসাহী যুবক বন্ধুদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযূল' নামে একটি শান্তি সংঘ গঠন করলেন। এ সংঘের উদ্দেশ্য ছিল আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি – শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি। তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় অনেক সফলতা লাভ করেন। সেদিনকার শান্তি সংঘের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আজও আমাদের কিশোর ও যুব সমাজ নিজেদের এ ধরনের মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পারে ।
ইতোমধ্যেই সত্যবাদী, বিশ্বাসী, আমানতদার, বিচক্ষণ, পরোপকারী, শান্তিকামী যুবক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপন-পর সকলেই তাঁকে “আস সাদিক’ মানে সত্যবাদী, ‘আল-আমীন' মানে বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করল। তাঁর কাছে ধন-সম্পদ আমানত রাখতে লাগল ।
আরও দেখুন...