সপ্তম পরিচ্ছেদ শিল্পের কাঁচামাল : কৃষিজ দ্রব্যাদি

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - কৃষি শিক্ষা - কৃষিজ উৎপাদন | NCTB BOOK

কৃষি মানবজাতির বেঁচে থাকার একটি অনন্য নিয়ামত এবং সভ্যতা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি । জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি শিল্পের কাঁচামালও যোগান দিয়ে থাকে । আবার গৃহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কাঁচামাল হিসাবে কাঠ, গুল্ম ও ঘাস জাতীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করে । চা, কফি, চিনি, তুলা, ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ কৃষিজ দ্রব্যাদি ছাড়াও বাঁশ, বেত, কাঠ, নারিকেলের ছোবড়া, আম ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে অবদান রাখছে । বাংলাদেশের কুটির শিল্পের উত্থান হচ্ছে বাঁশ-বেতের মাধ্যমে । অতএব, আমাদের সবারই জানা থাকা দরকার বাঁশ-বেত দ্বারা কিসব জিনিস তৈরি হয়, নারিকেলের ছোবড়া কী উপকারে আসে- আর আম দ্বারা কী ধরনের খাদ্য পণ্য তৈরি হয় । নিচে কয়েকটি কৃষিজ পণ্যের ব্যবহার আলোচনা করা হলো ।

আমজাত খাদ্যসামগ্রী ও ব্যবহার
আমকে ফলের রাজা বলা হয় । বাংলাদেশে যত ফল আছে তন্মধ্যে স্বাদের দিক থেকে আমের অবস্থান প্রথম । আম নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফসল । এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এবং আফ্রিকার অনেক দেশেই আম উৎপাদন হয় । তবে উৎপাদনের দিক থেকে ভারত প্রথম স্থান দখল করে আছে । আর বাংলাদেশের স্থান অষ্টম। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়ই কমবেশি আম জন্মে। তবে বেশি আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো হচ্ছে- বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা। মোট আমের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় উৎপাদন হয় । কাঁচা আম, পাকা আম প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আমের মোরব্বা, আমের চাটনি, আমের আচার, আমচুর, আমসত্ত্ব, পাকা আমের বোতলজাত জুস ইত্যাদি মুখরোচক খাদ্য তৈরি হচ্ছে ।

নারিকেলজাত দ্রব্য ও ব্যবহার
নারিকেল একটি অর্থকারী ও তেলজাতীয় ফসল । নারিকেল গাছ নানা কাজে ব্যবহৃত হয় । নারিকেলের ফলের ভিতরের অংশ মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং তা হতে তেলও পাওয়া যায় । নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি, মাদুর প্রভৃতি তৈরি হয় । নারিকেল গাছের পাতা দ্বারা ঝাঁটাও তৈরি হয় । নারিকেলের কচি ফলকে ডাব বলা হয় । ডাবের পানি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর । রোগীর পথ্য হিসাবেও ডাবের পানির ব্যবহার হয় । উপকূল অঞ্চলের লোকেরা তরকারিতে নারিকেলের শ্বাস ব্যবহার করেন । আর ক্ষীর, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি তৈরিতে বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই নারিকেল ব্যবহার করে । নারিকেল হতে মাথায় দেওয়ার এবং খাওয়ার তেল তৈরি করা হয়। গ্লিসারিন, সাবান ও অন্যান্য কসমেটিকস তৈরিতেও নারিকেল ব্যবহার করা হয় ।

নারিকেলের ছোবড়া
বাংলাদেশে সারা বছরই প্রচুর পরিমাণে নারিকেল উৎপন্ন হয়। নারিকেল উৎপাদনের সাথে নারিকেলের ছোবড়াও প্রচুর পাওয়া যায় । নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে নানা গৃহস্থালি বস্তু তৈরি হয় ।
যেমন— খাটের জাজিম, ওয়ালম্যাট, পাপোশ, রশি ইত্যাদি ।

শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে কৃষি দ্রব্যাদি ব্যবহারের গুরুত্ব

বাঁশ ও বাঁশজাত দ্রব্যাদির ব্যবহার
বাঁশ ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এটি গুরুত্বপূর্ণ অকাঠ বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ । আসবাবপত্র, গৃহনির্মাণ ও গৃহ সজ্জার কাজে প্রাচীনকাল থেকেই কাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো বাঁশকে পারিবারিক বা গৃহস্থালির নানান কাজে ব্যবহার করা হয় । গৃহনির্মাণ ও গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত এর ব্যবহার বিস্তৃত। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বাঁশ থেকে কাগজ, পার্টিকেল বোর্ড, পাইবোর্ড, ঢেউটিন এমনকি প্যানেল পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঁশ পাতলা করে চেরাই করে চাটাই, ডোল, বীম, আড়, ঘরের খুঁটি, খেলনা, বাদ্যযন্ত্র, টুকরি, ঝুড়ি, কুলা, মাছ ধরার খাঁচা, পলো ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয় । আধুনিক বিশ্বে দেশে ও বিদেশে বাঁশের হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বাঁশ থেকে স্বাস্থ্যকর লেমিনেটেড বাঁশের মেঝে ও দেয়ালকভার, মাদুর, কুশন, সিটকভার এমনকি পাদুকা পর্যন্ত তৈরি সম্ভব হচ্ছে।

বাঁশ শিল্পের শ্রেণি বিভাগ
বাঁশ শিল্পকে নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা :

১। কাগজশিল্প
২। নির্মাণশিল্প
৩। ক্ষুদ্র হস্তশিল্প

কাগজ শিল্প
মুলিবাঁশ কাগজ শিল্পের জন্য বিশেষ উপযোগী। মুলিবাঁশের তৈরি কাগজের মণ্ড দিয়ে উন্নত মানের কাগজ তৈরি হয় । কাগজের উপজাত হিসাবে রেয়নও প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশের নানা জায়গায় কাগজ শিল্প গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ বাঁশই এই শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। কাগজ ছাড়াও বাঁশ থেকে পার্টিকেল বোর্ড, প্লাইবোর্ড, ফ্লেকবোর্ড,বাশের ঢেউটিন, প্যানেল বোর্ড ইত্যদি তৈরি করা যায় ।

নির্মাণশিল্প
বিভিন্ন নির্মাণশিল্পেও বাঁশ ব্যবহৃত হয়। নির্মাণশিল্পের মধ্যে গৃহ বা দালান কোঠা নির্মাণই প্রধান। বাঁশ গ্রামীণ গৃহ নির্মাণের বিভিন্ন কাজ যেমন খুঁটি দেওয়া, ঘরের বেড়া দেওয়া, বীম বা আড় তৈরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। বড় বড় দালান কোঠা নির্মাণেও বাঁশ ব্যবহৃত হয় । আরও অনেক নির্মাণশিল্প যেখানে বাঁশ অতীতকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন গ্রামের খাল বা অপ্রশস্ত নদীতে সেতু বা সাঁকো তৈরিতে, নৌকার মাস্তুল, ছই, পাটাতন, গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, জোয়াল, ঘানি ও মাড়াই কল ইত্যাদি । বৈদ্যুতিক খুঁটি, মাছ ধরার চাঁই, খাড়া জাল ইত্যাদি তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। ধর্ম জালের দণ্ড, সবজির গাছ বেয়ে উঠার জন্য মাচা, নৌকার হাল ও দাঁড়ের দণ্ড, বক্তৃতার মঞ্চ, তোরণ এসব তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মিত। পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ দ্বারা কূপ তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় আর্টেজীয় কূপ। এই কূপের সাহায্যে পাহাড়ি এলাকায় জমি চাষ করা হয় ।

ক্ষুদ্র হস্তশিল্প
ক্ষুদ্র হস্তশিল্পেই অধিক হারে বাঁশ ব্যবহৃত হয় । কেননা এই শিল্পের দ্রব্যজাত তৈরি ও ব্যবহার বেড়ে গেছে । সমস্ত প্রকার বাঁশ বয়ন ক্ষুদ্র হস্তশিল্পেরই অন্তর্ভুক্ত। এই শিল্পের অধীনে তৈরি হয় চাটাই, ডোল, কুলা, ঝুড়ি, ঝাকা, চালনি, খাঁচা, খেলনা, কলম, টুপি, ফুলদানি, লাইট স্ট্যান্ড, লাঠি, কাঠি এমনকি দাঁত খিলান, বুকসেলফ ইত্যাদি ।

ঔষধি বাঁশ
বাঁশ শুধু কাগজ তৈরি বা গৃহ সামগ্রী তৈরির কাজেই ব্যবহার হয় না। ঔষধ তৈরির কাজেও বাঁশ ব্যবহার হয়। বাঁশের অনেক জাত আছে। তন্মধ্যে সোনালি বাঁশ বিভিন্ন রোগের কাজে লাগে, কাশি, শোথ রোগ, প্রস্রাবজনিত রোগ, ফোঁড়া পাকা ইত্যাদি মানুষের সাধারণ রোগ। এই রোগগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার মহৌষধ হচ্ছে এই সোনালি বাঁশ। ঔষধ হিসেবে বাঁশের শীষ, পাতা ও মূল ব্যবহার করা হয় । অবশ্যই এগুলো কবিরাজের পরমর্শমতো ঔষধ তৈরি ও ব্যবহার করতে হবে।

কাজ : শিক্ষার্থীরা যেখানে ঝুড়ি তৈরি করা হয় এমন স্থান পরিদর্শন করবে এবং ঝুড়ি তৈরির ধাপগুলো লিখে আনবে । পরবর্তীতে হাতে কলমে নিজেরা করবে।

বেত ও বেতের ব্যবহার
বেত কাঠ ও বাঁশের মতো প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ। বাংলাদেশের বনে জঙ্গলে অনেক ধরনের বেত পাওয়া যায় । বেত উৎপাদনের জন্য কৃষি ভূমি ব্যবহার করা হয় না। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর বেত উৎপন্ন হয়। বেত, তাল ও নারিকেল গোত্রীয় কিন্তু কাঁটাযুক্ত লতা ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর ফল হয়। যা বেত ফল নামে পরিচিতি ।

বেত শিল্প
বেতের শিল্পগুণের জন্যই বেত সবার নিকট সুপরিচিত। বেতের কাণ্ড বেত শিল্পে ব্যবহার করা হয় । বেতের কাণ্ড শক্ত বটে কিন্তু নমনীয় ও চেরাইযোগ্য। এ থেকে আকর্ষণীয় ও আভিজাত্যবহনকারী শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত করা হয়।

বেতের ফার্নিচার তৈরি
বেতের তৈরি ফার্নিচার একেবারেই প্রাকৃতিক । এতে কোনো প্রকার কৃত্রিমতা নেই । বেতকে সুতার মতো ব্যবহার করে কোনো শক্ত জিনিসের (রড, বাঁশ) উপর পেঁচিয়ে ফার্নিচার তৈরি করা যায় । আবার বেতের মোটা শাখা প্রশাখা শুকিয়ে শোধন করে শক্ত কাঠামো দাঁড় করিয়ে সোফা, চেয়ার, টেবিল, বুকসেলফ, খাট, দোলনা, মোড়া, জুতা রাখার তাক, কর্নার সেলফ, ওয়ার্ডড্রোবস, রকিং চেয়ার, আরাম কেদারা ইত্যাদি ফার্নিচার বা আসবাবপত্র তৈরি করা যায় । ফার্নিচার তৈরির আগে বেতগুলোকে সাইজ মতো কেটে শোধন করতে হবে। একটি চাড়িতে আনুমানিক হারে বরিক এসিড ও পানির দ্রবণ তৈরি করে এই দ্রবণে বেত এক সপ্তাহ ভিজিয়ে রাখলে ভালোভাবে শোধিত হবে । এতে ঘুণ বা অন্যান্য পোকা-মাকড় আক্রমণ করবে না ।

বেতজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান
বেতের ব্যবহার ব্যাপক। বেত শিল্পই হচ্ছে গ্রামীণ শিল্প ঐতিহ্য । বেতের শিল্পকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায় :

১। হালকা নির্মাণশিল্প      ৩। ক্ষুদ্র হস্তশিল্প
২। বুননশিল্প                   ৪। মিশ্ৰশিল্প

হালকা নির্মাণশিল্প
বেতের হালকা নির্মাণশিল্প বলতে বোঝায় মোটা বেতের আসবাবপত্র, যা হালকা ভার বহন করতে পারে। হালকা নির্মাণশিল্পের প্রধান উদাহরণ হচ্ছে- সোফাসেট, চেয়ার, খাট, পার্টিশন, শেলফ, টেবিল ইত্যাদি। এই শিল্পে যে বেত ব্যবহার করা হয় তা অপেক্ষাকৃত মোটা এবং পরিমাণে বেশি। আর এই বেত ব্যবহারে শিল্প নৈপুণ্যের দরকার হয়ে থাকে। দেশ-বিদেশের অভিজাত মহলে হালকা নির্মাণশিল্পের দ্রব্যাদির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই শিল্পে সাধারণত গোল্লাতে, উদমবেত, কদমবেত ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় ।

বুননশিল্প
বুননশিল্পে সরু ও নমনীয় বেত ব্যবহার করা হয়। এসব বেত চেরাই করে আরও সরু ফালি পাওয়া যায় । এই সরু ফালিকে বেতি বলা হয়। বাঁধাই ও বুনন কাজে এই বেতি ব্যবহার করা হয় । বুননশিল্পের মাধ্যমে হালকা নির্মাণশিল্পকে কারুকার্যময় ও নান্দনিক করা হয়। বুননশিল্পের জন্য বান্দরিবেত ও জালিবেত ব্যবহার করা হয় ।

ক্ষুদ্র হস্তশিল্প
বস্তুত বেতশিল্পের পুরোটাই হস্তশিল্প- ক্ষুদ্র হোক অথবা বড় হোক। নির্মাণশিল্প ও বুননশিল্পের অপ্রয়োজনীয় অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করে সৌন্দর্যবর্ধক যেসব দ্রব্যাদি হাতে তৈরি করা হয় তাকেই বলে বেতের ক্ষুদ্র হস্তশিল্প । বেতের ক্ষুদ্র হস্তশিল্পের উদাহরণ হচ্ছে খেলনা, ফুলের সাজি, কলমদানি, বেতের ধামা, জুতার র্যাক, মোড়া, ফুলদানি ইত্যাদি ।

মিশ্রশিল্প

বেতের সাথে বাঁশ, কাঠ, প্লাস্টিক, নাইলন, স্টিল ইত্যাদি মিশ্রণ করে যেসব দ্রবাদি তৈরি হয় তাকে বেতের মিশ্রশিল্প বলে। মোটা বেতের অভাব হলে এর স্থলে কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি ব্যবহার করে মিশ্রশিল্প হিসাবে দোলনা, মোড়া, র‍্যাক, সেলফ, চেয়ার তৈরি করা হয় । আবার সরু বেতের অভাব হলে এর স্থলে নাইলনের বা প্লাস্টিকের বেতি মোটা বেতের সাথে মিশ্রণ করে খাট, বাক্স, সোফা ইত্যাদি তৈরি করা যায় ।

Content added || updated By
Promotion