১৪.২.১ রেডিও থেরাপি (Radio Therapy)
রেডিও থেরাপি শব্দটি ইংরেজি Radiation Therapy শব্দটির সংক্ষিপ্তরূপ। রেডিওথেরাপি হচ্ছে কোনো রোগের চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ব্যবহার। এটি মূলত ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। রেডিওথেরাপিতে সাধারণত উচ্চক্ষমতার এক্সরে ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা হয়। এই এক্স-রে করে ক্যান্সার কোষের ভেতরকার ডিএনএ (DNA) ধ্বংস করে কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। একটি টিউমারকে সার্জারি করার আগে ছোট করে নেওয়ার জন্য কিংবা সার্জারির পর টিউমারের অবশিষ্ট অংশ ধ্বংস করার জন্যও রেডিওথেরাপি করা হয়। বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করার জন্যে সাধারণত একটি লিনিয়ার এক্সেলেটর ব্যবহার করে উচ্চক্ষমতার এক্স-রে তৈরি করা হয়। শরীরে যেখানে টিউমারটি থাকে সেদিকে তাক করে তেজস্ক্রির ৰিমটি (চিত্র ১৪.১১) পাঠানো হয়। বিমটি তখন শুধু ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে দেয় না, তার বিভাজন ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়। বিমটি শুধু ক্যান্সার আক্রান্ত জায়গায় পাঠানো সম্ভব হয় না বলে আশপাশের কিছু সুস্থ কোষও ধ্বংস হয়। রেডিওথেরাপি বন্ধ হওয়ার পর সুস্থ কোষগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।
১৪.২.২ কেমোথেরাপি (Chemotherapy)
ক্যান্সারে শরীরের কিছু কোষ বিভাজনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কেমোথেরাপি হলো এমন এক ধরনের চিকিৎসা, যেখানে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ঔষধ ব্যবহার করে শরীরের জন্য ক্ষতিকর দ্রুত বিভাজনরত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি
কার্যপ্রণালি : প্রতিটি জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। এই কোষ বৃদ্ধি পায় বা বিভাজিত হয়। জীবদেহের এই কোষ বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে কেমোথেরাপি গঠিত হয়েছে। কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক ঔষধ কোষ বিভাজনের নির্দিষ্ট ধাপে প্রয়োগ করা হয়। কোষ বিভাজনের কোন ধাপে কী প্রয়োগ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে রাসায়নিক ঔষধগুলো ঠিক করা হয়। এটি একটি নির্দিষ্ট সময় জুড়ে থাকে। যেমন: প্রতিদিনে ১ বার, সপ্তাহে ১ বার বা মাসে ১ বার প্রভৃতি। সাধারণত এভাবে প্রায় ৬ বার ঔষধ প্রয়োগ করা হয় ।
কেমোথেরাপির ঝুঁকি বা পার্শ্বক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া: কেমোথেরাপির বিশেষ ঔষধ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্য কোষও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এতে নিম্নোক্ত ঝুঁকি থাকতে পারে:
১. চুল পড়ে যাওয়া
২. হাতের তালু, পায়ের তালু প্রভৃতি অঙ্গের চামড়া পুড়ে যাওয়া
৩. হজমে সমস্যা হওয়া এবং এর কারণে ডায়ারিয়া, পানিশূন্যতা, বমি প্রভৃতি সমস্যা হওয়া
৪. লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেতরক্ত কণিকা ও অণুচক্রিকা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া। কেমোথেরাপির ঝুঁকি এড়াবার কিছু কৌশল এরকম:
১. শরীরের তাপমাত্রার দিকে লক্ষ রাখা ।
২. তরল বা নরম খাবার খাওয়া।
৩. কেমোথেরাপি গ্রহণকৃত রোগীর বর্জ্য, যেমন মলমূত্র, বমি ইত্যাদি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জীবাণুনাশক নিয়ে পরিষ্কার করে ফেলা।
৪. বর্জ্য পরিষ্কার করার সময় খালি হাত ব্যবহার না করে গ্লাভস বা কমপক্ষে প্লাস্টিকের ব্যাগে হাত ভালভাবে মুড়িয়ে পরিষ্কার করা।
৫. শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঠিক রাখার জন্য সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা ও যোগাযোগ রাখা।
১৪.২.৩ আইসোটোপ এবং এর ব্যবহার (Isotopes and its Uses)
মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হলে তাকে সেই মৌলিক পদার্থের আইসোটপ বলে। প্রকৃতিতে অনেক মৌলের বিভিন্ন আইসোটপকে স্বাভাবিকভাবে তেজস্ক্রিয় হিসেবে পাওয়া যায়, আবার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া করে তেজস্ক্রিয় আইসোটপ বানানো সম্ভব। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই এই মস্তিষ্কের বিপাকক্রিয়া সুস্থ মস্তিষ্ক কোকেনসেবীর মস্তিষ্ক
চিত্র ১৪.১২ : PET scan দিয়ে দেখা স্বাভাবিক এবং কোকেন মাদকাস মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীল অংশের ছবি তেজস্ক্রিয় আইসোটপ ব্যবহার করা হয়। এই আইসোটোপগুলো রোগ নির্ণয় করার জন্য যেরকম ব্যবহার করা যায়, ঠিক সেরকম রোগ নিরাময়ের জন্যও ব্যবহার করা যায়। শরীরের কোনো কোনো অঙ্গে মাঝে মাঝে আলাদাভাবে বিশেষ কোনো যৌগিক পদার্থ যুক্ত হয়। সেই যৌগিক পদার্থের পরিমাণ দেখে অঙ্গটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব। যৌগটির পরিমাণ বোঝার জন্য যৌগটির কোনো একটি পরমাণুকে তেজস্ক্রিয় আইসোটপ দিয়ে পাল্টে দেওয়া হয় এবং সেই তেজস্ক্রিয় আইসোটপের বিকিরণ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্গে যৌগের পরিমাণ বোঝা যায়। সাধারণত আইসোটপটি গামা-রে বিকিরণ করে এবং বাইরে থেকেই এই গামা-রে শনাক্ত করা যায়।
সম্ভবত: তেজস্ক্রিয় আইসোটপ ব্যবহারের একটি চমকপ্রদ উদাহরণ PET বা Positron Emission Tomography যেখানে তেজস্ক্রিয় আইসোটপটি পজিট্রন বিকিরণ করে। তোমরা জান, পজিট্রন ইলেকট্রনের প্রতিপদার্থ (Anti Particle) এবং এটি ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হয়ে শক্তিতে রূপান্তর হয়। এই শক্তি দুটি গামা-রে হিসেবে বিপরীত দিকে বের হয়ে আসে। কাজেই বিপরীত দিকে দুটি নির্দিষ্ট শক্তির গামা-রে শনার করে পজিট্রনটি কোথা থেকে বের হয়েছে, সেটি বের করে নেওয়া যায়। সেই তথ্য থেকে আমরা শুধু যে পজিট্রন তৈরির অস্তিত্ব জানতে পারি তা নয়, সেটি ঠিক কোথায় কতটুকু আছে, সেটাও বলে দিতে পারি। গ্লুকোজের ভেতর পজিট্রন বিকিরণ করে সেরকম একটি আইসোটোপ যুক্ত করে দিলে PET ব্যবহার করে আমরা মস্তিষ্কের কোথায় কতটুকু জমা হয়েছে, সেটি বের করতে
পারব। এই তথ্য থেকে কোন সময় মস্তিষ্কের কোন অংশ বেশি ক্রিয়াশীল (চিত্র ১.১২) এবং বেশি গ্লুকোজ ব্যবহার করেছে, সেই তথ্যও বের করা সম্ভব। PET প্রযুক্তি মানুষের মস্তিষ্কের কর্মপদ্ধতি বের করার ব্যাপারে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।তেজস্ক্রিয় আইসোটপ ব্যবহার করে শুধু যে রোগ নির্ণয় বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মপদ্ধতি বের করা হয়, তা নয়, এটি দিয়ে রোগ নিরাময় করা হয়। Co একটি গামা-রে বিকিরণকারী আইসোটপ, এই আইসটোপ ব্যবহার করে গামা রে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করা হয়। I (আয়োডিন)-কে থাইরয়েডের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। থাইরয়েডের চিকিৎসার এটি এতই কার্যকর যে আজকাল থাইরয়েডের সার্জারির প্রয়োজন হয় না। এছাড়াও লিউকেমিয়া নামে রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয় ফসফরাস আইসোটোপ p যুক্ত ফসফেট ব্যবহার করা হয়।