বয়ঃসন্ধিকাল

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৫) - বিজ্ঞান - নবজীবনের সূচনা | | NCTB BOOK
18
18

কোনো বাড়িতে একটি শিশু জন্ম নিলে সেখানে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সকলেই শিশুটিকে আদর করতে চায়, কোলে নিতে চায়। শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে তাদের শৈশবকাল। ছয় থেকে দশ বছর পর্যন্ত বয়সকে আমরা বাল্যকাল বলি, তখন একজন শিশুকে মেয়ে হলে বালিকা এবং ছেলে হলে বালক বলা হয়। দশ বছর বয়সের পর একটি মেয়েকে কিশোরী এবং একটি ছেলেকে কিশোর বলা হয়। মানুষের জীবনের এই সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। দশ বছর থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোরকালের বিস্তৃতি। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকাল বাল্যাবস্থা ও যৌবনকালের মধ্যবর্তী সময়। এ সময়কালে বালক ও বালিকার শরীর যথাক্রমে পুরুষের এবং নারীর শরীরে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে একটু আগে শুরু হয়। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয় আট থেকে তেরো বছর বয়সের মধ্যে। ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর বয়স দশ থেকে পনেরো বছর। কারো কারো ক্ষেত্রে এর চেয়ে একটু আগে বা পরেও বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হতে পারে।

৪.১.১ বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনসমূহ

বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলোর মধ্যে দৈহিক বা শারীরিক পরিবর্তনগুলোই প্রথমে চোখে পড়ে। এই পরিবর্তন দেখলেই বোঝা যায় যে কারো বয়ঃসন্ধিকাল চলছে।শৈশব থেকে বাল্যকাল পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে বেশ সময় নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের বেড়ে ওঠা অনেকটা আকস্মিক। ছেলেমেয়েরা হঠাৎ দ্রুত লম্বা হতে থাকে (চিত্র ৪.০১), ওজনও বাড়তে থাকে দ্রুত। দশ বছর বয়সের পরে তিন থেকে চার বছর ধরে মেয়ে ও ছেলেদের শরীরে নানারকম পরিবর্তন আসে।নানা কারণে আমাদের দেশের মানুষেরা এই অভ্যন্ত স্বাভাবিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু যেহেতু তোমরা এখন বয়ঃসন্ধিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ, তাই তোমার ভেতর কী কী পরিবর্তন হবে, সেগুলো জেনে রাখা ভালো। তাহলে তোমরা ভয় কিংবা লজ্জা না পেয়ে তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে প্রস্তুত থাকতে পারবে। চিত্র ৪,০১; বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা দ্রুত লম্বা হয়ে ওঠে

বয়ঃসন্ধিকালে যেসব পরিবর্তন দেখা দেয়, সেগুলো প্রধানত তিন রকম:

১. শারীরিক পরিবর্তন

২. মানসিক পরিবর্তন

৩. আচরণগত পরিবর্তন।

১. শারীরিক পরিবর্তন

(ক) দ্রুত লম্বা হয়ে ওঠা এবং দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া

(খ) ছেলেদের (১৬/১৭ বছর বয়সে) দাড়ি-গোঁফ গজানো এবং মেয়েদের স্তন বর্ধিত হতে শুরু করা

(গ) শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম গজানো

(ঘ) ছেলেদের স্বরভঙ্গ হওয়া ও গলার স্বর মোটা হওয়া

(ঙ ) ছেলেদের বীর্যপাত এবং মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়া

(চ) ছেলেদের বুক ও কাঁধ চওড়া হয়ে ওঠা এবং মেয়েদের কোমরের হাড় মোটা হওয়া।

২. মানসিক পরিবর্তন

(ক) অন্যের, বিশেষত নিকটজনের মনোযোগ, যত্ন ও ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হওয়া

(খ) আবেগ দ্বারা চালিত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া

(গ) ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হওয়া

(ঘ) বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া

(ঙ) মানসিক পরিপক্বতার পর্যায় শুরু হওয়া

(চ) পরনির্ভরতার মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে আত্মনির্ভর হওয়ার পর্যায় শুরু হওয়া।

৩. আচরণগত পরিবর্তন

(ক) প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করা

(খ) সে যে একজন আলাদা ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা

(গ) প্রত্যেক বিষয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা

(ঘ) দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া।

 

 

৪.১.২ বয়ঃসন্ধিকাল পরিবর্তনের কারণ

সাধারণত ছেলেমেয়েদের ১১-১৯ বছরের সময়কালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে এ সময়ে ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়। তবে আবহাওয়া, স্থান, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ও মানের তারতম্যের কারণে এক একজনের বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা এক এক রকম হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে যেসব পরিবর্তন ঘটে, তার জন্য দায়ী হরমোন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। হরমোন শরীরের ভিতরে স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। ছেলে ও মেয়েদের শরীরের হরমোন ভিন্ন। এ কারণে তাদের শরীর ও মনে যে পরিবর্তন হয় সেটিও ভিন্ন। মেয়েদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য দায়ী প্রধানত দুটি হরমোন। এ হরমোন দুটোর নাম হলো ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন। এসব হরমোনের প্রভাবে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়, দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অ- প্রত্যঙ্গের আকার বৃদ্ধিসহ অন্যান্য পরিবর্তন ঘটে। এ হরমোনের কারণে মেয়েদের ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হয়। বয়স যখন ১০-১৭ বছর হয়, সাধারণত তখনই মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হয়। নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতার লক্ষণ হলো নিয়মিত ঋতুস্রাব। ঋতুস্রাব শুরু হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। বাংলাদেশের নারীদের সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। ২৮ দিন পরপর বা মাসে একবার এই ঋতুস্রাব প্রক্রিয়া চলে এবং সাধারণত এটি ৩-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য যে হরমোন দায়ী, তার নাম হলো টেস্টোস্টেরন। এ হরমোনের প্রভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। ছেলেদের গলার স্বর ভারী হয়। মুখে দাড়ি ও গোঁফ গজায় (চিত্র ৪.০২), দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি পায়। ১৩ থেকে ১৫ বছরের ছেলেদের শরীরে শুক্রাণু তৈরি হয় এবং মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত ঘটে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মাঝেই শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তন হয়। ছেলে ও মেয়েরা এ বয়সে কল্পনাপ্ৰৰণ হয় এবং আবেগ দ্বারা চালিত হয়। তারা পরিপাটি রূপে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে চায় (চিত্র ৪.০৩)। এ সময় ছেলেরা মেয়েদের প্রতি এবং মেয়েরা ছেলেদের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। এভাবেই ধীরে ধীরে কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হতে শুরু করে। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো ঘটে হরমোনের কারণে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের কারণ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ ।মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন কাজ করে । ইস্ট্রোজেন হরমোন ছেলেদের শরীরে তৈরি হয়ে ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো ঘটে প্রজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে ইস্ট্রোজেন খাদ্য হজমে সহায়তা করে । তোমরা জেনেছ যে ছেলে-মেয়েদের ১১-১৯ বছর বয়সের সময়কালকে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল। তোমরা এও জেনেছ, এ সময় ছেলে-মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি জড়িত।  বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন।

৪.১.৩ দৈহিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে যে বীর্যপাত ঘটে, সেটাকে স্বপ্নদোষ বলা হয়ে থাকে। স্বপ্নদোষ ভয় বা লজ্জার কোনো বিষয় নয়। “স্বপ্নদোষ" বলা হলেও এটি কোনো দোষ নয়। এটা এ বয়সে শরীরের একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম। বয়ঃসন্ধিকালে সাধারণ ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ছেলেদের শুক্রাণু তৈরি শুরু হয়। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যে বীর্যের মাধ্যমে এ শুক্রাণু দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শরীর থেকে বীর্যপাত হয় এবং তা অবিরাম তৈরি হতে থাকে। স্বপ্নদোষ হলে গোসল করে পরিষ্কার হওয়া ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এ সময় শরীর দ্রুত বেড়ে উঠে বলে পুষ্টিকর খাবার (চিত্র ৪.০৪, চিত্র ৪.০৫) বিশেষ করে বেশি করে শাক- সবজি খাওয়া ও পানি পান করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা উচিত। বয়ঃসন্ধিকালে স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াও নানা রকম মানসিক পরিবর্তন হয়। প্রয়োজন হলে এ বিষয়ে মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়দের সাথে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা যেতে পারে। বয়সন্ধিকালে সবাই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে, সবাইকে বুঝতে হবে এটি হরমোনের ক্রিয়া এবং বয়ঃসন্ধিকাল পার হওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ছেলেদের মতো মেয়েদেরও বয়ঃসন্ধিকালে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় মেয়েদের শরীরের যেসব পরিবর্তন ঘটে, তার মধ্যে ঋতুস্রাব বা মাসিক এবং সাদা স্রাব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।সাধারণত ৯-১৩ বছর বয়সের মধ্যে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হয়। প্রত্যেক মাসে একবার ঋতুস্রাব হয় বলে একে মাসিক বলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব শরীরের একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ঋতুস্রাবের সময় ৩-৫ দিন পর্যন্ত রক্তস্রাব হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ সময় কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। কখন ঋতুস্রাব শুরু হবে, সেই সময়টুকু অনুমান করে তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। এ সময় মেয়েদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, নিয়মিত গোসল করা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং বেশি পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন। এ সময় সাধারণত, একটু বেশি বিশ্রাম নেওয়া দরকার।যেহেতু মাসিকের সময় শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে যায়, তাই ক্ষয়পূরণের জন্য মাছ, মাংস, সবজি এবং ফলমূল বেশি পরিমাণে খাওয়া দরকার। মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা হতে পারে। সেক্ষেত্রে গরম পানির সেঁক দিলে আরাম বোধ হবে। এ সময় মাথাব্যথা ও কোমরে ব্যথা হতে পারে। এসব দেখে বিচলিত হওয়া বা ভয় পাবার কিছু নেই। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে হবে।মাসিকের সময় আজকাল শোষক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্যাড পাওয়া যায়। প্যাড জোগাড় করা সহজ না হলে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত তুলা বা পরিষ্কার শুকনো কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে। মাসিকের সময় ব্যবহার করা কাপড় শোষক হিসেবে আবার ব্যবহার করতে হলে সাবান দিয়ে গরম পানিতে ধুতে হবে এবং রোদে শুকিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। এই কাপড় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখা ঠিক নয়, তাহলে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।

৪.১.৪ মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা

বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের সময়ে অনেকে একা থাকতে পছন্দ করে। অনেকে খানিকটা অস্বাভাবিক আচরণও করতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনের চাইতেও অনেক সময় মানসিক পরিবর্তন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অনেকে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং এ কারণে পরিবারের সদস্যদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হতে পারে। এ বয়সে তাদের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সেই পরিবর্তনের বিষয়গুলো মনে রেখে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ এবং সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তাদেরকে মানসিক দিকসহ অন্য সকল ব্যাপারে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে এবং সাহস যোগাতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ছেলেমেয়েরা নিজেরাও সচেষ্ট থাকবে। তাদের প্রথম কাজ হবে বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা। এ পরিবর্তনগুলো যে খুবই স্বাভাবিক, এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে বুঝতে হবে। এটা বুঝতে পারলে অস্বস্তি, লজ্জা বা ভয় কমে যাবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলা মনে মা-বাবা বা বড় ভাই-বোনের সাথে আলোচনা করতে পারলে সংকোচও কেটে যাবে। তখন একা থাকা বা লোকজন এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। এছাড়া ভালো গল্পের বই পড়লে, সাথিদের সাথে খেলাধুলা করলে মানসিক প্রফুল্লতা বজায় থাকবে।বয়ঃসন্ধিকালে বাবা-মা, ভাই-বোন এবং পরিবারের সদস্য কিংবা স্কুলের শিক্ষক সবাইকেই ছেলে- মেয়েদের প্রয়োজনীয় মানসিক সহায়তা কিংবা পরামর্শ দিতে হবে। এতে তারা সুস্থ সবল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হবে।

একক কাজ

কাজ: বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তার একটি ছক তৈরি কর।

৪.১.৫ বয়ঃসন্ধিকালীন বিবাহ ও গর্ভধারণ

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য মেয়েদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হতে হয়। কিন্তু এই আইন থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অনেক মেয়েকেই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেন। তোমরা কখনও কি ভেবে দেখেছ, উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিলে তারা কোন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়? অল্প বয়সের বিবাহিত মেয়েরা নানা ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে। এর মধ্যে একটি হলো অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ।

গর্ভধারণ কী?

পুরুষের শুক্রাণু যখন মেয়েদের ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়, তখনই একটি মেয়ে গর্ভধারণ করে অর্থাৎ তার শরীরে সন্তান গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মেয়েদের জন্য এটি একটি বিশেষ শারীরিক প্রক্রিয়া এবং শুধু সন্তান গর্ভে এলেই শরীরের এই বিশেষ পরিবর্তনগুলো ঘটে।গর্ভধারণের প্রথম কয়েক মাস মেয়েদের শরীরে কিছু কিছু অস্বস্তিকর লক্ষণ দেখা যায়।এ লক্ষণগুলো হলো:

  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া 
  • মাথা ঘোরা;
  • বারবার প্রস্রাব হওয়া;

 

স্বাস্থ্যঝুকি

সন্তান জন্ম দেওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তাই পরিণত বয়সে গর্ভধারণ করলে মানসিক ও শারীরিক জটিলতা তেমন একটা দেখা যায় না। এ সময়ে যেসব শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হলে দুর্ভাবনারও কিছু থাকে না এবং একটি সুস্থ শিশু জন্ম নেয়। অপরিণত বয়সে একটি মেয়ের মা হওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা কিংবা শারীরিক প্রস্তুতি বা পূর্ণতা থাকে না। একটি মেয়ে যদি ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভবর্তী হয়, তখন তাদের নিজেদেরই শারীরিক বৃদ্ধি ও পঠন সম্পূর্ণ হয় না বলে তার নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া অপরিণত বয়সের একটি মেয়ের সন্তান ধারণ এবং সন্তান জন্ম দেওয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকে না। কাজেই সে তার গর্ভের সন্তান এবং তার নিজের শরীরকে ঠিকভাবে রক্ষা করতে পারে না। অপরিণত বয়সে যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তবে শুধু যে মেয়েটিই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়; ভবিষ্যৎ শিশুটির জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এর কারণে পুরো পরিবার এবং সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্বাস্থ্যগত সমস্যা

অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, শরীরে পানি আসা, খুব বেশি ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটে থাকে। তাছাড়া মা ও সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে।অপরিণত বয়সে গর্ভে সন্তান এলে সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য গর্ভে পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বড় হওয়ার পর এসব শিশু স্বাস্থ্যবান এবং সফল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে না।বিদ্যালয়ে পড়ার সময় যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তবে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় (চিত্র ৪.০৭)। সে লজ্জায় আর বিদ্যালয়ে যায় না। তার মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং নানা অশান্তিতে ভোগে। শারীরিক দিক থেকেও সে চলাফেরা করতে সমস্যায় (চিত্র ৪.০৮ ) পড়ে। এসব কারণে সে ঘরে বসেও লেখাপড়া করতে পারে না।

পারিবারিক সমস্যা

অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা সুস্থভাবে অন্যান্য কাজকর্ম করতে পারে না। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে তার পরিবারের অশান্তি দেখা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার বাল্যবিবাহের হার খুব বেশি এবং দেখা পেছে, সেখানে অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের দম্পতির মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

আর্থিক সমস্যা

স্বাভাবিক গর্ভধারণে চিকিৎসকের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ হলেই কাজ চলে যায় কিন্তু অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করলে নয় মাসের পুরো সময় জুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। এছাড়া কোনো জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিলে বারবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। চিকিৎসক এবং ঔষধপত্রের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। গর্ভবর্তী মায়ের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাদ্যেরও ব্যবস্থা করতে হয়। এতেও বেশ অর্থের প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে পরিবারের উপর একটি বড় ধরনের আর্থিক চাপ পড়ে (চিত্র ৪.০৯)।

গর্ভপাত কী এবং গর্ভপাতের জটিলতা

একটি মেয়ের গর্ভে যখন সন্তান আসে তখন প্রথম ভ্রুণ   হিসেবে জরায়ুতে তার বৃদ্ধি ঘটে। ভ্রূণের  বৃদ্ধি  অবস্থায় কোনো কারণে সময়ের আগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জরায়ু থেকে ভ্রুণ বের হয়ে যাওয়াকে গর্ভপাত বলে। গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেও অনেকে গর্ভপাত ঘটায়।গর্ভধারণের ফলে সঙ্গীর চাপ, অন্যের প্রভাব এবং হতাশার কারণে অনেক মেয়ে আনাড়ি গর্ভপাতকারীদের কাছে যায় এবং অত্যন্ত  ঝুঁকিপূর্ণভাবে গর্ভপাত ঘটায়। এ ধরনের গর্ভপাতের ফলে মেয়েদের বড় ধরনের শারীরিক ঝুঁকি ছাড়াও তাদের উপর মানসিক এবং প্রবল আবেগীয় প্রভাব পড়ে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।

কাজ : অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের সমস্যাসমূহ ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায়  চিত্রেলিপিবদ্ধ কর।

 

৪.১.৬ টেস্টটিউব বেবি

কৃত্রিম উপায়ে দেহের বাইরে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে প্রাথমিক ভ্রূণ সৃষ্টি করে সেটি নারীদের জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হলে তাকে টেস্ট টিউব বেবি বলা হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম না হলে অনেক বাবা-মা এই প্রক্রিয়ায় সন্তানদের জন্ম দিতে আগ্রহী হন। দেহের বাইরে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটানোকে বলে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। ইটালির বিজ্ঞানী ড. পেট্রসি (Dr. Petrucci) ১৯৫৯ সালে প্রথম টেস্টটিউব বেবি জন্ম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে তিনি ততটা সফলতা অর্জন করতে পারেননি, শিশুটি মাত্র ২৯ দিন বেঁচে ছিল। এর প্রায় ১৯ বছর পর ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের ড. প্যাট্রিক স্টেপটো ও ড. রবার্ট এডওয়ার্ডের প্রচেষ্টায় লুইস জয় ব্রাউন নামে একটি টেস্টটিউব বেবি জন্মায়। পর্যায়ক্রমে কতগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ঘটিয়ে টেস্টটিউব বেবির জন্ম দেওয়া হয় ।প্রক্রিয়াগুলো হলো (১) সক্ষম দম্পতি থেকে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু সংগ্রহ করে বিশেষ ধরনের পালন মাধ্যমে (Culture medium) এদের মিলন ঘটান। (২) অতঃপর পালন মাধ্যমে প্রাথমিক ভ্রূণ উৎপাদন। ( ৩ ) উৎপাদিত ভ্রূণকে স্ত্রী জরায়ুতে প্রতিস্থাপন এবং সবশেষে (৪) প্রসূতির পরিচর্যা ও সন্তান লাভ সম্পন্ন করা। নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভের জন্য আজকাল এই প্রক্রিয়া আমাদের দেশেও বেশ ভালোভাবে চালু হয়েছে।

Content added || updated By
Promotion