আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের পলিমার। এদের কোনোটি প্রাকৃতিক আবার কোনোটি কৃত্রিম। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি মুহূর্তও কল্পনা করতে পারব না, যখন আমরা কোনো না কোনো পলিমার ব্যবহার করছি না। কিছু কিছু পলিমার আছে, যেগুলো পরিবেশবাদ্ধব, আবার কোনো কোনোটি পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এই অধ্যায়ে আমরা পলিমারকে চিনতে শিখব, কোনটি ব্যবহার করব কোনটি থেকে দূরে থাকব সেটিও আমরা বুঝতে শিখৰ ।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা :
পূর্বেকার দিনে রাজা-রাণীরা রেশমি পোশাক পরত। যা রেশম থেকে পাওয়া যেত। যা এক ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি ।
আবুল সাহেব বাজার থেকে মেলামাইনের প্লেট কিনে আনলেন।
মেলামাইনের থালা-বাসন, বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড, কার্পেট, পিভিসি পাইপ, পলিথিনের ব্যাগ, পাটের ব্যাগ, সিল্কের কাপড়, উলের কাপড়, সুতি কাপড়, নাইলনের সুতা, রাবার – এসব জিনিস আমাদের খুবই পরিচিত, আমরা সবসময়েই এগুলো ব্যবহার করছি। এগুলো সবই পলিমার। পলিমার (Polymer) শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ পলি (Poly) ও মেরোস (Meros) থেকে। পলি শব্দের অর্থ হলো অনেক (Many) এবং মেরোস শব্দের অর্থ অংশ (Part)। অর্থাৎ অনেকগুলো একই রকম ছোট ছোট অংশ জোড়া দিয়ে যে একটি বড় জিনিস পাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে পলিমার। তোমরা একটা লোহার শিকলের কথা চিন্তা করতে পার। লোহার ছোট ছোট অংশ জোড়া দিয়ে একটি বড় শিকল তৈরি হয়। অর্থাৎ বড় শিকলটি হলো এখানে পলিমার। রসায়ন বিজ্ঞানের ভাষায়, একই ধরনের অনেকগুলো ছোট অণু পর পর যুক্ত হয়ে পলিমার তৈরি করে। যে ছোট অণু থেকে পলিমার তৈরি হয়, তাদেরকে বলে মনোমার (Monomer)।
আমরা যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করি, তা হলো “ইথিলিন” নামের মনোমার থেকে তৈরি পলিমার। একইভাবে আমরা যে পিভিসি পাইপ (PVC) ব্যবহার করি, তা হলো ভিনাইল ক্লোরাইড নামের মনোমার থেকে তৈরি পলিমার। তবে সব সময় একটি মনোমার থেকেই পলিমার তৈরি হবে এমন কোনো কথা নেই, একের অধিক মনোমার থেকেও পলিমার তৈরি হতে পারে। যেমন: বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড বা বৈদ্যুতিক সুইচ হলো বাকেলাইট নামের একটি পলিমার, যা তৈরি হয় ফেনল ও ফরমালডিহাইড নামের দুটি মনোমার থেকে। আবার মেলামাইনের থালা-বাসন হলো মেলামাইন রেজিন নামের পলিমার, যা তৈরি হয় মেলামাইন ও ফরমালডিহাইড নামের দুটি মনোমার থেকে। শুরুতে আমরা পলিমারের যে উদাহরণগুলো দেখেছি, তাদের মধ্যে কিছু কিছু প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। এদেরকে আমরা বলি প্রাকৃতিক পলিমার ।
এখন তোমরা নিজেরাই বল শুরুতে দেওয়া উদাহরণগুলোর মধ্যে কোনগুলো প্রাকৃতিক পলিমার?
পাট, সিল্ক, সুতি কাপড়, রাবার—এগুলো প্রাকৃতিক পলিমার। অন্যদিকে মেলামাইন, রেজিন, বাকেলাইট, পিভিসি, পলিথিন—এগুলো প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, শিল্প-কারখানায় কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে হয়। তাই এরা হলো কৃত্রিম পলিমার।
৬.১.১ পলিমারকরণ প্রক্রিয়া
মনোমার থেকে পলিমার তৈরি হয় নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনোমার সংযুক্ত করে পলিমার তৈরি হয়, তাকেই বলে পলিমারকরণ প্রক্রিয়া। সাধারণত পলিমারকরণে উচ্চ চাপ এবং তাপের প্রয়োজন হয়। যদি দুটি মনোমার একসাথে যুক্ত হয় তাহলে উৎপন্ন পদার্থটি কেমন হবে? বুঝতেই পারছ তাহলে উৎপন্ন পদার্থটিতে দুটির বেশি মনোমার থাকতে পারবে না। আমরা এটিকে এভাবে লিখতে পারি :
১টি মনোমার + ১টি মনোমার → মনোমার-মনোমার কিংবা এটাকে আমরা অন্যভাবেও লিখতে পারি (মনোমার)2
তিনটি মনোমার হলে উৎপন্ন পদার্থটিতে তিনটি মনোমার থাকবে অর্থাৎ আমরা লিখতে পারি: ১টি মনোমার + ১টি মনোমার + ১টি মনোমার → মনোমার - মনোমার - মনোমার বা ( মনোমার ও
আমরা যদি n সংখ্যক মনোমার নিয়ে একটি পলিমার বানাতে চাই, তাহলে পলিমারকরণ প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত উপায়ে দেখানো যায় :
মনোমার + মনোমার + মনোমার → (মনোমার) n কিংবা n মনোমার → ( মনোমার) n
আমরা পলিথিনের কথা বলেছি, তোমরা কি জান কিভাবে পলিথিন তৈরি হয়? ইথিলিন গ্যাসকে ১০০০-১২০০ বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ২০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে পলিথিন পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে পলিমারকরণ দ্রুত করার জন্য প্রভাবক হিসেবে অক্সিজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। n (ইথিলিন (উচ্চতাপ ও চাপ ) → পলিথিন
(02 প্রভাবক)
কিংবা,
n (CH₂ = CH₂)
(উচ্চতাপ ও চাপ )
(02 প্রভাবক) → ( CH2 - CH,-)n
তবে উচ্চ চাপ পদ্ধতি সহজসাধ্য না হওয়ায় বর্তমানে পদ্ধতিটি তেমন জনপ্রিয় নয়। এখন টাইটেনিয়াম ট্রাইক্লোরাইড (Ticl.) নামক প্রভাবক ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলীয় চাপেই পলিথিন তৈরি হয়।
তোমরা জান যে আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো বস্ত্র বা কাপড়। এই বস্ত্ৰ আমাদেরকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করে এবং আমরা বস্ত্র দিয়ে সুন্দর পোশাক তৈরি করি। বস্ত্র বা কাপড়-চোপড় আধুনিক সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তোমরা কি জান, বস্ত্র বা কাপড় কীভাবে তৈরি হয়? সব বস্ত্রই তৈরি হয় সুতা থেকে। আবার সুতা তৈরি হয় তন্তু থেকে। তন্তু ক্ষুদ্র আঁশ দিয়ে তৈরি। তাই তন্তু বলতে আমরা আঁশজাতীয় পদার্থকেই বুঝি, তবে বস্ত্রশিল্পে তন্তু বলতে বুনন এবং বয়নের কাজে ব্যবহৃত আঁশসমূহকেই বুঝায়। তন্তু দিয়ে সুতা আর কাপড় ছাড়াও কার্পেট, ফিল্টার, তড়িৎ নিরোধক দ্রব্য ইত্যাদি বিভিন্ন রকম পদার্থ তৈরি করা হয়।
আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় তন্তু উৎস অনুযায়ী দুই রকম হয়। সুতি কাপড় তৈরির জন্য তুলা (Cotton), পাট, লিনেন, রেশম, পশম, উল, সিল্ক, অ্যাসবেস্টস, ধাতব তন্তু ইত্যাদি যেগুলো প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, সেগুলোকে আমরা প্রাকৃতিক তন্তু বলি। অন্যদিকে পলিস্টার, রেয়ন, ডেক্রন, নাইলন ইত্যাদি যেগুলো বিভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়, সেগুলো হলো কৃত্রিম তন্তু।প্রাকৃতিক তন্তুগুলোর মধ্যে আবার তুলা, পাট ইত্যাদি পাওয়া যায় উদ্ভিদ থেকে। তাই এদেরকে উদ্ভিদ তন্তু বলে। অন্যদিকে রেশম, পশম এগুলো পাওয়া যায় প্রাণী থেকে। তাই এদেরকে প্রাণিজ তন্তু বলে। আবার ধাতব তন্তু পাওয়া যায় প্রাকৃতিক খনিতে। তাই এদেরকে খনিজ তন্তু বলে।
অন্যদিকে কৃত্রিম তন্তু আবার দুরকমের হয়। সেলুলোজিক তন্তু এবং নন সেলুলোজিক তন্তু। তোমরা জান যে সেলুলোজ হলো একধরনের সূক্ষ্ম আঁশযুক্ত পদার্থ, যা দিয়ে উদ্ভিদ এবং প্রাণী কোষ তৈরি হয়। রেয়ন, এসিটেট রেয়ন, ভিসকোস রেয়ন, কিউপ্রা অ্যামোনিয়াম – রেয়ন, এগুলো সেলুলোজকে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় বলে এদেরকে সেলুলোজিক তন্তু বলে।যেসব কৃত্রিম তন্তু সেলুলোজ থেকে তৈরি না করে অন্য পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি করা হয়, তারাই হলো নন-সেলুলোজিক তন্তু। নাইলন, পলিস্টার, পলি প্রোপিলিন, ডেব্ৰুন—এগুলো হলো নন সেলুলোজিক কৃত্রিম তন্তু।
৬.২.১ তন্তুর বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার
একটি পোশাক আরামদায়ক কি না তা নির্ভর করে এটি কী ধরনের কাপড় দিয়ে তৈরি তার ওপর। আবার কাপড় তৈরি হয় সুতা থেকে, যা আসে তন্তু থেকে। কাজেই তন্তুর বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এখন ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম তন্তুর বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নেওয়া যাক।
তুলা
গরমের দিনে আমরা সুতির পোশাক পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি কেন? কারণ সুতির তাপ পরিবহন এবং পরিচলন ক্ষমতা বেশি। তুলার আঁশ থেকে সুতা তৈরি হয়। প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ তন্তুর মধ্যে প্রধান হলো সুতা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে (চিত্র ৬.০১) সুতির তন্তুকে অনেকটা নলের মতো দেখায়। নলের মধ্যে যে সরু পদার্থটি থাকে তা প্রথম অবস্থায় 'লুমেন' (Lumen) নামক পদার্থে পূর্ণ থাকে। পরে আঁশগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার পর রোদের প্রভাবে শুকিয়ে যায় এবং নলাকৃতি তন্তুটি ধীরে ধীরে চ্যাপ্টা হয়ে ক্রমে
চিত্র ৬.০১ : অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে সুভিদু
একটি মোচড়ানো ফিতার মতো রূপ ধারণ করে। এই ফিতার মতো সুতির আঁশে ১০০ থেকে ২৫০টি পর্যন্ত পাক বা মোচড় থাকে।বস্ত্র বা কাপড় তৈরির সময় এই মোচড়ানো অংশ একে অপরের সাথে সুন্দরভাবে মিশে যায় বলে সুতি বস্ত্র টেকসই হয়। আপাতদৃষ্টিতে সুতি তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে ময়েশ্চারাইজেশনের (moisturization ) মাধ্যমে একে উজ্জ্বল ও চকচকে করে তোলা যায়। সুতি তন্তুকে রং করা হলে সেটি পাকা রং হয় এবং তাপ ও ধোয়ার ফলে রংয়ের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। অজৈব এসিডের সংস্পর্শে সুতি তন্তু নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু অন্যান্য এসিডের সংস্পর্শে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। সুতির বস্ত্র ব্যবহারের তেমন বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয় না বলে এর অনেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে। সুতি বস্ত্রের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটি সংকুচিত হয়ে যায়।
রেশম (silk)
আগেকার দিনের রাজা-রানির পোশাক বলতে আমরা সিল্কের বা রেশমি পোশাকই বুঝি। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, বিলাসবহুল বন্ধ তৈরিতে রেশম ত ব্যবহৃত হয়। রেশমের প্রধান গুণ হচ্ছে এর সৌন্দর্য। তিন শতাধিক রঙের রেশম পাওয়া যায়। রেশম বা পলু পোকা নামে এক প্রজাতির পোকার গুটি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রেশমের তন্তু আহরণ করা হয়। রেশম মূলত ফাইব্রেয়ন (Fibroln) নামের এক ধরনের প্রোটিন—জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। প্রাকৃতিক প্রাণিজ তন্তুর মধ্যে রেশম সবচেয়ে শক্ত এবং দীর্ঘ। বিভিন্ন গুণাগুণের জন্য রেশমকে তস্তুর রানি বলা হয়। সূর্যালোকে রেশম দীর্ঘক্ষণ রাখলে এটি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়। রেশম হালকা কিন্তু অনেক বেশি উষ্ণ এবং খুবই অল্প জায়গায় রেশমি বা সিল্কের কাপড় রাখা যায়।
পশম (Wool)
আমরা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে পোশাকের কথা সবার আগে ভাবি, সেটি হচ্ছে পশম বা উলের পোশাক। ভাপ কুপরিবাহী বলে পশমি পোশাক শীতবস্ত্র হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। নমনীয়তা, স্থিতিস্থাপকতা, কুঞ্চন প্রতিরোধের ক্ষমতা, রং ধারণক্ষমতা—এগুলো হচ্ছে উল বা পশমের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই তক্ষুর মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকে যেখানে বাতাস আটকে থাকতে পারে। বাতাস তাপ অপরিবাহী তাই পশম বা উলের কাপড় তাপ কুপরিবাহী। পশমি কাপড় পরে থাকলে শীতের দিনে শরীর থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে পারে না, তাই এটি গায়ে দিলে আমরা গরম অনুভব করি। লঘু এসিড এবং ক্ষারে পশমের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে মথ পোকা খুব সহজে পশম তন্তু নষ্ট করে। এছাড়া কিছু ছত্রাক পশম তন্তুকে খুব সহজে আক্রান্ত করে নষ্ট করে দিতে পারে।
পশম একটি অভি প্রাচীন তন্তু। বিভিন্ন জাতের ভেড়া বা মেষের লোম থেকে পশম উৎপন্ন হয়। প্রায় ৪০ জাতের মেষ থেকে ২০০ ধরনের পশম তৈরি করা হয়। জীবন্ত মেষ থেকে লোম সরিয়ে যে পশম তৈরি করা হয়, তাকে বলে 'ফ্লিস উন' (Fleece wool)। মৃত বা জবাই করা মেষ থেকে যে পশম তৈরি করা হয়, তাকে বলে 'গুপ্ত উল' (Pulled wool)। মানুষের চুল ও নখে যে প্রোটিন থাকে, অর্থাৎ কেরাটিন (Keratin), সেটি দিয়ে পশম তন্তু গঠিত পশমের মধ্যে আলপাকা, মোহেরা, কাশ্মিও, ভিকুনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কৃত্রিম নন-সেলুলোজিক তন্তুর মাঝে নাইলন সর্বপ্রধান। সাধারণত এটিপিক এসিড এবং হেক্সামিথিলিন ডাই অ্যামিন নামক রাসায়নিক পদার্থের পলিমারকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাইলন তৈরি হয়। নাইলনকে প্রধানত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়— নাইলন ৬৬ এবং নাইলন ৬।নাইলন খুব হালকা ও শক্ত। ভিজলে এর স্থিতিস্থাপকতা বিপুণ হয়। এটি আগুনে পোড়ে না, তবে পলে পিয়ে বোরাক্স বিজের Borax Bead এর মতো স্বচ্ছ বিদ্ধ গঠন করে। কার্পেট, দড়ি, টায়ার, প্যারাসুটের কাপড় ইত্যাদি তৈরি করতে নাইলন ব্যবহৃত হয়।
রেয়ন
কৃত্রিম তন্তুর মধ্যে রেয়ন (চিত্র ৬.০২) হলো প্রধান এবং প্রথম তন্তু। উদ্ভিজ্জ সেলুলোজ ও প্রাণিজ পদার্থ থেকে রেয়ন তৈরি করা হয়। তিন প্রকারের প্রধান রেরন হলো (১) ভিসকোস, (২) কিউপ্রামোনিয়াম এবং (৩) অ্যাসিটেট। এগুলো শুধু সুন্দর, উজ্জ্বল, মনোরম, অভিজাত এবং আকর্ষণীয় নয়, এগুলো মোটামুটি টেকসই। লঘু এসিডের সাথে তেমন কোনো বিক্রিয়া করে না কিন্তু ধাতব লবণে রেয়ন সহজে বিক্রিয়া করে। অধিক উত্তাপে রেয়ন গলে যায়। ভাই রেয়ন কাপড়ে বেশি গরম ইস্ত্রি ব্যবহার করা যায় না।
অ্যাসিটেট
ভিসকোস
কিউপ্রামোনিয়াম (আড়াআড়িভাবে
চিত্র ৬.০২: অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেয়ন তন্দুর ৰূপ
৬.২.২ তন্তু থেকে সুতা তৈরি
তন্তু দিয়ে কি সরাসরি কাপড় বানানো যায়? না, যায় না। তন্তু দিয়ে প্রথমে সুতা তৈরি করা হয়, অতঃপর সেই সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি হয়। তন্তু থেকে কোন প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি হবে, সেটা নির্ভর করে তন্তুর বৈশিষ্ট্যের ওপর। একেক রকমের তন্তুর জন্য একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। তাহলে এখন আমরা সুতা তৈরির বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে জেনে নিই ।
তন্তু সংগ্রহ
যেকোনো ধরনের সুতা তৈরির প্রধান ধাপ হলো তন্তু সংগ্রহ, তন্তুর উৎস অনুযায়ী সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন: তুলার বেলায় গাছ থেকে কার্পাস ফল সংগ্রহ করে বীজ থেকে তুলা আলাদা করে ফেলা হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম হলো জিনিং। জিনিং প্রক্রিয়ায় পাওয়া তন্তুকে বলে কটন লিন্ট। অনেকগুলো কটন লিন্ট একসাথে বেঁধে গাঁট তৈরি করা হয়। এই গাঁট থেকেই স্পিনিং মিলে সুতা কাটা হয়।
তোমরা বল দেখি, পাট বা পাটজাতীয় (যেমন: শণ, তিসি ইত্যাদি) গাছ থেকে কী একই পদ্ধতিতে তন্তু সংগ্রহ করা যাবে? না, যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রে বীজ থেকে তন্তু সংগ্রহ করা হয় না, তন্তু সংগ্রহ করা হয় সরাসরি গাছের বাকল থেকে। এর জন্য গাছ কেটে পাতা ঝরানোর জন্য প্রথমে কয়েক দিন মাঠেই একসাথে জড়ো করে রাখা হয়। এতে সাধারণত ৫-৮ দিন সময় লাগে। এলাকাভেদে জড়ো করে রাখা গাছকে চেল্লা বা পিল বলে। এভাবে জড়ো করে রাখার ফলে উদ্ভিদের পাতায় পচন ধরে, তাই একটু ঝাঁকুনি দিলেই সেগুলো গাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। তবে খেয়াল রাখতে হয় গাছের পাতা যেন পুরোপুরি পচে না যায়। তখন পচা পাতা গাছের গায়ের সাথে লেগে যায়, যা সরানো কষ্টসাধ্য। পাতা ঝরানোর পর গাছগুলো একসাথে আটি বেঁধে ১০-১৫ দিন পানিতে ডুবিয়ে পচানো হয়। পচে গেলে খুব সহজেই গাছ থেকে আঁশ বা তন্তু আলাদা করা যায়। গাছ থেকে আঁশ আলাদা করে পানিতে ধুয়ে সেগুলো রৌদ্রে শুকানো হয়। শুকনো আঁশ একত্রিত করে গাঁট বা বেল বাঁধা হয়। তুলার মতোই এই গাঁট বা বেল সুতা কাটার জন্য স্পিনিং মিলে নেওয়া হয়।
এবার প্রাণিজ তন্তু কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, সেটা দেখা যাক। তোমরা আগেই জেনেছ যে রেশমি সুতা তৈরি হয় রেশম তন্তু থেকে। এক্ষেত্রে সরাসরি সুতা উৎপাদিত হয়, অন্য কোনো প্রক্রিয়ার দরকার হয় না। কৃত্রিম তন্তুর বেলাতেও কিন্তু রেশম তন্তুর মতো সরাসরি সুতা তৈরি হয়। কিন্তু উল বা পশমি সুতার জন্য দরকারি প্রাণিজ তন্তু অর্থাৎ প্রাণিজ পশম, লোম বা চুল। এগুলো সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে কেটে নিয়ে। এভাবে প্রাণীর দেহ থেকে লোম, পশম, চুল কেটে নিলে কি তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়? আসলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না, পশম বা লোম কেটে নেওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যে আবার লোম গজায়, যা বড় হলে আবার কেটে সংগ্রহ করা হয়। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে একই পশুর গা থেকে বারবার পশম সংগ্রহ করা যায়। আমরা আগেই বলেছি, এভাবে সংগ্রহ করা পশম, লোম বা চুলকে ফ্লিস উল বলা হয়। এই ফ্লিস উল বস্তায় করে সুতা কাটার জন্য স্পিনিং মিলে আনা হয়।
সুতা কাটা (Spinning ) সুতা কাটা হয় স্পিনিং মিলে (চিত্র ৬.০৩)। সাধারণত একটি মিল বা কারখানার এক ধরনের তন্তু থেকে সুতা কাটা হয়। কারণ সুতা কাটার যে বিভিন্ন ধাপ রয়েছে, তা একেক ধরনের তন্তুর জন্য একেক রকম। এজন্য ভিন্ন ভিন্ন তঙ্কু থেকে তৈরি সুতার কারখানাও আলাদা। তবে তন্তুভেদে সুতা কাটার পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকলেও কিছু কিছু মিলও আছে। এখন আমরা তন্তু থেকে সুতা কাটার পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।
ব্লেন্ডিং ও মিক্সিং
কারখানায় আনা তন্তুর বেল বা গাঁট ব্লেন্ডিং রুমে নিয়ে প্রথম খুলে ফেলা হয়। এরপর বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে এক সাথে গুচ্ছাকারে থাকা তন্তুকে ভেঙে যথাসম্ভব ছোট ছোট গুচ্ছে পরিণত করা হয়। এ সময় তন্তুর সাথে থাকা ময়লার ছোট ছোট টুকরা, বীজ বা পাতার ভাঙা কোনো অংশ ইত্যাদিও দূর করা হয়। এরপর বিভিন্ন রকম তুলার একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এই মিশ্রণ তৈরি করা হয় কেন? তার কারণ হলো, গুণে এবং মানে ঠিক একই রকম তুলা সব সময় পাওয়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন রকম তুলার মিশ্রণ না করলে একেক সময় একেক রকম সুতা তৈরি হবে, কখনো ভালো, কখনো মন্দ অর্থাৎ সুতার মান এক হবে না। এছাড়া বিভিন্ন রকম তুলা মিশিয়ে সুতা তৈরি করলে উৎপাদন খরচও কম হয়। এটি বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য। কারণ এখানে বাণিজ্যিকভাবে তুলার উৎপাদন হয় না বললেই চলে। বেশির ভাগ তুলা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। একেক দেশের তুলার মানও একেক রকম হয়। একই রকম তুলার যোগান পাওয়া বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। এজন্য বিভিন্ন রকম তুলা সংগ্রহ করে সেগুলোর মিশ্রণ তৈরি করা হয়। বেল বা গাঁট থেকে তুলার এই মিশ্রণ তৈরিই হলো ব্লেন্ডিং এবং মিক্সিং। তবে পাট ভল্লুর বেলায় এই প্রক্রিয়াকে ব্যাচিং (Batching) বলে।
কার্ডিং ও কম্বিং (Carding & Combing) সূতা কাটার দ্বিতীয় ধাপ হলো কার্ডিং ও কম্বিং । তুলা, লিনেন, পশম—এসব তন্তুর বেলায় এই ধাপটি প্রয়োগ করা হয়। ভত্তুর বৈশিষ্ট্য ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কার্ডিং এবং কম্বিংয়ের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ঠিক করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী অতি ছোট তন্তু বাদ দেওয়া হয় এবং ধুলাবালি বা ময়লার কণা থাকলে সেগুলোও দূর করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু কার্ডিং করলেই চলে। তবে মিহি মসৃণ ও সন্তু সুতা তৈরি করতে হলে কম্বিং দরকার হয়। লিনেন তন্তুর জন্য বিশেষ ধরনের কম্বিং করা হয়, যা হেলকিং নামে পরিচিত। হেলকিং করলে সুতা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মিহি হয়। কার্ডিং ও কম্বিং করে প্রাপ্ত তন্তু পাতলা আস্তরের মতো হয় এবং এটিকে স্লাইভার (Sliver) বলে। এ স্লাইভার পাকালেই সুতা তৈরি হয়। পাকানোই হলো মূলত স্পিনিং। এ পর্যায়ে স্লাইভারকে টেনে ক্রমশ অধিকতর সরু করা হয়। একসময় স্লাইভারের শেষ প্রান্তে মাত্র কয়েক গোছা তন্তু বিদ্যমান থাকে। এভাবে পরিবর্তিত স্লাইভারকে মোচড়ানো হয় বা পাক দেওয়া হয়। স্লাইভারকে টেনে সরু করার প্রক্রিয়া হলো রোডিং আর টুইস্টিং (Twisting)। স্লাইভারকে পাক দেওয়া বা মোচড় দেওয়ার ফলে তন্তুগুলো একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে লেগে যায় এবং সুতায় পরিণত হয়। পাকানো কিংবা মোচড় কম-বেশি করে সুতা শক্ত বা নরম করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই মোচড় বেশি দিলে সুতা বেশি শক্ত হয়, তবে মোচড় অতিরিক্ত হলে সুতা ছিঁড়ে যেতে পারে। পাকানো বা মোচড়ের পরিমাণ নির্ভর করে মূল তন্তুর বৈশিষ্ট্যের উপর। সাধারণত লম্বা তন্তুর বেলায় (যেমন: পাট বা লিনেন) তুলনামূলকভাবে বেশি মোচড় দিতে হয়। টুইস্ট কাউন্টার (Twist Counter) নামের একধরনের যন্ত্রের সাহায্যে এ কাজ করা হয় ।
রেশম তন্তু থেকে রেশম সুতা তৈরি রেশম পোকা থেকে তৈরি হয় একধরনের গুটি। একে কোকুন (Cocoon) বলে। পরিণত কোকুন বা গুটি সাবান পানিতে লোহার কড়াইয়ে সেদ্ধ করা হয়। এতে কোকুনের ভেতরকার রেশম পোকা মরে যায় এবং গুটি কেটে বের হয়ে রেশমের গুটি নষ্ট করতে পারে না। সিদ্ধ করার কারণে কোকুন নরম হয়ে যায় এবং ওপর থেকে খোসা খুব সহজেই আলাদা হয়ে যায়। খোসা উঠে গেলে রেশমি তন্তুর প্রান্ত বা নাল পাওয়া যায়। এই নাল ধরে আস্তে আস্তে টানলে লম্বা সুতা বের হয়ে আসে (চিত্র ৬.০৪)। চিকন বা মিহি সুতার জন্য ৫-৭টি কোকুনের নাল আর মোটা সুতার জন্য ১৫-২০টি কোকুনের নাল একত্রে করে টানা হয়। এ কাজে চরকা ব্যবহার করা হয়। ছবিতে চরকার সাহায্যে কোকুন থেকে সুতা তৈরি দেখানো হয়েছে। নালগুলো একত্রিত করলে এদের গায়ে লেগে থাকা আঠার কারণে একটি আরেকটির সাথে লেগে গিয়ে সুতার গোছা তৈরি হয়।
কৃত্রিম তন্তু থেকে সুতা তৈরি কৃত্রিম তন্তু থেকে সুতা তৈরির পদ্ধতি প্রায় সব তন্তুর ক্ষেত্রে একই রকম। একের অধিক ক্ষুদ্র আঁশ ও উপযুক্ত দ্রাবকের সাহায্যে ঘন ও আঠালো দ্রবণ তৈরি করা হয়। এই দ্রবণ হলো স্পিনিং দ্রবণ। এই স্পিনিং দ্রবণকে স্পিনারেট (চিত্রে) নামক বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রপথে উচ্চ চাপে প্রবাহিত করা হয়। দ্রবণকে জমাট বাঁধানোর জন্য এর সাথে প্রবাহপথে উপযুক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এতে স্পিনারেট থেকে সুতার দীর্ঘ নাল বের হয়ে আসে, যা সরাসরি ব্যবহারযোগ্য। এই সুতা কাপড় তৈরি বা বয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়।
রেশম পোকার ডিম
ডিম ফুটে বের হওয়া মধ
কোকুন
কোকুন থেকে বের হওয়া আঁশ
পরিণত কোকুন সাবান পানিতে সিদ্ধ হচ্ছে
প্রতিটি মধ তার চারপাশে কোকুন তৈরি করল
রেশম রঙ করা হচ্ছে
স্পিনারেটে সুতা তৈরি হচ্ছে
সুতা থেকে কাপড় বোনা হচ্ছে
চিত্র ৬.০৪: রেশম তন্তু থেকে সুতা তৈরি
বিভিন্ন ধরনের সুতার বৈশিষ্ট্য
সব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে সুতার বৈশিষ্ট্য তার তন্তুর বৈশিষ্ট্যের মতো। তোমরা যেহেতু তন্তুর বৈশিষ্ট্য জেনেছ, তাই নিশ্চয়ই সুতার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সেটি বুঝতে পারছ।
অনুসন্ধান
কাজ: তাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন প্রকার সুতার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: সিল্ক, উল, সুতি কাপড়, পলিস্টার কাপড়, নাইলন ইত্যাদি কাপড় বা সুতা, একটি মোমবাতি ও দিয়াশলাই।
পদ্ধতি: দিয়াশলাই দিয়ে মোমবাতি জ্বালাও। এবার একে একে কাপড় বা সুতা দিয়ে নিয়ে পুঁড়িয়ে দেখ কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে। সুতি কাপড়ের বেলায় কী ঘটল? কাপড় খুব দ্রুত পুড়ে গেল। কোনো পথ পাওয়া গেল কি? হ্যাঁ, কাগজ পোড়ালে যে রকম পদ্ধ পাওয়া যায়, অনেকটা সে রকম গন্ধ পাওয়া গেল। কারণ হলো, কাগজে যেমন সেলুলোজ থাকে, তুলা দিয়ে তৈরি সুতি কাপড়েও তা থাকে। আর সে কারণেই একই রকম গন্ধ পাওয়া যায়। নাইলন পুড়িয়ে কী দেখলে? সুতি কাপড়ের মতো এটিও কি দ্রুত পুড়ে গেল? না, অতটা দ্রুত পুড়ল না, ধীরে ধীরে পুড়ল। পোড়া শেষে একটি গুটির মতো তৈরি হলো, যা সুতি কাপড়ের বেলায় হয়নি। আবার কাগজ পোড়ানোর মতো গন্ধও পাওয়া গেল না, কারণ নাইলন সেলুলোজ থেকে তৈরি হয় না। এভাবে তোমরা সবগুলো কাপড় ও সুতার বৈশিষ্ট্য টেবিল করে খাতায় লিপিবদ্ধ কর।
৬.৩.১ রাবার
তোমরা পেনসিলের লেখা মোছার জন্য যে ইরেজার ব্যবহার কর, সেটি কী ধরনের বস্তু জান? এটি হলো রাবার। সাইকেল, রিক্সা বা অন্যান্য গাড়ির টায়ার, টিউব, জন্মদিনে ব্যবহৃত বেলুন— এসবই রাবারের তৈরি। পানির পাইপ, সার্জিক্যাল মোজা, কনভেয়ার বেল্ট, রাবার ব্যান্ড, বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর নিপল— এগুলোও রাবারের তৈরি সামগ্রী। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, রাবার এবং রাবারজাত পণ্যসামগ্রী আমাদের জীবনের অনেক কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবার তাহলে রাবার সম্পর্কে আরো একটু বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
রাবারের ভৌত ধর্ম
প্রাকৃতিক রাবার পানিতে অদ্রবণীয় একটি অদানাদার কঠিন পদার্থ। রাবার কিছু কিছু জৈব দ্রাবক, যেমন : এসিটোন, মিথানল— এগুলোতে অদ্রবণীয় হলেও টারপেন্টাইন, পেট্রোল, ইথার, বেনজিন এগুলোতে সহজেই দ্রবণীয়। রাবার সাধারণত সাদা বা হালকা বাদামি রঙের হয়। রাবার একটি স্থিতিস্থাপক পদার্থ অর্থাৎ একে টানলে লম্বা হয় এবং ছেড়ে দিলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বেশিরভাগ রাবারই তাপ সংবেদনশীল অর্থাৎ তাপ দিলে গলে যায়। বিশুদ্ধ রাবার বিদ্যুৎ এবং তাপ কুপরিবাহী। তবে আজকাল বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে তৈরি বিদ্যুৎ পরিবাহী রাবার আবিষ্কার করেছেন।
রাবারের রাসায়নিক ধর্ম
তোমরা জান, প্রায় প্রতিটি পদার্থ তাপ দিলে আয়তনে বাড়ে। কিন্তু রাবারের বেলায় ঠিক উল্টোটি ঘটে অর্থাৎ তাপ দিলে রাবারের আয়তন কমে যায়।রাবারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক ধর্ম হলো এটি বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- দুর্বল ক্ষার, এসিড, পানি এগুলোর সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে না। যে কারণে কোনো কিছু রক্ষা করার জন্য প্রলেপ দেওয়ার কাজে এটি ব্যবহৃত হয়।তোমরা কি খেয়াল করে দেখেছ, রাবার দীর্ঘদিন রেখে দিলে কী ঘটে? সেটি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
এর কারণ হলো, রাবার বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। অক্সিজেন ছাড়াও আরও কিছু রাসায়নিক পদার্থ, বিশেষ করে ওজোন (O,) প্রাকৃতিক রাবারের সাথে বিক্রিয়া করে, যার কারণে রাবার ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
৬.৩.২ প্লাস্টিক
প্লাস্টিক শব্দের অর্থ হলো সহজেই ছাঁচযোগ্য। নরম অবস্থায় প্লাস্টিক ইচ্ছামতো ছাঁচে ফেলে সেটা থেকে নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি বিশিষ্ট পদার্থ তৈরি করা যায়। আমরা বাসাবাড়িতে নানা রকম প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছি। মগ, বালতি, জগ, মেলামাইনের থালা-বাসন, পিভিসি পাইপ, বাচ্চাদের খেলনা, গাড়ির সিটবেল্ট, এমনকি আসবাবপত্র সবকিছুই প্লাস্টিকের তৈরি। তোমরা জান যে এগুলো সবই পলিমার পদার্থ। এবারে প্লাস্টিকের ধর্ম সম্পর্কে একটুখানি জেনে নেওয়া যাক।
প্লাস্টিকের ভৌত ধর্ম
প্লাস্টিক কি পানিতে দ্রবীভূত হয়? না, হয় না। বেশির ভাগ প্লাস্টিকই পানিতে অদ্রবণীয়। প্লাস্টিকের একটি গুরুত্বপুর্ণ ধর্ম হলো এরা বিদ্যুৎ এবং তাপ পরিবহন করে না। তাই বিদ্যুৎ এবং তাপ নিরোধক হিসেবে এদের বহুল ব্যবহার রয়েছে। প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো গলিত অবস্থায় এদেরকে যেকোনো আকার দেওয়া যায়। এই সুবিধার কারণেই এটি নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। তাপ দিলে প্লাস্টিকে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে? পলিথিন, পিভিসি পাইপ, পলিস্টার কাপড়, বাচ্চাদের খেলনা — এসব প্লাস্টিক তাপ দিলে নরম হয়ে যায় এবং গলিত প্লাস্টিক ঠাণ্ডা করলে শক্ত হয়ে যায়। এভাবে যতবারই এদেরকে তাপ দেওয়া যায়, এরা নরম হয় ও ঠাণ্ডা করলে শক্ত হয়। এগুলোকে থার্মোপ্লাস্টিকস (Thermoplastics) বলে।
অন্যদিকে মেলামাইন, বাকেলাইট (যা ফ্রাইং প্যানের হাতলে এবং বৈদ্যুতিক সকেটে ব্যবহার করা হয়) এগুলো তাপ দিলে নরম হয় না বরং পুড়ে শক্ত হয়ে যায়। এদেরকে একবারের বেশি ছাঁচে ফেলে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া যায় না। এই সকল প্লাস্টিককে থার্মোসেটিং প্লাস্টিকস (Thermosetting Plastics) বলে।
প্লাস্টিকের রাসায়নিক ধর্ম
বেশির ভাগ প্লাস্টিক রাসায়নিকভাবে যথেষ্ট নিষ্ক্রিয়। তাই বাতাসের জলীয় বাষ্প ও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে না এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। এমনকি পাতলা এসিড বা ক্ষারের সাথেও প্লাস্টিক বিক্রিয়া করে না। তবে শক্তিশালী ও ঘনমাত্রার এসিডে কিছু কিছু প্লাস্টিক দ্রবীভূত হয়ে যায়। প্লাস্টিক সাধারণত দাহ্য হয় অর্থাৎ এদেরকে আগুন ধরালে পুড়তে থাকে এবং প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে।
প্লাস্টিক কি পচনশীল? না, প্লাস্টিক পচনশীল নয়। দীর্ঘদিন মাটি বা পানিতে পড়ে থাকলেও এসব পচে না। অবশ্য বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পচনশীল প্লাস্টিক আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়। হাত-পা কেটে গেলে বা মেডিক্যাল অপারেশনে সেলাইয়ের কাজে যে সুতা ব্যবহৃত হয়। সেগুলো এক ধরনের পচনশীল প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক পোড়ালে অনেক ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হয়। যেমন: পিভিসি পোড়ালে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড (HCl) নিঃসৃত হয়। আবার পলিইউরেথেন (Polyurethane) প্লাস্টিক (যা আসবাবপত্র, যেমন: চেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) পোড়ালে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস এবং হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়।
৬.৩.৩ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় রাবার ও প্লাস্টিক
তোমরা জেনেছ যে বেশির ভাগ প্লাস্টিক এবং কৃত্রিম রাবার পচনশীল নয়। এর ফলে পুনর্ব্যবহার না করে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিলে এগুলো পরিবেশে জমা হতে থাকে এবং নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তোমরা কি খেয়াল করে দেখেছ ঢাকা বা অন্যান্য শহরের বেশির ভাগ নর্দমার নালায় প্রচুর প্লাস্টিক বা রাবার জাতীয় জিনিস পড়ে থাকে? এগুলো জমতে জমতে একপর্যায়ে নালা নর্দমা বন্ধ হয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেখা যায়, সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই রাস্তায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। একইভাবে প্লাস্টিক এবং বর্জ্য পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবস্থাপনা না করায় এর বড় একটি অংশ নদ-নদী, হৃদ বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। এভাবে জমতে থাকলে একসময় নদীর গভীরতা কমে যায়, যা নাব্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আবার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বা রাবারের বর্জ্য অনেক সময় মাটিতে থাকলে তা মাটির উর্বরতা নষ্ট করতে পারে। ফেলে দেওয়া এসব বর্জ্য অনেক সময় গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশুর খাবারের সাথে মিশে তাদের পাকস্থলীতে যায় এবং এক পর্যায়ে সেগুলো মাংস ও চর্বিতে জমতে থাকে। এমনকি নদ-নদী, খাল-বিলে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক/রাবার বর্জ্য খাবার গ্রহণের সময় মাছের দেহেও প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে জমা হতে থাকে। আমরা সেই মাছ, মাংস খেলে শেষ পর্যন্ত সেগুলো আমাদের দেহে প্রবেশ করে, যা ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
তাহলে এটি স্পষ্ট যে প্লাস্টিক ও রাবার সামগ্রী সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে তা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। তাই প্লাস্টিক আর রাবার সামগ্রী যতবার সম্ভব নিজেরা পুনরায় ব্যবহার করতে হবে এবং অন্যদেরও ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে যেখানে-সেখানে ফেলে না দিয়ে একসাথে জড়ো করে রাখতে হবে। এভাবে জড়ো করা সামগ্রী বিক্রিও করা যায়। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ সংরক্ষিত হবে, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যায়। বিক্রি করার সুযোগ না থাকলে— এটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।