কল্পনানির্ভর লেখা

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা - বুঝে পড়ি লিখতে শিখি | NCTB BOOK

বাংলাদেশে মানুষের মুখে মুখে অনেক রূপকথা চালু আছে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রূপকথা সংগ্রহ করে কয়েকটি বই লিখেছিলেন। তাঁর লেখা এ রকম একটি বইয়ের নাম ঠাকুরমার ঝুলি’। সেখান থেকে একটা গল্প নিচে দেওয়া হলো।

এক রাজার সাত রানি। দেমাকে বড়ো রানিদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটো রানি খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটো রানিকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।

কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত রাজার ছেলেমেয়ে হয় না। এত বড়ো রাজ্য কে ভোগ করবে? রাজা মনের দুঃখে থাকেন। এভাবে দিন যায়। কত দিন পরে — ছোটো রানির ছেলে হবে। রাজার মনে আনন্দ আর ধরে না। রাজার আদেশে পাইক-পেয়াদারা ব্রাজ্যে ঘোষণা দিলেন “রাজা রাজভান্ডার খুলে দিয়েছেন। মিঠাই-মন্ডা, মণি-মানিক যে যত পারো এসে নিয়ে যাও।“

বড়ো রানিরা হিংসায় জ্বলে মরতে লাগল।

রাজা নিজের কোমরে আর ছোটো রানির কোমরে এক সোনার শিকল বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘যখন ছেলে হবে, এই শিকলে নাড়া দিয়ো, আমি এসে ছেলে দেখব!’ এই বলে রাজা রাজদরবারে গেলেন।

ছোটো রানির ছেলে হবে, আঁতুড়ঘরে কে যাবে? বড়ো রানিরা বললেন, “আহা, ছোটো রানির ছেলে হবে, তা অন্য লোক দেবো কেন? আমরাই যাব।‘

বড়ো রানিরা আঁতুড়ঘরে গিয়েই শিকলে নাড়া দিলেন। অমনি রাজসভা ভেঙে, ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়ে, মণি- মানিক হাতে রাজা এসে দেখেন—কিছুই না! 

রাজা ফিরে গেলেন।

রাজা সভায় বসতে না বসতেই আবার শিকলে নাড়া পড়ল।

রাজা আবার ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখেন, এবারও কিছু না। মনের কষ্টে রাজা রাগ করে বললেন, ‘ছেলে না-হতে আবার শিকল নাড়া দিলে আমি সব রানিকে কেটে ফেলব।‘ এই বলে রাজা চলে গেলেন।

একে একে ছোটো রানির সাতটি ছেলে ও একটি মেয়ে হলো। আহা ছেলে-মেয়েগুলো যেন চাঁদের পুতুল—ফুলের কলি। আকুপাঁকু করে হাত নাড়ে, পা নাড়ে— আঁতুড়ঘর আলো হয়ে গেল।

ছোটো রানি আস্তে আস্তে বললেন, দিদি, কী ছেলে হলো একবার দেখাল না।‘

বড়ো রানিরা ছোটো রানির মুখের কাছে রঙ্গ-ভঙ্গি করে হাত নেড়ে, নথ নেড়ে বলে উঠল, “ছেলে না, হাতি হয়েছে—ওর আবার ছেলে হবে। — কয়টা ইঁদুর আর কয়টা কাঁকড়া হয়েছে। 

শুনে ছোটো রানি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন।

নিষ্ঠুর বড়ো রানিরা আর শিকালে নাড়া দিলো না। চুপিচুপি হাঁড়ি-সরা এনে, ছেলে-মেয়েগুলিকে তাতে পুরে,পানগাদায় পুঁতে ফেলে এলো। এসে, তারপর শিকল ধরে টান দিলো।

রাজা আবার ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়ে, মণি-মানিক হাতে এলেন। বড়ো রানিরা হাত মুছে, মুখ মুছে তাড়াতাড়ি করে কতকগুলি ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা এনে দেখাল। দেখে রাজা আগুন হয়ে ছোটো রানিকে রাজপুরী থেকে বের করে দিলেন।

বড়ো রানিদের মুখে আর হাসি ধরে না; পায়ের মলের বাজনা থামে না, সুখের কাঁটা দূর হলো; রাজপুরীতে আগুন দিয়ে, ঝগড়া-কোন্দল সৃষ্টি করে ছয় রানিতে মনের সুখে ঘরকন্না করতে লাগলেন।

পোড়াকপালী ছোটো রানির দুঃখে গাছ-পাথর কাটে, নদী-নালা শুকায়— ছোটো ব্রানি ঘুঁটে কুড়ানি দাসী হয়ে পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। 

এমনি করে দিন যায়। রাজার মনে সুখ নেই, রাজার রাজ্যে সুখ নেই— রাজপুরী ধারী করে, রাজার বাগানে ফুল ফোটে না।

একদিন মালি এসে বলল, ‘মহারাজ, ফুল তো ফোটে না। তবে আজ পীলাদার উপরে সাতটি চাঁপা গাছে ও একটি পারুল গাছে টুলটুলে সাতটি চাঁপা ফুল আর একটি পারুল ফুল ফুটে রয়েছে।‘

রাজা বললেন, ‘তবে সেই ফুল আনো।‘

মালি ফুল আনতে গে

মালিকে দেখে পারুল গাছে পারুল কুল চাঁপা ফুলগুলোকে ডেকে বলল, ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে! 

অমনি সাত চাঁপা নড়ে উঠে সাড়া দিল— ‘কেন বোন পারুল ডাকো রে?”

পারুল বলল, ‘রাজার মালি এসেছে, ফুল দেবে কি না দেবে?”

সাত চাঁপা ভুরভুর করে উপরে উঠে গিয়ে ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল, ‘না দেবো না দেবো ফুল, উঠব শতেক দূর, আগে আসুক রাজা, তবে দেবো ফুল!’

দেখে শুনে মালি অবাক হয়ে গেল। 

ফুলের সাজি ফেলে দৌড়ে দিয়ে রাজার কাছে খবর দিলো।

আশ্চর্য হয়ে রাজা আর রাজসভার সবাই সেখানে এলেন। রাজা এসে ফুল তুলতে গেলেন, অমনি পারুল কুল চাঁপা ফুলনের ডেকে বলল, “সাত ভাই চম্পা জাগো রে।“ চীপারা উত্তর দিলো, ‘কেন বোন পারুল ডাকো রে?

পারুল বলল, ‘রাজা নিজে এসেছেন, ফুল দেবে কি না দেবে?”

চাঁপারা বলল, “না দেবো না দেবো ফুল, উঠব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার বড়ো রানি, তবে দেবো ভুল। ‘ এই বলে চাঁপা ফুলেরা আরও উঁচুতে উঠল।

রাজা বড়ো রানিকে ডাকালেন। বড়ো রানি মল বাজাতে বাজাতে এসে ফুল তুলতে গেলেন। চাঁপা ফুলেরা বলল, কানা দেবো না দেবো ফুল, উত্তর শতেক দূর, আগে আসুক রাজার মেজো রানি, তবে দেবো ফুল!! তারপর মেজো রানি এলেন, সেজো রানি এলেন, নোয়া রানি এলেন, কনে রানি এলেন, কেউই ফুল পেলেন না। ফুলেরা গিয়ে আকাশে তারার মতো কুটে রইল।

রাজা গালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।

শেষে দুয়ো রানি এলেন; তখন ফুলেরা বলল, ‘না দেবো না দেবো ফুল, উঠব শতেক দূর, যদি আসে রাজার ঘুঁটেকুড়ানি দাসী, তবে দেবো ফুল।

তখন খোঁজ খোঁজ পড়ে দেন। রাজা চৌদোলা পাঠিয়ে দিলেন, পাইক-বেহারারা চৌদোলা নিয়ে মাঠে গিয়ে খুঁটেকুড়ানি দাসী ছোটো রানিকে নিয়ে এল।

ছোটো রানির হাতে পায়ে গোবর, পরনে ছেঁড়া কাপড়, তাই নিয়ে তিনি ফুল তুলতে গেলেন। অমনি সুড়সুড় করে চাঁপারা আকাশ থেকে নেমে এল, পারুল ফুলটি গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশন। ফুলের মধ্য থেকে সুন্দর সুন্দর চাঁদের মতো সাত রাজপুত্র আর এক রাজকন্যা ‘মা’ ‘মা’ বলে ডেকে ঝুপঝুপ করে খুঁটেকুড়ানি দাসী ছোটো রানির কোলে-কাঁখে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সকলে অবাক! রাজার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে গেল। বড়ো রানিরা ভয়ে কাঁপতে লাগল। রাজা তখনি বড়ো রানিদের কঠিন শাস্তি দিয়ে সাত রাজপুত্র, পারুল-রাজকন্যা আর ছোটো রানিকে নিয়ে রাজপুরীতে গেলেন। রাজপুরীতে জয়া বেজে উঠল।

(পরিমার্জিত)

 

শব্দের অর্থ

নথ= নাকে পরার অলংকার।

আঁতুড়ঘর= যে ঘরে শিশুর জন্ম হয়।

পাইক= লাঠিয়াল।

পেয়াদা= সংবাদবাহক।

কাঁখ= কোমর।

পাঁশগাদা = ছাইয়ের স্তূপ।

ঘুঁটে = শুকনা গোবর।

বেহারা= পালকিবাহক।

খুঁটেকুড়ানি= ঘুঁটে কুড়ায় যো

মল = পায়ের অলংকার। 

রাজভান্ডার= কোষাগার।

দেমাক= অহংকার।

হাঁড়ি-সরা= হাঁড়ি ও তার ঢাকনা।

 

পড়ে কী বুঝলাম

ক. আগে এ ধরনের আর কোন গল্প পড়েছ? _________________

খ. ‘সাত ভাই চম্পা’ গল্পে কী কী চরিত্র আছে? _________________

গ.এখানকার কোন কোন ঘটনা বাস্তবে হয় না?। _________________

খ. এখানকার কোন কোন ঘটনা বাস্তবেও ঘটতে পারে? _______________

ঙ. এই গল্প পড়ে আমরা কী বুঝলাম? _______________________

 

বলি ও লিখি

‘সাত ভাই চম্পা’ গল্পটি নিজের ভাষায় বলো এবং নিজের ভাষায় লেখো।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

বিভিন্ন রকম কল্পকাহিনি

এমন কিছু গল্প আছে যেগুলোর মধ্যে অনেক ঘটনা বাস্তবের সাথে মেলে না। এগুলোকে কাল্পনিক গল্প বা কল্পকাহিনি বলে। কল্পকাহিনি পড়তে বা শুনতে আমাদের ভালো লাগে, অনেক কিছু জানাও যায়। নিচে তিন ধরনের কল্পকাহিনির পরিচয় দেওয়া হলো।

রূপকথা: রূপকথা এক ধরনের শিশুতোষ গল্প, যেখানে মানুষের পাশাপাশি রাক্ষস-পৈতা, ডাইনি-পরি, ভূত- পেতনি ইত্যাদি কাল্পনিক চরিত্র থাকে।

উপকথা: মূলত পশু-পাখি নিয়ে রচিত গল্পকে উপকথা বলে। উপকথার পশু-পাখিরা মানুষের মতো আচরণ করে।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি: বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখা কাল্পনিক গল্পকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে। 

Content added By
Promotion