ভিনেগার হলো অ্যাসিটিক অ্যাসিডের 6 --10 % জলীয় দ্রবণ। ফরাসি শব্দ "VIN" অর্থ মদ এবং AIGRE অর্থ টক, যা হতে ভিনেগার শব্দটির সৃষ্টি। ভিনেগারের pH মান 4.74,এই pH - এ অণুজীবের বংশ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।অধিকাংশ অণুজীবের বংশবিস্তারের অনুকূল pH পরিসর 6.5--7.5। অম্লীয় পরিবেশে অনুজীব বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা এবং 6--10% অ্যাসিটিক এসিডের জলীয় দ্রবণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।তাই ভিনেগার বা সিরকা খাদ্যে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
খাবার পচনের মূল কারণ দুটি :
1.ক্ষতিকারক বা প্যাথোজেন জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্ম।
2.খাদ্যে অক্সিজেন দ্বারা জারণ ক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারের পুষ্টিকর উপাদান ভেঙে যাওয়া অর্থাৎ খাবারের কোষ প্রাচীরে জারণের ফলে খাবার নষ্ট হয়।
অতএব ভিনেগারের ব্যবহারে খাবারের উপরোক্ত দুটি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বিধায় খাবারের জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ ও খাবারের গুণগত মান সঠিকভাবে বজায় থাকে। এভাবে খাবারকে ভিনেগার সংরক্ষণ করে।
খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত উপাদান সমূহের মধ্যে সাশ্রয়ী বিধায় ভিনেগার বা সিরকা সর্বোচ্চ পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোনভাবেই যেন তাতে অনুজীবের সংক্রমণ না ঘটে।ভিনেগারের উপস্থিতিতে খাদ্যদ্রব্যে অনুজীবের সংক্রমণ রোধ নিশ্চিত হয়এবং এই অবস্থায় খাদ্যকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। ভিনেগার একটি সনাতন ও বহুল প্রচলিত প্রাকৃতিক খাদ্যসংরক্ষক এবং এটি অম্লীয় স্বাদযুক্ত বিধায় বিভিন্ন প্রকার আচার সংরক্ষণের পাশাপাশি এটি খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
উৎপাদনের উৎসের ভিন্নতার কারণে পাঁচ ধরনের ভিনেগার পাওয়া যায় :
1.ফলজাত ভিনেগার 2. মদজাত ভিনেগার 3.চালজাত ভিনেগার 4.সাদা পাতিত ভিনেগার 5. স্বাদ গন্ধযুক্ত ভিনেগার।
বানিজ্যিকভাবে বাজারে মনোহারী বা মোদির দোকানে কাচের বোতলে কিনতে পাওয়া যায়। এই ভিনেগারে সামান্য অ্যালকোহল,টারটারিক এসিড,শর্করা জাতীয় পদার্থ এবং সুগন্ধিযুক্ত এস্টার মিশ্রিত থাকে। আবার কুইক ভিনেগার পদ্ধতিতে ইথানয়িক এসিড থেকে প্রস্তুতকৃত ভিনেগারকে white বা সাদা ভিনেগার বলে।
খাবার সংরক্ষণে ভিনেগার প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভস হিসেবে যেসব ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো:
1) আচার সংরক্ষণে:
সব ধরনের আচার যেমন- আম, জলপাই,আমড়া, তেঁতুল, চালতা, রসুন,বরই ইত্যাদির আচার সকল স্বাদের (ঝাল অথবা মিষ্টি ) প্রতি ক্ষেত্রেই সংরক্ষণের জন্য ভিনেগার প্রয়োজন হয়।
2) মাছ- মাংস সংরক্ষণে:
মাছ-মাংস কৌটাজাত করনে ভিনেগারের বিকল্প খুঁজে পাওয়া বিরল,কারণ এটি এদের পচন রোধে বিরাট অবদান রাখে।তবে ফলের মতো ইচ্ছা করলে মাংসেরও আচার তৈরি করে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
3) স্যুপের স্বাদ বৃদ্ধিতে:
আমাদের ছোট ছেলেমেয়ে স্যুপ খুব পছন্দ করে। প্রাকৃতিক ভিনেগারের স্বাদ টক জাতীয় এবং এটি স্বাস্থ্যসম্মত বিধায় এর সামান্য অংশ স্যুপে যোগ করে তার স্বাদ বৃদ্ধি করা যায়।
4) সুস্বাদু সালাদ তৈরিতে:
আমাদের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় যে সালাদ অপরিহার্য তার স্বাদ বৃদ্ধির জন্য ভিনেগার যোগ করা যায়।
5) রোগ প্রতিরোধে ভিনেগার :
শারীরিক বহুমাত্রিক রোগ প্রতিরোধে খাবারের সাথে ভিনেগার মেশানো হয়ে থাকে। এটি মুখে রুচি ফিরিয়ে আনে,রক্ত সরবরাহ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে, হজম শক্তি বাড়িয়ে দেয়,রক্তের অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ ও রক্তচাপ হ্রাস করে।শরীরে সৃষ্ট তরল অপদ্রব্য নিঃসরণ কাজে সহায়তা করে।এটি ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
6) শাকসবজি সংরক্ষণে ভিনেগার:
শাকসবজি সব এলাকায় সমানভাবে জন্মায় না।এক এলাকার শাকসবজি অন্য এলাকায় পেতে হলে তার পচন রোধে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। ফলে শাক সবজির গুনাগুন অক্ষুন্ন থাকে। তাছাড়া শাকসবজিতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম,আয়রন, ফসফরাস ইত্যাদি খনিজ উপাদান শরীরের উপযোগীতে পরিণত করতে ভিনেগার বিশেষ ভূমিকা রাখে।
7) ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ততা নষ্ট করে :
অনেক সময় বিভিন্ন খাদ্যে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত পদার্থ দূরীকরণে ভিনেগার ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত ভিনেগার খাদ্যে ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক প্রজনন ক্রিয়া নষ্ট করে দেয়।
পেশীকে মসৃণ করে ভিনেগার:
ভিনেগার ল্যাকটিক এসিডের পরিমাণ কমিয়ে পেশিকে মসৃণ রাখে। এছাড়া ক্যান্সার বা অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে।
9) জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে ভিনেগার: মানবদেহে বটুলিনাম টক্সিন রোটক্স উৎপন্ন করে, যা ভীষণ বিষাক্ত। ভিনেগার শুধু বটুলিনাম নয়,এটা থালমোনেলা,লিস্টোরিয়া এবং স্ট্যাফাইলোকক্কাসের বিরুদ্ধে জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে।
10) বিভিন্ন ফাষ্টফুডে ভিনেগার:
ফুটপাতের চটপটি থেকে শুরু করে আধুনিক ফাষ্টফুডের রকমারি রেসিপি ভিনেগার ছাড়া চলে না। রেসিমোস থেকে শুরু করে বানিজ্যিক টমেটো কেচাপ,মেয়নিজ,সয়াসচ সংরক্ষণে ভিনেগার গুরুত্বপূর্ণ।সুগন্ধি ভিনেগার ব্যবহারে খাদ্যের স্বাধ ও গন্ধ বৃদ্ধি পায়।।
প্রকৃতপক্ষে খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগার এর কোন তুলনা হয় না। এটি প্রাকৃতিক খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে বহুল প্রচলিত কারণ --
ক) ভিনেগারের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
খ) এটি একটি মৃদু এসিড হাওয়ায় খাবারের সাথে গ্রহণ করলে এসিডিটি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা, বরং খাবার ও দেহের pH এর সমতা বজায় রাখে।
গ) এটি অম্লীয় দ্রবণ বিধায় এর প্রভাবে সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্যের দ্রবণের pH মান কমে যায়।অনুজীব বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া জন্মানো ও বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ পায় না।ইথানয়িক এসিডের শুধুমাত্র 6% জলীয় দ্রবণের pH মান প্রায় 2.35 যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
ঘ) এটি পানিতে যে কোন অনুপাতে দ্রবণীয়। কারণ এটি পানির অনুর সাথে কার্যকরী হাইড্রোজেন বন্ধন গঠন করতে পারে। ফলে খাদ্যের পানির সাথে সহজে মিশে সর্বত্র সুষম মাত্রা বজায় রেখে অণুজীবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ঙ) এর স্ফুটনাঙ্ক পানি অপেক্ষা বেশি হওয়ায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তাপ প্রয়োগে এর বাষ্পীভূত হওয়ার সুযোগ থাকেনা।
আরও দেখুন...