তরঙ্গ ও তরঙ্গ-গতি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব ধরনের তরঙ্গের ক্ষেত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, তরঙ্গ চলনক্ষম আলোড়ন বা আন্দোলন এবং দ্বিতীয়ত তরঙ্গ একস্থান হতে অন্যস্থানে শক্তি সঞ্চালন করে। আমরা যে শব্দ শুনি বা আলো দেখি তা তরঙ্গ আকারে উৎস থেকে আমাদের কাছে পৌঁছায়। কাজেই তরঙ্গ প্রকৃতি এবং তরঙ্গ গতি সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই অধ্যায়ে তরঙ্গের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং শব্দতরঙ্গ আলোচনা করব।
একটি পুকুরের স্থির পানিতে ঢিল ছুড়লে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। ঢিলটি যে বিন্দুতে পানিতে প্রবেশ করে সে বিন্দুকে কেন্দ্র করে পানির উপরিপৃষ্ঠে সারি সারি তরঙ্গ ক্রমবর্ধমান বৃত্তাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে পানির উপরিতলে একস্থান হতে অন্যস্থানে শক্তির সঞ্চালন ঘটে। পানির উপরে একটি শোলা বা পাটকাঠি থাকলে দেখা যাবে যে শোলা বা কাঠিটি একই স্থানে থেকে উপরে-নিচে উঠানামা করছে। এর অর্থ হল মাধ্যমের কণাগুলো স্থান ত্যাগ করে না, যদি করত তবে শোনা বা কাঠিটি সরে পাড়ে চলে আসত। মাধ্যমের কণাগুলোর মধ্যে সংযুক্তি বলের কারণে এগুলো স্থান ত্যাগ করে না, তবে আন্দোলনের দ্বারা পার্শ্ববর্তী কণাগুলোতে শক্তি সঞ্চালিত হয় এবং পাশের কণাগুলো আন্দোলিত হয়। এভাবে শক্তি তরঙ্গাকারে একস্থান হতে অন্যস্থানে সঞ্চালিত হয়। সুতরাং, তরঙ্গের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেয়া যায় :
যে সব তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয় সেগুলোকে যান্ত্রিক তরঙ্গ বলে। শব্দতরঙ্গ, টানা তারে সৃষ্ট তুরঙ্গ ইত্যাদি যান্ত্রিক তরঙ্গের উদাহরণ।
মাধ্যম ছাড়াও তরঙ্গ সঞ্চালিত হতে পারে। সূর্য থেকে আমরা যে আলো পাই তা কোন মাধ্যম ছাড়াই চলাচল করে। এদেরকে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বলে। তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের পর্যাবৃত্ত গতি পরিবর্তনের ফলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের উৎপত্তি হয়।
কম্পনশীল বস্তুর আঘাতে এর সংলগ্ন মাধ্যমের কণা নিজ মধ্য অবস্থানের দুদিকে এদিক-ওদিক (to and fro) সরল দোলন গতিতে কাপতে থাকে। ঐসব বায়ুকণা তাদের পাশের কণাকে একই জাতীয় কম্পনে কম্পিত করে। এভাবেই পরপর কণা থেকে কণাতে কম্পন স্থানান্তর হতে থাকে, অর্থাৎ শব্দ উৎস থেকে তরঙ্গ বিস্তারের অভিমুখে কম্পনরত কণার একটি শৃঙ্খল তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত শ্রোতার কানে কম্পন আঘাত করে। সুতরাং শব্দ উৎস হতে প্রাপ্ত শক্তি কণা থেকে কণাতে স্থানান্তরিত হয়ে অবশেষে শ্রোতার কানে পৌঁছায়; কিন্তু কোনো স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানান্তর ছাড়া যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলনের দ্বারা এক স্থান মাধ্যমের কণার কোনো স্থায়ী স্থানচ্যুতি ঘটে না।
জড় মাধ্যমের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের বিস্তারের সময় মাধ্যমের কণাগুলি আন্দোলিত হয়, ফলে শক্তির স্থানান্তর ঘটে। ঐ শক্তির কিছু অংশ গতিশক্তি ও বাকী অংশ স্থিতিশক্তি, যদিও মোট শক্তি সর্বত্র সমান। তরঙ্গ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হলে মাধ্যমের কণাগুলো সরল দোলন গতি লাভ করে [চিত্র ১.৪]। শক্তি সঞ্চালনে কণাগুলো সরাসরি ভূমিকা পালন করে না এবং কণাগুলো স্থায়ীভাবে স্থানচ্যুতও হয় না। পক্ষান্তরে তরা সঞ্চালনে মাধ্যমের প্রয়োজন না হলে শক্তি স্থানান্তরে কণার কোনো ভূমিকাই থাকে না। পানির উপর একটি শোলা বা পাটকাঠি থাকলে দেখা যাবে যে, শোলা বা কাঠিটি একই স্থানে থেকে উপরে-নিচে উঠানামা করছে। এর অর্থ হলো মাধ্যমের কণাগুলো স্থান ত্যাগ করে না, যদি করত তবে শোলা বা কাঠিটি সরে পাড়ে চলে আসত। মাধ্যমের কণাগুলোর মধ্যে সংসক্তি বলের কারণে এগুলো স্থান ত্যাগ করে না; তবে আন্দোলনের দ্বারা পার্শ্ববর্তী কণাগুলোতে শক্তি সঞ্চালিত হয় বলে পাশের কণাগুলো আন্দোলিত হয়। এভাবে শক্তি তরঙ্গাকারে এক স্থান হতে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। সুতরাং তরঙ্গের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেয়া যায় :
কোনো স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানান্তর ছাড়া যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলনের দ্বারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চালিত হয় তাকে তরঙ্গ বলে। তরঙ্গ শক্তির এক প্রকার রূপ তাই পানিতে ডিল নিক্ষেপের সময় হাত থেকে শক্তি ঢিলে স্থানান্তরিত হয়। আবার যখন টানা দেয়া তারে একটি তরঙ্গকে স্থাপন করা হয় তখন প্রকৃতপক্ষে তারে তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য শক্তি সরবরাহ করা হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, মাধ্যমে আন্দোলনের ফলে মাধ্যমের কণাসমূহে যে যান্ত্রিক শক্তির সৃষ্টি হয়। তা কম্পনের মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। তরঙ্গ দ্বারা শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। এই তরঙ্গ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের সময় গতিশক্তি ও স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি স্থানান্তরিত হয়।
মনে করি তারের একটি কণার ভর dm, যা আড় তরঙ্গরূপে সরল ছন্দিত গতিতে কম্পিত হচ্ছে। যখন তরঙ্গ এই কণাকে অতিক্রম করে তখন তা গতিশক্তি প্রাপ্ত হয় যার বেগ v। y = 0 অবস্থানে কণার অবস্থানের জন্য আড় কম্পনের বেগ তথা গতিশক্তি সর্বাধিক হয় [চিত্র ৯.৪]। আবার কণাটির চূড়ান্ত অবস্থান y = ym অবস্থানে আড় কম্পনের বেগ তথা গতিশক্তি শূন্য বা সর্বনিম্ন হয়।
এখন একটি সাইন তরঙ্গ পূর্বের টানা তারে সঞ্চালনের জন্য প্রয়োগ করা হলে তা তারটিতে চাপ (stretch) প্রয়োগ করে। (১-৪) চিত্র অনুযায়ী ধরি তারের ক্ষুদ্র dx অংশ আড়াআড়িভাবে কম্পিত হচ্ছে; কাজেই এই দৈর্ঘ্য dx বরাবর পর্যায়ক্রমিকভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়।
সেক্ষেত্রে বলা যায় তারটি স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি লাভ করার জন্য দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হচ্ছে যেমনটি লক্ষ করা যা একটি স্প্রিং এর ক্ষেত্রে। যখন তারে কণার অবস্থান y = ym হয় তখন ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্য dx অপরিবর্তিত থাকে এবং এই অবস্থানে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি শূন্য হয়। আবার y = 0 অবস্থানে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি সর্বাধিক হয়। এভাবে কম্পিত তার গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তি লাভ করে।
আমরা যখন কথা বলি তখন উৎপন্ন শব্দ তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, একটি শব্দসৃষ্টিকারী উৎসের কম্পনে পর্যায়ক্রমে মাধ্যমে সংকোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি হয় এবং তরঙ্গ সমবেগে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। একটি পূর্ণ কম্পনকালের মধ্যে মাধ্যমের কোনো কণার সরণ-সময় লেখচিত্র কিংবা তরঙ্গের বিস্তারের অভিমুখে নির্দিষ্ট সময় বিভিন্ন কণার সরণ-দূরত্ব লেখচিত্র অঙ্কন করলে লেখচিত্রগুলি তরঙ্গ আকারের হবে।
মাধ্যমের কণাগুলো সরল দোল গতিতে কম্পিত হলে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তাকে সরল দোল তরঙ্গ (Simple harmonic wave) বা সাইন তরঙ্গ (Sine wave) বলে। সরল দোল তরঙ্গ আবার দুই প্রকারের। যথা—
(১) আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ (Transverse waves) এবং
(২) লম্বিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal waves)।
ব্যাখ্যা : চিত্র ১৭.১-এ একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ দেখান হয়েছে। তরঙ্গের উপর ছোট ছোট তাঁর চিহ্ন দ্বারা কণার কম্পনের অভিমুখ দেখান হয়েছে। তরঙ্গের উপরের দিকে A ও E বিন্দুতে কণার সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। তরঙ্গের এই বিন্দুগুলোকে তরঙ্গ শীর্ষ বা তরঙ্গ চূড়া (crest) বলে। আবার নিচের দিকে C বিন্দুতে সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। একে তরঙ্গ পাদ বা তরঙ্গ খাঁজ (Trough) বলে।
এক্ষেত্রে কণার স্পন্দনের অভিমুখ তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখের সমকোণে ঘটেছে। অতএব এটা আড় তরঙ্গ।
(১) পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়লে দেখা যায় যে পানির কণাগুলো উপরে-নিচে দুলতে থাকে এবং এই আন্দোলন কিনারার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৃষ্ট এরূপ আন্দোলনই আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।
(২) একটি তার টান করে বেঁধে এর দৈর্ঘ্যের সমকোণে টেনে ছেড়ে দিলে তারে একটি তরঙ্গের সৃষ্টি হবে [চিত্র ১৭.২ ]। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তারটি এর দৈর্ঘ্যের সাথে সমকোণে আন্দোলিত হচ্ছে। এই আন্দোলন তারের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং টানা তারের এরূপ কম্পন হতে স্পষ্ট যে, এই তরঙ্গ আড় তরঙ্গ।
পরীক্ষায় সমান দৈর্ঘ্যের কতকগুলো দণ্ড নেয়া হয় যাদের প্রত্যেকের এক মাথায় একটি করে বল এবং অপর মাথায় একটি করে চাকা যুক্ত আছে [ চিত্র ১৭.৩]। চাকাগুলো একটি হাতলযুক্ত ঘূর্ণনক্ষম দণ্ডের সাথে এমনভাবে লাগানো আছে যে চাকাগুলো কম-বেশি উৎকেন্দ্রিক (eccentric) অবস্থায় থাকে অর্থাৎ দণ্ডগুলো এক এক চাকার এক এক স্থান দিয়ে পরানো থাকে এবং দণ্ডগুলো খাড়াভাবে অবস্থান করে। হাতল ঘুরালে চাকাগুলোও ঘুরতে থাকে এবং দণ্ডগুলো উঠা-নামা করে। চাকাগুলো কম-বেশি উৎকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন দণ্ডের উপরের প্রান্তের বলগুলো একসঙ্গে উপরে উঠে না বা নিচে নামে না— পর্যায়ক্রমে উঠা-নামা করে। ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে বলগুলো যে দিকে উঠা-নামা করে তার সমকোণে তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং এস্থলে উদ্ভূত তরঙ্গ আড় তরঙ্গ।
চিত্র ১৭.৪-এ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ প্রবাহ দেখান হয়েছে। মাধ্যমের বিভিন্ন স্তরের সাম্যাবস্থান কতগুলো সমান দূরত্বের রেখা দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে [চিত্র ১৭.৪ (ক)]।
মাধ্যমের ভেতর দিয়ে লম্বিক তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকলে যে কোন সময়ে স্তরগুলোর অবস্থান কিরূপ হবে তা ১৭.৪ (খ) চিত্রে দেখান হয়েছে। অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের কণাগুলো সাম্যাবস্থানের উভয় পার্শ্বে তরঙ্গের গতিপথের সমান্তরালে কম্পিত হয়, ফলে তরঙ্গশীর্ষ বা তরঙ্গপাদ সৃষ্টি হয় না। এক্ষেত্রে কম্পনের সময় কিছু কিছু স্থানে কণাগুলো কাছাকাছি চলে আসে আবার কোথাও দূরে সরে যায়। কণাগুলো কাছাকাছি আসায় মাধ্যমের সংকোচন বা ঘনীভবন (compression or condensation) হয় এবং কণাগুলো সরে গেলে মাধ্যমের প্রসারণ (rarefaction) হয়। চিত্রে রেখাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব কম দ্বারা সংকোচন এবং রেখাগুলোর দূরত্ব বৃদ্ধি দ্বারা সম্প্রসারণ বুঝান হয়েছে। সংকোচনের স্থানগুলোতে মাধ্যমের ঘনত্ব ও চাপ বেড়ে যায় এবং প্রসারণের স্থানগুলোতে মাধ্যমের ঘনত্ব ও চাপ কমে যায়। এভাবে মাধ্যমের কণাগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের মধ্য দিয়ে অনুদৈর্ঘ্য ও লম্বিক তরঙ্গ সঞ্চালিত হয়। পাশাপাশি একটি সংকোচন ও একটি প্রসারণ নিয়ে একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য গঠিত হয়।
(১) কথা বলার সময় আমরা জিহ্বার সাহায্যে মুখের মধ্যকার বায়ু কণাতে কম্পন সৃষ্টি করি। বায়ুকণাগুলোর কম্পনের দিক শব্দ তরঙ্গের গতির অভিমুখে সংঘটিত হয়। অতএব শব্দ লম্বিক তরঙ্গ। বক্তা বা গায়কের মুখ হতে শব্দ বায়ু মাধ্যমে সঙ্কোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি করে লম্বিক তরঙ্গের আকারে শ্রোতার কানে পৌঁছায়। [ চিত্র ১৭.৪ ]।
(২) একটি স্প্রিং খাড়াভাবে ঝুলিয়ে দিয়ে এর নিচের প্রান্ত খানিকটা নিচের দিকে টেনে ছেড়ে দিলে দেখা যাবে যে স্প্রিং-এর কুণ্ডলী পর্যায়ক্রমে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে । চিত্র ১৭.৫ ] এবং এই স্পন্দন তারের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রবাহিত হয় । অর্থাৎ, কুণ্ডলীগুলো সরল দোলন গতিতে তরঙ্গের গতির সমান্তরালে আন্দোলিত হচ্ছে। সুতরাং স্প্রিং-এ সৃষ্ট এই তরঙ্গ লম্বিক তরঙ্গ।
পরীক্ষায় একটি সরু তারের স্প্রিং নিয়ে এর প্রত্যেক কুণ্ডলীকে দুটি অনুভূমিক দণ্ড CD ও CD' হতে V আকারে সিল্ক সুতা দ্বারা এমনভাবে ঝুলানো হয় যে, তারটি অনুভূমিক থাকে | চিত্র ১৭.৬]।
এই স্প্রিং-এর এক প্রান্ত ধরে হঠাৎ অনুভূমিকভাবে ধাক্কা দিলে দেখা যাবে যে, তারের কুণ্ডলীগুলো পর্যায়ক্রমে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে এবং এই স্পন্দন ক্রমে ক্রমে তার বরাবর এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কুণ্ডলীগুলো তরঙ্গ প্রবাহের দিকেই সরল দোল গতিতে আন্দোলিত হচ্ছে। সুতরাং উদ্ভূত তরঙ্গই লম্বিক তরঙ্গ।
আড় তরঙ্গ ও লম্বিক তরঙ্গের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
আড় তরঙ্গ | লম্বিক তরঙ্গ |
---|---|
১। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে জড় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দিক তরঙ্গ প্রবাহের দিকের সমকোণী হয়,তাকে আড় তরঙ্গ বলে। | ১। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে জড় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দিক তরঙ্গ প্রবাহের দিকের সমান্তরাল হয় তাকে লম্বিক তরঙ্গ বলে। |
২। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমে তরঙ্গ শীর্ষ এবং তরঙ্গ পাদ সৃষ্টি হয়। | ২। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমে সংকোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি হয়। |
৩। পর পর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা পর পর দুটি তরঙ্গ পাদের মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে। | ৩। পর পর দুটি সংকোচন বা পর পর দুটি প্রসারণের মধ্যবর্তী দূরত্বকে বা একটি প্রসারণ ও একটি সংকোচনের মিলিত দৈর্ঘ্যকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে। |
৪। মাধ্যমে এর সমবর্তন বা পোলারণ ঘটে। | ৪। মাধ্যমে এর সেমবর্তন বা পোলারণ ঘটে না |
৫। অনম্যতার বা আকৃতির স্থিতিস্থাপক ধর্মসম্পন্ন মাধ্যমে (কঠিন) এই তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। প্রবাহীতে পৃষ্ঠ টানের দরুন আড় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। | ৫। আয়তনের সিতিস্থাপক এইসম্পন্ন মধ্য (কঠিন, তরল ও গ্যাস।) এই তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। |
তরঙ্গের উপরিস্থিত পরপর দুটি সমদশাসম্পন্ন কণার ন্যূনতম দূরত্বই হল তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। একে দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
আড় তরঙ্গে ক্ষেত্রে পরপর দুটি তরঙ্গশীর্ষ বা পরপর দুটি তরঙ্গ পাদ-এর মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে। চিত্র ১৭.৭-এ AE বা BF বা CG আড় তরঙ্গের ক্ষেত্রে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং চিত্র ১৭.৪-এ RR‘ বা CC‘ লম্বিক তরঙ্গের ক্ষেত্রে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য।
কোন একটি মাধ্যমে বিভিন্ন শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিভিন্ন। একই শব্দের তরঙ্গ বিভিন্ন মাধ্যমেও বিভিন্ন।
কম্পাঙ্ক বা দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
কোন বস্তু বা কণা t সময়ে N সংখ্যক কম্পন সম্পন্ন করলে কম্পাঙ্ক, বা n =
কম্পাঙ্কের একককে হার্টজ (Hertz সংক্ষেপে Hz) বলে। অনেক সময় সাইকেল/সেকেণ্ড (cs-1) এককও ব্যবহার করা হয়।
একে T দ্বারা প্রকাশ করা হয়। মনে করি t সেকেন্ডে একটি উৎস Nটি পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করে।
:- দোলন কাল, এবং কম্পাঙ্ক,
চিত্র ১৭.৭-এ তরঙ্গের B হতে F বা D হতে H-এ যেতে ব্যয়িত সময়ই পর্যায়কাল বা দোলনকাল।
বিভিন্ন তরঙ্গের পর্যায়কাল বা কম্পাঙ্ক একই মাধ্যমে বিভিন্ন। কিন্তু একই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বা পর্যায়কাল বিভিন্ন মাধ্যমে সমান।
বিস্তার দুই প্রকার, যথা— (ক) রৈখিক বিস্তার, একে সাধারণত 'a' দ্বারা সূচিত করা হয় এবং
(খ) কৌণিক বিস্তার; একে সাধারণত '‘ দ্বারা সূচিত করা হয়। চিত্র ১৭.৭-এ BF হতে E বা C বা A-এর লম্ব দূরত্বই রৈখিক বিস্তার ’a'।
কোন শব্দের প্রাবল্য I বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক। অর্থাৎ []
আরও বিস্তারিতভাবে বলা যায়— তরঙ্গস্থিত কোন একটি কণার কোন মুহূর্তের অবস্থান এবং তার গতির অবস্থা ও দিক যার দ্বারা নির্দেশ করা হয় তাকে দশা বলে।
মাধ্যম ভেদে একই শব্দের বেগ বিভিন্ন। কিন্তু বিভিন্ন শব্দের বেগ একই মাধ্যমে সমান।
যেমন পানির তরঙ্গ শীর্ষে অবস্থিত সব কণার দশা একই। তেমনি এর তরঙ্গ
পাদে অবস্থিত সব কণার দশাও একই। কাজেই তরঙ্গ শীর্ষ বরাবর অঙ্কিত তল হবে একটি তরঙ্গ মুখ এবং তরঙ্গ পাদ বরাবর অঙ্কিত তল হবে আর একটি তরঙ্গ মুখ। পরপর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা তরঙ্গপাদ বরাবর অঙ্কিত তলের তরঙ্গ মুখের মধ্যবর্তী দূরত্ব এক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য [চিত্র ১৭.৮]।
তরঙ্গের তীব্রতা, I = শক্তি ঘনত্ব × তরঙ্গ বেগ
গাণিতিকভাবে দেখান যায় যে,
এখানে,
মাধ্যমের ঘনত্ব
n তরঙ্গের কম্পাঙ্ক
a তরঙ্গের বিস্তার এবং
v তরঙ্গের বেগ ।
উপরের সমীকরণ হতে দেখা যায় যে,
= Ka², এখানে K ধ্রুবক।
অর্থাৎ তীব্রতা (I) বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক।
এস. আই. পদ্ধতিতে তীব্রতার একক [Jm-1] বা Wm-2
মনে করি, কোন মাধ্যমে কোন একটি তরঙ্গের বেগ = v, তরঙ্গ উৎসের কম্পাংক = n এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ্য = । তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যেহেতু v তরঙ্গ বেগ,
অতএব আমরা পাই,
v = তরঙ্গ কর্তৃক এক সেকেণ্ডের অতিক্রান্ত দূরত্ব (1)
পুনঃ, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য = , সুতরাং শব্দ উৎসের একটি পূর্ণ কম্পনে তরঙ্গ কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব = ।
কম্পাঙ্ক n হওয়ায় প্রতি সেকেন্ডে nটি পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন হয়। অতএব n টি পূর্ণ কম্পনের জন্য অতিক্রান্ত দূরত্ব =
= তরঙ্গ কর্তৃক এক সেকেণ্ডের অতিক্রান্ত দূরত্ব (2)
সমীকরণ (1) এবং (2) হতে পাই,
v = (3)
অর্থাৎ তরঙ্গ'বেগ = কম্পাঙ্ক × তরঙ্গ দৈর্ঘ্য।
এটিই হল তরঙ্গ বেগ. কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মধ্যে সম্পর্ক।
মনে করি কোন একটি কম্পমান বস্তুর দোলনকাল T এবং কম্পাঙ্ক n । এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
দোলনকাল T-এর অর্থ কম্পমান বস্তুর একটি পূর্ণ কম্পনে অতিবাহিত সময়। অতএব nটি পূর্ণ কম্পনে অতিবাহিত সময় =nT
NT = nটি পূর্ণ কম্পনে ব্যয়িত সময় (4)
আবার কম্পাঙ্ক শব্দের অর্থ—এক সেকেণ্ডের পূর্ণ কম্পন সংখ্যা।
কাজেই nটি পূর্ণ কম্পুন দিতে সময় লাগবে 1 সেকেণ্ড।
1 সে. = nটি পূর্ণ কম্পনে ব্যয়িত সময় (5)
সমীকরণ (4) এবং (5) হতে পাই
বা,
বা,
এটিই হল দোলনকাল ও কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্ক।
যে তরঙ্গ উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে সময়ের সাথে সাথে অগ্রসরমান বা চলমান হয় তাকে অগ্রগামী তরঙ্গ বলে। অগ্রগামী তরঙ্গ আড় বা অনুদৈর্ঘ্য এবং লম্বিক বা অনুপ্রস্থ উভয় ধরনের হতে পারে। আবার দুটি বিপরীতমুখী তরঙ্গের উপরিপাতের ফলে উৎপন্ন তরঙ্গ মাধ্যমের একটি সীমিত অংশে আবদ্ধ থাকে। এই তরঙ্গকে স্থির তরঙ্গ বলে।
উদাহরণ : (ক) পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়লে আড় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই ঢেউ বা তরঙ্গ পানির মধ্য দিয়ে কিনারার দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে। সুতরাং পানির ঢেউ অগ্রগামী আড় বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।
(খ) বক্তা কথা বললে শব্দ উৎপন্ন হয়। শব্দ লম্বিক বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। এই শব্দ বক্তার মুখ হতে বাতাসের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে শ্রোতার কানে পৌঁছায়। অতএব শব্দ অগ্রগামী লম্বিক তরঙ্গ।
(ক)কোন মাধ্যমের একই প্রকার কম্পনে এই তরঙ্গের উৎপত্তি হয়।
(খ) এটি একটি সুষম মাধ্যমের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দ্রুতি বা বেগে প্রবাহিত হয়।
(গ) অগ্রগামী তরঙ্গের বেগ মাধ্যমের ঘনত্ব ও স্থিতিস্থাপকতার উপর নির্ভর করে।
(ঘ) মাধ্যমের কণাগুলোর কম্পন তরঙ্গ প্রবাহের সাপেক্ষে আড় ও লম্বিক হতে পারে।
(ঙ) মাধ্যমের কণাগুলো কখনও স্থির থাকে না।
(চ) তরঙ্গ মুখের অভিলম্ব বরাবর শক্তি বহন করে এ তরঙ্গ প্রবাহিত হয়।
(ছ) তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমের বিভিন্ন অংশের চাপ ও ঘনত্বের একই প্রকার পরিবর্তন ঘটে।
(জ) মাধ্যমের প্রতিটি কণার কম্পাঙ্ক ও বিস্তার একই হয় এবং তারা একই ধরনের কম্পনে কম্পিত হয়।
(ঝ) তরঙ্গ প্রবাহের দরুন মাধ্যমের কণার দশা পরবর্তী কণাতে স্থানান্তরিত হয়। এরূপ দুটি কণার দশা বৈষম্য তাদের দূরত্বের সমানুপাতিক।
(ঞ) মাধ্যমের যে কোন কণার বিভিন্ন ধর্ম—যেমন বেগ, ত্বরণ, শক্তি প্রভৃতি একইরূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়।
কোন মাধমের কণাগুলো সরল ছন্দিত স্পন্দনে স্পন্দিত বা আন্দোলিত হলে অগ্রগামী তরঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং মাধ্যমের এক কণা হতে পরবর্তী কণায় আন্দোলন স্থানান্তরিত হয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এক কণা 'হতে পরবর্তী কণায় আন্দোলন পৌঁছতে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। ফলে তরঙ্গের অভিমুখ বরাবর কণাগুলোর দশার পরিবর্তন ঘটে। এখন তরঙ্গ যদি বামদিক থেকে ডানদিকে অগ্রসর হতে থাকে তবে বামদিকের কণা আন্দোলিত হওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ডানদিকের কণা আন্দোলিত হবে; ফলে এদের মধ্যে দশার পার্থক্য সৃষ্টি হবে। এভাবে ডানদিকের পরের কণাগুলো পরে আন্দোলিত হবে। সুতরাং প্রথম কণার সঙ্গে দূরবর্তী কণার দশা পার্থক্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তবে প্রতি দুটি পার্শ্ববর্তী কণার দশা পার্থক্য একই হবে। এখন এই অগ্রগামী তরঙ্গের গাণিতিক সমীকরণ বের করব।
মনে করি একটি অগ্রগামী তরঙ্গ X-অক্ষের ধনাত্মক দিকে অগ্রসর হচ্ছে। চিত্র ১৭.৯]। ধরি t সময়ে মাধ্যমের কোন একটি কণা O-এর সরণ = y (লম্বিক তরঙ্গের ক্ষেত্রে কণার সরণ X-অক্ষ বরাবর এবং আড় তরঙ্গের ক্ষেত্রে কণার সরণ Y-অক্ষ বরাবর ঘটে। যেহেতু মাধ্যমের কণাগুলো সরল ছন্দিত স্পন্দনে আন্দোলিত হচ্ছে, কাজেই O- কণাটির গতির সমীকরণ হবে,
এখানে, A = কণার বিস্তার
কণার কৌণিক কম্পাঙ্ক = (7)
এবং = কণার দশা কোণ, সংক্ষেপে দশা।
এখন, যদিও মাধ্যমের প্রতিটি কণার গতি অভিন্ন, কিন্তু কণাগুলোর দশা এক নয়।
ধরা যাক, O বিন্দু কণার এ গতি ডানদিকের কণাগুলোতে একের পর এক সঞ্চালিত হচ্ছে। এর অর্থ হল O-এর পরবর্তী কণা কিছু সময় পরে O কণার দশাপ্রাপ্ত হবে। . তারপরের কণা আরও একটু পরে O-কণার দশাপ্রাপ্ত হবে। ফলে O বিন্দু থেকে ডানদিকের কণাগুলোর দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে দশা পার্থক্যও বাড়বে। এক্ষেত্রে তরঙ্গের গতিপথের উপর অবস্থিত প্রতিটি কণার দশা এর পূর্ববর্তী রাম দিকের কণার দশার পশ্চাদগামী (Lagging) হবে।
আমরা জানি একটি পূর্ণ কম্পনে তরঙ্গ যে পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য () বলে এবং এই সময় দশা পার্থক্য হয় 2π। এখন O বিন্দু হতে x দূরত্বে অবস্থিত P বিন্দুর কণা বিবেচনা করি। ধরি O বিন্দুর কণার সাথে এর দশা পার্থক্য । সেহেতু দূরত্ব অতিক্রমকালে দশা পরিবর্তন বা দশা পার্থক্য হয় 2π; সুতরাং x দূরত্বের জন্য দশা পার্থক্য হবে,
অর্থাৎ, দশা পার্থক্য = পথ পার্থক্য
P বিন্দুর কণার গতির সমীকরণ হবে
(9)
যদি তরঙ্গ X-অক্ষের ঋণাত্মক দিকে অগ্রসর হয়, তবে গতির সমীকরণ হবে,
(10)
অতএব সমীকরণ (9) ও (10)-ই হল অগ্রগামী তরঙ্গের সাধারণ সমীকরণ বা রাশিমালা। উপরোক্ত সমীকরণ দুটি তরঙ্গের উপরিপাতন এবং আবদ্ধ নলে শব্দ তরঙ্গের প্রতিফলনের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়।
আমরা জানি, সরল দোলগতির ক্ষেত্রে সরণ সাইন অপেক্ষক (sine function) না হয়ে কোসাইন অপেক্ষক (consine function) হতে পারে। সেক্ষেত্রে, উপরের সমীকরণগুলোতে সাইন-এর স্থলে কোসাইন বসালেই অগ্রগামী তরঙ্গের সমীকরণ পাওয়া যাবে।
দুই বা ততোধিক তরঙ্গ যদি একই মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, তবে তরঙ্গগুলো পরস্পর নিরপেক্ষভাবে সঞ্চালিত হয়। মাধ্যমের যে অংশে তরঙ্গগুলো পরস্পরের উপর আপতিত হয়, সে অঞ্চলে কোন কণার লব্ধি সরণ কি হবে তা নির্ণয়ের নিমিত্তে একটি নীতি প্রবর্তিত হয়। এর নাম তরঙ্গের উপরিপাতন নীতি বা সূত্র। সূত্রটি হচ্ছে :
মনে করি একটি তরঙ্গ মাধ্যমের কোন কণার y1 সরণ এবং আর একটি তরঙ্গ মাধ্যমের উক্ত কণার y2 সরণ ঘটছে।
উপরিপাতন সূত্র অনুসারে কণাটির লম্বি সরণ
y = y1 + y2
এখানে, y1 ও y2 উভয়ই ধনাত্মক বা উভয়ই ঋণাত্মক কিংবা একটি ধনাত্মক এবং অপরটি ঋণাত্মক হতে পারে।
উপরিপাতন সূত্রের সাহায্যে আমরা স্থির তরঙ্গ সৃষ্টি, শব্দের ব্যতিচার ও বীট ব্যাখ্যা করতে পারি।
পুকুরে কাছাকাছি অবস্থানে দুটি ঢিল ছুড়লে যে দুটি বৃত্তাকার তরঙ্গের উৎপত্তি হয়, তাদের মধ্যে উপরিপাতন লক্ষ করা যায়। পানিতে যে বিন্দুতে দুটি তরঙ্গের চূড়া একই দিক থেকে মিলিত হয় সেখানে তরঙ্গচূড়ার উচ্চতা সর্বোচ্চ হয়। পক্ষান্তরে, যে বিন্দুতে দুটি তরঙ্গপাদ একই দিক থেকে মিলিত হয় সেখানে তরঙ্গপাদে গভীরতা সর্বাধিক হয়। আবার সে বিন্দুতে একটি তরঙ্গশীর্ষ ও একটি তরঙ্গপাদ মিলিত হয় সেখানে পানিতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
এই তরঙ্গ মাধ্যমের ঐ অংশে সীমাবদ্ধ থাকে, মাধ্যমের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয় না। সাধারণভাবে বলা যায় যে, এ স্থলে সীমাবদ্ধ থেকে পর্যায়ক্রমে গতিশক্তি (স্থিতিস্থাপক) স্থিতি বা বিভব শক্তিতে পরিবর্তিত হয়।
একটি টানা তারের কোথাও আঘাত করলে একটি তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। [চিত্র ১৭.১০] এবং এই তরঙ্গ তার বেয়ে দুই প্রান্তের দিকে অগ্রসর হয় এবং পরিশেষে দুই প্রান্ত হতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। এই প্রতিফলিত তরঙ্গ ও মূল তরঙ্গের প্রকৃতি অভিন্ন থাকলেও তাদের মধ্যে দশা বৈষম্য 180° হয়।
ফলে তারে প্রতিফলিত তরঙ্গ ও এর বিপরীত দিকে গতিশীল (নতুন) মূল তরঙ্গ মিলে স্থির তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গ তারের বাইরে যায় না— তারের মধ্যেই পর্যায়ক্রমে উৎপন্ন ও বিলুপ্ত হয়। তারটি ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তারের সকল বিন্দুর বিস্তার সমান নয়। স্থির তরঙ্গের ক্ষেত্রে কোন কোন বিন্দুতে বস্তুকণার বিস্তার শূন্য এবং কোন কোন বিন্দুতে বিস্তার সর্বাধিক। যে বিন্দুগুলোতে বিস্তার সর্বাধিক (চিত্রে A চিহ্নিত বিন্দুগুলো) তাদেরকে সুস্পন্দ বিন্দু (Antinode) এবং যে সকল বিন্দুতে বিস্তার শূন্য (চিত্রে N চিহ্নিত বিন্দুগুলো) তাদেরকে নিস্পন্দ বিন্দু (Node) বলে।
স্থির তরঙ্গের কতকগুলো ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল :
(ক) এই তরঙ্গ কোন একটি মাধ্যমের সীমিত অংশে উৎপন্ন হয়।
(খ) অগ্রগামী তরঙ্গের ন্যায় অগ্রসর না হয়ে একই স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে।
(গ) তরঙ্গের বিভিন্ন বিন্দুতে কম্পনের বিস্তার সমান নয়।
(ঘ) তরঙ্গের যে বিন্দুতে বিস্তার সর্বাধিক তাকে 'সুস্পন্দ' বিন্দু বলে এবং তরঙ্গের যে বিন্দুতে বিস্তার শূন্য তাকে 'নিস্পন্দ' বিন্দু বলে।
(ঙ) তরঙ্গের সস্পন্দ বিন্দুর বিস্তার তরঙ্গ সৃষ্টিকারী মূল তরঙ্গের বিস্তারের দ্বিগুণ-এর সমান।
(চ) সত্য দুটি পর পর নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী কণার সরণ একই দিকে হয় এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব /2। পর পর নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী অংশকে লুপ (Loop) বলে।
(ছ) পর পর দুটি লুপের সরণ পরস্পর বিপরীত দিকে হয়।
(জ) নিস্পন্দ বিন্দুতে চাপ ও ঘনত্বের পরিবর্তন সর্বাধিক, কিন্তু সুস্পন্দ বিন্দুতে চাপ ও ঘনত্বের পরিবর্তন শূন্য ।
(ঝ)পর পর তিনটি সুস্পন্দ বিন্দু বা পর পর তিনটি নিস্পন্দ বিন্দু বা দুটি লুপের মধ্যবর্তী দূরত্বই স্থির তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য।
(ট) স্থির তরঙ্গের স্থির বিন্দুসস্থ কণাগুলো ছাড়া সকল কণার গতি সরল ছন্দিত গতি।
(ঠ) কোন মাধ্যমে স্থির তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য () বা কম্পাঙ্ক (n) তরঙ্গ সৃষ্টিকারী যে কোন একটি মূল তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য (λ) বা কম্পাঙ্ক (n)-এর সমান।
এবং ঋণাত্মক X-অক্ষ অভিমুখে অগ্রগামী তরঙ্গের সরণ সমীকরণ,
এখানে A0 = তরঙ্গের বিস্তার, T = 2π/ = পর্যায়কাল এবং v = বেগ। এ স্থলে, y1 ও y2 হচ্ছে উৎস হতে x দূরত্বে অবস্থিত একটি কণার সময়ে দুটি পৃথক তরঙ্গের জন্য দুটি সরণ। ধরা যাক, তরঙ্গ দুটি একটি অপরটির উপর আপতিত হল। এখন এই দুটি তরঙ্গের লব্ধি সরণ-
এখানে, স্থির তরঙ্গের উপর x দূরত্বে অবস্থিত কণার বিস্তার।
সমীকরণ (11) হতে দেখা যায় যে সমাপতিত তরঙ্গ দুটি একটি সরল ছন্দিত গতিসম্পন্ন তরঙ্গ উৎপন্ন করে। এই সরল ছন্দিত গতিটি অগ্রগামী তরঙ্গ নয় ; কারণ এতে অগ্রগামী তরঙ্গের ন্যায় দশার কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ অগ্রগামী তরঙ্গের ন্যায় দশা কোণের ভিতর (vt — x) জাতীয় কোন রাশি অন্তর্ভুক্ত নেই। সুতরাং, সমীকরণ (11) দুটি - তরঙ্গের উপরিপাতের ফলে সৃষ্ট স্থির তরঙ্গ প্রকাশ করে।
সমীকরণ ( 11 ) -এ বিস্তার, । এটা কণার অবস্থান x-এর উপর নির্ভরশীল। কাজেই বিভিন্ন কণার বিভিন্ন অবস্থানের জন্য A ভিন্ন ভিন্ন হবে। যে সব বিন্দুতে A = 0 অর্থাৎ বিস্তার শূন্য হবে, সে সব বিন্দুতে নিস্পন্দ বিন্দুর সৃষ্টি হবে।
পরপর সংলগ্ন দুটি নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব : =
সুস্পন্দ বিন্দু (Antinodes): যে সকল বিন্দুতে লব্ধি বিস্তার, A সর্বাধিক; অর্থাৎ , সে সকল বিন্দুতে সুস্পন্দ বিন্দুর উদ্ভব হবে। সুতরাং, সুস্পন্দ বিন্দু তৈরির শর্ত হল :
বা,
বা,
বা,
:- পরপর সংলগ্ন দুটি সুস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব = [ চিত্র ১৭.১০] এবং একটি সুস্পন্দ ও একটি সন্নিহিত নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব বা ব্যবধান । [ চিত্র ১৭.১১] -এ a এবং n দ্বারা যথাক্রমে সুস্পন্দ ও নিস্পন্দ বিন্দুর অবস্থান দেখান হয়েছে। পাশাপাশি দুটি নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যে একটি সুস্পন্দ বিন্দু থাকে।
অগ্রগামী তরঙ্গ | স্থির তরঙ্গ |
---|---|
১। মাধ্যমের সকল কণাই পর্যাবৃত্ত গতি লাভ করে। | ১। মাধ্যমের নিস্পন্দ বিন্দুর কণাগুলি ছাড়া অন্যান্য সব কণাই পর্যাবৃত্ত গতি লাভ করে। |
২। মাধ্যমের কণাগুলো কখনও স্থির অবস্থা প্রাপ্ত হয় না। | ২। প্রতিটি পূর্ণ কম্পনে কণাগুলো দুই বার স্থির অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। |
৩। মাধ্যমের প্রতিটি কণার বিস্তার সমান; কিন্তু তাদের ভেতর দশার পার্থক্য থাকে। | ৩। মাধ্যমের প্রতিটি কণার দশা সমান; কিন্তু বিস্তার বিভিন্ন। সুস্পন্দ বিন্দুতে বিস্তার সর্বাধিক এবং নিস্পন্দ বিন্দুতে বিস্তার সর্বাপেক্ষা কম। |
৪। মাধ্যমের ভেতর দিয়ে নির্দিষ্ট বেগে অগ্রসর হয়। | ৪। মাধ্যমের মধ্যে স্থিরভাবে অবস্থান করে এবং সীমাবদ্ধ স্থানে পর্যায়ক্রমে উৎপন্ন ও বিলুপ্ত হয়। |
৫। মাধ্যমের প্রতিটি কণাকে সরণ, ঘনত্ব, চাপের পরিবর্তন, শক্তি ও বেগের একই রকম পরিবর্তন চক্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। | ৫। মাধ্যমের প্রতিটি কণাকে একই রকম পরিবর্তন চক্রের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। |
৬। অগ্রগামী অনুপ্রস্থ তরঙ্গের ক্ষেত্রে পরপর দুটি তরঙ্গশীর্ষের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং অগ্রগামী অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে একটি সংকোচন ও একটি প্রসারণের মোট দৈর্ঘ্যকে এক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে। | ৬। পরপর তিনটি নিস্পন্ন বিন্দু অথবা তিনটি সুস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্বই স্থির তরঙ্গের এক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। |
৭। অগ্রগামী তরঙ্গের সমীকরণ হচ্ছে-
| ৭। স্থির তরঙ্গের সমীকরণ হচ্ছে- |
শব্দ এক প্রকার শক্তি। কোন কম্পমান বস্তুর দ্বারা সৃষ্ট অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গই হল শব্দ। যেমন গীটারের তার, মানুষের বাকযন্ত্র, মাইক্রোফোনের পর্দা ইত্যাদি হতে উৎপন্ন তরঙ্গ শব্দ ।
শব্দ সঞ্চালনের জন্য মাধ্যম অত্যাবশ্যক। শব্দ তরঙ্গ যখন বায়ু মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়ে আমাদের কানে প্রবেশ করে তখন স্নায়ু মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে এক প্রকার অনুভূতি জাগায়, যার ফলে আমরা শুনতে পাই। বায়ু বা গ্যাসীয় পদার্থ ছাড়া তরল ও কঠিন পদার্থও শব্দের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যেমন রেল লাইনে কান পাতলে বহুদূর হতে আগত ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। শূন্য মাধ্যমে শব্দের উৎপত্তি ও সঞ্চালন কোনটিই সম্ভব নয়।
শব্দ উৎপত্তির মূল উৎসই বস্তুর কম্পন। বস্তুতে যতক্ষণ কম্পন থাকে ততক্ষণই এর শব্দ নিঃসরণ হয়। এ শব্দ নিরবচ্ছিন্ন স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমাদের কানে পৌঁছে শ্রবণের অনুভূতি জন্মায়।
উদাহরণস্বরূপ : একটি সুরশলাকা বা সুরেলী কাঁটাকে [চিত্র ১৭.১২] আঘাত করলে সুরেলী কাঁটা কম্পিত হবে ও শব্দ উৎপন্ন হবে। সুরেলী কাঁটা হাত দ্বারা স্পর্শ করলে কম্পন বন্ধ হবে। ফলে শব্দ নিঃসরণও বন্ধ হবে। চিত্রে সুর নিঃসরণকালে একটি সুরশলাকার এক বাহুর সংস্পর্শে রক্ষিত একটি ঝুলন্ত পিথবল সুরশলাকার কম্পনের দরুন বার বার ধাক্কা খেয়ে সরে যাচ্ছে বুঝানো হয়েছে [চিত্র ১৭.১২]
আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেও শব্দের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বুঝতে পারি। যেমন কোন ধাতব পদার্থ মেঝেতে পড়ে গেলে বা ধাতব পদার্থকে কোন ধাতব দণ্ড দিয়ে আঘাত করলে শব্দের সৃষ্টি হয়; কিন্তু হাত বা শক্ত কিছু দিয়ে চেপে ধরলে শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে কিংবা বাদ্যযন্ত্রের তারে টান দিয়ে বা ঢাক-ঢোলের চামড়ার পর্দা কাঁপিয়ে শব্দ সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে কম্পন থেকেই শব্দ সৃষ্টি হয়। এই কম্পন মাধ্যমে তরঙ্গের সৃষ্টি করে যা আমাদের কানের পর্দাকেও আন্দোলিত করে এবং আমরা শব্দ শুনতে পাই।
আমরা জানি, তরঙ্গ দু'রকমের — অনুপ্রস্থ এবং অনুদৈর্ঘ্য। শব্দ এক প্রকার তরঙ্গ। নিম্নের কারণগুলো প্রমাণ করে যে শব্দ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
১। তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য বস্তুর কম্পন প্রয়োজন। শব্দ সৃষ্টির জন্যও বস্তুর কম্পন প্রয়োজন।
২। তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের প্রয়োজন হয়, শব্দ সঞ্চালনের জন্যও স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।
৩। তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য মাধ্যম স্থানান্তরিত হয় না। শব্দের সঞ্চালনের সময়ও মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানান্তর ঘটে না।
৪। একস্থান হতে অন্যস্থানে সঞ্চালিত হতে তরঙ্গের কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়,শব্দ সঞ্চালনের জন্যও সময় প্রয়োজন হয় ।
৫। তরঙ্গের বেগ মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। শব্দের বেগও মাধ্যমের উপর নির্ভর করে।
৬। প্রত্যেক তরঙ্গের যেমন প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার এবং অপবর্তন ঘটে শব্দের বেলায়ও তা ঘটে।
৭। শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের সঙ্কোচন ও প্রসারণ ঘটে যা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য।
৮। গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের (সমবর্তন (polarization) হয় না। সমবর্তন কেবল আড় তরঙ্গের ক্ষেত্রে ঘটে। এতে প্রমাণিত হয় যে শব্দ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
৯। শব্দ কঠিন, তরল ও বায়বীয় মাধ্যমে সঞ্চালিত হতে পারে যা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে ঘটে।
উপরের ঘটনাসমূহ হতে প্রমাণিত হয় যে, শব্দ উৎসের কম্পনের ফলে শব্দ উৎপন্ন হয় এবং অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গাকারে বায়ু মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়ে আমাদের কানে পৌঁছায় এবং আমরা তা শুনতে পাই । অতএব, শব্দ একটি অগ্রগামী অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
মনে করি A ও B দুটি মাধ্যম।
ধরি কোন একটি শব্দের বেগ ও তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যথাক্রমে A মাধ্যমে vA এবং ও B মাধ্যমে যথাক্রমে vB এবং । যদি শব্দের কম্পাঙ্ক ‘n’ হয়, তবে
A মাধ্যমে শব্দের বেগ (18)
এবং B মাধ্যমে শব্দের বেগ (19)
(18) নং সমীকরণকে (19) নং সমীকরণ দ্বারা ভাগ করে পাই,
(20)
এটাই হল দুটি মাধ্যমে শব্দের বেগের মধ্যে সম্পর্ক।
মনে করি একটি মাধ্যমে দুটি তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। একটির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্ক n1। অপরটির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্ক |
মাধ্যমে তরঙ্গের বেগ v হলে,
প্রথম তরঙ্গের ক্ষেত্রে v =n1 । (22)
এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে v =
এখন (22) ও (23) সমীকরণ হতে পাই,
n1 =
বা,
এটিই হল তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্ক।
ব্যতিচার দুই ধরনের। যথা— (ক) গঠনমূলক ব্যতিচার এবং (খ) ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার
(ক) গঠনমূলক ব্যতিচার (Constructive interference) সমান বিস্তার ও কম্পাঙ্কের দুটি শব্দতরঙ্গ উপরিপাতনের ফলে যে স্থানে একই দশায় মিলিত হয়, সেখানে লঘি সরণ শব্দের প্রত্যেকটি তরঙ্গের সরণের যোগফলের সমান হয়। এক্ষেত্রে y1 = y2 হলে, লব্ধি সরণ দ্বিগুণ হয়। ফলে লব্ধি সরণের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হয়। এ ব্যতিচারকে গঠনমূলক ব্যতিচার বলে। [চিত্র ১৭-১৩(ক)]
(খ) ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার (Destructive interference) : সমান বিস্তার ও কম্পাঙ্কের দুটি শব্দতরঙ্গ উপরিপাতনের ফলে যে স্থানে বিপরীত দশায় মিলিত হয়, সেখানে লব্ধি সরণ শূন্য হওয়ায় কোন শব্দ শোনা যায় না। একে শব্দের ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে [চিত্র ১৭.১৩(খ)]। লব্ধি সরণ মোটা সরলরেখা দ্বারা দেখান হয়েছে।
দুটি উৎসকে সুসংগত করতে হলে উভয়কে একই উৎস হতে সৃষ্টি করতে হয়।
ধরা যাক সমান বিস্তার ও কম্পাঙ্কের দুটি শব্দ তরঙ্গ একই রেখায় সঞ্চালিত হয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হল। t সময় পরে যে কোন বিন্দুতে এদের সরণ যথাক্রমে Y1 এবং Y2 হলে আমরা পাই,
ও
এখানে n = সুরশলাকার কম্পাঙ্ক, = মাধ্যমে শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ও A0 = তরঙ্গের বিস্তার।
এ স্থলে প্রথম তরঙ্গ আলোচ্য বিন্দুতে যেতে x1 পথ ও দ্বিতীয় তরঙ্গ ঐ বিন্দুতে যেতে x2 পথ অতিক্রম করে। এখন তরঙ্গদ্বয়ের উপরিপাতের ফলে এদের লব্ধি সরণ Y হলে,
এখানে, হল লব্ধি বিস্তার।
সমীকরণ (25) একটি নতুন তরঙ্গের সমীকরণ। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে দুটি তরঙ্গের উপরিপাতের ফলে একটি নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়।
দুটি তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে উৎপন্ন তরঙ্গের বিস্তার A = 2 A0 cos π এবং এর মান মূল তরঙ্গদ্বয়ের পথ পার্থক্য (x2 – X1 )-এর উপর নির্ভর করে। গাণিতিকভাবে পাওয়া যায়, শব্দের তীব্রতা I তরঙ্গের বিস্তারের (A) বর্গের সমানুপাতিক।
অর্থাৎ,
বা,
উপরের গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, দুটি শব্দ তরঙ্গ নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করলে ব্যতিচার হবে :
১। তরঙ্গ দুটির কম্পাঙ্ক ও বিস্তার সমান হতে হবে।
২। তরঙ্গ দুটির আকৃতি ও দশা অপরিবর্তিত থাকবে।
৩। তরঙ্গ দুটির দরুণ মাধ্যমের কোন একটি কণার সরণ একই রেখায় হবে।
৪। শব্দের উৎস হতে নিঃশব্দ বা ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বিন্দুতে তরঙ্গদ্বয়ের অতিক্রান্ত পথ পার্থক্য -এর অযুগ্ম গুণিতক হবে এবং জোরালো বা গঠনমূলক ব্যতিচারের ক্ষেত্রে তরঙ্গদ্বয়ের অতিক্রান্ত পথ-পার্থক্য শূন্য অথবা -এর যুগ্ম গুণিতক হবে।
বাস্তবে দুটি ভিন্ন উৎস দ্বারা ১৭.১৪-এ বর্ণিত শর্তগুলো পুরাপুরি পূর্ণ করে শব্দের ব্যতিচার দেখানো যায় না। এজন্য কুইঙ্ক (Quincke)-এর উদ্ভাবিত পরীক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা একটি শব্দ তরঙ্গকে কোন একটি বিন্দু হতে দুটি ভিন্ন পথে প্রবাহিত হতে দিয়ে উপযুক্ত দশা বৈষম্যে পুনরায় অপর এক বিন্দুতে আপতিত করে শব্দের ব্যতিচার সৃষ্টি করা হয়। ১৭.১৪ নং চিত্রে পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে।
পরীক্ষায় দুটি U-আকৃতির দুই মুখ খোলা নল AB ও DEF নেয়া হয়। AB নলের দুই বাহুতে দুটি পার্শ্ব নল M ও N আছে। DEF নলের দুই বাহুর ভেতর AB নলের বাহু দুটি প্রবেশ করানো যায়।
একটি সুর-শলাকাকে শব্দায়িত করে M নলের মুখে ধরা হয়। এতে সুর-শলাকা হতে শব্দ তরঙ্গ AB ও DEF পথে প্রবাহিত হয়ে N নল দিয়ে বের হয়ে যাবার কালে P বিন্দুতে মিলিত হবে। ঐ দুই পথে প্রবহমান তরঙ্গের কম্পাঙ্ক, বিস্তার ও জাতি অভিন্ন থাকবে এবং তারা N নলে একই রেখায় সরণ সৃষ্টি করবে। এখন DEF নলটিকে বাইরের দিকে টেনে অথবা ভিতরের দিকে ঠেলে ABP ও AEP পথের দূরত্বের পার্থক্য বাড়ালে অথবা কমালে N নলের মুখে শব্দের তীব্রতার নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যাবে :
(ক) যখন ABP ও AEP-এর মধ্যে দৈর্ঘ্যের পার্থক্য অর্থাৎ তরঙ্গ দুটির অতিক্রান্ত পথের পার্থক্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অযুগ্ম গুণিতক হবে অর্থাৎ (AEP – ABP) = , 3(),5() ইত্যাদি হবে তখন তরঙ্গ দুটি P 'বিন্দুতে বিপরীত দশায় মিলিত হওয়ায় N নলের মুখে কোন শব্দ শোনা যাবে না। এটাই ধ্বাংসাত্মক ব্যতিচার ।
(খ) যখন AEP ও ABP পথের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য শূন্য অথবা এর যুগ্ম গুণিতক হবে অর্থাৎ (AEP - ABP)= 0,2 (), 4 ( ) ইত্যাদি হবে, তখন তরঙ্গ দুটি P বিন্দুতে সমদশায় মিলিত হবে এবং N-এর মুখে জোরালো শব্দ শোনা যাবে। এটিই শব্দের গঠনমূলক ব্যতিচার ।
ব্যবহার : কুইক নলের সাহায্যে শব্দের বেগ নির্ণয় করা যায়। AEP ও ABP পথের দৈর্ঘ্যের ন্যূনতম পার্থক্য N নলের মুখে কোন শব্দ শোনা না গেলে আমরা পাই, AEP - ABP = λ/2 । এখন, সুর শলাকার কম্পাক n হলে,
V= nλ = 2n ()=2n (AEP - ABP)
কাজেই, λ জেনে নলের বায়ুতে শব্দের বেগ জানা যাবে।