বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান (The contribution of garment industries to the economy of Bangladesh)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ভূগোল ও পরিবেশ - বাংলাদেশের সম্পদ ও শিল্প | NCTB BOOK

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের প্রথম থেকে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরপর এ শিল্প অতিদ্রুত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের শীর্ষে নিজের স্থান করে নেয়। বর্তমানে দেশে অনেকগুলো রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প ইউনিট রয়েছে। এগুলোর প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত। অবশিষ্টগুলো প্রায় সবই চট্টগ্রাম বন্দর সাময়িক নগরীতে এবং কিছু খুলনা এলাকায় রয়েছে। ২০১৭-১৮* সালে এ শিল্পে বাংলাদেশ ১৫,৪২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে, যা মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৪২.০৭ ভাগ (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৮* সাময়িক)।

 উৎপাদিত পোশাক  রপ্তানিকৃত দেশসমূহ
 ট্রাউজার, জিন্স প্যান্ট, স্কার্ট, টপস, সোয়েটার, জ্যাকেট, মেয়েদের পুলওভার, কার্ডিগান, ব্লাউজ, টি-শার্ট, শার্ট ও প্যান্ট ইত্যাদি।  আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, বেলজিয়াম, স্পেন ও যুক্তরাজ্য।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। অন্যান্য নিয়ামকের মধ্যে স্বল্প মজুরিতে শ্রমশক্তির সহজলভ্যতা অন্যতম। এ দেশে এ শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে দক্ষ ও অদক্ষ বিপুল শ্রমশক্তির, বিশেষ করে সমাজের নিম্ন আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়-রোজগারের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও সুফল বয়ে আনছে। পোশাক শিল্পকে এখন বলে ‘বিলিয়ন ডলার' শিল্প।

 EPZ : Export Processing Zone (রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল)

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প (Tourism Industry of Bangladesh )

প্রাকৃতিক ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। সপ্তম শতাব্দীতে প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক কবি হিউয়েন সাং এই দেশে এসে উচ্ছ্বসিতভাবে উল্লেখ করেছেন, ' A sleeping beauty emerging from mists and water.' তিনি তখন এই জনপদের সুপ্ত সৌন্দর্যটিকে কুয়াশা ও পানির অন্তরাল থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হতে দেখেছিলেন। তার সেই উপলব্ধি আজও এই বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য। পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্রসৈকত, ঘন অরণ্য ও পাহাড়ি এলাকা প্রকৃতিগতভাবেই এখানে বিদ্যমান। বাংলাদেশের পর্যটকদের ভ্রমণ কেন্দ্রগুলোর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য এ দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য বিরাট সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র । এ দেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুময় সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, দ্বীপ, হ্রদ, নদী ও পালতোলা নৌকার অনুপম দৃশ্যাবলি, সবুজ-শ্যামলিকা ঘেরা পাহাড়ি ভূমি রয়েছে, যা দেখলে মন ভরে যায়। এখানে রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও মঠসহ প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন। সিলেটের পাহাড়, হাওর ও চা বাগানের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য, কুয়াকাটায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। এছাড়াও এ দেশে বহু প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক স্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি রয়েছে, যা আকর্ষণীয় পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকর্ষণ করতে সক্ষম।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব (Importance of Tourism Industry of Bangladesh)

 বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, এই শিল্পের উন্নয়নের বদৌলতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক গতিশীলতা, আঞ্চলিক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও পরিবেশগত উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখতে পারে। এই শিল্পের মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পথ সুগম হয়। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং স্থাপত্যের নিদর্শনসমূহ বিশ্ব দরবারে পর্যটনের মাধ্যমেই তুলে ধরার মুখ্য পন্থা হিসেবে গণ্য করা যায় ।
বাংলাদেশ পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ২০০৫ সালে প্রণীত জাতীয় শিল্পনীতিতে একে অগ্রাধিকার শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয়, কর্মসংস্থান ও জাতীয় রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায়। পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নিকট উপস্থাপন করা যায়। এমন একটি ঝুঁকিহীন শিল্পে বাংলাদেশ আজও প্রাথমিক স্তরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বিদেশি পর্যটক এসেছে প্রায় ২,৯২,৮৮২ জন। এতে বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে আয় হয়েছে ২০১৮ সালে ১০৫৬.৭৪০ মার্কিন ডলার ।

(উৎস : বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রণালয় - বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৮-২০১৯)।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রসমূহ (Importance of Tourism Centres of Bangladesh)

  বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি স্থানেই পর্যটনের আকর্ষণীয় উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থানের নাম উল্লেখ করা হলো (চিত্র ১১.৬)।

বৃহত্তর ঢাকার পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of Greater Dhaka)

ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী ও প্রধান শহর। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত সাত গম্বুজ মসজিদ, অষ্টাদশ শতাব্দীর তারা মসজিদ এবং সাম্প্রতিককালের নির্মিত বায়তুল মোকাররম জামে মসজিদ। একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত ঢাকেশ্বরী মন্দির। মোগল সম্রাটদের বুড়িগঙ্গার নির্মিত লালবাগ দুর্গ, ১৮৫৭ সালের স্মৃতিসৌধ বাহাদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্থাপত্যসমূহ, জাতীয় কবির সমাধি, জাতীয় সংসদ ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মীরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, ধানমণ্ডিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিকৃতি ও মিউজিয়াম, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের জাতির জনক কর্তৃক ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইত্যাদি পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ও জমিদারবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক সোনারগাঁও এবং পানাম নগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পূর্ববঙ্গের পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of the Eastern Bengal)

টাঙ্গাইলের আটিয়া মসজিদ, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মাজার ও বঙ্গবন্ধু সেতু, মধুপুরের গড় ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর স্মৃতি বিজড়িত দরিরামপুর। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রা) ও শাহপরান (রা) মাজার, কিন ব্রিজ, জাফলং-এ জয়ন্তিয়া পাহাড়, মৌলভীবাজারে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া ইকোপার্ক ইত্যাদি। কুমিল্লার ময়নামতি বৌদ্ধ ও শালবন বিহার এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের সমাধিস্থল, নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ, গান্ধী আশ্রম, হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ ইত্যাদি ।

উত্তরবঙ্গের পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of the Northern Bengal)

রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর ও শাহ মখদুম (রা) মাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সোনা মসজিদ, নাটোরের রানি ভবানীর বাড়ি ও দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি (উত্তরা গণভবন), নওগাঁয় পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও শাহ সুলতান বলখী (রা) মাজার, দিনাজপুরে কান্তজিউ মন্দির ইত্যাদি।

দক্ষিণবঙ্গের পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of the Southern Bengal)

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সমাধি, সরমী কবি লালন শাহের মাজার ও শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, যশোরের সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান, নড়াইলে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান শিশু স্বর্গ ও আর্ট গ্যালারী চিত্রা নদীর তীরে, মেহেরপুরে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, বাগেরহাটে ষাট গম্বুজ মসজিদ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, বৃহত্তর খুলনার অবস্থিত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ইত্যাদি।


রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of Chittagong Hill Tracts)

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ এখানকার প্রধান আকর্ষণ (চিত্র ১১.৭)। এই হ্রদের চারদিকে সবুজ ঘেরা পাহাড়, নীলাভ পানি এবং হ্রদের ধারে ছোট ছোট টিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে, অনাবিল আনন্দ উপভোগের এক মোহনীয় স্থানে রূপান্তরিত করেছে। এখানে বৌদ্ধ বিহার ও চাকমা রাজার রাজবাড়ি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। খাগড়াছড়ির বনভূমি, পাহাড় ও প্রাকৃতিক ঝরনা। বান্দরবানের মেঘলা, শৈলপ্রপাত, নীলপির ও নীলাচল (চিত্র ১১.৮) ইত্যাদি পর্যটন স্পট অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

চট্টগ্রামের পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of Chittagong)

চট্টগ্রামের আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো হচ্ছে হযরত শাহ আমানত (রা) মাজার, ফর'স লেক, ডিসি হিল, কোর্ট বিল্ডিং, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, সীতাকুণ্ড ইত্যাদি।

কক্সবাজার এলাকার পর্যটন স্থানসমূহ (Tourism places of Cox's Bazar)

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও বনভূমির নয়নাভিরাম দৃশ্য কল্পবাজারকে একটি আকর্ষণীর পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। কক্সবাজারের করেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থান হলো হিমছড়ি, ইনানি বিচ, কলাতলি বিচ, রামু বৌদ্ধ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, মহেশখালী দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ (চিত্র ১১.৯) ।

 

Content added By
Promotion