সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আবদুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে সে এসে ঘরে ঢুকল। রুটি, মামলেট, পনির, চা। অন্যদিন খাবার দিয়ে চলে যেত, আজ সামনে দাঁড়িয়ে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল। কী মুশকিল । মৌলানা এসে বললেন, চিরকুটে লেখা আছে, মাথাপিছু দশ পাউন্ড লাগেজ নিয়ে যেতে দেবে। কী রাখি, কী নিয়ে যাই?
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন চারদিকে তাকালাম, তখন মনে যে প্রশ্ন উঠল তার কোনো উত্তর নেই । নিয়ে যাব কী, আর রেখে যাব কী?
ওই তো আমার দু ভল্যুম রাশান অভিধান । এরা এসেছে মস্কো থেকে ট্রেনে করে তাশখন্দ, সেখান থেকে মোটরে করে আমুদরিয়া, তারপর খেয়া পেরিয়ে, খচ্চরের পিঠে চেপে সমস্ত উত্তর আফগানিস্তান পিছনে ফেলে, হিন্দুকুশের চড়াই-উতরাই ভেঙে এসে পৌঁছেছে কাবুল। ওজন পাউন্ড ছয়েক হবে।
ভুলেই গিয়েছিলাম । এক জোড়া চীনা ‘ভাজ’। পাতিনেবুর মত রং আর চোখ বন্ধ করে হাত বুলোলে মনে হয় যেন পাতিনেবুরই গায়ে হাত বুলোচ্ছি, একটু জোরে চাপ দিলে বুঝি নখ ভেতরে ঢুকে যাবে। কত ছোটোখাটো টুকিটাকি। পৃথিবীর আর কারো কাছে এদের কোনো দাম নেই, কিন্তু আমার কাছে এদের প্রত্যেকটি আলাউদ্দিনের প্রদীপ ।
অবশ্য জামা-কাপড় পরে নিলুম একগাদা। মৌলানা তার এক পাঞ্জাবি বন্ধুর সঙ্গে আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন।
আবদুর রহমান বসবার ঘরে প্রাণভরে আগুন জ্বালিয়েছে। আমি একটা চেয়ারে বসে। আবদুর রহমান আমার পায়ের কাছে।
আমি বললুম, ‘আবদুর রহমান, তোমার ওপর অনেকবার খামোখা রাগ করেছি, মাফ করে দিয়ো ।' আবদুর রহমান আমার দু-হাত তুলে নিয়ে আপন চোখের ওপর চেপে ধরল। ভেজা । আমি বললুম, “ছিঃ আবদুর রহমান, এ কী করছ? আর শোনো, যা রইল সবকিছু তোমার ।’
রাস্তা দিয়ে চলেছি। পিছনে পুঁটুলি-হাতে আবদুর রহমান ।
দু-একবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলুম। দেখলুম সে চুপ করে থাকাটাই পছন্দ করছে।
শহর ছাড়িয়ে মাঠে নামলাম। হাওয়াই জাহাজের ঘাঁটি আর বেশি দূর নয়। পিছন ফিরে আরেকবার কাবুলের দিকে তাকালাম। এই নিরস নিরানন্দ বিপদসঙ্কুল পুরী ত্যাগ করতে কোনো সুস্থ মানুষের মনে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কিন্তু বোধ হয় এই সব কারণেই যে লোকের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জন্মেছিল তাঁদের প্রত্যেককে অসাধারণ আত্মজন বলে মনে হতে লাগল। এঁদের প্রত্যেকেই আমার হৃদয় এতটা দখল করে বসে আছে যে, এঁদের সকলকে এক সঙ্গে ত্যাগ করতে গিয়ে মনে হলো আমার সত্তাকে যেন কেউ দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে। ফরাসিতে বলে ‘পার্তিও সে তাঁ প্য মুরির', প্রত্যেক বিদায় গ্রহণে রয়েছে খণ্ড-মৃত্যু
হাওয়াই জাহাজ এল । আমাদের কুঁচকিগুলো সাড়ম্বরে ওজন করা হলো । কারো পোটলা দশ পাউন্ডের বেশি হয়ে যাওয়ায় তাদের মস্তকে বজ্রাঘাত। অনেক ভেবেচিন্তে যে কয়টি সামান্য জিনিস নিয়ে মানুষ দেশত্যাগী হচ্ছে তার থেকে ফের জিনিস কমানো যে কত কঠিন সেটা দাঁড়িয়ে না দেখলে অনুমান করা অসম্ভব। একজন তো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
এইটুকু ওজনের ভিতর আবার এক গুণী একখানা আয়না এনেছেন! লোকটির চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, কই তেমন কিছু খাপসুরত অ্যাপোলো তো নন। ঘরে আগুন লাগলে মানুষ নাকি ছুটে বেরোবার সময় ঝাঁটা নিয়ে বেরিয়েছে, এ কথা তাহলে মিথ্যা নয় ।
ওরে আবদুর রহমান, তুই এটা এনেছিস কেন? দশ পাউন্ডের পুঁটুলিটা এনেছে ঠিক কিন্তু বাঁ হাতে আমার টেনিস র্যাকেটখানা কেন? আবদুর রহমান কি একটা বিড়বিড় করল। বুঝলাম, সে ওই র্যাকেটখানাকেই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছিল, তার কারণ ও জিনিসটা আমি তাকে কখনও ছুঁতে দিতুম না । আবদুর রহমান আমাদের দেশের ড্রাইভারদের মতো। তার বিশ্বাস স্ক্রু মাত্রই এমনভাবে টাইট করতে হয় যে, সেটা যেন আর কখনো খোলা না যায়। ‘অপটিমাম’ শব্দটা আমি আবদুর রহমানকে বোঝাতে না পেরে শেষটায় কড়া হুকুম দিয়েছিলাম, র্যাকেটটা প্রেসে বাঁধা দূরে থাক, সে যেন ওটার ছায়াও না মাড়ায় । আবদুর রহমান তাই ভেবেছে, সায়েব নিশ্চয়ই এটা সঙ্গে নিয়ে হিন্দুস্থানে যাবে।
দেখি স্যার ফ্রান্সিস। নিতান্ত সামনে, বয়সে বড়ো, তাই একটা ছোটাসে ছোটা নড্ করলুম। সায়েব এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুড মর্নিং আই উইশ এ গুড জার্নি।'
আমি ধন্যবাদ জানালুম ৷
সায়েব বললেন, 'ভারতীয়দের সাহায্য করবার জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। প্রয়োজন হলে আশা করি, ভারতবর্ষে সে কথাটি আপনি বলবেন।'
আমি বললুম, ‘আমি নিশ্চয়ই সব কথা বলব।'
সায়েব ভোঁতা, না ঘড়েল ডিপ্লোমেট, ঠিক বুঝতে পারলুম না ।
বিদায় নেবার সময় আফগানিস্তানে যে চলে যাচ্ছে সে বলে ‘ব্ আমানে খুদা'—'তোমাকে খোদার আমানতে রাখলাম', যে যাচ্ছে না সে বলে 'ব্ খুদা সপুদমৎ’–‘তোমাকে খোদার হাতে সোপর্দ করলাম।' আবদুর রহমান আমার হাতে চুমো খেল। আমি বললাম, ‘ব্ আমানে খুদা, আবদুর রহমান', আবদুর রহমান মন্ত্রোচ্চারণের মত একটানা বলে যেতে লাগল ‘ব্ খুদা সপুদমৎ, সায়েব, ব্ খুদা সপুদমৎ, সায়েব।' হঠাৎ শুনি স্যার ফ্রান্সিস বলছেন, 'এ-দুর্দিনে যে টেনিস র্যাকেট সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় সে নিশ্চয়ই পাকা স্পোর্টসম্যান'।
লিগেশনের এক কর্মচারী বললেন, 'ওটা দশ পাউন্ডের বাইরে পড়েছে বলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।' সাহেব বললেন, ‘ওটা প্লেনে তুলে দাও।' ওই একটা গুণ না থাকলে ইংরেজকে কাক-চিলে তুলে নিয়ে যেত ।
আবদুর রহমান এবার চেঁচিয়ে বলছে, ‘ব্ খুদা সপুদমৎ, সায়েব, ব্ খুদা সপুদমৎ।' প্রপেলার ভীষণ শব্দ করছে।
আবদুর রহমানের তারস্বরে চিৎকার প্লেনের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছি। হাওয়াই জাহাজ জিনিসটাকে আবদুর রহমান বড্ড ডরায়। তাই খোদাতালার কাছে সে বারবার নিবেদন করছে যে, আমাকে সে তাঁরই হাতে সঁপে দিয়েছে।
প্লেন চলতে আরম্ভ করেছে। শেষ শব্দ শুনতে পেলাম, ‘সপুদমত্’। আফগানিস্তানে আমার প্রথম পরিচয়ের আফগান আবদুর রহমান; শেষ দিনে সেই আবদুর রহমান আমায় বিদায় দিল ।
উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে এবং এই শেষ বিদায়কে যদি শ্মশান বলি তবে আবদুর রহমান শ্মশানেও আমাকে কাঁধ দিল । স্বয়ং চাণক্য যে কয়টা পরীক্ষার উল্লেখ করে আপন নির্ঘণ্ট শেষ করেছেন আবদুর রহমান সব কয়টাই উত্তীর্ণ হলো। তাকে বান্ধব বলব না তো কাকে বান্ধব বলব?
বন্ধু আবদুর রহমান, জগদ্বন্ধু তোমার কল্যাণ করুন ।
মৌলানা বললেন, ‘জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও' বলে আপন সিটটা আমায় ছেড়ে দিলেন । তাকিয়ে দেখি দিকদিগন্ত বিস্তৃত শুভ্র বরফ । আর এয়ারফিল্ডের মাঝখানে, আবদুর রহমানই হবে, তার পাগড়ির ন্যাজ মাথার উপর তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হলো চতুর্দিকের বরফের
চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয় ।
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের করিমগঞ্জ (বর্তমান ভারতের কাছাড়) শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি সিলেট সরকারি স্কুলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। সৈয়দ মুজতবা আলীর কর্মজীবন শুরু হয় আফগানিস্তান সরকারের শিক্ষা বিভাগে। সৈয়দ মুজতবা আলী ভ্রমণ ও রম্যসাহিত্য রচয়িতা হিসেবে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত। তিনি বাংলা গদ্যে হাস্যরসের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের সংযোগ ঘটিয়ে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ‘দেশে বিদেশে', ‘পঞ্চতন্ত্র', 'চাচা কাহিনী', 'শবনম' তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমান অংশটি লেখকের বিখ্যাত ভ্রমণ-কাহিনি ‘দেশে-বিদেশে' গ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত অংশবিশেষ। আফগান সরকারের শিক্ষা বিভাগে কাজ করার সময় লেখক কাবুলে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁর গৃহপরিচারক আবদুর রহমানের সঙ্গে গড়ে ওঠে এক গভীর মানবিক সম্পর্ক। গৃহকর্ম ছাড়াও লেখকের দেখভালের প্রতিও আবদুর রহমানের ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিছুদিন পর কাবুলে হঠাৎ অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে খাবার-দাবারসহ নিরাপত্তারও সংকট দেখা দেয়। এ সংকটে লেখক ও আবদুর রহমান অল্প খাবার ভাগ করে খেতেন। এ পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসার জন্য লেখক বিমানের একটি আসন লাভ করেন। বিমানবন্দরে আবদুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণের সময় আবেগঘন অবস্থার সৃষ্টি হয়। আফগানিস্তানে লেখকের উচ্চপদস্থ বহু বন্ধু থাকা সত্ত্বেও আবদুর রহমানকেই পরম বান্ধব বলে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন । মানুষের প্রতি ভালোবাসার সত্যিকারের প্রকাশ জাতি বা শ্রেণিতে আবদ্ধ থাকে না- তা সর্বদেশের, সর্বকালের।
মামলেট — অমলেট। ডিম ভাজা। ইংরেজি omelette |
পনির — লবণাক্ত জমাট বাঁধা ছানা ।
কার্পেট — গালিচা । ইংরেজি carpet
ভল্যুম — বইয়ের খণ্ড। ইংরেজি volume.
রাশান — রুশ। ইংরেজি Russian.
তাশখন্দ — তৎকালীন রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের শহর। বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী ।
আমুদরিয়া — তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী।
খচ্চর — ঘোড়া ও গাধার মতো পশু ।
হিন্দুকুশ — আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত পবর্তমালা ।
চড়াই-উতরাই — উঁচু-নিচু ।
পাণ্ডুলিপি — হাতে লেখা কাগজ বা গ্রন্থ ।
ভাজ — ফুলদানি। ইংরেজি vase.
আলাউদ্দীনের প্রদীপ — আরব্য রজনীর কাহিনিতে উল্লেখিত আশ্চর্য প্রদীপ । এই প্রদীপের সাহায্যে এক দৈত্যের মাধ্যমে যে কোনো কিছু করতে পারা যায়।
পাঞ্জাবি — পাঞ্জাব অঞ্চলের মানুষ ৷
ঘাঁটি — বিমানবন্দর ।
বিপদসঙ্কুল — বিপদে পরিপূর্ণ
পুরী — প্রাসাদ, আবাসস্থল বা থাকার জায়গা ।
হৃদ্যতা — · বন্ধুত্ব।
গুণী — পণ্ডিত মানুষ । এখানে বিদ্রূপ অর্থে ।
খাপসুরত — অত্যন্ত সুন্দর। ফারসি ‘খাপ’ ও আরবি ‘সুরত' শব্দের মিলিত রূপ ।
র্যাকেট — টেনিস খেলার ব্যাট। ইংরেজি racket.
অপটিমাম — সহজে খোলা যায় এমন অবস্থা। ইংরেজি optimum.
প্রেসে বাঁধা — র্যাকেট বাঁকা না হওয়ার জন্য স্ক্রু দিয়ে একটি ফ্রেমে চেপে বেঁধে রাখা । ইংরেজি
ছোটাসে ছোটা — ছোটোর চেয়ে ছোটো।
নড় — · সামনের দিকে মাথা নত করে অভিবাদন জানানো। ইংরেজি nod.
ভোঁতা — ধারহীন । এখানে ‘চালাক নয়’ অর্থে।
ঘড়েল — পাকা, সুচতুর।
ডিপ্লোম্যাট — কূটনীতিক । রাষ্ট্রদূত। ইংরেজি diplomat.
লিগেশন — দূতাবাসের কর্মকর্তা । ইংরেজি legation.
প্রপেলার — ইঞ্জিনের পাখা। ইংরেজি propeller.
তারস্বরে — অতি উচ্চ শব্দে
ব্যসনে — দুঃখে, কষ্টে ।
রাষ্ট্রবিপ্লব — এখানে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলের কথা বলা হয়েছে।
চাণক্য — প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ।
ন্যাজ — লেজ।