রামিনের বয়স দুই বছর। সে তার খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলে। কিন্তু কয়েক মাস আগে সে যেভাবে খেলত, এখন তার খেলা আরও বেশি বাস্তবধর্মী। সে এখন গাড়ি চালানোর সময় শব্দ করে বু বু ... ...। গাড়িটি যখন ধাক্কা খায় কিংবা পড়ে যায় তখন সে অন্য রকম শব্দ করে। অর্থাৎ গাড়ি সম্পর্কে সে নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলছে। পূর্বে রামিন বা–বা, দা-দা এভাবে শুধুমাত্র আওয়াজ করত, এখন সে কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে, শুধু তা–ই নয়, রামিন এখন হাঁটতে পারে, দৌড়াতে পারে, কোনো কিছু বেয়ে উঠতে পারে যা কয়েক মাস আগেও তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। রামিনের মতো বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিটি শিশু ধীরে ধীরে কিছু ক্ষমতা অর্জন করে, যা তার আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এসবই শিশুর বিকাশ। বিকাশ হলো গুণগত পরিবর্তন, যা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিকাশ কখনো থেমে থাকে না ।
আমরা বিকাশ (Development) কথাটির পাশাপাশি বর্ধন (Growth) কথাটি ব্যবহার করি। বর্ধন হলো পরিমাণগত পরিবর্তন। যখন দেহের কোনো একটি অংশের বা সমগ্র দেহের বৃদ্ধি ঘটে যার ফলে আকার আকৃতির পরিবর্তন হয় সেটাই বর্ধন। শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি, ওজনের বৃদ্ধি এর সহজ উদাহরণ। বর্ধন ও বিকাশ-এর অর্থ এক নয়। শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার ওজন থাকে প্রায় ৩ কেজি। ছয় মাসে তার ওজন দ্বিগুণ হয়, এক বছরে হয় তিনগুণ। শিশুর ওজন বৃদ্ধি হলো পরিমাণগত পরিবর্তন বা বর্ধন । নবজাতকের ওজন বাড়ার সাথে সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিছু ক্ষমতা অর্জন করে। জন্মের পর প্রথমে শিশু নিজের হাত-পা নিয়ে খেলে, পাঁচ বছরে সেই হাত দিয়ে সে ছবি আঁকে, দশ বছরে দক্ষতার সাথে হাত দিয়ে ক্রিকেট খেলার বল ছুড়তে পারে। শিশুর হাত শুধু দৈর্ঘ্যেই বাড়ে নি, তার গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনই হলো বিকাশ। বর্ধনের তুলনায় বিকাশ অনেক ব্যাপক। বর্ধন হচ্ছে বিকাশের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়।
বিকাশ একটি জটিল প্রক্রিয়া। পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতার ফলে বিকাশজনিত পরিবর্তন হতে থাকে। বিকাশে বৃদ্ধি ও ক্ষয় – এ দু'টোই ক্রিয়াশীল থাকে। জীবনের শুরুতে ক্ষয়ের চেয়ে বৃদ্ধি এবং জীবনের শেষ দিকে বৃদ্ধির চেয়ে ক্ষয় বেশি হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক, মানসিক দক্ষতার ক্ষয় হলেও চুল ও নখের বৃদ্ধি হতেই থাকে।
বর্ধন ও বিকাশের বৈশিষ্ট্য :
বিকাশের ক্ষেত্রগুলো হলো-
শারীরিক বিকাশ- বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার ও আকৃতির পরিবর্তন, ওজনের বৃদ্ধি, উচ্চতার বৃদ্ধি, বুক কাঁধ চওড়া হওয়া ইত্যাদি।
বুদ্ধিবৃত্তীয় বিকাশ- কোনো কিছুর প্রতি মনোযোগ দেওরা, বুঝতে চেষ্টা করা, মনে রাখা, যুক্তি দিয়ে চিন্তাকরা, সৃজনী শক্তি, সমস্যার সমাধান করতে পারা ইত্যাদি।
সঞ্চালনমূলক বিকাশ- জন্মের পর হাত-পা নাড়াতে পারা, বসতে পারা, হাঁটতে, দৌড়াতে, ধরতে পারা, লাথি মারা, ভারসাম্য রাখতে পারা ইত্যাদি।
ভাষার বিকাশ- একটি দুইটি শব্দ বলা, ছোট ছোট বাক্য কাতে পারা। প্রশ্ন করা, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, গুছিয়ে কথা বলতে পারা ইত্যাদি ।
আবেগীর বিকাশ- খুশি হলে হাসা, ব্যথা পেলে কাঁদা, বিকট শব্দে ভয় পাওয়া, কিছু চেয়ে না গেলে রেগে যাওয়া ইত্যাদি শিশুর আবেগের প্রকাশ। এভাবে ভালো লাগা, খারাপ লাগা, আবো সঠিকভাবে প্রকাশ করা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন এ সব গুলোই আবেগীয় বিকাশ।
আবেদীর বিকাশ - খুশি হলে হাসা, ব্যথা পেলে কাঁদা, বিকট শব্দে ভয় পাওয়া, কিছু চেয়ে না গেলে রেগে যাওয়া ইত্যাদি শিশুর আবেগের প্রকাশ। এভাবে ভালো লাগা, খারাপ লাগা, আবো সঠিকভাবে প্রকাশ করা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন এ সব গুলোই আবেগীয় বিকাশ।
সামাজিক বিকাশ- জন্মের পর থেকে বয়স অনুযায়ী মা-বাবা, ভাইবোনসহ অন্যদের সাথে মিলতে পারার ক্ষমতা এবং ধীরে ধীরে পরিবার ও সমাজের রীতিনীতি নিয়ম অনুযায়ী খাপ খাইয়ে চলতে পারার ক্ষমতার বিকাশ। যেমন— অন্যকে সাহায্য করা, দয়া প্রদর্শন, সৌজন্যবোধ, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব ইত্যাদি।
নৈতিক বিকাশ— সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ গড়ে উঠা, অন্যায়ের জন্য অনুশোচনা করা, ন্যায় কাজের জন্য তৃপ্তি পাওয়াই নৈতিক বিকাশ। মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি নৈতিকতাবিরোধী কাজ।
শিশুর বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিকাশ একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শিশু যখন বসতে শেখে, হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শেখে, হাঁটতে শেখে, তখন সে তার চারপাশের জগতের সাথে পরিচিত হয়। এতে তার বুদ্ধিবৃত্তীয় বিকাশ ঘটে। আবার শিশুটি যখন নতুন কিছু শেখে তখন বড় সদস্যরা তাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে, আনন্দ দেয়। এ কাজগুলোর মধ্য দিয়ে শিশুর সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ ঘটে। সুতরাং বলা যায় সকল প্রকার বিকাশের সমন্বয়ে মানব শিশুর পূর্ণবিকাশ ঘটে।
কাজ - বর্ধন ও বিকাশের পার্থক্য চার্চ করে দেখাও।
আমরা সবাই জানি, জীবনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভ থেকে। ২৮০ দিন বা ৪০ সপ্তাহ বা নয় মাস গর্ভে থাকার পর শিশুর জন্ম হয়। জন্মের পর শৈশব, কৈশোর, প্রাপ্ত বয়স পার হয়ে একজন ব্যক্তি বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়। মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে একই রকম বৈশিষ্ট্য থাকে না। একটি দুই বছরের শিশু এবং একটি দশ বছরের শিশুর বৈশিষ্ট্যের অনেক পার্থক্য থাকে। আবার কৈশোর ও প্রাপ্ত বয়সের বিকাশ কখনোই একরকম নয়। জীবন প্রসারের সম্পূর্ণ সময়কে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলোই বিকাশের স্তর নামে পরিচিত।
এই স্তরগুলো হলো –
জন্মপূর্ব কাল (Prenatal Period) - জীবনের সূচনা থেকে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সময়কাল। সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনের সময়কাল হলো মাতৃগর্ভের এই সময়কাল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে একটি এককোষী জীব একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়। জন্মগ্রহণের পর মাতৃগর্ভের বাইরের পরিবেশের সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য ভ্রুণ শিশুর মধ্যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে।
নবজাতকাল (Neonatal Period) - জন্ম মুহূর্ত থেকে দুই সপ্তাহ সময়কাল নবজাতকাল। এ সময়ে নবজাতককে নতুন পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য গ্রহণ ও শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশনে তার গ্রন্থি সক্রিয় হয়। মাতৃগর্ভের গরম পরিবেশ ( ১০০° ফারেনহাইট) থেকে কম তাপমাত্রার পরিবেশের সাথে তাকে সঙ্গতি বিধান করতে হয়। সুস্থ নবজাতক জন্মের সময় চিৎকার করে কাঁদে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২০ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটায়। তার যেকোনো অসুবিধা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো কান্না । আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নবজাতকের স্বাভাবিক ওজন আড়াই কেজি থেকে তিন কেজি।
অতি শৈশব ও টডলারহুড (Babyhood & Toddlerhood) - দুই সপ্তাহ থেকে ২ বছর পর্যন্ত সময়কাল। কিছুদিন পূর্বেও যে শিশুটি বড় অসহায় ছিল সে এখন—বসতে পারে, হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে। এই বয়সের মধ্যে তার অন্যের সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। ১ম বৎসর অতি শিশু, ২য় বৎসর হলো টডলার। শিশুর দুই বছর বয়সের মধ্যে আত্মনির্ভরতার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়, যা তাদের স্বাধীনভাবে চলতে সহায়তা করে।
প্রারম্ভিক শৈশব (Early childhood) - ২ থেকে ৬ বছর। এ সময়ে শিশু লম্বা ও ক্ষীণকায় হয়। হাঁটা, দৌড়ানো, আরোহণ করা, ধরা ইত্যাদিতে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করে। তারা অনেক বেশি নিজের কাজগুলো করতে পারে। যেমন- নিজে খাওয়া, নিজে নিজে পোশাক পরা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া ইত্যাদি। তারা পরিবারের সদস্যদের অনুকরণ করে খেলে। তারা সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করে। এ বয়সে তারা কৌতূহলী হয় ও অনেক প্রশ্ন করে।
মধ্য শৈশব (Middle Childhood) - ৬ থেকে ১১ বছর। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে এবং নতুন নতুন দায়িত্ব পালনে দক্ষ হয়। খেলাধুলায় দক্ষ হয়, নিয়ম সমৃদ্ধ খেলায় (যেমন-গোল্লাছুট, বৌচি, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি) অংশ নেয়। তারা যুক্তিপূর্ণ চিন্তা, ভাষার দক্ষতা অর্জন করে এবং ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে তাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়। তারা বন্ধুত্ব তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
বয়ঃসন্ধি বা কৈশোরকাল ( Adolescence) - ১১ থেকে ১৮ বছর – এই সময়টি শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়সে যাওয়ার সময়কাল। বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রাপ্ত বয়স্কের মতো দেহের আকার আকৃতি ও যৌন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়। যৌন ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে তারা প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। বিমূর্ত বিষয় চিন্তা করতে পারে অর্থাৎ যে বিষয় চোখে দেখা যায় না যেমন- সততা, স্নেহ, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়গুলো বুঝতে পারে। কে কোন পেশায় যাবে সে অনুযায়ী পড়াশোনা করে।তার মধ্যে নিজস্ব লক্ষ্য, মূল্যবোধ — তৈরি হয়। তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে আরম্ভ করে। এ বয়সে নিজ চেহারার প্রতি তাদের মনোযোগ বাড়ে।
প্রারম্ভিক বয়ঃপ্রাপ্তিকাল ( Early Adulthood) - ১৮ থেকে ২৫ বছর। পেশা ও সঙ্গী নির্বাচনের প্রস্তুতি— এ সময়ের অন্যতম কাজ। এ বয়সে বিয়ে ও পরিবার গঠনের আগ্রহ তৈরি হয়। অনেকে পেশা সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে আসে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি উত্তরণের পর বাস্তবমুখী পেশা নির্বাচনের পথ স্থির হয়। খেলাধুলায় অংশগ্রহণের চেয়ে এই বয়সে দর্শকের ভূমিকা পালনে তারা আগ্রহী হয়। তারা সরকার, রাজনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে বন্ধুদের সাথে চিন্তার আদান-প্রদান করে ।
বয়ঃপ্রাপ্তির শেষভাগ (Late Adulthood)- ২৫ থেকে ৪০ বছর। বয়ঃপ্রাপ্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মা- বাবা হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ। এ সময়ে বিয়ের পর দুইটি ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দুজনের মধ্যে খাপ খাওয়ানো শিখতে হয়। সন্তান লালন-পালন একটি নতুন কাজ, যা তাদের অবশ্যই পালন করতে হয়। স্বামী স্ত্রীর সুন্দর সমঝোতায় গৃহ পরিচালনায় সফলতা আসে। চাকরি, বিয়ে, সন্তান সবকিছু নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, তারা এসবের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ পায় না।
মধ্যবয়স (Middle Age ) - ৪০ থেকে ৬৫ বছর। কাজ থেকে অবসর গ্রহণের সময় পর্যন্ত এই বয়সের ব্যাপ্তি। এটা প্রাপ্ত বয়স থেকে বার্ধক্যে অবতীর্ণ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়। কর্মক্ষেত্রে সফলতা বা নেতৃত্বদান এ বয়সেই হয়ে থাকে। মধ্য বয়সে প্রধান শারীরিক লক্ষণগুলো হলো- ওজন বৃদ্ধি, চুল পাকা, কুঁচকানো ত্বক, হাত পায়ের জোড়ায় ব্যথা, দৃষ্টি শক্তির সমস্যা ইত্যাদি।
বার্ধক্য (Old Age )-৬৫ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি মানব - বিকাশের সর্বশেষ স্তর। বার্ধক্য ক্ষয়ের সূচনা করে। এই সময়ে শারীরিক, মানসিক অবস্থার ধারাবাহিক অবনতি দেখা যায়। তাঁদের কাজ করার শক্তি হ্রাস পায়। বৃদ্ধরা তাঁদের নিজেদেরকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা খুব কম গঠনমূলক কাজ করতে পারে। তাদের ধর্মীয় আগ্রহ বাড়ে। যদি বার্ধক্যে হতাশা, জীবন সম্পর্কে বিরক্তি, মৃত্যু ভয় মোকাবিলা করা যায় তবে এ সময়টিতে পরিতৃপ্তির অনুভূতি আসে।
আমরা জানি, বিকাশ ধারাবাহিকভাবে চলে। এটা কখনো থেমে থাকে না। জীবনের প্রতিটি স্তরে বিকাশ সম্পর্কে সমাজের নির্দিষ্ট প্রত্যাশা থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কে সমাজের প্রত্যাশা এমন থাকে যে সে উপার্জন করবে, পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করবে। যে ব্যক্তি প্রাপ্তবয়সেও পিতামাতার উপর নির্ভরশীল থাকে সে সঠিকভাবে সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যক্রম পালন করতে পারছে না ধরে নেওয়া হয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে যে নির্দিষ্ট কাজ সামনে আসে তা সফলভাবে করতে পারলে জীবন হয় সুখের এবং পরবর্তী স্তরের কাজও সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়। অপর দিকে এ কাজের ব্যর্থতা জীবনে আনে অশান্তি এবং পরবর্তী স্তরের সফলতায় বাধা সৃষ্টি করে। বিকাশের বিভিন্ন স্তরে সামাজিক প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজকেই বিকাশমূলক কার্যক্রম বলা হয়। অর্থাৎ বিকাশমূলক কার্যক্রম হলো-
বিকাশমূলক কাজগুলো হলো-
বিকাশমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকলে যে সুবিধাগুলো হয় তা হলো-
অতি শৈশব ও প্রারম্ভিক শৈশবের কয়েকটি বিকাশমূলক কাজ -
মধ্য শৈশবের কয়েকটি বিকাশমূলক কাজ—
বয়ঃসন্ধি বা কৈশোরের বিকাশমূলক কাজ—
কাজ – মধ্য শৈশব ও কৈশোরের বিকাশমূলক কাজ কোন গুলো— পৃথকভাবে তালিকা কর ।
আমাদের চারপাশে যে মানুষগুলোকে আমরা দেখি তারা সবাই এক রকম নয় কেন? জন্ম অবস্থায় শিশুর মধ্যে কি এমন প্রবণতা থাকে যার কারণে তার দেহের আকৃতি, গঠন, চেহারাসহ আচরণ, গুণাবলি অন্যদের থেকে আলাদা হয়? নাকি সে যে পরিবেশে জীবনযাপন করে তার প্রভাবেই তার সারা জীবনের বিকাশ নিয়ন্ত্রিত হয়! এসব প্রশ্ন নিয়ে মনোবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক যুগ যুগ ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার মাধ্যমে তারা শিশুর বিকাশে বংশগতি কীভাবে কাজ করে, বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা কী এসব বিষয়ে ধারণা লাভ - করেন। আমরা এখন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানব ।
বংশগতি—
মেয়েটির গায়ের রং একেবারে তার দাদির মতো। ছেলেটি বাবার মতো সাহসী কিংবা মেয়েটি মায়ের মতোই গানের গলা পেয়েছে। এরকম উক্তি আমরা সব সময়ই শুনে থাকি। শিশু জন্মসূত্রে তার বাবা-মা কিংবা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যে বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে সেটাই বংশগতি। বংশগতি দিয়ে শিশু তার জীবন শুরু করে। বংশগতির কারণে মানুষের সন্তান মানুষের মতো দেখতে হয়, অন্য কোনো প্রাণীর মতো হয় না। আবার উচ্চতা, দেহের গঠন, চুল, চোখ, চামড়ার রং ইত্যাদি দৈহিক গুণাবলি এবং বিভিন্ন মানসিক গুণাবলি বংশগতির কারণে একেক জনের একেক রকম হয়। বংশগতির প্রভাব জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে সারা জীবনব্যাপী চলতে থাকে।
বংশগতির সূচনা হয় মাতৃগর্ভ থেকে। বাবার শুক্রাণু ও মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে ভ্রুণ বা জীবকোষ (Zygote) তৈরি হয়। জীবকোষের প্রধান তিনটি অংশ হচ্ছে— কোষ প্রাচীর, প্রোটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াস । নিউক্লিয়াস হলো জীবকোষের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিটি মানব জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। প্রতিটি জোড়ার একটি আসে মাতৃকোষ থেকে অন্যটি পিতৃকোষ থেকে। মা ও বাবার কাছ থেকে পাওয়া ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ২২টি জোড়াই ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে একই রকম থাকে। এই ক্রোমোজোমগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য শিশুর মধ্যে বহন করে। বাকি একজোড়া ক্রোমজোম ছেলে ও মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে থাকে ভিন্ন রকমের যা নির্ধারণ করে সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে । এই ২৩ তম জোড়াটিই লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম
মায়ের ডিম্বকোষ থেকে ভ্রুণে যে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম আসে তা সবসময়ই X টাইপ ক্রোমোজোম হয় ৷ বাবার শুক্রাণু থেকে যে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম আসে তা কখনো X, কখনো Y টাইপ হয়ে থাকে। যদি মায়ের X ক্রোমোজোমের সাথে বাবার X ক্রোমোজোমের মিলন ঘটে তাহলে মেয়ে শিশু জন্ম নেয়। আর যদি মায়ের X ক্রোমোজোমের সাথে বাবার Y ক্রোমোজোমের জোড় বাঁধে তবে ছেলে শিশু জন্ম নেয়। আমরা দেখি দুটি শিশু কখনোই এক রকম হয় না। আমাদের আপন ভাইবোনের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। কেন এমন হয়?
ক্রোমোজোমের এক এক জোড়া জিন মানুষের এক একটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। যার ফলে কেউ বেশি বুদ্ধিমান, কেউ বা কম, কেউ বেঁটে, কেউ বা লম্বা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মায়ের ক্রোমোজোম থেকে আসা কোন জিনটি বাবার ক্রোমোজোম থেকে আসা কোন জিনটির সাথে জোড়া বাঁধবে, তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। এ কারণে একই পিতামাতার সন্তানের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। তোমাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে অনেক সময় যমজ সন্তানের চেহারা ও আচরণ একই রকম হয় কীভাবে? একমাত্র সমকোষী যমজ শিশুর ক্ষেত্রে এ রকম হতে পারে ।
যমজ শিশু দুই ধরনের হয়। সমকোষী যমজ (Identical Twin) ও ভিন্নকোষী যমজ (Fraternal Twin)। যখন একটি জীবকোষ বা জাইগোট ভেঙ্গে দুটি ভ্রুণে পরিণত হয়; তখন তারা একই লিঙ্গের হয় এবং একই রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। এরাই সমকোষী যমজ
ভিন্নকোষী যমজদের ক্ষেত্রে একাধিক ডিম্বাণু একাধিক শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। অনেক সময়ে দেখা যায় মায়ের একাধিক ডিম্বাণু পরিপক্ক থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে একাধিক শুক্রাণু একাধিক ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে। এ ধরনের যমজ দুজনেই ছেলে বা দুজনেই মেয়ে বা একটি ছেলে, একটি মেয়ে হতে পারে। দুই এর বেশি জাইগোট তৈরি হলে সন্তান সংখ্যাও দুই-এর অধিক হয়। ভিন্নকোষী যমজদের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে না। এদের বৈশিষ্ট্য সাধারণ ভাইবোনদের মতো হয়ে থাকে। শুধু পার্থক্য এটুকুই থাকে যে সাধারণ ভাইবোনেরা এক বছর বা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে জন্ম নেয়। ভিন্নকোষী যমজ একই দিনে জন্ম গ্রহণ করে।
শিশুর বিকাশে পরিবেশ-
শিশুর বিকাশে জন্মপূর্ব পরিবেশ ও জন্ম পরবর্তী পরিবেশ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাতৃগর্ভে শিশু যে ৪০ সপ্তাহকাল অবস্থান করে সেটিই জন্মপূর্ব পরিবেশ। ভ্রুণ অবস্থায় মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপর শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক গঠন ও বিকাশ নির্ভর করে। যেমন—গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিহীনতায় ভ্রুণশিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয়। আবার মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে হলে সন্তান ধারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবনে ঝুঁকি থাকে ।
জন্ম পরবর্তী পরিবেশ শিশু জন্মের পর হতে শুরু হয়। জন্ম পরবর্তী পরিবেশ দুই ধরনের হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু, আলো-বাতাস, গাছ-পালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশ। সমতল ভূমির একটি ছেলের চেয়ে পাহাড়ি এলাকার একটি ছেলের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সমতলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চলে জীবন ধারণ করা অনেক কষ্টসাধ্য বলে ওই অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা হয় কর্মঠ ও পরিশ্রমী।
সামাজিক পরিবেশের মধ্যে আছে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার সাথি, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, দেশীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি। শিশুর জীবনে মা-বাবা, ভাই-ে -বোন, পরিবারের সদস্যদের স্নেহ-মমতা, সঠিক পরিচালনা পদ্ধতি তার সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করে। অপর দিকে মা-বাবার অনাদর, অবহেলা, অতিরিক্ত শাসন ইত্যাদি শিশুর বিকাশে অন্তরায় হয়। ছেলে-মেয়েরা জীবনের দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, নিয়ম-শৃঙ্খলা, শিক্ষার বিষয়বস্তু শিক্ষাপদ্ধতি ইত্যাদি তথা শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ শিশু বিকাশে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়াও সহপাঠী, খেলার সাথি, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবার সহায়তায় শিশুর বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
শিশুর বিকাশে বংশগতি এবং পরিবেশ কোনটির প্রভাব বেশি? এ বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। কারও মতে, শিশুর বিকাশ সম্পূর্ণরূপে বংশগতির উপর নির্ভরশীল। আবার কারও মতে— শিশুর বিকাশে পরিবেশের ভূমিকাই মূখ্য । বংশগতিকে যাঁরা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁদের মতে শিশু যে পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন একমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যাবলি তার বিকাশকে প্রভাবিত করে। যেমন- বুদ্ধিমান মা-বাবার সন্তানেরা বেশির ভাগ বুদ্ধিমান হয়। জন্মের পর ভিন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত দুই জন সমকোষী যমজের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ বছর ভিন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হলেও দুই যমজ বোনের রুচি, পছন্দ, আচরণ ও স্বভাবে কোনো পার্থক্য নেই (গবেষক—গেসেল ও থমসন)।
অপরদিকে পরিবেশবাদীরা মনে করেন- ব্যক্তির বিকাশে বংশগতি যাই হোক না কেন, তাকে যদি উপযুক্ত পরিবেশে রেখে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তবে ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্ভব। গ্ল্যাডিস এবং হেলেন নামে দুইজন সমকোষী যমজকে ভিন্ন পরিবেশে পাঠানো হয়; তখন তাদের বয়স মাত্র ১৮ মাস। হেলেন পড়াশোনা করার সুযোগ পেল। কিন্তু গ্ল্যাডিস পড়ার কোনো সুযোগই পায়নি। তাদের ৩৫ বছর বয়সে তুলনা করে দেখা গেছে যে, তাদের মুখের গঠন, চেহারা, আচরণ, মানসিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তায় হেলেন গ্ল্যাডিস চেয়ে অনেক উন্নত। সমকোষী যমজ বোন হিসেবে উভয়ের বৈশিষ্ট্য একইরূপ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় নি । এতে প্রমাণিত হয় পরিবেশের কারণে বিকাশ পার্থক্যপূর্ণ হয়।
পরিবেশ ও বংশগতি উভয়কেই যাঁরা সমর্থন করেন তাঁদের মতে- বিকাশ বংশগতি ও পরিবেশ এই দুই উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়। উন্নত জাতের বীজ থেকে উন্নত মানের ফলন পাওয়া যায় । কিন্তু বীজ থেকে গাছ হওয়ার জন্য চাই উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত পানি, আলো-বাতাস ইত্যাদি। পরিবেশের এই উপাদানগুলোর অভাবে কখনই উন্নতমানের বীজ হতে উন্নতমানের ফলন সম্ভব হয় না। আবার উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত পানি, আলো-বাতাস ইত্যাদি ভালো পরিবেশ বিদ্যমান থাকলেও উন্নত বীজের অভাবে উন্নত মানের ফলন আশা করা যায় না। অর্থাৎ শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে বংশগতি এবং পরিবেশ উভয়েরই গুরুত্ব অপরিসীম।
জন্ম থেকে ক্ষীণ বুদ্ধিসম্পন্ন একটি শিশুকে উন্নত পরিবেশে প্রতিপালন করলেও তার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। একই ভাবে অধিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে শিশু জন্ম গ্রহণ করে তাকে যদি তার বুদ্ধি বিকাশের সহায়ক পরিবেশ ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া না হয়, তবে তার বুদ্ধিমত্তার পূর্ণাঙ্গ পরিস্ফুটন হয় না। উপযুক্ত পরিবেশ শিশুর জন্মসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়। তাই বলা যায়- বংশগতি এবং পরিবেশ উভয়েরই পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে শিশুর বিকাশ নির্ধারিত হয়।
কাজ – শিশুর বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশ কোনটির গুরুত্ব বেশি? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে উদাহরণসহ যুক্তি উপস্থাপন কর।