বিপ্রদাশ বড়ুয়ার 'বিদ্যাসাগর' জীবনীটি কত সালে প্রকাশিত হয়? 

Created: 1 year ago | Updated: 1 year ago
Updated: 1 year ago

ন্ধ্যের আলো-আঁধারিতে, ২৪শে মে, ২০০১, মিয়ানমারের (বার্মার) সীমান্ত শহর মংডুর পথে নেমে আমার মুখ, চোখ, কান ও হৃদয় অচেনা আবেগে উপচে পড়ল।
মংডু আমাদের টেকনাফের ওপারে। মাঝখানে নাফ নদী। মংডু বার্মার পশ্চিম সীমান্তের শহর। ব্রিটিশ যুগের বহু আগে থেকেই চট্টগ্রামের সঙ্গে তার যোগাযোগ। কখনও ছিন্ন, কখনও নিরবচ্ছিন্ন। পাদরি মেস্ট্রো সেবাস্টিন মানরিক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পথে আসেন। তারও একশ বছর আগে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। তারা নিজেদের বসতির জায়গাকে ব্যাণ্ডেল বলত। চট্টগ্রামে এখন ব্যাণ্ডেল রোড তাদের স্মৃতি বহন করছে।
সন্ধ্যের আঁধার ঘনিয়ে আসার পর আমরা অভিবাসন ও শুল্ক দফতর থেকে ছাড়া পেয়ে খাঁচা ছাড়া পাখির মতো উড়াল দিলাম। এই পথে আসতে পেরে খুশি হয়েছি, পথে আরাকান পড়বে, আরাকান রাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন রাজধানী ম্রাউক-উ দেখতে পাব। এক সময় আরাকান বার্সা থেকে আলাদা স্বাধীন রাজ্য ছিল। তার পরিধি ছিল উত্তরে ফেনী নদী থেকে আন্দামান সাগরের কাছাকাছি পুরো বঙ্গোপসাগর উপকূল। সেখানে এসে পড়েছি এখন। আরাকান রাজ্যের রাজসভায় দৌলত কাজী, আলাওল সাহিত্যচর্চা করেছেন।
ছেলেবেলা থেকে চট্টগ্রামের পাশে অপরূপ মিয়ানমারের কথা শুনে এসেছি রূপকথার গল্পের মতো, আজ তা বাস্তবে ভেসে উঠল সন্ধ্যের আলোছায়ায়। অন্ধকার প্রায় গাঢ় হয়ে এসেছে। আকাশে মেঘের কোলে শুক্লপক্ষের চাঁদ। আমার হাতে ও কাঁধে ঝোলাঝুলি। শুল্ক অফিসের চৌহদ্দি পেরিয়ে পঞ্চাশ কদম না যেতেই বাঁ দিকে বড় বড় রেস্তোরাঁ, প্রায় জনমানবহীন। ডান দিকে মোড় ঘুরতেই দেখি এক মিয়ানমার কুমারী পানীয়ের পসরা নিয়ে বসেছে। একেবারেই ঝুপড়ি দোকান। কুমারীর দোকানের পাশেই আর একটি সে রকম দোকান। তারপর সামনেই শুরু হয়েছে বাড়িঘর ও দোকান। পথে নেমে পড়েছে তরুণ-তরুণী, মেয়ে-পুরুষ। পথে পথে মিয়ানমারের যুবতি-তরুণী। কলহাস্যে মুখর। বাড়ির সামনে, দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ যুবক, যুবতি, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ। মিয়ানমারের সবাই লুঙ্গি পরে। মেয়েদের পরনে লুঙ্গি ও ঝলমলে ব্লাউজ জাতীয় জামা বা গেঞ্জি । চুলে ফুল গোঁজা, চিরুনি ও রিবন-ফিতে।

পাশ দিয়ে একটা পাইক্যা চলে যাচ্ছে। তিন চাকার রিকশা, যেমন মোটর বাইকের পাশে আর একটা চাকা লাগিয়ে ক্যারিয়ারে বউ বাচ্চা বসতে পারে, এও প্রায় তেমনি। সারা মিয়ানমারে আমাদের রিকশার বদলে পাইক্যা। স্থানীয় মুসলমানরা এর একচেটিয়া চালক। মংডুর ব্যবসাও প্রায় ওদের দখলে, আর হিন্দুরাও আছে।

ইউনাইটেড হোটেলে পৌঁছলাম, কিন্তু জায়গা হলো না। আগে-ভাগে যারা গেছে তারা জায়গা দখল করে নিয়েছে। প্রায় অনাথের মতো বোঁচকা-কুঁচকি নিয়ে নতুন হোটেলের উদ্দেশে চললাম। আমরা খুঁজে পেতে যে হোটেল পেলাম তার অবস্থা শোচনীয় বললে কম বলা হয়। বেড়ার ঘরের দোতলার মাঝবারান্দায় বসেই টের পেলাম এটা চতুর্থ শ্রেণির হোটেল হতেও পারে। কাঠের মেঝে। কাঠের যেমন-তেমন দেয়াল। বিছানায় গিয়ে পরখ করে দেখি উঁচু-নিচু চষা জমির মতো তোশক। মশারিতে বিচিত্র ও বিপরীতধর্মী নানা রকম উৎকট দুর্গন্ধ। মাথার উপরে পাখা আছে। কিন্তু রাত নয়টার পর তো বিজলি থাকবে না। তখন গ্লাভস পরে হাত ধোয়ার অবস্থা হবে। নিলাম ফ্যান ছাড়া একটি কক্ষ। পরে মনে পড়ল ফ্যান থাকলেই বা কী! আমার তো রাতে ফ্যান সহ্য হয় না। বাতিও থাকবে না রাতে

মাঝবয়সী এক নারী আমাদের প্রায় টেনে নিয়ে গেল তার রয়েল রেস্তোরায়, রাতের খাওয়ার জন্য। ইউনাইটেড হোটেলে যারা উঠেছে তারা নাকি ওদিকে এক মুসলিম রেস্তোরাঁয়, খেয়ে নিচ্ছে। রয়েল রেস্তোরা, মন্দ নয়। সুন্দর ঝকঝকে টেবিল-টুল। বাসন-কোসন ভদ্র। ভাতের দোকান বলেই উঁচু টেবিল ও প্লাস্টিকের টুল। সম্ভবত চীন থেকে আমদানি ওই টুল। সাধারণ বর্মি রেস্তোরাঁয় নিচু টেবিল ও টুল থাকে ।

রেস্তোরাঁর রাখাইন মালকিনের বয়স প্রথমে বুঝতে পারিনি। বলে কী! ওর বড় ছেলে কলেজে পড়ে! কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে রাখাইন আছে। এখন বুঝতে পারলাম আমার দেশের রাখাইনদের কত কম জানি । তাদের খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। তাহলে কী করে দেশের সব মানুষের সঙ্গে আমার সখ্য নিবিড় হবে।

রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো একটি মেয়ে। লুঙ্গি এবং কোমর-ঢাকা ব্লাউজ পরেছে। ওর নাম ঝরনা । চেহারা ও স্বাস্থ্য গরিব ঘরের রোগা-পটকা নারীর মতো।

পোড়া লঙ্কা কচলে নুন-তেল দিয়ে ভর্তা করল। একটা প্লেটে তার সঙ্গে দিল কচি লেবুপাতা। বাহ্ । খাস চট্টগ্রামের খাবার। আসলে এদের থেকে চট্টগ্রামের বড়ুয়ারা এই খাবার নিয়েছে। চাকমা মারমারা ধানি লঙ্কা পুড়ে নুন ও পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করে। পোড়া বা সেদ্ধ ধানি লঙ্কা কুইজ্যায় বা মাটির হামানদিস্তায় পিষে নেয়। একটা রাত কেটে গেল অখ্যাত বা কুশ্রী হোটেলে।

২৫শে মে, দ্বিতীয় দিন। মহাথেরোর সঙ্গে মংডুর প্রধান সড়ক ধরে চলেছি। বাজার। দুইপাশে বাড়ি, বাড়ির নিচে দোকান। ভেতরের বাড়িগুলো সেগুন কাঠের থাম বা পাকা থামের ওপর। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ভেজা পথ। গাছপালার পাতা চকচক করছে ধাতব নতুন টাকার মতো। বৃষ্টি শিরীষ, আম, কাঁঠাল, কৃষ্ণচূড়া সবই আমাদের মতো। পদাউকের পাতা লকলক করছে। পদাউকের সোনারঙ ফুল ফোটার এটিই সময়।মিয়ানমারে ওদের নাম সেন্না। মংডুর কিছু গাছ ব্রিটিশ আমলের। ওদের বয়স শতাব্দী বা তারও বেশি । বৃষ্টি
শিরীষ, তেঁতুল এবং একটু কম বয়সী নারকেল গাছ। আছে কাঠগোলাপ ও সোনালু। নারকেল সর্বত্র। বাড়ির সামনের নারকেল গাছটির গোড়ার দিকে মাথা সমান উঁচুতে অর্কিড করেছে। তাতে রঙিন ও সাদা ফুল।

পাইক্যায় বোরকা পরা মহিলা। তার ওপর মাথায় ছাতা। ছবি তুলতে যেতেই ছাতা দিয়ে আড়াল তুলে দিল। হাঁটতে হাঁটতে শহরের পূর্ব দিকে শেউইজার সেতু পার হয়ে গেলাম। নদীর নাম সুধার ডিয়ার। এপারে মংডু, ওপারে সুধার পাড়া। মুসলিম গ্রাম। 

সেতুর কাছেই পাঁচ-সাতজন মাছ নিয়ে বসেছে। তরিতরকারি নিয়ে বসেছে কয়েকজন। গ্রামের ছোট্ট বাজার। পাঁচ-ছয়টা বেড়ার দোকান। বুড়ো আঙুলের সমান চিংড়ির কিলো ৪ থেকে ৫শ চ্যা। আমাদের তুলনায় পানির দাম। টাকার হিসাবে ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। নদীর উজান দিকে বিলে দেখা যাচ্ছে চিংড়ির ঘের। অঢেল মাছ পাওয়া যায় ওখানে। চায়ের দোকান থেকে লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মংডুতে এখনো প্যান্ট দেখিনি । শুধু আমাদের পরনে প্যান্ট। মহাথেরো চীবর পরেছেন। বর্মিরা সবাই লুঙ্গি পরেছে। অফিস কাছারিতেও লুঙ্গি। গতকাল শুল্ক অফিসের দুজনের প্যান্ট দেখেছি। ওরা পুলিশ। অন্যদের লুঙ্গি। লুঙ্গি, ফুঙ্গি ও প্যাগোডা এই তিন নিয়ে মিয়ানমার। ফুঙ্গি হলো বৌদ্ধ ভিক্ষু। গম (ভালো), ছাম্মান বা সাম্পান, ছা (শাবক), থামি (বর্মি রমণীদের সেলাইবিহীন লুঙ্গি) ইত্যাদি অনেক শব্দ বার্মা ও আরাকান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে বাংলা ভাষায় ঢুকেছে 

বাসের চালে যাত্রীদের সঙ্গে ফুঙ্গি। পথে ঘাটে ফুঙ্গি। সকালে তারা খালি পায়ে ভিক্ষে করতে বের হন। ভিক্ষে ছাড়া ভিক্ষু বা ফুঙ্গিদের চলবে না। ভিক্ষাই তাদের জীবিকা। ভিক্ষুদের পরিধেয় চীবর সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতো। গায়ে আলাদা অন্য এক টুকরো চীবর থাকে। হাত কাটা ও এক কাঁধ কাটা একটা গেঞ্জি থাকে, কোমরে বেল্ট জাতীয় অর্থাৎ সেলাই করা কাপড়ের কোমর বন্ধনী থাকে। এসব মিলে ত্রিচীবর। আর হাতে থাকে ছাবাইক বা ভিক্ষাপাত্র। আদিতে এটি কাঠ বা লোহার হতো। এখন লাক্ষা দিয়ে তৈরি হয়। ভিক্ষুদের চীবর বিশেষ মাপে এবং অনেক জোড়া দিয়ে সেলাই করা হয়। এটি নিয়ম। সাধারণ লাল ও লালের কাছাকাছি রঙে চীবরে রঙ করা হয়। বার্মায় ফুঙ্গিদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়।

ছেলে-বুড়ো যুবক-যুবতি সবার পরিধানে লুঙ্গি। স্কুলের পোশাকও লুঙ্গি ও জামা বা শার্ট। বর্মি মুসলমান- হিন্দু-বড়ুয়া-খ্রিষ্টান সবার লুঙ্গি। বর্মিরা শার্টটি লুঙ্গির নিচে গুঁজে দেয়। মংডুর মুসলিমরা শার্ট পরে লুঙ্গির বাইরে। বার্মা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে লুঙ্গি প্রবেশ করে। মাত্র একশ বছরের মধ্যে সারা বাংলা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত লুঙ্গি চলে গেছে। লুঙ্গি, শার্ট ও বর্মি কোট, মাথায় বর্মি টুপি, পায়ে দুই ফিতের মজবুত স্যাণ্ডেল বর্মিদের জাতীয় পোশাক।

লোকজন আমাদের দেখছে। আমাদের পোশাক ও চাল-চলন ওদের থেকে ভিন্ন। সব দেশের লোক বিদেশিদের চিনতে পারে। সেতু পেরিয়ে ফিরে আসছি। কিছুদূর এসে মূল রাস্তা থেকে ডান দিকে বর্মি পাড়ায় ঢুকে পড়লাম। রাস্তার মোড়ে খালি জায়গায় বড় শিরীষ গাছের নিচে মিয়ানমারের তরুণী নুডলস বিক্রি করছে। ভাসমান দোকান। সকালের টিফিন এ রকম এক দোকানে পুলকসহ খেয়েছি। নুডলস, পোড়া লঙ্কাগুড়ো, তেঁতুলের টক, কলার থোড় ইত্যাদি সবজি দিয়ে স্যুপ, ডিমসেদ্ধ মিশিয়ে খেয়েছি। ডিমের খোসা ফেলে কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে ক্ষিপ্র গতিতে। আমার মোটামুটি ভালোই লেগেছে। সকালের জন্য আদর্শ খাবার বলা যায়। সঙ্গে বিনি পয়সায় দুধ চিনি ছাড়া চা দিয়েছে। দোকানি মাঝবয়সী মহিলা। ইঙ্গিতে, ইংরেজিতে কোনোমতে এক রকম করে কথা হলো। বুঝতে পারছি সারা ভ্রমণ এভাবে অপূর্ণ কথাবার্তা বলতে হবে।

দোকানটির দিকে এগিয়ে গেলাম। মাথার উপর ছত্রাকার শিরীষ গাছের নিচে পলিথিন টাঙিয়ে দিয়েছে। লম্বা বেঞ্চিতে খাবারের বড় বড় ডেকচি। টুল আছে বসার। তরুণী বলল, বিকিকিনি শেষ। নুডলস আছে, কিন্তু মশলাপাতি ও তেঁতুলের ঝোল ফুরিয়ে গেছে। ওখান থেকে একটু এগিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। মালকিন বসে আছে চেয়ারে। রোয়াইংগা মুসলিম বয় আছে দুজন। কিন্তু বিস্কুট বা সে রকম কোনো খাবার নেই। দুধ চিনির চা ও বিনি পয়সার চা আছে। দোকানের ভেতরে আরেক মহিলা চুরুট সিগারেট ও পান বেচতে বসেছে। অন্য মহিলারা আছে রান্নাঘরে। চা বানিয়ে দিচ্ছে। মহিলারা চিরস্বাধীন। দোকানের মালিক তারা। সবই খুব সাধারণ মানের। চা খেয়ে বেরিয়ে এলাম ।

 

 

Content added By
Promotion