সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর, এ লাইনটি কোন কবির কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে?
প্রথম অধ্যায় ঈশ্বরের স্বরূপ
কত বিচিত্র আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ। ওপরে অনন্ত আকাশ, নিচে জীবকূল, নদ-নদী, পাহাড়- পর্বত। আমাদের পৃথিবী অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈচিত্র্যে ভরপুর, যেমন- তুচক্রের আবর্তন, দিন-রাত্রির পালাবদল, প্রহানুপুঞ্জের আপন কক্ষপথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আবর্তিত হওয়া প্রভৃতি। অনন্ত আকাশে চন্দ্র, সূর্যসহ অসংখ্য গ্রহ, উপগ্রহ ও নক্ষত্র রয়েছে। এ-সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও উপগ্রহ নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে না। সবকিছুই একটি গভীর ঐক্য ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে চলছে। এ সবকিছুর কারণ ঈশ্বর এবং তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। অন্যথায় এ মহাবিশ্বের সবকিছু যথানিয়মে আবর্তিত হতো না।
ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় তিনি নিরাকার, শাশ্বত বা নিত্য ও অবিনশ্বর।
এ-বিশ্বে যা-কিছু ঘটছে তার প্রত্যেকটির পেছনেই একটি কারণ আছে। এ-কারণেরও কারণ আছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করলে অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে সৃষ্টির প্রথম কারণকে বলা হয় ঈশ্বর
ॐ
ঈশ্বর যখন নিরাকার, তখন তিনি ব্রহ্ম। আবার তিনিই ভগবান এবং জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। জ্ঞানী, যোগী ও ভট্টগণ নিজ-নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা করছেন। চিরশান্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য তরু ঈশ্বরের কাছে স্তুতি করেন এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা জানান অধ্যায়ে উল্লিখিত বিষয়সমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। এ অধ্যায়শেষে আ
• ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এ ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে পারব -
• ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান- এ ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা করতে পারব
• ঈশ্বরের আত্মারূপে অবস্থান ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে পারব
• জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে পারব
• ধর্মগ্রন্থ থেকে ঈশ্বরের উদ্দেশে একটি প্রার্থনামূলক সংস্কৃত শ্লোক ও একটি বাংলা কবিতা অর্থসহ ব্যাখ্যা করতে পারব
• ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস স্থাপন করতে পারব।
কর্মা-১, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা- অষ্টম শ্রেণি
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
পাঠ ১ : ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়
ঈশ্বর এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। দেব-দেবীরা তাঁরই গুণ বা শক্তির প্রতিভূ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঈশ্বরের একত্ত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে -
একো দেবঃ সর্বভূতেষু গু সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরা। কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতানিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণ (৬/১১)
ॐ
সরলার্থঃ এক ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সকল জীবের মধ্যে প্রচ্ছন্নরূপে অবস্থান করছেন। তিনি সর্বব্যাপী, সকল জীবের আত্মা, সকল কাজের কর্তা এবং সকল জীবের আবাসস্থল। তিনি সকল কিছু দেখেন, সকল জীবকে চেতনা দান করেন। তিনি নিরাকার-নির্গুণ ব্রহ্মা ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত করছেন। গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রসমূহ এ মহাকাশে নির্দিষ্ট গতিপথে আবর্তিত হচ্ছে। জীব ও জড়বস্তু সবকিছুই একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। জীৰ জন্মলাভ করছে, আবার আয়ুশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহত্যাগ করছে। হিন্দুধর্মানুসারে জীবের দেহের ধ্বংস আছে, কিন্তু জীবাত্মার ধ্বংস নেই। পৃথিবীর সকল জীব ও জড়ের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। একজন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক না থাকলে এ মহাবিশ্বের সকল কিছু শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হতো না। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একাধিক ঈশ্বর থাকলে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো নিম্নমতান্ত্রিকভাবে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে পারত না। সকল জীব ও জড়ের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকত না ধ্যান-ধারণা ও মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যার। ঈশ্বর নিরাকার। তাঁকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁকে অনুভব করা যায়। যেমন বিদ্যুৎ চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার কাজের মাধ্যমে তাকে অনুভব করা যায়। ধর্ম ও সততা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস আনয়ন করে। এর মাধ্যমে নৈতিক চিন্তাশক্তি বিকশিত হয় উপনিষদে উল্লেখ আছে যে, 'সূর্য তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না; চন্দ্র, তারকা,ঈশ্বরের স্বরূপ
বিদ্যুৎ, অগ্নিও তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না; সর্বত্র তিনিই প্রকাশিত আছেন এবং সকল কিছুই তিনি প্রকাশ করেন।' উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, 'প্রাণী ও অপ্রাণী যে-কোনো বিষয় বা পদার্থ যে স্থান থেকে জন্মলাভ করে, মৃত্যু বা ধ্বংসের মাধ্যমে আবার যাঁর কাছে ফিরে যায়, তিনিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর।'
ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। তিনি সবকিছু জানেন। তাই তিনি পুণ্যাত্মাকে সুখী করেন, অপরাধীকে শাস্তি দেন এবং অদৃশ্যভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি সবকিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রক ।
একক কাজ : ঈশ্বরের একত্ব সম্পর্কে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের স্তোত্রটি আবৃত্তি কর ।
নতুন শব্দ : শাশ্বত, অবিনশ্বর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
পাঠ ২: ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও জীবাত্মা
ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম রয়েছে এবং আমরা তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকি। যেমন- ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ঈশ্বর ও ভগবান। ঋষিরা ঈশ্বরকে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, ভগবান ও আত্মা বা জীবাত্মারূপে উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা ঋষিদের বর্ণনানুসারে ব্রহ্ম, ঈশ্বর ও ভগবানের পরিচয় জানব । ব্ৰহ্ম
হিন্দুধর্ম অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্রহ্মেরই সৃষ্টি। ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সকল জীব ও জড়ের স্রষ্টা । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু ঘটছে, সবই তাঁর কারণে। নিরাকার ব্রহ্মকে বোঝাবার জন্য ঋষিরা 'ওঁ'-এ প্রতীকী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ বৃহৎ। বৃহত্ত্বাৎ ব্রহ্ম, বা বৃহৎ বলেই তাঁর নাম ব্রহ্ম। আবার ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- তিনি সত্য। অর্থাৎ সত্যই ব্রহ্ম। কোনো-কোনো ঋষি আবার বলেছেন, ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। আমাদের আনন্দ ব্রহ্মেরই আনন্দ। এই ব্রহ্মকেই আবার বলা হয়েছে পরমাত্মা ।
ঈশ্বর
'ঈশ্বর' শব্দের অর্থ প্রভু। তিনি সকল জীবের সকল কাজের প্রভুত্বকারী। ব্রহ্ম যখন জীবের ওপর প্রভুত্ব করেন এবং জীবকুলে সকল কাজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তাঁকে ঈশ্বর বলা হয়। নিরাকার ঈশ্বর তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুসারে নিজের আনন্দের জন্য নিজেকেই নানারূপে প্রকাশ করেন
ঈশ্বরই অবতার। তিনি যখন দুষ্টের দমন করেন এবং ন্যায়-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে নেমে আসেন, তখন তাঁকে অবতার বলে। যেমন- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, রাম প্রভৃতি। আবার ঈশ্বরের কোনো গুণ বা শক্তি যখন আকার ধারণ করে, তখন তাঁকে দেবতা বা দেব-দেবী বলে । যেমন- শক্তির দেবী দুর্গা, বিদ্যার দেবী সরস্বতী ইত্যাদি।
ঈশ্বর এক। বিভিন্ন অবতার বা দেব-দেবী এক ঈশ্বরেরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ সবই এক ঈশ্বরের লীলা।
8
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
ভগবান
ঈশ্বরকে আমরা সর্বশক্তিমান হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করি। সর্বশক্তিমান বা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বলে আমরা তাঁকে সমীহ করি তাঁকে ঘিরে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ভালোবাসার অপর নাম মায়া । এই মায়ার জালে সকল জীব আবদ্ধ। আমাদের কোনোকিছুর অভাব ঘটলে বা আমরা গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হলে ঈশ্বর আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হন। তবে আমরা তাঁকে দেখতে পাই না, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি। ভক্তের নিকট ঈশ্বর ভগবানরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। ভক্তের কাছে ভগবান আনন্দময়। 'ভগ' শব্দটির অর্থ ঐশ্বর্য বা গুণ। ঈশ্বরের ছয়টি গুণ - ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য । এই ছয়টি ভগ বা ঐশ্বর্য আছে বলে ঈশ্বরকে ভগবান বলা হয় ভগবান ভক্তের ডাকে সাড়া দেন ও লীলা করেন। সুতরাং, ঈশ্বর যখন ভক্তদের কৃপা করেন, তাদের দুঃখ দূর করে তাদের মঙ্গল করেন, তখন তাঁকে ভগবান বলা হয় ।
জীবাত্মা
আত্মা বা পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে অবস্থান করেন তখন তাঁকে বলা হয় জীবাত্মা। জীবাত্মারূপে তিনি মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ সবকিছুর মধ্যেই অবস্থান করেন। তাই ঈশ্বরভক্ত যাঁরা তাঁরা সব জীবকেই সমান দৃষ্টিতে দেখেন। কারো প্রতি হিংসা করেন না। কারণ জীবের প্রতি হিংসা করলে ঈশ্বরকেই হিংসা করা হয়।
পাঠ ৩ : জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর
জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত ঈশ্বরকে নিজ-নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। জ্ঞানী জ্ঞানের দৃষ্টিতে, যোগী যোগসাধনার মধ্য দিয়ে এবং ভক্ত ভক্তির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন
ঈশ্বরকে যিনি জ্ঞানের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তিনিই জ্ঞানী। ধর্মপালন ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য গীতায় বিভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর লাভের এ-সকল পথকে যোগসাধনা বলে। যাঁরা আত্মার উপাসনা করেন এবং যোগসাধনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তাঁদের যোগী বলা হয়। আবার যাঁরা ভক্তির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেন তাঁরা হলেন ভক্ত এখন জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের যে স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে, সংক্ষেপে তার আলোচনা করা হলো।
জ্ঞানীর দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যাঁরা সকল বিষয় -বাসনা পরিত্যাগ করে কেবল সর্বব্যাপী ও নিরাকার ব্রহ্মকে উপাসনা করেন এবং ব্রহ্মেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁদের জ্ঞানী বলা হয়। জ্ঞানীদের কাছে ঈশ্বরই ব্রহ্ম, যিনি এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা মানুষের জন্য, জীবের জন্য এবং ঈশ্বরের ভালোবাসা লাভের জন্য কাজ করেন। জ্ঞানযোগে তাঁরা এসব করেন। জ্ঞান অর্থ জানা, যোগ অর্থ যুক্ত হওয়া। তাই জ্ঞানী শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার সঙ্গে যুক্ত যিনি ।
ঈশ্বরের অপ
জ্ঞান দুই প্রকার বিদ্যা ও অবিদ্যা। বিদ্যা ও অবিদ্যা যথাক্রমে পরা ও অপরা নামেও পরিচিত। - বিদ্যার যাৱা ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ হয়। সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়। জাগতিক বিষয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয় এবং মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। অবিদ্যার দ্বারা জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় না। তাই ধর্মশাস্ত্রে জ্ঞানী বলতে আত্মা বা ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে জ্ঞানী ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। যোগীর দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যাঁরা একাগ্রতা সহকারে মনের অন্তঃস্থল থেকে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেন, সফল কামনা-বাসনা দূর করতে সমর্থ হন, তাঁদের যোগী বলা হয়। এঁদের মূখ্য উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ।
যোগীদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর পরমাত্মা। এই পরমাত্মাই জীবাত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই যোগীর কাছে জীবও ঈশ্বর। মহাযোগী ও মহাজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই বহুরূপে ঈশ্বররের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর অমর বাণী - জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। অর্থাৎ জীবের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যাঁরা সংসারের বিষয় ও বৈষয়িক কর্মের মধ্যে থেকে সর্বশক্তিমান ভগবানের উপাসনা করেন, তাঁদের শুক্ত বলা হয়। ভক্তেরা সর্বজীবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেন এবং সেভাবেই জীবসেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা করেন। ভক্তের নিকট ঈশ্বর ভগবান। তিনি রসময়, আনন্দময় ও গুণময়।
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
কখনও কখনও ভগবান ভক্তের সেবা করেন। ভক্তের বোঝা বহন করেন। ভক্তও ভগবানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। নিজের সকল কাজকে ভগবানের কাজ হিসেবে সম্পাদন করেন। ভগবানের প্রতি ভক্তের মনে নিবিড় ও গভীর ভালোবাসা বিরাজ করে। শুধু তাই নয়, তাঁর সৃষ্টিকেও যাতে গভীরভাবে ভালোবাসতে পারেন সেজন্য ভক্ত ভগবানের নিকট প্রার্থনা করেন। নতুন শব্দ: সমৰ্পণ, আত্মজ্ঞান, বিষয়জ্ঞান, মহাযোগী।
পাঠ ৪ : ঈশ্বরের আত্মারূপে অবস্থান
ঈশ্বর বা ব্রহ্মের আর একটি নাম পরমাত্মা। এ পরমাত্মা জীবের মধ্যে অবস্থান করেন বলেই জীবের চেতনাশক্তি আছে। এই চেতনাই জীবাত্মা। জীবাত্মার ধ্বংস নেই। কেবল দেহের ধ্বংস হয়। আর দেহের এ ধ্বংসকেই বলা হয় মৃত্যু ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবের মধ্যে আত্মারূপে নিরাকার ব্রহ্ম বা পরমাত্মার ক্রিয়াশীল থাকার বিষয়টি চমৎকারভাবে তাঁর একটি কবিতায় প্রকাশ করেছেন:
সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর। (গীতাঞ্জলি)
জীবের দেহের সীমার মধ্যে অসীম পরমাত্মা বা ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাঁর ক্রিয়াশীলতার কারণেই আমাদের জীবন এত সুন্দর, এত মধুর। ওপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ব্রহ্মই ঈশ্বর, ভগবান এবং জীবাত্মা। তিনি
এক এবং অদ্বিতীয়।
দলীয় কাজ: ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের একটি তালিকা তৈরি কর ।
পাঠ ৫: প্রার্থনামূলক মন্ত্র ও বাংলা কবিতা
ক. প্রার্থনামূলক মন্ত্র
দৃতে দৃংহ মা মিত্রস্য মা চক্ষুষা
সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষস্তাম্ ।
মিত্রস্যাহং চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে। (শুক্লযজুর্বেদ-৩৬। ১৮)
সরলার্থ : হে ঈশ্বর, আমাকে এমন দৃঢ় কর যাতে সকল প্রাণী আমাকে বন্ধুর চোখে দেখে। আমিও যেন তাদের বন্ধুর চোখে দেখি। আমরা সকলেই যেন পরস্পরকে বন্ধুর চোখে দেখি
ঈশ্বরের স্বরূপ
ব্যাখ্যা: শুক্লযজুর্বেদের এ-মন্ত্রে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে - ঈশ্বর যেন আমাদের জানে ও শক্তিতে এমন দৃঢ় করেন যাতে সকল প্রাণী আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে। আমরাও যেন সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করি। কাউকে যেন হিংসা না করি। এভাবে আমরা সকলেই যেন সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করি। এর ফলে জীবন হবে শান্তিময়। বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক - এ প্রার্থনা-মন্ত্রটির মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করা হয়েছে।
খ. প্রার্থনামূলক বাংলা কবিতা
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে- নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ॥ জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে । মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে। যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ । সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ ॥ চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে। নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ॥
(গীতবিতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ব্যাখ্যাঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ কবিতার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পবিত্র, উদার ও সুন্দর মন এবং সচেতনতা, সক্রিয়তা ও নির্ভীকতা প্রার্থনা করা হয়েছে। ঈশ্বর যেন আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ঈশ্বরের সৃষ্টিতে যেমন শৃঙ্খলা রয়েছে, আমাদের সকল কাজেও যেন তেমন শৃঙ্খলা থাকে। আমরা যেন নির্ভয় ও নিঃসংশয়ে সকল কাজ করতে পারি এবং সকলের তথা বিশ্বের সকল প্রাণীর মঙ্গল সাধন করতে পারি। সকল বাধাবিঘ্ন ছিন্ন করে আমরা সকল মঙ্গল ও সুন্দর কাজের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারি। সবশেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, যেন ঈশ্বরের প্রতি আমাদের প্রগাঢ় ভক্তি থাকে। ঈশ্বর যেন আমাদের মঙ্গল করেন এবং আনন্দে রাখেন। টীকা
যজুর্বেদ হিন্দুধর্মের একটি মৌলিক গ্রন্থ যজুর্বেদ। এতেও ঋগবেদের মতো দেবতাদের উদ্দেশে স্তুতি ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র রয়েছে । যজুর্বেদের দুইটি অংশ শুক্ল ও কৃষ্ণ। যজুর্বেদের প্রধান বর্ণনার বিষয় যজ্ঞ - ও যজ্ঞ-প্রণালী
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ: বারটি প্রধান উপনিষদের মধ্যে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ একটি। এ উপনিষদে আমরা কোথা থেকে জন্মেছি, কীভাবে জীবন ধারণ করছি এবং প্রলয়ের পরে কোথায় থাকব এ-সকল বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। এ উপনিষদে ব্রহ্মের স্বরূপও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
একক কাজ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রার্থনামূলক কবিতাটির ভাবার্থ লেখ ।
নতুন শব্দ: নিঃসংশয়, নিষ্পন্দিত, সঞ্চার, সক্রিয়তা, নির্ভীকতা।