শ্রীলভক্তিবেদান্ত স্বামী কতগুলো মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ?

Created: 1 year ago | Updated: 1 year ago
Updated: 1 year ago

সপ্তম অধ্যায়

আদর্শ জীবনচরিত

আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ জন্মেছিলেন, যাঁরা আজীবন অন্যের উপকার করে গেছেন। নিজের কথা ভাবেন নি। তাঁদের কোনো লোভ-মোহ ছিলনা। পরোপকারই ছিল তাদের একমাত্র ভাবনা। জগতের কল্যাণ করাই ছিল তাদের জীবনের উদ্দেশ্য। তাঁরাই হলেন মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী। তাঁদের জীবনীই হচ্ছে আদর্শ জীবনচরিত। তাঁদের জীবনী থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। আমাদের জীবন সুন্দরভাবে গড়তে পারি। আমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এমন বেশ কয়েকজন মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী সম্পর্কে জেনেছি। এ অধ্যায়ে আমরা শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীহরিচাদ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ঠাকুর নিগমানন্দ, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, মা আনন্দময়ী এবং শ্রীলভক্তিবেদান্তস্বামী প্রভুপাদের জীবনী সম্পর্কে জানব এবং নৈতিকতা গঠনে তাঁদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।

এ অধ্যায়শেষে আমরা-

নৈতিকতা গঠনে শ্রীকৃষ্ণের কৈশোর-পরবর্তীকালের জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব

• নৈতিকতা গঠনে শ্রীহরিচাদ ঠাকুরের জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব

• নৈতিকতা গঠনে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনচরিতের আলোকে তাঁর শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব

• নৈতিকতা গঠনে ঠাকুর নিগমানন্দের জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব

• নৈতিকতা গঠনে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব

• নৈতিকতা গঠনে মা আনন্দময়ীর জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পাৱৰ

নৈতিকতা গঠনে শ্রীলভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের জীবন ও শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।

 

আদর্শ জীবনচরিত

90

পাঠ ১, ২ ও ৩ : শ্রীকৃষ্ণ

আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও শৈশবকালের কথা জেনেছি। সপ্তম শ্রেণিতে জেনেছি তাঁর বাল্য ও কৈশোরের কথা। এখন আমরা জানব তাঁর কৈশোর-পরবর্তী থেকে শুরু করে শেষ জীবন পর্যন্ত কর্মকাণ্ডের কথা। আমরা আগেই জেনেছি যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান । পৃথিবীতে যখন ধর্মের গ্লানি দেখা দেয়, অধর্মের বৃদ্ধি ঘটে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য এবং দুষ্টের দমন ও নিষ্টের পালনের জন্য তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে এবং বাল্য ও কৈশোরে কীভাবে তিনি দুষ্টদের দমন করেছেন এবং শিউদের পালন করেছেন তা আমরা জেনেছি। এখন আমরা তাঁর কৈশোর থেকে পরবর্তী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এবং তার শিক্ষা সম্পর্কে অবগত হব।

কংস ছিলেন মধুরার রাজা। তিনি ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী। নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে তিনি রাজ্য দখল করেন । কৃষ্ণ তাকে হত্যা করবে এই দৈববাণী শুনে শিশুকাল থেকেই তিনি কৃষ্ণকে মারার বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেন নি। তাই বলে তিনি বসে নেই। এবার কৌশলে তাঁকে মারার পরিকল্পনা করলেন। মল্লযুদ্ধে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তিনি অনুররে পাঠালেন কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ-বলরাম তখন বৃন্দাবনে। অসুর গিয়ে কংসের দুরভিসন্ধির কথা বলে দিলেন। কৃষ্ণ ও বলরাম মথুরায় এলেন। তাঁদের হাতে অনেক যোদ্ধা মারা গেল। তা দেখে কংস ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তিনি কৃষ্ণকে মারার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে আসামাত্রই কৃষ্ণ লাফ দিয়ে তাঁর রখে উঠলেন। চুল ধরে মাটিতে ফেলে কংসকে হত্যা করেন। তারপর উগ্রসেন, দেবকী বসুদেবসহ সকল নন্দীকে যুক্ত করেন। উগ্রসেনকে মথুরার রাজা করেন। মা-বাবার সঙ্গে কৃষ্ণ, বলরামও মথুরায় থেকে যান। মথুরায় শান্তি ফিরে আসে। জরাসন্ধ বধ

জরাসন্ধ ছিলেন মগধের রাজা এবং ফংশের শ্বশুর। তিনিও ভীষণ অত্যাচারী ছিলেন। কালের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ভীষণ রেগে খান। বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু কৃষ্ণের হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে। কৃষ্ণ তাঁকে ক্ষমা করে দেন। এতে জরাসন্ধ লজ্জিত হন বটে, কিন্তু তাঁর প্রতিশোষস্পৃহা বেড়ে যায়। তাই কৃষ্ণকে মারার জন্য তিনি পরপর সাতবার মন্থরা আক্রমণ। কৃষ্ণ তারপরও তাঁকে মারেন নি। কিন্তু জরাসন্ধ এক বিরাট অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছিলেন। প্রদেবের পূজার জন্য তিনি একশ নরবলি দেবেন বলে স্থির করেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ৮৬ জন রাজাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। আর ১৪ জন হলেই তিনি তাঁর অভীষ্ট কাজ সম্পন্ন করবেন। এ খবর কৃষ্ণ জানতে পেরে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সাহায্যে তাঁকে বধ করেন। ফলে একশ জন রাজার প্রাণ বেঁচে যায় ফর্মা ১০, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা- অষ্টম শ্রেণি

আদর্শ জীবনচরিত

দুর্যোধনের কাছে যান। অনেক আলোচনা করেন। কিন্তু দুর্যোধন কোনো কথাই শুনলেন না। অগত্যা কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষে ছিলেন যুদ্ধে লক্ষ-লক্ষ লোক নিহত হয় । কৌরবদের সবাই নিহত হন। যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির রাজা হন এবং রাজ্যে শান্তি ফিরে আসে। অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুই পক্ষ মুখোমুখি। কৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথি। তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি। অর্জুন বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে কৃষ্ণকে বললেন যুদ্ধ করবেন না। আত্মীয়দের হত্যা করে তিনি রাজ্য চান না। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বললেন, 'তুমি ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা। তা না হলে তার অধর্ম হয়। অপযশ হয়। তাছাড়া আত্মার মৃত্যু নেই। দেহান্তর ঘটে মাত্র। তুমি যাদের দেখে মায়া করছ, তারা নিজেদের দোষে মৃত্যুকে বরণ করে আছে। তুমি উপলক্ষ মাত্র। কাজেই যুদ্ধ করে তুমি তোমার কর্তব্য পালন কর। যার যা কর্তব্য তা পালন করাই ধর্ম।

কৃষ্ণ একথা বলার পর অর্জুনের মোহভঙ্গ হয় এবং তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে অন্যায়ের পরাজয় ঘটে, ন্যায়ের জয় হয় । এভাবে শ্রীকৃষ্ণ বারবার দুষ্টকে দমন করে শিষ্টের পালন করেছেন এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন।

দলীয় কাজ: দুষ্টের দমনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবদান লিখে একটি তালিকা তৈরি কর

শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুবাৎসল্য

শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। সুদামা নামে তাঁর এক সহপাঠী ছিলেন। একই গুরুর নিকট তাঁরা পড়াশোনা করেছেন। সুদামা খুবই গরিব। তবে ব্রহ্মবিদ। তাঁর কোনো লোভ-লালসা নেই। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ এখন দ্বারকার রাজা। তদুপরি স্বয়ং ভগবান হিসেবে তাঁর খ্যাতি সর্বত্র

একদিন সুদামার স্ত্রী তাঁকে বললেন, 'তোমার বন্ধু কৃষ্ণ দ্বারকার রাজা। তাঁর কাছে গেলে হয়তো কিছু অর্থ পাওয়া যেত। তাতে আমাদের অভাব অনেকটা ঘুচত।' সুদামা অর্থের লোভে নয়, অনেক দিন পরে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবে যেতে রাজি হলেন। তিনি একদিন সত্যি-সত্যিই দ্বারকায় রওনা হলেন । যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণকে উপহার দেয়ার জন্য কিছু চিড়ার খুদ সুদামার উত্তরীয় বস্ত্রে বেঁধে দিলেন।

সুদামা দ্বারকায় পৌঁছলেন। তাঁকে দেখামাত্র কৃষ্ণ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণী তাঁকে বিশেষভাবে আদর-আপ্যায়ন করলেন। কিছুক্ষণ পর শ্রীকৃষ্ণ বললেন, 'বন্ধু, আমার জন্য কী এনেছ?' সুদামা তখন সেই চিড়ার খুদ বের করে দিলেন। কৃষ্ণ পরম তৃপ্তিভরে তা খেলেন। তারপর তাঁরা অনেকক্ষণ গল্প করলেন। কিন্তু সুদামা একবারও অর্থের কথা বললেন না। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বন্ধুর বেশভূষা দেখে সবই বুঝতে পারলেন। তাই তিনি ঐশীবলে সুদামার বাড়ির অবস্থা পরিবর্তন করে দিলেন। সুদামা ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর কুড়ে ঘরের জায়গায় বিশাল অট্টালিকা ঘরে ধন-সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু তিনি আগের মতই সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং ব্রহ্মের উপাসনা করতেন।

একক কাজ: তোমার জানা বন্ধুপ্রীতির কোনো ঘটনা সম্পর্কে লেখ।

96

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান

ভগবান যে উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ অবতাররূপে জন্ম নিয়েছিলেন, তা সম্পন্ন হয়েছে। দুষ্টদের দমন করা হয়েছে। সমাজে ধর্ম ও শান্তি পুনঃস্থাপিত হয়েছে। তাই এবার তাঁর বৈকুণ্ঠে যাবার পালা। বলরাম ইতোমধ্যে ধ্যানযোগে দেহত্যাগ করেছেন। কৃষ্ণ তাই বনে প্রবেশ করে একটি অশ্বখ বৃক্ষের নিচে বসে আছেন। দূর থেকে জরা নামে এক ব্যাধ তাঁকে হরিণ মনে করে শর নিক্ষেপ করে। শরটি কৃষ্ণের পায়ে লাগে। এই শরাষাতেই কৃষ্ণ ইহলীলা সংবরণ করেন ।

শ্রীকৃষ্ণের জীবনী থেকে আমরা এই নৈতিক শিক্ষা পাই যে, অন্যায় ও অসত্য এক সময় পরাজিত হয়ই। সমাজে দুষ্টদের ঠাঁই নেই । ভগবানও তাদের ক্ষমা করেন না। ভগবান ধনী-গরিব সকলকেই ভালোবাসেন । যার যা কর্তব্য তা পালন করা ধর্মের অঙ্গ। অতএব, আমরা এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে কাজে লাগাব। নতুন শব্দ: গ্লানি, অনুর, স্পৃহা, অভীষ্ট, রাজসূয়, ইন্দ্রপ্রস্থ, ঐশীবল, অন্তর্ধান

পাঠ ৪ ও ৫ শ্রীহরিচাদ ঠাকুর

গোপালগঞ্জ জেলার কাশীয়ানি উপজেলার অন্তর্গত সাফলিডাঙ্গা একটি গ্রাম। এই গ্রামেই অ করেন হরিচাদ ঠাকুর। তাঁর জন্ম বাংলা ১২১৮ সনের ২৯ শে (১১ মার্চ ১৮১২ খ্রি:) ফাল্গুন। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিনি।

হরিচাদ ঠাকুরের পিতার নাম যশোমন্ত বৈরাগী এবং মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। যশোমন্ত ছিলেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। হরিচাঁদ ছিলেন যশোমন্তের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর অপর চার পুত্রের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণদাস, বৈষ্ণব দাস, গৌরী দাস ও স্বরূপ দাস। এঁরা সকলেই ছিলেন বৈষ্ণব। হরিচাদ ছিলেন খুবই মেধাবী। কিন্তু বিদ্যালয়ের ধরাবাধা পাঠ তাঁর ভালো লাগেনি তাই মাত্র কয়েক মাস গিয়ে তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। মিশে যান রাখাল বন্ধুদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে গোচারণ করেন। খেলাধুলা করেন। কখনো বা গান করেন। তাঁর গানের গলা ছিল খুবই মধুর। তাই তাঁর গান, ভজন, কীৰ্ত্তন শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। তাঁর চেহারাও ছিল খুবই সুন্দর। ব্যবহার ছিল অমায়িক। এসব কারণে সবাই তাঁকে পছন্দ করত। রাখাল বন্ধুরা তাঁকে বলত 'রাখাল রাজা"

আদর্শ জীবনচরিত

११

হরিচাদ ঠাকুর ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এ বিষয়টি তাঁর মধ্যে আরো প্রকট হয়। তিনি ক্রমশ ধর্মের দিকে চলে যান। তবে তিনি নতুন কোনো ধর্মমত প্রচার করেন নি । তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের হরিনাম প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভক্তির সঙ্গে হরির নাম নিলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। এই নাম সংকীর্তনই হচ্ছে তাঁর সাধন-ভজনের পথ। তিনি এই হরিনামে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন। এজন্য তাঁর এই সাধনপথের নাম হয় ‘মতুয়া'। আর তাঁর অনুসারীদের বলা হয় 'মতুয়া সম্প্রদায়।

মতুয়াবাদের মূল কথা হলো মনুষ্যত্ব অর্জন, আত্মোন্নতি এবং সার্বিক কল্যাণ সাধন। সভ্য, প্রেম ও পবিত্রতা – এই তিনটি স্তম্ভের ওপর মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত। সাধনার লক্ষ্য সত্যদর্শন বা ঈশ্বরলাভ। এজন্য চাই প্রেম। প্রেমের পূর্বশর্ত হচ্ছে পবিত্রতা। পবিত্র দেহ-মনে প্রেমের উদয় হয়। তখন ভক্তের অন্তরে প্রেমময় হরি জাগ্রত হন।

হরিচাদ ঠাকুর হরিনামের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অবহেলিত সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করেন। তাঁর পুত্র শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর বলতেন, 'দল নাই যার, বল নাই তার। এর ফলে মতুয়াবাদ এক বিরাট আন্দোলনে পরিণত হয় এবং মতুয়া সম্প্রদায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র।

ঠাকুর বলতেন, 'ধর্মচর্চার জন্য সংসার ত্যাগ করতে হয় না। সংসারে থেকে সংসারের কাজ করেও ধর্মচর্চা করা যায়।' তাঁর নির্দেশই ছিল, 'হাতে কাম, মুখে নাম। তিনি নিজেও সংসারী ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র ও তিন কন্যা ছিলেন। পুত্ররা হলেন গুরুচরণ ও উমাচরণ। ঠাকুরের অন্তর্ধানের পর গুরুচরণই গুরুচাঁদ নামে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধানরূপে পূজিত হন। মতুয়া সম্প্রদায় হরিচাদ ঠাকুরকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে জ্ঞান করেন। তাই তাঁরা বলেন:

রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ। সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাদ ॥

ঠাকুরের মতুয়াবাদে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ এসবে কোনো ভেদ নেই যে-কেউ হরিনাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

মতুয়া সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। সাফলিডাঙ্গা গ্রামের পাশে। সেখানে প্রধান হরিমন্দির অবস্থিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হরিমন্দির আছে। ২০১০ সনে ঢাকার রমনা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে একটি হরিমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে ওড়াকান্দিতে মহাবারুণি স্নান অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিন পর্যন্ত মেলা বসে। হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে ঐ স্নান ও মেলায়। তাঁরা হরিচাদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন ।

 

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

বাংলা ১২৮৪ সনের (১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) ২৩ ফাল্গুন ৬৬ বছর বয়সে হরিচাঁদ ঠাকুর ইহলীলা সংবরণ করেন। ঠাকুরের জীবন ও আদর্শ নিয়ে কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেছেন 'শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত' গ্রন্থ। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হরিমন্দিরে মতুয়াসহ ভক্তরা নিয়মিত নামকীর্তন করেন এবং হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

ঠাকুরের কয়েকটি বাণী

১. হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার।

প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।

২. জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা

ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া স্রষ্টা।

৩. গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়

সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।

B. গৃহকর্ম গৃহধর্ম করিবে সকল ।

হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।

৫. গার্হস্থ্য তোমার ধর্ম অতি সনাতন । দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনঃ

হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুসারীদের বারটি উপদেশ দিয়েছেন, যেগুলো দ্বাদশ আজ্ঞা' নামে পরিচিত। এই আজ্ঞাগুলো সবার জন্যই পালনীয়। আজ্ঞাগুলো হলো: (১) সদা সত্য কথা বলবে। (২) পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে। (৩) নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে। (৪) জগৎকে প্রেম করবে। (৫) সকল ধর্মে উদার থাকবে। (৬) জাতিভেদ করবে না। (৭) হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। (৮) প্রত্যহ প্রার্থনা করবে । (৯) ঈশ্বরে আত্মদান করবে। (১০) বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না। (১১) ষড়রিপু বশে রাখবে। (১২) হাতে কাম, মুখে নাম করবে।

দলীয় কাজ: হরিচাদ ঠাকুরের উপদেশগুলো লিখে একটি পোস্টার তৈরি কর ।

নতুন শব্দ: আত্মোন্নতি, মতুয়া, মহাবারুণি, বহিরঙ্গে, ষড়রিপু।

 

আদর্শ জীবনচরিত

পাঠ ৬, ৭ ও ৮ : স্বামী বিবেকানন্দ

'মন চল নিজ নিকেতনে

সংসার বিদেশে বিদেশির বেশে

ভ্রম কেন অকারণে

সুললিত কণ্ঠে অসীম দরদ দিয়ে গানটি গাইলেন এক যুবক। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তন্ময় হয়ে গানটি শুনলেন কোলকাতার সিমুলিয়ায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে বসে। তিনি জানতে চাইলেন কে এই যুবক? সুরেন্দ্রনাথ বললেন বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্রনাথ। এই নরেন্দ্রনাথই পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে জগদ্বিখ্যাত হন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি কোলকাতায় তাঁর জন্ম। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কোলকাতা হাইকোর্টের একজন নামকরা উকিল। মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণা সুগৃহিণী।

প্রথম দেখায়ই ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভালো লাগে নরেন্দ্রনাথকে। তিনি আকুল কণ্ঠে নরেন্দ্রনাথকে বলেন, 'একদিন এসো দক্ষিণেশ্বরে ।

নরেন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একটু অন্য রকম। নির্ভীকতা, সত্যবাদিতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, জীবে দয়া এসব ছিল তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। হিন্দুদের জাত-পাত ভেদ তাঁর ভালো লাগত না। তাঁর পিতার মক্কেলদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, মুসলমান, খ্রিষ্টান সবই ছিল। বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁদের সবার জন্য আলাদা আলাদা হুঁকা ছিল তামুক সেবনের জন্য। প্রত্যেক হুঁকার গায়ে নাম লেখা ছিল। নরেন্দ্রনাথ একদিন সব হুঁকায় মুখ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় পিতা বিশ্বনাথ এসে পড়েন। তিনি ছেলেকে বলেন, 'এ কী হচ্ছে, নরেন?' নরেন্দ্রনাথ বললেন, 'আমি সব হুঁকা টেনে দেখলাম, কৈ আমার তো জাত গেল না!' ছেলের এই অদ্ভুত কথা শুনে পিতা হেসে ফেললেন । প্রভাত যেমন সমস্ত দিনের ইঙ্গিত দেয়, এই ঘটনাও তেমনি সেদিন ভবিষ্যতের সর্বজীবে সমদর্শী বিবেকানন্দের ইঙ্গিত দিয়েছিল।

নরেন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ১৮৮৪ সনে তিনি বিএ পাস করেন। এর পরপরই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ফলে তাঁদের পরিবার দারুণ অর্থসঙ্কটে পড়ে। মা এবং ছোট ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির সন্ধান করেন। কিন্তু সুবিধা হয় না। অবশেষে কোলকাতার এ্যাটর্নি অফিসে একটা কাজ নেন এবং বই অনুবাদ করে কিছু-কিছু রোজগার করতে থাকেন ।

এ-সময়ে নরেন্দ্রনাথের মনে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে চিন্তা করেন। ঈশ্বর কি আছেন? তাঁকে কি দেখা যায়? এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই তাঁর মনে জাগে। তিনি অনেককে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসও করেছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকেও প্রশ্নটি করেছিলেন। কিন্তু কারো উত্তরে তিনি হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষ

সন্তুষ্ট হতে পরেননি এমন সময় একদিন তিনি লক্ষণেশ্বর কালীবাড়িতে যান। সুযোগমতো তিনি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন?' রামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলেন, হ্যাঁ, দেখেছি, যেমন তোকে দেখছি। চাইলে ডোকেও দেখাতে পারি । এই সহজ-সরল উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণকে নরেন্দ্রনাথের ভালো লাগে। তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন। এক সময় শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নেন। নরেন্দ্রনাথ হন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। তখন তাঁর নাম হয় বিবেকানন্দ। পরবর্তীকালে তরুরা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ বা শুধু স্বামীজী বলেই ডাকতেন ।

বিবেকানন্স গৃহত্যাগ করে ভারতভ্রমণে বের হন। তিনি দেখেন, সারা দেশে কেবল দারিদ্র্য আর দারিদ্র্য। কেবল অশিক্ষা আর কুশিক্ষা। দেশবাসীর এই দুরবস্থা দেখে তিনি খুব ব্যথিত হন। তাই কীভাবে এসব থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করা যায়, সে-কথা চিন্তা করতে লাগলেন কন্যাকুমারীকায় ভারতের শেষ শিলাখতে বসে তিনি ধ্যান হলেন। ধ্যানের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারলেন, ভারতের জীবনীশক্তির উৎস হচ্ছে ধর্ম। এই ধর্ম হচ্ছে দেবতা জ্ঞানে মানুষের সেবা। এই ধর্মমন্ত্রে ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবেই ভারতের উন্নতি হবে।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আমেরিকা যান। সেখানে ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে। তিনি বক্তৃতা দেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, হিন্দুধর্ম পৃথিবীর সকল ধর্মকে সমান সত্য মনে করে। সব ধর্মের লক্ষ্যই এক। নদীসমূহ যেমন এক সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সকল ধর্মেরই লক্ষ্য এক ঈশ্বরলাভ। তাই বিবাদ নয়, সহায়তা: বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ - নয়, সমন্বয় ও শান্তি। ধর্মসভার বিচারে তিনি হন শ্রেষ্ঠ বক্তা। তাঁর পাখিতো মুগ্ধ হয়ে আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইট বলেছিলেন, ইনি এমন একজন মানুষ, যাঁর পাণ্ডিত্য আমাদের সমস্ত অধ্যাপকদের মিলিত পাণ্ডিত্যকেও হার মানায়

ধর্মসভার বক্তৃতার পর সারা আমেরিকায় বিবেকানন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসে বক্তৃতার জন্য। তিনিও হিন্দু ধর্ম-দর্শন, বিশেষত বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেন। তারপর যান ইউরোপ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশ ঘুরে বেড়ান

Content added || updated By
Promotion