মৃতের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে যা অঙ্কুরিত হয়-
চতুর্থ অধ্যায়
হিন্দুধর্মে সংস্কার
আমাদের এই পার্থিব জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণময় করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাচীন ঋষিরা ধর্মীয় আচার-আচরণ ও মাঙ্গলিক কর্মের নির্দেশ দিয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা রচনা করেছেন ‘মনুসংহিতা”, ‘যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা', 'পরাশরসংহিতা' প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্র । এগুলো হিন্দু ধর্মের বিধিবিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থে বর্ণিত বিধি-বিধানকে আশ্রয় করে হিন্দুদের সমগ্র জীবনে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন মাঙ্গলিক ক্রিয়া। মৃতজনের উদ্দেশে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, পারলৌকিক কৃত্য প্রভৃতি সম্পাদন করার বিধি-বিধানও হিন্দুধর্মের গ্রন্থাবলিতে বর্ণিত রয়েছে ।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
পাঠ ১ : ধর্মীয় সংস্কারের ধারণা ও ধরন
ঐতিহ্য অনুসরণ করে হিন্দুদের সমগ্রজীবনে যে-সকল মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করা হয় সেগুলোকে বলা হয় সংস্কার। স্মৃতিশাস্ত্রে দশবিধ সংস্কারের উল্লেখ আছে। যেমন- ১. গর্ভাধান ২. পুং বম ৩. সীমন্তোন্নয় B. জাতকর্ম ৫. নামকরণ ৬. অন্নপ্রাশন ৭. চূড়াকরণ ৮. সমাবর্তন ৯. উপনয়ন ১০. এখানে প্রচলিত কয়েকটি সংস্কারের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো : • বিৰাহ ।
: জন্মের পর পিতা বব, বষ্টিমধু ও ঘৃতদ্বারা সন্তানের জিহ্বা স্পর্শ করে মন্ত্রোচ্চারণ করেন একে বলে জাতকর্ম।
নামকরণ : সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দশম, একাদশ, দ্বাদশ ৰা শততম দিবসে নামকরণ করণীয় ।
অন্নপ্রাশন পুরে ষষ্ঠ মাসে এবং কন্যার $ পঞ্চম, অষ্টম বা দশম মাসে পূজাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথম অন্নভোজনের নাম অন্নপ্রাশন ।
সমাবর্তন : পাঠ শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা গুরুগৃহ থেকে নিজগৃহে ফিরে আসার সময় যে অনুষ্ঠান হয় তার নাম সমাবর্তন। এই অনুষ্ঠানে শিক্ষকমহাশয় বা শুরু শিক্ষার্থীকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিতেন।
বিৰাজ : যৌবনে বেল ও পিতৃপুজা, হোম প্রভৃতির মাধ্যমে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক বর ও বন্ধুর মিলনরূপ সংস্কারকে বলা হয় বিবাহ। দশবিধ সংস্কারের মধ্যে বর্তমানে গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন প্রভৃতি সংস্কার লুপ্তপ্রায়।
পাঠ ২ : বিবাহ
হিন্দুসমাজে বিবাহ হলো ধর্মীয় জীবনের চর্চা। স্ত্রী হচ্ছেন পুরুষের সহধর্মিণী। স্ত্রীকে বাদ দিয়ে পুরুষের কোনো ধর্মকার্যই সম্পন্ন হয় না। "বিবাহ" শব্দটি বি-পূর্বক বহু ধাতু ও স্ব প্রত্যয়যোগে গঠিত। বহু ধাতুর অর্থ বহন করা" এবং বি উপসর্গের অর্থ বিশেষরূপে। সুতরাং 'বিবাহ' শব্দের অর্থ বিশেষরূপে ভারবহন করা । বিবাহের ফলে পুরুষকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মানসম্ভ্রম রক্ষার সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে হয় ।
বিবাহের প্রকারভেদ
স্মৃতিশাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ মনুসংহিতায় আট প্রকার বিবাহের উল্লেখ আছে । ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস এবং পৈশাচ । এই আট প্রকার বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ ও প্রাজাপাত্য উল্লেখযোগ্য । বর্তমান সমাজে ব্রাহ্মবিবাহ প্রচলিত। কন্যাকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে এবং অলংকার দ্বারা সজ্জিত করে বিদ্বান ও সদাচারী বরকে আমন্ত্রণ করে কন্যা দান করাকে বলা হয় ব্রাহ্মবিবাহ।
সমাজে গান্ধর্ব বিবাহেরও প্রচলন আছে । নারী-পুরুষ পরস্পর শপথ করে মাল্যবিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে তার নাম গান্ধর্ব বিবাহ । মহাভারতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিবাহ গান্ধর্ব বিবাহের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
বিবাহের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র
'যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।'
(ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ)
“তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় হোক তোমার ।” এই মন্ত্রের মাধ্যমে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর একাত্মতার সম্পর্ক । জীবন হয় একসূত্রে গাঁথা । আমৃত্যু তারা সুখে-দুঃখে একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করে এবং জীবনের নতুন অধ্যায়ে শুরু হয় পথ চলা ।
বিবাহের গুরুত্ব
হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে সমগ্র জীবনে যে-দশটি সংস্কার বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান রয়েছে তন্মধ্যে বিবাহ শ্রেষ্ঠ । বিবাহের দ্বারা স্বামী সস্তানের জনক হয়ে লাভ করেন পিতৃত্ব এবং স্ত্রী জননীরূপে লাভ করেন মাতৃত্ব। বিবাহের মাধ্যমে মাতা, পিতা, পুত্র, কন্যা, সকলকে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার, যাকে কেন্দ্র করে প্রেমপ্রীতি, স্নেহ, বাৎসল্য প্রভৃতি মানব মনের সুকুমার বৃত্তিগুলো পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। এভাবে গড়ে ওঠে আলোকিত মানুষ তৈরির সূতিকাগার ৷
পাঠ ৩ ও ৪ : বিবাহ অনুষ্ঠানের পর্বসমূহ
হিন্দু বিবাহের কিছু বিধিবিধান শাস্ত্রীয়, কিছু অনুষ্ঠান স্ত্রী-আচার। হিন্দুবিবাহ কোনো চুক্তি নয়, জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারমূলক অধ্যায়। শুভলগ্নে নারায়ণ, অগ্নি, গুরু, পুরোহিত, আত্মীয় এবং আমন্ত্রিত অতিথিগণকে
সাক্ষী রেখে মঙ্গলমন্ত্রের উচ্চারণ, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয় যজ্ঞ এবং কতগুলো লোকাচারের মাধ্যমে । বিবাহ অনুষ্ঠানের অনেক পর্ব আছে। যেমন- আশীর্বাদ, অধিবাস, বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ, গায়ে হলুদ (গাত্র হরিদ্রা),
বর-বরণ, শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সম্প্রদান, যজ্ঞানুষ্ঠান ও সাতপাকে বাঁধা, সিঁথিতে বিবাহ চিহ্ন,
সপ্তপদীগমন, বাসি বিয়ে, অষ্টমঙ্গলা প্রভৃতি । এর মধ্যে কিছু পর্ব শাস্ত্রীয়, আর কিছু অঞ্চলভেদে লোকাচার ।
বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ
বিবাহের দিন কিংবা তার আগের দিন উভয় পক্ষই নিজ নিজ ঘরে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁদের আশীর্বাদ কামনা করে । উভয় কুলের পিতৃপুরুষদের প্রতি এই শ্রাদ্ধতর্পণ করাকে বলা হয় বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ।
গায়ে হলুদ (গাত্র হরিদ্রা)
গায়ে হলুদ হিন্দু বিবাহের একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব । এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় । বর-কনের স্ব স্ব বাড়িতে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হয় । বর বা কনেকে একটি আসনের উপর বসানো হয়। বড়রা ধান, দূর্বা প্রভৃতি দিয়ে আশীর্বাদ করে আর ছোটরা নমস্কার করে গালে, কপালে, হাতে হলুদ মাখিয়ে দেয় । সাথে সাথে মিষ্টিমুখও করানো হয় ।
এটি মূলত দেহশুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান। কাঁচা হলুদের সাথে মেথি, সুন্ধা, সরিষা, চন্দন প্রভৃতি থাকে। এগুলো সবই সৌভাগ্যের প্রতীক । সুদৃঢ় বিবাহিত জীবন, নবদম্পতির সুখ-শান্তি কামনা করাই এ অনুষ্ঠানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ৷
একক কাজ : বিবাহের আগে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান করা হয় কেন? কারণ উল্লেখ কর ।
মালাবদল
বর তার গলার মালাটি কনের গলায় এবং একইভাবে কনেও তার গলার মালাটি বরের গলায় পরিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় পর পর তিনবার পরস্পরের মালা বদল করা হয় ।
সম্প্রদান
বিবাহের মূল পর্বই হচ্ছে সম্প্রদানপর্ব । বিবাহের নির্দিষ্ট পোশাক পরে বর-কনেকে বিয়ের পিঁড়িতে মুখোমুখী বসাতে হয় । বর পূর্বমুখী আর কনে পশ্চিমমুখী হয়ে বসে। যিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি উত্তরমুখী হয়ে বসেন। পুত্তলি অঙ্কিত, আম্রপল্লবে সুশোভিত, গঙ্গাজলপূর্ণ একটা ঘটের উপর বরের চিৎ করা ডান হাতের উপর কনের ডান হাত রাখা হয়। তার উপর লাল গামছায় বাঁধা পাঁচটি ফল কুশপত্র আর ফুলের মালা দিয়ে বেঁধে দেয়া হয় । সম্প্রদানকর্তা দেবতাদের নাম উচ্চারণ করে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি ও আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে কন্যা সম্প্রদান করেন ।
যজ্ঞানুষ্ঠান ও সাতপাকে বাঁধা
সম্প্রদান পর্বের পরে সেখানে বর্গাকার যজ্ঞক্ষেত্র তৈরি করা হয়। বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে মনের অহংকার, মান- অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণাসহ সকল অসাধু চিন্তারূপী ঘি-মাখা আমপাতা আগুনে আহুতি দিতে হয়। এরপর দেবপুরোহিত অগ্নিকে পর পর সাতবার প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করতে হয় । এভাবেই সাতপাকে বেঁধে নবদম্পতি বিশুদ্ধ নব-জীবন লাভ করে । এই যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে অগ্নিদেবের কাছে বর-কনে আমৃত্যু বাঁধা হয়ে থাকে । অনেক স্থানে কলাগাছ বেষ্টিত বিবাহ আসরে বর কনেকে সাতবার ঘোরানো হয় । বর সম্মুখে কনে তার পিছনে । বর তার বাঁ হাত দিয়ে কনের ডান হাত ধরে বিবাহ আসরের চারদিকে সাতবার ঘোরে । এর পাশাপাশি দুজনের কাপড়ের কোণা একত্র করে একটা গিঁটও দেওয়া হয় ।
একক কাজ : বিবাহে শুভদৃষ্টি ও যজ্ঞানুষ্ঠানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা কর ।
সিঁথিতে বিবাহ চিহ্ন
সম্প্রদানপর্ব ও যজ্ঞানুষ্ঠান শেষে বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিদুর দিয়ে বিবাহ চিহ্ন পরানো একজন হিন্দু নারীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । এরপর থেকেই কন্যা অর্থাৎ স্ত্রী স্বামীর জীবিতাবস্থায় সিঁথিতে সিঁদুর পরতে পারবে । আমাদের দেশে অনেক স্থানে বাসি বিয়ের দিন অর্থাৎ বিয়ের পরদিন সিঁদুর পরানোর অনুষ্ঠান হয় ।
পণপ্রথা অধর্ম
কন্যাকে পাত্রস্থ করার সময় বরপক্ষকে যদি নগদ অর্থ, সম্পদ প্রভৃতি দিতে হয় তাহলে তাকে বলে পণ । এই পণপ্রথা বা যৌতুকপ্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি । বহুকাল থেকে এটি আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। পণ গ্রহণ এবং প্রদান দুটোই সমান অপরাধ। এর মূলে রয়েছে অশিক্ষা, অসচেতনতা, পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা ।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই পণপ্রথা নিন্দনীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ। এ সমস্ত জঘন্য অপরাধমূলক কাজকর্ম থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য আমরা এগিয়ে আসব। এ জঘন্য প্রথা নির্মূল করার জন্য দরকার আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সামাজিক প্রতিরোধ, নারীকে শিক্ষিত ও সচেতন করে যথাযোগ্য মর্যাদা দান । এছাড়াও মানসিক প্রসারতা ও জীবনমুখী শিক্ষা এ প্রথা নির্মূলে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে । সর্বোপরি পণ বা যৌতুকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে ।
একক কাজ : সিঁথিতে সিঁদুর পরানো একজন হিন্দু রমণীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ব্যাখ্যা কর ।
পাঠ ৫ : অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
‘অন্ত্য ও ‘ইষ্টি’ এই দুটি শব্দ মিলেই অন্ত্যেষ্টি শব্দটি গঠিত । ‘অন্ত্য' শব্দের অর্থ শেষ এবং ‘ইষ্টি' শব্দের অর্থ যজ্ঞ । সুতরাং অন্ত্যেষ্টি শব্দের অর্থ ‘শেষযজ্ঞ' অর্থাৎ অগ্নিতে মৃতদেহকে আহুতি দেওয়া ।
মৃত্যু মানে দেহ থেকে আত্মার বহির্গমন। আত্মা দেহ থেকে অন্তর্হিত হলে দেহ একটি প্রাণহীন অচল পদার্থে পরিণত হয় এবং ক্রমে ক্রমে এটি পচে যায়। তাই শাস্ত্রে মৃতদেহের সৎকারের বিধান দেয়া হয়েছে । এই সৎকারই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নামে পরিচিত।
মৃত্যুর পর দেহটিকে বস্ত্রাবৃত ও মালা চন্দনাদি দ্বারা বিভূষিত করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে মৃতদেহের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে তাকে কুশের উপর শয়ন করানো হয় । দাহাধিকারী স্নান করে এসে মৃতদেহের গায়ে তেল ও কাঁচা হলুদ মেখে তাকে স্নান করান ।
স্নানের পরে মৃতদেহকে নতুন কাপড় ও মালা পরিয়ে কপালে চন্দন দিতে হয় । এরপর দুই চোখ, দুই কান, নাকের দুই ছিদ্র ও মুখ এই সপ্তছিদ্র স্বর্ণ বা কাঁসা দ্বারা আচ্ছাদন করতে হয় । তারপর পিণ্ডদান করতে হয়।
এরপর আমকাঠ বা চন্দনকাঠ দিয়ে চিতা সাজানো হয় । তারপর শবকে চিতায় শয়ন করানো হয় । চন্দনকাঠ পাওয়া না গেলে ক্ষতি নেই । যেখানে যেমন কাঠ প্রাপ্য তা দিয়ে দাহকার্য সম্পন্ন করতে হবে । বর্তমানে বৈদ্যুতিক চুল্লিতেও শবদাহ করা হয় ।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্র
সাধারণত নিয়মানুসারে প্রথমে জ্যেষ্ঠ পুত্র শির বা মস্তকে অগ্নিপ্রদান করে । প্রচলিত কথায় বলা হয় মুখাগ্নি ।
তার অভাবে কে অগ্নিপ্রদান করবে, তার একটি ক্রমধারা স্মৃতিশাস্ত্রে বর্ণিত আছে ।
অগ্নিদানের পূর্বে শবদেহ সাত বা তিনবার প্রদক্ষিণ করতে করতে নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয় :
কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্ম জানতা বাপ্যজানতা ।
মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্ ৷৷
ধর্মাধর্মসমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃতম্ । দহেয়ং সর্বগাত্রাণি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু '
অর্থাৎ জেনে বা না জেনে তিনি হয়ত দুষ্কার্য করেছেন । এখন মৃত্যুকালবশে তিনি পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন । ধর্ম, অধর্ম, লোভ ও মোহাচ্ছন্ন তাঁর শরীর দগ্ধ করুন । তিনি দিব্যলোকে গমন করুন । দাহকার্য শেষ হলে চিতায় জল ঢেলে আগুন নিভিয়ে চিতা পরিষ্কার করতে হবে । শ্মশানবন্ধুগণ বা দাহকার্যে নিয়োজিত সকলে স্নান করে পরিচ্ছন্ন হবেন ।
একক কাজ : অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্রটির অর্থ লেখ ।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গুরুত্ব
আত্মা দেহ থেকে নির্গত হলে দেহটি একটি জড়বস্তুতে পরিণত হয় এবং প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে এটি পচতে শুরু করে । ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে থাকলে তখন ভীতির সঞ্চার হয় এবং পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই শাস্ত্রে মৃতদেহের সৎকারের বিধান দেওয়া হয়েছে । সুতরাং শবদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একটি ধর্মীয় বিধি-বিধান । তবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শুধু যে ধর্মীয় দিক থেকেই গুরুত্ব আছে তা নয়, সামাজিক দিক থেকেও এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ কাজ । কেউ মারা গেলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসেন । মৃত ব্যক্তির পরিবার, জ্ঞাতিবর্গ অশৌচ পালন করে তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন । এতে সামাজিক অনুশাসনের বন্ধন আরও দৃঢ় হয় । তাছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্রটি উচ্চারণের ফলে আত্মা পবিত্র হয় । সকলের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ মন তৈরি হয় । মানুষের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় ।
পাঠ ৬ : অশৌচ
‘শৌচ' শব্দের অর্থ ‘শুচিতা' । সুতরাং ‘অশৌচ' শব্দের অর্থ শুচিতা বা পবিত্রতার অভাব । মাতা-পিতা বা জ্ঞাতিবর্গের মৃত্যুতে আমাদের অশৌচ হয় । কারণ প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমাদের মন শোকে আচ্ছন্ন হয় । আমাদের চিত্ত সাধন-ভজনের উপযোগী থাকে না । তখন আমরা অশুচি হই ।
মাতা-পিতার মৃত্যুর পর অশৌচ কালে হবিষ্যান্ন বা ফলফলাদি খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয় । এসময় কঠোর সংযম পালন করে শ্রাদ্ধ করার উপযুক্ততা অর্জন করতে হয় । অশৌচকালে উঠানে একটি তুলসী গাছ রোপণ করে সেখানে প্রতিদিন মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে জল ও দুগ্ধ প্ৰদান করতে হয় ।
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর চতুর্থ দিনে ও দশম দিনে পিণ্ড দান করতে হয় । এই পিণ্ডকে বলা হয় পূরকপিণ্ড । পূরক পিণ্ড দিতে হয় মোট দশটি। অশৌচান্তে মস্তক মুণ্ডন করে নববস্ত্র পরিধান করতে হয় । অশৌচান্তের দ্বিতীয় দিবসে হয় শ্রাদ্ধ । অশৌচ পালনে বর্ণপ্রথার প্রভাব দেখা যায় । উচ্চবর্ণের চেয়ে নিম্নবর্ণের লোকদের অশৌচ পালনের দিবস সংখ্যা বেশি । ব্রাহ্মণের দশদিন, ক্ষত্রিয়ের বারদিন, বৈশ্যের পনরদিন এবং শূদ্রের ত্রিশদিন অশৌচ পালনের বিধান আছে । তবে বর্তমানে প্রায় সকল বর্ণের বা গোত্রের মানুষ দশ দিন অশৌচ পালন করে একাদশ কিংবা ত্রয়োদশ দিবসে, কেউ কেউ পনের দিন অশৌচ পালন করে ষোড়শ দিবসে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন ।
জননাশৌচ ও মরণাশৌচ ভেদে অশৌচ দুই প্রকার । কেউ জন্মগ্রহণ করলে যে অশৌচ হয় তার নাম জননাশৌচ এবং মৃত্যুর পরে যে অশৌচ হয় তার নাম মরণাশৌচ । সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত জ্ঞাতিত্ব বর্তমান থাকে । সুতরাং সপ্তম পুরুষ পর্যন্তই জননাশৌচ ও মরণাশৌচ পালন করার নিয়ম আছে ।
অশৌচ পালনের গুরুত্ব
অশৌচ পালন যে শুধু শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান তা-ই নয়, সামাজিক দিক থেকেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। পিতা-মাতার জীবদ্দশায় সারাদিন কর্মক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এলে তাঁদের স্পর্শ আমাদের স্বর্গসুখ দেয় । হঠাৎ করে তাঁদের চির অনুপস্থিতি সন্তানকে বিচলিত করে তোলে । এমনকি নিকট আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুও আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে তোলে । তাঁদের আত্মার শান্তি কামনায় নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হয়। কিন্তু বিচলিত মনে ঈশ্বরের প্রতি সবিনয়ে পূর্ণ একাগ্রতা আসে না । এজন্য চাই শান্ত মন । তাই সময়ের প্রয়োজন । আর এ প্রস্তুতির জন্য অশৌচ পালন কর্তব্য । এতে মন ধীরে ধীরে শান্ত হয় এবং মনে প্রশান্তি ফিরে আসে। এছাড়া মৃত ব্যক্তির পরিবার ও জ্ঞাতিবর্গ অশৌচ পালন করে তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন ।
একক কাজ : মরণাশৌচ পালনের বিধানগুলো উল্লেখ কর ।
পাঠ ৭ ও ৮ : আদ্যশ্ৰাদ্ধ
‘শ্রদ্ধা' শব্দের সঙ্গে ‘অণু' প্রত্যয় যোগে 'শ্রাদ্ধ' শব্দ গঠিত। শ্রদ্ধার সঙ্গে যা দান করা হয় তাই শ্রাদ্ধ । সুতরাং যেখানে শ্রদ্ধার সংযোগ নেই সেখানে আড়ম্বর থাকলেও শ্রাদ্ধ হয় না। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর
প্রথমে যে শ্রাদ্ধ করণীয় তাকে বলা হয় আদ্যশ্রাদ্ধ । অশৌচকাল উত্তীর্ণ হলে পর দিন অনুষ্ঠিত হয় এই শ্রাদ্ধ। যতদূর জানা যায়, নিমি শ্রাদ্ধের প্রবর্তক । আদ্যশ্রাদ্ধের সময় শাস্ত্রে ছয়, আট, ষোল প্রভৃতি বিভিন্ন দানের বিধান আছে। যার যেমন সামর্থ্য সে তেমন দানই করে থাকে। আদ্যশ্রাদ্ধে গীতা ও মহাভারতের বিরাট পর্ব পাঠেরও বিধান আছে। কোনো কোনো অঞ্চলে শ্রাদ্ধবাসরে কঠোপনিষদ পাঠ করা হয় ।
আদ্যশ্রাদ্ধের পূর্ণ নাম আদ্য একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ । একজন মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হয় বলে তাকে বলা হয় একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ । অর্থাৎ একজনের উদ্দেশে শ্রদ্ধার সাথে দান। আদ্য একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধের প্রথমে প্রদীপ প্রজ্বলিত করে বাস্তুপুরুষ যজ্ঞেশ্বর ও ভূস্বামীর পূজা করণীয় । অতঃপর মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে শ্রাদ্ধ করতে হয়। এই সময় আসন, ছাতা, পাদুকা, বস্ত্র, অন্ন, জল, তাম্বুল, মালা, বিছানা প্রভৃতি মৃতব্যক্তির নামে মন্ত্রোচ্চারণসহ উৎসর্গ করা হয় । পরে পিণ্ডদান করে আদ্য একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ সমাপ্ত করা হয় । নারীরাও অশৌচ এবং চতুর্থী প্রভৃতি অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন ।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আদ্যশ্রাদ্ধের গুরুত্ব
আদ্যশ্রাদ্ধের যে শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই গুরুত্ব আছে তা নয়, পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট । কেউ মারা গেলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন যেমন দেখতে আসেন তেমনি মৃত ব্যক্তির আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার পরিবার, জ্ঞাতিবর্গের দুঃখের সাথে একাত্ম হন। এতে মানুষের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয় । সকলেই সমব্যথী হয় । পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের একটি
মিলনমেলাও হয় । একজনের প্রতি আরেক জনের শ্রদ্ধা ভালোবাসা বেড়ে যায় । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে
সামাজিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়।
একক কাজ : আদ্যশ্রাদ্ধ করার সময় কী কী দান করতে হয় ?
অভিন্ন বিধানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
হিন্দু সমাজের আচার-অনুষ্ঠান পালনে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য না রেখে একই প্রকার বিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে । কেননা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে জন্মভেদে নয়, বরং কর্মভেদেই বর্ণবিভাজন হয় । অর্থাৎ যে যে রকম পেশায় নিয়োজিত তার বর্ণটি সে অনুসারে হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- 'চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ'- অর্থাৎ কর্মের বিভাগ অনুসারে আমিই চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি । গুণ ও
ব্রাহ্মণ সন্তান হলেই যে একজন ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হবে, এমনটি নয় । সত্ত্বগুণ প্রভাবিত কোনো শূদ্রের সন্তানও ব্রাহ্মণ পদবাচ্য হতে পারেন । আবার কোনো ব্রাহ্মণ-সন্তান তমঃ গুণে প্রভাবিত হলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবেন । সুতরাং বলা যায়, জাতি বা বর্ণভেদ বংশগত নয়, গুণ ও কর্মগত ।
অশৌচ পালনের দিবসসংখ্যায় তারতম্য ও অনুষ্ঠানের ভিন্নতা যৌক্তিক নয়। আর সেজন্যই বর্তমানে প্রায় সকল বর্ণের মানুষ দশ দিন অশৌচ পালন করে একাদশ কিংবা ত্রয়োদশ দিবসে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করছেন । কিন্তু এটা স্বেচ্ছাকৃত । সকল বর্ণের জন্য অভিন্ন বিধান যৌক্তিক এবং হিন্দু সমাজের সামগ্রিক ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য অভিন্ন বিধান প্রয়োজন ।
নতুন শব্দ : পার্থিব, অষ্টদুর্গা, মোহাচ্ছন্ন, জননাশৌচ, মরণাশৌচ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, হবিষ্যান্ন, মুণ্ডন, বিষাদগ্রস্ত,
প্রবর্তক, পাদুকা, তাম্বুল, অঙ্কুরিত ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১। নারী-পুরুষ পরস্পর শপথ করে মাল্য বিনিময়ের মাধ্যমে কোন বিবাহ সংঘটিত হয়?
ক. প্রাজাপত্য
খ. গান্ধর্ব
গ. আসুর
ঘ. ব্ৰাহ্ম
২। সমাবর্তন বলতে কীরূপ অনুষ্ঠান বোঝায়?
ক. পাঠগ্রহণের উদ্দেশ্যে গুরুগৃহে গমন
খ. পাঠগ্রহণকালে গুরুকে মূল্যবান উপহার প্রদান
গ. পাঠশেষে গুরুগৃহ থেকে বিদায়ানুষ্ঠান
ঘ. পাঠশেষে গুরুগৃহ থেকে নিজগৃহে ফিরে আসা
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও : গোপাল তার ঠাকুরদার একমাত্র নাতি । চোখের সামনে ঠাকুরদার মৃত্যুতে সে শোকাহত হয় । গোপাল দেখে মৃত্যুর পর তার ঠাকুরদার দেহটিকে ফুলের মালা ও চন্দন দিয়ে সাজিয়ে তার বাবা ও পাড়া-প্রতিবেশীরা শ্মশানে নিয়ে যায় । শাস্ত্র অনুযায়ী গোপাল ও তার বাবা মা-বার দিন অশৌচ পালন করেন ।
৩ । গোপালের ঠাকুরদাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার কারণ কোনটি ?
ক. হবিষ্যান্ন পালন খ. নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান সম্পন্ন
গ. আদ্যশ্ৰাদ্ধ সম্পন্ন ঘ. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন
৪ । তাদের অশৌচ পালনের মাধ্যমে অর্জিত হবে-
i. শ্রাদ্ধ করার উপযুক্ততা
ii. আত্মার শান্তি কামনায় নিজেদের প্রস্তুত করা
iii. শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান পালন করা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন :
স্নাতক পরীক্ষা শেষে মিতার বাবা-মা তার বিবাহের দিন ধার্য করে । ঐদিন মিতাকে বস্ত্র ও অলংকার সজ্জিত করে তার বাবা তাকে বরের হাতে সম্প্রদান করেন । এ অনুষ্ঠানে পুরোহিত মন্ত্র পাঠ ও যজ্ঞের মাধ্যমে তাদের বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন ।
ক. সংস্কার কী?
খ. কেন অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান করা হয়?
গ. মিতার বিবাহ পদ্ধতিটি তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. মিতার বিবাহ কার্য সম্পাদনে যজ্ঞানুষ্ঠানের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ কর।