সকল মানুষ এক রকম না হওয়ার কারণ-
পঞ্চম অধ্যায়
বৌদ্ধ কর্মবাদ
কর্ম বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বলা হয় কর্মের শক্তি বিশ্বব্যাপী। বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তিই হলো ‘কর্মবাদ’। মানুষ নিজ নিজ কর্ম অনুসারে কর্মফল ভোগ করে। ভালো কাজ করলে ভালো ফল এবং মন্দ কাজ করলে মন্দ ফল তাকে ভোগ করতে হবেই। শুধু মানুষ নয়, জীবমাত্রই কর্মের অধীন। কর্মের জন্য তার উৎপত্তি, কর্মের মাধ্যমে তার স্বীকৃতি, কর্মই তার বন্ধু, কর্মই তার আশ্রয়। কর্মের দ্বারা উন্নত জীবন যেমন লাভ হয় তেমনি কর্মের দ্বারা হীন জীবনও লাভ হয়। এ অধ্যায়ে আমরা বৌদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
এ অধ্যায় শেষে আমরা -
* কর্ম-এর ধারণা বলতে পারব ;
* বৌদ্ধধর্ম মতে ‘কর্মবাদ' কী ব্যাখ্যা করতে পারব ;
* কুশল এবং অকুশল কর্মের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারব;
* চুল্লকর্ম বিভঙ্গ সূত্রের আলোকে বৌদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতে পারব ।
পাঠ : ১
কর্ম শব্দের ধারণা
'কর্ম' বলতে কোনো অনুষ্ঠান করা, নির্মাণ করা বা সম্পাদন করা ইত্যাদি বোঝায়। বৌদ্ধধর্মে কর্মকে শুভ-অশুভ, কুশল-অকুশল ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে কর্ম বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ যা চিন্তা করা যায়, বাক্যে উচ্চারণ করা যায় এবং দেহের দ্বারা সম্পাদন করা যায় তাই কর্ম। কায়-বাক্য ও মন এই ত্রিদ্বারে কর্ম সংঘটিত হয়। চিন্তন, কথন, এবং করণ (দৈহিক) সমস্তই কর্মের অধীন। মনের চেতনাহীন ক্রিয়াকে কর্ম বলা হয় না । ‘অঙ্গুত্তর নিকায়' নামক গ্রন্থে বুদ্ধ বলেছেন-
“চেতনাহং ভিক্খবে কম্মং বদামি । চেতযিত্বা কম্মং করোতি কায়েন, বাচায মনসা’পি” ।
বাংলা অনুবাদ : হে ভিক্ষুগণ! চেতনাকেই (ইচ্ছাকে) আমি কর্ম বলি । কারণ চেতনার দ্বারা ব্যক্তি কায়-বাক্য ও মনের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করে।
কর্মের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মন বা চিত্ত। চেতনা মনের সহজাত প্রবৃত্তি বিশেষ। চিত্ত থেকে উৎপন্ন উপলব্ধিই চেতনা। একটি ক্ষণের একটি চেতনা সুখ-দুঃখ প্রদান করতে সক্ষম। কায় কর্ম ও বাক্য কর্ম সমস্তই মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বৌদ্ধধর্ম মতে, নিজ নিজ কর্মের ফল সবাইকে ভোগ করতে হবে। প্রত্যেক কর্মের ফল আছে। গাছের ফলের মতো কর্মফল মানুষের কর্মকে অনুসরণ করে। কর্ম যদি ভালো বা মন্দ হয় তবে ফলও ভালো বা মন্দ হবে।
কর্মের শ্রেণি বিভাগ
করণীয় অনুসারে কর্ম চার প্রকার। যেমন : ক. জনক কর্ম, খ. উপস্তম্ভক কর্ম, গ. উৎপীড়ক বা উপপীড়ক কর্ম, এবং ঘ. উপঘাতক কৰ্ম ।
ক. জনক কর্ম : যে কর্ম পুনর্জন্ম ঘটায়, জীবিতকালে যে কর্ম স্কন্ধ ও কর্মজরূপ উৎপাদক এবং কুশল-অকুশল চেতনামূলক তাই জনক কর্ম। জনক কর্ম অতীত কর্মেরই ফল।
খ. উপস্তম্ভক কর্ম : যে কৰ্ম জনক কর্মকে সাহায্য করে তাই উপস্তম্ভক কর্ম। উপস্তম্ভক কৰ্ম জনক কর্মকে
ফল প্রদানে সাহায্য করে । জনক কর্মের প্রভাবে জন্ম হয় আর বেঁচে থাকা হয় উপস্তম্ভক কর্মের প্রভাবে। গ. উৎপীড়ক বা উপপীড়ক কর্ম : এই জাতীয় কর্ম জনক কর্ম বা উপস্তম্ভক কর্মের বিপাককে দুর্বল করে কিংবা বাধা দেয়। কুশল উৎপীড়ক কর্ম অকুশল উপস্তম্ভক কর্মকে, অকুশল উৎপীড়ক কর্ম কুশল উপস্তম্ভক কর্মকে বাধা দেয় এবং দুর্বল করে।
ঘ. উপঘাতক কৰ্ম : এ ধরনের কর্মের কাজ হলো বাঁধা দেওয়া। এ রকম কর্ম শুধু বাধা দেয় না জনক কর্মকে
সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। ফল উৎপন্ন করাই হলো এর কাজ।
অনুশীলনমূলক কাজ অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ কী বলেছিলেন? করণীয় অনুসারে কর্ম কয় প্রকার ও কী কী বল । |
পাঠ : ২
কর্মবাদের ধারণা
‘কর্ম’ ও ‘বাদ’-দুটি অর্থবোধক শব্দের সমন্বয়ে ‘কর্মবাদ' শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘কর্ম' বলতে কায়, বাক্য ও মনে সম্পাদিত কাজ বা ক্রিয়াকে বোঝায়। 'বাদ' বলতে তত্ত্ব বা ধারণার বিশ্বাসকে বোঝায়। সুতরাং কর্মবাদ বলতে কর্মফলে গভীর বিশ্বাসকে বোঝানো হয়।
আয়ু-বর্ণে, ভোগ-ঐশ্বর্যে এবং জ্ঞান-গরিমায় মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তার অন্যতম কারণ কর্ম । জীব মাত্রই নিজ নিজ কর্মের অধীন। কর্মই প্রাণীগণকে হীন-উত্তম বা উঁচু-নিচু বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত করে। পৃথিবীতে সকল মানুষের আচার-আচরণ যেমন এক রকম নয় তেমনি আবার স্বভাব-চরিত্র একই রকম নয়। ‘মিলিন্দ প্রশ্ন' নামক গ্রন্থে ভিক্ষু নাগসেন ও গ্রিক রাজ মিলিন্দের কথোপকথনে নাগসেন স্থবির বলেছিলেন - ‘সকল মানুষ এক রকম না হওয়ার কারণ হলো তাদের কৃতকর্ম। বিভিন্ন মানুষের কর্মফলে পার্থক্য আছে বলেই মানুষের মধ্যে নানারকম পার্থক্য লক্ষ করা যায়'। তিনি আরো বলেন – 'সকল বৃক্ষের ফল সমান হয় না। কিছু টক, কিছু লবণাক্ত, কিছু মধুর রসযুক্ত। এগুলো বীজের নানাত্ব কারণেই হয়' । এভাবে কর্মের নানাত্ব হেতু সকল মানুষ সমান হয় না। কারণ প্রাণী মাত্রই কর্মের অধীন। এ রকম ভিন্নতার অন্যতম কারণ হলো কর্ম ।
কর্মই প্রাণীকে নানাভাবে বিভাজন করে। জীবের সুখ এবং দুঃখের দাতা কেউ নয়। এগুলো কর্মেরই
প্রতিক্রিয়া। বুদ্ধ সুত্তনিপাত নামক গ্রন্থে বলেন -
ন জচ্চা ব্রাহ্মণো হোতি, ন জচ্চা হোতি অব্রাহ্মণো কম্মুনা ব্রাহ্মণো হোতি কম্মুনা হোতি অব্রাহ্মণো ।
বাংলা অনুবাদ : জন্ম দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, জন্ম দ্বারা কেউ অব্রাহ্মণ হয় না, কর্ম দ্বারা ব্রাহ্মণ হয় এবং
কর্ম দ্বারা অব্রাহ্মণ হয় ।
কস্সকো কম্মুনা হোতি, সিপ্পিকো হোতি কম্মুনা বাণিজো কম্মুনা হোতি, পেসিকো হোতি কম্মুনা ।
বাংলা অনুবাদ : কর্ম দ্বারা কেউ চাষী হয়, কর্ম দ্বারা কেউ কারিগর হয়, কর্ম দ্বারাই মানুষ ব্যবসায়ী হয় এবং কর্ম দ্বারা চাকর হয় ।
কম্মুনা বত্ততি লোকো, কম্মুনা বত্ততি পজা কম্ম নিবন্ধন সত্তা, রথস্সানীব যাযতো।
বাংলা অনুবাদ : কর্মের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী সচল। কর্মের মাধ্যমে মানব জন্মের সৃষ্টি। চাকার উপর নির্ভর করে রথ যেমন চলে তেমনি সকল প্রাণী নিজ নিজ কর্মের উপর নির্ভরশীল।
মানুষের জীবন কর্মবিধানের দ্বারা শৃঙ্খলিত । অতীত কর্মের দ্বারা বর্তমান জীবন নির্ধারিত হয়েছে। আবার বর্তমান কর্মের দ্বারা ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হচ্ছে। অর্থাৎ অতীতের উপর যেমন বর্তমান জীবন নির্ভর করে, আবার বর্তমানের উপরও ভবিষ্যৎ জীবন নির্ভর করে।
জাতকে দীর্ঘায়ু কুমারের একটি কাহিনী আছে। বারানসিরাজ দীর্ঘায়ু কুমারের মা-বাবাকে হত্যা করেছিলেন। অনেক দিন পর দীর্ঘায়ু কুমার একবার সুযোগ পেয়েছিলেন রাজাকে হত্যা করার। তিনি রাজাকে নিজের পরিচয় দিয়ে সৎকর্মের প্রভাবে রাজাকে হত্যা না করে বললেন, মহারাজ ! আমি আপনার অনিষ্ট করবো না। বরং আপনি আমাকে আমার মা-বাবার মতো হত্যা করুন । তা না হলে আপনার শত্রু পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। রাজাও তখন দীর্ঘায়ু কুমারকে বললেন, আমিও আপনার অনিষ্ট করবো না। এ ভাবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, মন্দ কর্ম জন্মলাভের সুযোগ থাকলেও কুশল চিন্তার জন্য তা ঘটলো না । এতে দুজনের উপর শুভ অদৃষ্টফলের প্রভাব পড়েছিল।
অনুশীলনমূলক কাজ নাগসেন স্থবির গ্রিকরাজ মিলিন্দকে কর্ম সম্পর্কে কী বলেছিলেন? বল সুত্তনিপাতে বর্ণিত কর্মের ধারণা দাও। |
পাঠ : ৩ কর্মফলের ব্যাখ্যা
কর্মবাদ অনুসারে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজ নিজ কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন কর্মফল ভোগ করবে। কর্ম যদি ভালো-মন্দ হয় তবে ফলও ভালো-মন্দ হবে। আপনি যেমন বীজ রোপণ করবেন, তেমন ফসল পাবেন। কেউ যদি ধানের বীজ রোপণ করে তবে সে ধান পাবে, গম পাবে না। আর যদি কেউ খারাপ ধানের বীজ বপন করে তবে খারাপ ধান পাবে, ভালো ধান পাবে না ।
পৃথিবীর সর্বত্রই একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমি তোমাকে মুক্ত করবো এ কথা বুদ্ধ কোথাও বলেননি । বর্তমান মুহূর্তের কর্ম পরবর্তী মুহূর্তে ফল প্রদান করে। এটাই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক নিয়ম। মানুষ নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। সুত্ত পিটকের অন্তর্গত ‘ধর্মপদ' নামক গ্রন্থে দেখা যায় –
‘অত্তাহি অত্তনাথো কোহি নাথো পরোসিযা'।
অত্তনাহি সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং
অর্থাৎ নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা বা প্রভু, অন্যকোনো ত্রাণকর্তা বা প্রভু নেই। নিজেকে সুসংযত করতে পারলেই যে কোনো দুর্লভ বিষয় লাভ সম্ভব।
আত্মনির্ভরশীল না হলে কারো পক্ষে কোনোপ্রকার কাজে সফলতা আসে না। তাই আত্মপ্রতিষ্ঠাই হলো সর্ববিধ মহৎ কাজের ভিত্তিস্বরূপ। মানুষ তার ভালো-মন্দ কর্মের ফলস্বরূপ সুখদুঃখ ভোগ করে । কর্ম ফল দেয়, ফল কারণ নির্দেশ করে। বীজ ফল প্রদান করে এবং ফল বীজের বর্ণনা করে। এখানে বীজ এবং ফল উভয়েরই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সেরূপ কর্ম ও কর্মফল পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ফল পূর্ব থেকে কর্মের মধ্যে অঙ্কুররূপে বিদ্যমান থাকে। ‘সঙ্গীতি সূত্রে' কর্মের ফল বিবেচনায় কর্মের বিধানকে বিশেষ চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন :
ক. অকুশল বা দুঃখদায়ী পাপকর্ম : এগুলো হচ্ছে লোভ-দ্বেষ-মোহাচ্ছন্ন চিত্তে সম্পাদিত কর্ম। এরূপ কর্মের ফল সম্পর্কে ধর্মপদ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে -
দিসো দিসং যং তং কযিরা বেরি বা পন বেরিনং মিচ্ছাপণিহিতং চিত্তং পাপিযো নং ততো করে ।
বাংলা অনুবাদ : একজন শত্রু আর একজন শত্রুর যতটুকু ক্ষতি করতে পারে না তার চেয়ে অধিক ক্ষতি করতে পারে নিজের বিপথগামী চিত্ত । ধর্মপদ গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে-
ইধ সোচতি পেচ্চ সোচতি পাপকারী উভযথ সোচতি
সো সোচতি নো বিজ্ঞতি দিস্বা কম্মকিলিঠমনো
বাংলা অনবাদ : পাপকারী ইহলোক পরলোক উভয়লোকে অনুশোচনা করে। সে নিজের পাপকর্ম ও তার ফল দেখে গভীরভাবে অনুশোচনা করতে থাকে ।
খ. কুশল বা সুখদায়ী পুণ্যকর্ম : শীল পালন, দানানুশীলন, পরোপকারসাধন প্রভৃতি সৎকর্ম কুশল বা
সুখদায়ী। পুণ্যকর্ম সুখময় ফলদায়ক। এরূপ কর্মের ফল সম্পর্কে ধর্মপদে বলা হয়েছে-
নং তং মাতা-পিতা কযিরা অজ্ঞে বাপি চ ঞাতকা
সম্মা পণিহিতং চিত্তং সেয্যসো নং ততো করে ।
বাংলা অনুবাদ : মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যে উপকার করতে পারে না, সুপথে পরিচালিত
চিত্ত তার চেয়ে অধিক উপকার করে।
গ. কুশলাকুশল ফলদায়ী পাপ-পুণ্যকর্ম : কুশলাকুশল বিমিশ্রিত চিত্তে সম্পাদিত কর্ম পাপ পুণ্যময় হয় এবং তার ফল সুখ দুঃখময় হয়। এ রকম কর্মের একটি উদাহরণ নিচে প্রদান করা হলো – কোনো এক ব্যক্তি চুরি, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি হীন উপায়ে অর্থ উপার্জন করে। কোনো ব্যক্তি তার কাছ থেকে অর্থ চাইলে সে মুক্ত হস্তে দান করে। দুঃখীর দুঃখ মোচনে সে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফল লাভের ক্ষেত্রে সে তার বদান্যতা, উদারতা ও পরের উপকার করার ফলস্বরূপ পরবর্তী জন্মে বিত্তশালী হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। তবে চুরি, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি অপকর্মের জন্য মিথ্যা অপবাদের ভাগী হতে পারে। বিপুল অর্থ থাকা সত্বেও ভোগে বঞ্চিত হতে পারে। দৈহিক ও মানসিক নানাকষ্টের মধ্য দিয়ে তার জীবনের অবসান হয়।
ঘ. সব রকম কর্মক্ষয়কর কর্ম যার দ্বারা মুক্তি লাভ সম্ভব : মানুষ যখন লোভ-দ্বেষ-মোহে আকৃষ্ট হয়, তখন তার মধ্যে নানারকম কামনা-বাসনা উৎপন্ন হয়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মনকে সংযত করার মাধ্যমে এগুলোকে দমন করা সম্ভব। তাঁর জন্য দরকার একাগ্র সাধনা, যার মধ্য দিয়ে পরম মুক্তি লাভ সম্ভব। বুদ্ধ সংযুক্ত নিকায়ের 'সমিদ্ধি সুত্তে' বলেছেন, 'কায়-বাক্য- মনে কোনোরকম পাপকর্ম করা উচিত নয়। কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে স্মৃতিমান হয়ে অনর্থক দুঃখ সেবন থেকে বিরত থাকা উচিত'।
সুকর্ম ও সুকর্মের ফল ব্যক্তিকে পুণ্যময় কর্মানুষ্ঠানের দিকে নিয়ে যায়। অঙ্গুলিমাল ছিলেন নরঘাতক দস্যু। তিনি ৯৯৯ জনকে নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু সেই অঙ্গুলিমালই তাঁর অন্তিম জন্মে অতীতের সমস্ত পাপকর্ম হতে মুক্ত হয়ে অর্হৎ হয়েছিলেন। আলবক যক্ষ বুদ্ধের দ্বারা দমিত হয়ে প্রাণিহত্যা পরিত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর কর্ম প্রচেষ্টায় স্রোতাপত্তি ফল লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । গণিকা আম্রপালি বুদ্ধ নির্দেশিত এবং প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে অর্হত্ব ফল লাভ করেছিলেন। রাজ্য বিস্তারের মোহে সম্রাট অশোক চণ্ডাশোক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সেই চণ্ডাশোক পরবর্তীকালে ধর্মাশোক হিসেবে খ্যাতি লাভ করে বহু জনহিতকর কর্ম সম্পাদন করেছিলেন। পিতৃহত্যাকারী রাজা অজাতশত্ৰু বুদ্ধের নিকটে এসে ধর্মানুরাগ ও ভক্তির জন্য আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। কিন্তু পিতৃহত্যাজনিত পাপকর্মের ফলে মৃত্যুর পর নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন । ব্রাহ্মণ পুত্র হয়েও ব্রাহ্মণোচিত আচরণের অধিকারী অনেকেই হতে পারে না। অন্যদিকে শূদ্রকুলে জন্ম গ্রহণ করে দৈহিক সুশ্রীতার জন্য অনেক সুনাম-সুখ্যাতির অধিকারী হওয়া যায়। যিনি বৌদ্ধ কর্মফলে বিশ্বাসী তিনি কোনো জঘন্যতম অপরাধীকেও ঘৃণা করে না। কারণ তিনি জানেন ঐ ব্যক্তি সুযোগ পেলে মহামহীয়ান হতে পারেন। আবার তার সুকর্মের দ্বারা তিনি ইহজীবনেই নিজের কর্মফল ভোগ করতে পারেন।
অনুশীলনমূলক কাজ কর্মের ফল বিবেচনায় কর্মের বিধানকে কয়ভাগে ভাগ করা যায়? |
পাঠ : : 8
কুশল ও অকুশল কর্ম
‘কুশল' শব্দের সমার্থক শব্দগুলো হলো যথাক্রমে - নিপুণ, শুভ, পুণ্যধর্ম, সৎ, ধার্মিক দোষশূন্য, নির্দোষ, প্রশংসনীয়, গুণসম্পন্ন, কল্যাণ, মঙ্গল ইত্যাদি। লোভ, দ্বেষ, এবং মোহহীন চেতনা দ্বারা সম্পাদিত কর্মকে কুশল কর্ম বলা হয়। এ ধরনের কাজে কোনোরকম পাপের স্পর্শ থাকে না। দান, শীল ভাবনা, সেবা, পুণ্যদান, ধর্ম শ্রবণ ইত্যাদি কুশলকর্ম। কুশলকর্ম সম্পাদন করতে হলে কুশল চিত্তের দরকার । এভাবে ভালো কাজ করলে ভালো ফল লাভ করা সম্ভব। বৌদ্ধধর্মে কুশলকর্মের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কুশলকর্মের ফল কুশল হয়। পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে ক্ষেমা হংসবতী নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন দাসী। একদিন তিনি ভিক্ষু সুজাতকে তিনটি সুমিষ্ট পিঠা দান করেছিলেন। এই কুশল কর্মের ফলে ক্ষেমা সুকৃতি অর্জনপূর্বক বিপর্শী বুদ্ধের সময় মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন। ককুসন্ধ বুদ্ধের সময়ে তিনি ধনবানের গৃহে জন্মগ্রহণ করে সুন্দর এক মনোরম উদ্যান বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেন। কোনাগমন বুদ্ধের সময়েও তিনি একই রকম দানানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। কশ্যপ বুদ্ধের সময়ে তিনি নৃপতি কিকির জ্যেষ্ঠা কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে সঙ্ঘকে বাসস্থান নির্মাণ করে দেন। অবশেষে গৌতম বুদ্ধের সময়ে তিনি রাজা বিম্বিসারের পত্নী হন।
এ প্রসঙ্গে কুশলকর্মের আরো একটি উদাহরণ নিচে প্রদান করা হলো :
বোধিসত্ত্ব একবার গরিব ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি পরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন কাজের সন্ধানে তিনি বের হয়ে রাজগৃহের ধনী শ্রেষ্ঠীর পরিবারে কাজ নেন। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে লাগলেন। একদিন সারাদিন ক্ষেতে পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখলেন সকলেই সেদিন পূর্ণিমার উপবাসব্রত পালন করছে। অর্থাৎ অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীল পালন করেছে। তিনি শ্রেষ্ঠীকে বললেন প্রভু! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি জানতাম না আজ উপোসথ দিন। তাই সকালে উপোসথ পালন করতে পারিনি। এখন আমি উপোসথ গ্রহণ করতে চাই। শ্রেষ্ঠীর কথা মতো তিনি সারারাত উপবাস থেকে শীলানুস্মৃতি ভাবনা করেন। দুর্ভাগ্যবশত সারাদিনের পরিশ্রম এবং সারারাত অনাহারে উপোসথ পালন করায় পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে কুশল চিন্তা-চেতনায় মগ্ন ছিলেন। সেই কুশল কর্ম ও চেতনার প্রভাবে মৃত্যুর পর রাজপুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এটা কুশলকর্মের ফল।
অকুশল' শব্দের অর্থগুলো হলো-পাপ, দোষ, ত্রুটি, অপুণ্য, অসৎকার্য, অপরাধ, অশুভ কার্য, অনিপুণ, অমঙ্গল কর্ম, অহিতকর, অন্যায়, অনুপযুক্ত, নীতিবিরূদ্ধ, অযথার্থ, নৃিকষ্ট ইত্যাদি। অকুশল কর্মের মধ্যে লোভ, দ্বেষ এবং মোহ বিরাজমান রয়েছে। অকুশলজনিত কাজের ফল সব সময় অকুশল হয়। অকুশল কর্মের ফলে সমাজে মানুষ অপমানিত হয়। মান-সম্মানের হানি হয়। সর্বোপরি সর্বত্র তার নিন্দা প্রচারিত হয়। অকুশল কর্মের ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। মৌদ্গল্যায়নকে শেষ বয়সে শারীরিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। মৌদ্গল্যায়ন ছিলেন অহৎ। তিনি পূর্বজন্মে পরম মমতাময়ী মাকে কষ্ট দিয়েছিলেন। সেই কষ্টের ফল হিসেবে তাঁকে অর্থৎ হওয়া সত্ত্বেও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, অকুশল কর্মের ফল জন্মান্তরেও ভোগ করতে হয়।
দেবদত্ত একবার বুদ্ধের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় তিনি পাহাড় থেকে পাথর ছুঁড়ে দিয়ে বুদ্ধকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এ সময় বুদ্ধের মতো মহাজ্ঞানীর শরীর থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। এই অকুশল কর্মের ফলে দেবদত্তকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।
মধ্যম নিকায়ের ‘মহাবচ্ছ' সূত্রে উল্লেখ রয়েছে- এক সময় বুদ্ধ বচ্ছগোত্র পরিব্রাজককে কুশল এবং অকুশল কর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন; ‘লোভ অকুশল আর অলোভ কুশল। দ্বেষ অকুশল, অদ্বেষ কুশল। মোহ অকুশল, অমোহ কুশল'। তিনি আরো বলেন; হিংসা অকুশল, হিংসা হতে বিরতি কুশল। চুরি অকুশল, চুরি হতে বিরতি কুশল। কামাচার অকুশল, কামাচার হতে বিরতি কুশল। মিথ্যাকথা বলা অকুশল, মিথ্যাকথা বলা হতে বিরতি কুশল। বিদ্বেষ পরায়ণ বাক্য অকুশল, বিদ্বেষ পরায়ণ বাক্য হতে বিরতি কুশল। কর্কশ বাক্য অকুশল, কর্কশবাক্য বলা হতে বিরতি কুশল। বৃথাবাক্য বলা অকুশল, বৃথাবাক্য বলা হতে বিরতি কুশল। অভিধ্যা (লোভ) অকুশল, অনভিধ্যা কুশল। করুণাহীন অকুশল, করুণা কুশল । ভ্রান্তধারণা অকুশল, সত্যধারণা কুশল' । এখানে বুদ্ধ এই দশবিধ ধর্মকে (আচার) অকুশল আর দশবিধ বিরত ধর্মকে কুশল হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মৃত্যুকালে সম্পাদিত কর্ম কুশল হোক আর অকুশল হোক বিশেষ ফলদায়ী। জীবনে কুশল কর্মের প্রাধান্য সত্ত্বেও মৃত্যুর সময় অকুশল চিন্তা উৎপন্ন হলে অবশ্যই নিম্নগতি প্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে সারাজীবনে অকুশল কর্মের পরিমাণ বেশি থাকলেও মৃত্যুক্ষণে কুশলচিত্তের উৎপত্তি হেতু উর্দ্ধগতি লাভ হয়। মৃত্যুক্ষণে কুশল উৎপন্ন হলেই তার গতি সৎ ও সুখের হয় । সুতরাং কুশল চিন্তা উৎপন্ন করা উচিত ।
অনুশীলনমূলক কাজ
কুশল এবং অকুশল কর্মের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধর? পাঠ : : & চূল্লকর্ম বিভঙ্গ সুত্ত বা ক্ষুদ্রকর্ম বিভঙ্গ সূত্র মধ্যম নিকায়ের (তৃতীয় খণ্ড) ১৩৫ নং সংখ্যক সূত্র। এতে কর্ম ও কর্মফল সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। নিচে তা তুলে ধরা হলো ।
চূল্পকর্ম বিভঙ্গ সূত্রের বাংলা অনুবাদ
আমি এ রকম শুনেছি যে, এক সময় ভগবান বুদ্ধ জেতবনে অনাথ পিণ্ডিকের আরামে বাস করেছিলেন। সে সময় তোদেয় ব্রাহ্মণের পুত্র শুভ মাণবক বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে বুদ্ধের সাথে আনন্দময় আলাপ-আলোচনা করেন। তারপর তোদেয় পুত্র শুভ মাণবক বুদ্ধকে বললেন, “হে গৌতম পুত্র! কী কারণে মানুষের মধ্যে কেউ হীন ও কেউ উৎকৃষ্ট, কেউ অল্পায়ু ও কেউ দীর্ঘজীবী, কেউ রোগী ও কেউ নিরোগী, কেউ বিশ্রী ও কেউ সুশ্রী, কেউ গরিব ও কেউ ধনী, কেউ অল্পশক্তিযুক্ত ও কেউ মহাশক্তিযুক্ত, কেউ নীচু কুলজাত, কেউ উচ্চ কুলজাত, কেউ জ্ঞানী ও অজ্ঞানী লোক জগতে দেখা যায়? হে গৌতম! মানুষের মধ্যে এরূপ হীন ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণ কী?
তখন বুদ্ধ উত্তরে বললেন, “হে মাণবক! এ জগতে জীবমাত্রই কর্মের অধীন। কর্মই জীবগণের একমাত্র
বন্ধু। কর্মই তাদের একমাত্র শরণ বা আশ্রয়। কর্মই জীবগণের একমাত্র রক্ষাকারী। কর্মই জীবগণকে
হীন ও শ্রেষ্ঠভাবে বিভক্ত কবে।
শুভ মাণবক বললো, ‘হে গৌতম ! আমি আপনার দেশিত বিষয়টি ভালো করে ঝুঝতে পারিনি । আপনি সর্বজ্ঞ। সুতরাং কর্ম সম্পর্কে বিস্তৃত দেশনা করুন যাতে আমি সহজেই বুঝতে পারি । তখন বুদ্ধ বললেন, “হে শুভ মাণবক! তাহলে শোনো। মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করো। শুভ মাণবক বললেন, 'হ্যাঁ ভগবান বলুন।’
তখন বুদ্ধ বললেন, ‘হে মাণবক! এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ প্রাণিহত্যাকারী এবং লোভী হয়। তারা সবসময় প্রাণীর রক্তে হাত রঞ্জিত করে। এভাবে হত্যা বা আহত করে জীবের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। এ রকম আচরণের ফলে তারা মৃত্যুর পর অপায়, দুর্গতি, অসুরলোক বা নরকে যায়। যদি মানবকুলে জন্ম নেয় তবে তারা কম আয়ু পায় ।
হে মাণবক ! প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হওয়া এবং হতাহত জীবের প্রতি নিষ্ঠুরতাই কম আয়ু পাওয়ার অন্যতম কারণ ।
হে মাণবক! কোনো কোনো নারী পুরুষ প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকে। তারা অস্ত্র ফেলে দেয়, প্রাণী হত্যায় লজ্জা অনুভত করে। সকল প্রাণীর প্রতি করুণা প্রদর্শনপূর্বক জীবনধারণ করে। এভাবে কুশল কাজ করে এবং কুশল জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে তারা জীবনধারণ করে। এ জন্য মৃত্যুর পর তারা স্বর্গে যায়। স্বর্গে না গিয়ে আবার মানুষ হয়ে জন্ম নিলেও দীর্ঘ জীবন পায়। প্রাণীদের প্রতি করুণা পরায়ণ ও উপকারী হয়ে জীবহত্যা থেকে বিরত থাকার জন্য তারা দীর্ঘজীবী হয় ।
‘হে মাণবক! পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ প্রাণীদের উপর অত্যাচার করে। তারা ঢিল, লাঠি বা অস্ত্রের দ্বারা জীবের উপর অত্যাচার চালায়। জীবের উপর এ রকম অত্যাচার করা উচিত নয়। এ ধরনের কষ্ট দেওয়ার জন্য তারা অপায়, দুর্গতি, অসুরলোক অথবা নরকে জন্ম নেয়। আর যদি মানবকুলে জন্মগ্রহণ করে তবে তারা সবসময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়' ।
‘হে মাণবক! ‘এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ রাগী হয়। সামান্য কথাতেই তারা রেগে উঠে। মন্দ কথা বলে। রাগ, হিংসা দীর্ঘদিন ধরে মনে পুষে রাখে এবং পরে তা আবার প্রকাশ করে। এরূপ কাজের জন্য তারা অপায়, দুর্গতি, অসুরলোকে অথবা নরকে জন্মগ্রহণ করে। আর যদি তারা মানবকুলে জন্ম নেয়ও তবে তাদের চেহারা খুবই বিশ্রী হয়। এটিই তাদের বিশ্রী হওয়ার কারণ
‘হে মাণবক! পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ রাগহীন হয়। তাদের শত কিছু বললেও তারা রাগ করে না, লাফালাফি ও উচ্চবাক্য করে না। এ জন্য তারা মৃত্যুর পর স্বর্গে যায়। স্বর্গে না গিয়ে আবার মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও দীর্ঘ জীবন পায়। প্রাণীর প্রতি করুণা পরায়ণ ও উপকারী হয়ে জীবহত্যা থেকে বিরত থাকার জন্য তারা দীর্ঘজীবী হয়। হে মাণবক ! এটি তাদের সুশ্রী হওয়ার অন্যতম কারণ ।
“হে মানবক! কোনো কোনো নারী বা পুরুষ ঈর্ষাপরায়ণ হয়। যশ-গৌরব, সম্মান, শ্রদ্ধা বা পুজা পাওয়া লোকদের তারা ঈর্ষা করে। আক্রোশ প্রকাশ করে। দোষী বলে সাব্যস্ত করে। এরূপ কাজের জন্য তারা অপায়, দুর্গতি, অসুরলোকে অথবা নরকে জন্মগ্রহণ করে। তারা মানবকুলে জন্ম নিলেও গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করে । হে মাণবক! এটাই গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণ ।
‘হে মাণবক ! কোনো কোনো নারী বা পুরুষ ঈর্ষাপরায়ণ হয় না। যশ-গৌরব, সম্মান, শ্রদ্ধা পূজা পাওয়ার লোকদের তারা ঈর্ষা করে না। ঈর্ষার কারণে কারো প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করে না। দোষী বলে সাব্যস্থ করে না। এজন্য তারা স্বর্গে যায়। মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলে মহাপরিবারে জন্ম নেয়। এটাই মহাপরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণ ।
‘হে মাণবক! এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ দাতা হয় না। শ্রমণ ব্রাহ্মণকে খাদ্য, পানীয়, কাপড় কোন কিছুই দান করে না। এরূপ কাজের জন্য তারা অপায়, দুর্গতি, অসুর লোক অথবা নরকে জন্ম নেয়। আর যদি মানবকুলে জন্ম নেয়ও তবে তারা খুব গরিব হয় । এটাই গরিব হওয়ার কারণ” ।
‘হে মাণবক! এ পৃথিবীতে কোনো নারী বা পুরুষ অহংকারী হয়। সে অভিবাদনের যোগ্য ব্যক্তিকে অভিবাদন করে না। দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোর যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান করে না। আসন দানের যোগ্য ব্যক্তিকে আসন দান করে না।পূজনীয় ব্যক্তিকে পূজা করে না। মান্য করার যোগ্য ব্যক্তিকে মান্য করে না। এরূপ কাজের জন্য তারা অপায়, দুর্গতি, অসুরলোক অথবা নরকে জন্ম নেয়। আর যদি মানবকুলে জন্মগ্রহণ করে তারা নীচুকুলে জন্ম নেয়। আর যদি মানবকুলে জন্ম নেয়ও তবে তারা নীচকুলে জন্মগ্রহণ করে। এটাই নীচুকুলে জন্ম নেওয়ার কারণ' ।
‘হে মাণবক, এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ অহংকারী হয় না। অভিবাদনের যোগ্য ব্যক্তিকে অভিবাদন করে। এছাড়া যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করেন, আসন দানের যোগ্য ব্যক্তিকে আসন দান করে, পূজা করার ব্যক্তিকে পূজা করে, মান্য করার যোগ্য ব্যক্তিকে মান্য করে। এজন্য তার স্বর্গে যায়। আর মানুষ হয়ে জন্ম নিলেও উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে। এটাই উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করার কারণ।'
‘হে মাণবক, এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী পুরুষ শ্রমণ বা ব্রাহ্মণের নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ভন্তে, কুশল কী ? অকুশল কী? কী দোষের নয়? কী সেবা করা উচিৎ? কী সেবা উচিৎ নয়। কোন কাজ করলে তা আমার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্টকর ও দুঃখকর হবে এবং কোন কাজ করলে তা আমার জন্য দীর্ঘকাল সুখ বয়ে আনবে? এরূপ কাজ করলে তারা অপায়, দুর্গতি, অসুরলোক অথবা নরকে জন্ম নেয়। আর যদি মানবকুলে জন্মও নেয় তবে তারা প্রজ্ঞাহীন নয়। এটাই প্রজ্ঞাহীন হয়ে জন্মগ্রহণের কারণ' ।
‘হে মাণবক! এ পৃথিবীতে কোনো কোনো নারী বা পুরুষ, শ্রমণ বা ব্রাহ্মণের নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কুশল কী? অকুশল কী? কী কী দোষের নয়? কিসের সেবা করা উচিৎ? কিসের সেবা করা উচিৎ নয়? কোন কাজ করলে তা দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট অনিষ্টকর দুঃখকর হবে? কোন কাজ করলে তা আমার জন্য দীর্ঘকাল সুখ বয়ে আনবে? এরূপ কাজের জন্য তারা স্বর্গে যায়। আর মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলে মহজ্ঞানী হয়ে জন্ম নেয়। এটাই মহাজ্ঞানী হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণ' ।
‘হে মাণবক! এরূপে অল্প আয়ু, দীর্ঘ আয়ু, জটিল ব্যাধিগ্রস্থ, নিরোগ, বিশ্রী, সুশ্রী, দুঃখী পরিবার, সুখী পরিবার, গরিব, ধনী, অল্পশক্তিসম্পন্ন, মহাশক্তিসম্পন্ন, উঁচুকুল, নিচুকুল, জ্ঞানহীন, মহাজ্ঞানী নানারকম মানুষ দেখা যায়' ।
‘হে মাণবক! কর্মই জীবগণের সঙ্গী। জীবগণ কর্মেরই অধীন। কর্মের মাধ্যমেই মানুষ বিভিন্নকুলে জন্মগ্রহণ করার কারণ হয়। অর্থাৎ তারা দুর্গতি, অপায়, অসুরলোক, নরক বা মানবকুলে জন্ম নেয়। কর্মই বন্ধু। কর্মই প্রতিকারণ। সুতরাং কর্মই মানুষকে হীনকুলে নিয়ে যায়। কর্মই আবার মানুষকে উঁচুকুলে নিয়ে যায়। উঁচুবংশে জন্মাতে সাহায্য করে। শ্রেষ্ঠ করে তোলে” ।
বুদ্ধ এভাবে কর্মবাদ ব্যাখ্যা করলে তোদেয় পুত্র শুভ মাণবক বুদ্ধকে বললেন ; অতি উত্তম, অতি সুন্দর, অতি মনোরম। আপনি আচ্ছাদিত বস্তুর স্বরূপ উদ্ঘাটিত করলেন। পথ হারা মানুষকে পথ প্রদর্শন করলেন। হে বুদ্ধ ! এখন আমি আপনার প্রবর্তিত ধর্ম এবং প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের শরণ গ্রহণ করলাম । আজ থেকে আপনি আমাকে আপনার শরণাগত উপাসক মনে করুন।
অনুশীলনমূলক কাজ চূল্লকর্ম বিভঙ্গ সূত্রের মূলকথা কী লেখ । |
পাঠ : ৬
কর্মবাদের গুরুত্ব
কর্মবাদ বৌদ্ধধর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । বুদ্ধের কর্মবাদ অনুসারে চিত্ত বা চেতনাই হলো কুশলকর্ম এবং অকুশল কর্মের উৎপত্তিস্থল। এই কর্মবাদ অনুসারে খারাপ চিন্তা করাও পাপ। কুশল চেতনার মাধ্যমে কুশলকর্ম সম্পাদিত হয়। কার্যকারণনীতির অমোঘ প্রক্রিয়ার দ্বারা গত জীবনের কর্মফলে বর্তমান জীবন, বর্তমান জীবনের কর্মফলে ভবিষ্যৎ জীবন গঠন করে। স্বর্গ হতে নিম্নতর নরক পর্যন্ত সমস্ত জীব কর্মসূত্রে গ্রথিত। সকলেই কর্মের একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। কোনো কর্ম একবার সম্পাদন করলে অনন্তকাল পর্যন্ত তা ফল প্রদান করতে থাকে। এভাবে কর্মের ফল অখণ্ডনীয়। সবাইকে তা ভোগ করতে হবে। তাই কুশল কাজের জন্য মন সংযত করা দরকার। ধর্মপদে এ বিষয়ে দেখা যায় ;
মনো পুংগমা ধম্মা মনোসেট্ঠা মনোমযা মনসা চ পসন্নেন ভাসতি বা করোতি বা,
ততো ন সুখমন্বেতি ছাযা'ব অনুপাযিনী
বাংলা অনুবাদ : মন সকল ধর্মের মধ্যে অগ্রগামী। সব ধর্ম মনের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রসন্ন মনে কেউ যদি কোনো রকম কাজ সম্পাদন করে তাহলে সুখ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। কর্মের দ্বার তিনটি । যথা : কায় দ্বার, বাক্য দ্বার, এবং মনো দ্বার। প্রতিনিয়ত এই তিনটি দ্বার দিয়ে কর্ম সম্পাদিত হয়। কোনো কোনো কর্মে তিনটি দ্বারই এক সঙ্গে থাকে। কোনো কাজে দুটো এবং কোনো কোনো কাজ কেবল একটি দ্বার দিয়েই সম্পাদিত হয়। তিন দ্বারের মাধ্যমে আমরা যে সব কাজ করছি, তার কোনোটি সৎ, কোনোটি অসৎ আবার কোনোটি নিরপেক্ষ। কোনো কর্ম সৎ নাকি অসৎ তার বিচার করা হয় কর্মফলের দ্বারা। যে কর্মের ফল কর্তার নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিক জীবজগতের পক্ষে কল্যাণময় ও সুখপ্রদায়ী তাকে বলা হয় সৎ কর্ম। যা কর্তার নিজের এবং পারিপার্শ্বিক জীবজগতের অকল্যাণকর বা দুঃখ আনয়ন করে তাই অসৎ কর্ম। যে কর্ম সম্পাদন হলেও ফলপ্রসূ হয় না তাই নিরপেক্ষ কর্ম ।
কর্ম দ্বারা সমাজে মানুষের অবস্থান সুদৃঢ় হয় কিংবা প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব, জন্ম দিয়ে নয়। সুন্দরভাবে প্রতিদিন কর্ম সম্পাদন করলে জীবন সুখময় হয়। তবে সম্পাদিত কর্মের মধ্যে কুশল চেতনা থাকা দরকার। এভাবে কাজ করলে ভালো ফলাফল অবশ্যম্ভাবী। সেজন্য বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মের মাধ্যমেই একজন মানুষ তার নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করতে পারে। কর্মই মানুষকে উচ্চ আসনে আসীন করে। কর্মের সুফল সবদিকেই প্রবাহিত হয়। কর্মই মানুষের চালিকাশক্তি। মানুষ নিজেই নিজের কর্মফল বহন করে । পশ্চাতে ফেলে আসে না। বৌদ্ধ কর্মবাদ অনুসারে, প্রাণী হত্যা না করা, চুরি না করা, ব্যভিচারে লিপ্ত না হওয়া, মিথ্যা কথা না বলা, মাদকদ্রব্য সেবন না করা, বৃথা বাক্য না বলা, কর্কশ বাক্য না বলা-এর বিধান রয়েছে। সুন্দরভাবে জীবিকা অবলম্বনের জন্য অন্যায় ও অসামাজিক সকল প্রকার কাজ করা উচিত নয়। কেননা, নিন্দিত বা খারাপ কাজ যারা করে তাদেরকে সমাজে সবাই অবজ্ঞা করে। ঘৃণার চোখে দেখে। সুতরাং বুদ্ধের কর্মবাদ মনে রেখে কল্যাণময় কর্ম করা উচিত । শুভ বা কুশলকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে যে ফল অর্জিত হয় তা কখনো পুণ্যের পথ ধ্বংস করতে পারে না। এমন কর্মসম্পাদন করতে হবে যার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধি পায় ।
অনুশীলনী
শূন্যস্থান পূরণ কর
১. মানুষ নিজ নিজ কর্ম অনুসারে ..........ভোগ করে।
২. ..........নানাত্ব হেতু সকল মানুষ সমান হয় না
৩. বৌদ্ধধর্মে.......... উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৪. কর্মই প্রাণীকে নানাভাবে........... করে ।
৫. বর্তমান জীবনের.......... ভবিষ্যৎ জীবন গঠন হয় ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. কর্মবাদ বলতে কী বোঝ?
২. কর্মের অধীন কারা?
৩ . কুশল কর্ম বলতে কী বোঝ?
৪. অকুশল কর্ম বলতে কী বোঝ ?
৫. কর্মের দ্বার কয়টি ও কি কি?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. বৌদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা কর ।
২. কুশল এবং অকুশল কর্ম সম্পর্কে তুমি যা জান লেখ।
৩. চূল্লকর্ম বিভঙ্গ সূত্রের সারমর্ম তুলে ধর।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। কোন্ বুদ্ধের সময়ে ক্ষেমা হংসবতী নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ?
ক. ককুসন্ধ
খ. কোণাগমন
খ. কশ্যপ
ঘ. পদুমুত্তর
২। কর্মবাদ বলতে কী বোঝায় ?
ক. ধারণার বিশ্বাসকে খ. কর্মফলের গভীর বিশ্বাসকে
গ. পূর্ব জন্মের বিশ্বাসকে
ঘ. ইহকর্মফলের বিশ্বাসকে
নিচের অনুচ্ছেদ পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও
দায়ক ও ভন্তের কথোপকথন :
দায়ক : বিহারের গিয়ে ত্রিরত্ন বন্দনা শেষে ভিক্ষু বন্দনাপূর্বক পাশে বসে প্রশ্ন করেন ধনী-গরিব, সুশ্রী-বিশ্ৰী হয় কেন ? মানুষ
ভন্তে : তিনি দেশনায় বুদ্ধের উদ্ধৃতাংশ দিয়ে বলেন – 'জীবমাত্রই কর্মের অধীন। কর্মই জীবনের একমাত্র বন্ধু। কর্মই তাদের একমাত্র আশ্রয়। কর্মই জীবগণের একমাত্র রক্ষাকারী । কর্মই জীবগণকে
৩। হীন ও শ্রেষ্ঠভাবে বিভক্ত করে।' দায়কের প্রশ্নকরণের বিষয়টি পাঠ্যবইয়ের কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ?
ক. সুভদ্রের
খ. ব্রাহ্মণের
গ. শুভমানবের
ঘ. উপালির
8। ভক্তের দেশনায় বুদ্ধের উদ্ধৃতাংশটিতে কীসের প্রকাশ পেয়েছে
ক. ধম্মপদের
খ. বস্তুবাদের
গ. কর্মবাদের
ঘ. ভাববাদের
সৃজনশীল প্রশ্ন
নতুনপাড়ার দুই প্রতিবেশী পাশাপাশি অবস্থান করেন। তাঁদের মধ্যে দীপান্বিতা চাকমার পরিবারের
সদস্যরা শান্ত ও ভদ্র । যশ-গৌরব, সম্মান, শ্রদ্ধা ও পূজা পাওয়া লোকদের তাঁরা ঈর্ষা করেন না বরং বিহারে ও বাড়িতে ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ করে খাদ্য, পানীয় ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র সামর্থ অনুসারে দান দিয়ে থাকেন । তাই অন্য পরিবারের সদস্যরা হিংসা ও আক্রোশমূলক কথাবার্তা বলে তাঁদের বিরক্তি ঘটান ।
ক. ‘সঙ্গীতি সূত্রে’ কর্মের ফল বিবেচনায় কর্মের বিধানকে কয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে ?
খ. দেবদত্তকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে কেন ? সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
গ. দীপান্বিতা চাকমার পরিবারের কর্মকাণ্ডগুলো কোন সূত্রের সাথে মিল পাওয়া যায় ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. উদ্দীপকে দুই পরিবারের আচরণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কী প্রভাব ফেলবে ? ধর্মীয় দৃষ্টিতে তা বিচার বিশ্লেষণ কর ।
ক. অকুশল শব্দের অর্থ কী ?
খ. উৎপীড়ক কর্ম কী ? ব্যাখ্যা কর।
গ. ছক-১ দ্বারা কোন কর্মের ইঙ্গিত বহন করছে- ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. ছক-১ ও ২ এ বর্ণিত কর্মফলের পার্থক্য কী হতে পারে ? ধর্মীয় আলোকে বিশ্লেষণ কর ।