ক্ষত্রিয়দের জীবিকা কোনটি?

Created: 10 months ago | Updated: 10 months ago
Updated: 10 months ago

একাদশ অধ্যায়

বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হয় ভারতবর্ষে। বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব কালে বেশিরভাগ মানুষই ভ্রান্ত ধারণা ও অন্ধ বিশ্বাসী ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতো যে কোনো ধরণের দুর্যোগ-দুর্ঘটনা অদৃশ্য দৈবশক্তির প্রভাবে সংঘটিত হতো। ফলে অদৃশ্য শক্তির প্রতি নিজেকে সমর্পন করেই মানুষ শান্তি ও নিরুপদ্রব থাকার চেষ্টা করতো এবং অদৃশ্য শক্তির সন্তুষ্টির জন্য আয়োজন করতো নানা রকম পূজা-অর্চনা ও আচার-অনুষ্ঠান। যাগ-যজ্ঞ ও পশুবলি ছিল এসব পূজাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকল সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য এগুলোই ছিল ধর্মাচার। বুদ্ধ সেই অদৃশ্য শক্তির আরাধনার চেয়ে নিজের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়ার উপদেশ প্রদান করেন। তিনি সেসব আচার-অনুষ্ঠান দুঃখ মুক্তির সঠিক পথ নয় বলে পরিত্যাগ করতে বলেন এবং দুঃখ হতে মুক্তির জন্য পথ নির্দেশ করেন। তাঁর এই অমিয়বাণীর আহ্বানে সাধারণ মানুষ থেকে রাজা মহারাজা সকলেই আকৃষ্ট হলেন। তাঁরা বুঝলেন দুঃখ যেমন আছে, দুঃখ নিরোধের উপায়ও আছে। এ সত্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ নব চেতনায় উদ্ভাসিত হলো। এভাবে বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের যাত্রা শুরু হয়। কালক্রমে তা ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে বহির্বিশ্বে বিস্তৃতি লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের এরূপ ক্রমবিকাশের ধারাই হলো বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। এ অধ্যায়ে আমরা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস পড়ব । এ অধ্যায় শেষে আমরা-

* প্রাক বুদ্ধ যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করতে পারব;

* বুদ্ধের সমকালীন ষোড়শ মহাজনপদের বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;

* বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রসারে মৌর্য, কুষাণ ও পাল রাজাদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব; * বাংলাদেশের প্রাক-আধুনিকযুগসহ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতে পারব।

পাঠ : ১

প্রাক বুদ্ধযুগের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা

প্রাচীন ভারতবর্ষে বুদ্ধের আবির্ভাব। ভারতবর্ষে নানা যুগে নানা মনীষীর জন্ম হয়েছে। সামাজিক রীতি নীতিও প্রবাহিত হয়েছে নানা আঙ্গিকে। প্রাক বুদ্ধ যুগে ভারতবর্ষে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব ছিল। তখন ভারতবর্ষ অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজারা জনগণের কাছ থেকে ফসল, গৃহপালিত পশু ইত্যাদি কর হিসেবে গ্রহণ করতো। সাধারণ মানুষ পল্লী অঞ্চলে বসবাস করতো। রাজা, রাজ কর্মচারী ও ধনীরা সুরক্ষিত নগরে বসবাস করতেন। তাঁরা শিকার, অস্ত্রচালনা, নাচ-গান প্রভৃতি করে আমোদ প্রমোদ করতেন। সমাজে নানা রকম পেশা প্রচলিত থাকলেও অধিকাংশ লোকই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। গৃহ নির্মাণে বাঁশ ও কাঠের পাশাপাশি ইট প্রস্তরও ব্যবহার হতো। উৎসবের সময় নাচ-গান এবং নানা রকম পিঠা তৈরি করা হতো। নারী পুরুষ লৌহনির্মিত অলংকার পরিধান করতো। সমাজে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। ধনীরা অর্থের বিনিময়ে দাস ক্রয় করতেন।

 

 

 

 

যুদ্ধ-বন্দী ও দণ্ডিত অপরাধীদের দাসে পরিণত করা হতো। আবার অনেকে জন্মসূত্রেও দাস হতো।

সমাজে বহুবিবাহ প্রথাও প্রচলিত ছিল। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতো।

সমাজে চার প্রকার বর্ণ প্রথা প্রচলিত ছিল । যথা:, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তখন ব্রাহ্মণেরা যাগযজ্ঞ করে ব্রহ্মা ও অন্য দেবতাদের উপাসনা করতেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিল পূজা-উপাসনায় স্বর্গসুখ লাভ হয়। ব্রহ্মাকে গণ্য করা হতো সৃষ্টিকর্তা রূপে। ব্রহ্মা নিজ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই ব্রহ্মাকে কেন্দ্র করেই ছিল মানুষের ধর্ম, কর্ম ও চিন্তা-চেতনা। ব্রাহ্মণেরা প্রচার করতেন যে, ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, হাত থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শূদ্রদের জন্ম হয়। সমাজে ব্রাহ্মণরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করতেন এবং তাঁদের আধিপত্য ছিল সবচেয়ে বেশি। রাজারা তাঁদের বিশেষ সমীহ করতেন। তাঁদের অবস্থান ছিল শীর্ষে। তাঁরা নিজেদেরকে দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করতেন। পূজা অর্চনা ও উপদেশ দেয়া ছিল ব্রাহ্মণদের প্রধান কাজ। ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যোদ্ধা। দেশের শাসনভার তাঁদের হাতে ন্যস্ত থাকতো। বৈশ্যরা ছিলেন বণিক। ব্যবসা বাণিজ্য ছিল তাঁদের প্রধান কাজ। শূদ্ররা ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা অপরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সমাজে তাদের অবস্থান ছিল সর্বনিম্নে ।

সে সময় যাগযজ্ঞ, পশুবলি, অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড, পূজা-অৰ্চনা প্রভৃতি ছিল ধর্মাচারের প্রধান অঙ্গ । তাছাড়া, বনাচরণ, নির্জনবাস, শারীরিক কৃচ্ছতা সাধন প্রভৃতি সাধন প্রণালিও বর্তমান ছিল। পশুরক্তে দেব-দেবীকে তুষ্ট করাই ছিল ধর্মাচারের অন্যতম প্রচলিত রীতি । কারণ তখন বিশ্বাস করা হতো যে, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধন, স্বাস্থ্য এবং মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ হয়। নানা রকম মন্ত্র, তন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক প্রভৃতিও প্রচলিত ছিল। মানুষ বিপদ ও রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসব ধর্মাচারের আশ্রয় গ্রহণ করতো। কিন্তু এসব ধর্মাচার সকল মানুষকে তৃপ্তি দিতে পারতো না। কারণ তারা উপলব্ধি করল যে, যাগযজ্ঞ, পশুবলি ইত্যাদি দ্বারা চিরস্থায়ী কল্যাণ আসে না। তারা অন্যপথে মুক্তির সন্ধান করতে থাকে। ফলে বিভিন্ন ধর্মমতের উদ্ভব হয় । পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরা এসব ধর্মমত প্রচার করতেন।

অনুশীলনমূলক কাজ

প্রাক বুদ্ধযুগের চার প্রকার বর্ণপ্রথা সম্পর্কে ধারণা দাও প্রাক বুদ্ধ যুগের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা কর

পাঠ : ২

গৌতম বুদ্ধের সময় ধর্মীয় অবস্থা

গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাব খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে। এ সময়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মসহ তেষট্টি প্রকার ধর্মীয় মতবাদ প্রচলিত ছিল। ত্রিপিটকের অন্তর্গত সূত্রপিটকের দীর্ঘ নিকায়ের ব্রহ্মজাল সূত্রে এ তথ্য বর্ণিত আছে। ভিক্ষুসঙ্ঘ ছাড়াও এ সময় ছয়টি বৃহৎ শ্রমণসঙ্ঘ ছিল। এই ছয়টি সঙ্ঘের প্রধান ছিলেন : পূরণ কশ্যপ, মক্‌খলী গোসাল, অজিত কেশকম্বলি, পকুদ কচ্চায়ন, নিগষ্ঠ নাথপুত্র এবং সঞ্জয় বেলট্ঠপুত্র। এঁরা ষড়তীর্থঙ্কর নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁদের অসংখ্য অনুসারী ছিলেন।

 

 

 

 

বুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর খুবই জনপ্রিয় ছিলেন । তাঁর সাথে বুদ্ধের কিছু বিষয়ে পার্থক্য ছিল। মহাবীরের প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিল রাজগৃহ। কিন্তু তাঁর সাথে বুদ্ধের কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। বুদ্ধের ন্যায় মহাবীরও অহিংসা বাণী প্রচার করেছেন।

এগুলো ছাড়াও বুদ্ধের সময় বনাচরণ, কৃচ্ছ্রতা সাধন, শারীরিক নিগ্রহ, যাগ-যজ্ঞ, নানা রকম মন্ত্র, তন্ত্র, ঝাড়, ফুঁক প্রভৃতিও প্রচলিত ছিল। বুদ্ধ তাঁর সমকালীন প্রচলিত ধর্মমতসমূহ দুঃখমুক্তির সঠিক পথ নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন । প্রাক বৌদ্ধযুগীয় মতবাদসমূহে যেখানে কর্ম ও কর্মফলকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং মানুষকে নিয়তি বা অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে বুদ্ধ কর্মবাদ উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, মানুষ কর্মের অধীন। যে যেরূপ কর্ম করবে সে সেরূপ কর্মফল ভোগ করবে।

বুদ্ধের সময় ভারতবর্ষ ষোলটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই রাজ্যগুলোর প্রত্যেকটিকে ‘মহাজনপদ’ বলা হতো। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এগুলো ‘ষোড়শ মহাজনপদ' নামে খ্যাত। এ মহাজনপদের অনেকগুলোতে বুদ্ধ পরিভ্রমণ করে ধর্ম প্রচার করেছেন। জনপদগুলোর অনেক স্থানে বুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত থাকায় সেগুলো তীর্থস্থানের মর্যাদা লাভ করেছে।

অনুশীলনমূলক কাজ

বুদ্ধের সমকালীন ছয়টি শ্রমণসঙ্ঘের প্রধান কে কে ছিলেন?

পাঠ-৩

বন্ধুযুগে ষোড়শ মহাজনপদের অবস্থা

গৌতম বুদ্ধের সময় ষোলটি রাজ্যের সবগুলোই খুব ইতিহাস প্রসিদ্ধ ছিল না। এতে অনেক রাজ্য অন্য রাজ্যের আগ্রাসনের কারণে নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছিল। তারপরও ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ষোড়শ মহাজনপদ বা ষোলটি রাজ্য হলো - -

১. অঙ্গ ২. মগধ ৩. কাসী ৪. কোশল ৫. বজ্জি ৬. মল্ল ৭. চেতী ৮. বংস ৯. কুরু ১০. পঞ্চাল ১১. মৎস্য

১২. সূরসেন ১৩. অশ্মক, ১৪. অবন্তী ১৫. গান্ধার এবং ১৬. কম্বোজ।

নিম্নে এই ষোলটি মহাজনপদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো :

১। অঙ্গ

অঙ্গ রাজ্যটি ছিল মগধের পূর্বদিকে। মগধ রাজ্য ও অঙ্গ রাজ্যে সীমানা বিভক্ত হয়েছিল চম্পা নদীর মাধ্যমে ৷ চম্পা নদী এ দুই রাজ্যকে পৃথক করে রেখেছিল। এ নদী ছিল মগধের অন্তর্গত। অঙ্গের রাজধানী ছিল চম্পা নগরী। মহারাজ দিসম্পতির মন্ত্রী মহাগোবিন্দ এ নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। চম্পা নদী ও গঙ্গা নদী সংগম স্থলস্থ উপকূলীয় অঞ্চলে চম্পা নগরী অবস্থিত ছিল। বুদ্ধের সময় ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা অঙ্গে রাজত্ব করতেন। রানি গগ্গরা অত্যন্ত বুদ্ধভক্ত ছিলেন। তিনি চম্পা নগরীতে একটি বিশাল দিঘি খনন করিয়েছিলেন। এই দিঘির পাড়ে বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন সূত্রপিটক পাঠে জানা যায় গৌতমবুদ্ধ এখানে আটবার এসেছিলেন। মগধের যুবরাজ বিম্বিসার রাজা

 

 

ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত করে অঙ্গ অধিকার করেন। সে সময় এ রাজ্য মগধের সাথে একত্রিত হয়ে অঙ্গ-মগধ নামে পরিচিতি লাভ করে ।

২ । মগধ

বর্তমান ভারতের পাটনা ও গয়া জেলার স্থলেই ছিল মগধ রাজ্য। এর উত্তরে গঙ্গা এবং পশ্চিমে শোন নদী, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতের শাখা এবং পূর্বে ছিল চম্পা নদী। গয়ার নিকটস্থ প্রাচীন রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী। রাজগৃহে গৌতম বুদ্ধ বহুবার ধর্মদেশনা করেছিলেন বলে জানা যায়। এখানে বুদ্ধ কয়েকবার বর্ষাবাসব্রত যাপন করেছিলেন। বুদ্ধের সময় মগধের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। তিনি বুদ্ধের গৃহী শিষ্য ছিলেন। রাজগৃহের বেলুবন উদ্যানটি তিনি বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের জন্য দান করেছিলেন। রাজা বিম্বিসার বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের কল্যাণে আরও অনেক মহৎ কাজ করেছিলেন। ত্রিপিটকের বিভিন্ন সূত্রে রাজা বিম্বিসারের নাম উল্লেখ রয়েছে। বুদ্ধের জীবিতকালেই যুবরাজ অজাতশত্রু অন্যের প্ররোচনায় পিতা বিম্বিসারকে বন্দী করে সিংহাসন দখল করেন । তিনি প্রথম জীবনে বুদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে বুদ্ধের শরণাপন্ন হন। তিনিও বুদ্ধের গৃহী শিষ্য হয়েছিলেন। অজাতশত্ৰু মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে স্থানান্তর করেছিলেন। সেসময় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান হিসেবে পাটলিপুত্রের সুখ্যাতি ছিল ।

৩। কাসী

প্রাচীন ভারতে কাসী এক উন্নত ও সম্পদশালী রাজ্য ছিল। শিক্ষা ও শিল্পকলার উন্নতিতে কাসী রাজ্যের খুব খ্যাতি ছিল। কাসীর রাজধানী ছিল বারানসি । এটি ছিল সে সময়ের এক প্রসিদ্ধ নগরী। বারানসি সারনাথের ঋষিপতনের মৃগধাবে বুদ্ধ পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের কাছে প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন। বারানসির বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধ দশবার ধর্মদেশনা করেছিলেন। বুদ্ধ প্রথম বর্ষাবাসব্রত এখানেই পালন করেছিলেন। এ রাজ্যের অনেক রাজাকেই ব্রহ্মদত্ত নামে অভিহিত করা হতো। বুদ্ধের সময়ে এ রাজ্য কোশলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাসী-কোশল নামে খ্যাত হয় ।

৪। কোশল

কোশল ছিল একটি নদী বেষ্টিত রাজ্য। এর পশ্চিমে সুমতি নদী, দক্ষিণে সপিকা বা স্যান্দিকা নদী, পূর্বে সদানীরা নদী ও উত্তরে ছিল নেপালের পার্বত্য অঞ্চল । কোশলের রাজধানী ছিল শ্রাবস্তী। পালি ভাষার উচ্চারণে এটি সাবথী । এখানে সবথ নামক এক ঋষি ছিলেন। অনেকের মতে তাঁর জন্মস্থান হিসেবে এটিকে সাবথী বলা হয়। আবার অনেকের মতে এ শহরে সবকিছু পাওয়া যায় বলে এটিকে শ্রাবস্তী বলা হয়। এটি অচিরাবতী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। অচিরাবতীর বর্তমান নাম রাপ্তী নদী । বুদ্ধের সময় রাজা প্রসেনজিত এখানে রাজত্ব করতেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রসারে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। বুদ্ধের অনুসারী এক প্রখ্যাত শ্রেষ্ঠী কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তীতে বাস করতেন। তাঁরা হলেন অনাথপিণ্ডিক ও বিশাখা। শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক জেতবন বিহার এবং মহাউপাসিকা বিশাখা পূর্বারাম বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধ ও তাঁর ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেছিলেন। শ্রাবস্তীতে বুদ্ধ ২৫ বর্ষাবাসব্রত পালন করেছিলেন। বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অনেক ধর্মোপদেশ দান করেছেন । প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ নগরী অযোধ্যা ও সাকেত কোশলের অন্তর্গত ছিল ।

 

 

 

৫। বজ্জি

গঙ্গার উত্তরে নেপালের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ রাজ্য। এর পশ্চিমে ছিল গণ্ডক নদী এবং পূর্ব দিকে ছিল কোসী ও মহানন্দা নদী। রাজধানী ছিল বৈশালী। বুদ্ধের সময় বৈশালী ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী নগরী। বজ্জিরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জাতি ছিল। তারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে সকল কাজ সমাধা করতেন। বুদ্ধ বজ্জিদের এ রূপ আচরণের প্রশংসা করেছেন।

বজ্জি রাজ্যের রাজধানী বৈশালীতে এক সময় মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও ভূত প্রেতের ভয়ে সকলে দিশাহারা হয়ে পড়ে। স্বয়ং রাজা এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিলেন না। তখন নিরূপায় হয়ে সকলে সর্বসত্তার হিতাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধকে স্বশিষ্য নিমন্ত্রণ করেন। বুদ্ধ বজ্জি রাজ্যবাসীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বজ্জিরাজ অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল চিত্তে উপযুক্ত মর্যাদায় বুদ্ধকে স্বরাজ্যে আনয়নের ব্যবস্থা করেন। বুদ্ধের আগমনে এ রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এতে জলপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। এতে পচা শবাদিসহ নোংরা গন্ধ আবর্জনাদি বিনাশ হয়। এ সময় তথাগত বুদ্ধ আনন্দ স্থবিরকে বৈশালীর চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করে 'রতন সূত্র' পাঠের আদেশ দেন। সূত্র পাঠের পর উক্ত ত্রিবিধ ভয় উপশম হয়। বুদ্ধের এ আগমণ উপলক্ষে বৈশালীর বিভিন্ন জায়গায় চৈত্য নির্মাণ করা হয়। পরে বুদ্ধ বজ্জিবাসীর উদ্দেশ্যে ‘সপ্ত অপরিহানীয়' নামে রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধিজনক ধর্মোপদেশ প্রদান করেন। বুদ্ধ তাঁর শেষ বর্ষাবাসব্রত বৈশালীতে পালন করেছিলেন ।

৬। মঙ্গ

মল্ল রাজ্য ছিল বজ্জি রাজ্যের পূর্বে ও কোশল রাজ্যের পশ্চিমে অবস্থিত। মল্ল রাজ্যের মধ্য দিয়ে বুদ্ধ বহুবার যাতায়াত করেছেন। মগধ ও কোশলে যাওয়ার রাস্তা মল্ল রাজ্যের ভিতর দিয়ে ছিল । মল্লদের রাজধানী ছিল কুশিনারা। এটিকে কুশনগরও বলা হয়। এর অবস্থান ছিল হিরণ্যবতী নদীর তীরে। এই নদীর বর্তমান নাম শোন নদী। কুশিনারার শালবনে গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর এখানে তাঁর যে দেহাবশেষ ছিল তা দ্রোন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে আটজন ভাগ করে নিয়ে সেগুলোর উপর চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সম্রাট অশোক এখানে বুদ্ধের বিশাল পরিনির্বাণ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

৭ । চেতি

চেতি বা চেদী রাজ্যের অবস্থান ছিল যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলে কুরু রাজ্যের পাশে। চেতির রাজধানী ছিল সোখিবতী বা স্বস্তিবতী। এটি বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত। বেসসন্তর জাতকে বর্ণিত ‘শিবি’ এই চেতি রাজ্য সংলগ্ন ছিল। বুদ্ধ চেতি রাজ্যে একবার ধর্মদেশনা করেছিলেন। কাসী রাজ্যের সঙ্গে চেতি রাজ্যের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। চেতি রাজ্যের সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের জীবনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না ।

 

 

 

 

 

৮। বংস

গঙ্গার দক্ষিণ তীরে বংস রাজ্য অবস্থিত ছিল। এলাহাবাদের কাছে কৌশাম্বী বা আধুনিক কোসম ছিল এর রাজধানী। বুদ্ধের সময় এখানে উদয়ন নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও বিলাসী ছিলেন । তিনি হাতি ধরার মন্ত্র জানতেন। তিনি পিণ্ডল ভারদ্বাজ নামের এক ভিক্ষুর মাধ্যমে বুদ্ধের গৃহী শিষ্য হয়েছিলেন। রাজা উদয়নের প্রধান রানি শ্যামাবতী ও তার প্রধান সেবিকা খুজ্জত্তরা দু'জনই বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন। কৌশাম্বীর এই উদ্যানে রানি শ্যামাবতী একটি বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে দান করেছিলেন। এ বিহারের নাম ঘোষিতারাম। এখানে রাজা উদয়ন বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাবশত বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই রক্তচন্দন কাঠ দ্বারা একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

৯। কুরু

কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। এটি বর্তমান দিল্লির নিকটবর্তী ইন্দ্রপ্রস্থ অঞ্চল। বুদ্ধের সময় পৌরব্য নামের এক রাজা রাজত্ব করতেন। বুদ্ধ কুরু জনপদ অনেকবার পরিভ্রমণ করেছিলেন। এখানে বুদ্ধ চার বার ধর্মদেশনা করেছিলেন বলে জানা যায়। কুরুর বিশিষ্ট ধনী যুবক রাষ্ট্রপাল বুদ্ধের কাছে ভিক্ষুত্বে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

১০। পঞ্চাল

রোহিলাখণ্ড এবং মধ্য দোয়ারের একাংশ নিয়ে পঞ্চাল গঠিত। গঙ্গা নদী এই রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। একটি ছিল উত্তর পঞ্চাল অন্যটি দক্ষিণ পঞ্চাল। উত্তর পঞ্চালের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র বা ছত্রবতী। এটি বর্তমানে রামনগর নামে পরিচিত। দক্ষিণ পঞ্চালের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য। বুদ্ধের সময়ে এ রাজ্যের খুব বেশি প্রভাব ছিল বলে অনুমিত হয়না। এ রাজ্যের জনসাধারণ ও নগর সম্পর্কে বৌদ্ধ সাহিত্যে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

১১। মৎস্য

চেতি রাজ্যের পার্শ্বস্থ চম্বলের পার্বত্য অঞ্চল ও সরস্বতী নদীর তীরবর্তী বনাঞ্চল নিয়ে মৎস্য রাজ্য বা জনপদ গঠিত। এর মধ্যস্থলে ছিল রাজধানীর মর্যাদা সম্পন্ন 'বিরাট নগর'। এটি হলো বর্তমান জয়পুরের বৈরাট। বুদ্ধ এই রাজ্য কয়েকবার ভ্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। বৈরাট নগরে সম্রাট অশোকের কয়েকটি বিখ্যাত শিলালিপি পাওয়া গেছে।

১২। সুরসেন

এটি যমুনার তীরবর্তী একটি রাজ্য। এর রাজধানী ছিল মথুরা। বুদ্ধের সময় এখানে রাজত্ব করতেন রাজা অবন্তীপুত্র। তিনি বুদ্ধশিষ্য মহাকচ্চায়নের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি বুদ্ধের অন্যতম উপাসক ছিলেন। এ রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় মথুরা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ সাধিত হয়েছিল।

 

 

 

 

১৩। অশ্মক

অশ্মক বা অস্সক রাজ্য ছিল গোদাবরী নদীর কূলবর্তী অঞ্চলে । রাজধানী ছিল পোটলি, পোটন বা পোদন ৷ এ রাজ্যের রাজা ছিলেন অস্সক। তার সম্পর্কে তেমন বেশি জানা যায় না। এখানে বাবরি নামে এক সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি সশিষ্য বুদ্ধের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ।

১৪। অবম্ভী

নর্মদা উপত্যকার মান্ধাতা থেকে মহেশ্বর ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা নিয়েই গঠিত হয়েছিল অবন্তী রাজ্য। রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। বুদ্ধের সময়ে এখানে রাজা ছিলেন চণ্ডপ্রদ্যোত। বুদ্ধ অবন্তী রাজ্যে এসেছিলেন কতবার সে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অবন্তী রাজার পুরোহিত পুত্র মহাকচ্চায়ন বুদ্ধের একজন খ্যাতনামা শিষ্য ছিলেন।

১৫। গান্ধার

প্রাচীন ভারতবর্ষে শিল্প সংস্কৃতির লালন কেন্দ্র হিসেবে গান্ধার রাজ্যের সুখ্যাতি ছিল। গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা। বুদ্ধের সময় এখানে পুক্কুস্সাতি নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি শেষ বয়সে রাজ্য ছেড়ে পায়ে হেঁটে রাজগৃহে গিয়ে বুদ্ধের ভিক্ষুসঙ্ঘে যোগদান করেছিলেন। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশীলা ছিল বিবিধ বিদ্যাশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রস্থল। প্রসিদ্ধ চিকিৎসক জীবক এখানেই চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতবর্ষের অত্যন্ত প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় । তক্ষশীলা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত।

১৬। কম্বোজ

বর্তমান কালের ভারত পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমে গান্ধারের নিকটবর্তী স্থানে কম্বোজ রাজ্য অবস্থিত ছিল। কম্বোজের রাজধানী হিসেবে দুটি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো দ্বারকা ও রাজপুর। কম্বোজ রাজ্যে রাজতন্ত্রের প্রচলন ছিল। এ রাজ্যে চন্দ্রবর্মন ও সুদক্ষিণ নামের দু'জন রাজার কথা জানা যায়। বুদ্ধের সময় এ রাজ্যে কোন্ রাজা রাজত্ব করতেন তা জানা যায় না। এ রাজ্যে কুক্কুটবতী নামের এক নগরী ছিল। সে নগরীর শাসনকর্তা ছিলেন মহাকপ্পিন। তাঁকেও রাজা নামে আখ্যায়িত করা হতো। রাজা মহাকপ্পিন বুদ্ধবাণীর গুণ মহিমা উপলব্ধি করে সপারিষদ মধ্যদেশের চন্দ্রভাগা নদীর তীরে বুদ্ধের কাছে গিয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

অনুশীলনমূলক কাজ

ষোড়শ মহাজনপদের প্রত্যেকটির রাজা ও রাজধানীর নামের একটি তালিকা তৈরি কর

 

 

 

 

 

 

 

পাঠ : ৪

বিভিন্ন রাজাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও অবদান

বুদ্ধের সমকালীন রাজাদের মধ্যে যাঁরা বৌদ্ধধর্মের কল্যাণে নানাবিধ অবদান রেখে খ্যাত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন রাজা বিম্বিসার। তিনি মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন। তাঁর সাথে সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বেও একবার সাক্ষাৎ হয়। তখন সিদ্ধার্থ গৌতম সন্ন্যাস ব্রত পালনের মাধ্যমে দুঃখমুক্তির পথ অন্বেষণ করে ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করছিলেন। রাজা বিম্বিসার সিদ্ধার্থ গৌতমের সুন্দর সুগঠিত দেহাবয়ব দেখে তাঁকে সেনাপতির পদ দিতে ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। উত্তরে সিদ্ধার্থ গৌতম বলেছিলেন, আমি কোশল রাজ্যের অন্তর্গত শাক্যগণের রাজ্য কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র। দুঃখমুক্তির পথ অন্বেষণের জন্য আমি সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছি। তখন রাজা বিম্বিসার বলেছিলেন বুদ্ধত্ব লাভ করলে তিনি তাঁর শরণাগত হবেন। সত্যিই বুদ্ধত্ব লাভের পর রাজা বিম্বিসার বুদ্ধের শরণাগত হন। তিনি বুদ্ধ ও বুদ্ধশিষ্যদের উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের জন্য রাজ্যে আদেশ জারি করেছিলেন। ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাভ-সৎকার বেড়ে যায়। এ কারণে অনেকে সুবিধা লাভের জন্য ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করেছিলেন । রাজা বিম্বিসার বিষয়টি বুদ্ধের কাছে জানালেন। এ পরিস্থিতিতে বুদ্ধ রাজভৃত্য, চোর- ডাকাত, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ও ঋণী ব্যক্তিদের প্রব্রজ্যা না দেওয়ার আদেশ দেন। রাজা বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে ভিক্ষুদের জন্য উপোসথ ও ধর্মালোচনা, গৃহীদের জন্য অষ্টশীল, পঞ্চশীল পালনের বিধান প্রবর্তন করেন।

মহাবর্গ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, পিলিন্দবৎস স্থবির এক সময় রাজগৃহে পাহাড় পরিষ্কার করছিলেন । রাজা বিম্বিসার বুদ্ধশিষ্য পিলিন্দবস স্থবিরকে এরূপ কাজ করতে দেখে জিজ্ঞেস করে জানলেন ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য স্থান প্রস্তুত করছেন । রাজা বিম্বিসার বললেন তথাগত বুদ্ধ সম্মতি দিলে তিনি এর ব্যবস্থা করবেন । বুদ্ধের সম্মতি যথাসময়ে পাওয়া গেল। কিন্তু রাজা এ প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে হঠাৎ বিষয়টি তাঁর স্মরণ হলো। তখন প্রধান অমাত্যকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভিক্ষুদের জন্য আমি বাসস্থান তৈরি করে দেব বলেছিলাম, সে কাজ কি সম্পন্ন করা হয়েছিল?' উত্তরে অমাত্য বলল- না । তখন রাজা জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিশ্রুতির পর কত রাত অতিবাহিত হলো? অমাত্য গণনা করে বললেন পাঁচশো' রাত্রি। তখন রাজা ভিক্ষুদের জন্য পাঁচশ'টি আরাম নির্মাণ করে দিতে আদেশ দিলেন। কালক্রমে রাজগৃহের এ স্থানটি ‘পিলিন্দবৎস গ্রাম' নামে খ্যাত হয় ।

বিম্বিসারের পর তাঁর পুত্র অজাতশত্রু মগধের রাজপদে অভিষিক্ত হন। তিনি দেবদত্তের প্ররোচনায় প্রথমে বুদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর অনুতপ্ত হয়ে তিনি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করেন। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পর প্রথম বৌদ্ধ-মহাসঙ্গীতি রাজা অজাতশত্রু পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সঙ্গীতিতে বুদ্ধবাণী সংকলন করা হয়েছিল। তাই বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে রাজা অজাতশত্রুর নাম অমর হয়ে আছে।

 

 

 

 

পরবর্তিতে তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশ' বছর পরে মগধের রাজা কালাশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় দ্বিতীয় বৌদ্ধ-মহাসঙ্গীতি ও প্রায় দুইশো' আঠার বছর পরে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হয় তৃতীয় বৌদ্ধ-মহাসঙ্গীতি। বুদ্ধের বাণী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়ণ করার ক্ষেত্রে এ মহাসঙ্গীতিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রসারে এই বৌদ্ধ-মহাসঙ্গীতিগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া মহাসঙ্গীতি আয়োজন করা কখনোই সম্ভব ছিল না। সঙ্গীতি আয়োজনের ক্ষেত্রে রাজাদের অবদান বৌদ্ধধর্মের অনুসারীগণ এখনো শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করে । এ ছাড়া অন্যান্য রাজাদের মধ্যে কোশলের রাজা প্রসেনজিত ও উজ্জয়িনির রাজা প্রদ্যোত বুদ্ধের উপাসক ছিলেন । তাঁরা রাজা বিম্বিসারের সমসাময়িক ছিলেন। তাঁরা সে সময় নানাভাবে বুদ্ধের ধর্ম দর্শন বিকাশে সশ্রদ্ধ চিত্তে সহায়তা দিয়েছিলেন ।

অনুশীলনমূলক কাজ

বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতাকারী রাজাদের একটি নামের তালিকা তৈরি করো

পাঠ : ৫

মৌর্য যুগ

চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসারের পরিচয়

চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন মৌর্য বংশের প্রথম রাজা। তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। মৌর্যরা ছিল সূর্যবংশীয়। সূর্যবংশীয় রাজকুমার মান্ধ্যাতৃ থেকে মৌর্যবংশের উদ্ভব। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মৌর্যরা এক গণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী ছিল। পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তারাও মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন মগধের রাজা ছিল নন্দবংশীয়। এ সময় চন্দ্রগুপ্ত তক্ষশীলার এক খ্যাতিমান ব্রাহ্মণের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার নাম কোটিল্য, যিনি চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত। তার সহায়তায় নন্দ বংশের রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসন লাভ করেন। রাজা চন্দ্রগুপ্ত যেমন সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন তেমনি সুদক্ষ শাসকও ছিলেন। তাঁর মন্ত্রী কোটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রের নীতিসমূহ তিনি বিশেষভাবে অনুসরণ করতেন।

গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ভারত উপমহাদেশ থেকে গ্রিক শাসন উচ্ছেদের প্রথম উদ্যোগ নেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তিনি গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গ্রিকদের পরাজিত করে বহু রাজ্য তিনি অধিকার করেন। এ সময় আলেকজান্ডারের অনুগামী সেলুকাসের সাথে তাঁর প্রথমে দ্বন্দ্ব ও মৈত্রী সম্পর্ক হয়। মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সেলুকাস মেঘাস্থিনিস নামক একজন দূত চন্দ্রগুপ্তের দরবারে পাঠিয়েছিলেন। সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে কান্দাহার, কাবুল, হিরাট ও বেলুচিস্থান হস্তান্তর করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেলুকাসকে পাঁচশ হাতি উপহার দিয়েছিলেন। এ ঐতিহাসিক বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তিতে মেগাস্থিনিস একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম হলো 'ইন্ডিকা'। এই মূল গ্রন্থটি এখন পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় শতাব্দীর খ্যাতিমান জীবনীকার প্লুটার্ক, জাস্টিন ও ঐতিহাসিক বিষয়ের গ্রন্থ প্রণেতা এ্যারিবিয়ান তাদের রচনায় ইন্ডিকা গ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন।

 

 

 

 

 

চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন জৈন ধর্মের অনুসারী । তিনি চব্বিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কথিত আছে, এক সময় রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রাজা চন্দ্রগুপ্ত নিজ পুত্রের হাতে সিংহাসনের ভার তুলে দিয়ে তিনি মহীশূরে চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্রের নাম বিন্দুসার। তিনি চন্দ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসন লাভ করেন। তিনি সুশাসক ছিলেন। কোটিল্য বিন্দুসারের রাজত্বকালেও কিছুদিন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিন্দুসার রাজ্য বিস্তারের নেশায় যুদ্ধাস্ত্র হাতে তুলে নেননি। তিনি পিতার ন্যায় গ্রিকদের সাথে সম্প্রীতির সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। বিন্দুসার শান্তিকামী ও শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি রাজ্য বিস্তারের নেশায় যুদ্ধাস্ত্র হাতে তুলে নেননি। বিন্দুসারের রাজত্বকালে তক্ষশীলায় একবার প্রজা বিদ্রোহ হয়েছিল। রাজা বিন্দুসার যুবরাজ অশোককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। অশোক শান্তিপূর্ণ ভাবেই সে বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। অশোক ছাড়াও রাজা বিন্দুসারের আরও অনেক পুত্র ও কন্যা ছিল। বিন্দুসার পঁচিশ বছর রাজত্ব করেন বলে জানা যায়। অতঃপর বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হলে পুত্র অশোক সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়।

রাজ্য বিস্তার ও শৌর্য বীর্যের পরাক্রমতায় বিন্দুসার পুত্র অশোক 'সম্রাট অশোক' নামে সমধিক খ্যাত হন। সম্রাট অশোক প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেননি। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বুদ্ধের শিক্ষা ও নীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগে। কলিঙ্গ যুদ্ধে এক লক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়। এই ঘোরতর যুদ্ধের পর অশোকের মনে পরিবর্তন আসে। তারপর ন্যাগ্রোধ শ্রামণের নিকট বুদ্ধবাণী শ্রবণ করে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম উপাসকে পরিণত হন। তাঁর নাম হয় ‘ধর্মাশোক'। এছাড়া অন্য একটি অভিধা ছিল ‘দেবানাম পিয় পিয়দসি' অর্থাৎ দেবগণের প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী। তিনি বুদ্ধের শিক্ষাসমূহ ভালোভাবে অনুসরণ করতেন ।

বৌদ্ধধর্ম প্রচার প্রসারে মৌর্যবংশের অবদান

মৌর্যবংশের কীর্তিমান নৃপতি অশোক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হয়ে জনসাধারণের কল্যাণে গভীর মনোনিবেশ করেন। জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি ধর্মমহামাত্য নামে এক শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত করেন। লোকশিক্ষা ও ধর্ম প্রচারের জন্য রাজ্যের সবখানে বুদ্ধের অনুশাসন লিখে দিলেন। সেগুলো খোদাই করা হয় পর্বতের গায়ে, পাহাড়ের শীর্ষে ও গুহা গাত্রে। এভাবে তিনি অনেক অনুশাসন তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের সবখানে ছড়িয়ে দেন। এগুলো অশোক শিলালিপি নামে পরিচিত।

এখন পর্যন্ত সম্রাট অশোকের ৩৪টি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব অনুশাসনের মর্মবাণী ছিল গুরুজনে ভক্তি, জীবে দয়া, ভিক্ষু শ্রামণ ও দরিদ্রদের দান প্রদান, আত্মীয় স্বজন, দাসদাসী ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি সৎ ব্যবহার, সত্যভাষণ করা ইত্যাদি। তিনি সকল ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন । তাঁর সাম্রাজ্যে সকল ধর্মের লোক সুখে বাস করতো। সকলকে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। তিনি বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র স্থানগুলো চিহ্নিত করেন ও সেসব স্থানে বিহার, চৈত ও স্তম্ভ নির্মাণ করেন ।

সেবা ও কল্যাণের ব্রত নিয়ে তিনি রাজ্যে ভ্রমণের ব্যবস্থা করতেন। এটিকে ধর্মযাত্রা বলা হতো। ধর্মযাত্রার সময় তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধের পবিত্র অস্থিধাতু সংগ্রহ করেন। তারপর চুরাশি হাজার স্তূপ

 

 

 

 

নির্মাণ করে সেগুলো সমগ্র ভারতবর্ষে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশের মানুষকে গৌতম বুদ্ধের অমিয় বাণীর প্রতি আকৃষ্ট করা। তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন। এই সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় সম্রাট অশোকের রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্রে। এই সঙ্গীতির মাধ্যমে বৌদ্ধসঙ্ঘ কলুষমুক্ত হয় এবং প্রকৃত বুদ্ধবাণী সংকলিত করে ধর্মদূতের মাধ্যমে তা দেশ-বিদেশে প্রচার করা হয়। অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা বুদ্ধবাণী সিংহলে প্রচার করেন। সিংহলের রাজা তিস্স সম্রাট অশোকের সম্মানে নিজেও ‘দেবনাম পিয়’ উপাধি গ্রহণ করেন।

অশোকের অনুশাসনে লেখা আছে যে, তিনি আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন। তাঁর বাণী গ্রিক ভাষায় অনুদিত করে প্রচার করা হয়েছিল। অশোকের সাম্রাজ্যের সীমা আফগানিস্তানের কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেখানেও সম্রাট অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। এ সময় ভারত ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্ম জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিব্বতে ধর্মদূত প্রেরণ করা হয় ।

মৌর্যরা প্রায় ১৩৭ বছর মগধে রাজত্ব করেন। তারপর মৌর্যবংশের শাসন সমাপ্ত হয়। এরপর শুঙ্গবংশ মগধের সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁরা বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন না। কিন্তু তখনও বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব বজায় ছিল। হিউয়েন সাং বাংলাদেশেও সম্রাট অশোকের নির্মিত স্তূপ দেখেছেন বলে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন।

অনুশীলনমূলক কাজ

বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে মৌর্যবংশের কোন্ রাজার অবদান তুমি সবচেয়ে বেশি মনে কর এবং কেন?

পাঠ : : ৬

কুষাণ আমল

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে কুষাণ বংশের রাজত্বের সূচনা হয়। কুষাণ বংশের প্রথম রাজা ছিলেন কুজুল কফিসেস। মগধ বা বর্তমান বিহার থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত, মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চল ও আফগানিস্তান নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত হয়। এই বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন কণিষ্ক। সম্রাট অশোকের মতো তিনি প্রথম জীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না। স্থবির পার্শ্বকের সংস্পর্শে এসে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগী হন। তারপর থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার-প্রসারের জন্য তিনি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে সম্রাট কণিষ্কের অবদান

সম্রাট কণিষ্কের সময়ে ভিক্ষুসঙ্ঘ বিভিন্ন নিকায়ে বিভক্ত ছিলেন। ভিক্ষুদের সংহতি রক্ষার জন্য সম্রাট কণিষ্ক চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ধর্মগুরু পার্শ্বকের পরামর্শে একটি সঙ্গীতি আহ্বান করেন। বিভিন্ন মতবাদের পণ্ডিত ভিক্ষুদের আহবান করে জালন্ধরে সমবেত করেন। উপস্থিত ভিক্ষুদের মধ্যে থেকে সঙ্গীতির জন্য পাঁচশত পণ্ডিত ভিক্ষু নির্বাচন করা হয় ।

 

 

 

 

সম্রাট কণিষ্ক তাঁদের জন্য একটি সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন। এই ভবনেই সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। পরে এ ভবনের নাম হয় কুণ্ডলবন বিহার। এই সঙ্গীতিতে পালি ভাষার বদলে বুদ্ধবাণী সংস্কৃত ভাষায় সংকলন করা হয়। তারপর সংকলিত ত্রিপিটকের ওপর টীকাগ্রন্থ রচিত হয়। এর নাম বিভাসাশাস্ত্র । এই সঙ্গীতিকে কণিষ্ক সঙ্গীতি বা সর্বাস্তিবাদী সঙ্গীতিও বলা হয়।

কনিষ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রসারে অনেক স্তূপ ও চৈত্য নির্মাণ করেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিনি চিন ও মধ্য এশিয়ায় ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেন। কণিষ্কের সময় মহাকবি অশ্বঘোষ ও বিখ্যাত দার্শনিক বসুমিত্র অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। কণিষ্ক নিজেও অত্যন্ত গুণী ও বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের নানা স্থানে শিলালিপিতে উপদেশ লিখে রেখে গেছেন। আফগানিস্তানে এ রকম একটি প্রকাণ্ড শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপিতে বিহার নির্মাণের উল্লেখ পাওয়া যায় ।

কণিষ্কের পর গুপ্ত সম্রাজ্যের সময় ফা-হিয়েন ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসেন। তিনি বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসারের কথা বলে গেছেন। বগুড়া জেলার মহাস্থানে বোধিসত্ত্বের একটি মূর্তি পাওয়া যায়। রাজশাহীর বিহারেও এই সময়ে একটি বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে কণিষ্কের সময় বাংলাদেশেও

বৌদ্ধধর্মের প্রচার লাভ করেছিল।

অনুশীলনমূলক কাজ

সম্রাট কণিষ্কের কোন অবদানটি তুমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে কর যুক্তিসহ লেখ

পাঠ : ৭

পাল যুগ

অষ্টম শতকে বাংলার শাসন ব্যবস্থায় অরাজকতা দেখা দেয়। দেশে তখন কোন রাজা ছিল না। পরিস্থিতি ছিল ক্ষমতাধরদের নিয়ন্ত্রণে। এরূপ বিশৃঙ্খল অবস্থাকে বলা হতো 'মাৎস্যন্যায়'। মাৎস্যন্যায় বলতে ন্যায়-নীতিহীন ব্যবস্থাকে বোঝায়। অর্থাৎ, বড় মাছ যেমন নির্বিচারে ছোট মাছদের খেয়ে ফেলে তেমনি অষ্টম শতকে বাংলায় বলবানরা দুর্বলদের শোষণ ও পীড়ন করতো। এরূপ পরিস্থিতিকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে। এরূপ অবস্থায় বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গোপালকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। তিনি পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজা হন ।

রাজা গোপালের পিতার নাম ছিল বপ্পট দেব। তিনি ছিলেন গৌড়ের দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র। গোপাল প্রায় কুড়ি বছর রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক রাজা। তাঁর মৃত্যুর পর রাজপদে অভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র ধর্মপাল। রাজা ধর্মপালের সময় বিক্রমশীল ও সোমপুর মহাবিহারসহ বহু বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছিল। রাজা ধর্মপালের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তাঁর পুত্র দেবপাল । এভাবে পাল বংশ প্রায় চারশত বছরব্যাপী বাংলায় রাজত্ব করেন। এ সময় প্রজন্ম পরম্পরায় পালবংশের আঠারো জন রাজা রাজত্ব করেন। পরবর্তী প্রজন্মের রাজাদের মধ্যে মহীপাল, রামপাল, ন্যায়পাল ও মদনপালের নাম বিশেষভাবে সুপরিচিত। পালবংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন গোবিন্দপাল ।

 

 

 

পাল বংশের সব রাজাই ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। কিন্তু অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতিও তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। এ সময় বাংলার সঙ্গে এশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বালী ইত্যাদি দ্বীপ রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেসব অঞ্চলে আগেই বৌদ্ধধর্মের প্রসার লাভ করেছিল। পাল যুগে সেই অঞ্চলের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় হয়েছিল ।

বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে পাল রাজাদের অবদান

পাল যুগের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত বিহারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল : ওদন্তপুরী বিহার, বিক্রমশীল বিহার, সোমপুরী বিহার, পণ্ডিত বিহার ও জগদ্দল বিহার। রাজা মহীপাল সারনাথ ও বুদ্ধগয়া অঞ্চলে অনেক বিহার সংস্কার করেন এবং নতুন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন।

এ সময় বাঙালী পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নানাবিধ বিষয়ে প্রায় দুইশ'টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি তিব্বত রাজার আমন্ত্রণে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিব্বতে গিয়েছিলেন। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন তিব্বতবাসীকে বুদ্ধের অমৃত বাণী ভাষণ করে ধর্মপথে পরিচালিত করেন। ধর্মপালের সময় নালন্দা মহাবিহার সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহাবিহারসমূহের গৌরব বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিহারসমূহে তিব্বত ও চিন থেকে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমণ শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। বিহারগুলো অসংখ্য খ্যাতিমান বৌদ্ধ পণ্ডিতের বিচরণক্ষেত্র ছিল। তিব্বতি ও ভারতীয় পণ্ডিতরা বিহারগুলোতে বসবাস করে বৌদ্ধগ্রন্থ অনুবাদ করে তিব্বত, কাশ্মীর, নেপাল ও চিন প্রভৃতি দেশে নিয়ে যেতেন ।

পাল যুগে বাংলা ভাষার উন্মেষ হয়। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ বা বৌদ্ধ গান ও দোহা এ সময় রচিত হয়েছিল। এগুলো রচনাকাল অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দী বলে অনুমান করা হয়। পাল যুগে বৌদ্ধ স্থাপত্য ও শিল্পকলার প্রভুত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এ সময় বাংলাদেশে শাক্ত ধৰ্ম, বৈষ্ণব ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও প্রসার ঘটে। পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পাল যুগে বাংলার বিভিন্ন ধর্ম ও সাস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্মিলিতভাবে বিকাশ লাভ করেছিল ।

অনুশীলনমূলক কাজ

পালযুগে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহারগুলোর তালিকা প্রস্তুত কর

পাঠ : ৮ বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম

প্রাক-আধুনিক যুগ

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম কখন এবং কীভাবে প্রচার প্রসার লাভ করেছিল সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে যে, বুদ্ধের সময়ই বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল। জনশ্রুতি হতে জানা যায় যে, বুদ্ধ, কর্ণসুবর্ণ ও সমতটে সাতদিন, পুণ্ড্রবর্ধনে তিনমাস অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। কর্ণসুবর্ণ, সমতট ও পুণ্ড্রবর্ধন ছিল বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন নাম। মহাবংস ও দীপবংস গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, সম্রাট অশোকের সময় সোণ ও উত্তর থের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য মিয়ানমারে

 

 

 

গিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তাঁরা বাংলার উপর দিয়ে মিয়ানমারে গিয়েছিলেন এবং যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। পুণ্ড্রবর্ধন সম্রাট অশোকের শাসনাধীন ছিল বলে ধারণা করা হয়। অশোকাবদান গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, এক নিগ্রন্থ বুদ্ধের ছবি এঁকে তা পদদলিত করে অবমাননা করে। সম্রাট অশোক এ খবর শুনে তাঁকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। সম্রাট অশোক তাঁর সমগ্র রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। এসব কারণে পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলেও তখন বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। বিখ্যাত বৌদ্ধ প্রত্নস্থল সাঁচীতে একটি অনুশাসন আবিষ্কৃত হয়। অনুশাসনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বলে ধারণা করা হয়। এ অনুশাসন হতে জানা যায় যে, ধর্মদত্তা ও ইসিনন্দন (ঋষিনন্দন) নামক পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলের দু'জন অধিবাসী সাঁচীস্তূপের তোরণ ও দেয়াল নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেছিলেন। নাগার্জুনকোণ্ড নামক বৌদ্ধ প্রত্নতীর্থ হতে একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়। শিলালিপিটি খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের বলে ধারণা করা হয়। এ শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে সেসময় বাংলা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ।

চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের দিকে প্রাচীন বাংলার তাম্রলিপ্তি অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তিনি সেখানে ২২টি বৌদ্ধবিহারে বহু ভিক্ষু বসবাস করতেন বলে ভ্রমণ বিবরণীতে উল্লেখ করেন। সেসময় আরো কয়েকজন চৈনিক ভ্রমণকারী বাংলায় এসেছিলেন। গুপ্তযুগের অনেক তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। তাম্রলিপিতে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা চৈনিক ভ্রমণকারীদের বর্ণনা সঙ্গে মিলে যায়। তাম্রলিপিতে এরূপ উল্লেখ আছে যে, পুণ্য অর্জনের জন্য মহারাজা রুদ্রদত্তের অনুরোধে মহাযানী আচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আশ্রমবিহারে দিনে তিনবার বুদ্ধকে ধূপ-বাতি ও নানাদ্রব্যে পূজা করার জন্য এবং ভিক্ষুদের ভরণ-পোষণের জন্য এগার পাটক জমি দান করছি।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলায় ভ্রমণে আসেন এবং বাংলায় বিভিন্ন বিহারে অবস্থান করে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা ও গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তাঁর ভ্রমণ বিবরণী হতে জানা যায় যে, সে সময় পুণ্ড্রবর্ধনে ২০টি সঙ্ঘারাম এবং তিন হাজার হীনযানী ও মহাযানী বৌদ্ধভিক্ষু; কর্ণসুবর্ণে ১০টি সঙ্ঘরাম এক হাজার হীনযানী ভিক্ষু; তাম্রলিপ্তিতে ১০টি সঙ্ঘারাম ও দুই হাজার ভিক্ষু; সমতটে ৩০টি সঙ্ঘরাম ও দু'হাজার ভিক্ষু বসবাস করতেন। এসব অঞ্চলে বহু বিখ্যাত বিহার ছিল। তিনি এসব অঞ্চলে সম্রাট অশোক প্রতিষ্ঠিত বহু স্তূপ ও স্তম্ভ দেখতে পেয়েছিলেন ।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক হতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত খড়গবংশ, দেববংশ, চন্দ্রবংশ এবং পালবংশ প্রভৃতি বৌদ্ধ রাজবংশ বাংলায় রাজত্ব করতেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম বাংলায় ব্যাপক প্রচার-প্রসার লাভ করেছিল। এ সময় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বাংলা খুবই জনপ্রিয় ছিল। খননকাজের ফলে বিভিন্ন বহু প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও দেব-দেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, পালযুগ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম খুবই জনপ্রিয় ধর্ম ছিল। উপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে হীনযানী, মহাযানী ও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধসাধকগণ রচনা করেছিলেন।

 

 

 

 

 

পাল যুগের পর থেকে আঠারোশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় বাংলার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস অস্পষ্ট। এ সময় বৌদ্ধরা রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নানা কারণে অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। জানা যায় সে সময় চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও পটুয়াখালীতে বৌদ্ধরা বসবাস করতো। এছাড়া রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর প্রভৃতি বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল ।

বৌদ্ধদের মধ্যে ছোট-বড় বহু নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। যেমন, বড়ুয়া, চাকমা, মারমা, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, চাক ইত্যাদি। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসব বৌদ্ধ নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করতো। বড়ুয়া ব্যতীত অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস মূলত চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলাসমূহে। এছাড়া চাক, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যার বসবাসও এ অঞ্চলে। ইতিহাস পাঠে ধারণা করা হয় ‘বড়ুয়া' অভিধাযুক্ত বৌদ্ধরা মগধ থেকে আসাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালী হয়ে চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করে। ১২০১ সালে বখতিয়ার খিলজী মগধ (বর্তমান বিহার রাজ্য) আক্রমণ করেন। সে সময় মগধ ও বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন লক্ষণ সেন। বখতিয়ার খিলজীর হাতে লক্ষণ সেন পরাজিত হন। এ সময় বৌদ্ধদের একটি দল পুব দিকে চলে আসে। অনুমান করা হয় তারাই কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের পূর্বপুরুষ। তাছাড়া সে সময় কুমিল্লা অঞ্চল ছিল পট্টিকের রাজাদের শাসনে। পট্টিকের রাজা রণবঙ্কেমল্ল ছিলেন বৌদ্ধ। তিনি ১২০৪ থেকে ১২২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি তখন সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। এই অঞ্চলের নাম ছিল সমতট। তখন ময়নামতিতে শালবন বিহার, পট্টিকের বিহার ইত্যাদির গৌরব ছিল অক্ষুণ্ণ।

বর্তমানে কুমিল্লার বৌদ্ধরা সিংহ উপাধিধারী । সিংহ অর্থ শ্রেষ্ঠ। শাক্যদের নামের সঙ্গে ‘সিংহ' শব্দটি ব্যবহার হতে দেখা যায়। বুদ্ধকে শাক্যসিংহ বলা হতো। কুমিল্লার বৌদ্ধরা মনে করেন তাঁরা শাক্যসিংহ বুদ্ধের বংশধর। এছাড়া বৌদ্ধদের মধ্যে চৌধুরী, তালুকদার ও মুৎসুদ্দী পদবিরও প্রচলন ছিল ।

আঠারো শতকে আরাকানি বৌদ্ধরা চট্টগ্রাম শাসন করত। এ সময় চাকমা রাজা শেরমুস্ত খান ছিলেন চট্টগ্রামের শাসক । তিনি আরাকান রাজার অধীনস্থ রাজা ছিলেন। চাকমারা নিজেদের আদি নিবাস চম্পক নগর মনে করেন । সেখান থেকে তারা চট্টগ্রামে আসেন বলে মনে করা হয়। বিতর্ক থাকলেও চাকমারা বিশ্বাস করেন এই চম্পক নগর ছিল ভারতের মগধ অঞ্চলে । আবার অনেকের মতে কুমিল্লার কাছাকাছি কোথাও এ নামে একটি নগর ছিল। কেউ কেউ অনুমান করেন মিয়ানমারের পূর্বে কোন অঞ্চলে এটি ছিল । শেরমুস্ত খান ১৭৩৭ সাল থেকে ১৭৫৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা পলাশীতে সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত চাকমা রাজার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ চলে । তখন চাকমা রাজ্যের সীমা উত্তরে লুসাই পাহাড়, দক্ষিণে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড, পূর্বে শঙ্খ নদী ও পশ্চিমে ফেনী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এ সময় চট্টগ্রামের চাকমা, চাক, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ও বড়ুয়া বৌদ্ধরা বসবাস করত। তাঁরা সবাই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । এছাড়া হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টানরাও চট্টগ্রামে বাস করত। তখন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি জেলা বা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি ছিল।

মারমারা রামু ও মাতামুহুরী অঞ্চলে বসবাস শুরু করে ১৭৭৪ সালের দিকে। এরপর তারা বান্দরবান

শহরে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৮৪ সালের দিকে আরাকান থেকে রাখাইন বৌদ্ধরা বরিশালের পটুয়াখালী

 

 

অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধদের প্রভাব ছিল বলে কিছু মারমা ও রাখাইনরা ঢাকায় চলে আসে। ঢাকার বড় মগবাজার ও মগবাজার তার সাক্ষ্য বহন করছে। ঢাকার ধামরাই অঞ্চলের নাম ধর্মরাজিক থেকে উদ্ভূত। সাভারের প্রাচীন নাম ছিল সাহোর। এখানে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। অতীশ দীপঙ্কর এই সাহোরে পড়াশুনা করেছিলেন বলে জানা যায় ।

আঠারো শতকে বড়ুয়ারা রাঙ্গুনীয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী, পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি অঞ্চলে বাস করত। কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চলে বড়ুয়া, মারমা ও রাখাইনদের প্রাধান্য ছিল।

চট্টগ্রামে চাকমা রাজ্যের রাজধানী প্রথমে সাতকানিয়া বা রামুর কাছাকাছি কোথাও ছিল। সাতকানিয়া শব্দ

এসেছে ‘সাত কন্যা’ বা চাকমা রাজকন্যার থেকে। রামু থানাতে এখনও চাকমাকূল নামে একটি স্থান আছে।

১৭৮৫ সালে চাকমা রাজ্যের রাজধানী রাঙ্গুনীয়া থানার রাজানগর গ্রামে স্থাপিত হয়। ১৮৬৯ সালে রাজানগর থেকে চাকমা রাজ্যের রাজধানী রাঙ্গামাটিতে চলে যায়। কারণ এ সময় চন্দ্রঘোনা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর অফিস রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, পটুয়াখালী ও উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের বৌদ্ধদের অবনতির কাল শুরু হয় বলে মনে করা হয়। এখনও উত্তরবঙ্গে অল্প সংখ্যক বৌদ্ধ আছে। কিন্তু তাঁদের সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য আর নেই ।

পাঠ-৯ আধুনিক যুগ

বর্তমানে অন্যান্য ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মও বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদায় অনুশীলিত হচ্ছে। এ দেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মতো স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। সকলের সাথে সৌভ্রাতৃত্ব বোধ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে ধর্ম অনুসরণ করা বৌদ্ধদের অন্যতম ঐতিহ্য। বৌদ্ধরা সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানসমূহ পালন করে চলেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে চাকমা, মারমা ও বড়ুয়া বৌদ্ধদের সম্মিলিত ইতিহাস জানা দরকার ৷ রাঙ্গামাটি, , বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি - এ তিনটি পার্বত্য জেলায় চাকমা, মারমা, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খিয়াং প্রভৃতি বৌদ্ধ নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। কিছু রাখাইন পটুয়াখালী, বরগুনা অঞ্চলে বসবাস করে। বড়ুয়া, চৌধুরী ও সিংহ উপাধিধারী বৌদ্ধরা যথাক্রমে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করে। এদের ইতিহাসই বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস ।

চাকমা রাজা জানবক্স খান ১৮০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সারা জীবন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটান। জানবক্স খানের মৃত্যুর পর ধরম বক্স খান রাজা হন। তাঁর মৃত্যুর পর রানি কালিন্দী রাজত্ব করেন। দীর্ঘদিন ইংরেজরা তাঁকে রানি স্বীকার করেন নি। ১৮৪৪ সালে ইংরেজরা তাঁকে সরকারিভাবে পার্বত্য সার্কেলের প্রধান হিসেবে 'রানি' বলে স্বীকার করেন। তিনি ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ১৮৬০ সালে পার্বত্য এলাকাকে নিয়ে ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করে ।

 

 

 

ব্রিটিশ শাসন আমলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো বৌদ্ধরাও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ সময় বিদ্যাশিক্ষার জন্য তারা কলকাতায় যেতেন। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য অনেকে মিয়ানমার, (তৎকালীন বার্মা) শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড গমন করেন। ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরির উদ্দেশ্যে এ সময় বৌদ্ধরা আরাকান, রেঙ্গুন, কলকাতা, ত্রিপুরা ও আসাম পাড়ি দিতেন। ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা শিক্ষা অর্জন ও জীবিকার জন্য ব্রিটিশ শাসনের অধীন আর্থিক ও শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চলে গমন করতেন। সরকারি ও বেসরকারি চাকরি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি পেশাজীবী ও ব্যবসা প্রভৃতি পেশায় আত্মনিয়োগ করে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন । ফলে তারা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশের জন্য নব উদ্যমে ধর্মচর্চা শুরু করেন। এ উদ্দেশ্য সফল করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধভিক্ষুগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ব্রিটিশ আমলে বৌদ্ধদের মধ্যে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার যে প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে তা আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাজ্ঞ বৌদ্ধভিক্ষুদের সঠিক দিক নির্দেশনা এবং তাঁদের নির্দেশিত কর্মকাণ্ডে গৃহী বৌদ্ধদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। একতাই শক্তি – এ উপলব্ধিতে বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, পরাধীন থেকে কখনো উন্নতি করা সম্ভব নয়। ফলে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এজন্য বৌদ্ধরা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও সহায়তা দানমূলক তৎপরতার কারণে পাকিস্তানী সৈন্যদের রোষানলে পড়ে। বিভিন্ন প্রকাশনা মাধ্যম হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বৌদ্ধ বিহারে অগ্নি সংযোগ, লুণ্ঠন, বুদ্ধমূর্তি ভাঙা ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা ইত্যাদি বহু ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে ।

এ সময় তদানীন্তন ঢাকার একমাত্র বৌদ্ধ বিহার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহার, চট্টগ্রামের রাউজান থানার অন্তর্গত হোয়ারাপাড়া গ্রামের সুদর্শন বিহার ও পটিয়া থানাধীন জোয়ারা সর্বজনীন বিহার হতে অমূল্য বুদ্ধাস্থি লুণ্ঠিত হয়। এছাড়া বহু বৌদ্ধ বিহারে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি এ সময় লুণ্ঠিত হয় এবং বিহারসমূহের বহু আবাসিক ভিক্ষুকে নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল- তদানীন্তন সঙ্ঘরাজ ভিক্ষু শ্রীমৎ অভয়তিষ্য মহাথের, মির্জাপুর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শান্তপদ মহাথের, রাউজানের ডোমখালী গ্রামের শাক্যবোধি মহাথের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। পটিয়া থানার পাঁচরিয়া গন্ধকুটি বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ জিনানন্দ ভিক্ষুকে নিজ বিহার হতে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কুমিল্লার বড়ইগাঁও বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের আসন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসন ধ্বংস করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্বস্থ ‘সীতাকুণ্ড বৌদ্ধ বিহার', রামুর ঐতিহ্যবাহী 'রামকোট বৌদ্ধ বিহার', কক্সবাজারের ঐতিহাসিক ‘অগ্‌গমেধা বৌদ্ধ বিহার' প্রভৃতি একাধিকবার পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দেশীয় দোসরদের দ্বারা আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়। ফলে বৌদ্ধসম্প্রদায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নতুনভাবে আবার দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণায় সকল সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ করে এ দেশকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। বৌদ্ধভিক্ষু ও গৃহী বৌদ্ধরা সম্মিলিত হয়ে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে এদেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশ সরকারও বৌদ্ধদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

 

 

 

 

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার বৌদ্ধদের কল্যাণে ‘বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট' গঠন করেছে। এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত ‘বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড' থেকে পালি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এর অধীনে দেশে প্রায় ১১৫ টির মতো পালি টোল ও কলেজ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে বি.এ অর্নাস, এম. এ, এম. ফিল ও পিএইচ. ডি পর্যায়ে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে।

বৌদ্ধদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি সবচেয়ে প্রাচীন । ১৮৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে । এছাড়া আরও কিছু বৌদ্ধ সংগঠন আছে। সেগুলোর মধ্যে পার্বত্য বৌদ্ধ সঙ্ঘ, বাংলাদেশ সঙ্ঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষুমহাসভা, রাখাইন মারমা সঙ্ঘ কাউন্সিল, বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন, বাংলাদেশ মারমা বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন, উত্তরবঙ্গ বৌদ্ধ পরিষদ উল্লেখযোগ্য ।

খননকার্যের ফলে বাংলাদেশে কুমিল্লা, বগুড়া, দিনাজপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, সাভার, নরসিংদি, চট্টগ্রাম, প্রভৃতি অঞ্চলে বহু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের বৌদ্ধদের অতীত ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। এগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুতত্ত্ব অপরিসীম। তন্মধ্যে সোমপুর মহাবিহারকে ইউনেস্কো 'বিশ্ব-ঐতিহ্য' হিসবে ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা প্রাচীন বিহারের ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসেন। ফলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি ও মান-মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পায় । বাংলাদেশ সরকার এসব প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বিহার আছে। তন্মধ্যে অনেক বিহার নানা কারণে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ার ঠেগরপুনি বুড়া গোঁসাই বিহার, পাহাড়তলী মহামুনি বিহার, উনাইনপুরা লংকারাম বিহার, বাগোয়ানের ফরাচিন বিহার, চট্টগ্রাম মহানগরীতে নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহার, নবপণ্ডিত বিহার, রাউজান সুদর্শন বিহার, কাপ্তাই চিরম বিহার, রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার, কক্সবাজার অগ্‌গমেধা বৌদ্ধ বিহার, বান্দরবান রাজবিহার, বান্দরবানের উজানী পাড়া বৌদ্ধ বিহার, বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দির, রামুর রামকোট বিহার, মানিকছড়ি রাজবন বিহার, ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার উল্লেখযোগ্য ।

বৌদ্ধ ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে মেলা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে অনেক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাগুলোকে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনন্য উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এসব মেলায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নাটক, গান ও বুদ্ধ কীর্তনের আয়োজন হয়। এগুলোর মধ্যে চক্রশালা মেলা, রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার মেলা, মানিকপুর পরিনির্বাণ মেলা, মছদিয়া চৈত্য মেলা, ঠেগরপুনি বুড়াগোঁসাই মেলা, বিনাজুরি পরিনির্বাণ মেলা, ইছামতি ধাতুচৈত্য মেলা, লাঠিছড়ি বুদ্ধ মেলা, শীল ঘাটা মহাপরিনির্বাণ মেলা, আবুরখীল কেন্দ্রীয় যোগেন্দ্র বৌদ্ধ বিহার মেলা, পাঁচরিয়া গন্ধকুটি বিহারে শীলাবুদ্ধ ও বাইশ বুদ্ধের মেলা, ঢেমশা শাক্যমুনি মেলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

রাজধানী ঢাকায় বৌদ্ধদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা শুরু হয় ১৯৫০ সালে। এসময় ঢাকায় চাকরির সুবাদে বসবাসরত বৌদ্ধরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতো। পরবর্তিতে ১৯৬০ সালে ঢাকায় প্রসিদ্ধ ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বৌদ্ধদের ঢাকায় ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার আবহ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ঢাকায় অনেক বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলো বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশে

 

 

 

গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, বাংলাদেশ বৌদ্ধ মহাবিহার, ধর্মজ্যোতি বৌদ্ধ বিহার, সাভার রাজবন বিহার। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী বৌদ্ধ সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সংখ্যায় কম হলেও অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বৌদ্ধ সম্প্রদায় বাংলাদেশে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

অনুশীলনমূলক কাজ

কোন্ কোন্ বৌদ্ধ বিহারে মেলা অনুষ্ঠিত হয় লেখ

অনুশীলনী

শূন্যস্থান পূরণ কর

১. ভারতবর্ষে অনেকগুলো বিভক্ত ছিল ।

২. গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব খ্রিষ্টপূর্ব--- অব্দে।

৩. শিক্ষা ও শিল্পকলার উন্নতিতে------- খুব খ্যাতি ছিল ।

৪. পাল যুগে ভাষার উন্মেষ হয় ।

৫. পাল বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :

১. প্রাক বুদ্ধ যুগে রাজারা জনগণের কাছ থেকে কর হিসেবে কী নিতেন?

২. গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে কী কী বিদ্যা শিক্ষার প্রচলন ছিল?

৩. ধর্মযাত্রা কী?

৪. চর্যাপদ কী?

বর্ণনামূলক প্রশ্ন

১. প্রাক বুদ্ধ যুগের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ কর।

২. ষোড়শ মহাজনপদের পরিচয় দাও।

৩. বাংলাদেশের কয়েকটি বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের পরিচয় তুলে ধর।

৪. বাংলাদেশের বৌদ্ধরা কী কী পদবি ব্যবহার করেন লেখ।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

১। কাসীর রাজধানী কোনুটি ?

ক. চম্পা নগরী

গ. বারানসি

খ. বৈশালী

ঘ. শ্রাবস্তী

 

 

 

 

২। গান্ধার জনপদ বিখ্যাত হওয়ার কারণ – 

i. বিদ্যা শিক্ষার কেন্দ্রস্থল ছিল বলে

ii. শিল্প সংস্কৃতির লালন কেন্দ্র ছিল বলে 

iii. সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল বলে।

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক iii

খ. ii ও iii

গ. i ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের ছকটি দেখে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও

৩। ‘?' চিহ্নিত স্থানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারে কোন্ বংশের অবদান বোঝানো হয়েছে ?

ক. পাল

গ. আধুনিক

খ. মৌর্য

ঘ. কুষাণ

8। উক্ত বংশীয় এক শাসক বৌদ্ধ সঙ্গীতি আয়োজনের ব্যবস্থা করেন তা হলো-

ক. ১ম সঙ্গীতি 

খ. ২য় সঙ্গীতি

গ. ৪র্থ সঙ্গীতি

 

 

 

 

 

ক. কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি কে ছিলেন ?

খ. ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে যে কোন একটি ব্যাখ্যা কর । 

গ. ছকে বর্ণিত কোন বংশীয় রাজা 'মাৎস্যন্যায় নীতি' বিলোপের ভূমিকা রেখেছিলেন ? পাঠ্যবইয়ের আলোকে ব্যাখ্যা কর । 

ঘ. ‘উক্ত বংশীয় রাজাদের অবদান বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে’-তাতে তুমি কী একমত ? যুক্তি প্রদর্শন কর।

২। রাঙ্গুনিয়ার পৌর মেয়র সুদর্শন চৌধুরী সত্যবাদিতা ও দানশীলতায় অতুলনীয় ছিলেন। সকল ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি মুক্ত হাতে দান দিতে পছন্দ করতেন। তাঁর এলাকায় গরিব দুঃখীরা কোন অবস্থায় আছেন, তাদের খোঁজ খবর নিতেন এবং সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হতেন।

ক. মৌর্য বংশের প্রথম রাজা কে ছিলেন ?

খ. অজাতশত্রু পিতাকে হত্যা করে অনুতপ্ত হলেন কেন ?

গ. মেয়র সুদর্শন চৌধুরীর সাথে বুদ্ধের সমসাময়িক কোন রাজার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে-

ব্যাখ্যা কর। 

ঘ. ‘মেয়র সুদর্শন চৌধুরীর কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের কল্যাণকর বাণীর প্রতি এলাকাবাসীদের আকৃষ্ট করা’- উক্তিটির যথার্থতা পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ব্যাখ্যা কর ।

Content added By
Promotion