কে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল।
দ্বাদশ অধ্যায়
হৃদয়ের তীব্র যন্ত্রণা
একটি প্রচলিত প্রবাদে বলা হয়েছে: “জীবন ফুলসজ্জা নয় ।” কথাটা চিরন্তন সত্য । এই পৃথিবীতে কোনো মানুষেরই জীবন কোনোরূপ দুঃখ-কষ্টবিহীন আরামের নরম ফুলসজ্জা নয় । এই পৃথিবীতে যেমন রয়েছে দিন-রাত্রি ও আলো-আঁধারের খেলা, ঠিক তেমনিভাবে মানুষের জীবনেও রয়েছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার রহস্যময় খেলা । দুঃখ যন্ত্রণার কষ্ট-জ্বালা থেকে কেউ রেহাই পায়নি কখনো, রেহাই পায়নি পৃথিবীর প্রথম নরনারী আদম হবা, এমন কি, বড় বড় প্রবক্তা, ধর্ম প্রবর্তক এবং সাধু-সাধ্বীগণও। তাঁরা বরং জীবনের দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণাকে বরণ ও সহ্য করেছেন মহত্তর কর্ম সাধনের উদ্দেশ্যে । কেননা তাঁরা বলেছিলেন যে, কষ্ট- যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই জীবনের প্রতিষ্ঠা, গৌরব ও সাফল্যের জন্ম । তাই আরেকটি প্রবাদে বলা হয়েছে: “কষ্ট ছাড়া গৌরব নেই” ।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
কষ্টের বিভিন্ন ধরন
মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের কষ্ট লক্ষ করা যায় । সেগুলোকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
ক. দৈহিক কষ্ট: রোগ-যন্ত্রণা, দীর্ঘকালীন অসুস্থতা, ক্লান্তি, স্বাস্থ্যহীনতা, প্রসব-বেদনা, কঠোর পরিশ্রম, মৃত্যুযন্ত্রণা ইত্যাদি ।
খ. মানসিক কষ্ট: দৈহিক কষ্টের মতো মনের কষ্টও কম নয়। দুশ্চিন্তা, হতাশা, নিরাশা, ব্যর্থতা, একাকীত্ববোধ, পরিত্যাক্তবোধ, ভুল বোঝাবুঝি, নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক সমালোচনা ইত্যাদি ভীষণ মনোকষ্টের জন্ম দেয় ।
গ. হৃদয়ের কষ্ট: আনন্দহীনতা, অশান্তি, ভালোবাসার অভাব, গ্রহণীয়তার অভাব, বন্ধুত্বের অভাব, হৃদয়ের দুঃখ-কষ্টের কথা কাউকে বলতে না পারা ইত্যাদি হৃদয়ের মধ্যে গভীর কষ্ট ও বেদনা সৃষ্টি করে । অনেক সময় গরিব মানুষ কষ্ট পায় তার দরিদ্রতা বা নানা অভাব অনটনের কারণে, অন্যদিকে ধনী মানুষ অনেক সময় কষ্ট পায় সম্পদের জন্যে দুশ্চিন্তা এবং প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকার কারণে ।
ঘ. জাগতিক কষ্ট: জগতের নেতিবাচক ঘটনাপ্রবাহ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মানুষের মনে কষ্ট জাগায় এবং হৃদয়কে ব্যথিত করে । যেমন: দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মহামারি, যুদ্ধ, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ, আর্থিক মন্দাভাব ইত্যাদি মানুষের মনে কষ্ট জাগায় এবং অশান্তি সৃষ্টি করে ।
একজন যুবতীর আত্মকথা
আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান । প্রাচুর্যের মধ্যেই আমি বড় হয়েছি। জীবনে যা কিছু প্রয়োজন মনে করেছি, তার সবই পেয়েছি, কোনোকিছুর অভাব কখনো বোধ করিনি, যদিও আমি একটি ভালো খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মেছি ও বড় হয়েছি, তবু কেন জানি ধর্ম-কর্ম আমার ভালো লাগত না। গির্জা প্রার্থনা আমার ভালো লাগত না । ঈশ্বরকে আমি ভালোবাসতাম না, চেষ্টা করতাম তাঁকে ভুলে যেতে এবং তাঁকে বিশ্বাস না করতে । কিন্তু আমি তা পারিনি । যতই তাঁকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছি, ততই মনে হয়েছে তিনি আমার অন্তরে এসে হানা দিয়েছেন । অন্তরের মধ্যে আমি কী যে ভীষণ জ্বালার মধ্যে রয়েছি । উহ্: কী কষ্ট! এর কি কোনো চিকিৎসা আছে, যার দ্বারা আমি অন্তরের এই জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে পারি?
কাজ: ১. এই যুবতী মহিলা কোন্ ধরনের কষ্টে ভুগছে: দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক না-কি জাগতিক?
কাজ: ২. তুমি কি কোনো কষ্টভোগী মানুষের কাহিনী উল্লেখ করতে পার ?
কাজ: ৩. যখন তুমি মানুষের দুঃখ কষ্ট স্বচক্ষে দেখ, তখন তোমার ভিতরে কী ধরনের অনুভুতি জাগে? দলে এই প্রশ্নগুলো আলোচনা কর।
কষ্ট-যন্ত্রণা কি অপরিহার্য?
শত সহস্র বছর ধরে বিশ্বের বৈজ্ঞানিকগণ চেষ্টা করে আসছেন কী করে মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণা দূর বা লাঘব করা যায় । কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা তা করতে পারেননি । এই যে বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে, চাঁদ ছেড়ে এখন মানুষ মঙ্গলগ্রহে এবং অন্যান্য গ্রহে পাড়ি জমাতে চেষ্টা করছে । এই উন্নত বিশ্বে মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণা কোনো দিকে কমেনি । একটু গভীর দৃষ্টি নিয়ে বিশ্বের দিকে তাকালেই মানুষের বিভিন্ন রকমের কষ্ট-দুঃখ-যন্ত্রণা আমাদের নজরে পড়ে ।
কেউ কেউ এমন প্রশ্নও করতে পারে: এতসব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কী করে আমরা ঈশ্বরকে প্রেমময় ও করুণাময় পিতা বলে ডাকতে পারি? বিশেষভাবে যখন দেখি, নিরপরাধ ও ভালো মানুষ কষ্টে ভুগছে; নিষ্পাপ শিশুরা অভাবে ও ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদছে এবং নিরীহ মানুষ যুদ্ধে মারা যাচ্ছে । এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া এত সহজ নয় । পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মে প্রবক্তা যোবের কাহিনী পড়লে একই ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে । তিনিও তাঁর জীবনের নানা কষ্ট-যন্ত্রণার কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পাননি । তাঁর বন্ধুদের এবং অনেকের প্রশ্ন ছিল: “ধার্মিক-নিরপরাধ মানুষ জীবনে কষ্ট ভোগ করে কেন?” মানুষের জীবনে কষ্টের আগমন একটি রহস্য । অর্থাৎ ভালো, নির্দোষ ও ধার্মিক মানুষ কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে কেন--এই রহস্যাবৃত প্রশ্নের সঠিক উত্তর একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। শুধু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কর্মফলে ধার্মিক-অধার্মিক, ঈশ্বরে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী--সকলের জন্য দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা অনিবার্য, কেউ তা এড়াতে পারে না ।
কষ্টের কারণসমূহ
ধার্মিক মানুষের জীবনে কষ্ট আসে কেন, যদিও এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া করো পক্ষেই সম্ভব নয়, তবুও কিছু কষ্টের ক্ষেত্রে আমরা কিছু উত্তর খুঁজে পেতে পারি ।
১. প্রকৃতির নিয়ম ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ: প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেই মানুষের জন্যে কিছু কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে । যেমন: ভূমিকম্প, সাইক্লোন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষকে কষ্ট পেতে হয় । তাছাড়া প্রকৃতির নিয়মের কারণেই মানুষকে বৃদ্ধ হতে হয় এবং মৃত্যুবরণ করতে
হয় যা মানুষকে কষ্ট দেয় ও কাঁদায় । বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারের ফলে মানুষ অনেক কষ্ট
জয় করতে পারলেও কিছু কষ্টদায়ক মন্দতাকে এখনো জয় করতে পারেনি ।
২. মনুষ্য-সৃষ্ট কষ্ট: অনেক কষ্ট রয়েছে যা মানুষ নিজেই সৃষ্টি করে তাদের অবহেলা, অজ্ঞানতা, স্বার্থপরতা, অতিরিক্ত চাহিদা, নানারকম পাপ ও বিভিন্ন রকম দুষ্টতা দ্বারা । যেমন: গাড়ি-ঘোড়ার দুর্ঘটনা--যা খামখেয়ালি ও অসাবধানতার জন্যে ঘটে; নরহত্যা, ব্যভিচার, যুদ্ধ, রোগব্যাধি ও অকাল মৃত্যু যা অনেক অপরিচ্ছন্ন ভেজাল ও ময়লাযুক্ত খাবারের জন্যে ঘটে, দারিদ্র্য, অভাব ইত্যাদি ।
কাজ: তোমার পরিচিত কোন ভালো মানুষ রোগযন্ত্রণা বা অন্য কোনভাবে কষ্ট পেয়েছে এরকম জানা থাকলে তা দলে অন্যদের সাথে সহভাগিতা কর । |
কষ্ট যন্ত্রণার ইতিবাচক মনোভাব
দৈহিক প্রতিবন্ধী জনী জীবনের চরম হতাশার কারণে নিজেকে নিরুপায় ভেবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তা করল না । পরে সে ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসতে চেষ্টা করল এবং তার সুস্থতার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল । তাতেও কোনো ভালো ফল না পেয়ে তার হতাশা রয়েই গেল ।
অনেক বন্ধু-বান্ধব আর গুরুজনদের প্রার্থনা আর সৎ পরামর্শে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পর জনী একদিন তার প্রতিবন্ধী অবস্থার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল । সে তার জীবনে ঈশ্বরের একটি সুন্দর পরিকল্পনা খুঁজে পেল। জনী মুখে পেন্সিল নিয়ে লিখতে ও ছবি আঁকা শিখতে শুরু করল । এখন তার আঁকা চমৎকার ছবিগুলো শুভেচ্ছা কার্ড ও বড়দিনের কার্ড হিসেবে সারা দেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে বিক্রির জন্যে শোভা পাচ্ছে । ছবিগুলোর পেছনে ট্রেডমার্ক হিসেবে লেখা রয়েছে: “Joni-PTL” - যার অর্থ হলো “Praise The Lord” (“প্রভুর প্রশংসা কর')।
প্রতিবন্ধী হওয়ার যে কষ্ট জনীর কাছে পূর্বে অতি বেদনাদায়ক মনে হয়েছে, সে কষ্টই এখন ঈশ্বরের প্রশংসায় পরিণত হয়েছে ।
উপরে বর্ণিত জনীর জীবনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখন চিন্তা করব কীভাবে দুঃখকষ্টের প্রতি আমরা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারি । সাধু পিতরের কাছ থেকে আমরা দুঃখকষ্ট সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব সম্পর্কে শিখতে পারি । তিনি বলেন: “প্রীতিভাজনেরা, তোমাদের যাচাই করার
জন্যে এখন যে অগ্নিকাণ্ড চলছে, তাতে তোমরা আশ্চর্য হয়ো না; মনে করো না, তোমাদের ওপর অদ্ভূত কিছু ঘটছে । বরং এতে তোমরা খ্রিষ্টের দুঃখযন্ত্রণার যতখানি অংশীদার হয়ে উঠছ, তোমরা ততখানি আনন্দিতই হও, যাতে তাঁর সেই মহিমা প্রকাশের দিনেও তোমরা গভীর আনন্দেই আনন্দিত হতে পার । মানুষ যদি খ্রিষ্টের নামের জন্যে তোমাদের অপমান করে, তাহলে ধন্য তোমরা, কেননা তখন তোমাদের ওপর যে অধিষ্ঠিত রয়েছেন সেই মহিমাময় আত্মা, স্বয়ং ঈশ্বরেরই আত্মা । তোমাদের কেউ যদি দুঃখযন্ত্রণা পায়, তবে সে যে তা পাচ্ছে খুনী, চোর, অনাচারী বা পরাধিকারচর্চাকারী বলেই, এমনটি যেন কখনো না হয় । কিন্তু কেউ যদি খ্রিষ্টান বলেই দুঃখযন্ত্রণা পায়, তাহলে সে যেন তার জন্যে কোনো লজ্জা অনুভব না করে; বরং সে যে খ্রিষ্টান নামে পরিচিত, তার জন্যে সে যেন পরমেশ্বরের স্তুতি-বন্দনাই করে । আসলে এই তো সেই বিচার শুরু হওয়ার সময়; আর তা শুরু হচ্ছে, পরমেশ্বরের আপনজন যারা, তাদেরই বিচার দিয়ে । আমাদের বিচার দিয়েই যখন বিচারের কাজ শুরু হলো, তখন যারা পরমেশ্বরের মঙ্গলসমাচার মানতে চায় না, না জানি কী হবে তাদের পরিণাম । শাস্ত্রে তো লেখাই আছে: ধার্মিকের পক্ষে পরিত্রাণ পাওয়া যদি এত কঠিন হয়, তাহলে ভক্তিহীন পাপী মানুষের কী দশাটাই না হবে । তাই পরমেশ্বরের ইচ্ছায় যারা দুঃখযন্ত্রণা পায়, তারা সৎ জীবন যাপন করে চলুক আর এভাবে তারা, সেই পরম বিশ্বস্ত স্রষ্টা যিনি, তাঁরই হাতে সঁপে দিক নিজেদের প্রাণ” (১ পিতর ৪:১২-১৯)। সাধু পিতরের এ কথা থেকে চারটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে:
১. আনন্দিত হওয়া: আমাদের নিজেদেরকে খ্রিষ্টের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে । কারণ আমরা ঈশ্বরের পুত্রের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরসন্তানের মর্যাদা লাভ করেছি । সন্তান হতে গিয়ে আমাদের কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। এখন আমরা বুঝতে পারি, কেন যীশুর শিষ্যগণ যীশুর নামে কষ্ট ভোগ করতে পেরে আনন্দিত হতেন। কষ্ট ভোগ করতে পেরে তাঁরা খ্রিষ্টের কষ্টের সাথে অংশগ্রহণ করতেন ।
২. ব্যথার পর আসে গৌরব: স্বর্ণকে যেমন আগুনে পুড়িয়ে এর খাঁটিত্ব প্রমাণ করতে হয়, তেমনি কষ্টের কারণে প্রাপ্ত ব্যথার দ্বারা আমরা পরিশোধিত হই । এই ব্যথাই আমাদেরকে পিতা ঈশ্বরের যোগ্য সন্তানে পরিণত করে। এভাবে আমরা খ্রিষ্টের গৌরবে অংশগ্রহণ করতে পারি । তাই কবি বলেছেন, কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয়কি মহীতে?
৩. নিজের আত্মপরিচয়ের কথা স্মরণে রাখ: ঈশ্বর নিজেই আমাদের মধ্যে বসবাস করেন। কারণ সাধু পল বলেন, আমাদের দেহ হচ্ছে পবিত্র আত্মার মন্দির । কাজেই আমরা যখন কষ্টভোগ করি তখন ঈশ্বর নিজেই আমাদের মধ্যে অবস্থান করেন এবং তিনি আমাদের কষ্টভোগ করতে দেখেন । এই কারণে আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই ।
৪. ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ: আমরা যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে ঈশ্বর নিজেই আমাদের মধ্যে আছেন তখন আমরা আর নিজের ওপর ভরসা করি না । আমরা তখন পুরোপুরি ভরসা করি ঈশ্বরের ওপর । আমরা তখন এই ভরসা করতে পারি যে, তিনিই কষ্টের সময় আমাদের শক্তি যোগাবেন এবং ভালো কাজ ক্রমাগত করে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন ।
কষ্টভোগ সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলের শিক্ষা
কষ্টভোগ সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মে দুই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয় । নিম্নে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
ক. পুরাতন নিয়মের দৃষ্টিভঙ্গি
পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মে কষ্টভোগকে খুবই নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়েছে। সেখানে কষ্টভোগকে মানব জীবনের একটি অভিশাপ ও কলঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো । এমন কি, কষ্টভোগকে কারো জীবনে পাপের শাস্তি হিসেবে দেখা হতো । সাধু পিতরও একবার পুরাতন নিয়মের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখে যীশুকে প্রশ্ন করেছিলেন: “এটা কার পাপের জন্যে হয়েছে?” যীশু বলেছিলেন, কারো পাপের জন্যে নয় বরং ঈশ্বরের গৌরবের জন্যে ।
পুরাতন নিয়মে যদিও কষ্টভোগী মানুষের প্রতি যথেষ্ট সমবেদনা সহানুভূতি দেখানো হয়েছে, তবুও কষ্টভোগকে একটি মন্দতা হিসেবেই দেখা হতো । দুষ্ট লোক জগতের মন্দের কবলে পড়ে বলত: “ঈশ্বর বলে কোনো কিছুই নেই” (সাম ১০:৪)। আবার কিছু কিছু দুষ্টলোক এ-ও মনে করত যে, এসব কষ্ট-যন্ত্রণার কারণ স্বয়ং ঈশ্বরের কাছেও অজানা (সাম ৭৩ : ১১)। যোব (ইয়োব)-এর চরম কষ্টভোগের সময় তাঁর স্ত্রী তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন: “তুমি ঈশ্বরকে অভিশাপ দাও” (যোব ২:৯) । যোবের বন্ধুদেরও একই মনোভাব ছিল, যা পুরাতন নিয়মের সমস্ত মানুষেরই মনোভাব প্রকাশ করে ।
পুরাতন নিয়মে মানুষ মনে করত প্রতিটি কষ্ট বা মন্দের পেছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। তারা বিশ্বাস করত যে, হয় কোন প্রাকৃতিক শক্তির কারণেই তা ঘটছে, না হয় সেই মন্দের পেছনে কোনো না কোনো মন্দ শক্তি বিশ্বের কোথাও রয়েছে ।
খ. নতুন নিয়মে যীশুর দৃষ্টিভঙ্গি
নতুন নিয়মে যীশু নিজেই কষ্ট-যন্ত্রণাকে ধারণ করেছেন এবং মানুষের কষ্টভোগ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন । তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হলেও আমাদের মতোই মানবরূপ ধারণ করলেন এবং পাপ ব্যতীত সকল বিষয়েই আমাদের মতোই দুর্বল স্বভাবের মানুষ হলেন । “তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন । আকারে প্রকারে মানুষের মতো হয়ে... আমাদেরই একজন হলেন তিনি (ফিলিপ্পীয় ২:৭-৮)।” আমাদের মতোই তাঁর জীবনেও ছিল অনেক স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা--যা তিনি পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন । আবার আমাদের মতোই তিনি ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্লান্তি, সমস্যা, বিরোধিতা, ব্যর্থতা, হতাশা, বাধা এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতা এমন কি, মৃত্যুর অভিজ্ঞতাও গ্রহণ করেছেন ।
যীশু কখনোই শুধু নিজের দুঃখ-কষ্টকে বড় করে দেখেননি; বরং অন্যের দুঃখ-কষ্টে তিনি তাদের সমব্যথী হয়েছেন । তাই যখনই তিনি অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখেছেন, তখনই তিনি দয়া ও করুণায় পূর্ণ হয়েছেন; ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন (মথি ৯:৩৬; ১৪:১৪; ১৫:৩২; লুক ৭:১৩; যোহন ১১:৩৩-৩৭)।
কষ্ট-যন্ত্রণার উপর যীশুর বিজয়
যীশু তাঁর প্রকাশ্য-জীবনকালে স্বর্গরাজ্যের সুখবর প্রচারের সময় বহু রোগীকে সুস্থ করে, মৃতকে জীবন দান করে, নানা অলৌকিক কর্ম সাধন করে, সর্বোপরি তিনি নিজে মৃত্যুর পর কবর থেকে পুনরুত্থিত হয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনিই সেই প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা যাকে স্বয়ং ঈশ্বর এই জগতে পাঠিয়েছেন (মথি ১১:৪-৫) । এইসব কিছুই ছিল তাঁর চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বাভাষ বা সূচনামাত্র । তিনি জগতকে জয় করেছেন । রোগ-ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-যন্ত্রণা, মৃত্যু--এই সব কিছুই তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছে । চরম কষ্টকর ক্রুশীয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের জন্যে মুক্তি বা পরিত্রাণ অর্জন করেছেন । তিনি সর্বজয়ী মহাবিজয়ী ও সর্বকালের সর্ব- মানবের মহান মুক্তিদাতা। যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে কষ্ট-নিরাময়ের শক্তি--তথা মানুষকে দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেবার শক্তি দান করেছেন । তাঁর পবিত্র ‘যীশু’-নামের শক্তিতেই তাঁরা সেই কষ্ট নিরাময়ের কাজ করতে পারবেন । আজও যীশু তাঁর সেই নিরাময়কারী শক্তি তাঁর শিষ্যদের সাথে সহভাগিতা করে চলেছেন।
কষ্টভোগকে যীশু আশিসধন্য করেন
এটা সত্যি যে, যীশু দুঃখ-কষ্ট বা মৃত্যু- এর কোনোটাই দূরে সরিয়ে দেন না কিন্তু সেইগুলোর সামনে সৎ-সাহসের সাথে দাঁড়াবার এবং মোকাবেলা করার শক্তি তিনি আমাদের দান করেন । যীশু বলেন: “দুঃখ-শোকে কাতর যারা, ধন্য তারা--তারাই পাবে সান্ত্বনা” (মথি ৫:৪)। শোকে কাতর মানুষের চোখের জল তিনি দূর করে দেন না; কিন্তু জীবনের চলার পথে তিনি মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দেন (লুক ৭:১৪)। এটি কষ্টভোগী মানুষের সাথে ঈশ্বরের মিলনের একটি আনন্দময় চিহ্ন, তিনি “তাদের চোখ থেকে মুছিয়ে দেবেন সমস্ত অশ্রুজল” (প্রত্যাদেশ/প্রকাশিত ২১:৪)।
দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ আমাদের জন্যে হয়ে উঠতে পারে একটি আশীর্বাদ । কেননা তা ঈশ্বরের রাজ্যে আরও মহৎ গৌরব ও আনন্দের জন্যে আমাদেরকে প্রস্তুত করে ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. মানসিক কষ্ট কোটি ?
ক. অশান্তি
খ. ক্লান্তি
গ. হতাশা
ঘ. বেকারত্ব
২. কে মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছেন ?
ক. লাসার
খ. কুমারী মারীয়া
গ. যোসেফ
ঘ. যীশু
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
বাদল খুবই ধনী লোক । তার পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে । তবুও তিনি মানুষকে ঠকান এবং অবৈধ উপার্জন করেন । একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও অজস্র সম্পদ করেছেন । এরপরও আরও সৌখিন ও ব্যয়বহুল জিনিস করার চাহিদা প্রকাশ পায় । তিনি কোনো প্রকারে নিজের ক্ষতি মেনে নিতে পারেন না ।
৩. বাদলের মধ্যে কোন ধরনের কষ্ট বিদ্যমান ?
ক. মনুষ্য সৃষ্ট
খ. দেবতা সৃষ্ট
গ. প্ৰকৃতি সৃষ্ট
ঘ. অলৌকিক সৃষ্ট
৪. বাদলের কষ্টের কারণ -
i. অতিরিক্ত চাহিদা
ii. সম্পদের মোহ
iii. ত্যাগের মনোভাব
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. জাগতিক কষ্ট বলতে কী বুঝ ?
২. কষ্ট মানুষের জীবনে অপরিহার্য কেন ?
৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে কী বোঝায় ?
৪. কষ্ট ভোগ সম্পর্কে নতুন নিয়মের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল ?
৫. দুঃখ-যন্ত্রণাভোগ আমাদের জন্য আশীর্বাদ কেন ?
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. জর্জ একজন বিশ্বাসী ঈশ্বর ভক্ত । শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে খুবই দৃঢ়তা সম্পন্ন । সামান্য অসুস্থতায় তিনি ভেঙ্গে পড়েন না । দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান তাই তিনি সবার সাথে একাত্ম হয়ে চলতে চেষ্টা করেন । এভাবে সহ্য করতে করতে এক সময় পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ডায়বেটিসই হয়েছে । তিনি জানেন এই রোগ মৃত্যু পর্যন্তই থাকবে তবু তিনি হতাশ না হয়ে ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে খুশি মনে গ্রহণ করেন । তিনি জানেন ঈশ্বর কষ্টের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
ক. মানুষের হয়ে কে সবচেয়ে বেশি কষ্ট স্বীকার করেছেন ?
খ. দুঃখ কষ্ট সবার জন্য অনিবার্য কেন ? বর্ণনা কর ।
গ. দুঃখ যন্ত্রণার ক্ষেত্রে জর্জের মনোভাব ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. 'জর্জের মনোভাব যেন পিতরের শিক্ষারই প্রতিফলন' উক্তিটির বিশ্লেষণ কর ।
২. রাজু সাহেব একজন শিল্পপতি । তিনি তার প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক লোকদের সাথে কিছু সংখ্যক অস্বাভাবিক লোকদের নিয়োগ দেন । যাকে দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল । গেইটে বসে অনেক সময় ঘুমাতে থাকেন । ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারে না ৷ ফলে তাকে সহকর্মীদের কাছ থেকে তিরস্কার পেতে হয় । টেলিফোন অপারেটর চন্দন চুপচাপ থাকেন; দেখলে মনে হয় খুবই চিন্তিত । জনগণ তার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করলে একটির বেশি দুইটি কথা বলেন না । অন্যমনস্কভাবে থাকেন; ফলে জনগণ তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায় না ।
ক. পুরাতন নিয়মে কষ্টভোগকে কেমন দৃষ্টিতে দেখা হতো ?
খ. সাধু সাধ্বীগণ কেন দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন ?
গ. দারোয়ানের মধ্যে কোন ধরনের কষ্ট বিদ্যমান ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. “কষ্ট সম্পর্কে যীশুর শিক্ষা চন্দনের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে' – মূল্যায়ন কর ।