প্রাচীনকালের মানুষ শত্রুকে ঘৃণা করত কেন?
চতুর্দশ অধ্যায়
পরিবর্তিত বিশ্ব চাই
বর্তমান জগতের বাস্তবতা দেখে আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সমাজ আজ অমানবিক কার্যকলাপে ভরপুর। মানুষের বিবেক যেন পরাধীন হয়ে গেছে । সেই কারণে অন্যায্য কার্যকলাপ করলেও মানুষের বিবেক বাধা দেয় না । ধর্মকর্মের চেয়ে খাওয়া-পরাই যেন মানুষের কাছে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে । আধ্যাত্মিকতার চেয়ে জাগতিকতার মোহে মানুষ বেশি আবিষ্ট হয়ে আছে । ফলে অরাজকতা, অন্যায্যতা, অশান্তি চারিদিকে ছেয়ে আছে । আমরা এই পরিবর্তন করে সুস্থ ও সুন্দর বিশ্ব গড়তে চাই । আমরা আজ যারা শিক্ষার্থী, আমরা যদি পরিবর্তিত হই, তবেই বিশ্ব পরিবর্তিনের দিকে অগ্রসর হবে ।
এই অধ্যায় শেষে আমরা-
সামাজিক অন্যায়ের চিত্র
তিলক একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার রুটিনমাফিক প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন । একটা বড় পাঁচ তারা হোটেলের কাছে একটা ডাস্টবিন । সেখানে রাতের বেলায় হোটেলের উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল । একটা ময়লা ও তালি দেওয়া শাড়ি পরিহিতা একজন মা তার দুই বছরের শিশু পুত্রকে নিয়ে ঐ ডাস্টবিন থেকে খাবার নিয়ে একটু দূরে বসে খাচ্ছে। কাছেই একটা কুকুর এসে একই ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে । এত সকালে এমন একটা দৃশ্য দেখে তিলকের ভিতরে নাড়া দিয়ে উঠল
কাজ: কয়েকজন করে দলে গোল হয়ে বসো । উপরের অবস্থাটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা কর: ঘটনাটি শুনে তোমার কেমন লাগল? ঘটনাটির জন্য কে বা কারা দায়ী ? এর মানবিক ও আবেগীয় দিকগুলো তুমি কীভাবে বর্ণনা করবে? |
তোমার অভিজ্ঞতা থেকে এরূপ আরো কোনো অমানবিক ঘটনা জানা থাকলে সহভাগিতা করতে পার । সবার অভিজ্ঞতা একের পর এক নিজেরাই বিশ্লেষণ কর । তোমাদের সহভাগিতা করা এসব অমানবিক ও অসামাজিক অবস্থাগুলোর কারণ কী কী হতে পারে বলে মনে কর? দলে বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করার পর সমাজ সম্পর্কে যেসব বিষয় বের হয়ে আসবে সেগুলো পোস্টারে বা ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হবে যেন সবাই দেখতে পায় ।
বর্তমান সমাজের এই চিত্র ভয়ানক। সারা দেশেই আজ মানুষের মনে নানা রকম ভয়-ভীতি, কুসংস্কার, মাদকাসক্তি, বোমাবাজি, ভণ্ডামী, ঘৃণাবিদ্বেষ, চুরি-ডাকাতি, স্বার্থপরতা ইত্যাদি বিরাজমান ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'দুই বিঘা জমি' নামক একটি কবিতা লিখেছেন। তিনি সেখানে দেখিয়েছেন, কী করে এক রাজা তার গরিব প্রজার কাছ থেকে দুই বিঘা জমি দখল নিয়ে নিল । গরিব লোকটার দুর্দশার কথা রাজা চিন্তা করলেন না । কবিগুরু ঐ কবিতার এক জায়গায় বলেছেন:
“এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি” ।
ভোগবাদী জগতে মানুষ ত্যাগে নয় বরং ভোগে বেশি সুখের অন্বেষণ করছে। যার প্রচুর আছে, সে আরও বেশি চায় । একটি অতৃপ্ত বাসনা মানুষকে তাড়া করে বেড়ায় আরও পাওয়ার জন্য । আর তাই একজন গরিব লোকের এক টুকরো সম্বল বিশাল রাজ্যের অধিকারী রাজার চোখ এড়াতে পারেনি । প্রায় নিঃস্ব লোকটির শেষ সম্বলটুকুও রাজার চাই ।
আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ আছে। কিন্তু সম্পদের সমবণ্টন হচ্ছে না। সমাজের শতকরা ২০ ভাগ মানুষ আজ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে । আর ৮০% মানুষ ভোগ করছে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ সম্পদ । আর শতকরা ২০ ভাগ মানুষ ভোগ করছে শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ । কেউ কেউ পাহাড়সম সম্পদ ভোগ করছে আর কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করছে । ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এভাবে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েই চলছে । ধনীরা নিজেদেরকে সকল ক্ষেত্রে মহাশক্তিধর মনে করে । অর্থাৎ তারা মনে করে তারাই সকল ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী । তারা বিলাসিতায় জীবন যাপন করে আর দরিদ্রদের অবহেলা করে । ফলে দরিদ্রতা প্রকট আকার ধারণ করছে ।
মানুষ রাজা হওয়ার পিছনে বা ক্ষমতা লাভের জন্য ছুটছে। সবাই পাওয়ার অতৃপ্ত বাসনায় ছুটে চলছে অজানা পথে । এই ছুটতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছে আপন ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে। হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর । কেবল নিজের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির সন্ধান করছে । এতে অসৎ পথ বেছে নিতেও সে কুণ্ঠাবোধ করছে না । ফলে দেখা দিচ্ছে দ্বন্দ্ব, রেষারেষি, মারামারি, হানাহানি, রাহাজানি, ধর্ষণ ও খুন । সামাজিক অবকাঠামোর মধ্যেও একটি বৈষম্য দৃশ্যমান । কেউ কেউ সকল সুবিধা ভোগ করছে, আবার কেউ কেউ বঞ্চিত হচ্ছে । শ্রেণীভেদ, গোত্রভেদ, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা মানুষের মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে যা অনেক সময় যুদ্ধে পরিণত হয় । সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে । সমাজের সকল ক্ষেত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে ।
চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদ, যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও বোমাবাজি সারা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি । রাতে নারী, শিশু বা অন্য একাকী কেউ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। রাস্তাঘাটে কেউ নিরাপদ নয় । যে কোন সময় ছিনতাই হতে পারে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন কিংবা হাতের ব্যাগ । এমন কি গুম হয়ে যেতে পারে যে কোনো মানুষ । বখাটেরা ভয়ঙ্কর ব্যক্তি । তাদের দ্বারা মহিলা ও যুবতী মেয়েরা নিগৃহীত ও ইভ টিজিং-এর শিকার হচ্ছে ।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে । সামান্য ব্যাপারে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে যাচ্ছে পরিবারের লোকজন । ভাড়াটে মাস্তান লেলিয়ে দিচ্ছে আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে । এসিডে দগ্ধ হচ্ছে মেয়েরা । কেউ কেউ ধর্ষিত হচ্ছে স্বামী বা পিতার সামনেই । প্রেমিকের হাতে টুকরো টুকরো হচ্ছে প্রেমিকার দেহ । ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি তো আজ একটি বড় সমস্যা ও নিত্যদিনের প্রধান আলোচনার বিষয় ।
কাজ: সমাজের বিভিন্ন অন্যায্যতার তালিকা, এগুলোর কারণ ও বিভিন্ন কুফল পোস্টার পেপারের মাধ্যমে উপস্থাপন কর । |
সহিংস বিপ্লবের কুফল
একবার একজন হিন্দু ভদ্রলোক মহাত্মা গান্ধীর কাছে এসে বললেন যে, তিনি নরকে যাচ্ছেন । গান্ধীজী জিজ্ঞেস করলেন, কেন? লোকটি বললেন, ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যাবার পর যে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সে যুদ্ধে একজন মুসলিম একজন হিন্দুর পুত্র সন্তানকে হত্যা করেছে । হিন্দু লোকটি কষ্টে ও রাগে সেই মুসলিম লোকটির পুত্র সন্তানকেও পাথরে আঘাত করে হত্যা করেছেন। একথা শুনে গান্ধীজী বলেছেন, তুমি যাও, এই যুদ্ধে মা-বাবা হারিয়েছে এমন একজন মুসলিম ছেলেকে খুঁজে নিজের ঘরে লালনপালন কর এবং তাকে মুসলিম হিসেবেই বড় হতে সাহায্য কর। এই অহিংস পরামর্শ শুনে যে লোকটি অস্থিরতা নিয়ে গান্ধীজির কাছে এসেছিল, সে শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে বাড়ি চলে গেল ।
সমাজ থেকে অন্যায্যতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস দূর করার জন্য এবং সমাজে শান্তি স্থাপনের জন্য অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করেছেন । কেউ শান্তিপূর্ণভাবে আর কেউ বা সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে । আমরা হয়তো ফরাসি বিপ্লবের কথা ইতিহাসে পড়েছি । এটি ঘটেছিল ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে । অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য, ধনীদের অত্যাচার থেকে দরিদ্রদের রক্ষার জন্য, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য ঐ সময় ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটেছিল । তাছাড়া, সারা ইউরোপ-আমেরিকায়ও ঐ ধরনের বিপ্লব শুরু হয়েছিল । এতে যেমন অনেক সুফল ছিল, তেমনি অনেক কুফলও ছিল । অনেক মানুষ এতে প্রাণ হারিয়েছে। এসব বিপ্লব ধীরে ধীরে জাতিকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল । ফলে পৃথিবীতে পর পর দুইটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকির ঘটনার কথা শুনেছি । আমরা জানি সেখানে কীভাবে পারমাণবিক বোমায় দুইটি শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আর কত মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ।
দাসত্ব থেকে মুক্তি, শ্রেণিভেদ দূর করা, জাতিগত দ্বন্দ্ব ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য জাতিতে জাতিতে দেশে দেশে এরূপ কত যে বিপ্লব ও যুদ্ধ হয়েছে তার হিসেবে নেই । প্রতিনিয়ত এক দেশ অন্য দেশের সাথে, এক জাতি অন্য জাতির সাথে এমন কি এক ধর্ম অন্য ধর্মের সাথে যুদ্ধ করছে ।
চীন, ভিয়েতনাম, যুগোস্লাভিয়া, আফ্রিকা, লিবিয়া, মিশর, মধ্য প্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক ও কুয়েতের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দরিদ্রতা, ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস, প্রাচীন পদ্ধতির রাজনীতি এবং মানব মুক্তির জন্য বিভিন্ন বিপ্লব ঘটেছে।
এসব যুদ্ধ-বিপ্লবে কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসেব নেই, কত সম্পদ যে বিনষ্ট হয়েছে তার
পরিমাপ করা যাবে না। তাছাড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হবে না । এসব যুদ্ধে সুফলের চাইতে কুফলই এসেছে বেশি । কারণ আমরা জানি, সহিংসতা দিয়ে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না । মহাত্মা গান্ধী ভারত উপমহাদেশে উজ্জ্বল এক উদাহরণ । তিনি অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে রক্তপাত ছাড়া ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন । তিনি যুদ্ধ নয় বরং অহিংসা দিয়ে শুধু দেশই জয় করেননি বরং মানুষের হৃদয়কে জয় করেছেন । আজ তিনি চির অমর হয়ে আছেন ।
কাজ : রাজাবলির প্রথম গ্রন্থে উল্লিখিত নাবোথের আঙুর ক্ষেতের কাহিনীটি (১ রাজাবলি ২১তম অধ্যায়) অভিনয়ের মাধ্যমে দেখাও । |
সমাজ পরিবর্তনে খ্রিষ্টের পথ
“তোমরা শুনেছ, প্রাচীনকালের মানুষদের এই কথা বলা হয়েছিল: তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে আর তোমার শত্রুকে ঘৃণা করবে! কিন্তু আমি তোমাদের বলছি: তোমরা তোমাদের শত্রুদেরও ভালোবাস” । প্রাচীনকালের প্রবর্তিত এই নিয়মটি হয়তো অপরাধকে দমিয়ে রাখার জন্য করা হয়েছিল । কারণ তখনকার সমাজে অনেক অনাচার, অত্যাচার ও অবিচার বিরাজ করছিল ।
নাবোথের আঙুর ক্ষেতের কাহিনীটি অভিনয় করে আমরা সামাজিক অন্যায্যতা সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করেছি । এই সমস্ত অনাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য তখন কঠিন কঠিন নিয়ম জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো । তার মধ্যে একটি নিয়ম ছিল কেউ একজনের ক্ষতি করলে তার সেই শত্রুর সমপরিমাণ ক্ষতি করে প্রতিশোধ নেওয়া । উদাহরণস্বরূপ, কেউ ঝগড়া করে একজনের একটা দাঁত ভেঙ্গে ফেললে, বিচারে সে-ও তার শত্রুর একটা দাঁত ভেঙ্গে দিতে পারত । এই নিয়ম তখন করা হয়েছিল এজন্য যে, নিজের সমপরিমাণ ক্ষতি করা হবে, এই ভয়ে যেন মানুষ অন্যের ক্ষতি না করে । এই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও অপরাধ, অসামাজিকতা, অন্যায্যতা সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব হয়নি ।
প্রাচীনকালের এইসব নিয়মের মধ্যে ক্ষমা ও ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। বরং শত্রুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, শত্রুর ক্ষতি করা হয়েছে এবং শত্রু-মিত্রের দ্বন্দ্ব সমাজে যুগ যুগ ধরে স্থায়ী হয়েছিল । এমন পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের অদ্বিতীয় পুত্র আমাদের মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিষ্ট এ জগতে আসেন । তিনি পুরাতন সব নিয়ম বাতিল বা পরিবর্তন করতে আসেননি বরং সেগুলোর পূর্ণতা দিতে এসেছেন । পূর্ণতার জন্য তিনি সর্বপ্রথমে মন পরিবর্তনের আহ্বান জানান “তোমরা পাপ থেকে মন ফেরাও আর মঙ্গলসমাচারে বিশ্বাস কর” ।
মন পরিবর্তনের এই বিপ্লব তিনি হঠাৎ করে শুরু করেননি । কেননা, কেউ হঠাৎ করে কোনো কিছু শুরু করলে সমাজে তার প্রতিক্রিয়া হয় । অনেক সময় তা গ্রহণযোগ্যতা হারায় । বিপ্লবকারী বা আন্দোলনকারীর পরিচয় নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে । তাই যীশু তাঁর প্রচারকাজ শুরু করার পূর্বে ৪০ দিন নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। পর্বতের উপর নির্জনে, একাকী তিনি দিনরাত প্রার্থনা করেছেন । ধ্যান-প্রার্থনা, উপবাস ও ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে
নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছেন । শুধু তাই নয়, তিনি পাপী না হয়েও ৪০ দিন পর মরুপ্রান্তরে যাওয়ার পূর্বে তিনি দীক্ষাস্নান গ্রহণ করেছেন । জনসম্মুখে তাঁর শুচিতা ও পবিত্রতাকে প্রকাশ করেছেন। ঈশ্বর হয়েও তিনি নিজেকে নম্র করেছেন যেন তিনি সবাইকে নম্রতা ও পবিত্রতার পথে আহ্বান করতে পারেন ।
তিনি মন্দিরে গিয়ে সেই শান্ত্রাংশটি পাঠ করেছেন যেখানে তার নিজের সম্বন্ধে বলা আছে (লুক ৪:১৮-১৯)। তিনি এসেছেন বন্দীর কাছে মুক্তি আর অন্ধের দৃষ্টি খুলে দেওয়ার জন্য । তাঁর এ কথা সত্য হয়েছে তখনই যখন লোকেরা তাঁর মুখ থেকে তা শুনতে পেয়েছে (লুক ৪:২১)। এভাবে তাঁর নিজের পরিচয় মানুষের কাছে তুলে ধরে তিনি তাঁর মুক্তির কাজ শুরু করেছেন । যারা দরিদ্র, অভাবী, অত্যাচারিত, অবহেলিত, সমাজের চোখে ঘৃণিত, অবাঞ্ছিত তাদেরকে রক্ষা করতেই তিনি এসেছেন ।
ইহুদি সমাজে যেসব নিয়মের বাড়াবাড়ি ছিল যীশু তা চ্যালেঞ্জ করেছেন। যেসব অনাচার, অত্যাচার, অবিচার ছিল তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন । মন্দির থেকে তিনি ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিয়েছেন । ধর্ম ব্যবসায়ীদের তিনি ধিক্কার দিয়েছেন । আর শিষ্যদের শিখিয়েছেন তারা যেন খ্রিষ্টের উপস্থিতিতে শান্তি ও মুক্তির আস্বাদ লাভ করে । কারণ তাঁর আগমন মুক্তির ও পরিত্রাণের জন্য । যারা বিশ্বাস করবে তারা মুক্তিলাভ করবে ও অনন্তকাল বেঁচে থাকবে ।
তিনি দরিদ্রদের ‘ধন্য' বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ ‘স্বর্গরাজ্য' তাদেরই । তিনি এসেছেন স্বর্গরাজ্যের পথ দেখাতে । দরিদ্ররাই সে পথে সবার পূর্বে যেতে পারবে । তিনি বলেছেন, ধনীর পক্ষে স্বর্গে যাবার চেয়ে বরং সূচের ছিদ্র দিয়ে একটি উটের যাওয়া সহজ । তিনি আরও বলেছেন, সুস্থ-সবল যারা তাদের চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই । দরকার শুধু তাদেরই যারা ব্যাধিগ্রস্ত । একদিকে তিনি দরিদ্রদের বন্ধু হয়েছেন অন্যদিকে যত অসুস্থ, বিকলাঙ্গ, ব্যাধিগ্রস্ত ও অপদূতে পাওয়া ব্যক্তিদের তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন ।
যীশু বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ঐশরাজ্যের বাণী প্রচার করতেন । তিনি দরিদ্র ও পাপীদের বাড়িতে যেতেন এমনকি তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়াও করতেন । তাদেরকে তিনি বন্ধু হিসেবে দেখতেন । তিনি বলতেন, “বন্ধুদের জন্য প্রাণ দেওয়ার চেয়ে বড় ভালোবাসা মানুষের আর নেই” । তোমরা আমার বন্ধু, অবশ্য আমি তোমাদের যা করতে বলছি যদি তা-ই কর । আমি তোমাদের আর দাস বলছি না, কারণ প্রভু যে কী করছেন, দাসের তো তা জানার কথা নয় । তোমাদের আমি এই জন্যেই বন্ধু বলছি যে, আমার পিতার কাছ থেকে যা কিছু শুনেছি, সবই তোমাদের জানিয়েছি” (যোহন ১৫:১৩-১৫) । যীশু শুধু মুখেই এই শিক্ষা দেননি বরং নিজের জীবন দিয়ে তা বাস্তব করে তুলেছেন । ক্রুশের উপর নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি আমাদের প্রতি তাঁর চরম ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন ।
যীশু শুধু ধনী-দরিদ্রের সম্পর্ক উন্নয়নের কথাই বলেননি বরং প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য ও গুরুত্ব দিতে আহ্বান করেছেন। আমাদের প্রতি যীশুর আহ্বান “আমি যেমন তোমাদের ভালোবেসেছি, তেমনি তোমরাও পরস্পরকে ভালোবাস।” তিনি সেবা পেতে আসেননি বরং সেবা করতে এসেছেন । তিনি বলেছেন, বড় হতে হলে সকলের দাস হতে হবে, প্রধান হতে হলে সকলের সেবক হতে হবে (লুক ২২:২৬) । সামনের সম্মানিত আসনে বসতে চাইলে আগে পিছনের সারিতে বসতে হবে । এসব কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের আহ্বান করেছেন যেন আমরা নিজেদের বড় মনে না করি । নিজেদেরকে অন্যদের চাইতে বেশি গুরুত্ব না দেই । সর্ব ক্ষেত্রে নিজেদেরকে যেন প্রধান না ভাবি। বরং অন্যকে যেন আগে
সুযোগ দেই, অন্যের জন্য চিন্তা করি, অন্যের সেবা করি, অন্যের সামনে নিজেদেরকে বিনীত করি ৷ তিনি তো ঈশ্বর ছিলেন । তাঁর সেই ঈশ্বরত্বকে তিনি ধরে রাখেননি বরং তিনি নমিত হলেন, মানুষের মাঝে বাস করতে আসলেন । তাঁর নম্রতার চরম প্রকাশ তিনি করেছেন কোনো প্রতিবাদ না করে ক্রুশের উপর থেকে শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়ে ।
যীশু বিবেক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়েছেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি নতুন পৃথিবী গড়ার আন্দোলন গড়ে তোলেন । তাঁর আন্দোলন ছিল অন্য সকল আন্দোলনের চেয়ে ভিন্ন । তাঁর কথা, কাজ ও শিক্ষায় গোটা পৃথিবীটাই যেন বদলে গিয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে, নতুন হয়ে উঠেছে। কারণ তাঁর আন্দোলন ছিল সত্য, সুন্দর, ক্ষমা, সেবা ও ভালোবাসার আন্দোলন । তাঁর এই আন্দোলনে তিনি যুদ্ধ করে জয়ী হননি বরং মানুষ ও জগতের জন্য পিতার ভালোবাসা প্রকাশের উদ্দেশ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে জয়ী হয়েছেন। তিনি আমাদের আত্মত্যাগের পথ দেখিয়ে গেছেন ।
প্রভু যীশু চেয়েছেন যেন আমরা তাঁর দেখানো পথে চলি । আর তাঁর দেখানো পথ হলো বিশ্বাস, দরিদ্রতা, ভালোবাসা, ক্ষমা, বন্ধুত্ব, নম্রতা, সেবা, পবিত্রতা এবং সর্বোপরি আত্মত্যাগের পথ । তিনি বলেছেন, স্বর্গরাজ্যের জন্য যে নিজের জীবন হারাবে সে তার শতগুণ ফিরে পাবে । তিনি শুধু মন নয় বরং আমাদের হৃদয় পরিবর্তনের আহ্বান জানান । এরজন্য দরকার আত্মত্যাগ, সংলাপ, পুনর্মিলন, একতা ও ভালোবাসা। প্রতিজন খ্রিষ্টানের দায়িত্ব খ্রিষ্টের দেখানো পথে চলা । একই সাথে খ্রিষ্টের সৎ ও সাহসী সৈনিক হিসেবে অসামাজিকতা দূর করা এবং ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপনে কাজ করা । তবেই সত্য, সুন্দর, শৃঙ্খল ও মনোরম বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে ।
কাজ: ১. ‘যীজাস ক্রাইষ্ট সুপার স্টার' সিনেমাটি ক্লাসে দেখানো যায় যেখানে যীশুকে দেখা যাবে অভাবী ও অত্যাচারিত দরিদ্রদের মাঝে । কাজ: ২. খ্রিষ্টের শিক্ষা অনুসরণ করে কী কী ভাবে পরিবর্তিত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়? তার তালিকা প্রস্তুত করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন কর । |
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. যীশু দরিদ্রদের কী বলে সম্বোধন করেছেন ?
ক. দয়ালু
খ. দীন
গ. পীড়িত
ঘ. ধন্য
২. কেন যীশু খ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল ?
ক.পুরাতন নিয়ম বাতিল করতে
খ. পুরাতন নিয়ম পরিবর্তন করতে
গ. পুরাতন নিয়মের পূর্ণতা দিতে
ঘ. ঈশ্বরের গৌরব করতে
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি মি. জেমস এলাকার উন্নয়নে সর্বদা সচেষ্ট। এলাকার দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত পরিবারের লোকদের সবসময় খোঁজ খবর নেন, তাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে যান । গত বছর বড়দিন পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান সবাই তাকে প্রথমেই খাবার খেয়ে নিতে বলল । কিন্তু তিনি প্রথমে খাবার না খেয়ে সবাই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করল কি না তা লক্ষ করলেন । সবাইকে খাইয়ে তারপর তিনি খেলেন ।
৩. মি. জেমস এর মধ্যে কেমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে -
i. বিনয়ী
ii. নম্র
iii. আত্মত্যাগের
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i
খ. i ও ii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
৪. মি. জেমস এর এরূপ আচরণের ফলাফল কী হতে পারে
ক. শান্তি স্থাপন
খ. গর্ববোধ
গ. ক্ষমতা লাভ
ঘ. আত্মঅহংকার
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. সমাজে প্রচলিত ৩টি অন্যায্যতা উল্লেখ করে তার কুফল লেখ ।
২. সমাজ পরিবর্তনে সহিংস বিপ্লবের কুফল ব্যাখ্যা কর ।
৩. সমাজ পরিবর্তনে খ্রিষ্টের দেখানো পথ এক ব্যাখ্যা কর ।
৪ . খ্রিষ্টের শিক্ষা অনুসরণ করে কীভাবে পরিবর্তিত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় ?
৫. মহাত্মা গান্ধী অহিংসা দিয়ে শুধু দেশই জয় করেননি মানুষের হৃদয়কেও জয় করেছেন – কথাটি বুঝিয়ে লেখ ।
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. জীবন ও সুজন একই শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু একে অন্যের সাথে কথা বলে না, একসাথে বসে না, কেউ কাউকে কোনো কাজে সাহায্য সহযোগিতা করে না । একদিন সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে দুইজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে মারামারির পর্যায়ে চলে গেল । কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সুজন খবর পেল জীবন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । তখন সুজন জীবনকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে গেল । জীবন সুজনকে দেখে খুব খুশি হলো ।
ক. যীশু ক্রুশের উপর জীবন বিসর্জন দিয়ে মানুষের প্রতি কী প্রকাশ করেছেন ?
খ. প্রাচীনকালে অন্যায্যতাকে সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব হয়নি কেন ?
গ. যীশুর কোন শিক্ষা সুজনকে প্রভাবিত করেছে ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. সুজনের কর্মকাণ্ড সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে ? মূল্যায়ন কর ।
২. শতাব্দী হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে । প্রতিদিন সকালে সে গির্জায় যায়, হোস্টেলের নিয়মকানুন মনে চলে । একদিন সকালে গির্জায় যাবার সময় সে দেখতে পেল হোস্টেলের যে দিদি রান্না করে তার প্রচণ্ড জ্বর । তখন সে তার কাছে গিয়ে তাকে ঔষধ খাওয়ালো, মাথা ধুয়ে দিল । ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠল ।
ক. যীশু বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কী প্রচার করতেন ?
খ. সহিংসতার কুফল সম্পর্কে লেখ ।
গ. শতাব্দীর মধ্যে সমাজ পরিবর্তনে খ্রিষ্টের দেখানো কোন দিকটির প্রকাশ ঘটেছে ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. শতাব্দীর আচরণে প্রকাশ পেয়েছে যীশুর পথ অনুসরণ – কথাটি বিশ্লেষণ কর ।