On This Page
নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য - NCTB BOOK
Please, contribute to add content into গদ্য.
Content

আলী ইবনে আব্বাস নামে এক ব্যক্তি মামুন নামক খলিফার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহে খলিফার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, হস্তপদবদ্ধ এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে নীত হইলেন। খলিফা আমার প্রতি এই আজ্ঞা করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে আপন আলয়ে লইয়া গিয়া রুদ্ধ করিয়া রাখিবে এবং কল্য আমার নিকট উপস্থিত করিবে। তদীয় ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ যদি তিনি পলাইয়া যান, আমাকে খলিফার কোপে পতিত হইতে হইবে ।
কিয়ৎক্ষণ পরে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? তিনি বলিলেন, ডেমাস্কাস আমার জন্মস্থান; ঐ নগরের যে অংশে বৃহৎ মসজিদ আছে, তথায় আমার বাস। আমি বলিলাম, ডেমাস্কাস নগরের, বিশেষত যে অংশে আপনার বাস তাহার উপর, জগদীশ্বরের শুভদৃষ্টি থাকুক । ঐ অংশের অধিবাসী এক ব্যক্তি একসময় আমার প্রাণদান দিয়াছিলেন ।
আমার এই কথা শুনিয়া, তিনি সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত, ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম : বহু বৎসর পূর্বে ডেমাস্কাসের শাসনকর্তা পদচ্যুত হইলে, যিনি তদীয় পদে অধিষ্ঠিত হন, আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে তথায় গিয়াছিলাম। পদচ্যুত শাসনকর্তা বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আমি প্রাণভয়ে পলাইয়া, এক সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে প্রবিষ্ট হইলাম এবং গৃহস্বামীর নিকট গিয়া, অতি কাতর বচনে প্রার্থনা করিলাম, আপনি কৃপা করিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করুন। আমার প্রার্থনাবাক্য শুনিয়া গৃহস্বামী আমায় অভয় প্রদান করিলেন । আমি তদীয় আবাসে, এক মাসকাল নির্ভয়ে ও নিরাপদে অবস্থিতি করিলাম ।


একদিন আশ্রয়দাতা আমায় বলিলেন, এ সময়ে অনেক লোক বাগদাদ যাইতেছেন। স্বদেশে প্রতিগমনের পক্ষে আপনি ইহা অপেক্ষা অধিক সুবিধার সময় পাইবেন না। আমি সম্মত হইলাম। আমার সঙ্গে কিছুমাত্র অর্থ ছিল না, লজ্জাবশত আমি তাঁহার নিকট সে কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। তিনি, আমার আকার প্রকার দর্শনে, তাহা বুঝিতে পারিলেন, কিন্তু তৎকালে কিছু না বলিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।
তিনি আমার জন্য যে সমস্ত উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, প্রস্থান দিবসে তাহা দেখিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব সুসজ্জিত হইয়া আছে, আর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে খাদ্যসামগ্রী স্থাপিত হইয়াছে, আর পথে আমার পরিচর্যা করিবার নিমিত্ত, একটি ভৃত্য প্রস্থানার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। প্রস্থান সময় উপস্থিত হইলে, সেই দয়াময়, সদাশয়, আশ্রয়দাতা আমার হস্তে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলি দিলেন এবং আমাকে যাত্রীদের নিকটে লইয়া গেলেন। তন্মধ্যে যাহাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা ছিল, তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলেন। আমি আপনকার বসতি স্থানে এই সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। এ জন্য পৃথিবীতে যত স্থান আছে ঐ স্থান আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় ।
এই নির্দেশ করিয়া, দুঃখ প্রকাশপূর্বক আমি বলিলাম, আক্ষেপের বিষয় এই, আমি এ পর্যন্ত সেই দয়াময় আশ্রয়দাতার কখনো কোনো উদ্দেশ পাইলাম না। যদি তাঁহার নিকট কোনো অংশে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের অবসর পাই, তাহা হইলে মৃত্যুকালে আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না। এই কথা শুনিবামাত্র, তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, আপনার মনস্কাম পূর্ণ হইয়াছে। আপনি যে ব্যক্তির উল্লেখ করিলেন, সে এই। এই হতভাগ্যই আপনাকে, এক মাসকাল আপন আলয়ে রাখিয়াছিল ।
তাঁহার এই কথা শুনিয়া, আমি চমকিয়া উঠিলাম, সবিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম; আহ্লাদে পুলকিত হইয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আলিঙ্গন করিলাম; তাঁহার হস্ত ও পদ হইতে লৌহশৃঙ্খল খুলিয়া দিলাম এবং কী দুর্ঘটনাক্রমে তিনি খলিফার কোপে পতিত হইয়াছেন, তাহা জানিবার নিমিত্তে নিতান্ত ব্যগ্র হইলাম। তখন তিনি বলিলেন, কতিপয় নীচ প্রকৃতির লোক ঈর্ষাবশত শত্ৰুতা করিয়া খলিফার নিকট আমার ওপর উৎকট দোষারোপ করিয়াছে; তজ্জন্য তদীয় আদেশক্রমে হঠাৎ অবরুদ্ধ ও এখানে আনীত হইয়াছি; আসিবার সময় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদিগের সহিত দেখা করিতে দেয় নাই; বোধ করি আমার প্রাণদণ্ড হইবে। অতএব, আপনার নিকট বিনীত বাক্যে প্রার্থনা এই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার পরিবারবর্গের নিকট এই সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। তাহা হইলে আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।
তাঁহার এই প্রার্থনা শুনিয়া আমি বলিলাম, না, না, আপনি এক মুহূর্তের জন্যও প্রাণনাশের আশঙ্কা করিবেন না; আপনি এই মুহূর্ত হইতে স্বাধীন; এই বলিয়া পাথেয়স্বরূপ সহস্র স্বর্ণমুদ্রার একটি থলি তাঁহার হস্তে দিয়া বলিলাম, আপনি অবিলম্বে প্রস্থান করুন এবং স্নেহাস্পদ পরিবারবর্গের সহিত মিলিত হইয়া সংসারযাত্রা সম্পন্ন করুন। আপনাকে ছাড়িয়া দিলাম, এ জন্য আমার ওপর খলিফার মর্মান্তিক ক্রোধ ও দ্বেষ জন্মিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি আপনার প্রাণ রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সে জন্য আমি অণুমাত্র দুঃখিত হইব না ।


আমার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি বলিলেন, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি কখনই তাহাতে সম্মত হইতে পারিব না। আমি এত নীচাশয় ও স্বার্থপর নহি যে, কিছুকাল পূর্বে, যে প্রাণের রক্ষা করিয়াছি, আপন প্রাণরক্ষার্থে এক্ষণে সেই প্রাণের বিনাশের কারণ হইব। তাহা কখনও হইবে না। যাহাতে খলিফা আমার ওপর অক্রোধ হন, আপনি দয়া করিয়া তাহার যথোপযুক্ত চেষ্টা দেখুন; তাহা হইলেই আপনার প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইবে। যদি আপনার চেষ্টা সফল না হয়, তাহা হইলেও আমার কোনো ক্ষোভ থাকিবে না ।
পরদিন প্রাতঃকালে আমি খলিফার নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লোকটি কোথায়, তাহাকে আনিয়াছ? এই বলিয়া, তিনি ঘাতককে ডাকাইয়া, প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তখন আমি তাঁহার চরণে পতিত হইয়া বিনীত ও কাতর বচনে বলিলাম, ধর্মাবতার, ঐ ব্যক্তির বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে । অনুমতি হইলে সবিশেষ সমস্ত আপনকার গোচর করি। এই কথা শুনিবামাত্র তাঁহার কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি রোষরক্ত নয়নে বলিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া থাক, এই দণ্ডে তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। তখন আমি বলিলাম, আপনি ইচ্ছা করিলে, এই মুহূর্তে আমার ও তাহার প্রাণদণ্ড করিতে পারেন তাহার সন্দেহ কি । কিন্তু, আমি যে নিবেদন করিতে ইচ্ছা করিতেছি, কৃপা করিয়া তাহা শুনিলে, আমি চরিতার্থ হই ।
এই কথা শুনিয়া খলিফা উদ্ধত বচনে বলিলেন, কী বলিতে চাও, বল। তখন সে ব্যক্তি ডেমাস্কাস নগরে কীরূপে আশ্রয়দান ও প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন এবং এক্ষণে তাহাকে ছাড়িয়া দিতে চাহিলে, আমি অবধারিত বিপদে পড়িব, এ জন্য তাহাতে কোনোমতে সম্মত হইলেন না; এই দুই বিষয়ে সবিশেষ নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ধর্মাবতার, যে ব্যক্তির এরূপ প্রকৃতি ও এরূপ মতি, অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন দয়াশীল, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ ও সবিবেচক তিনি কখনই দুরাচার নহেন। নীচপ্রকৃতি পরহিংসুক দুরাত্মারা, ঈর্ষাবশত অমূলক দোষারোপ করিয়া তাহার সর্বনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে; নতুবা যাহাতে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, তিনি এরূপ কোনো দোষে দূষিত হইতে পারেন, আমার এরূপ বোধ ও বিশ্বাস হয় না। এ ক্ষেত্রে আপনার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন।
খলিফা মহামতি ও অতি উন্নতচিত্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি এই সকল কথা কর্ণগোচর করিয়া কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর প্রসন্ন বদনে বলিলেন, সে ব্যক্তি যে এরূপ দয়াশীল ও ন্যায়পরায়ণ, ইহা অবগত হইয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইলাম। তিনি প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইলেন। বলিতে গেলে, তোমা হইতেই তাহার প্রাণরক্ষা হইল । এক্ষণে তাহাকে অবিলম্বে এই সংবাদ দাও, ও আমার নিকটে লইয়া আইস।
এই কথা শুনিয়া আহ্লাদের সাগরে মগ্ন হইয়া আমি সত্বর গৃহে প্রত্যাগমনপূর্বক তাঁহাকে খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। খলিফা অবলোকনমাত্র, প্রীতি-প্রফুল্ললোচনে, সাদর বচনে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, তুমি যে এরূপ প্রকৃতির লোক, তাহা আমি পূর্বে অবগত ছিলাম না। দুষ্টমতি দুরাচারদিগের বাক্য বিশ্বাস করিয়া অকারণে তোমার প্রাণদণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম । এক্ষণে, ইহার নিকটে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় প্রীতিপ্রাপ্ত হইয়াছি। আমি অনুমতি দিতেছি, তুমি আপন আলয়ে প্রস্থান কর। এই বলিয়া, খলিফা, তাহাকে মহামূল্য পরিচ্ছদ, সুসজ্জিত দশ অশ্ব, দশ খচ্চর, দশ উষ্ট্র উপহার দিলেন এবং ডেমাস্কাসের রাজপ্রতিনিধির নামে এক অনুরোধপত্র ও পাথেয় স্বরূপ বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন ।

Content added By

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ‘বিদ্যাসাগর’ তাঁর উপাধি । তিনি ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। তিনি প্রথমে সংস্কৃত ও পরে ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দানশীলতার জন্য তিনি ‘দয়ার সাগর' নামেও পরিচিত। একাধারে পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক ও খ্যাতনামা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তিনি। সুশৃঙ্খল পদবিন্যাস, যথাযথভাবে যতিচিহ্ন প্ৰয়োগ এবং সাহিত্যিক গদ্য রচনার জন্য তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়ে থাকে। বাংলা বর্ণমালাকে নতুন বিন্যাসে সাজিয়ে ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেন শিশুপাঠ্য বই বর্ণপরিচয়। ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এ বই আজও পথপ্রদর্শক বিবেচিত হয়। বেতাল পঞ্চবিংশতি, ব্যাকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি তাঁর প্রধান গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

Content added || updated By

প্রত্যুপকার- উপকারীর প্রতি উপকার। অভিরুচি- ইচ্ছা। সমভিব্যাহারে- সঙ্গে নিয়ে। নিষ্কৃতি- মুক্তি। কোপানল- কোপ ও অনল মিলে কোপানল; ক্রোধ বা রাগের আগুন। এখানে যাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতীতি- বিশ্বাস। পরিচ্ছদ- পোশাক। প্রীতিপ্রফুল্ললোচনে- শব্দটিতে মূলত তিনটি শব্দ যুক্ত করা হয়েছে; প্রীতি, প্রফুল্ল ও লোচন—বন্ধুত্বের অনুভূতিতে আনন্দিত চোখে লোচন অর্থ চোখ। মৌনাবলম্বন- মৌন ও অবলম্বন মিলে মৌনাবলম্বন; অর্থাৎ নিরবতা পালন । অব্যাহতি- মুক্তি, ছাড়া পাওয়া। অবধারিত- নিশ্চিত। প্রত্যাগমন- ফিরে আসা। শব্দটি গঠিত দুটি শব্দ মিলে: প্রতি ও আগমন। রোষারক্ত নয়নে- ক্রোধে লাল চোখে।

অবলোকনমাত্র- দেখামাত্র। সম্ভাষণ- সম্বোধন। উৎকট- অত্যন্ত প্রবল, তীব্র। অবরুদ্ধ- বন্দি। নিরীক্ষণ- মনোযোগ দিয়ে দেখা । খলিফা- প্রতিনিধি । হযরত মুহম্মদ (স.)-এর পরে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান শাসনকর্তাকে ‘খলিফা” বলা হতো। তিনি একাধারে রাজ্যের প্রধান শাসক ও ধর্মনেতা ছিলেন ।
ডেমাস্কাস- দামেস্ক। এশিয়ার একটি প্রাচীন শহর। হযরত ইব্রাহিমের (আ.) যুগের পূর্বে এখানে শহর গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী ।
মামুন- আল মামুন নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ আল মামুন (৭৮৬-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি ছিলেন সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা এবং খলিফা হারুনর রশীদের দ্বিতীয় পুত্র। বাগদাদ- বর্তমান ইরাকের রাজধানী। খলিফা হারুনর রশীদের সময় বাগদাদ মুসলিম সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। টাইগ্রিস নদীর উভয় তীরে এবং ফুরাত বা ইউফ্রেটিস নদীর পঁচিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনর রশীদের সময় বাগদাদ মুসলিম সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। বর্তমানে ইরাকের রাজধানী ।

Content added By

‘প্রত্যুপকার' রচনাটি আখ্যানমঞ্জরী দ্বিতীয় ভাগ থেকে সংকলন করা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আখ্যানমঞ্জরী রচিত হয় ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে । বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের জীবনের গৌরবদীপ্ত ঘটনাই এ গ্রন্থের বিভিন্ন রচনার উপজীব্য। ‘প্রত্যুপকার’ আলী আব্বাস নামক এক ব্যক্তির প্রতি-উপকারের কাহিনি। খলিফা মামুনের সময়কালে দামেস্কের জনৈক শাসনকর্তা পদচ্যুত হন । নতুন শাসনকর্তা মামুনের একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন আলী ইবনে আব্বাস । তিনি স্থানীয় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কাছে আশ্রয়লাভ করে জীবন রক্ষা করেন। পরবর্তীকালে আলী ইবনে আব্বাসের আশ্রয়দাতা ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি খলিফা মামুনের সৈন্যদল কর্তৃক বন্দি হন এবং খলিফার নির্দেশে আলী ইবনে আব্বাসের গৃহে তাকে অন্তরীণ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আলী ইবনে আব্বাস বন্দি ব্যক্তির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে উপকারীর উপকারের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করেন এবং খলিফার কাছে তার মুক্তির জন্য সুপারিশ করেন। বস্তুত এ রচনায় দুজন মহৎ ব্যক্তির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তাদের একজন নিঃস্বার্থ উপকারী, অন্যজন সকৃতজ্ঞ প্রত্যুপকারী। খলিফার মহত্ত্বও এ রচনায় প্রকাশিত হয়েছে।

Content added By

বৈশাখ মাস বিবাহের মাস। আমি ১লা বৈশাখে নসী বাবুর ফুলবাগানে বসিয়া একটি বিবাহ দেখিলাম । ভবিষ্যৎ বরকন্যাদিগের শিক্ষার্থ লিখিয়া রাখিতেছি।
মল্লিকা ফুলের বিবাহ। বৈকাল-শৈশব অবসানপ্রায়, কলিকা-কন্যা বিবাহযোগ্যা হইয়া আসিল । কন্যার পিতা বড়োলোক নহে, ক্ষুদ্র বৃক্ষ, তাহাতে আবার অনেকগুলি কন্যাভারগ্রস্ত। সম্বন্ধের অনেক কথা হইতেছিল, কিন্তু কোনটা স্থির হয় নাই। উদ্যানের রাজা স্থলপদ্ম নির্দোষ পাত্র বটে, কিন্তু ঘর বড়ো উঁচু, স্থলপদ্ম অত দূর নামিল না। জবা এ বিবাহে অসম্মত ছিল না, কিন্তু জবা বড়ো রাগী, কন্যাকর্তা পিছাইলেন । গন্ধরাজ পাত্র ভালো, কিন্তু বড়ো দেমাগ, প্রায় তাঁহার বর পাওয়া যায় না। এইরূপ অব্যবস্থার সময়ে ভ্রমররাজ ঘটক হইয়া মল্লিকা-বৃক্ষসদনে উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিয়া বলিলেন, ‘গুণ ! গুণ ! গুণ মেয়ে আছে?'
মল্লিকাবৃক্ষ পাতা নাড়িয়া সায় দিলেন, ‘আছে!' ভ্রমর পত্রাসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, ‘গুণ গুণ গুণ! গুণ গুণাগুণ! মেয়ে দেখিব।'
বৃক্ষ, শাখা নত করিয়া মুদিতনয়না অবগুণ্ঠনবতী কন্যা দেখাইলেন ।
ভ্রমর একবার বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘গুণ্ ! গুণ! গুণ ! গুণ দেখিতে চাই। ঘোমটা খোল ৷
লজ্জাশীলা কন্যা কিছুতেই ঘোমটা খুলে না। বৃক্ষ বলিলেন, ‘আমার মেয়েগুলি বড়ো লাজুক। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি মুখ দেখাইতেছি।'

ভ্রমর ভোঁ করিয়া স্থলপদ্মের বৈঠকখানায় গিয়া রাজপুত্রের সঙ্গে ইয়ারকি করিতে বসিলেন। এদিকে মল্লিকার সন্ধ্যাঠাকুরাণী-দিদি আসিয়া তাহাকে কত বুঝাইতে লাগিল— বলিল, “দিদি, একবার ঘোমটা খোল– নইলে, বর আসিবে না – লক্ষ্মী আমার, চাঁদ আমার, সোনা আমার, ইত্যাদি ।' কলিকা কতবার ঘাড় নাড়িল, কতবার রাগ করিয়া মুখ ঘুরাইল, কতবার বলিল, 'ঠান্‌দিদি, তুই যা !' কিন্তু শেষে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ স্বভাবে মুগ্ধ হইয়া মুখ খুলিল। তখন ঘটক মহাশয় ভোঁ করিয়া রাজবাড়ি হইতে নামিয়া আসিয়া ঘটকালিতে মন দিলেন। কন্যার পরিমলে মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, ‘গুণ গুণ গুণ গুণ গুণাগুণ ! কন্যা গুণবতী বটে । ঘরে মধু কত?’
কন্যাকর্তা বৃক্ষ বলিলেন, 'ফর্দ দিবেন, কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিবে।' ভ্রমর বলিলেন, ‘গুণ গুণ, আপনার অনেক গুণ — ঘটকালিটা?'
কন্যাকর্তা শাখা নাড়িয়া সায় দিল, 'তাও হবে।'
ভ্রমর— 'বলি ঘটকালির কিছু আগাম দিলে হয় না?' নগদ দান বড়ো গুণ-গুণ গুণ গুণ ।’ ক্ষুদ্র বৃক্ষটি তখন বিরক্ত হইয়া, সকল শাখা নাড়িয়া বলিল, আগে বরের কথা বল— বর কে?’ ভ্রমর— ‘বর অতি সুপাত্র।— তাঁর অনেক গুণ-- ণ।'
এ সকল কথোপকথন মনুষ্যে শুনিতে পায় না, আমি কেবল দিব্য কর্ণ পাইয়াই এ সকল শুনিতেছিলাম । আমি শুনিতে লাগিলাম, কুলাচার্য মহাশয়, পাখা ঝাড়িয়া, ছয় পা ছড়াইয়া গোলাবের মহিমা কীর্তন করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন যে, গোলাব বংশ বড়ো কুলীন; কেন না, ইহারা ‘ফুলে’ মেল। যদি বল, সকল ফুলই ফুলে, তথাপি গোলাবের গৌরব অধিক; কেন না, ইহারা সাক্ষাৎ বাঞ্ছামালির সন্তান; তাহার স্বহস্তরোপিত । যদি বল, এ ফুলে কাঁটা আছে, কোন্ কুলে বা কোন্ ফুলে নাই ?
যাহা হউক, ঘটকরাজ কোনরূপে সম্বন্ধ স্থির করিয়া, বোঁ করিয়া উড়িয়া গিয়া, গোলাব বাবুর বাড়িতে খবর দিলেন। গোলাব, তখন বাতাসের সঙ্গে নাচিয়া নাচিয়া, হাসিয়া হাসিয়া, লাফাইয়া লাফাইয়া খেলা করিতেছিল, বিবাহের নাম শুনিয়া আহ্লাদিত হইয়া কন্যার বয়স জিজ্ঞাসা করিল। ভ্রমর বলিল, ‘আজি কালি ফুটিবে।'
গোধূলি লগ্ন উপস্থিত, গোলাব বিবাহে যাত্রার উদ্‌যোগ করিতে লাগিলেন । উচ্চিঙ্গড়া নহবৎ বাজাইতে আরম্ভ করিল ; মৌমাছি সানাইয়ের বায়না লইয়াছিল, কিন্তু রাতকানা বলিয়া সঙ্গে যাইতে পারিল না। খদ্যোতেরা ঝাড় ধরিল ; আকাশে তারাবাজি হইতে লাগিল। কোকিল আগে আগে ফুকরাইতে লাগিল। অনেক বরযাত্রী চলিল; স্বয়ং রাজকুমার স্থলপদ্ম দিবাবসানে অসুস্থকর বলিয়া আসিতে পারিলেন না, কিন্তু জবাগোষ্ঠী— শ্বেত জবা, রক্ত জবা, জরদ জবা প্রভৃতি সবংশে আসিয়াছিল । করবীদের দল, সেকেলে রাজাদিগের মতো বড়ো উচ্চ ডালে চড়িয়া আসিয়া উপস্থিত হইল । সেঁউতি নীতবর হইবে বলিয়া, সাজিয়া আসিয়া দুলিতে লাগিল। গরদের জোড় পরিয়া চাঁপা আসিয়া দাঁড়াইল – উগ্র গন্ধ ছুটিতে লাগিল। গন্ধরাজেরা বড়ো বাহার দিয়া, দলে দলে আসিয়া, গন্ধ বিলাইয়া দেশ মাতাইতে লাগিল। অশোক নেশায় লাল হইয়া আসিয়া উপস্থিত; সঙ্গে একপাল পিপড়া মোসায়েব হইয়া আসিয়াছে; তাহাদের গুণের সঙ্গে সম্বন্ধ নাই, কিন্তু দাঁতের জ্বালা বড়ো- কোন বিবাহে না এরূপ বরযাত্রী জোটে, আর কোন বিবাহে না তাহারা হুল ফুটাইয়া বিবাদ বাধায়? কুরুবক কুটজ প্রভৃতি আরও অনেক বরযাত্রী আসিয়াছিলেন, ঘটক মহাশয়ের কাছে তাঁহাদের পরিচয় শুনিবেন। সর্বত্রই তিনি যাতায়াত করেন এবং কিছু কিছু মধু পাইয়া থাকেন ।
আমারও নিমন্ত্রণ ছিল, আমিও গেলাম। দেখি, বরপক্ষের বড়ো বিপদ। বাতাস বাহকের বায়না লইয়াছিলেন; তখন হুঁ-হুম করিয়া অনেক মর্দানি করিয়াছিলেন, কিন্তু কাজের সময় কোথায় লুকাইলেন, কেহ খুঁজিয়া পায় না। দেখিলাম, বর বরযাত্রী, সকলে অবাক হইয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। মল্লিকাদিগের কুল যায় দেখিয়া, আমিই বাহকের কার্য স্বীকার করিলাম। বর, বরযাত্রী সকলকে তুলিয়া লইয়া মল্লিকাপুরে গেলাম ।
সেখানে দেখিলাম, কন্যাকুল, সকল ভগিনী, আহ্লাদে ঘোমটা খুলিয়া মুখ ফুটাইয়া, পরিমল ছুটাইয়া, সুখের হাসি হাসিতেছে। দেখিলাম, পাতায় পাতায় জড়াজড়ি, গন্ধের ভাণ্ডারে ছড়াছড়ি পড়িয়া গিয়াছে —রূপের ভারে সকলে ভাঙিয়া পড়িতেছে। যূথি, মালতী, বকুল, রজনীগন্ধা প্রভৃতি এয়োগণ স্ত্রী-আচার করিয়া বরণ করিল । দেখিলাম, পুরোহিত উপস্থিত; নসী বাবুর নবমবর্ষীয়া কন্যা (জীবন্ত কুসুমরূপিণী) কুসুমলতা সূচ সুতা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে; কন্যাকর্তা কন্যা সম্প্রদান করিলেন; পুরোহিত মহাশয় দুইজনকে এক সূতায় গাঁথিয়া গাঁটছড়া বাঁধিয়া দিলেন ।
তখন বরকে বাসর-ঘরে লইয়া গেল। কত যে রসময়ী মধুময়ী সুন্দরী সেখানে বরকে ঘিরিয়া বসিল, তাহা কি বলিব। প্রাচীনা ঠাকুরাণীদিদি টগর সাদা প্রাণে বাঁধা রসিকতা করিতে করিতে শুকাইয়া উঠিলেন । রঙ্গণের রাঙ্গামুখে হাসি ধরে না। যুই, কন্যের সই, কন্যের কাছে গিয়া শুইল; রজনীগন্ধাকে বর তাড়কা রাক্ষসী বলিয়া কতো তামাসা করিল; বকুল একে বালিকা, তাতে যত গুণ, তত রূপ নহে; এককোণে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; আর ঝুমকা ফুল বড়ো মানুষের গৃহিণীর মতো মোটা নীল শাড়ি ছড়াইয়া জমকাইয়া বসিল । তখন—
‘কমলকাকা—ওঠ বাড়ি যাই- রাত হয়েছে, ও কি, ঢুলে পড়বে যে?' কুসুমলতা এই কথা বলিয়া আমার গা ঠেলিতেছিল; – চমক হইলে, দেখিলাম কিছুই নাই। সেই পুষ্পবাসর কোথায় মিশিল? – মনে - করিলাম, সংসার অনিত্যই বটে— এই আছে এই নাই। সে রম্য বাসর কোথায় গেল, – সেই হাস্যমুখী শুভ্রস্মিতসুধাময়ী পুষ্পসুন্দরীসকল কোথায় গেল? যেখানে সব যাইবে, সেইখানে— স্মৃতির দর্পণতলে, ভূতসাগরগর্ভে। যেখানে রাজা প্রজা, পর্বত সমুদ্র, গ্রহ নক্ষত্রাদি গিয়াছে বা যাইবে, সেইখানে – ধ্বংসপুরে! এই বিবাহের ন্যায় সব শূন্যে মিশাইবে, সব বাতাসে গলিয়া যাইবে । কুসুম বলিল, “ওঠ না— কি কচ্চো?
আমি বলিলাম, ‘দূর পাগলি, আমি বিয়ে দিচ্ছিলাম।'

কুসুম ঘেঁষে এসে, হেসে হেসে কাছে দাঁড়াইয়া আদর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কার বিয়ে, কাকা ?” আমি বলিলাম, ‘ফুলের বিয়ে।'
‘ওঃ পোড়া কপাল, ফুলের? আমি বলি কি! আমিও যে এই ফুলের বিয়ে দিয়েছি।'
'কই?'
‘এই যে মালা গেথেঁছি ।' দেখিলাম, সেই মালায় আমার বর কন্যা রহিয়াছে।

 

Content added || updated By

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৬শে জুন ১৮৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সে বছরই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকরিতে নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্ৰ তেত্রিশ বছর একই পদে চাকরি করে ১৮৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পাঠ্যাবস্থায়ই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে বাংলা উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ হিসেবে। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী বাংলা কথাসাহিত্যে এক নবদিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হলো : কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারানী, চন্দ্রশেখর, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম। প্রবন্ধ-সাহিত্যেও বঙ্কিমচন্দ্র কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য, কৃষ্ণ চরিত্র ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

Content added || updated By

কন্যাভারগ্রস্ত - বিবাহযোগ্যা কন্যা বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বহনকারী অর্থে।সম্বন্ধের - বিয়ের। কন্যাকর্তা - কন্যার অভিভাবক। পত্রাসন – পাতার ওপর আসন। অবগুণ্ঠনবতী — ঘোমটা দেওয়া। ইয়ারকি – বন্ধুদের সঙ্গেই করা চলে এমন আলাপ। সন্ধ্যাঠাকুরাণী দিদি – এখানে সন্ধ্যাকালকে দিদি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। পরিমল – সুগন্ধ। গন্ধোপাধ্যায় - গন্ধের রাজা বোঝাতে। কুলাচার্য – কুলের আচার্য বা বংশের প্রধান পুরোহিত। বাঞ্ছামালি – যে মালি ইচ্ছামতো ফুল ফোটাতে পারে। খদ্যোত - জোনাকি পোকা। এয়োগণ - সধবা নারী। কমলকাকা - কমলাকান্তকে কাকা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

Content added By

এই রচনায় হাস্যরসের মাধ্যমে বিভিন্ন ফুলের নাম, সে ফুলগুলোর গন্ধের তারতম্য, বর্ণের রকমফের অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন বঙ্কিমচন্দ্র । কখন কোন ফুল ফোটে সে পর্যবেক্ষণও এই রচনায় পাওয়া যায়। বিয়ে-অনুষ্ঠান বাঙালির জীবনে, বিশেষ করে বাড়ির শিশু-কিশোর ও প্রতিবেশীদের মধ্যে অতীব আনন্দ নিয়ে আসে। এই অনুষ্ঠানে বর-কনে কেন্দ্রে থাকলেও বর-কনের মাতা-পিতা, কনের পড়শি নারীরা নানা মাঙ্গলিক ব্রতে সম্পৃক্ত থাকেন, ঘটকও থাকেন বিশেষভাবে যুক্ত। বিয়ে অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এমন নানা ব্যক্তির পরিবর্তে বিভিন্ন ফুলের উল্লেখ করে অসাধারণ দক্ষতায় বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির গার্হস্থ্য একটি অনুষ্ঠানকে আরো আনন্দদায়ক করে এখানে উপস্থাপন করেছেন। এখানে লেখক প্রকৃতিকে বাস্তব জীবনে উপস্থাপনে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই রচনাভঙ্গি ও সাহিত্যবোধ বাংলা গদ্য সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘ফুলের বিবাহ’ গদ্যটি কৌতূহলী ও পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়ক

Content added By

মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হইবে। তাহার দুটি বড়ো বোনকে সুকেশিনী ও সুহাসিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরোধে তাহার বাপ ছোটো মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখে । এখন সকলে তাহাকে সংক্ষেপে সুভা বলে ।
দস্তুরমত অনুসন্ধান ও অর্থব্যয়ে বড়ো দুটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গেছে, এখন ছোটোটি পিতামাতার নীরব হৃদয়ভারের মতো বিরাজ করিতেছে।
যে কথা কয় না সে যে অনুভব করে ইহা সকলের মনে হয় না, এইজন্য তাহার সাক্ষাতেই সকলে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিত। সে যে বিধাতার অভিশাপস্বরূপে তাহার পিতৃগৃহে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে এ কথা সে শিশুকাল হইতে বুঝিয়া লইয়াছিল। তাহার ফল এই হইয়াছিল, সাধারণের দৃষ্টিপথ হইতে সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতে সর্বদাই চেষ্টা করিত। মনে করিত, আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচি । কিন্তু, বেদনা কি কেহ কখনো ভোলে? পিতামাতার মনে সে সর্বদাই জাগরূক ছিল ।
বিশেষত, তাহার মা তাহাকে নিজের একটা ত্রুটিস্বরূপ দেখিতেন; কেননা, মাতা পুত্র অপেক্ষা কন্যাকে নিজের অংশরূপে দেখেন— কন্যার কোনো অসম্পূর্ণতা দেখিলে সেটা যেন বিশেষরূপে নিজের লজ্জার কারণ বলিয়া মনে করেন। বরঞ্চ, কন্যার পিতা বাণীকণ্ঠ সুভাকে তাঁহার অন্য মেয়েদের অপেক্ষা যেন একটু বেশি ভালোবাসিতেন; কিন্তু মাতা তাহাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক জ্ঞান করিয়া তাহার প্রতি বড়ো বিরক্ত ছিলেন। সুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ ছিল এবং তাহার ওষ্ঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া উঠিত।
কথায় আমরা যেভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতো; সকল সময়ে ঠিক হয় না, ক্ষমতার অভাবে অনেক সময়ে ভুলও হয়। কিন্তু কালো চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না- মন আপনি তাহার উপরে ছায়া ফেলে; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনো প্রসারিত কখনো মুদিত হয়, কখনো উজ্জ্বলভাবে জ্বলিয়া উঠে, কখনো ম্লানভাবে নিবিয়া আসে, কখনো অস্তমান চন্দ্রের মতো অনিমেষভাবে চাহিয়া থাকে, কখনো দ্রুত চঞ্চল বিদ্যুতের মতো দিগ্‌বদিকে ঠিকরিয়া উঠে। মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নাই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর— অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াস্ত এবং ছায়ালোকের নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না। সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন ।
গ্রামের নাম চণ্ডীপুর। নদীটি বাংলাদেশের একটি ছোটো নদী, গৃহস্থঘরের মেয়েটির মতো, বহুদূর পর্যন্ত তাহার প্রসার নহে; নিরলসা তন্বী নদীটি আপন কূল রক্ষা করিয়া কাজ করিয়া যায়; দুই ধারের গ্রামের সকলেরই সঙ্গে তাহার যেন একটা-না-একটা সম্পর্ক আছে । দুই ধারে লোকালয় এবং তরুচ্ছায়াঘন উচ্চ তট; নিম্নতল দিয়া গ্রামলক্ষ্মী স্রোতস্বিনী আত্মবিস্মৃত দ্রুত পদক্ষেপে প্রফুল্ল হৃদয়ে আপনার অসংখ্য কল্যাণকার্যে চলিয়াছে ।
বাণীকণ্ঠের ঘর নদীর একেবারে উপরেই। তাহার বাঁখারির বেড়া, আটচালা, গোয়ালঘর, ঢেঁকিশালা, খড়ের স্তূপ, তেঁতুলতলা, আম কাঁঠাল এবং কলার বাগান নৌকাবাহী-মাত্রেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গার্হস্থ্য সচ্ছলতার মধ্যে বোবা মেয়েটি কাহারও নজরে পড়ে কি না জানি না, কিন্তু কাজকর্মে যখনই অবসর পায় তখনই সে এই নদীতীরে আসিয়া বসে।
প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর— সমস্ত মিশিয়ে চারিদিকের চলাফেরা- আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়- উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা – বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লববিশিষ্ট সুভার যেভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিল্লিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গি, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস ।
এবং মধ্যাহ্নে যখন মাঝিরা জেলেরা খাইতে যাইত, গৃহস্থেরা ঘুমাইত, পাখিরা ডাকিত না, খেয়া-নৌকা বন্ধ থাকিত, সজন জগৎ সমস্ত কাজকর্মের মাঝখানে সহসা থামিয়া গিয়া ভয়ানক বিজনমূর্তি ধারণ করিত, তখন রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোবা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখামুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত— একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে, আর-একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায় ।

সুভার যে গুটিকতক অন্তরঙ্গ বন্ধুর দল ছিল না তাহা নহে। গোয়ালের দুটি গাভী, তাহাদের নাম সর্বশী ও পাঙ্গুলি। সে নাম বালিকার মুখে তাহারা কখনো শুনে নাই, কিন্তু তাহার পদশব্দ তাহারা চিনিত— তাহার কথাহীন একটা করুণ সুর ছিল, তাহার মর্ম তাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে বুঝিত । সুভা কখন তাহাদের আদর করিতেছে, কখন ভর্ৎসনা করিতেছে, কখন মিনতি করিতেছে, তাহা তাহারা মানুষের অপেক্ষা ভালো বুঝিতে পারিত ৷
সুভা গোয়ালে ঢুকিয়া দুই বাহুর দ্বারা সর্বশীর গ্রীবা বেষ্টন করিয়া তাহার কানের কাছে আপনার গণ্ডদেশ ঘর্ষণ করিত এবং পাঙ্গুলি স্নিগ্ধদৃষ্টিতে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহার গা চাটিত। বালিকা দিনের মধ্যে নিয়মিত তিনবার করিয়া গোয়ালঘরে যাইত, তাহা ছাড়া অনিয়মিত আগমনও ছিল; গৃহে যেদিন কোনো কঠিন কথা শুনিত সেদিন সে অসময়ে তাহার এই মূক বন্ধু দুটির কাছে আসিত- তাহার সহিষ্ণুতাপরিপূর্ণ বিষাদশান্ত দৃষ্টিপাত হইতে তাহারা কী একটা অন্ধ অনুমানশক্তির দ্বারা বালিকার মর্মবেদনা যেন বুঝিতে পারিত, এবং সুভার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া অল্পে অল্পে তাহার বাহুতে শিং ঘষিয়া ঘষিয়া তাহাকে নির্বাক ব্যাকুলতার সহিত সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত।
ইহারা ছাড়া ছাগল এবং বিড়ালশাবকও ছিল; কিন্তু তাহাদের সহিত সুভার এরূপ সমকক্ষভাবে মৈত্রী ছিল না, তথাপি তাহারা যথেষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করিত। বিড়ালশিশুটি দিনে এবং রাত্রে যখন- তখন সুভার গরম কোলটি নিঃসংকোচে অধিকার করিয়া সুখনিদ্রার আয়োজন করিত এবং সুভা তাহার গ্রীবা ও পৃষ্ঠে কোমল অঙ্গুলি বুলাইয়া দিলে যে তাহার নিদ্রাকর্ষণের বিশেষ সহায়তা হয়, ইঙ্গিতে এরূপ অভিপ্রায়ও প্রকাশ করিত ৷
উন্নত শ্রেণির জীবের মধ্যে সুভার আরো একটি সঙ্গী জুটিয়াছিল। কিন্তু তাহার সহিত বালিকার ঠিক কিরূপ সম্পর্ক ছিল তাহা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ, সে ভাষাবিশিষ্ট জীব; সুতরাং উভয়ের মধ্যে সমভাষা ছিল না ।
গোঁসাইদের ছোটো ছেলেটি— তাহার নাম প্রতাপ । লোকটি নিতান্ত অকর্মণ্য। সে যে কাজকর্ম করিয়া সংসারের উন্নতি করিতে যত্ন করিবে, বহু চেষ্টার পর বাপ-মা সে আশা ত্যাগ করিয়াছেন । অকর্মণ্য লোকের একটা সুবিধা এই যে, আত্মীয় লোকেরা তাহাদের উপর বিরক্ত হয় বটে, কিন্তু প্ৰায় তাহারা নিঃসম্পর্ক লোকদের প্রিয়পাত্র হয়— কারণ, কোনো কার্যে আবন্ধ না থাকাতে তাহারা সরকারি সম্পত্তি হইয়া দাঁড়ায়। শহরের যেমন এক-আধটা গৃহসম্পর্কহীন সরকারি বাগান থাকা আবশ্যক তেমনি গ্রামে দুই-চারিটা অকর্মণ্য সরকারি লোক থাকার বিশেষ প্রয়োজন। কাজে-কর্মে আমোদে অবসরে যেখানে একটা লোক কম পড়ে সেখানেই তাহাদিগকে হাতের কাছে পাওয়া যায় ।
প্রতাপের প্রধান শখ- ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরা। ইহাতে অনেক সময় সহজে কাটানো যায়। অপরাহ্ণে নদীতীরে ইহাকে প্রায় এই কাজে নিযুক্ত দেখা যাইত । এবং এই উপলক্ষে সুভার সহিত তাহার প্রায় সাক্ষাৎ হইত । যে-কোনো কাজেই নিযুক্ত থাক, একটা সঙ্গী পাইলে প্রতাপ থাকে ভালো । মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ— এইজন্য প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝিত । এইজন্য, সকলেই সুভাকে সুভা বলিত, প্রতাপ আর-একটু অতিরিক্ত আদর সংযোগ করিয়া সুভাকে ‘সু’ বলিয়া ডাকিত ।

সুভা তেঁতুলতলায় বসিয়া থাকিত এবং প্রতাপ অনতিদূরে ছিপ ফেলিয়া জলের দিকে চাহিয়া থাকিত। প্রতাপের জন্য একটি করিয়া পান বরাদ্দ ছিল, সুভা তাহা নিজে সাজিয়া আনিত। এবং বোধ করি অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চাহিয়া ইচ্ছা করিত, প্রতাপের কোনো-একটা বিশেষ সাহায্য করিতে, একটা-কোনো কাজে লাগিতে, কোনোমতে জানাইয়া দিতে যে এই পৃথিবীতে সেও একজন কম প্রয়োজনীয় লোক নহে। কিন্তু কিছুই করিবার ছিল না। তখন সে মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করিত— মন্ত্রবলে সহসা এমন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাইতে ইচ্ছা করিত যাহা দেখিয়া প্রতাপ আশ্চর্য হইয়া যাইত, বলিত, ‘তাই তো, আমাদের সুভির যে এত ক্ষমতা তাহা তো জানিতাম না ।'
মনে করো, সুভা যদি জলকুমারী হইত; আস্তে আস্তে জল হইতে উঠিয়া একটা সাপের মাথার মণি ঘাটে রাখিয়া যাইত; প্রতাপ তাহার তুচ্ছ মাছধরা রাখিয়া সেই মানিক লইয়া জলে ডুব মারিত; এবং পাতালে গিয়া দেখিত, রুপার অট্টালিকায় সোনার পালঙ্কে—কে বসিয়া? – আমাদের বাণীকণ্ঠের ঘরের সেই বোবা মেয়ে সু— আমাদের সু সেই মণিদীপ্ত গভীর নিস্তব্ধ পাতালপুরীর একমাত্র রাজকন্যা। তাহা কি হইতে পারিত না, তাহা কি এতই অসম্ভব। আসলে কিছুই অসম্ভব নয়, কিন্তু তবুও সু প্রজাশূন্য পাতালের রাজবংশে না জন্মিয়া বাণীকণ্ঠের ঘরে আসিয়া জন্মিয়াছে এবং গোঁসাইদের ছেলে প্রতাপকে কিছুতেই আশ্চর্য করিতে পারিতেছে না ।
সুভার বয়স ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতেছে। ক্রমে সে যেন আপনাকে আপনি অনুভব করিতে পারিতেছে। যেন কোনো একটা পূর্ণিমাতিথিতে কোনো-একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে । সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে,ভাবিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে, এবং বুঝিতে পারিতেছে না ।
গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখে পূর্ণিমাপ্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া— যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমন— কি, তাহা অতিক্রম করিয়াও ধমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া ।
এ দিকে কন্যাভারগ্রস্ত পিতামাতা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছেন। লোকেও নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে । এমন-কি, এক-ঘরে করিবে এমন জনরবও শুনা যায়। বাণীকণ্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুই বেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিল।
স্ত্রীপুরুষে বিস্তর পরামর্শ হইল । কিছুদিনের মতো বাণী বিদেশে গেল । অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “চলো, কলিকাতায় চলো।”

বিদেশযাত্রার উদ্‌যোগ হইতে লাগিল। কুয়াশা-ঢাকা প্রভাতের মতো সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে একেবারে ভরিয়া গেল। একটা অনির্দিষ্ট আশঙ্কা বশে সে কিছুদিন হইতে ক্রমাগত নির্বাক জন্তুর মতো তাহার বাপ-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত- ডাগর চক্ষু মেলিয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়া কী— একটা বুঝিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু তাঁহারা কিছু বুঝাইয়া বলিতেন না ।
ইতিমধ্যে একদিন অপরাহ্ণে ছিপ ফেলিয়া প্রতাপ হাসিয়া কহিল, “কী রে সু, তোর নাকি বর পাওয়া গেছে, তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস? দেখিস আমাদের ভুলিস নে।” বলিয়া আবার মাছের দিকে মনোযোগ করিল ।
মর্মবিদ্ধ হরিণী ব্যাধের দিকে যেমন করিয়া তাকায়, নীরবে বলিতে থাকে ‘আমি তোমার কাছে কী দোষ করিয়াছিলাম', সুভা তেমনি করিয়া প্রতাপের দিকে চাহিল; সেদিন গাছের তলায় আর বসিল না; বাণীকণ্ঠ নিদ্রা হইতে উঠিয়া শয়নগৃহে তামাক খাইতেছিলেন, সুভা তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল । অবশেষে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়া বাণীকণ্ঠের শুষ্ক কপোলে অশ্রু গড়াইয়া পড়িল ।
কাল কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির হইয়াছে। সুভা গোয়ালঘরে তাহার বাল্য-সখীদের কাছে বিদায় লইতে গেল, তাহাদিগকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া, গলা ধরিয়া একবার দুই চোখে যত পারে কথা ভরিয়া তাহাদের মুখের দিকে চাহিল— দুই নেত্রপল্লব হইতে টপ টপ করিয়া অশ্রুজল পড়তে লাগিল ।
সেদিন শুক্লাদ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে শষ্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল— যেন ধরণীকে, এই প্রকাণ্ড মূক মানবতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, ‘তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।' [সংক্ষেপিত]

Content added By

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বিষয়। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি। বাল্যকালেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি Gitanjali : Song Offerings সংকলনের জন্য এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা। কাব্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Content added By

গর্ভের কলঙ্ক – সন্তান হিসেবে কলঙ্ক, গর্ভ হলো মায়ের পেট যে ব্যক্তি বা বস্তুকে পরিবারে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয় তা হলো কলঙ্ক।

সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট - বড়ো পাতাবিশিষ্ট, দীর্ঘ হলো বড়ো, ‘সু’ যুক্ত হয়ে ‘বড়ো’কে বিশেষায়িত করা হয়েছে। পল্লব হলো পাতা। এখানে চোখের পাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ওষ্ঠাধর – ওষ্ঠ এবং অধর, উপরের ও নিচের ঠোঁট [ওষ্ঠ+অধর = ওষ্ঠাধর] কিশলয় - গাছের নতুন পাতা। তর্জমা – অনুবাদ, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় বলা বা লেখা । অস্তমান – · ডুবন্ত, ডুবে যাচ্ছে এমন, চন্দ্র-সূর্যের পশ্চিম দিকে অদৃশ্য অবস্থা। অনিমেষ – অপলক, পলকহীন, উদয়াস্ত – উদয় + অস্ত = উদয়াস্ত, আবির্ভাব ও তিরোভাব, উঠা ও ডুবা । ছায়ালোক - ছায়া + আলোক = ছায়ালোক। কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে যে প্রতিবিম্ব হয় তা হলো ছায়া। বিজন – জনশূন্য, নির্জন। মহত্ত্ব - অবদান। বিজন মহত্ত্ব – কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির অবস্থার যে আকর্ষণীয় দিক। তন্বী – ক্ষীণ ও সুগঠিত অঙ্গবিশিষ্ট। বাঁখারি - কাঁধের দুদিকে দুপ্রান্তে ঝুলিয়ে বোঝা বহনের বাঁশের ফালি। ঢেঁকিশালা – যে ঘরে ঢেঁকি রাখা হয়। ঢেঁকি হলো ধান থেকে চাল তৈরির লোকজ যন্ত্র । এখনো গ্রামীণ জীবনে অনেক বাড়িতে ঢেঁকির ঘর আছে। গার্হস্থ্য সচ্ছলতা - পারিবারিক দৈনন্দিন জীবনের সচ্ছলতা। চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূল – শান্ত হৃদয়। নিস্তব্ধ হলো আলোড়নহীন অবস্থা। উপকূল হলো কূলের সদৃশ। এখানে হৃদয় উপকূল বলতে হৃদয়ের কিনারার কথাই বলা হয়েছে। ঝিল্লিরবপূর্ণ - ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ/শব্দে মুখর। বিজনমূর্তি – নির্জন অবস্থা। বিজন হলো নির্জন বা জনমানবশূন্য, মূর্তি হলো কোনোকিছুর প্রতিকৃতি। বিজনমূর্তি শব্দটি এখানে কোলাহলহীন অবস্থা বা নির্জন/জনমানবশূন্য অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। গণ্ডদেশ — গাল। মূক – বধির, বোবা। বিষাদশান্ত – দুঃখমগ্ন, বিষাদ - স্ফূর্তিশূন্যতা, বিষণ্ণতা। বিষাদশান্ত হলো খুববেশি বিষাদগ্রস্ততা থেকে যে শান্ত অবস্থা। পূর্ণিমাতিথি – চাঁদের পরিপূর্ণ রূপ হওয়ার সময়। কন্যাভারগ্রস্ত পিতা-মাতা- যে পিতা-মাতার বিবাহযোগ্যা কন্যা সন্তানের বিয়ে হয়নি। কপোল - গাল। নেত্রপল্লব - চোখের পাতা। শুক্লাদ্বাদশী – চাঁদের বারোতম দিন ।

Content added || updated By

‘সুভা' গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গল্পগুচ্ছ থেকে সংকলিত হয়েছে। বাক্প্রতিবন্ধী কিশোরী সুভার প্রতি লেখকের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও মমত্ববোধে গল্পটি অমর হয়ে আছে। সুভা কথা বলতে পারে না। মা মনে করেন, এ-তার নিয়তির দোষ, কিন্তু বাবা তাকে ভালোবাসেন। আর কেউ তার সঙ্গে মেশে না-খেলে না। কিন্তু তার বিশাল একটি আশ্রয়ের জগৎ আছে। যারা কথা বলতে পারে না সেই পোষা প্রাণীদের কাছে সে মুখর। তাদের সে খুবই কাছের জন। আর বিপুল নির্বাক প্রকৃতির কাছে সে পায় মুক্তির সনদ। ‘সুভা গল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মন ও চিন্তা, আবেগ ও অনুভূতির সূক্ষ্মতর দিকগুলো উপস্থাপন করেছেন । সমাজে বিকশিত সেসব শিশুর প্রতি সকলের মমত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তুতে সহায়তা করে এ গল্প ।

Content added By

মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!
বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে । কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দি করিবে! অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে!
লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে- দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জাগয়ার মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়াছে ।
শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ? এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে। বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে। সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে ‘দেহে দেহে লগ্ন হইয়া বাস করে।' এখানে দীর্ঘপ্রাণ স্বল্পপ্রাণ পরম ধৈর্য ও শান্তির সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেছে, কেহ কাহাকেও উপেক্ষা করিতেছে না ।
কত নদী সমুদ্র পর্বত উল্লঙ্ঘন করিয়া মানবের কণ্ঠ এখানে আসিয়া পৌছিয়াছে— কত শত বৎসরের প্রান্ত হইতে এই স্বর আসিতেছে । এসো এখানে এসো, এখানে আলোকের জন্মসংগীত গান হইতেছে।
অমৃতলোক প্রথম আবিষ্কার করিয়া যে যে মহাপুরুষ যে-কোনোদিন আপনার চারিদিকে মানুষকে ডাক দিয়া বলিয়াছিলেন ‘তোমরা সকলে অমৃতের পুত্র, তোমরা দিব্যধামে বাস করিতেছ' সেই মহাপুরুষদের কণ্ঠই সহস্র ভাষায় সহস্র বৎসরের মধ্য দিয়া এই লাইব্রেরির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছে।
এই বঙ্গের প্রান্ত হইতে আমাদের কি কিছু বলিবার নাই? মানবসমাজকে আমাদের কি কোনো সংবাদ
দিবার নাই? জগতের একতান সংগীতের মধ্যে বঙ্গদেশই কেবল নিস্তব্ধ হইয়া থাকিবে !
আমাদের পদপ্রান্তস্থিত সমুদ্র কি আমাদিগকে কিছু বলিতেছে না? আমাদের গঙ্গা কি হিমালয়ের শিখর হইতে কৈলাসের কোনো গান বহন করিয়া আনিতেছে না? আমাদের মাথার উপরে কি তবে অনন্ত নীলাকাশ নাই? সেখান হইতে অনন্তকালের চিরজ্যোতির্ময়ী নক্ষত্রলিপি কি কেহ মুছিয়া ফেলিয়াছে ?

দেশ-বিদেশ হইতে অতীত-বর্তমান হইতে প্রতিদিন আমাদের কাছে মানবজাতির পত্র আসিতেছে; আমরা কি তাহার উত্তরে দুটি-চারটি চটি চটি ইংরেজি খবরের কাগজ লিখিব। সকল দেশ অসীম কালের পটে নিজ নিজ নাম খুদিতেছে। বাঙালির নাম কি কেবল দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতেই লেখা থাকিবে! জড় অদৃষ্টের সহিত মানবাত্মার সংগ্রাম চলিতেছে, সৈনিকদিগকে আহ্বান করিয়া পৃথিবীর দিকে দিকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়া উঠিয়াছে, আমরা কি কেবল আমাদের উঠানের মাচার উপরকার লাউ-কুমড়া লইয়া মকদ্দমা এবং আপিল চালাইতে থাকিব ।
বহু বৎসর নীরব থাকিয়া বঙ্গদেশের প্রাণ ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে আপনার ভাষায় একবার আপনার কথাটি বলিতে দাও । বাঙালি-কণ্ঠের সহিত মিলিয়া বিশ্বসংগীত মধুরতর হইয়া উঠিবে।

Content added By

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বিষয়। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি। বাল্যকালেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি Gitanjali : Song Offerings সংকলনের জন্য এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা। কাব্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Content added By

কল্লোল- ঢেউ। শঙ্খ- শামুক জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী।উল্লঙ্ঘন- পার হওয়া, লঙ্ঘন করা। অমৃতলোক-স্বর্গ, বেহেশত। কৈলাস - হিন্দুধর্মের দেবতা শিবের বাসস্থান হিসেবে বর্ণিত হিমালয় পর্বতের উঁচু স্থান।

Content added By

‘লাইব্রেরি' প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এটি তাঁর বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি লাইব্রেরিকে মহাসমুদ্রের কল্লোলধ্বনির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, লাইব্রেরিতে মানবাত্মার ধ্বনিরাশি বইয়ের পাতায় বন্দি হয়ে থাকে । বইয়ের ভেতর দিয়েই আমরা আকাশের দৈববাণী থেকে মহাত্মাদের কথা পেয়ে থাকি। যাঁদের সান্নিধ্য আমাদের কখনই পাওয়া সম্ভব নয়, বইয়ের ভেতর দিয়েই আমরা তাদের পেতে পারি। বই আমাদের অতীতের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে দেয়। এ বইয়ের স্থান হলো লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরিতেই মানব হৃদয়ের উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়। লাইব্রেরিতে সকল পথের, সকল মতের মানুষের সম্মিলন ঘটে। লাইব্রেরির মহত্ত্বের কথা বর্ণনা করে লেখক বলেছেন- জগতের উদ্দেশ্যে কি আমাদেরও কিছু বলার নেই? আমরা কি কেবল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কলহ করে বেড়াব। লেখক শেষে আশা ব্যক্ত করে বলেছেন— বাঙালিরা জেগে উঠেছে । তারাও আপন ভাষায় লিখে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে তুলবে। ‘লাইব্রেরি' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটি আমাদের বই পাঠ এবং জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

Content added By

পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপ মায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনও শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুর-দেবতার নামই প্রচলিত ছিল— গণেশ, কার্তিক, পার্বতী তাহার উদাহরণ ।
এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোঁজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদি ঘর বটে
বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল। রামসুন্দর কিছুমাত্র
বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না।
কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। বাঁধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল । এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে।
অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না। বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল। রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, ‘শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয় টাকাটা শোধ করিয়া দিব।' রায়বাহাদুর বলিলেন, টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না ৷'
এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব-একটা ভক্তি কিংবা অনুরাগ জন্মিতেছে, তাহা বলা যায় না ।
ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল । সে বাপকে বলিয়া
বসিল, ‘কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না; বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইব।' বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, ‘দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার?” দুই-
একজন প্রবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, ‘শাস্ত্রশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই, কাজেই ।’
বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন । বিবাহ একপ্রকার বিষণ্ণ নিরানন্দভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল ।
শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না । নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা।' রামসুন্দর বলিলেন, “কেন ? আসতে দেবে না, মা আমি তোমাকে নিয়ে আসব।'

রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তাঁর কোনো প্রতিপত্তি ছিল না। চাকরগুলো পর্যন্ত তাঁহাকে নিচু নজরে দেখে । অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন-বা দেখিতে পান না ।
কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া আর অপমান তো সহ্য হয় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন, যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে ।
কিন্তু যে ঋণভার কাঁধে চাপিয়াছে তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি
পড়িয়াছে এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে
হইতেছে।
এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠিতে বসিতে মেয়েকে খোঁটা লাগাইতেছে। পিতৃগৃহের নিন্দা শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।
বিশেষত শাশুড়ির আক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না। যদি কেহ বলে, 'আহা কী শ্রী। বউয়ের মুখখানি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়।' শাশুড়ি ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে, শ্রী তো ভারি। যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্রী।'
এমন-কি, বউয়ের খাওয়াপরারও যত্ন হয় না। যদি কোনো দয়াপরতন্ত্র প্রতিবেশিনী কোনো ত্রুটির
উল্লেখ করে,
শাশুড়ি বলে, ‘ওই ঢের হয়েছে।' অর্থাৎ, বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন
পাইত । সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই, ফাঁকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে।
বোধ হয়, কন্যার এই-সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে। তাই রামসুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন ।
কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহাদের নিকট হইতে গোপনে রাখিলেন । স্থির করিয়াছিলেন, বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়ি ভাড়া লইয়া বাস করিবেন; এমন কৌশলে চলিবেন যে, তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পারিবে না ।
কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল। সকলে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো-বা সন্তান আছে। তাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল, বাড়ি বিক্রয় স্থগিত হইল ।
তখন রামসুন্দর নানা স্থান হইতে বিস্তর সুদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন। এমন হইল যে,সংসারের খরচ আর চলে না।
নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। বৃদ্ধের পক্ব কেশে, শুষ্ক মুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্য এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অনুতাপ কি আর গোপন রাখা যায়। রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইত ।

সেই ব্যথিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশ্যে দিনকতক বাপের বাড়ি যাইবার জন্য নিরু নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে। বাপের ম্লান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না। একদিন রামসুন্দরকে কহিল, ‘বাবা, আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও।' রামসুন্দর বলিলেন, ‘আচ্ছা।’
কিন্তু তাঁহার কোনো জোর নাই— নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে। এমন কি, কন্যার দর্শন, সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না ।
কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাহাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে। তাই, বেহাইয়ের নিকট সে সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা, কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো ।
নোট-কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাঁধিয়া রামসুন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন । প্রথমে হাস্যমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন। হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার অদ্যোপান্ত বিবরণ বলিলেন। নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের সুখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দা করিলেন; শহরে একটা নতুন ব্যামো আসিয়াছে, সে সম্বন্ধে অনেক আজগবি আলোচনা করিলেন; অবশেষে হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন, “হাঁ হাঁ, বেহাই, সেই টাকাটা বাকি আছে বটে। রোজই মনে করি, যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই, কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না। আর ভাই, বুড়ো হয়ে পড়েছি।' এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন। সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন ।
বলিলেন, ‘থাক, বেহাই, ওতে আমার কাজ নেই।' একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন,সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না ।
এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি আনিবার প্রস্তাব কাহারও মুখে আসে না- কেবল রামসুন্দর ভাবিলেন, ‘সে-সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না।' মর্মাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন। রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, ‘সে এখন হচ্ছে না।' এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন।
রামসুন্দর মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিত হস্তে কয়েকখানি নোট চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না ।
বহুদিন গেল। নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না। অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল— তখন রামসুন্দরের মনে বড়ো আঘাত লাগিল, কিন্তু তবু গেলেন না ।

আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি –’। খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন ।
পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন । পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল, 'দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস ?' বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনি আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই ।
রামসুন্দর তাহা জানিতেন এবং সে সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন । রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, এ কথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই ।
দৈন্যপীড়িত গৃহের ক্রন্দনধ্বনি কানে লইয়া বৃদ্ধ তাঁহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন। আজ তাঁহার সে সংকোচভাব নাই; দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলজ্জ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে, যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন। শুনিলেন, রায়বাহাদুর ঘরে নাই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে। মনের উচ্ছ্বাস সংবরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বাপও কাঁদে, মেয়েও কাঁদে; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না। এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল । তার পরে রামসুন্দর কহিলেন, ‘এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি মা। আর কোনো গোল নাই ৷ '
এমন সময় রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তাঁহার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন । পিতাকে বলিলেন, “বাবা, আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে?”
রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন, ‘তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব। আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে?' রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায় তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহাদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন ।
তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, 'দাদা, আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না?” নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে?”
নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, 'বাবা, তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও
তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম।' রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তাহলে তোর বাপের অপমান। আর তোরও অপমান।'

নিরু কহিল, টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম! না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না । তাছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না ।'
রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা ।
নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলো। তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না।' রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন ৷
কিন্তু রামসুন্দর এইযে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ দাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল । শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না।
নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল। এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন
পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তর চলিয়া গিয়াছে এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয়, এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে । এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই। আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না । সে যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল । কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না । যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন তবে শাশুড়ি বলিতেন, 'নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না। কখনো-বা বলিতেন, ‘দেখো-না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে।'
রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, ওর সমস্ত ন্যাকামি।' অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, ‘বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা।' শাশুড়ি বলিলেন, ‘কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল।'
কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না- যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল, সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।
বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রতিমা-বিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরীদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে, বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটি খ্যাতি রটিয়া গেল— এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনও দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব, এবং শুনা যায়, ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল।

রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময়, তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল ।
এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল, ‘আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে।' রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, 'বাবা তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে।' এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায় ।

Content added By

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বিষয়। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি। বাল্যকালেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি Gitanjali : Song Offerings সংকলনের জন্য এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা। কাব্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Content added By

রায়বাহাদুর – ব্রিটিশ আমলের সরকারি খেতাব, রাজার মতো সম্ভ্রান্ত ও প্রতাপশালী ব্যক্তি। তুমুল - প্রবল, ঘোরতর, ভয়ানক। অনুরাগ – আসক্তি, প্রীতি, সোহাগ, মমতা। হতোদ্যম - নিরুদ্যম, উদ্যমহীন। প্রতিপত্তি – সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব। খোঁটা – গঞ্জনা, নিন্দা, দোষের প্রতি ইঙ্গিত।

নিত্যক্রিয়া – দৈনন্দিন কর্ম, প্রতিদিনের কাজ। আক্রোশ - বিদ্বেষ, ক্রোধ। ঝংকার - গুঞ্জন, বীণা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রাদির শব্দ।

দয়াপরতন্ত্র – দয়ার্দ্র, দয়ার বশীভূত। আজগুবি - অদ্ভুত অবিশ্বাস্য - গুঞ্জন, বীণা পঞ্জর – পাঁজর, বুকের হাড়ের খাঁচা। সরোদনে - কেঁদে কেঁদে। স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ -  আড়ালে অবস্থান করে অন্যের কথোপকথন শোনা। শরশয্যা – মৃত্যুশয্যা। বন্দোবস্ত - ব্যবস্থা, আয়োজন ।

Content added By

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ থেকে 'দেনাপাওনা' গল্পটি সংকলিত হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের রামসুন্দর পাঁচ পুত্র এবং এক কন্যার জনক। আদরের কন্যার প্রতাপশালী রায়বাহাদুরের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের সময় পাত্রের পিতা রায়বাহাদুর দশ হাজার টাকা নগদসহ অন্যান্য সামগ্রী বিয়ের যৌতুক হিসেবে দাবি করেন। কন্যার বাপ রাজি হন। বিয়ের সময় নগদ অর্থ বাকি পড়ে যায়। শুরু হয় পিতা ও কন্যার ওপর মানসিক নির্যাতন। নিরুপমার আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের সমাজের এই ভয়াবহ ব্যাধির কাহিনি। ‘দেনাপাওনা গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজে প্রচলিত যৌতুক প্রথার মর্মান্তিক রূপ উপস্থাপন করেছেন। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভিন্ন মত গড়ে তুলতে গল্পটি সহায়ক।

Content added By

বই পড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। প্রথমত সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না, কেননা আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই। দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন কেননা আমাদের এখন ঠিক শখ করবার সময় নয়। আমাদের এই রোগ-শোক, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবন ধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সেই জীবনকেই সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমও ঠেকবে। আমরা সাহিত্যের রস উপভোগ করতে প্রস্তুত নই; কিন্তু শিক্ষার ফল লাভের জন্য আমরা সকলে উদ্‌বাহু। আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষা আমাদের গায়ের জ্বালা ও চোখের জল দুই-ই দূর করবে। এ আশা সম্ভবত দুরাশা; কিন্তু তা হলেও আমরা তা ত্যাগ করতে পারি নে কেননা আমাদের উদ্ধারের জন্য কোনো সদুপায় আমরা চোখের সুমুখে দেখতে পাইনে। শিক্ষার মাহাত্ম্যে আমিও বিশ্বাস করি এবং যিনিই যাই বলুন, সাহিত্যচর্চা যে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লোকে যে তা সন্দেহ করে, তার কারণ এ শিক্ষার ফল হাতে হাতে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ তার কোনো নগদ বাজারদর নেই। এই কারণে ডেমোক্রেসি সাহিত্যের সার্থকতা বোঝে না, বোঝে শুধু অর্থের সার্থকতা। ডেমোক্রেসির গুরুরা চেয়েছিলেন সকলকে সমান করতে কিন্তু তাদের শিষ্যরা তাদের কথা উলটো বুঝে প্রতি জনেই হতে চায় বড়োমানুষ। একটি বিশিষ্ট অভিজাত সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েও ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমরা ডেমোক্রেসির গুণগুলো আয়ত্ত করতে না পেরে তার দোষগুলো আত্মসাৎ করেছি। এর কারণও স্পষ্ট। ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। আমাদের শিক্ষিত সমাজের লোলুপদৃষ্টি আজ অর্থের উপরেই পড়ে রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যচর্চার সুফল সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান । যাঁরা হাজারখানা ল-রিপোর্ট কেনেন, তারা একখানা কাব্যগ্রন্থও কিনতে প্রস্তুত নন; কেননা তাতে ব্যবসার কোনো সুসার নেই। নজির না আউড়ে কবিতা আবৃত্তি করলে মামলা যে হারতে হবে সে তো জানা কথা। কিন্তু যে কথা জজে শোনে না, তার যে কোনো মূল্য নেই, এইটেই হচ্ছে পেশাদারদের মহাভ্রান্তি । জ্ঞানের ভাণ্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয়, এ সত্য তো প্রত্যক্ষ। কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও সমান সত্য যে,এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী। তারপর যে জাতি মনে বড়ো নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড়ো নয়; কেননা ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞানসাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টি ও মন সাপেক্ষ এবং মানুষের মনকে সরল, সচল, সরাগ ও সমৃদ্ধ করার ভার আজকের দিনে সাহিত্যের উপরও ন্যস্ত হয়েছে। কেননা মানুষের দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মনীতি, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-নৈরাশ্য, তার অন্তরের স্বপ্ন ও সত্য, এই সকলের সমবায়ে সাহিত্যের জন্ম। অপরাপর শাস্ত্রের ভিতর যা আছে,সে সব হচ্ছে মানুষের মনের ভগ্নাংশ; তার পুরো মনটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় শুধু সাহিত্যে। দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি হচ্ছে মনগঙ্গার তোলা জল, তার পূর্ণ স্রোত আবহমানকাল সাহিত্যের ভেতরই সোল্লাসে সবেগে বয়ে চলেছে এবং সেই গঙ্গাতে অবগাহন করেই আমরা আমাদের সকল পাপমুক্ত হব ।
অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের বই পড়তে হবে, কেননা বই পড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চার উপায়ান্তর নেই । ধর্মের চর্চা চাইকি মন্দিরের বাইরেও করা চলে, দর্শনের চর্চা গুহায়, নীতির চর্চা ঘরে এবং বিজ্ঞানের চর্চা জাদুঘরে; কিন্তু সাহিত্যের চর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি; ও-চর্চা মানুষে কারখানাতেও করতে পারে না; চিড়িয়াখানাতেও নয় । এইসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে, সাহিত্যের মধ্যেই আমাদের জাত মানুষ হবে। সেইজন্য আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে।
আমাদের মনে হয়, এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি। একথা শুনে অনেকে চমকে উঠবেন, কেউ কেউ আবার হেসে ও উঠবেন; কিন্তু আমি জানি, আমি রসিকতাও করছি নে, অদ্ভুত কথাও বলছি নে; যদিও এ বিষয়ে লোকমত যে আমার মতের সমরেখায় চলে না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। অতএব আমার কথার আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। আমার বক্তব্য আমি আপনাদের কাছে নিবেদন করছি, তার সত্য মিথ্যার-বিচার আপনারা করবেন। সে বিচারে আমার কথা যদি না টেকে, তা হলে রসিকতা হিসেবেই গ্রাহ্য করবেন।
আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। আজকের বাজারে বিদ্যার দাতার অভাব নেই। এমনকি, এ ক্ষেত্রে দাতা কর্ণেরও অভাব নেই; এবং আমরা আমাদের ছেলেদের তাদের দ্বারস্থ করেই নিশ্চিত থাকি, এই বিশ্বাসে যে, সেখান থেকে তারা এতটা বিদ্যার ধন লাভ করে ফিরে আসবে, যার সুদে তার বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এ বিশ্বাস নিতান্ত অমূলক। মনোরাজ্যেও দান গ্রহণসাপেক্ষ, অথচ আমরা দাতার মুখ চেয়ে গ্রহীতার কথাটা একেবারেই ভুলে যাই। এ সত্য ভুলে না গেলে আমরা বুঝতুম যে, শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, কিন্তু ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়। শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞানপিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না। যিনি যথার্থ গুরু, তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্‌বোধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে মুক্ত এবং ব্যক্ত করে তোলেন। সেই শক্তির বলে সে নিজের মন নিজে গড়ে তোলে, নিজের অভিমতবিদ্যা নিজে অর্জন করে বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে করতে হয়। গুরু উত্তরসাধক মাত্র ।
আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক উলটো। সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণশীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। একটা জানাশোনা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যাঁরা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির সর্বপ্রধান উপায় মনে করেন। গোদুগ্ধ অবশ্য অতিশয় উপাদেয় পদার্থ, কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করবার শক্তির উপর নির্ভর করে এ জ্ঞান ও শ্রেণির মাতৃকুলের নেই । তাঁদের বিশ্বাস ও-বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। কাজেই শিশু যদি তা গিলতে আপত্তি করে তা হলে সে যে ব্যাদড়া ছেলে, সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না । অতএব তখন তাকে ধরে-বেঁধে জোর জবরদস্তি করে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয় । শেষটায় সে যখন এই দুগ্ধপান ক্রিয়া হতে অব্যাহতি লাভ করবার জন্য মাথা নাড়তে, হাত-পা ছুড়তে শুরু করে, তখন স্নেহময়ী মাতা বলেন ‘আমার মাথা খাও, মরামুখ দেখ, এই ঢোক, আর এক ঢোক, আর এক ঢোক’ ইত্যাদি। মাতার উদ্দেশ্য যে খুব সাধু, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, উক্ত বলা কওয়ার ফলে মা শুধু ছেলের যকৃতের মাথা খান এবং ঢোকের পর ঢোকে তার মরামুখ দেখবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলেন। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষা পদ্ধতিটাও ঐ একই ধরনের। এর ফলে কত ছেলের সুস্থ সরল মন যে ইনফ্যান্টাইল লিভারে গতাসু হচ্ছে তা বলা কঠিন । কেননা দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যুর হয় না ।
আমরা কিন্তু এই আত্মার অপমৃত্যুতে ভীত হওয়া দূরে থাক, উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে। পাশ করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়, এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই। শিক্ষা-শাস্ত্রের একজন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি শাস্ত্রী বলেছেন যে, এক সময়ে ফরাসি দেশে শিক্ষা-পদ্ধতি এতই বেয়াড়া ছিল যে, সে যুগে France was saved by her idlers ; অর্থাৎ যারা পাশ করতে পারেনি বা চায় নি তারাই ফ্রান্সকে রক্ষা করেছে । এর কারণ, হয় তাদের মনের বল ছিল বলে কলেজের শিক্ষাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল, নয় সে শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছিল বলেই তাদের মনের বল বজায় ছিল। তাই এই স্কুল-পালানো ছেলেদের দল থেকে সে যুগের ফ্রান্সের যত কৃতকর্মা লোকের আবির্ভাব হয়েছিল।
সে যুগে ফ্রান্সে কী রকম শিক্ষা দেওয়া হতো তা আমার জানা নেই । তবুও আমি জোর করে বলতে পারি যে,এ যুগে আমাদের স্কুল কলেজে শিক্ষার যে রীতি চলছে, তার চাইতে সে শিক্ষাপদ্ধতি কখনোই নিকৃষ্ট ছিল না। সকলেই জানেন যে, বিদ্যালয়ে মাস্টার মহাশয়েরা নোট দেন এবং সেই নোট মুখস্থ করে ছেলেরা হয় পাশ। এর জুড়ি আর একটি ব্যাপারও আমাদের দেশে দেখা যায়। এদেশে একদল বাজিকর আছে, যারা বন্দুকের গুলি থেকে আরম্ভ করে উত্তরোত্তর কামানের গোলা পর্যন্ত গলাধঃকরণ করে। তারপর একে একে সবগুলো উগলে দেয়। এর ভেতর যে অসাধারণ কৌশল আছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই গেলা আর ওগলানো দর্শকের কাছে তামাশা হলেও বাজিকরের কাছে তা প্রাণান্ত ব্যাপার। ও কারদানি করা তার পক্ষে যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি অপকারী। বলা বাহুল্য, সে বেচারা লোহার গোলাগুলোর এক কণাও জীর্ণ করতে পারে না। আমাদের ছেলেরাও তেমনি নোট নামক গুরুদত্ত নানা আকারের ও নানা প্রকারের গোলাগুলো বিদ্যালয়ে গলাধঃকরণ করে পরীক্ষালয়ে তা উদ্‌গিরণ করে দেয়। এ জন্য সমাজ তাদের বাহবা দেয় দিক, কিন্তু মনে যেন না ভাবে যে, এতে জাতির প্রাণশক্তি বাড়ছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষা যে অনেকাংশে ব্যর্থ সে বিষয়ে প্রায় অধিকাংশ লোকই একমত। আমি বলি, শুধু ব্যর্থ নয়, অনেক স্থলে মারাত্মক। কেননা আমাদের স্কুল-কলেজের ছেলেদের স্বশিক্ষিত হবার সে সুযোগ দেয় না, শুধু তাই নয়, স্বশিক্ষিত হবার শক্তি পর্যন্ত নষ্ট করে। আমাদের শিক্ষাযন্ত্রের মধ্যে যে যুবক নিষ্পেষিত হয়ে বেরিয়ে আসে,তার আপনার বলতে আর বেশি কিছু থাকে না, যদি না তার প্রাণ অত্যন্ত কড়া হয়। সৌভাগ্যের বিষয়, এই ক্ষীণপ্রাণ জাতির মধ্যেও জনকতক এমন কঠিন প্রাণের লোক আছে, এহেন শিক্ষাপদ্ধতিও তাদের মনকে জখম করলেও একেবারে বধ করতে পারে না ।
আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়; প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্কুল কলেজ বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য। আমি পূর্বে বলেছি যে, লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল । অতঃপর আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, বই পড়ার পক্ষ নিয়ে এ ওকালতি করবার, বিশেষত প্রাচীন নজির দেখাবার কী প্রয়োজন ছিল? বই পড়া যে ভালো, তা কে না মানে? আমার উত্তর- সকলে মুখে মানলেও কাজে মানে না। মুসলমান ধর্মে মানবজাতি দুই ভাগে বিভক্ত। যারা কেতাবি, আর এক যারা তা নয়। বাংলায় শিক্ষিত সমাজ যে পূর্বদলভুক্ত নয়, একথা নির্ভয়ে বলা যায় না; আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটের ওপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেইজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়; কেননা, সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না। বাধ্য হয়ে বই পড়ায় আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে, কেউ স্বেচ্ছায় বই পড়লে আমরা তাকে নিষ্কর্মার দলেই ফেলে দিই; অথচ একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, যে জিনিস স্বেচ্ছায় না করা যায়, তাতে মানুষের মনের সন্তোষ নেই। একমাত্র উদরপূর্তিতে মানুষের সম্পূর্ণ মনস্তুষ্টি হয় না। একথা আমরা সকলেই জানি যে,উদরের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের দেহ বাঁচে না; কিন্তু একথা আমরা সকলে মানিনে যে, মনের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের আত্মা বাঁচে না। দেহরক্ষা অবশ্য সকলেরই কর্তব্য কিন্তু আত্মরক্ষাও অকর্তব্য নয়। মানবের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে যে মানুষের প্রাণ মনের সম্পর্ক যত হারায় ততই তা দুর্বল হয়ে পড়ে। মনকে সজাগ ও সবল রাখতে না পারলে জাতির প্রাণ যথার্থ স্ফূর্তিলাভ করে না; তারপর যে জাতি যত নিরানন্দ সে জাতি তত নির্জীব। একমাত্র আনন্দের স্পর্শেই মানুষের মনপ্রাণ সজীব, সতেজ ও সরাগ হয়ে ওঠে। সুতরাং সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, জাতির জীবনীশক্তির হ্রাস করা । অতএব, কোনো নীতির অনুসারেই তা কর্তব্য হতে পারে না। অর্থনীতিরও নয়, ধর্মনীতিরও নয় ।
কাব্যামৃতে যে আমাদের অরুচি ধরেছে সে অবশ্য আমাদের দোষ নয়, আমাদের শিক্ষার দোষ। যার আনন্দ নেই সে নির্জীব একথা যেমন সত্য, যে নির্জীব তারও আনন্দ নেই, সে কথাও তেমনি সত্য। আমাদের শিক্ষাই আমাদের নির্জীব করেছে। জাতীয় আত্মরক্ষার জন্য এ শিক্ষার উলটো টান যে 

আমাদের টানতে হবে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। এই বিশ্বাসের বলেই আমি স্বেচ্ছায় সাহিত্যচর্চার সপক্ষে এত বাক্য ব্যয় করলুম । সে বাক্যে আপনাদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়েছি কিনা জানিনে । সম্ভবত হইনি। কেননা, আমাদের দুরবস্থার কথা যখন স্মরণ করি, তখন খালি কোমল সুরে আলাপ করা আর চলে না; মনের আক্ষেপ প্রকাশ করতে মাঝে মাঝেই কড়ি লাগাতে হয়।

Content added By

প্রমথ চৌধুরী ৭ই আগস্ট ১৮৬৮ সালে যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনা জেলায় হরিপুর গ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান । বিলাত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগদান না করে তিনি কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল বীরবল । তাঁর সম্পাদিত সবুজ পত্র বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষারীতি প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বস্তুত তাঁরই নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বীরবলের হালখাতা, রায়তের কথা, চার-ইয়ারি কথা, আহুতি, প্রবন্ধ সংগ্রহ, নীললোহিত, সনেট পঞ্চাশৎ পদচারণ ইত্যাদি। প্রমথ চৌধুরী ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সালে কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

Content added By

শৌখিন- রুচিবান। উদ্বাহু- ঊর্ধ্ববাহু, আহ্লাদে হাত ওঠানো। ডেমোক্রেসি- গণতন্ত্র। সন্দিহান- সন্দেহযুক্ত। সুসার- প্রাচুর্য, সচ্ছলতা, সুবিধা।

জজ- বিচারক। ভাঁড়েও ভবানী- রিক্ত, শূন্য। আবহমানকাল- চিরকাল। সোল্লাসে- আনন্দে। অবগাহন - সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে গোসল ।

উপায়ান্তর- অন্য কোনো উপায়। স্বশিক্ষিত- নিজে নিজে শিক্ষিত। প্রচ্ছন্ন- গোপন। জীর্ণ- হজম । অব্যাহতি- মুক্তি। গতাসু- মৃত।

গলাধঃকরণ- গিলে ফেলা। কারদানি - বাহাদুরি । উদরপূর্তি- পেট ভরানো। ডেমোক্রেটিক- গণতান্ত্রিক।

দাতাকর্ণ- মহাভারতের বিশিষ্ট চরিত্র, কুন্তীপুত্র; দানের জন্য প্রবাদতুল্য মানুষ। কেতাবি- কেতাব অনুসরণ করে চলে যারা।

Content added || updated By

‘বই পড়া' প্রবন্ধটি প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ সংগ্রহ থেকে নির্বাচন করা হয়েছে। একটি লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল। আমাদের পাঠচর্চার অনভ্যাস যে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য ঘটছে তা সহজেই লক্ষণীয়। আর্থিক অনটনের কারণে অর্থকরী নয় এমন সবকিছুই এদেশে অনর্থক বলে বিবেচনা করা হয়। সেজন্য বই পড়ার প্রতি লোকের অনীহা দেখা যায় ৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লব্ধ শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ নয় বলে ব্যাপকভাবে বই পড়া দরকার। কারণ সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত । যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে মনের প্রসার দরকার। তার জন্য বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। এর জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। বাধ্য না হলে লোকে বই পড়ে না। লাইব্রেরিতে লোকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বই পড়ে যথার্থ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। প্রগতিশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সাহিত্যচর্চা করা আবশ্যক বলে লেখক মনে করেন। ‘বই পড়া' প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বই পড়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটি এই শিক্ষাই দেয় যে, জাতির মানসিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে বই পড়া, জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার কোনো বিকল্প নেই ।

Content added By

ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন। বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ধানের কারবারে অতিশয় সঙ্গতিপন্ন। তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে, ছেলেমেয়েদের ছেলেপুলে হইয়াছে, জামাইরা-প্রতিবেশীর দল, চাকর-বাকর সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল । সমস্ত গ্রামের লোক ধুমধামের শবযাত্রা ভিড় করিয়া দেখিতে আসিল। মেয়েরা কাঁদিতে কাঁদিতে মায়ের দুই পায়ে গাঢ় করিয়া আলতা এবং মাথায় ঘন করিয়া সিন্দুর লেপিয়া দিল, বধূরা ললাট চন্দনে চর্চিত করিয়া বহুমূল্য বস্ত্রে শাশুড়ির দেহ আচ্ছাদিত করিয়া দিয়া আঁচল দিয়া তাঁহার শেষ পদধূলি মুছাইয়া লইল। পুষ্পে, পত্রে, গন্ধে, মাল্যে, কলরবে মনে হইল না এ কোনো শোকের ব্যাপার-এ যেন বড়বাড়ির গৃহিণী পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নূতন করিয়া তাঁহার স্বামীগৃহে যাত্রা করিতেছেন। বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় শান্তমুখে তাঁহার চিরদিনের সঙ্গিনীকে শেষ বিদায় দিয়া অলক্ষে দুফোটা চোখের জল মুছিয়া শোকার্ত কন্যা ও বধূগণকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। প্রবল হরিধ্বনিতে প্রভাত- আকাশ আলোড়িত করিয়া সমস্ত গ্রাম সঙ্গে সঙ্গে চলিল। আর একটি প্রাণী একটু দূরে থাকিয়া এই দলের সঙ্গী হইল। সে কাঙালীর মা। সে তাহার কুটির-প্রাঙ্গণে গোটা-কয়েক বেগুন তুলিয়া এই পথে হাটে চলিয়াছিল, এই দৃশ্য দেখিয়া আর নড়িতে পারিল না। রহিল তাহার হাটে যাওয়া, রহিল তাহার আঁচলে বেগুন বাঁধা,-সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে সকলের পিছনে শ্মশানে আসিয়া উপস্থিত হইল। গ্রামের একান্তে গরুড়-নদীর তীরে শ্মশান। সেখানে পূর্বাহ্নেই কাঠের ভার, চন্দনের টুকরা, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা প্রভৃতি উপকরণ সঞ্চিত হইয়াছিল, কাঙালীর মা ছোটজাত, দুলের মেয়ে বলিয়া কাছে যাইতে সাহস পাইল না, তফাতে একটা উঁচু ঢিপির মধ্যে দাঁড়াইয়া সমস্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত উৎসুক আগ্রহে চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল। প্রশস্ত ও পর্যাপ্ত চিতার পরে যখন শব স্থাপিত করা হইল তখন তাঁহার রাঙ্গা পা-দুখানি দেখিয়া তাহার দু'চক্ষু জুড়াইয়া গেল, ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া একবিন্দু আলতা মুছাইয়া লইয়া মাথায় দেয়। বহুকণ্ঠের হরিধ্বনির সহিত পুত্রহস্তের মন্ত্রপুত অগ্নি যখন সংযোজিত হইল তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল,মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিল, ভাগ্যিমানী মা, তুমি সগ্যে যাচ্চো-আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও, আমিও যেন এমনি কাঙালীর হাতের আগুনটুকু পাই। ছেলের হাতের আগুন ! সে ত সোজা কথা নয়! স্বামী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, দাস, দাসী পরিজন-সমস্ত সংসার উজ্জ্বল রাখিয়া এই যে স্বর্গারোহণ- দেখিয়া তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, - এ সৌভাগ্যের সে যেন আর ইয়ত্তা করিতে পারিল না। সদ্য-প্রজ্বলিত চিতার অজস্র ধুঁয়া নীল রঙের ছায়া ফেলিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল, কাঙালীর মা ইহারই মধ্যে ছোট একখানি রথের চেহারা যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল। গায়ে তাহার কত না ছবি আঁকা, চূড়ায় তাহার কত না লতাপাতা জড়ানো । ভিতরে কে যেন বসিয়া আছে—মুখ তাহার চেনা যায় না, কিন্তু সিঁথায় তাঁহার সিঁদুরের রেখা, পদতল— দুটি আলতায় রাঙানো। ঊর্ধ্বদৃষ্টে চাহিয়া কাঙালীর মায়ের দুই চোখে অশ্রুর ধারা বহিতেছিল, এমন সময়ে একটি বছর চোদ্দ-পনরর ছেলে তাহার আঁচলে টান দিয়া কহিল, হেথায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস মা, ভাত রাঁধবি নে?
মা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, রাঁধবো’খন রে! হঠাৎ উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল, দ্যাখ দ্যাখ বাবা,-বামুন-মা ওই রথে চড়ে সগ্যে যাচ্ছে !
ছেলে বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া কহিল, কৈ? ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল, তুই ক্ষেপেছিস! ও
ত ধুঁয়া! রাগ করিয়া কহিল, বেলা দুপুর বাজে, আমার ক্ষিদে পায় না বুঝি? এবং সঙ্গে সঙ্গে মায়ের
চোখে জল লক্ষ করিয়া বলিল, বামুনদের গিন্নি মরছে তুই কেন কেঁদে মরিস মা ?
কাঙালীর মার এতক্ষণে হুঁশ হইল। পরের জন্য শ্মশানে দাঁড়াইয়া এইভাবে অশ্রুপাত করায় সে মনে মনে লজ্জা পাইল, এমন কি, ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় মুহূর্তে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, কাঁদব কিসের জন্যে রে !- চোখে ধোঁ লেগেছে বৈ ত নয় !
হাঃ—ধোঁ লেগেছে বৈ ত না ! তুই কাঁদতেছিলি !
মা আর প্রতিবাদ করিল না। ছেলের হাত ধরিয়া ঘাটে নামিয়া নিজেও স্নান করিল, কাঙালীকেও স্নান করাইয়া ঘরে ফিরিল,-শ্মশান-সৎকারের শেষটুকু দেখা আর তার ভাগ্যে ঘটিল না ।
সন্তানের নামকরণকালে পিতামাতার মূঢ়তায় বিধাতাপুরুষ অন্তরীক্ষে থাকিয়া অধিকাংশ সময়ে শুধু হাস্য করিয়াই ক্ষান্ত হন না, তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাই তাহাদের সমস্ত জীবনটা তাহাদের নিজের নামগুলোকেই যেন আমরণ ভ্যাঙচাইয়া চলিতে থাকে। কাঙালীর মার জীবনের ইতিহাস ছোটো, কিন্তু সেই ছোট্ট কাঙালজীবনটুকু বিধাতার এই পরিহাসের দায় হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল। তাহাকে জন্ম দিয়া মা মরিয়াছিল, বাপ রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী। মা নাই, বাপ নদীতে মাছ ধরিয়া বেড়ায়, তাহার না আছে দিন, না আছে রাত। তবু যে কি করিয়া ক্ষুদ্র অভাগী একদিন কাঙালীর মা হইতে বাঁচিয়া রহিল সে এক বিস্ময়ের বস্তু । যাহার সহিত বিবাহ হইল তাহার নাম রসিক বাঘ, বাঘের অন্য বাঘিনী ছিল, ইহাকে লইয়া সে গ্রামান্তরে উঠিয়া গেল, অভাগী তাহার অভাগ্য ও শিশুপুত্র কাঙালীকে লইয়া গ্রামেই পড়িয়া রহিল ।

তাহার সেই কাঙালী বড়ো হইয়া আজ পনরয় পা দিয়াছে। সবেমাত্র বেতের কাজ শিখিতে আরম্ভ করিয়াছে, অভাগীর আশা হইয়াছে আরও বছরখানেক তাহার অভাগ্যের সহিত যুঝিতে পারিলে দুঃখ ঘুচিবে। এই দুঃখ যে কি, যিনি দিয়াছেন তিনি ছাড়া আর কেহই জানে না ।
কাঙালী পুকুর হইতে আঁচাইয়া আসিয়া দেখিল তাহার পাতের ভুক্তাবশেষ মা একটা মাটির পাত্রে ঢাকিয়া রাখিতেছে, আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুই খেলি নে মা? বেলা গড়িয়ে গেছে বাবা, এখন আর ক্ষিদে নেই ।
ছেলে বিশ্বাস করিল না, বলিল, না, ক্ষিদে নেই বৈ কি! কৈ, দেখি তোর হাঁড়ি?
এই ছলনায় বহুদিন কাঙালীর মা কাঙালীকে ফাঁকি দিয়া আসিয়াছে। সে হাঁড়ি দেখিয়া তবে ছাড়িল। তাহাতে আর একজনের মত ভাত ছিল । তখন সে প্রসন্নমুখে মায়ের কোলে গিয়া বসিল । এই বয়েসের ছেলে সচরাচর এরূপ করে না, কিন্তু শিশুকাল হইতে বহুকাল যাবৎ সে রু ছিল বলিয়া মায়ের ক্রোড় ছাড়িয়া বাহিরের সঙ্গীসাথিদের সহিত মিশিবার সুযোগ পায় নাই। এইখানে বসিয়াই তাহাকে খেলাধুলার সাধ মিটাইতে হইয়াছে।
একহাতে গলা জড়াইয়া, মুখের উপর মুখ রাখিয়াই কাঙালী চকিত হইয়া কহিল, মা, তোর গা যে গরম,কেন তুই অমন রোদে দাঁড়িয়ে মড়া-পোড়ানো দেখতে গেলি? কেন আবার নেয়ে এলি? মড়া-পোড়ানো কি তুই-
মা শশব্যস্তে ছেলের মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, ছি বাবা, মড়া-পোড়ানো বলতে নেই, পাপ হয় । সতী-লক্ষ্মী মা-ঠাকরুন রথে করে সগ্যে গেলেন ৷
ছেলে সন্দেহ করিয়া কহিল, তোর এক কথা মা ! রথে চড়ে কেউ নাকি আবার সগ্যে যায় । মা বলিল, আমি যে চোখে দেখনু কাঙালী, বামুন-মা রথের উপরে বসে। তেনার রাঙা পা-দুখানি যে সবাই চোখ মেলে দেখলে রে! সবাই দেখলে?
সব্বাই দেখলে ।
কাঙালী মায়ের বুকে ঠেস দিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। মাকে বিশ্বাস করাই তাহার অভ্যাস, বিশ্বাস করিতেই সে শিশুকাল হইতে শিক্ষা করিয়াছে, সেই মা যখন বলিতেছে সবাই চোখ মেলিয়া এত বড়ো ব্যাপার দেখিয়াছে, তখন অবিশ্বাস করিবার আর কিছু নাই। খানিক পরে আস্তে আস্তে কহিল, তাহলে তুইও ত মা সগ্যে যাবি? বিন্দির মা সেদিন রাখালের পিসিকে বলতেছিল, ক্যাঙ্গার মার মত সতী- লক্ষ্মী আর দুলে-পাড়ায় নেই ।
কাঙালীর মা চুপ করিয়া রহিল, কাঙালী তেমনি ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, বাবা যখন তোরে ছেড়ে দিলে, তখন তোরে কত লোকে ত নিকে করতে সাধাসাধি করলে। কিন্তু তুই বললি, না। বললি, ক্যাঙালী বাঁচলে আমার দুঃখু ঘুচবে, আবার নিকে করতে যাবো কিসের জন্যে? হাঁ মা, তুই নিকে করলে আমি কোথায় থাকতুম? আমি হয়ত না খেতে পেয়ে এতদিনে কবে মরে যেতুম।

মা ছেলেকে দুই হাতে বুকে চাপিয়া ধরিল। বস্তুত সেদিন তাহাকে এ পরামর্শ কম লোকে দেয় নাই, এবং যখন সে কিছুতেই রাজি হইল না, তখন উৎপাত-উপদ্রবও তাহার প্রতি সামান্য হয় নাই, সেই কথা স্মরণ করিয়া অভাগীর চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । ছেলে হাত দিয়া মুছাইয়া দিয়া বলিল, ক্যাতাটা পেতে দেব মা, শুবি?
মা চুপ করিয়া রহিল । কাঙালী মাদুর পাতিল, কাঁথা পাতিল, মাচার উপর হইতে ছোট বালিশটি পাড়িয়া দিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে বিছানায় টানিয়া লইয়া যাইতে, মা কহিল, কাঙালী, আজ তোর আর কাজে গিয়ে কাজ নেই ৷
কাজ কামাই করিবার প্রস্তাব কাঙালীর খুব ভালো লাগিল, কিন্তু কহিল, জলপানির পয়সা দুটো ত তা হলে দেবে না মা !
না দিক গে, –আয় তোকে রূপকথা বলি ।
আর প্রলুব্ধ করিতে হইল না, কাঙালী তৎক্ষণাৎ মায়ের বুক ঘেঁষিয়া শুইয়া পড়িয়া কহিল, বল্ তা হলে । রাজপুত্তুর, কোটালপুত্তুর আর সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া -
অভাগী রাজপুত্র, কোটালপুত্র আর পক্ষীরাজ ঘোড়ার কথা দিয়া গল্প আরম্ভ করিল। এ-সকল তাহার পরের কাছে কতদিনের শোনা এবং কতদিনের বলা উপকথা। কিন্তু মুহূর্ত-কয়েক পরে কোথায় গেল তাহার রাজপুত্র, আর কোথায় গেল তাহার কোটালপুত্র-সে এমন উপকথা শুরু করিল যাহা পরের কাছে তাহার শেখা নয়— নিজের সৃষ্টি। জ্বর তাহার যত বাড়িতে লাগিল, উষ্ণ রক্তস্রোত যত দ্রুতবেগে মস্তিষ্কে বহিতে লাগিল, ততই সে যেন নব নব উপকথার ইন্দ্রজাল রচনা করিয়া চলিতে লাগিল। তাহার বিরাম নাই, বিচ্ছেদ নাই- কাঙালীর স্বল্প দেহ বার বার রোমাঞ্চিত হইতে লাগিল। ভয়ে, বিস্ময়ে, পুলকে সে সজোরে মায়ের গলা জড়াইয়া তাহার বুকের মধ্যে যেন মিশিয়া যাইতে চাহিল ।
বাহিরে বেলা শেষ হইল, সূর্য অস্ত গেল, সন্ধ্যার ম্লান ছায়া গাঢ়তর হইয়া চরাচর ব্যাপ্ত করিল, কিন্তু ঘরের মধ্যে আজ আর দীপ জ্বলিল না, গৃহস্থের শেষ কর্তব্য সমাধা করিতে কেহ উঠিল না, নিবিড় অন্ধকারে কেবল রুগ্‌ণ মাতার অবাধ গুঞ্জন নিস্তব্ধ পুত্রের কর্ণে সুধাবর্ষণ করিয়া চলিতে লাগিল । সে সেই শ্মশান ও শ্মশানযাত্রার কাহিনি। সেই রথ, সেই রাঙ্গা পা-টি, সেই তাঁর স্বর্গে যাওয়া। কেমন করিয়া শোকার্ত স্বামী শেষ পদধুলি দিয়া কাঁদিয়া বিদায় দিলেন, কি করিয়া হরিধ্বনি দিয়া ছেলেরা মাতাকে বহন করিয়া লইয়া গেল, তার পরে সন্তানের হাতের আগুন। সে আগুন ত আগুন নয় কাঙালী, সে ত হরি ! তার আকাশজোড়া ধুঁয়ো ত ধুঁয়ো নয় বাবা, সেই ত সগ্যের রথ ! কাঙালীচরণ, বাবা আমার !
কি মা?
তোর হাতের আগুন যদি পাই বাবা, বামুন-মার মত আমিও সগ্যে যেতে পাবো ।
কাঙালী অস্ফুটে শুধু কহিল, যাঃ-বলতে নেই।

মা সে কথা বোধ করি শুনিতেই পাইল না, তপ্তনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিতে লাগিল, ছোটোজাত বলে তখন কিন্তু কেউ ঘেন্না করতে পারবে না-দুঃখী বলে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ইস! ছেলের হাতের আগুন,– রথকে যে আসতেই হবে । ছেলে মুখের উপর মুখ রাখিয়া ভগ্নকণ্ঠে কহিল, বলিস নে মা, বলিস নে, আমার বড্ড ভয় করে ।
মা কহিল, আর দেখ্ কাঙালী, তোর বাবাকে একবার ধরে আনবি, অমনি যেন পায়ের ধুলো মাথায় দিয়ে আমাকে বিদায় দেয়। অমনি পায়ে আলতা, মাথায় সিঁদুর দিয়ে,-কিন্তু কে বা দেবে ? তুই দিবি, না রে কাঙালী? তুই আমার ছেলে, তুই আমার মেয়ে, তুই আমার সব! বলিতে বলিতে সে ছেলেকে একেবারে বুকে চাপিয়া ধরিল।
অভাগীর জীবন-নাট্যের শেষ অঙ্ক পরিসমাপ্ত হইতে চলিল । বিস্তৃতি বেশি নয়, সামান্যই। বোধ করি ত্রিশটা বৎসর আজও পার হইয়াছে কি হয় নাই, শেষও হইল তেমনি সামান্যভাবে। গ্রামে কবিরাজ ছিল না, ভিন্ন গ্রামে তাঁহার বাস। কাঙালী গিয়া কাঁদাকাটি করিল, হাতে-পায়ে পড়িল, শেষে ঘটি বাঁধা দিয়া তাঁহাকে এক টাকা প্রণামী দিল। তিনি আসিলেন না, গোটা-চারেক বড়ি দিলেন। তাহার কত কি আয়োজন। খল, মধু আদার সত্ত্ব, তুলসীপাতার রস-কাঙালীর মা ছেলের প্রতি রাগ করিয়া বলিল, কেন তুই আমাকে না বলে ঘটি বাঁধা দিতে গেলি বাবা ! হাত পাতিয়া বড়ি কয়টি গ্রহণ করিয়া মাথায় ঠেকাইয়া উনানে ফেলিয়া দিয়া কহিল,ভালো হই ত এতেই হবো, বাগদি-দুলের ঘরে কেউ কখনো ওষুধ খেয়ে বাঁচে না ।
দিন দুই-তিন এমনি গেল। প্রতিবেশীরা খবর পাইয়া দেখিতে আসিল, যে যাহা মুষ্টিযোগ জানিত, হরিণের শিঙ-ঘষা জল, গেঁটে-কড়ি পুড়াইয়া মধুতে মাড়িয়া চাটাইয়া দেওয়া ইত্যাদি অব্যর্থ ঔষধের সন্ধান দিয়া যে যাহার কাজে গেল। ছেলেমানুষ কাঙালী ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিতে, মা তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিল, কোবরেজের বড়িতে কিছু হলো না বাবা আর ওদের ওষুধে কাজ হবে? আমি এমনি ভালো হবো ।
কাঙালী কাঁদিয়া কহিল, তুই বড়ি ত খেলি নে মা, উনুনে ফেলে দিলি । এমনি কি কেউ সারে?
আমি এমনি সেরে যাবো। তার চেয়ে তুই দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নিয়ে খা দিকি, আমি চেয়ে দেখি ৷ কাঙালী এই প্রথম অপটু হস্তে ভাত রাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল । না পারিল ফ্যান ঝাড়িতে, না পারিল ভালো করিয়া ভাত বাড়িতে। উনান তাহার জ্বলে না-ভিতরে জল পড়িয়া ধুঁয়া হয়; ভাত ঢালিতে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে; মায়ের চোখ ছলছল করিয়া আসিল। নিজে একবার উঠিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু মাথা সোজা করিতে পারিল না, শয্যায় লুটাইয়া পড়িল। খাওয়া হইয়া গেলে ছেলেকে কাছে লইয়া কি করিয়া কি করিতে হয় বিধিমতে উপদেশ দিতে গিয়া তাহার ক্ষীণকণ্ঠ থামিয়া গেল, চোখ দিয়া কেবল অবিরলধারায় জল পড়িতে লাগিল ।
গ্রামে ঈশ্বর নাপিত নাড়ী দেখিতে জানিত, পরদিন সকালে সে হাত দেখিয়া তাহারই সুমুখে মুখ গম্ভীর করিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলিল এবং শেষে মাথা নাড়িয়া উঠিয়া গেল। কাঙালীর মা ইহার অর্থ বুঝিল, কিন্তু তাহার ভয়ই হইল না। সকলে চলিয়া গেলে সে ছেলেকে কহিল, এইবার একবার তাকে ডেকে আনতে পারিস বাবা?

কাকে মা?
ওই যে রে-ও-গাঁয়ে যে উঠে গেছে— কাঙালী বুঝিয়া কহিল, বাবাকে?
অভাগী চুপ করিয়া রহিল ।
কাঙালী বলিল, সে আসবে কেন মা?
অভাগীর নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, তথাপি আস্তে আস্তে কহিল, গিয়ে বলবি, মা শুধু একটু তোমার পায়ের ধুলো চায় ।
সে তখনি যাইতে উদ্যত হইলে সে তাহার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, একটু কাঁদাকাটা করিস বাবা, বলিস মা যাচ্চে ।
একটু থামিয়া কহিল, ফেরবার পথে অমনি নাপতে-বৌদির কাছ থেকে একটু আলতা চেয়ে আনিস ক্যাঙালী, আমার নাম করলেই সে দেবে। আমাকে বড় ভালোবাসে । ভালো তাহাকে অনেকেই বাসিত। জ্বর হওয়া অবধি মায়ের মুখে সে এই কয়টা জিনিসের কথা
এতবার এতরকম করিয়া শুনিয়াছে যে, সে সেইখান হইতে কাঁদিতে কাঁদিতে যাত্রা করিল ।
পরদিন রসিক দুলে সময়মত যখন আসিয়া উপস্থিত হইল তখন অভাগীর আর বড় জ্ঞান নাই ৷ মুখের পরে মরণের ছায়া পড়িয়াছে, চোখের দৃষ্টি এ সংসারের কাজ-সারিয়া কোথায় কোন্ অজানা দেশে চলিয়া গেছে।
কাঙালী কাঁদিয়া কহিল, মাগো ! বাবা এসেছে-পায়ের ধুলো নেবে যে !
মা হয়ত বুঝিল, হয়ত বুঝিল না, হয়ত বা তাহার গভীর সঞ্চিত বাসনা সংস্কারের মত তাহার আচ্ছন্ন চেতনায় ঘা দিল । এই মৃত্যুপথ-যাত্রী তাহার অবশ বাহুখানি শয্যার বাহিরে বাড়াইয়া হাত পাতিল ।
রসিক হতবুদ্ধির মত দাঁড়াইয়া রহিল। পৃথিবীতে তাহারও পায়ের ধুলোর প্রয়োজন আছে, ইহাও কেহ নাকি চাহিতে পারে তাহা তাহার কল্পনার অতীত। বিন্দির পিসি দাঁড়াইয়া ছিল, সে কহিল, দাও বাবা, দাও একটু পায়ের ধুলো ।
রসিক অগ্রসর হইয়া আসিল। জীবনে যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসা দেয় নাই, অশন-বসন দেয় নাই, কোন খোঁজখবর করে নাই, মরণকালে তাহাকে সে শুধু একটু পায়ের ধুলা দিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিল ৷
রাখালের মা বলিল, এমন সতীলক্ষ্মী বামুন-কায়েতের ঘরে না জন্মে, ও আমাদের দুলের ঘরে জন্মালে কেন! এইবার ওর একটু গতি করে দাও বাবা-ক্যাঙালার হাতের আগুনের লোভে ও যেন প্রাণটা দিলে । অভাগীর অভাগ্যের দেবতা অগোচরে বসিয়া কি ভাবিলেন জানি না, কিন্তু ছেলেমানুষ কাঙালীর বুকে গিয়া এ কথা যেন তীরের মত বিধিল ।

সেদিন দিনের বেলাটা কাটিল, প্রথম রাত্রিটা কাটিল, কিন্তু প্রভাতের জন্য কাঙালীর মা আর অপেক্ষা করিতে পারিল না। কি জানি, এত ছোটজাতের জন্যও স্বর্গে রথের ব্যবস্থা আছে কি না, কিংবা অন্ধকারে পায়ে হাঁটিয়াই তাহাদের রওনা হইতে হয়, কিন্তু এটা বুঝা গেল, রাত্রি শেষ না হইতেই এ দুনিয়া সে ত্যাগ করিয়া গেছে ।
কুটির-প্রাঙ্গণে একটা বেলগাছ, একটা কুড়ল চাহিয়া আনিয়া রসিক তাহাতে ঘা দিয়াছে কি দেয় নাই, জমিদারের দারোয়ান কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহার গালে সশব্দে একটা চড় কষাইয়া দিল; কুড়ল কাড়িয়া লইয়া কহিল, শালা, একি তোর বাপের গাছ আছে যে কাটতে লেগেছিস?
রসিক গালে হাত বুলাইতে লাগিল, কাঙালী কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, বাঃ, এ যে আমার মায়ের হাতে-পোঁতা গাছ, দারোয়ানজী । বাবাকে খামোকা তুমি মারলে কেন?
হিন্দুস্থানী দারোয়ান তাহাকেও একটা অশ্রাব্য গালি দিয়া মারিতে গেল, কিন্তু সে নাকি তাহার জননীর মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া বসিয়াছিল, তাই অশৌচের ভয়ে তাহার গায়ে হাত দিল না। হাঁকাহাঁকিতে একটা ভিড় জমিয়া উঠিল, কেহই অস্বীকার করিল না যে বিনা অনুমতিতে রসিকের গাছ কাটিতে যাওয়াটা ভালো হয় নাই। তাহারাই আবার দারোয়ানজীর হাতে-পায়ে পড়িতে লাগিল, তিনি অনুগ্রহ করিয়া যেন একটা হুকুম দেন। কারণ, অসুখের সময় যে-কেহ দেখিতে আসিয়াছে কাঙালীর মার তাহারই হাতে ধরিয়া তাহার শেষ অভিলাষ ব্যক্ত করিয়া গেছে।
দারোয়ান ভুলিবার পাত্র নহে, সে হাত-মুখ বাড়িয়া জানাইল, এ-সকল চালাকি তাহার কাছে খাটিবে না ।
জমিদার স্থানীয় লোক নহেন; গ্রামে তাঁহার একটা কাছারি আছে, গোমস্তা অধর রায় তাহার কর্তা । লোকগুলো যখন হিন্দুস্থানিটার কাছে ব্যর্থ অনুনয়-বিনয় করিতে লাগিল, কাঙালী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া একেবারে কাছারি- বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে লোকের মুখে মুখে শুনিয়াছিল, পিয়াদারা ঘুষ লয়, তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল অতবড় অসঙ্গত অত্যাচারের কথা যদি কর্তার গোচর করিতে পারে ত ইহার প্রতিবিধান না হইয়াই পারে না। হায় রে অনভিজ্ঞ! বাংলাদেশের জমিদার ও তাহার কর্মচারীকে সে চিনিত না । সদ্যমাতৃহীন বালক শোকে ও উত্তেজনায় উদভ্রান্ত হইয়া একেবারে উপরে উঠিয়া আসিয়াছিল, অধর রায় সেইমাত্র সন্ধ্যাহ্নিক ও যৎসামান্য জলযোগান্তে বাহিরে আসিয়াছিলেন, বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, কে রে?
আমি কাঙালী । দারোয়ানজী আমার বাবাকে মেরেছে। বেশ করেচে । হারামজাদা, খাজনা দেয়নি বুঝি ?
কাঙালী কহিল, না বাবুমশায়, বাবা গাছ কাটতেছিল, –আমার মা মরেচে-বলিতে বলিতে সে কান্না আর চাপিতে পারিল না ।
এই কান্নাকাটিতে অধর অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। ছোঁড়াটা মড়া ছুঁইয়া আসিয়াছে, কি জানি এখানকার কিছু ছুঁইয়া ফেলিল নাকি ! ধমক দিয়া বলিলেন, মা মরেচে ত যা নীচে নেবে দাঁড়া। ওরে কে আছিস রে, এখানে একটু গোবরজল ছড়িয়ে দে ! কি জাতের ছেলে তুই?
কাঙালী সভয়ে প্রাঙ্গণে নামিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আমরা দুলে ।
অধর কহিলেন, দুলে ! দুলের মড়ার কাঠ কি হবে শুনি?
কাঙালী বলিল, মা যে আমাকে আগুন দিতে বলে গেছে! তুমি জিজ্ঞেস কর না বাবুমশায়, মা যে সবাইকে বলে গেছে, সক্কলে শুনেছে যে ! মায়ের কথা বলিতে গিয়া তাহার অনুক্ষণের সমস্ত অনুরোধ উপরোধ মুহূর্তে স্মরণ হইয়া কণ্ঠ যেন তাহার কান্নায় ফাটিয়া পড়িতে চাহিল ।
অধর কহিলেন, মাকে পোড়াবি ত গাছের দাম পাঁচটা টাকা আন্ গে । পারবি ?
কাঙালী জানিত তাহা অসম্ভব। তাহার উত্তরীয় কিনিবার মূল্যস্বরূপ তাহার ভাত খাইবার পিতলের কাঁসিটি বিন্দির পিসি একটি টাকায় বাঁধা দিতে গিয়াছে সে চোখে দেখিয়া আসিয়াছে, সে ঘাড় নাড়িল, বলিল, না ৷
অধর মুখখানা অত্যন্ত বিকৃত করিয়া কহিলেন, না ত, মাকে নিয়ে নদীর চড়ায় পুঁতে ফেল গে যা কার বাবার গাছে তোর বাপ কুড়ুল ঠেকাতে যায়-পাজি, হতভাগা, নচ্ছার !
কাঙালী বলিল, সে যে আমাদের উঠানের গাছ বাবুমশায়! সে যে আমার মায়ের হাতে পোঁতা গাছ হাতে পোঁতা গাছ! পাঁড়ে, ব্যাটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দে ত!
পাঁড়ে আসিয়া গলাধাক্কা দিল, এবং এমন কথা উচ্চারণ করিল যাহা কেবল জমিদারের কর্মচারীরাই পারে । কাঙালী ধুলা ঝাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তার পরে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কেন সে যে মার খাইল, কি তাহার অপরাধ, ছেলেটা ভাবিয়াই পাইল না। গোমস্তার নির্বিকার চিত্তে দাগ পর্যন্ত পড়ি ল না। পড়িলে এ চাকরি তাহার জুটিত না। কহিলেন, পরেশ, দেখ ত হে, এ ব্যাটার খাজনা বাকি পড়েছে কি না। থাকে ত জাল-টাল কিছু একটা কেড়ে এনে যেন রেখে দেয়, – হারামজাদা পালাতে পারে ।
মুখুয্যে-বাড়িতে শ্রাদ্ধের দিন-মাঝে কেবল একটা দিন মাত্র বাকি। সমারোহের আয়োজন গৃহিণীর উপযুক্ত করিয়াই হইতেছে। বৃদ্ধ ঠাকুরদাস নিজে তত্ত্বাবধান করিয়া ফিরিতেছিলেন, কাঙালী আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল, কহিল, ঠাকুরমশাই, আমার মা মরে গেছে । তুই কে? কি চাস তুই?
আমি কাঙালী । মা বলে গেছে তেনাকে আগুন দিতে । তা দি গে না ।
কাছারির ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল, একজন কহিল, ও বোধ হয় একটা গাছ চায়।—এই বলিয়া সে ঘটনাটা প্রকাশ করিয়া কহিল ।
মুখুয্যে বিস্মিত ও বিরক্ত হইয়া কহিলেন, শোন আবদার। আমারই কত কাঠের দরকার,-কাল বাদে পরশু কাজ। যা যা, এখানে কিছু হবে না-এখানে কিছু হবে না। এই বলিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিলেন ।

ভট্টাচার্য মহাশয় অদূরে বসিয়া ফর্দ করিতেছিলেন, তিনি বলিলেন, তোদের জেতে কে কবে আবার পোড়ায় রে? যা, মুখে একটু নুড়ো জ্বেলে দিয়ে নদীর চড়ায় মাটি দে গো ।
মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বড় ছেলে ব্যস্তসমস্তভাবে এই পথে কোথায় যাইতেছিলেন, তিনি কান খাড়া
করিয়া একটু শুনিয়া কহিলেন, দেখচেন ভট্টচার্যমশায়, সব ব্যাটারাই এখন বামুন-কায়েত হতে চায় । বলিয়া কাজের ঝোঁকে আর কোথায় চলিয়া গেলেন । কাঙালী আর প্রার্থনা করিল না। এই ঘণ্টা-দুয়েকের অভিজ্ঞতায় সংসারে সে যেন একেবারে বুড়া
হইয়া গিয়াছিল । নিঃশব্দে ধীরে ধীরে তাহার মরা মায়ের কাছে গিয়া উপস্থিত হইল ।
নদীর চরে গর্ত খুঁড়িয়া অভাগীকে শোয়ান হইল । রাখালের মা কাঙালীর হাতে একটা খড়ের আঁটি জ্বালিয়া দিয়া তাহারই হাত ধরিয়া মায়ের মুখে স্পর্শ করাইয়া ফেলিয়া দিল। তার পরে সকলে মিলিয়া মাটি চাপা দিয়া কাঙালীর মায়ের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া দিল ।
সবাই সকল কাজে ব্যস্ত, শুধু সেই পোড়া খড়ের আঁটি হইতে যে স্বল্প ধুঁয়াটুকু ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল, তাহারই প্রতি পলকহীন চক্ষু পাতিয়া কাঙালী ঊর্ধ্বদৃষ্টে স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল ।

Content added By

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিক সংকটের কারণে এফ.এ. শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে। তিনি কিছুদিন ভবঘুরে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। পরে ১৯০৩ সালে ভাগ্যের সন্ধানে বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) যান এবং রেঙ্গুনে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। প্রবাস জীবনেই তাঁর সাহিত্য-সাধনা শুরু এবং তিনি অল্পদিনেই খ্যাতি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নিয়মিতভাবে সাহিত্য-সাধনা করতে থাকেন। গল্প, উপন্যাস রচনার পাশাপাশি তিনি কিছু প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তা ত্যাগ করেন। তিনি ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধি লাভ করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা কথা-সাহিত্যে দুর্লভ জনপ্রিয়তার অধিকারী। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, বড়দিদি, বিরাজ বৌ, রামের সুমতি, দেবদাস, বিন্দুর ছেলে, পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই, মেজদিদি, পল্লিসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, দত্তা, ছবি, গৃহদাহ, দেনা পাওনা, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন ইত্যাদি । শরৎচন্দ্র ১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

মুখুয্যে – মুখোপাধ্যায় পদবি, লোকমুখে উচ্চারণের পার্থক্য ঘটেছে এখানে। বর্ষীয়সী - অতি বৃদ্ধ, সকলের মধ্যে বয়সে বড়, স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। সঙ্গতিপন্ন – অর্থ-সম্পদের অধিকারী। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া – মৃত ব্যক্তির সৎকার, মৃত্যের জন্য অন্তিম বা শেষ অনুষ্ঠান। সগ্য – স্বর্গ, লোকমুখের উচ্চারণে পার্থক্য ঘটেছে। অন্তরীক্ষ – আকাশ, গগন। ভুক্তাবশেষ – ভোজন বা খাওয়ার পরে পাতে যা - পড়ে থাকে। প্রসন্ন - সন্তুষ্ট, খুশি। প্রসন্নমুখ – খুশি ভরা মুখ। ক্রোড় – কোল ; শশব্যস্ত - খরগোশ বা শশকের মতো ব্যস্ত। তেনার – তার, তাঁর। দুলে - পালকি বহনকারী হিন্দু সম্প্রদায়বিশেষ, নিচু জাতের মানুষ বলে অভিহিত। ইন্দ্রজাল – জাদুবিদ্যা, এখানে গল্পের মাধ্যমে মুগ্ধ বা মোহিত করে রাখার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। রোমাঞ্চ – শিহরণ, অনুভূতির আধিক্যে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া। ভগ্নকণ্ঠ – বিকৃত - স্বর,এখানে অতি আবেগে কাঙালীর ভাঙা বা বিকৃত স্বরে কথা বলা বোঝানো হয়েছে। প্রণামী-পুরোহিত বা দেব-দেবীকে দেওয়া সালামি, এখানে কবিরাজকে চিকিৎসা ফি হিসেবে দেওয়া টাকা বোঝানো হয়েছে। মুষ্টিযোগ – টোটকা চিকিৎসা। গেঁটে কড়ি – কাঁটাযুক্ত শামুক জাতীয় প্রাণি। নিস্তব্ধ – নিশ্চল, নিঃসাড়, নির্বাক। হরিধ্বনি - হরি নামের ধ্বনি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মৃতদেহ বহন করার সময় সমবেতকণ্ঠে দেবতা হরির নাম উচ্চস্বরে বলে থাকে তাকে হরিধ্বনি বলে। সংস্কার – বিশ্বাস, ঝোঁক, আজন্ম লালিত ধারণা। অশন – খাদ্যদ্রব্য, আহারের বস্তু। সন্ধ্যাহ্নিক – সন্ধ্যাবেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিত্যকরণীয় পূজা

Content added || updated By

সুকুমার সেন সম্পাদিত ‘শরৎ সাহিত্যসমগ্র' গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ' নামক গল্পটি সংকলন করা হয়েছে। গরিব-দুখী নীচু শ্রেণির ছেলে কাঙালী। তার মা অভাগী । প্রতিবেশী উঁচু জাতের বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে অভাগীর ভেতরকার ভাবানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় এ গল্প। মৃতের শবযাত্রার আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা দেখে অভাগীও নিজের মৃত্যু মুহূর্তের স্বপ্ন দেখে। চন্দন, সিঁদুর, আলতা, মালা, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা, অগ্নির ধোঁয়ায় মুখুয্যে বাড়ির গিন্নি স্বর্গে গমন করেছেন। দুখিনী অভাগীও ভাবে তার মৃত্যুর সময় স্বামীর পায়ের ধূলি নিয়ে মৃত্যু শেষে পুত্র মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। মৃত্যুর সময় কাঙালী তার বাবাকে হাজির করতে পারলেও পারেনি কাঠের অভাবে মায়ের সৎকার করতে। ‘অভাগীর স্বর্গ' গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমানবিক জাতিভেদ প্রথা এবং জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ-নির্যাতনের ছবি এঁকেছেন। এ গল্প জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয়।

Content added By

আমরা দুর্বল নিরীহ বাঙালি । এই বাঙালি শব্দে কেমন সুমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ হয়। আহা ! এই অমিয়াসিক্ত বাঙালি কোন্ বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য, চন্দ্রের চন্দ্রিকা, মধুর মাধুরী, যুথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলের তরলতা- এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙালি গঠিত হইয়াছে! আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধুর তদ্রূপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সরল।
আমরা মূর্তিমতী কবিতা-যদি ভারতবর্ষকে ইংরেজি ধরনের একটি অট্টালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা (drawing room) এবং বাঙালি তাহাতে সাজসজ্জা (drawing room suit)! যদি ভারতবর্ষকে একটা সরোবর মনে করেন, তবে বাঙালি তাহাতে পদ্মিনী। যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙালি তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙালি পুরুষিকা! অতএব আমরা মূর্তিমান কাব্য ।
আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি – পুঁইশাকের ডাঁটা, সজিনা ও পুঁটি মৎস্যের ঝোল- অতিশয় সরস। আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি -ঘৃত, দুগ্ধ, ছানা, নবনীত, ক্ষীর, সর, সন্দেশ ও রসগোল্লা-অতিশয় সুস্বাদু। আমাদের দেশের প্রধান ফল, আম্র ও কাঁঠাল- -রসাল এবং মধুর। অতএব আমাদের খাদ্যসামগ্রী ত্রিগুণাত্মক-সরস, সুস্বাদু, মধুর ।
খাদ্যের গুণ অনুসারে শরীরের পুষ্টি হয়। তাই সজিনা যেমন বীজবহুল, আমাদের দেশে তেমনই ভুঁড়িটি স্থূল। নবনীতে কোমলতা অধিক, তাই আমাদের স্বভাবের ভীরুতা অধিক। শারীরিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন; এখন পোষাক পরিচ্ছদের কথা বলি ।
আমাদের বর অঙ্গ যেমন তৈলসিক্ত নবনিগঠিত সুকোমল, পরিধেয়ও তদ্রূপ অতি সূক্ষ্ম শিমলার ধুতি ও চাদর। ইহাতে বায়ুসঞ্চালনের (Ventilation এর) কোন বাধা বিঘ্ন হয় না! আমরা সময় সময় সভ্যতার অনুরোধে কোট শার্ট ব্যবহার করি বটে, কারণ পুরুষমানুষের সবই সহ্য হয়।

কিন্তু আমাদের অর্ধাঙ্গী-হেমাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গীগণ তদানুকরণে ইংরেজ ললনাদের নির্লজ্জ পরিচ্ছদ (শেমিজ জ্যাকেট) ব্যবহার করেন না। তাঁহারা অতিশয় সুকুমারী ললিতা লজ্জাবতী লতিকা, তাই অতি মসৃণ ও সূক্ষ্ম ‘হাওয়ার শাড়ি’ পরেন। বাঙালির সকল বস্তুই সুন্দর, স্বচ্ছ ও সহজলব্ধ।
বাঙালির গুণের কথা লিখিতে হইলে অনন্ত মসী, কাগজ ও অক্লান্ত লেখকের আবশ্যক। তবে সংক্ষেপে দুটি চারিটা গুণের বর্ণনা করি ।
ধনবৃদ্ধির দুই উপায়, বাণিজ্য ও কৃষি। বাণিজ্য আমাদের প্রধান ব্যবসায়। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা (আরব্যোপন্যাসের) সিন্দাবাদের ন্যায় বাণিজ্যপোত অনিশ্চিত ফললাভের আশায় অনন্ত অপার সাগরে ভাসাইয়া দিয়া নৈরাশ্যের ঝঞ্ঝাবাতে ওতপ্রোত হই না। আমরা ইহাকে (বাণিজ্য) সহজ ও স্বল্পায়াসসাধ্য করিয়া লইয়াছি। অর্থাৎ বাণিজ্য ব্যবসায়ে যে কঠিন পরিশ্রম আবশ্যক, তাহা বর্জন করিয়াছি। এই জন্য আমাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিস নাই, শুধু বিলাসদ্রব্য-নানাবিধ কেশতৈল ও নানাপ্রকার রোগবর্ধক ঔষধ এবং রাঙা পিত্তলের অলঙ্কার, নকল হীরার আংটি, বোতাম ইত্যাদি বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে। ঈদৃশ ব্যবসায়ে কায়িক পরিশ্রম নাই। আমরা খাঁটি সোনা রূপা বা হিরা জওয়াহেরাৎ রাখি না, কারণ টাকার অভাব। বিশেষত আজি কালি কোন জিনিসটার নকল না হয় ?
যখনই কেহ একটু যত্ন পরিশ্রম স্বীকার পূর্বক “দীর্ঘকেশী” তৈল প্রস্তুত করেন, অমনই আমরা তদনুকরণে “হ্রস্বকেশী” বাহির করি। “কুন্তলীনের” সঙ্গে “কেশলীন” বিক্রয় হয়। বাজারে “মস্তিষ্ক স্নিগ্ধকারী” ঔষধ আছে, “মস্তিষ্ক উষ্ণকারী” দ্রব্যও আছে। এক কথায় বলি, যত প্রকারের নকল ও নিষ্প্রয়োজনীয় জিনিস হইতে পারে, সবই আছে। আমরা ধান্য তণ্ডুলের ব্যবসায় করি না, কারণ তাহাতে পরিশ্রম আবশ্যক ।
আমাদের অন্যতম ব্যবসায়-পাস বিক্রয়। এই পাস বিক্রেতার নাম “বর” এবং ক্রেতাকে “শ্বশুর” বলে । এক একটি পাসের মূল্য কত জান ? “অর্ধেক রাজত্ব ও এক রাজকুমারী”। এম.এ. পাস অমূল্যরত্ন, ইহা যে সে ক্রেতার ক্রেয় নহে। নিতান্ত সস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্য-এক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব। আমরা অলস, তরলমতি, শ্রমকাতর, কোমলাঙ্গ বাঙালি কিনা তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি, সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা Old fool শ্বশুরের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করা সহজ।
এখন কৃষিকার্যের কথা বলি । কৃষি দ্বারা অনুবৃদ্ধি হইতে পারে। কিন্তু আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি কৃষিবিভাগের কার্য (agriculture) করা অপেক্ষা মস্তিষ্ক উর্বর (brain culture) করা সহজ। অর্থাৎ কর্কশ উর্বর ভূমি কর্ষণ করিয়া ধান্য উৎপাদন করা অপেক্ষা মুখস্থ বিদ্যার জোরে অর্থ উৎপাদন করা সহজ। এবং কৃষিকার্যে পারদর্শিতা প্রদর্শন করা অপেক্ষা কেবল M.R.A.C পাশ করা সহজ। আইনচর্চা করা অপেক্ষা কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করা কঠিন। অথবা রৌদ্রের সময় ছত্র হস্তে কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শনের জন্য কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চা অপেক্ষা টানাপাখার তলে আরাম কেদারায় বসিয়া দুর্ভিক্ষ সমাচার (Famine Report) পাঠ করা সহজ। তাই আমরা অন্নোৎপাদনের চেষ্টা না করিয়া অর্থ উৎপাদনে সচেষ্ট আছি। আমাদের অর্থের অভাব নাই, সুতরাং অন্নকষ্টও হইবে না। দরিদ্র হতভাগা সব অন্নাভাবে মরে মরুক, তাতে আমাদের কি?
আমরা আরও অনেক প্রকার সহজ কার্য নির্বাহ করিয়া থাকি । যথা :

(১) রাজ্য স্থাপন করা অপেক্ষা “রাজা” উপাধি লাভ সহজ ।
(২) শিল্পকার্যে পারদর্শী হওয়া অপেক্ষা B.Sc ও D.Sc পাস করা সহজ।
(৩) অল্পবিস্তর অর্থব্যয়ে দেশে কোন মহৎ কার্য দ্বারা খ্যাতি লাভ করা অপেক্ষা “খাঁ বাহাদুর” বা “রায় বাহাদুর” উপাধি লাভের জন্য অর্থ ব্যয় করা সহজ।
(৪) প্রতিবেশী দরিদ্রদের শোক দুঃখে ব্যথিত হওয়া অপেক্ষা বিদেশীয় বড়ো লোকদের মৃত্যুদুঃখে “শোক সভার” সভ্য হওয়া সহজ।
(৫) দেশের দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য পরিশ্রম করা অপেক্ষা আমেরিকার নিকট ভিক্ষা গ্রহণ করা সহজ। ।
(৬) স্বাস্থ্যরক্ষায় যত্নবান হওয়া অপেক্ষা স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া ঔষধ ও ডাক্তারের হস্তে জীবন সমর্পণ করা সহজ।
(৭) স্বাস্থ্যের উন্নতি দ্বারা মুখশ্রীর প্রফুল্লতা ও সৌন্দর্য বর্ধন করা (অর্থাৎ healthy & cheerful হওয়া) অপেক্ষা (শুষ্কগণ্ডে!) কালিডোর, মিল্ক অভ রোজ ও ভিনোলিয়া পাউডার (Kalydore,
milk of rose and Vinolia powder) মাখিয়া সুন্দর হইতে চেষ্টা করা সহজ। (৮) কাহারও নিকট প্রহারলাভ করিয়া তৎক্ষণাৎ বাহুবলে প্রতিশোধ লওয়া অপেক্ষা মানহানির মোকদ্দমা করা সহজ ইত্যাদি ।
তারপর আমরা মূর্তিমান আলস্য-আমাদের গৃহিণীগণ এ বিষয়ে অগ্রণী। কেহ কেহ শ্রীমতীদিগকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে অনুরোধ করিয়া থাকেন। কিন্তু বলি, আমরা যদি রৌদ্রতাপ সহ্য করিতে না পারি, তবে আমাদের অর্ধাঙ্গীগণ কিরূপে অগ্নির উত্তাপ সহিবেন? আমরা কোমলাঙ্গ-তাঁহারা কোমলাঙ্গী; আমরা পাঠক, তাঁহারা পাঠিকা; আমরা লেখক, তাঁহারা লেখিকা । অতএব আমরা পাচক না হইলে তাঁহারা পাচিকা হইবেন কেন? সুতরাং যে লক্ষ্মীছাড়া দিব্যাঙ্গনাদিগকে রন্ধন করিতে বলে, তাহার ত্রিবিধ দণ্ড হওয়া উচিত। যথা তাহাকে (১) তুষানলে দগ্ধ কর, অতঃপর (২) জবেহ্ কর, তারপর (৩) ফাঁসি দাও !
আমরা সকলেই কবি-আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশি। আমাদের এখানে লেখক অপেক্ষা লেখিকার সংখ্যা বেশি। তাই কবিতার স্রোতে বিনা কারণে অশ্রুপ্রবাহ বেশি বহিয়া থাকে। আমরা পদ্য লিখিতে বসিলে কোন্ বিষয়টা বাদ দিই ? “ভগ্ন শূৰ্প”, “জীর্ণ কাঁথা”, “পুরাতন চটিজুতা” —কিছুই পরিতাজ্য নহে। আমরা আবার কত নতুন শব্দের সৃষ্টি করিয়াছি; যথা—“অতি শুভ্রনীলাম্বর, “সাশ্রুসজলনয়ন” ইত্যাদি। শ্রীমতীদের করুণ বিলাপ-প্রলাপপূর্ণ পদ্যের “অশ্রুজলের” বন্যায় বঙ্গদেশ ধীরে ধীরে ডুবিয়া যাইতেছে! সুতরাং দেখিতেছেন, আমরা সকলেই কবি।
আর আত্মপ্রশংসা কত করিব ? এখন উপসংহার করি।

Content added By

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ৯ই ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। ছোটবেলায় বড় বোন করিমুন্নেসা বেগম রোকেয়াকে বাংলা শিক্ষায় সাহায্য করেন। পরে তিনি বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি শেখেন। বিহারের অন্তর্গত ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহের পর তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হন। স্বামীর প্রেরণায় তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। সমকালীন মুসলমান সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেন। মুসলিম নারী জাগরণে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ও আনজুমান-ই-খাওয়াতীন -ই-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে তিনি মুসলমান নারীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন । পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ৯ই ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

সৌকুমার্য- সৌন্দর্য। ঝঞ্ঝাবাতে- ঝঞ্ঝার বাতাসে। কুন্তলীন, কেশলীন- লেখকের আমলে জনপ্রিয় চুলে দেয়ার তেলের নাম।

হাওয়ার শাড়ি- সূক্ষ্ম সুতোর শাড়ি। পাতলা শাড়ি। তন্ডুল - চাল। কালিডোর, মিল্ক অব রোজ, ভিনোলিয়া পাউডার- সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী।

দিব্যাঙ্গনা- স্বর্গের রূপসী, হুরপরি। শুভ্রনীলাম্বর- পরিষ্কার নীল আকাশ। সাশ্রুসজলনয়ন- জলভরা চোখ। আত্মপ্রশংসা- নিজের প্রশংসা ।

Content added By

পল্লিগ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই। চারদিকে কোকিল, দোয়েল,পাপিয়া প্রভৃতি পাখির কলগান, নদীর কুলকুল ধ্বনি, পাতার মর্মর শব্দ, শ্যামল শস্যের ভঙ্গিময় হিলাদুলা প্রচুর পরিমাণে শহরের অভাব এখানে পূর্ণ করে দিচ্ছে। পল্লির ঘাটে মাঠে, পল্লির আলোবাতাসে, পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বাতাসের মধ্যে বাস করে যেমন আমরা ভুলে যাই বায়ু- সাগরে আমরা ডুবে আছি, তেমনি পাড়াগাঁয়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে কত বড়ো সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ ছড়িয়ে আছে ।
শ্রদ্ধেয় ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, সাহিত্যের কী এক অমূল্য খনি পল্লিজননীর বুকের কোণে লুকিয়ে আছে। সুদূর পশ্চিমের সাহিত্যরসিক রোমাঁ রোলাঁ পর্যন্ত ময়মনসিংহের মদিনা বিবির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। মনসুর বয়াতির মতো আরও কত পল্লিকবি শহুরে চক্ষুর অগোচরে পল্লিতে আত্মগোপন করে আছেন, কে তাঁদের সাহিত্যের মজলিসে এসে জগতের সঙ্গে চেনাশোনা করিয়ে দেবে? আজ যদি বাংলাদেশের প্রত্যেক পল্লি থেকে এইসব অজানা অচেনা কবিদের গাথা সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হতো, তাহলে দেখা যেত বাংলার মুসলমানও সাহিত্য সম্পদে কত ধনী। কিন্তু হায়! এ কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল কই?
আমরা পল্লিগ্রামে বুড়োবুড়ির মুখে কোনো ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাকালে যেসব কথা শুনতে শুনতে ছেলেবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছি, সেগুলি না কত মনোহর! কত চমকপ্রদ! আরব্য উপন্যাসের আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ, আলিবাবা ও চল্লিশ দস্যু প্রভৃতির চেয়ে পল্লির উপকথাগুলোর মূল্য কম নয়। আধুনিক শিক্ষার কর্মনাশা স্রোতে সেগুলো বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। এখনকার শিক্ষিত জননী সন্তানকে আর রাখালের পিঠা গাছের কথা, রাক্ষসপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যার কথা বা পঙ্খিরাজ ঘোড়ার কথা শুনান না, তাদের কাছে বলেন আরব্য উপন্যাসের গল্প কিংবা Lambs Tales from Shakespeare এর গল্পের অনুবাদ। ফলে কোনো সুদূর অতীতের সাক্ষীস্বরূপ এই রূপকথা নষ্ট হয়ে অতীতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ লোপ করে দিচ্ছে। যদি আজ বাংলার সমস্ত রূপকথা সংগৃহীত হতো, তবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করে দেখিয়ে দিতে পারতেন যে, বাংলার নিভৃত কোণের কোনো কোনো পিতামহী মাতামহীর গল্প ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য প্রান্তে কিংবা ভারত উপমহাদেশের বাইরে সিংহল, সুমাত্রা, যাভা, কম্বোডিয়া প্রভৃতি স্থানে এমনিভাবে প্রচলিত আছে। হয়তো এশিয়ার বাইরে ইউরোপখণ্ডে লিথোনিয়া কিংবা ওয়েলসের কোনো পল্লিরমণী এখনও হুবহু বা কিছু রূপান্তরিতভাবে সেই উপকথাগুলো তার ছেলেপুলে বা নাতি-পোতাকে শোনাচ্ছে। কে আছে এই উপকথাগুলো সংগ্রহ করে তাদের অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে? ইউরোপ, আমেরিকা দেশে বড়ো বড়ো বিদ্বানদের সভা আছে, যাকে বলা হয় Folklore Society। তাদের কাজ হচ্ছে এইসব সংগ্রহ করা এবং অন্য সভ্য দেশের উপকথার সঙ্গে সাদৃশ্য নিয়ে বিচার করা । এগুলো নৃতত্ত্বের মূল্যবান উপকরণ বলে পণ্ডিত সমাজে গৃহীত হয়। শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বা ‘ঠাকুরদার থলে' যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের সমস্ত উপকথা এক জায়গায় জড় করলে বিশ্বকোষের মতো কয়েক বালামে তার সংকুলান হতো না ।
আমরা Shakespeare-এ পড়েছি রাক্ষসদের বাঁধা বুলি হচ্ছে Fi, Fie, foh, fun ! ও smell the blood of a British man- এর সঙ্গে তুলনা করে পল্লির ‘হাঁউ, মাউ, খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ, এ সাদৃশ্য হলো কোথা থেকে? তবে কি একদিন ঐ সাদা ইংরেজ ও এই কালো বাঙালির পূর্ব পুরুষগণ ভাই ভাই রূপে একই তাঁবুর নিচে বাস করত? সে আজ কত দিনের কথা কে জানে? আমরা কথায় কথায় প্রবাদ বাক্য জুড়ে দিই- যেমন ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই’, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি', আপনি বাঁচলে বাপের নাম', এই রকম আরও কত কী! তারপর ডাকের কথা আছে, খনার বচন আছে ।
যেমন ধরুন— কলা রুয়ে না কেটো পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত ।
প্রবাদ বাক্যে এবং ডাক ও খনার বচনে কত যুগের ভূয়োদর্শনের পরিপক্ব ফল সঞ্চিত হয়ে আছে, কে তা অস্বীকার করতে পারে? শুধু তাই নয়, জাতির পুরনো ইতিহাসের অনেক গোপন কথাও এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় ।
আমরা আজও বলি— ‘পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর।’এই প্রবাদ বাক্যটি সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন পাণ্ডুয়া বঙ্গের রাজধানী ছিল। কে এই প্রবাদ বাক্য, ডাক, খনার বচনগুলি সংগ্রহ করে তাদের চিরকাল জীবন্ত করে রাখবে?
তারপর ধরুন, ছড়ার কথা। কথায় কথায় ছেলেমেয়েগুলো ছড়া কাটতে থাকে। রোদের সময় বৃষ্টি হচ্ছে, অমনি তারা সমস্বরে ঝংকার দিয়ে ওঠে—
রোদ হচ্ছে, পানি হচ্ছে,
খেঁকশিয়ালীর বিয়ে হচ্ছে ।
এর সঙ্গে সঙ্গে মনে করুন মায়ের সেই ঘুমপাড়ানী গান, সেই খোকা-খুকির ছড়া। এগুলি সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস, কিন্তু আজ দুঃখে দৈন্যে প্রাণে সুখ নেই। ছড়াও ক্রমে লোকে ভুলে যাচ্ছে। কে এগুলিকে বইয়ের পাতায় অমর করে রাখবে ?

শুধু ছড়া কেন? খেলাধুলার না কত বাঁধা গৎ আছে বা ছিল আমাদের এ দেশে । যখন ফুটবল, ব্যাটবলের নাম কারও জানা ছিল না, তখন কপাটি খেলার খুব ধুম ছিল। সে খেলার সঙ্গে কত না বাঁধা বুলি ছেলেরা ব্যবহার করত—
এক হাত বোল্লা বার হাত শিং
উড়ে যায় বোল্লা ধা তিং তিং ৷
বিদেশি খেলার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে এসব লোপ পাবার উপক্রম হয়েছে। কে এদের বাঁচিয়ে রাখবে? তারপর ধরুন, পল্লিগানের কথা। পল্লিসাহিত্য সম্পদের মধ্যে এই গানগুলি অমূল্য রত্নবিশেষ। সেই জারি গান, সেই ভাটিয়ালি গান, সেই রাখালি গান, মারফতি গান- গানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার পল্লির ঘাটে, মাঠে ছড়ানো রয়েছে। তাতে কত প্রেম, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, কত তত্ত্বজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শহুরে গানের প্রভাবে সেগুলো এখন বর্বর চাষার গান বলে ভদ্রসমাজে আর বিকায় না । কিন্তু -
মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না ।
এই গানটির সঙ্গে আপনার শহুরে গানের কোনো তুলনা হতে পারে? কিন্তু ধারাবাহিকরূপে সেগুলো সংগ্রহের জন্য কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি?
এ পর্যন্ত যা বললাম সেগুলো হচ্ছে পল্লির প্রাচীন সম্পদ। সাহিত্যের ভাণ্ডারে দান করবার মতো পল্লির নতুন সম্পদেরও অভাব নেই। আজকাল বাংলাসাহিত্য বলে যে সাহিত্য চলছে, তার পনেরো আনা হচ্ছে শহুরে সাহিত্য, সাধু ভাষায় বলতে গেলে নাগরিক সাহিত্য। সে সাহিত্যে আছে রাজ-রাজড়ার কথা, বাবু-বিবির কথা, মোটরগাড়ির কথা, বিজলি বাতির কথা, সিনেমা থিয়েটারের কথা, চায়ের বাটিতে ফুঁ দেবার কথা। এইসব কথা নিয়ে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক রাশি রাশি লেখা হচ্ছে। পল্লির গৃহস্থ কৃষকদের, জেলে-মাঝি, মুটে-মজুরের কোনো কথা তাতে ঠাঁই নাই। তাদের সুখ-দুঃখ, তাদের পাপ-পুণ্য, তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষার কথায় কজন মাথা ঘামাচ্ছে? আমাদের বিশ্ববরেণ্য কবিসম্রাটও একবার ‘এবার ফিরাও মোরে' বলে আবার পুরানো পথে নাগরিক সাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ধানগাছে তক্তা হয় কিনা, এখন শহুরে লোকেরা এটা জানলেও পাড়াগাঁয়ের জীবন তাদের কাছে এক অজানা রাজ্য। সেটা কারো কাছে একেবারে পচা জঘন্য, আর কারো কাছে একেবারে চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়ে ঘেরা। তাঁরা পল্লির মর্মকথা কী করে জানবেন? কী করেই বা তার মুখচ্ছবিখানি আঁকবেন? আমাদের আজ দরকার হয়েছে শহুরে সাহিত্যের বালাখানার পাশে গেঁয়ো সাহিত্যের জোড়াবাংলা ঘর তুলতে। আজ অনেকের আত্মা ইট-পাথর ও লোহার কৃত্রিম বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে মাটির ঘরে মাটির মানুষ হয়ে থাকতে চাচ্ছে। তাদের জন্য আমাদের কিছু গড়াগাঁথার দরকার আছে। ইউরোপ, আমেরিকায় আজ এই Proletariat সাহিত্য ক্রমে আদরের আসন পাচ্ছে, আমাদের দেশেও পাবে। কিন্তু কোথায় সে পল্লির কবি, ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক, যাঁরা নিখুঁতভাবে এই পল্লির ছবি শহরের চশমা আঁটা চোখের সামনে ধরতে পারবেন?

এই সমস্ত রূপকথা, পল্লিগাথা, ছড়া প্রভৃতি দেশের আলোবাতাসের মতো সকলেরই সাধারণ সম্পত্তি। তাতে হিন্দু মুসলমান কোনো ভেদ নেই। যেরূপ মাতৃস্তন্যে সন্তান মাত্রেরই অধিকার, সেরূপ এই পল্লিসাহিত্যে পল্লিজননীর হিন্দু মুসলমান সকল সন্তানেরই সমান অধিকার ।
এক বিরাট পল্লিসাহিত্য বাংলায় ছিল। তার কঙ্কালবিশেষ এখনও কিছু আছে, সময়ের ও রুচির পরিবর্তনে সে অনাদৃত হয়ে ধ্বংসের পথে দাঁড়িয়েছে। নেহাত সেকেলে পাড়াগাঁয়ের লোক ছাড়া সেগুলোর আর কেউ আদর করে না। কিন্তু একদিন ছিল যখন নায়ের দাঁড়ি-মাঝি থেকে গৃহস্থের বউ-ঝি পর্যন্ত, বালক থেকে বুড়ো পর্যন্ত, আমির থেকে গরিব পর্যন্ত সকলকেই এগুলো আনন্দ উপদেশ বিলাতো। যদি পল্লিসাহিত্যের দিকে পল্লিজননীর সন্তানেরা মনোযোগ দেয়, তবেই আমার মনে হয় এরূপ পল্লিসাহিত্য সভার আয়োজন সার্থক হবে, নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার।

Content added By

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১০ই জুলাই ১৮৮৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৯১০ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বি.এ. অনার্স পাস করেন। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে ডিপ্লোমা এবং ডি. লিট. লাভের গৌরব অর্জন করেন। তিনি সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসরকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষরূপে নিয়োজিত ছিলেন। অসামান্য প্রতিভাধর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন সুপণ্ডিত ও ভাষাবিদ। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির অধিকারী। প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে দুরূহ ও জটিল সমস্যার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে তিনি অসামান্য পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, বাংলা সাহিত্যের কথা (দুই খণ্ড) এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । তাঁর অন্যতম কালজয়ী সম্পাদনা গ্রন্থ বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। তিনি আলাওলের পদ্মাবতী, বিদ্যাপতি শতক সহ আরও অনেক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। শিশু পত্রিকা আঙুর তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক অনুবাদ এবং নানা মৌলিক রচনায় তিনি তাঁর দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। ১৩ই জুলাই ১৯৬৯ সালে ঢাকায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ জীবনাবসান ঘটে ।

Content added By

কলগান- শ্রুতিমধুর ধ্বনি। পরতে পরতে- স্তরে স্তরে। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন - বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক ও সাধক দীনেশচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে তিনিই সর্বপ্রথম ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' গ্রন্থে বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের গৌরব ও মর্যাদা সাহিত্যের দরবারে তুলে ধরেন। তাঁরই সুযোগ্য সম্পাদনায় চন্দ্রকুমার দে কর্তৃক সংগৃহীত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ এবং ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেনের মৌলিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে রামায়ণী কথা, বৃহৎবঙ্গ, বেহুলা, ফুল্লরা, জড়ভরত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন।

রোমাঁ রোলাঁ- (Roman Rolland) - ফরাসি দেশের কালজয়ী সাহিত্যিক ও দার্শনিক। রোমাঁ রোলাঁর জন্ম ২৯ শে জানুয়ারি ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। ‘জাঁ ক্রিস্তফ' উপন্যাস তাঁর অমূল্য কীর্তি। এ গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে তার মৃত্যু হয়। মদিনা বিবি- মৈমনসিংহ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত লোকগাথা ‘দেওয়ানা-মদিনা'র নায়িকা ।
মনসুর বয়াতি - দেওয়ানা-মদিনা'র লোকগাথার প্রখ্যাত কবি। আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ - আরব্য উপন্যাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গল্প ‘আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ'। এ গল্পটির ঘটনাস্থল চীন দেশ। আলাউদ্দিন নামের এক সাহসী তরুণ এক চতুর জাদুকরের বিস্ময়কর প্রদীপ লাভ করে । আলাউদ্দিন ছিল গরিব এক দুঃখিনী মায়ের একমাত্র ছেলে। এ প্রদীপে ঘষা দিলেই এক মহাশক্তিধর দৈত্য এসে হাজির হতো এবং আলাউদ্দিনের আদেশ অনুযায়ী অলৌকিক কাজ করত। এভাবেই এ প্রদীপের বদৌলতে আলাউদ্দিন প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়। মায়ের দুঃখও দূর হয় ।
আলিবাবা ও চল্লিশ দস্যু- আরব্য উপন্যাসের অন্যতম বিখ্যাত গল্প। গরিব কাঠুরে আলিবাবা ভাগ্যক্রমে পাহাড়ের গুহায় দস্যুদলের গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধান পায় । সেখান থেকে প্রচুর ধনরত্ন এনে সে বাড়িতে রাখে। দস্যুদল আলিবাবার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে। আলিবাবা তার বুদ্ধিমতী বাঁদি মর্জিনার সহায়তায় এই দস্যুদলকে কাবু করে ।

Lamb's Tales from Shakespeare - বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজি নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো চার্লস ল্যাম্ব সহজ ভাষায় কিশোরদের উপযোগী করে রূপান্তর করেন। সেই গ্রন্থেরই উল্লেখ এখানে করা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক- পুরাতত্ত্ববিদ । যিনি প্রাচীন লিপি, মুদ্রা বা ভগ্নাবশেষ থেকে পুরাকালের তথ্য নির্ণয় করেন ।

Folklore Society- যে সমিতি লোকশিল্প ও গান, উৎসব-অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার উপাদান সংগ্রহ করে এবং প্রচারের জন্য নানা কাজ করে থাকে। এ সমিতি লোকসাহিত্য সংরক্ষণ ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত। উইলিয়াম থমস‘ফোকলোর' কথাটির উদ্ভাবক। ১৮৪৮ সালে সর্বপ্রথম লণ্ডনে এই সমিতি গঠিত হয় ৷
নৃতত্ত্ব (Anthropology)- মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ সংক্রান্ত বিজ্ঞান ।
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার- প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক ও বাংলা লোকগাথা ও রূপকথার রূপকার দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের জন্ম ১২৮৪ বঙ্গাব্দে, মৃত্যু ১৩৬৩ সনে। তিনি বাংলার নানা অঞ্চল ঘুরে বহু পরিশ্রম করে রূপকথা সংগ্রহ করেন। তাঁর রচিত ঠাকুরমার ঝুলি শিশুদের প্রিয় বই।
প্রবাদবাক্য- দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিশ্বাসযোগ্য কথা বা জনশ্রুতি, যেমন, ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা' ।
খনা- প্রাচীন ভারতের প্রখ্যাত নারীজ্যোতিষী । বাংলাদেশের জলবায়ু-নির্ভর কৃষিতত্ত্ব বিষয়ে উপদেশমূলক খনার ছড়াগুলো অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে রচিত বলে ধারণা করা হয় । পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত বারাসত মহকুমার দেউলি গ্রামে তাঁর নিবাস ছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
বালাম- বইয়ের খণ্ড, ইংরেজি Volume। ভূয়োদর্শন- প্রচুর দেখা ও শোনার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা । বালাখানা- প্রাসাদ।

Proletariat সাহিত্য- অত্যাচারিত শ্রমজীবী দুঃখী মানুষের সাহিত্য। ফক্কিকার - ফাঁকিবাজি ।

Content added By

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ জেলায় ‘পূর্ব ময়মনসিংহ সাহিত্য সম্মিলনী'র একাদশ অধিবেশনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সভাপতিত্ব করেন। এ সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে তিনি যে অভিভাষণ দেন, তারই পুনর্লিখিত রূপ এই ‘পল্লিসাহিত্য' প্রবন্ধটি। আলোচ্য প্রবন্ধে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলার পল্লিসাহিত্যের বিশেষ কয়েকটি দিক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। লেখক এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, একদিন এক বিরাট পল্লিসাহিত্য বাংলাদেশে ছিল, আজ উপযুক্ত গবেষক এবং আগ্রহী সাহিত্যিকদের উদ্যোগ ও চেষ্টায় সেই সম্পদগুলো সংগ্রহ করা নিতান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং প্রসারের জন্য পল্লিসাহিত্যের বিচিত্র সম্পদ বিশেষ যত্নের সঙ্গে আহরণ করা একান্ত আবশ্যক। প্রবন্ধটি আবহমান কালের বাঙালি, বাংলাদেশ, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি সকলকে সচেতন হতে উৎসাহিত করে।

Content added By

চাকরি করা কাজ উত্তম, যখন তা হয় জাতির সেবা- যখন তাতে মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয় না । যখন জীবন ধারণের সম্বল হয়ে পড়ে চাকরি-যখন সেটাকে দেশ-সেবা বলে মনে হয় না,তখন তা কোরো না । সত্য ও আইন অপেক্ষা উপরিস্থ কর্মচারীকে যদি বেশি মানতে হয়, তা হলে সরে পড়। প্রভুর সামনে যদি মনের বল না থাকে, কঠিনভাবে সত্য বলতে না পার, প্রয়োজন হলেই চাকরি ছেড়ে দেবার সঙ্গতি না থাকে— তাহলে বুঝব চাকরি করে তুমি পাপ করেছ।
মনের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে না পারলে তোমাতে ও পশুতে প্রভেদ থাকবে না— জীবন তোমার
মিথ্যা হবে। স্বাধীন হৃদয়, সত্যের সেবক কামার হও, সেও ভালো। নিজকে যন্ত্র করে ফেলো না ।
সৎ, জ্ঞানী ও মহৎ যিনি, তিনি নিজকে ব্যক্তিত্বহীন করতে ভয়ংকর লজ্জা বোধ করেন। তিনি তাতে পাপ বোধ করেন।
চাকরি করে অন্যায় পয়সায় ধনী হবার লোভ রাখ? তোমার চেয়ে মুদি ভালো। মুদির পয়সা পবিত্র। অনেক যুবক থাকতে পারে, যারা মনে করে কোনোরকম একটা চাকরি সংগ্রহ করে সমাজের ভেতরে আসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই হলো। চুরির সাহায্যেই হোক বা অসৎ উপায় অবলম্বন করেই হোক, ক্ষতি নেই ৷
চরিত্র তোমার নিষ্কলঙ্ক- সামান্য কাজ করে পয়সা উপায় কর, তাতে জাত যাবে না। চুরি অন্যায়ের সাহায্যে যে বাঁচতে চেষ্টা করে, তারই জাত যায়, অসৎ উপায়ে আয় কোরো না, মিথ্যার আশ্রয় নিও না। লোককে কায়দায় ফেলে অর্থ সংগ্রহ করতে তুমি ঘৃণা বোধ কোরো ।
ইউরোপের জ্ঞানগুরু প্লেটো মিসর ভ্রমণকালে মাথায় করে তেল বেচে রাস্তা-খরচ যোগাড় করতেন। যে কুঁড়ে, আলসে, ঘুষখোর ও চোর, সেই হীন। ব্যবসা বা ছোটো স্বাধীন কাজে মানুষ হীন হয় না- হীন হয় মিথ্যা চতুরতা ও প্রবঞ্চনায়। পাছে জাত যায়, সম্মান নষ্ট হয়— এই ভয়ে পরের গলগ্রহ হয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছ ? সম্মান কোথায়, তা তুমি টের পাওনি?
সৎ উপায়ে যে পয়সা উপায় করা যায় তাতে তোমার আত্মার পতন হবে না। তোমার আত্মার পতন হবে আলস্যে ও অসাধুতায় । তোমারই স্পর্শে কাজ গৌরবময় হবে। আমাদের দেশের লোক যেমন আজকাল বিলেতে যায় এককালে তেমনি করে বিলেতের লোক গ্রিস ভ্রমণে যেত ।

বিলেত-ফেরত লোককে কেউ ইট টেনে বা কুলির কাজ করে পয়সা উপায় করতে দেখেছে?
বিলেতের এক পণ্ডিত দেশভ্রমণ দ্বারা অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন— গ্রিকদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি আরম্ভ করলেন এমন কাজ, যা তুমি আমি করতে লজ্জাবোধ করব। তাতে কি তাঁর জাত গিয়েছিল? যার মধ্যে জ্ঞান ও গুণ আছে, সে কয়দিন নিচে পড়ে থাকে? লোকে তাকে সম্মান করে উপরে টেনে তোলেই ।
কাজে মানুষের জাত যায় না- এটা বিশ্বাস করতে হবে। কাজহীন হও ঐ সময় যখন কাজের ভেতর অসাধুতা প্রবেশ করে, আর কোনো সময়েই নয় ।
বিশ্ব-সভ্যতার এত দান তুমি ভোগ কর এসব কী করে হলো? হাতের সাহায্যে নয় কি? কাজকামকে খেলো মনে করলে চলবে না। মিস্ত্রির হাতুড়ির আঘাত, কামারের কপালের ঘাম, কুলির কোদালকে শ্রদ্ধার চোখে দেখো ।
অনেকে বলে, তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। যে কাজই তারা করুক, যে দিকেই তারা হাঁটুক- কেবল ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা! মূর্খ যারা তারাই এ কথা বলে। তাদের এ ব্যর্থতার জন্য তারা নিজে দায়ী! এই নৈরাশ্যের হা-হুতাশ তাদেরই অমনোযোগ আর কুঁড়েমির ফল ।
ডাক্তার জনসন মাত্র কয় আনা পয়সা নিয়ে লন্ডনের মতো শহরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, অথচ তিনি কারও কাছে কোনো হাত পাতেননি। এক বন্ধু তাঁকে এক সময় এক জোড়া জুতো দিয়েছিলেন। অপমানবোধ করে তিনি সে জুতো পথে ফেলে দিয়েছিলেন। উদ্যম, পরিশ্রম ও চেষ্টার সামনে সব বাধাই পানি হয়ে যায়। এ গুণ যার মধ্যে আছে, যে ব্যক্তি পরিশ্রমী, তার দুঃখ নেই। জনসনকে অনেক সময় রাত্রিতে না খেয়ে শুয়ে থাকতে হতো, তাতে তিনি কোনোদিন ব্যথিত বা হতাশ হননি। বাধাকে চূর্ণ করে বীরপুরুষের মতো তিনি যে কীর্তি রেখে গিয়েছেন, তা অনেক দেশের অনেক পণ্ডিতই পারবেন না ।
গুণ থাকলেও চেষ্টা না করলে জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। আরভিং সাহেব বলেছেন, চুপ করে বসে থাকলে কাজ হবে না। চেষ্টা কর, নড়াচড়া কর, এমন কি কিছু-নাড়, ভেতর কিছু ফলাতে পারবে। কুকুরের মতো চিৎকার কর, সিংহ হয়েও ঘুমিয়ে থাকলে কী লাভ?
পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছ, তারপর মনে হচ্ছে তোমার মূল্য এক পয়সা নয়। জিজ্ঞাসা করি, কেন ? জান না, এ জগতে যারা নিতান্ত আনাড়ি তারা মাসে হাজার হাজার টাকা উপায় করছে?
তোমার এই মর্মবেদনা ও দুঃখের কারণ তুমি মূর্খ । মানুষ বালিতে সোনা ফলাতে পারে, এ তুমি
বিশ্বাস কর না? তুমি কুড়ে, তোমার উদ্যম নেই, তুমি একটা আত্মপ্রত্যয়হীন অভাগা ।
কাজ ছোটো হোক, বড়ো হোক, প্রাণ-মন দিয়ে করবে। মূল্যহীন বন্ধুগণের লজ্জায় কাজকে ঘৃণা কোরো না। সকল দিকে, সকল রকমে তোমার কাজ যাতে সুন্দর হয় তার চেষ্টা করবে।
ফক্স সাহেবকে এক সময় এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, আপনার লেখা ভালো নয়। কাজের চারুতার প্রতি তাঁর এত নজর ছিল যে, তিনি সেই দিন থেকে স্কুলের বালকের ন্যায় লেখা আরম্ভ করলেন এবং অল্পকালের মধ্যে তাঁর লেখা চমৎকার হয়ে গেল ।

উন্নতির আর এক কারণ হচ্ছে দৃষ্টি ও মনোযোগ। এক ভদ্রলোকের খানিক জমি ছিল। জমিতে লাভ তো হতই না, বরং দিন দিন তাঁর ক্ষতি হচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে নামমাত্র টাকা নিয়ে তিনি এক ব্যক্তিকে জমিগুলো ইজারা দিলেন। কয়েক বছর শেষে ইজারাদার এক দিন ভূস্বামীকে বললেন, যদি জমিগুলো বিক্রয় করেন তাহলে আমাকেই দেবেন। আপনার কৃপায় এই কয় বছরে আমি অনেক টাকা জমা করতে সক্ষম হয়েছি। ভূস্বামী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কয় বছরের ভেতর যে জমিতে আমি একটা পয়সা উপায় করতে পারিনি, সেই জমি মাত্র কয়েক বছর চাষ করেই খরিদ করতে সাহস করছ? সে বলল, আপনার মতো অমনোযোগী ও বাবু আমি নই। পরিশ্রম ছাড়া আমি আর কিছু জানি না । বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমানো আমার অভ্যাস নয় ।
এক যুবক স্কট সাহেবের কাছে উপদেশ চেয়েছিল। যুবককে তিনি এই উপদেশ দেন : কুঁড়েমি কোরো না, যা করবার, তা এখনই আরম্ভ কর । বিশ্রাম যদি করতে হয় কাজ সেরে করবে।
সময়ের যারা সদ্ববহার করে, তারা জিতবেই। সময়েই টাকা, সময় টাকার চেয়ে বেশি। জীবনকে উন্নত করো কাজ করে। জ্ঞান অর্জন কর। চরিত্রকে ঠিক করে বসে থাক। কৃপণের মতো সময়ের কাছ থেকে তোমার পাওনা বুঝে নাও ।
এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন নষ্ট কর, বৎসর শেষে গুণে দেখ, অবহেলায় কত সময় নষ্ট হয়েছে। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন একটু করে কাজ কর, দেখবে বৎসর শেষে, এমনকি মাসে কত কাজ তোমার হয়েছে। তোমার কাজ দেখে তুমি নিজেই বিস্মিত হবে। প্রতিদিন তোমার চিন্তা একখানা কাগজে বেশি নয়-দশ লাইন করে ধরে রাখ, দেখবে বছর শেষে তুমি একখানা সুচিন্তিত চমৎকার বই লিখে ফেলেছ। জীবনকে ব্যবহার কর, দেখবে মৃত্যু জীবনের হাজার কীর্তির নিশান উড়িয়ে দিয়েছে। জীবন আলস্যে, বিনা কাজে কাটিয়ে দাও, মৃত্যুকালে মনে হবে জীবনে তোমার একটা মিথ্যা লীলার অভিনয় ছাড়া আর কিছু হয় নি— একটা সীমাহীন দুঃখ ও হা-হুতাশের সমষ্টি ! জীবন শেষে যদি বলো, ‘জীবনে কী করলাম? কিছু হলো না' তাতে কী লাভ হবে? কাজের প্রারম্ভে ভেবে নিও, তুমি কোন কাজের উপযোগী, জগতে কোন কাজ করবার জন্য তুমি তৈরি হয়েছ – কোন কাজে তোমার আত্মা তৃপ্তি লাভ করে।
সাধুতা ও সত্যের ভেতর দিয়ে যেমন উন্নতি লাভ করা যায়, এমন আর কিছুতে নয়। সত্য এবং সাধুতাকে লক্ষ্য রেখে ব্যবসা কর, তোমার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। জুয়াচুরি করে দু দিনের জন্য তুমি লাভবান হতে পার, সে লাভ দু দিনের। জগতে যে সমস্ত মানুষ ব্যবসাতে উন্নতি করেছেন তাঁদের কাজেকামে কখনও মিথ্যা, জুয়াচুরি ছিল না। ব্যবসা, ভালো কাজ-এর ভেতর অমর্যাদার কিছু নেই। অগৌরব হয় হীন পরাধীনতায়, মিথ্যা ও অসাধুতায়।
এক ব্যক্তি মুদি জীবনের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল। মরবার আগে একখানা কাগজে লিখে রেখে গিয়েছিল— ‘এ হীন জীবন আমার পক্ষে অসহনীয়।' তার মৃত্যুতে আমাদের মনে কোনো দয়ার উদ্রেক হয় না। লোকটি এত হীন ছিল যে, তার মুদি হয়ে বাঁচবারও অধিকার ছিল না । কাজকাম বা ব্যবসাতে অগৌরব নেই। ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ নবাব বংশের নাম পূর্ববঙ্গে প্ৰসিদ্ধ ।

এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্লাহ্ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। জাতির কল্যাণ হয় ব্যবসার ভেতর দিয়ে । ব্যবসাকে যে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না সে মূর্খ। ইংরেজ জাতির এই গৌরব-গরিমার এক কারণ ব্যবসা । ব্যবসা না করলে তারা এত বড় হতে পারত না ।
যে জিনিস নিজে কিনলে ঠকেছ বলে মনে হয়, সে জিনিস ক্রেতাকে কখনও দিও না। কখনও অনভিজ্ঞ ক্রেতাকে ঠকিও না। হয়তো মনে হবে তোমার লোকসান হলো, কিন্তু না, অপেক্ষা কর, তোমার সাধুতা ও সুনাম ছড়াতে দাও, লোকসানের দশগুণ এসে তোমার পকেটে ভর্তি হবে ।
ব্যবসার ভেতর সাধুতা রক্ষা করে কাজ করায় অনেকখানি মনুষ্যত্বের দরকার। যে ব্যবসায়ী লোভ সংবরণ করে নিজের সুনামকে বাঁচিয়ে রাখে, সে কম মহত্ত্বের পরিচয় দেয় না। মিষ্ট ও সহিষ্ণু ব্যবহার, ভদ্রতা এবং অল্প লাভের ইচ্ছা তোমার ব্যবসায়ী জীবনকে সফল করবে।
অনবরত চাকরির লোভে যুবকেরা সোনার শক্তিভরা জীবনকে বিড়ম্বিত করে দিচ্ছে। মিস্ত্রি, কামার, শিল্পী, দরজি এরা কি সত্যই নিম্নস্তরের লোক? অশিক্ষিত বলেই কি সভ্য সমাজে এদের স্থান নেই? যা তুমি সামান্য বলে অবহেলা করছ, তা কতখানি জ্ঞান, চিন্তা ও সাধনার ফল তা কি ভেবে দেখেছ? শিক্ষিত ব্যক্তি যে কোনো কাজই করুক না, তার সম্মান, অর্থ দুই-ই লাভ হবে। আত্মার অফুরন্ত শক্তিকে মানুষের কৃপাপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ করে দিয়ো না।

Content added By

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ১৮৮৯ সালে মাগুরা জেলার পারনান্দুয়ালী গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস যশোর জেলার হাজীগ্রামে। লুৎফর রহমান এফ.এ. পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। তিনি প্রথমে শিক্ষক এবং পরে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি ডাক্তার লুৎফর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ সহজবোধ্য কিন্তু ভাবগম্ভীর। তিনি মহৎ জীবনের লক্ষ্যে সাহিত্যের মাধ্যমে মহৎ চিন্তা চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন । গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ এবং আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর রচনার প্রসাদগুণ। উন্নত জীবন, মহৎ জীবন, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, প্রীতি উপহার প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও ছোটদের বই রচনা করেছেন। ১৯৩৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।

Content added By

ব্যক্তিত্ব— ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। নিষ্কলঙ্ক- নির্মল। প্লেটো (খ্রি.পূ. ৪২৭-৩৪৭)- শিক্ষাব্রতী ও সত্যানুসন্ধানী প্লেটো ৩৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে একাডেমি নামে এথেন্সে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং শিক্ষামূলক গবেষণায় ব্রতী হন। রিপাবলিক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। প্লেটোর মতে, ব্যক্তিত্বের মান বা জীবনের সার্থকতা কী? তাঁর কথায় Only an examined life is worthliving অর্থাৎ পরীক্ষিত জীবনই সার্থক জীবন-আত্মজ্ঞানের দ্বারা পরিশীলিত জীবনবোধই ব্যক্তিসত্তার ধারক ও বাহক। অসাধুতা— প্রতারণা, অসৎকাজ। খেলো— মূল্যহীন, নিকৃষ্ট।
ড. জনসন- (Dr. Samuel Johnson : ১৭০৯-১৭৮৪)-একজন বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক ও ইংরেজি ভাষার প্রথম অভিধান সংকলক। তিনি বহু প্রখ্যাত অভিধান প্রণেতা। Dictionary, Vanity of Human Wishes, Rasselas, Prince of Abyssinia, Lives of the Poets ইত্যাদি গ্রন্থের জন্য তিনি স্মরণীয়।
আরভিং- (Washington Irving : ১৮৮৩-১৯৫৯)-একজন আমেরিকান লেখক। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় গ্রন্থের নাম ‘রিপ ভ্যান উইংকল ।’
স্কট- (Sir Walter Scott : ১৭৭১-১৮৩২)- ইংরেজি ভাষায় প্রখ্যাত স্কটিশ ঔপন্যাসিক ও গাথা রচয়িতা। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'আইভানহো' ।
 হা-হুতাশ-আক্ষেপধ্বনি । উদ্রেক-উদয়, সঞ্চার । গৌরব-গরিমা, মর্যাদা, গর্ব। বিড়ম্বিত-দুঃখপ্রাপ্ত। ব্যর্থ-নিষ্ফল ।

Content added By

‘উদ্যম ও পরিশ্রম' নিবন্ধটি মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন গ্রন্থের দশম পরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত । গ্রন্থের মূল নিবন্ধে এর নাম ‘চাকরি, কাজকর্ম ও ব্যবসা : উদ্যম, চেষ্টা, পরিশ্রম।' উদ্যম ও পরিশ্রম নিবন্ধে লুৎফর রহমান স্পষ্টরূপে উচ্চারণ করেছেন যে, জীবন ধারণের জন্য কাজ করতে হবে। তবে কোনো কাজই যেন মনের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে। চাকরি জীবনে স্বার্থবুদ্ধি বা অন্যায়ের কোনো স্পর্শ যেন না থাকে। কাজ ছোট হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু তা করতে গিয়ে যেন ব্যক্তি তার সত্তার অমর্যাদা না ঘটায়। পৃথিবীতে এমনও দৃষ্টান্ত আছে, যাঁরা এককালে ছোটখাটো কাজ করেছেন, আত্মসম্মান বজায় রেখে নিজ লক্ষ্য স্থির রেখে অবশেষে হয়েছেন পৃথিবীখ্যাত লোক । আত্মোন্নতির জন্য পরিশ্রম এবং উদ্যম অপরিহার্য, এর সঙ্গে উন্নত দৃষ্টি ও একাগ্র মনোযোগ থাকতে হবে। সত্তার মহিমা উদ্ভাসিত হয় কাজের মাধ্যমে, তেমনি সমাজেও স্বনির্ভর যুবকের, শিক্ষিত মানুষের অফুরন্ত শক্তির প্রকাশও আমরা দেখতে পাই। প্রবন্ধটির মূল শিক্ষা এই যে, উদ্যম ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করা যায়; অন্যের অনুগ্রহ নয়, বরং নিজের পরিশ্রম ও কাজের সূত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই জীবনের প্রকৃত সফলতা।

Content added By

জীবনকে সুন্দর করতে হলে সৌন্দর্যের নিদর্শন শিল্পকে সাধারণ জীবনে বিশিষ্ট একটু স্থান দেওয়া দরকার । আমাদের বাড়ি সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির প্রাঙ্গণ সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির আসবাবপত্র সুন্দর হওয়া চাই,বাড়ির সাজ-সরঞ্জাম সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির বেষ্টনীও সুন্দর হওয়া চাই। তারপর আমরা যা পরি, আমরা যা ব্যবহার করি, সবই সুন্দর হওয়া চাই। কেবল তাই নয়- আমাদের বসবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের উঠবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের কথা বলবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গি, আমাদের প্রত্যেকটি আচার, প্রত্যেকটি ব্যবহার সুন্দর হওয়া চাই। যা অসুন্দর, যা কদর্য, যা কুৎসিৎ, যা কদাকার সে সবকে কোন-না-কোন উপায়ে জীবন থেকে আমাদের তাড়াতে হবে। সত্য যেমন বাঞ্ছনীয় জীবনের অপরিহার্য একটি অঙ্গ, শ্রেয় যেমন বাঞ্ছনীয় জীবনের অপরিহার্য একটি অঙ্গ, সুন্দরও তেমনি সেই বাঞ্ছনীয় জীবনেরই অপরিহার্য একটি অঙ্গ। প্রাচীন গ্রীকেরা যে একান্তভাবে সৌন্দর্যপ্রিয় ছিলেন পাঠক সে কথা জানেন। তাঁরা যুদ্ধ-কুশল এবং যুদ্ধপ্রিয়ও ছিলেন। তাদের বিষয় আমি পড়েছি, যুদ্ধের সময় সর্বাঙ্গ লাল কাপড়ে আবৃত করে তাঁরা যুদ্ধে যেতেন, রক্তের দাগ দেহকে তাদের যাতে কুৎসিৎ, কদাকার করে না তোলে সেই উদ্দেশ্যে। আমাদেরও তাঁদেরই মতো জীবনকে সর্বপ্রকার কদর্যতা থেকে দূরে রাখবার চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশের গ্রামে এবং শহরে কি দৃশ্য আমরা দেখতে পাই? আমার নিজের এবং আশেপাশের গ্রামগুলির কথাই এখন বলি। মোটরযোগে কিংবা পদব্ৰজে District Board-এর রাস্তা বেয়ে গ্রামের দিকে অগ্রসর হই, তখন স্পষ্টই মনে হয়, District Board-এর কর্তারা জীবনে সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা মোটে উপলব্ধি করেন না! সরু, অসমান পথ, দুধারে তার আগাছার রাশ। পথের পাশ দিয়ে চলে গেছে নর্দমা, তাতে কতরকম আবর্জনা যে পড়ে আছে তা বর্ণনা করা যায় না। অদূরে বাঁশের বন, তাতে মানুষও প্রবেশ করতে পারে না, আলোকও প্রবেশ করতে পারে না। ডোবা, পুষ্করিণী, মজানদী সবই লতাগুল্মে ভরা— কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রয়াসের চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমরা দেশ নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসি। বক্ষ স্ফীত করে সব সময়ে আমরা বলে থাকি বাংলাদেশের মতো সুন্দর দেশ কোথাও নাই । কিন্তু সত্যই কি তাই!
এই সেদিন আমি শিমুলতলায় গিয়েছিলাম। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করেছিল। আমার সঙ্গে এক তরুণ বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি বড়োই ভালোবাসেন। শিমুলতলায় যাবার পূর্বে তাঁর কাছে বাংলা দেশের সৌন্দর্যের প্রশংসা অহরহ শুনতে পেতুম । ফেরবার সময় যখন আমাদের ট্রেন বাংলার মাটিতে প্রবেশ করলে তখন দেখলুম আমার তরুণ বন্ধু মাতৃভূমির সৌন্দর্যের বিষয়ে তাঁর মত সম্পূর্ণরূপে বদলে ফেলেছেন। সত্যই, বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসতে যে কদর্যতা আমাদের দৃষ্টিকে ব্যথায় জর্জরিত করে, তা দেখে মনে হয় না যে আমাদের দেশের লোকেরা জীবনের সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা কিছুমাত্র উপলব্ধি করছেন।
আমার গ্রামের কথায় ফেরা যাক্। District Board-এর রাস্তা থেকে যে পথ গ্রামে গিয়েছে সে পথ এত সরু যে, তার উপর দিয়ে কোন রকম যানবাহন চালান একান্ত কঠিন ব্যাপার। সেই সরু রাস্তাকে গ্রামবাসীদের সৌন্দর্য অনুভূতিহীন স্বার্থপরতা নিত্যই আরও সরু করে তুলছে। সকলেই সাধারণের রাস্তার এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি কিংবা ততোধিক পরিমাণ জমি নিজের এলাকাভুক্ত করবার জন্য ব্যগ্র। রাস্তার সৌন্দর্যের দিকে কারও দৃষ্টি নাই, সৌন্দর্য নামক জিনিসটার দিকেই কারও দৃষ্টি নাই। গ্রামে অনেকগুলি কোঠাবাড়ি আছে। সে সব প্রস্তুত করতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সৌন্দর্যানুভূতির কোন নিদর্শন বাড়িগুলির ভিতরেও পাওয়া যায় না আর বাইরেও পাওয়া যায় না। এক কাঠা জমি ও কেউ সুন্দরভাবে সাজাতে চেষ্টা করেনি। কেউ হয়তো কিছু ফার্নিচার, দু’একখানা ছবি একটা ঘরে রেখেছে। কিন্তু সে ঘরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, যে গৃহস্বামী Taste বা রুচি জিনিসটার সঙ্গে দূর সম্পর্কও রাখে না। মাটির বাড়ির অবস্থা কোঠাবাড়ির চেয়েও শোচনীয়,আর বাগান, পুষ্করিণী প্রভৃতির বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো ।
পল্লিগ্রামের বিষয় যা বলা হলো, শহরের বেলাতেও তাই বলা চলে। শহরের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বাড়ির বেষ্টনী প্রভৃতি দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আমাদের দেশবাসীরা জীবনে সৌন্দর্যের প্রয়োজন মোটেই অনুভব করেন না, সুন্দর কি আর অসুন্দর কি সে বিষয়ে তাঁদের ধারণা একান্তই কুহেলিকাবৃত ৷
আমি এক স্থানে বলেছি, পুনরায় বলি, সবচেয়ে বড়ো শিল্প হচ্ছে জীবন-শিল্প। অন্য সব রকমের শিল্প হচ্ছে সেই বিরাট জীবন শিল্পেরই এক একটি বিভাগমাত্র। প্রত্যেকটি বিভাগের দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা দরকার, জীবন-শিল্পকে সার্থক করার জন্যে । আর যদি সত্যই তা করতে হয়, তবে আমাদের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমাদের নাগরিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এক কথায় আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সেজন্য দরকার ব্যাপক এবং ঐকান্তিক সমবায়িক প্ৰচেষ্টা ।পাঠক বলবেন, এত বড়ো প্রচেষ্টার কথা বলা সহজ, করা সহজ নয়। ক্ষুদ্র আমি এতে কী করতে পারি? তবে বলি শুনুন । আপনি এতে অনেক কিছু করতে পারেন। আপনার বাড়িকে সুন্দর করে সাজান। আপনার বাড়ির উঠানকে, আশ-পাশের জমিকে পত্রেপুষ্পে শোভিত করে তুলুন । আপনার পোশাক - পরিচ্ছদ আর্টের এক একটি নিদর্শন হোক। সুন্দর এক বেষ্টনী আপনার জীবনে ঘিরে থাকুক। সুন্দরের প্রশংসায় আপনার কণ্ঠ মুখরিত হোক। দেখবেন নিজেকে যতটা ক্ষুদ্র মনে করেছিলেন ততটা ক্ষুদ্র আপনি নন। আর দেখবেন, আপনার স্তব-স্তুতিতে, আপনার সাধনায় তুষ্ট হয়ে সৌন্দর্যদেবী আপনার গ্রামে, আপনার পাড়ায় সশরীরে আবির্ভূত হয়েছেন। 

Content added By

হুগলি জেলার শ্রীরামপুরস্থ বড়তাজপুর গ্রামে ১৮৯০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এস. ওয়াজেদ আলি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ বেলায়েত আলী পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। শিলং-এর মোখার হাইস্কুল থেকে স্বর্ণপদকসহ এন্ট্রান্স পাসের পর তিনি আলীগড় কলেজ থেকে আই. . এবং ১৯১০ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থকে বি.. পাস করেন ১৯১৫ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার অ্যাট- ডিগ্রি লাভ করে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন ১৯২৫ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। সত্য সুন্দরের সাধনায়, নীতিজ্ঞান, ধর্মবোধ প্রেমের শাশ্বত মহিমায় মার্জিত রুচি পরিচ্ছন্ন রসবোধে তাঁর সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ : জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪৩); গল্পগ্রন্থ : গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); ভ্রমণকাহিনী : মোটরযোগে রাঁচির সফর (১৯৪৯), পশ্চিম ভারত (১৩৫৫) প্রকৃতপক্ষে এস. ওয়াজেদ আলি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একজন মনীষী। ১৯৫১ সালের ১০ই জুন তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

পদব্রজ - পায়ে হাঁটা। নর্দমা – পয়ঃপ্রণালি, ড্রেন। মজানদী - জলহীন নদী, এমন, শুকিয়ে যাওয়া নদী। স্ফীত – ফুলে বা ফেঁপে উঠেছে গর্বিত। কোঠাবাড়ি পাকাবাড়ি, - - অট্টালিকা, দালান। ফার্নিচার – আসবাবপত্র। কুহেলিকাবৃত – কুয়াশা আবৃত, প্রচ্ছন্ন। সমবায়িক - - সম্মিলিত উদ্যোগে কোনো কিছু গড়ে তোলার প্রয়াস, দলবদ্ধ প্রচেষ্টা ।

Content added By

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এস. ওয়াজেদ আলি রচনাবলি থেকে, ‘জীবনে শিল্পের স্থান' শীর্ষক প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। তবে মন না থাকলে মানুষ হয় না। আর এ মনকে সর্বদা মানস-সৌন্দর্যের চর্চায় নিবেদিত হতে হয়। কথাবার্তা, আচরণ, খাদ্য গ্রহণ, পোশাক নির্বাচন, গৃহসজ্জা, গৃহের চারপাশের পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি মানুষের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলে । এর ফলে পরিবার, সমাজ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে একটি সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার নিদর্শনরূপে গড়ে ওঠে। ‘জীবন শিল্পের স্থান' প্রবন্ধটিতে এস. ওয়াজেদ আলি জীবন ও সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। প্রবন্ধটি সৌন্দর্যবোধে উদ্বুদ্ধ হবার শিক্ষা দেয়।

Content added By

সকাল বেলা। আটটা কি নয়টা। হরিহরের পুত্র আপন মনে রোয়াকে বসিয়া খেলা করিতেছে, তাহার একটা ছোটো টিনের বাক্স আছে, সেটার ডালা ভাঙা। বাক্সের সমুদয় সম্পত্তি সে উপুড় করিয়া মেঝেতে ঢালিয়াছে । একটা রং-ওঠা কাঠের ঘোড়া, চার পয়সা দামের একটা টোল্-খাওয়া টিনের ভেঁপু-বাঁশি, গোটাকতক কড়ি। এগুলি সে মায়ের অজ্ঞাতসারে লক্ষ্মীপূজার কড়ির চুপড়ি হইতে খুলিয়া লইয়াছিল ও পাছে কেহ টের পায় এই ভয়ে সর্বদা লুকাইয়া রাখে- একটা দু'পয়সা দামের পিস্তল, কতকগুলো শুকনো নাটা ফল । দেখিতে ভালো বলিয়া তাহার দিদি কোথা হইতে অনেকগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল, কিছু তাহাকে দিয়াছে, কিছু নিজের পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে। খানকতক খাপরার কুচি। গঙ্গা-যমুনা খেলিতে এই খাপরাগুলির লক্ষ্য অব্যর্থ বলিয়া বিশ্বাস হওয়ায় সে এগুলি সযত্নে বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে, এগুলি তাহার মহামূল্যবান সম্পত্তি এতগুলি জিনিসের মধ্যে সবে সে টিনের বাঁশিটা কয়েকবার বাজাইয়া সেটির সম্বন্ধে বিগত কৌতূহল হইয়া তাহাকে একপাশে রাখিয়া দিয়াছে। কাঠের ঘোড়া নাড়াচাড়া করা হইয়া গিয়াছে। সেটিও একপাশে পিজরাপোলের আসামির ন্যায় পড়িয়া আছে। বর্তমানে সে গঙ্গা-যমুনা খেলিবার খাপরাগুলিকে হাতে লইয়া মনে মনে দাওয়ার উপর গঙ্গা-যমুনার ঘর আঁকা কল্পনা করিয়া চোখ বুজিয়া খাপরা ছুঁইয়া দেখিতেছে তাক ঠিক হইতেছে কি না!
এমন সময়ে তাহার দিদি দুর্গা উঠানের কাঁঠালতলা হইতে ডাকিল-অপু- ও অপু-। সে এতক্ষণ বাড়ি ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল। তাহার স্বর একটু সতর্কতা মিশ্রিত। মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পুতুলের মতো লক্ষ্মীর চুপড়ির কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল । পরে বলিল- কি রে দিদি?
দুর্গা হাত নাড়িয়া ডাকিল- আয় এদিকে- শোন্ -
দুর্গার বয়স দশ-এগারো বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মতো অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা । হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ- বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মতো চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু রোয়াক হইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল, – কে রে?

দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা! সেটা সে নিচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা । সুর নিচু করিয়া বলিল- মা ঘাট থেকে আসে নি তো?
অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল— উঁহু-
দুর্গা চুপিচুপি বলিল – একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুশি জারাবো অপু আহ্লাদের সহিত বলিয়া উঠিল – কোথায় পেলি রে দিদি? -
দুর্গা বলিল-পটলিদের বাগানে সিঁদুরকৌটোর তলায় পড়ে ছিল – আন্ দিকি একটু নুন আর তেল অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল – তেলের ভাঁড় ছুঁলে মা মারবে যে? আমার কাপড় যে বাসি? -
– তুই যা না শিগগিরি করে, মা'র আসতে এখন ঢের দেরি-ক্ষার কাচতে গিয়েচে শিগগির যা— অপু বলিল- নারকোলের মালাটা আমায় দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আসবো- তুই খিড়কি দোরে গিয়ে দ্যাখ মা আসচে কি না ।
দুর্গা নিম্নস্বরে বলিল— তেলটেল যেন মেঝেতে ঢালিসনে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পাবে- তুই তো একটা হাবা ছেলে— অপু বাড়ি মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা লইয়া আমগুলি বেশ
করিয়া মাখিল,– বলিল, নে হাত পাত ।
– তুই অতগুলো খাবি দিদি?
- অতগুলি বুঝি হলো? এই তো- ভারি বেশি- যা, আচ্ছা নে আর দু'খানা— বাঃ, দেখতে বেশ হয়েচে রে,একটা লঙ্কা আনতে পারিস? আর একখানা দেবো তা হলে
• লঙ্কা কী করে পাড়বো দিদি? মা যে তক্তার ওপর রেখে দ্যায়, আমি যে নাগাল পাই নে?
– তবে থাকগে যাক্ – আবার ওবেলা আনবো এখন-পটলিদের ডোবার ধারের আমগাছটায় গুটি যা ধরেচে – দুপুরের রোদে তলায় ঝরে পড়ে-
দুর্গাদের বাড়ির চারিদিকেই জঙ্গল। হরিহর রায়ের জ্ঞাতি-ভ্রাতা নীলমণি রায় সম্প্রতি গত বৎসর মারা গিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রকন্যা লইয়া নিজ পিত্রালয়ে বাস করিতেছেন। কাজেই পাশের এ ভিটাও জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়িয়া আছে। নিকটে আর কোনো লোকের বাড়ি নাই। পাঁচ মিনিটের পথ গেলে তবে ভুবন মুখুয্যের বাড়ি ।
হরিহরের বাড়িটাও অনেকদিন হইয়া গেল মেরামত হয় নাই, সামনের দিকের রোয়াক ভাঙা, ফাটলে বন-বিছুটির ও কালমেঘ গাছের বন গজাইয়াছে— ঘরের দোর- জানালার কপাট সব ভাঙা, নারিকেলের দড়ি দিয়া গরাদের সঙ্গে বাঁধা আছে ।
খিড়কি দোর ঝনাৎ করিয়া খুলিবার শব্দ হইল এবং একটু পরেই সর্বজয়ার গলা শুনা গেল- দুগ্‌গা, ও দুগ্‌গা- দুর্গা বলিল- মা ডাকছে, যা দেখে আয়- ওখানা খেয়ে যা- মুখে যে নুনের গুঁড়ো লেগে আছে, মুছে ফ্যাল্‌ -

মায়ের ডাক আর একবার কানে গেলেও দুর্গার এখন উত্তর দিবার সুযোগ নাই, মুখ ভর্তি । সে তাড়াতাড়ি জারানো আমের চাকলাগুলি খাইতে লাগিল । পরে এখনো অনেক অবশিষ্ট আছে দেখিয়া কাঁঠালগাছটার কাছে সরিয়া গিয়া গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সেগুলি গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল । অপু তাহার পাশে দাঁড়াইয়া নিজের অংশ প্রাণপণে গিলিতেছিল, কারণ চিবাইয়া খাওয়ার আর সময় নাই। খাইতে খাইতে দিদির দিকে চাহিয়া সে দোষ সম্বন্ধে সচেতনতাসূচক হাসি হাসিল। দুর্গা খালি মালাটা এক টান মারিয়া ভেরেণ্ডাকচার বেড়া পার করিয়া নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়িয়া দিল। ভাইয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- মুখটা মুছে ফ্যাল্ না বাঁদর, নুন লেগে রয়েছে যে ....
পরে দুর্গা নিরীহমুখে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া বলিল— কী মা?
–কোথায় বেরুনো হয়েছিল শুনি? একলা নিজে কতদিকে যাবো? সকাল থেকে ক্ষার কেচে গা— গতর ব্যথা হয়ে গেল, একটুখানি কুটোগাছটা ভেঙে দু খানা করা নেই, কেবল পাড়ায় পাড়ায় টোটো টোকলা সেধে বেড়াচ্ছেন- সে বাঁদর কোথায়?
অপু আসিয়া বলিল, মা, খিদে পেয়েছে!
-রোসো রোসো, একটুখানি দাঁড়াও বাপু ... একটুখানি হাঁপ জিরোতে দ্যাও! তোমাদের রাতদিন খিদে আর রাতদিন ফাই-ফরমাজ! ও দুগ্‌গা, দ্যাখ তো বাছুরটা হাঁক পাড়ছে কেন? খানিকটা পরে সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় বঁটি পাতিয়া শসা কাটিতে বসিল। অপু কাছে বসিয়া পড়িয়া
বলিল –আর এট্টু আটা বের করো না মা, মুকে বড্ড লাগে !
দুর্গা নিজের ভাগ হাত পাতিয়া লইয়া সঙ্কুচিত সুরে বলিল- চালভাজা আর নেই মা?
অপু খাইতে খাইতে বলিল— উঃ, চিবনো যায় না । আম খেয়ে দাঁত টকে- দুর্গার ভ্রুকুটিমিশ্রিত চোখটেপায় বাধা পাইয়া তাহার কথা অর্ধপথেই বন্ধ হইয়া গেল। তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল,- আম কোথায় পেলি?
সত্য কথা প্রকাশ করিতে সাহসী না হইয়া অপু দিদির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে চাহিল। সর্বজয়া মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- তুই ফের এখন বেরিয়েছিলি বুঝি?
দুর্গা বিপন্নমুখে বলিল- ওকে জিজ্ঞেস করো না? আমি- এই তো এখন কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে- তুমি যখন ডাকলে তখন তো—
স্বর্ণ গোয়ালিনী গাই দুহিতে আসায় কথাটা চাপা পড়িয়া গেল। তাহার মা বলিল- যা, বাছুরটা ধরগে যা— ডেকে সারা হোলো- কমলে বাছুর, ও সন্ন, এত বেলা করে এলে কি বাঁচে? একটু সকাল করে না এলে এই তেতপ্পর পজ্জন্ত বাছুর বাঁধা-
দিদির পিছনে পিছনে অপুও দুধ দোয়া দেখিতে গেল। সে বাহির উঠানে পা দিতেই দুর্গা হাতার পিঠে দুম্ করিয়া নির্ঘাত এক কিল বসাইয়া দিয়া কহিল- লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর! পরে মুখ ভ্যাঙাইয়া কহিল- আম খেয়ে দাঁত টকে গিয়েছে— আবার কোনোদিন আম দেবো খেও ছাই দেবো-এই ওবেলাই পটলিদের কাঁকুড়তলির আম কুড়িয়ে এনে জারাবো, এত বড় বড় গুটি হয়েচে, মিষ্টি যেন গুড়— দেবো তোমায়? খেও এখন? হাবা একটা কোথাকার— যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে !

দুপুরের কিছু পরে হরিহর কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিল। সে আজকাল গ্রামের অন্নদা রায়ের বাটীতে গোমস্তার কাজ করে । জিজ্ঞাসা করিল- অপুকে দেখচি নে? সর্বজয়া বলিল- অপু তো ঘরে ঘুমুচ্ছে।
—দুগ্‌গা বুঝি-
–সে সেই খেয়ে বেরিয়েছে- সে বাড়ি থাকে কখন? দুটো খাওয়ার সঙ্গে যা সম্পর্ক! আবার সেই খিদে পেলে তবে আসবে— কোথায় কার বাগানে কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে— এই চত্তির মাসের রোদ্দুরে, ফের দ্যাখো না এই জ্বরে পড়লো বলে— অত বড় মেয়ে, বলে বোঝাবো কত? কথা শোনে, না কানে নেয়?
একটু পরে হরিহর খাইতে বসিয়া বলিল— আজ দশঘরায় তাগাদার জন্যে গেছলাম, বুঝলে? একজন লোক, খুব মাতবর, পাঁচটা-ছয়টা গোলা বাড়িতে, বেশ পয়সাওয়ালা লোক- আমায় দেখে দণ্ডবৎ করে বল্লে—
দাদাঠাকুর, আমায় চিনতে পাচ্ছেন? আমি বল্লাম- না বাপু, আমি তো কৈ?— বল্লে- আপনার কর্তা থাকতে তখন তখন পূজা-আচ্চায় সবসময়ই তিনি আসতেন, পায়ের ধুলো দিতেন। আপনারা আমাদের গুরুতুল্য লোক, এবার আমরা বাড়িসুদ্ধ মন্তর নেবো ভাবচি— তা আপনি যদি আজ্ঞে করেন, তবে ভরসা করে বলি— আপনিই কেন মন্তরটা দেন না? তা আমি তাদের বলেচি আজ আর কোনো কথা বলবো না, ঘুরে এসে দু- এক-দিনে- বুঝলে ?
সর্বজয়া ডালের বাটি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল, বাটি মেজেতে নামাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল। বলিল- হ্যাঁগো, তা মন্দ কী? দাও না ওদের মন্তর? কী জাত? হরিহর সুর নামাইয়া বলিল- বলো না কাউকে!— সদ্‌গোপ । তোমার তো আবার গল্প করে বেড়ানো স্বভাব-
-আমি আবার কাকে বলতে যাবো, তা হোক গে সদ্‌গোপ, দাও গিয়ে দিয়ে, এই কষ্ট যাচ্ছে— ঐ রায়বাড়ির আটটা টাকা ভরসা, তাও দু'তিন মাস অন্তর তবে দ্যায়- আর এদিকে রাজ্যের দেনা। কাল ঘাটের পথে সেজ ঠারুন বল্লে- বৌমা, আমি বন্দক ছাড়া টাকা ধার দিই নে– তবে তুমি অনেক করে বল্লে বলে দিলাম- আজ পাঁচ পাঁচ মাস হয়ে গেল, টাকা আর রাখতে পারবো না। এদিকে রাধা বোষ্টমের বৌ তো ছিঁড়ে খাচ্ছে, দু'বেলা তাগাদা আরম্ভ করেচে। ছেলেটার কাপড় নেই— দু'তিন জায়গায় সেলাই, বাছা আমার তাই পরে হাসিমুখে নেচে নেচে বেড়ায়— আমার এমন হয়েচে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই—
-আর একটা কথা ওরা বলছিল, বুঝলে? বলছিল গাঁয়ে তো বামুন নেই, আপনি যদি এই গাঁয়ে উঠে আসেন, তবে জায়গা— জমি দিয়ে বাস করাই- গাঁয়ে একঘর বামুন বাস করানো আমাদের বড্ড ইচ্ছে। তা কিছু ধানের জমিটমি দিতেও রাজি— পয়সার তো অভাব নেই! আজকাল চাষাদের ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা— ভদ্দর লোকেরই হয়ে পড়েচে হা ভাত যো ভাত-

আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইল— এখুনি। তা তুমি রাজি হলে না কেন? বল্লেই হতো যে আচ্ছা আমরা আসবো! ও রকম একটা বড় মানুষের আশ্রয়- এ গাঁয়ে তোমার আছে কী ? শুধু ভিটে কামড়ে পড়ে থাকা-
হরিহর হাসিয়া বলিল— পাগল! তখুনি কি রাজি হতে আছে? ছোটলোক, ভাববে ঠাকুরের হাঁড়ি দেখচি শিকেয় উঠেচে- উঁহু, ওতে খেলো হয়ে যেতে হয়- তা নয়, দেখি একবার চুপি চুপি মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে- আর এখন ওঠ বল্লেই কী ওঠা চলে? সব ব্যাটা এসে বলবে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেবো না- দেখি পরামর্শ করে কি রকম দাঁড়ায়-
এই সময়ে মেয়ে দুর্গা কোথা হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া বাহিরের দুয়ারের আড়াল হইতে সতর্কতার সহিত একবার উঁকি মারিল এবং অপর পক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ দেখিয়া ওধারে পাঁচিলের পাশ বাহিয়া বাহির বাটীর রোয়াকে উঠিল। দালানের দুয়ার আস্তে আস্তে ঠেলিয়া দেখিল উহা বন্ধ আছে। এদিকে রোয়াকে দাঁড়ানো অসম্ভব, রৌদ্রের তাপে পা পুড়িয়া যায়, কাজেই সে স্থান হইতে নামিয়া গিয়া উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইল। রৌদ্রে বেড়াইয়া তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, আঁচলের খুঁটে কী কতকগুলো যত্ন করিয়া বাঁধা। সে আসিয়াছিল এইজন্য যে, যদি বাহিরের দুয়ার খোলা পায় এবং মা ঘুমাইয়া থাকে, তবে ঘরের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকিয়া একটু শুইয়া লইবে। কিন্তু বাবার, বিশেষত মার সামনে সম্মুখ দুয়ার দিয়া বাড়ি ঢুকিতে তাহার সাহস হইল না ।
উঠানে নামিয়া সে কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া কী করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহভাবে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল । পরে সেখানেই বসিয়া পড়িয়া আঁচলের খুঁট খুলিয়া কতকগুলি শুকনো রড়া ফলের বিচি বাহির করিল । খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে আপন মনে সেগুলি গুনিতে আরম্ভ করিল, এক-দুই- তিন-চার ... ছাব্বিশটা হইল। পরে সে দুই তিনটা করিয়া বিচি হাতের উল্টা পিঠে বসাইয়া উঁচু করিয়া ছুঁড়িয়া দিয়া পরে হাতের সোজা পিঠ পাতিয়া ধরিতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিল অপুকে এইগুলো দেবো আর এইগুলো পুতুলের বাক্সে রেখে দেবো-
কেমন বিচিগুলি তেল চুকচুক কচ্ছে— আজই গাছ থেকে পড়েছে, ভাগ্যিস আগে গেলাম, নৈলে সব গোরুতে খেয়ে ফেলে দিতো, ওদের রাঙি গাইটা একেবারে রাক্কস, সব জায়গায় যাবে, সেবার কতকগুলো এনেছিলাম আর এইগুলো নিয়ে অনেকগুলো হলো ।
সে খেলা বন্ধ করিয়া সমস্ত বিচি আবার সযত্নে আঁচলের খুঁটে বাঁধিল। পরে হঠাৎ কী ভাবিয়া রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে উড়াইতে উড়াইতে মহা খুশির সহিত পুনরায় সোজা বাটীর বাহির হইয়া গেল ।

Content added By

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালে ২৪ পরগনার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহানন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। স্থানীয় বনগ্রাম স্কুল থেকে ১৯১৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই.. এবং বি.. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি হুগলী, কলকাতা ব্যারাকপুরের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শরৎচন্দ্রের পরে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবন- যাপনের অসাধারণ এক আলেখ্য নির্মাণ করে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনের অভিন্ন সম্পর্কের চিরায়ত তাৎপর্যে তাঁর কথাসাহিত্য মহিমামণ্ডিত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো : পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতি, দৃষ্টিপ্রদীপ। গল্পগ্রন্থ : মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল। ইছামতি উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

রোয়াক – ঘরের সামনের খোলা জায়গা বা বারান্দা। চুপড়ি – ছোটো ঝুড়ি, ক্ষুদ্র ধামা। নাটাফল – করঞ্জা ফল। খাপরার কুচি – কলসি-হাঁড়ি প্রভৃতির ভাঙা অংশ বা টুকরা।  পিজরাপোলের আসামি – খাঁচায় পড়ে থাকা অবহেলিত আসামির মতো অর্থে। দাওয়া – বারান্দা। আমের কুসি – কচি আম। জারা – জীর্ণ করা, কুচি কুচি করা অর্থে। বন-বিছুটি – বুনো গাছ।কালমেঘ – যকৃতের রোগে উপকারী একপ্রকার তিক্ত স্বাদের গাছ। গরাদ— জানালার সিক। ভেরেণ্ডাকচার বেড়া-এরন্ড বা রেড়ি গাছের বেড়া । কুটোগাছ— তৃণ। রোসো রোসো - থাম থাম।

Content added || updated By

‘আম আঁটির ভেঁপু' শীর্ষক গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস থেকে সংকলন করা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাই-বোনের আনন্দিত জীবনের আখ্যান নিয়ে গল্পটি রচিত হয়েছে। অপু ও দুর্গা হতদরিদ্র পরিবারের শিশু। কিন্তু তাদের শৈশবে দারিদ্র্যের সেই কষ্ট প্রধান হয়ে ওঠেনি । গ্রামীণ ফলফলাদি খাওয়ার আনন্দ এবং বিচিত্র বিষয় নিয়ে তাদের বিস্ময় ও কৌতূহল গল্পটিকে মানুষের চিরায়ত শৈশবকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গল্পের সর্বজয়া পল্লি-মায়ের শাশ্বত চরিত্র হয়ে উঠেছে। গল্পটিতে শিশুর আনন্দপূর্ণ শৈশব এবং প্রকৃতির সম্পর্ক দেখিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। এ গল্প শিশু-কিশোরকে প্রকৃতিমুখী হওয়ার প্রেরণা জোগায় ।

Content added By

হযরতের মৃত্যুর কথা প্রচারিত হইলে মদিনায় যেন আঁধার ঘনাইয়া আসিল। কাহারও মুখে আর কথা সরে না; কেহবা পাগলের মতো কাণ্ড শুরু করে। রাসুলুল্লাহর পীড়ার খবর শুনিবার জন্য বহুলোক জমায়েত হইয়াছে। কে একজন বলিলেন, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। বীরবাহু ওমর উলঙ্গ তরবারি হাতে লইয়া লাফাইয়া উঠিলেন, যে বলিবে হযরত মরিয়াছেন, তাহার মাথা যাইবে ।
মহামতি আবুবকর শেষ পর্যন্ত হযরতের মৃত্যুশয্যার পার্শ্বে ছিলেন। তিনি গম্ভীরভাবে জনতার মধ্যে দাঁড়াইলেন। বলিলেন, যাহারা হযরতের পূজা করিত, তাহারা জানুক তিনি মারা গিয়াছেন; আর যাহারা আল্লাহর উপাসক, তাহাদের জানা উচিত আল্লাহ অমর, অবিনশ্বর। আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী : : মুহম্মদ (স.) একজন রাসুল বৈ আর কিছু নন। তাঁহার পূর্বে আরও অনেক রাসুল মারা গিয়াছেন । রাসুলুল্লাহ (স.) মরিতে পারেন, নিহত হইতে পারেন; তাই বলিয়া তিনি যেই সত্য তোমাদের দিয়া গেলেন তাহাকে কি তোমরা মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিবে না? এই বিশ্বভুবনে ঐ দূর অন্তরীক্ষে যাহা কিছু দেখিতে পাও সবই আল্লাহ্র সৃষ্টি, তাঁহারই দিকে সকলের মহাযাত্রা ।
হযরত আবুবকরের গম্ভীর উক্তিতে সকলেরই চৈতন্য হইল । হযরত ওমরের শিথিল অঙ্গ মাটিতে লুটাইল । তাঁহার স্মরণ হইল হযরতের বাণী : আমি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ মাত্র। তাঁহার মনে পড়িল কুরআনের আয়াত : মুহম্মদ, মৃত্যু তোমারও ভাগ্য, তাহাদেরও ভাগ্য। তাঁহার অন্তরে ধ্বনিয়া উঠিল মুসলিমের গভীর প্রত্যয়ের স্বীকারোক্তি অমর সাক্ষ্য : মুহম্মদ (স.) আল্লাহর দাস (মানুষ) ও রাসুল।
শোকের প্রথম প্রচণ্ড আঘাতে আত্মবিস্মৃতির পূর্ণ সম্ভাবনার মধ্যে দাঁড়াইয়া স্থিতধী হযরত আবুবকর (রা.) রাসুলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সীমারেখা সৃষ্টি করিয়া তুলিলেন । তিনি রাসুল, কিন্তু তিনি মানুষ, আমাদেরই মতো দুঃখ-বেদনা, জীবন-মৃত্যুর অধীন রক্ত-মাংসে গঠিত মানুষ— এই কথাই বৃদ্ধ হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) মূর্ছিত মুসলিমকে বুঝাইয়া দিলেন ।
তিনি মানুষের মন আকর্ষণ করিয়াছিলেন মুখ্যত তাঁহার মানবীয় গুণাবলি দ্বারা। মক্কার শ্রেষ্ঠ বংশে তিনি জন্মিয়াছিলেন । কিন্তু বংশগৌরব হযরতের সচেতন চিত্তে মুহূর্তের জন্যও স্থানলাভ করে নাই ।

জন্মদুঃখী হইয়া তিনি সংসারে আসিয়াছিলেন। এই দুঃখের বেদনা তাঁহার দেহসৌন্দর্য ও চরিত্র- মাধুরীর সহিত মিলিয়া তাঁহাকে নরনারীর একান্ত প্রিয় করিয়া তুলিয়াছিল । আবাল্য তিনি ছিলেন আল- আমিন- বিশ্বস্ত, প্রিয়ভাষী, সত্যবাদী। তাঁহার অসাধারণ যোগ্যতা, বুদ্ধি, বিচারশক্তি, বলিষ্ঠ দেহ দেখিয়া মানুষ অবাক হইয়া যাইত। এই সকল গুণ বিবি খাদিজাকে আকর্ষণ করিয়াছিল ।
বস্তুত হযরতের রূপলাবণ্য ছিল অপূর্ব, অসাধারণ। মক্কা হইতে মদিনায় হিযরতের পথে এক পরহিব্রতী দম্পতির কুটিরে তিনি আশ্রয় নেন। রাহী-পথিকদের সেবা করাই ছিল তাহাদের ব্রত। হযরত যখন আসিলেন, কুটিরস্বামী আবু মা’বদ মেষপাল চরাইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার পত্নী উম্মে মা'বদ ছাগীদুগ্ধ দিয়া হযরতের তৃষ্ণা দূর করিলেন । গৃহপতি ফিরিলে এই নারী স্বামীর কাছে নব অতিথির রূপ বর্ণনা করেন, সুন্দর, সুদর্শন পুরুষ তিনি। তাঁহার শীর্ষে সুদীর্ঘ কুঞ্চিত কেশপাশ, বয়ানে অপূর্ব কান্তশ্রী। তাঁহার আয়তকৃষ্ণ দুটি নয়ন, কাজল-রেখার মতো যুক্ত ভূযুগল, তাঁহার সুউচ্চ গ্রীবা, কালো কালো দুটি চোখের ঢলঢল চাহনি মনপ্রাণ কাড়িয়া নেয়। গুরুগম্ভীর তাঁহার নীরবতা, মধুবর্ষী তাঁহার মুখের ভাষণ, বিনীত নম্র তাঁহার প্রকৃতি । তিনি দীর্ঘ নন, খর্ব নন, কৃশ নন। এক অপূর্ব পুলকদীপ্তি তাঁহার চোখেমুখে, বলিষ্ঠ পৌরুষের ব্যঞ্জনা তাঁহার অঙ্গে। বড়ো সুন্দর, বড়ো মনোহর সেই অপরূপ রূপের অধিকারী ।
সত্যই হযরত বড়ো সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। তাঁহার চেহারা মানুষের চিত্ত আকর্ষণে যতটুকু সহায়তা করে,
তাহার সবটুকু তিনি পাইয়াছিলেন। সত্যের নিবিড় সাধনায় তাঁহার চরিত্র মধুময় হইয়া উঠিয়াছিল।
কাছে আসিলেই মানুষ তাঁহার আপনজন হইয়া পড়িত। অকুতোভয় বিশ্বাসে তিনি অজেয়
হইয়াছিলেন। শত্রুর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন তাঁহার অন্তরের লৌহকপাটে আহত হইয়া ফিরিয়া যাইত ।
কিন্তু সত্যে তিনি বজ্রের মতো কঠিন, পর্বতের মতো অটল হইলেও করুণায় তিনি ছিলেন কুসুমকোমল । বৈরীর অত্যাচারে বারবার তিনি জর্জরিত হইয়াছিলেন, শত্রুর লোষ্ট্রাঘাতে-অরাতির হিংস্র আক্রমণে বরাঙ্গের বসন তাঁহার বহুবার রক্তরঙিন হইয়া উঠিয়াছে, তথাপি পাপী মানুষকে তিনি ভালোবাসিয়াছিলেন, অভিশাপ দেওয়ার চিন্তাও তাঁহার অন্তরে উদিত হয় নাই। মক্কার পথে প্রান্তরে পৌত্তলিকের প্রস্তরঘায়ে তিনি আহত হইয়াছেন, ব্যঙ্গবিদ্রুপে বারবার তিনি উপহাসিত হইয়াছেন; কিন্তু তাঁহার অন্তর ভেদিয়া একটি মাত্র প্রার্থনার বাণী জাগিয়াছে;-এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর । তায়েফে সত্য প্রচার করিতে গিয়া তাঁহাকে কী ভীষণ পরীক্ষার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল; আমরা দেখিয়াছি। পথ চলিতে শত্রুর প্রস্তরঘায়ে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িতেছিলেন; তখন তাহারাই আবার তাঁহাকে তুলিয়া দিতেছিল। তিনি পুনর্বার চলা শুরু করিলে দ্বিগুণ তেজে পাথরবৃষ্টি করিতেছিল । রক্তে রক্তে তাঁহার সমস্ত বসন ভিজিয়া গিয়াছে, দেহ নিঃসৃত রুধিরধারা পাদুকায় প্রবেশ করিয়া জমিয়া শক্ত হইয়াছে, মৃত্যুর আবছায়া তাঁহার চৈতন্যকে সমাচ্ছন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে, তথাপি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তাঁহার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নাই । রমণীর রূপ, গৃহস্থের ধনসম্পদ, নেতৃত্বের মর্যাদা, রাজার সিংহাসন সব কিছুকে তুচ্ছ করিয়া সেই সত্যকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্বল জ্ঞানে আশ্ৰয় করিয়াছিলেন; তাঁহাকে উপহাসিত, অবহেলিত, অস্বীকৃত দেখিয়াও ক্রোধ, ঘৃণা বা বিরক্তির একটি শব্দও তাঁহার মুখে উচ্চারিত হয় নাই। অভিসম্পাত করিতে অনুরুদ্ধ হইয়াও তিনি বলিলেন : না না, তাহা কখনই সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতে আমি ইসলামের বাহন, সত্যের প্রচারক। মানুষের দ্বারে দ্বারে সত্যের বাণী বহন করা আমার কাজ। আজ যাহারা সত্যকে অস্বীকার করিতেছে, তাঁহাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছে, হয়ত কাল তাহারা তাহাদের অনাগত বংশধরেরা ইসলাম কবুল করিবে। আপনার আঘাত জর্জরিত দেহের বেদনায় তিনি কাতর। সত্যকে ব্যাহত দেখিয়া মনের ব্যথা তাঁহার সেই কাতরতাকে ছাপাইয়া উঠিল। তিনি ঊর্ধ্বদিকে বাহু প্রসারণ করিয়া বলিলেন : তোমার পতাকা যদি দিয়াছ প্রভু, হীন আমি, তুচ্ছ আমি, নির্বল আমি, তাহা বহন করিবার শক্তি আমায় দাও । বিপদবারণ তুমি অশরণের শরণ তুমি, তোমার সত্য মানুষের দ্বারে পৌঁছাইয়া তাহাকে উন্নীত করিলেন যাঁহারা— তাঁহাদের পংক্তিতে আমার স্থান দাও ৷
মক্কাবাসীরা হযরতের নবিত্ব লাভের শুরু হইতেই তাঁহার প্রতি কী নির্মম অমানুষিক অত্যাচার চালাইয়াছিল, আমরা দেখিয়াছি । যখন তাহাদের নির্যাতন সহনাতীত হইল, যখন দেখা গেল, কোরেশরা সত্যকে গ্রহণ করিবে না, হযরত মদিনায় চলিয়া গেলেন। পথে তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য, তাঁহার ও হযরত আবুবকরের ছিন্ন মুণ্ড আনিবার জন্য বিপুল পুরস্কারের লোভ দেখাইয়া, ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো হিংস শত শত ঘাতক পাঠানো হইল। বদর, ওহোদ ও আহযাব (বা খন্দক) যুদ্ধে মক্কার বাসিন্দা এবং তাহাদের মিত্রজাতিরা সম্মিলিত হইয়া ইসলামের ও মুসলিমের চিহ্নটুকু পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠ হইতে মুছিয়া ফেলিবার জন্য প্রাণপণ করিল। খয়বরের যুদ্ধে হযরতের পরাজয়ের মিথ্যা সংবাদ শুনিয়া হযরতের মৃত্যু সম্ভাবনায় আনন্দে আত্মহারা হইয়া পড়িল। হুদায়বিয়া সন্ধিতে হযরতের শান্তিপ্রিয়তার সুযোগ লইয়া মুসলিমের স্কন্ধে ঘোর অপমানের শর্ত চাপাইয়া দেওয়ার পরও তাহাদের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিতে চাহিল এবং তারপর হযরত যেই দিন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করিলেন, সেই দিনও তাঁহার সহিত যুদ্ধকামনা করিয়া খালিদের সহিত হাঙ্গামা বাঁধাইয়া দিল। এইভাবে শেষ পর্যন্ত যাহারা পদে পদে আনিয়া দিল লাঞ্ছনা, অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন, প্রত্যেক সুযোগে যাহারা হানিল বৈরিতার বিষাক্ত বাণ, হযরত তাঁহাদের সহিত কী ব্যবহার করিলেন? জয়ীর আসনে বসিয়া ন্যায়ের তুলাদণ্ড হাতে লইয়া বলিলেন : ভাইসব, তোমাদের সম্বন্ধে আমার আর কোনো অভিযোগ নাই, আজ তোমরা সবাই স্বাধীন, সবাই মুক্ত। মানুষের প্রতি প্রেমপুণ্যে উদ্ভাসিত এই সুমহান প্রতিশোধ সম্ভব করিয়াছিল হযরতের বিরাট মনুষ্যত্ব ।
শুধু প্রেম-করুণায় নয়, মানুষ হিসেবে আপনার তুচ্ছতাবোধ আপনার ক্ষুদ্রতার অনুভূতি তাঁহার মহিমাগৌরবকে মুহূর্তের জন্যও ছাপাইয়া উঠিতে পারে নাই। মক্কাবিজয়ের পর হযরত সাফা পর্বতের পার্শ্বে বসিয়া সত্যান্বেষী মানুষকে দীক্ষা দান করিতেছেন, এমন সময় একটি লোক তাঁহার কাছে আসিয়া ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। হযরত স্মিতমুখে তাহাকে বলিলেন, কেন তুমি ভয় পাইতেছ? ভয়ের কিছুই এখানে নাই। আমি রাজা নই, সম্রাট নই, মানুষের প্রভু নই। আমি এমন এক নারীর সন্তান, সাধারণ শুষ্ক মাংসই ছিল যাঁহার নিত্যকার আহার্য।
মহামহিমার মাঝখানে আপনার সামান্যতম এই অনুভূতিই হযরতের চরিত্রকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর ও স্বচ্ছ রাখিয়াছিল। মানুষ ত্রুটির অধীন, হযরতও মানুষ, সুতরাং তাঁহারও ত্রুটি হইতে পারে- এই যুক্তির বলে নয়, বরং তাঁহার অনাবিল চরিত্রের স্বচ্ছ সহজ প্রকাশ মর্যাদাহানির আশঙ্কা তুচ্ছ করিয়া, লোকচক্ষে সম্ভাবিত হেয়তার ভয় অবহেলায় দূর করিয়া তিনি অকুতোভয়ে আত্মদোষ উদ্ঘাটন করিয়াছেন ।

একদিন তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত লোকদের কাছে সত্য প্রচারে ব্রতী। মজলিসের এক প্রান্তে বসিয়া একটি অন্ধ। সম্ভবত সে হযরতের দুইএকটি কথা শুনিতে পায় নাই। বক্তৃতার মাঝখানে একটি প্রশ্ন করিয়া সে হযরতকে থামাইল। বাধা পাইয়া হযরতের মুখে ঈষৎ বিরক্তির আভাস ফুটিয়া উঠিল, তাঁহার ললাট সামান্য কুঞ্চিত হইল ।
ব্যাপারটি এমন কিছুই গুরুতর নয়। বক্তৃতায় বাধা হইলে বিরক্তি অতি স্বাভাবিক। আবার দুঃখী দুর্বল লোকদের হযরত বড়ো আদর করিতেন, কাহারও ইহা অজ্ঞাত নয়। সুতরাং তিনি অন্ধকে ঘৃণা করিয়াছেন, কাঙাল বলিয়া তাহাকে হেলা করিয়াছেন, এই কথা কাহারও মনে আসে নাই ৷ কিন্তু তাঁহার এই তুচ্ছতম ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত আসিল কুরআনের একটি বাণীতে। তিনি বিনা দ্বিধায়, বিনা সঙ্কোচে তাহা সকলের কাছে প্রচার করিলেন।
মানুষ হিসেবে যে ক্ষুদ্রতাবোধ, মানুষের সহজ দৈন্যের যে নির্মল অনুভূতি হযরতকে আপনার দোষত্রুটি সাধারণের চক্ষে এমন নির্বিকারভাবে ধরাইয়া দিতে প্ররোচিত করিয়াছিল, তাহাই আবার তাঁহার মহিমান্বিত জীবনে ইচ্ছা-স্বীকৃত দারিদ্র্যের মাঝখানে প্রদীপ হইয়া জ্বলিয়াছিল। অনাত্মীয় পরিপার্শ্বের মধ্যেও নিবিড় নির্বিচার ভক্তি, শ্রদ্ধা, স্বীকৃতি ও আনুগত্য তিনি বড়ো অল্প পান নাই । শত শত, বরং সহস্র সহস্র মুসলিম তাঁহার ব্যক্তিগত পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিতে সর্বদা শুধু ইচ্ছুক নয়, সমুৎসুক ছিল। কিন্তু হযরত আপনাকে দশজন মানুষের মধ্যে একজন গণনা করিলেন, সকলের সঙ্গী সহচররূপে সহোদর ভাইয়ের মতাদর্শ প্রয়াসী নেতার কর্তব্য পালন করিলেন। সত্যের জন্য অত্যাচার নির্যাতন সহিলেন, দুঃখে-শোকে অশ্রুনীরে তিতিয়া আল্লাহর নামে সান্ত্বনা মানিলেন, দেশের রাজা-মানুষের মনের রাজা হইয়া স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যের কণ্টক মুকুট মাথায় পরিলেন। তাই তাঁহার গৃহে সকল সময় অন্ন জুটিত না, নিশার অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিবার মতো তৈলটুকুও সময় সময় মিলিত না। এমনি নিঃস্ব কাঙালের বেশে মহানবি মৃত্যু রহস্যের দেশে চলিয়া গেলেন ।
স্বামীর মহাপ্রয়াণে বিয়োগবিধুরা আয়েশার বক্ষ ভেদিয়া শোকের মাতম উঠিল, মানুষের মঙ্গল সাধনায় যিনি অতন্দ্র রজনী যাপন করিলেন, সেই সত্যাশ্রয়ী আজ চলিয়া গেলেন। নিঃস্বতাকে সম্বল করিয়া যিনি বিশ্বমানবের জন্য আপনাকে বিলাইয়া দিলেন, তিনি আজ চলিয়া গেলেন। সাধনার পথে শত্রুর আঘাতকে যিনি অম্লান বদনে সহিলেন। হায়, সেই দয়ার নবি, মানুষের মঙ্গল বহিয়া আনিবার অপরাধে প্রস্তরঘায়ে যাঁহার দাঁত ভাঙিয়াছিল, প্রশস্ত ললাট রুধিরাক্ত হইয়াছিল, আর সেই আহত জর্জরিত মুমূর্ষু দশাতেও যিনি শত্রুকে প্রেমভরে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, তিনি আজ জীবন-নদীর ওপারে চলিয়া গেলেন। দুই বেলা পূর্ণোদর আহারও যাঁহার ভাগ্যে হয় নাই, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূর্ত প্রকাশ মহানবি আজ চলিয়া গেলেন। বিবি আয়েশার মর্মছেঁড়া এই বিলাপ সমস্ত মানুষের, সমগ্র বিশ্বের। শুধু সত্য সাধনায় নয়, শুধু ঊর্ধ্ব লোকচারী মহাব্রতীর তত্ত্বানুসন্ধানে নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারে হযরত মোস্তফা ইতিহাসের একটি অত্যন্ত অসাধারণ চরিত্র। ত্যাগ, প্রেম, সাধুতা, সৌজন্য, ক্ষমা, তিতিক্ষা, সাহস, শৌর্য, অনুগ্রহ, আত্মবিশ্বাস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও সমদর্শন চরিত্র-সৌন্দর্যের এতগুলি দিকের সমাহার ধুলোমাটির পৃথিবীতে বড়ো সুলভ নয়। তাই মানুষের একজন হইয়াও তিনি দুর্লভ, আমাদের অতি আপনজন হইয়াও তিনি অনুকরণীয়, বরণীয়।

Content added By

মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ১৮৯৬ সালে (২৯শে ভাদ্র ১৩০৩ সাল) সাতক্ষীরা জেলার বাঁশদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজে বি.. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং এখানেই লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটান। এরপর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি মাসিক মোহাম্মাদী, দৈনিক মোহাম্মাদী, দৈনিক সেবক, সাপ্তাহিক সওগাত, সাপ্তাহিক খাদেম, ইংরেজি দি মুসলমান ইত্যাদি পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : মহামানুষ মুহসীন, মরুভাস্কর, সৈয়দ আহমদ, স্মার্ণানন্দিনী, ছোটদের হযরত মুহম্মদ ইত্যাদি। তিনি খুব পরিচ্ছন্ন চিন্তা যুক্তিবাদী মন নিয়ে সবকিছুর বিচার করতেন। সহজ সরল প্রকাশভঙ্গি তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর গদ্যশৈলী ঋজু, রচনা সাবলীল। স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি ১৯৩৫ সালে কলকাতা ছেড়ে বাঁশদহে ফিরে আসেন এবং সেখানেই ১৯৫৪ সালের ৮ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন

Content added By

বীরবাহু-শক্তিধারী। স্থিতধী-স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন। ধী-বুদ্ধি । রাসুল-আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। পরহিতব্রতী— পরের উপকারে নিয়োজিত । বয়ান-মুখনিঃসৃত বাণী । গ্রীবা-ঘাড় । অকুতোভয়-নির্ভয়। নির্যাতন-অত্যাচার, জুলুম। কুসুমকোমল—ফুলের মতো নরম। লোট্রাঘাত— ঢিলের আঘাত। বৈরী-শত্রু । অরাতি-শত্রু। পৌত্তলিক-মূর্তিপূজক। তিতিয়া-ভিজে। সমাচ্ছন্ন- অভিভূত। পূর্ণোদর-ভরপেট। বীরবাহু ওমর-ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) ছিলেন একজন তেজস্বী বীরযোদ্ধা। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোরেশ বংশোদ্ভূত তরুণ বীর ওমর মহানবিকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন তাঁর ভগ্নীর কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের বাণী শুনে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত ওমর (রা) ছিলেন একজন বীরযোদ্ধা, ন্যায়পরায়ণ শাসক ও মহানবির বিশ্বাসভাজন সাহাবা ৷
রুধিরাক্ত-রক্তাক্ত, রক্তরঞ্জিত। রাহী-পথিক, মুসাফির। পুলকদীপ্তি-আনন্দের উদ্ভাস। অনুরুদ্ধ-অনুরোধ করা হয়েছে এমন । মহামতি আবুবকর-ইসলামের প্রথম খলিফা এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে প্রথম পুরুষ ব্যক্তি।
তিনি ছিলেন মহানবির হিজরতকালীন সঙ্গী এবং সারাজীবনের বিশ্বস্ত সহচর। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ,
আদর্শবাদী ও ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ।
মক্কা-সৌদি আরবের অন্যতম প্রধান নগরী। এখানে আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ অবস্থিত । এই
নগরীতে রাসুলুল্লাহ (স.) জন্মগ্রহণ করেন। মদিনা— সৌদি আরবে অবস্থিত মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় সম্মানিত নগরী। এখানে হযরত মুহম্মদ (স.) এবং হযরত আবু বকর (রা.) এর মাজার রয়েছে ।
হিজরত— শাব্দিক অর্থ পরিত্যাগ। এখানে মক্কা ত্যাগ করে মদিনা যাত্রা বোঝানো হয়েছে। এই সময় থেকে হিজরি সাল গণনার শুরু।
তায়েফ— সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলের একটি উর্বর প্রদেশ।
বদর, ওহোদ, আহযাব, খয়বর- হযরতের জীবনকালে ভিন্ন ধর্মাবলম্বলীদের বিরুদ্ধে এ সব স্থানে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়েছিল।
হুদায়বিয়া— একটি যুদ্ধক্ষেত্র, এই স্থানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) এর একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এ সন্ধি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রাসুলুল্লাহর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক । খালিদ- হযরতের জীবিতকালে ইসলামের প্রখ্যাত বীরযোদ্ধা এবং সেনাপতি।
সাফা- সাফা ও মারওয়া দুটি ছোটো পাহাড় কাবার নিকটে অবস্থিত। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্ত্রী বিবি হাজেরা শিশুপুত্র ইসমাইলের পিপাসা নিবারণের জন্য পানির সন্ধানে এই দুই পাহাড়ের মধ্যে ছোটাছুটি করেছিলেন। সেই স্মৃতি রক্ষার্থে আজও হজব্রতীরা সাফা-মারওয়ায় দৌড়ে থাকেন ।
আয়েশা (রা.)-  হযরত আবুবকরের কন্যা, রাসুলুল্লাহ (স.) -এর অন্যতম সহধর্মিণী, বিদুষী রমণী ছিলেন। হযরতের ইন্তেকালের পর তিনি বহু হাদিস উদ্ধৃত করেন ।

 

Content added By

‘মানুষ মুহম্মদ (স.)' প্রবন্ধটি মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত মরু ভাস্কর গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর মানবিক গুণাবলি এ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। হযরত ছিলেন মানুষের নবি । তাই মানুষের পক্ষে যা আচরণীয় তিনি তারই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি বিপুল ঐশ্বর্য, ক্ষমতা ও মানুষের অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মধ্যে থেকেই একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে গেছেন। ক্ষমতা ও মহত্ত্ব, প্রেম ও দয়া তাঁর অজস্র চারিত্রিক গুণের মধ্যে প্রধান। তাঁর সারা জীবন মানব জাতির কল্যাণের জন্য নিয়োজিত ছিল। মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে তিনি তাঁর জীবন রূপায়িত করে তুলেছিলেন। তাঁর সাধনা, ত্যাগ, কল্যাণচিন্তা ছিল বিশ্বের সমগ্র মানুষের জন্য অনুকরণীয়। হযরত মুহম্মদ (স.) এর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীগণের মধ্যে যে বেদনা ও হতাশা দেখা দিয়েছিল তা প্রশমন করার জন্য হযরত আবুবকর (রা) মহানবি (স.)-এর জীবনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে প্রচণ্ড শোককে শান্ত করেন। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর মানবিক গুণাবলি উপস্থাপনের মাধ্যমে এ প্রবন্ধ আমাদের নৈতিক, সৎ ও মানবিক হবার শিক্ষা দেয় ।

Content added By

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ! কেউবা ভাজছে গরম তেলে । খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে । কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে । এমনি কাঁচাই ...
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ ।
কিম্বা ভেজে বেগুন-সহযোগে ।
যকৃতের পক্ষে ভারি উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক দাঁত ভালো থাকে । কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন।
বলে- “নিমের হাওয়া ভালো, থাক্, কেটো না ৷'
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না ।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাঁধিয়েও দেয় কেউ— সে আর-এক আবর্জনা । হঠাৎ একদিন একটা নতুন ধরনের লোক এলো ।
মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু ।
বলে উঠল,– ‘বাহ্, কী সুন্দর পাতাগুলি ... কী রূপ ! থোকা থোকা ফুলেরই বা কী বাহার.... একঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাহ্-' খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল ।
কবিরাজ নয়, কবি ।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতরে শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মীবউটার ঠিক এক দশা।

Content added By

প্রকৃত নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বিহারের পূর্ণিয়ার অন্তর্গত মণিহার গ্রামে ১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। বনফুল পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিক, হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে ১৯২০ সালে আই.এসসি এবং ১৯২৭ সালে পাটনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করেন। মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরির মাধ্যমে বনফুলের কর্মজীবন শুরু। ১৯১৮ সালে শনিবারের চিঠি তে ব্যঙ্গ-কবিতা প্যারোডি লিখে তাঁর সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ। প্রবাসী পত্রিকায় তিনি একপাতা-আধপাতার গল্প লিখতেন গল্পগুলো আকারে ক্ষুদ্র, অথচ বক্তব্যে তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ : বনফুলের গল্প, বনফুলের আরো গল্প, বাহুল্য, বিন্দুবিসর্গ, অনুগামিনী, তন্বী, ঊর্মিমালা, দূরবীন ইত্যাদি। বাস্তবজীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র উপাদান তাঁর গল্প উপন্যাসে নিপুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বনফুলের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো : তৃণখণ্ড, কিছুক্ষণ, দ্বৈরথ, নির্মোক, সে আমি, জঙ্গম, অগ্নি ইত্যাদি। এছাড়াও বনফুলের কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, চতুর্দশপদী, জীবনী নাটক শ্রীমধুসূদন, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি তাঁর অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। বিভিন্ন পুরস্কারসহ তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন ১৯৭৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বনফুল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

ছাল – বাকল, এখানে নিমগাছের বাকল । শিলে পেষা – শিল-পাটায় বাটা। অব্যর্থ – যা বিফল হবে না। পাতাগুলো খায়ও - নিমের কচিপাতা খেলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। শান দিয়ে বাঁধানো - এখানে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বোঝাচ্ছে। কবিরাজ – যিনি গাছগাছালি পরিশোধন করে মনুষ্যরোগের চিকিৎসা করেন। কবি – যিনি কবিতা লেখেন ।  শিকড় অনেক দূর চলে গেছে- প্রতীকাশ্রয়ে বর্ণিত। নিমগাছের শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং চারিদিকে বিস্তৃতও হয়। লক্ষ্মী বউটার প্রতীক যেহেতু নিমগাছ সেহেতু নিমগাছের শিকড়ের সঙ্গে বউয়ের সংসারের জালে চারিদিকে আবদ্ধ হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।

Content added By

:বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) অদৃশ্যলোক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘নিমগাছ গল্প । এই গল্পের সংক্ষিপ্ত অবয়বের মধ্যে লেখক বিপুল বক্তব্য উপস্থাপনের যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। নিমগাছের বর্ণনা, এর পাতা, বাকল, ছায়ার ইত্যাদির বাহ্যিক উপকারিতা কবিতার মতো বর্ণনা করা হয়েছে এই গল্পে। কবিরাজ তার চিকিৎসার কাজে, সাধারণ মানুষ প্রাত্যহিক প্রয়োজনে নিমগাছকে অনবরত ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কেউ এই গাছের সামান্যও যত্ন নেয় না। একজন কবি একদিন নিমগাছের গুণ ও রূপের প্রশংসা করে। নিমগাছের ভালো লাগে ঐ লোককে এবং সে তার সঙ্গে চলে যেতে চায়। কিন্তু মাটির গভীরে তার শিকড়। গাছটি যেতে পারে না । আসলে গাছ তো চলতে পারে না। এটি একটি প্রতীকী গল্প । প্রকৃতপক্ষে, ‘নিমগাছ' গল্পটির নিমগাছ প্রতীকের সূত্রে বনফুল দেখিয়েছেন নারীর অপরিসীম আত্মত্যাগ। নারীর মানবিক মর্যাদা, পারিবারিক ও সামাজিক গুরুত্ব উপলব্ধি করার ইঙ্গিত দেয় গল্পটি।

Content added By

                                                                                                                                                                                             ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ! যাদের করেছ অপমান
                                                                                                                                                                                              অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।'
                                                                                                                                                                                                                                                            - রবীন্দ্রনাথ

আজ আমাদের এই নতুন করিয়া মহাজাগরণের দিনে আমাদের সেই শক্তিকে ভুলিলে চলিবে না— যাহাদের উপর আমাদের দশ আনা শক্তি নির্ভর করিতেছে, অথচ আমরা তাহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছি। সে হইতেছে, আমাদের দেশের তথাকথিত ‘ছোটোলোক’ সম্প্রদায়। আমাদের আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায়ই এই হতভাগাদের এইরূপ নামকরণ করিয়াছেন। কিন্তু কোনো যন্ত্র দিয়া এই দুই শ্রেণির লোকের অন্তর যদি দেখিতে পারো, তাহা হইলে দেখিবে, ঐ তথাকথিত ‘ছোটোলোক’-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, এই ‘ছোটোলোক’ এমন স্বচ্ছ অন্তর, এমন সরল মুক্ত উদার প্রাণ লইয়াও যে কোনো কার্য করিতে পারিতেছে না, তাহার কারণ এই ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার। সে বেচারা জন্ম হইতে এই ঘৃণা, উপেক্ষা পাইয়া নিজেকে এত ছোটো মনে করে, সঙ্কোচ জড়তা তাহার স্বভাবের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়াইয়া যায় যে, সেও-যে আমাদেরই মতো মানুষ— সেও যে সেই এক আল্লাহ্-এর সৃষ্টি, তাহারও যে মানুষ হইবার সমান অধিকার আছে,- তাহা সে একেবারে ভুলিয়া যায়। যদি কেউ এই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করে, অমনি আমাদের ভদ্র সম্প্রদায় তাহার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে। এই হতভাগাদিগকে— আমাদের এই সত্যিকার মানুষদিগকে আমরা এই রকম অবহেলা ? করিয়া চলিয়াছি বলিয়াই আজ আমাদের এত অধঃপতন। তাই আমাদের দেশে জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিত হইতে পারিতেছে না। হইবে কীরূপে? দেশের অধিবাসী লইয়াই তো দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিই তো জাতি। আর সে-দেশকে, সে-জাতিকে যদি দেশের, জাতির সকলে বুঝিতে না পারে, তবে তাহার উন্নতির আশা করা আর আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের চেষ্টা করা একই কথা। তোমরা ভদ্রসম্প্রদায়, মানি, দেশের দুর্দশা জাতির দুর্গতি বুঝো, লোককে বুঝাইতে পারো এবং ঐ দুর্ভাগ্যের কথা কহিয়া কাঁদাইতে পার, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নামিয়া কার্য করিবার শক্তি তোমাদের আছে কি? না, নাই । এ-কথা যে নিরেট সত্য, তাহা তোমরাই বুঝো। কাজেই তোমাদের এই দেশকে, জাতিকে উন্নত করিবার আশা ঐ কথাতেই শেষ হইয়া যায়। কিন্তু যদি একবার আমাদের এই জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে পারো, তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তোমার উদারতা থাকে, তাহাদিগের শক্তির উন্মেষ করিতে পারো, তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, একদিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে। একথা হয়তো তোমার বিশ্বাস হইবে না, একবার মহাত্মা গান্ধীর কথা ভাবিয়া দেখো দেখি! তিনি ভারতে কি অসাধ্য সাধন করিতে পারিয়াছেন!
তিনি যদি এমনি করিয়া প্রাণ খুলিয়া ইহাদের সহিত না মিশিতেন, ইহাদের সুখ-দুঃখের এমন করিয়া ভাগী না হইতেন, ইহাদিগকে যদি নিজের বুকের রক্ত দিয়া, তাহারা খাইতে পাইল না বলিয়া নিজেও তাহাদের সঙ্গে উপবাস করিয়া ইহাদিগকে নিতান্ত আপনার করিয়া না তুলিতেন, তাহা হইলে আজ তাঁহাকে কে মানিত? কে তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিত? কে তাঁহার একটি ইঙ্গিতে এমন করিয়া বুক বাড়াইয়া মরিতে পারিত? তাঁহার আভিজাত্য-গৌরব নাই, পদ-গৌরবের অহঙ্কার নাই, অনায়াসে প্রাণের মুক্ত উদারতা লইয়া তোমাদের ঘৃণ্য এই ‘ছোটলোক'কে বক্ষে ধরিয়া ভাই বলিয়া ডাকিয়াছেন, সে-আহ্বানে জাতিভেদ নাই, ধর্মভেদ নাই, সমাজ-ভেদ নাই, সে যে ডাকার মতো ডাকা, তাই নিখিল ভারতবাসী, এই উপেক্ষিত হতভাগারা তাঁহার দিকে এত হা হা করিয়া ব্যগ্র বাহু মেলিয়া ছুটিয়াছে । হায়, তাহাদের যে আর কেহ কখনো এমন করিয়া এত বুকভরা স্নেহ দিয়া আহ্বান করেন নাই! এ মহা-আহ্বানে কি তাহারা সাড়া না দিয়া পারে? যদি পারো, এমনি করিয়া ডাকো, এমনি করিয়া এই উপেক্ষিত শক্তির বোধন করো- দেখিবে ইহারাই দেশে যুগান্তর আনিবে, অসাধ্য সাধন করিবে। ইহাদিগকে উপেক্ষা করিবার, মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার, তোমার কি অধিকার আছে? ইহা তো আত্মার ধর্ম নয়। তাহার আত্মা তোমার আত্মার মতোই ভাস্বর, আর একই মহা- আত্মার অংশ। তোমার জন্মগত অধিকারটাই কি এত বড়? তুমি যদি এই চণ্ডাল বংশে জন্মগ্রহণ করিতে, তাহা হইলে তোমার মতো ভদ্রলোকদের দেওয়া এই সব হতাদর উপেক্ষার আঘাত, বেদনার নির্মমতা একবার কল্পনা করিয়া দেখো দেখি,- ভাবিতে তোমার আত্মা কি শিহরিয়া উঠিবে না?
আমাদের এই পতিত, চণ্ডাল, ছোটোলোক ভাইদের বুকে করিয়া তাহাদিগকে আপন করিয়া লইতে, তাহাদেরই মতো দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তোমারও প্রাণ সংযোগ করিয়া উচ্চশিরে তার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াও, দেখিবে বিশ্ব তোমাকে নমস্কার করিবে। এস, আমাদের উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরিয়া আজ বোধন-বাঁশিতে সুর দিই-

 

                                                                                                                                                                                                       ‘কীসের দুঃখ, কিসের দৈন্য,

                                                                                                                                                                                                       কীসের লজ্জা, কীসের ক্লেশ!'
                                                                                                                                                                                                                                                               (সংক্ষেপিত)

Content added By

কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সালে (২৪শে মে ১৮৯৯) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন পরে বর্ধমান ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এজন্য তাঁকেবিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি গজল, খেয়াল রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প উপন্যাস। যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে (বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়

Content added By

চণ্ডাল - চাড়াল, হিন্দু বর্ণব্যবস্থায় নিম্নবর্গের লোক।

বোধন-বাঁশি - বোধ জাগিয়ে তোলার বাঁশি।

দৈন্য- দারিদ্র্য, দীনতা।

Content added By

‘উপেক্ষিত শক্তির উদবোধন' শীর্ষক প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলি (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড) থেকে সংকলন করা হয়েছে । অবিভক্ত ভারতবর্ষের পটভূমিতে লেখা প্রবন্ধটি সম্পাদনা করে পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। এটি কাজী নজরুল ইসলামের যুগবাণী নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থের একটি রচনা। আলোচ্য প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। একটি দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছোটো-বড়ো, উঁচু-নিচু, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ দূর করা আবশ্যক। বিশ্বের বুকে মর্যাদাবান জাতি ও রাষ্ট্র গঠন করতে প্রতিটি দেশের মনীষীগণ আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁদের নির্দেশিত পথে যদি আমরা পরিভ্রমণ করতে পারি তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি বিরাজ করবে। প্রবন্ধটিতে জাতি, ধর্ম, সমাজভেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ প্রবন্ধ শ্রেণি, ধর্ম, জাতি ও সমাজভেদমুক্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয়।

Content added By

মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার ম‍ই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীবসত্তার ঘরেও সে কাজ করে; ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলা, তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায়, শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনীয় দিকও আছে। আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক। সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়, কী করে মনের মালিক হয়ে অনুভূতি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়। শিক্ষার এ দিকটা যে বড়ো হয়ে ওঠে না, তার কারণ ভুল শিক্ষা ও নিচের তলায় বিশৃঙ্খলা জীবসত্তার ঘরটি এমন বিশৃঙ্খল হয়ে আছে যে,হতভাগ্য মানুষকে সব সময়ই সে সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হয়। ওপরের তলার কথা সে মনেই আনতে পারে না । অর্থচিন্তার নিগড়ে সকলে বন্দি । ধনী-দরিদ্র সকলেরই অন্তরে সেই একই ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে : চাই, চাই, আরও চাই। তাই অন্নচিন্তা তথা অর্থচিন্তা থেকে মানুষ মুক্তি না পেলে, অর্থসাধনাই জীবনসাধনা নয়- একথা মানুষকে ভালো করে বোঝাতে না পারলে মানবজীবনে শিক্ষা সোনা ফলাতে পারবে না। ফলে শিক্ষার সুফল হবে ব্যক্তিগত, এখানে সেখানে দুএকটি মানুষ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটি উপলব্ধি করতে পারবে, কিন্তু বেশির ভাগ লোকই যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে যাবে।
তাই অন্নচিন্তার নিগড় থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার যে চেষ্টা চলেছে তা অভিনন্দনযোগ্য । কিন্তু লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতন না থাকলে সে চেষ্টাও মানুষকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। কারারুদ্ধ আহারতৃপ্ত মানুষের মূল্য কতটুকু? প্রচুর অন্নবস্ত্র পেলে আলো হাওয়ার স্বাদবঞ্চিত মানুষ কারাগারকেই স্বর্গতুল্য মনে করে। কিন্তু তাই বলে যে তা সত্য সত্যই স্বর্গ হয়ে যাবে, তা নয়। বাইরের আলো হাওয়ার স্বাদ পাওয়া মানুষ প্রচুর অন্নবস্ত্র পেলেও কারাগারকে কারাগারই মনে করবে, এবং কী করে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাই হবে তার একমাত্র চিন্তা । আকাশ-বাতাসের ডাকে যে পক্ষী আকুল, সে কি খাঁচায় বন্দি হবে সহজে দানাপানি পাওয়ার লোভে? অন্নবস্ত্রের প্রাচুর্যের চেয়েও মুক্তি বড়, এই বোধটি মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক।

চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে নেই সেখানে মুক্তি নেই। মানুষের অন্নবস্ত্রের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে এই মুক্তির দিকে লক্ষ রেখে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর মানুষটিকে তৃপ্ত রাখতে না পারলে আত্মার অমৃত উপলব্ধি করা যায় না বলেই ক্ষুৎপিপাসার তৃপ্তির প্রয়োজন। একটা বড়ো লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখেই অন্নবস্ত্রের সমাধান করা ভালো, নইলে আমাদের বেশি দূর নিয়ে যাবে না ।
তাই মুক্তির জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করতে হবে। একটি অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা, আরেকটি শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা মানুষকে মনুষ্যত্বের স্বাদ পাওয়ানোর সাধনা। এ উভয়বিধ চেষ্টার ফলেই মানবজীবনের উন্নয়ন সম্ভব। শুধু অন্নবস্ত্রের সমস্যাকে বড়ো করে তুললে সুফল পাওয়া যাবে না। আবার শুধু শিক্ষার ওপর নির্ভর করলে সুদীর্ঘ সময়ের দরকার। মনুষ্যত্বের স্বাদ না পেলে অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েও মানুষ যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকতে পারে; আবার শিক্ষাদীক্ষার মারফতে মনুষ্যত্বের স্বাদ পেলেও অন্নবস্ত্রের দুশ্চিন্তা মনুষ্যত্বের সাধনা ব্যর্থ হওয়া অসম্ভব নয় ।
কোনো ভারি জিনিসকে ওপরে তুলতে হলে তাকে নিচের থেকে ঠেলতে হয়, আবার ওপর থেকে টানতেও হয়; শুধু নিচের থেকে ঠেললে তাকে আশানুরূপ ওপরে ওঠানো যায় না। মানব উন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা সেই ওপর থেকে টানা, আর সুশৃঙ্খল সমাজ-ব্যবস্থা নিচের থেকে ঠেলা। অনেকে মিলে খুব জোরে ওপরের থেকে টানলে নিচের ঠেলা ছাড়াও কোনো জিনিস ওপরে ওঠানো যায়- কিন্তু শুধু নিচের ঠেলায় বেশিদূর ওঠানো যায় না। তেমনি আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার দ্বারাই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব, কিন্তু শুধু সমাজ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খলতার দ্বারা তা সম্ভব নয়। শিক্ষাদীক্ষার ফলে সত্যিকার মনুষ্যত্বের ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু' কথাটা বুলিমাত্র, সত্য। লোভের ফলে যে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে, অনুভূতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে, শিক্ষা মানুষকে সে-কথা জানিয়ে দেয় বলে মানুষ লোভের ফাঁদে ধরা দিতে ভয় পায়। ছোটো জিনিসের মোহে বড়ো জিনিস হারাতে যে দুঃখ বোধ করে না, সে আর যাই হোক, শিক্ষিত নয়। শিক্ষা তার বাইরের ব্যাপার, অন্তরের ব্যাপার হয়ে ওঠে নি। লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি; জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই ।
শিক্ষার মারফতে মূল্যবোধ তথা মনুষ্যত্ব লাভ করা যায়; তথাপি অন্নবস্ত্রের সুব্যবস্থাও প্রয়োজনীয় । তা না হলে জীবনের উন্নয়নে অনেক বিলম্ব ঘটবে। মনুষ্যত্বের তাগিদে মানুষকে উন্নত করে তোলার চেষ্টা ভালো; কিন্তু প্রাণিত্বের বাঁধন থেকে মুক্তি না পেলে মনুষ্যত্বের আহ্বান মানুষের মর্মে গিয়ে পৌঁছতে দেরি হয় বলে অন্নবস্ত্রের সমস্যার সমাধান একান্ত প্রয়োজন। পায়ের কাঁটার দিকে বারবার নজর দিতে হলে হাঁটার আনন্দ উপভোগ করা যায় না, তেমনি অন্নবস্ত্রের চিন্তায় হামেশা বিব্রত হতে হলে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই দু দিক থেকেই কাজ চলা দরকার একদিকে অন্নবস্ত্রের চিন্তার বেড়ি উন্মোচন, অপরদিকে মনুষ্যত্বের আহ্বান, উভয়ই প্রয়োজনীয় । নইলে বেড়িমুক্ত হয়েও মানুষ ওপরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করবে না, অথবা মনুষ্যত্বের আহ্বান সত্ত্বেও ওপরে যাওয়ার স্বাধীনতার অভাব বোধ করবে, পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো উড়বার আকাঙ্ক্ষায় পাখা ঝাপটাবে, কিন্তু উড়তে পারবে না।

Content added By

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে বাংলায় এম.. পাস করেন কর্মজীবনে তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। একজন সংস্কৃতিবান মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'শিখা' পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন তাঁর লেখায় মননশীলতা চিন্তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গদ্যে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব লক্ষণীয় মূলত গদ্যকার হলেও তিনি বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ সংস্কৃতি কথা বাংলা সাহিত্যের মননশীল প্রবন্ধ-ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সভ্যতা সুখ তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ। ১৯৫৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন

Content added By

নিগড়-শিকল, বেড়ি। তিমির-অন্ধকার। ক্ষুৎপিপাসা-ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। ফতুর-নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত । লেফাফাদুরস্তি-বাইরের দিক থেকে ত্রুটিহীনতা কিন্তু ভিতরে প্রতারণা। বেড়ি-শিকল, শৃঙ্খল।

হামেশা- সবসময়, সর্বক্ষণ। উন্মোচন-উন্মুক্ত করা। পিঞ্জরবদ্ধ-খাঁচায় বন্দি। জীবসত্তা- জীবের অস্তিত্ব। জীবসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে অন্নবস্ত্র চাই ।

মানবসত্তা-মানুষের অস্তিত্ব। মানবসত্তা বলতে লেখক মনুষ্যত্বকে বুঝিয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যমে এই মনুষ্যত্ব অর্জন করা যায়।

অর্থচিন্তার নিগড়ে সকলে বন্দি— লেখকের মতে আমরা জীবসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে অধিক মনোযোগী। ফলে অর্থচিন্তা আমাদের সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখে। অর্থচিন্তায় ব্যস্ত মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্ব অর্জনে সক্ষম নয় ।
কারারুদ্ধ আহারতৃপ্ত মানুষের মূল্য কতটুকু?— খাওয়া-পরার সমস্যা মিটে গেলেই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব হয় না। এ জন্য প্রয়োজন চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা । শিক্ষার মাধ্যমেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয় ।

Content added By

‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব' প্রবন্ধটি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি কথা গ্রন্থের ‘মনুষ্যত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ। মানুষের দুটি সত্তা- একটি তার জীবসত্তা, অপরটি মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব। জীবসত্তার প্রয়োজনে অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষা লাভের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার ফলে মনুষ্যত্বের স্বাদ পেলে অন্নবস্ত্রের সমাস্যার সমাধান সহজ হয়ে ওঠে। শিক্ষার আসল কাজ মূল্যবোধ সৃষ্টি, জ্ঞান দান নয়; জ্ঞান মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায়মাত্র। ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। জ্ঞান ও অন্তরের মুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিকে মনুষ্যত্ববোধে উন্নীত হওয়ার শিক্ষা দেয় ।

Content added By

পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলা হয় । সকল প্রকার জ্ঞানকে একত্র করে স্থায়িত্বদানের অভিপ্রায় থেকে লাইব্রেরির সৃষ্টি । এক ব্যক্তির পক্ষে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া অসম্ভব । বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে । আবার যে ব্যক্তি যে বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে, তার সবটুকু জ্ঞান মস্তিষ্কে ধারণ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না । তাই প্রয়োজন এমন কোনো উপায় উদ্ভাবনের, যার দৌলতে দরকার অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ে একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায় । ফলে লাইব্রেরির সৃষ্টি ।
লাইব্রেরি তিন প্রকার - ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ । ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ব্যক্তিমনের খেয়ালমতো গড়ে ওঠে তা হয়ে থাকে ব্যক্তির মনের প্রতিবিম্ব । ব্যক্তি যে ধরনের রচনা ভালোবাসে তার প্রাচুর্য, আর যে ধরনের রচনা পছন্দ করে না তার অনুপস্থিতি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বৈশিষ্ট্য । এখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী সম্রাট, খেয়ালমতো গড়ে তোলে তার কল্পনার তাজমহল । কাব্যপ্রেমিক হলে কাব্যগ্রন্থ দিয়ে, কথাসাহিত্যপ্রেমিক হলে কথাসাহিত্য দিয়ে, ইতিহাসপ্রিয় হলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ দিয়ে সে সাজিয়ে তোলে তার টেবিল, আলমারির শেলফ - সবকিছু । কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই, আপত্তি করবার দাবি নেই, উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই । এখানে সে স্বাধীন, স্বতন্ত্ৰ ৷
ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেমন ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিবিম্ব, পারিবারিক লাইব্রেরি তেমনি পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া । এখানে যেমন একের রুচির ওপর বহুর অত্যাচার অশোভন, তেমনি বহুর রুচির ওপর একের জবরদস্তি অন্যায় । দশ জনের রুচির দিকে নজর রেখেই পারিবারিক লাইব্রেরি সাজাতে হয় ।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি ব্যক্তি বা পরিবারের মর্জিমাফিক গড়ে ওঠে। সাধারণের হুকুম চালাবার মতো সেখানে কিছুই নেই । লাইব্রেরিসম্পন্ন ব্যক্তির চালচলনে এমন একটা শ্রী ফুটে উঠতে বাধ্য, যা অন্য প্রত্যক্ষ করা দুষ্কর । সত্যিকার বৈদগ্ধ্য বা চিৎপ্রকর্ষের অধিকারী হতে হলে লাইব্রেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয় । তাছাড়া, লাইব্রেরি বা শ্রেণিবদ্ধ পুস্তক সংগ্রহ গৃহসজ্জার কাজেও লাগে । আর এই ধরনের গৃহসজ্জায় লাভ এই যে, বাইরের পারিপাট্যের সঙ্গে তা মানসিক সৌন্দর্যেরও পরিচয় দেয়। লাইব্রেরি সৃজনে তৎপর হয়ে ধনী ব্যক্তিরা পুস্তক কেনার নেশা সৃষ্টি করলে দেশের পক্ষে লাভ হবে এই যে অনবরত বাঁধানো পুস্তকগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে তাদের চামড়ার তলে যে একটি মন সুপ্ত রয়েছে, সে সম্বন্ধে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠবেন । লাইব্রেরি সৃজনের দরুন তাঁরা নিজেরা ততটা লাভবান না হলেও তাঁদের পুত্রকন্যাদের যথেষ্ট উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা। হয়তো এই লাইব্রেরি থাকার দরুণই পরিণত বয়সে তাঁরা সুসাহিত্যিক বা সাহিত্য-সমঝদার হয়ে উঠবেন । এ আশা শুধু ভিত্তিহীন কল্পনা নয়, বড় বড় সাহিত্যিক বা কবিদের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, বাল্যে তাঁরা পিতার অথবা পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে সাহিত্যসাধনার প্রেরণা লাভ করেছেন ।সাধারণ পাঠাগার আধুনিক জিনিস । কারণ, ঐতিহাসিকরা কী বলবেন জানি নে, যে জ্ঞানার্জনস্পৃহা থেকে পাঠাগারের জন্ম, ব্যাপকভাবে তার জাগরণস্পৃহা সহজে মেটানো সম্ভব নয় । জ্ঞানের বাহন পুস্তক, আর পুস্তক কিনে পড়া যে দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা ধারণা করা সহজ । পুস্তকের ব্যাপারেও সমবায়নীতির প্রবর্তন আবশ্যক । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দশে মিলে কাজ না করলে সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব। এ ব্যাপারে দশের মিলিত ফলস্বরূপ যা পাওয়া যায়, তাকেই সাধারণ লাইব্রেরি বলা হয় । অবশ্য সাধারণ লাইব্রেরি ব্যক্তির দানও হতে পারে । তবে ব্যক্তিগত প্রভাবের চাইতে সাধারণের প্রভাবই সেখানে বলবত্তর হতে বাধ্য । যদি না হয়, তবে সাধারণ পাঠাগার না বলে ব্যক্তিগত পাঠাগার বলাই ভালো ।
সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তক শ্রেণিবদ্ধ করতে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিতে হলেও পুস্তক নির্বাচনে বিশেষ সাবধানতার পরিচয় দিতে হয় বলে মনে হয় না ।
সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তকসংগ্রহ বিষয়ে আরেকটি কথা বলা দরকার । পুস্তক নির্বাচনকালে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বা জাতীয় সংকীর্ণতার পরিচয় যত কম দেওয়া হয়, ততই ভালো । কারণ, যতদূর মনে হয়, পাঠাগার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের রক্ষক নয়, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিকাশক। আর ভালো পুস্তকলেখক যখন কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক নন, সমস্ত সম্প্রদায়ের আত্মীয়, তখন পুস্তক নির্বাচনকালে সংকীর্ণ মনোভাবসম্পন্ন না হওয়াই ভালো ।
জাতির জীবনধারা গঙ্গা-যমুনার মতো দুই ধারায় প্রবাহিত । এক ধারার নাম আত্মরক্ষা বা স্বার্থ প্রসার, আরেক ধারার নাম আত্মপ্রকাশ বা পরার্থ বৃদ্ধি । একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, মামলাফ্যাসাদ প্রভৃতি কদর্য দিক, অপর দিকে সাহিত্যশিল্প, ধর্ম প্রভৃতি কল্যাণপ্রদ দিক । একদিকে শুধু কাজের জন্য কাজ, অপর দিকে আনন্দের জন্য কাজ । একদিকে সংগ্রহ, আরেক দিকে সৃষ্টি । যে জাতি দ্বিতীয় দিকটির প্রতি উদাসীন থেকে শুধু প্রথম দিকটির সাধনা করে, সে জাতি কখনও উঁচু জীবনের অধিকারী হতে পারে না । কোনো প্রকারে টিকে থাকতে পারলেও নব নব বৈভব সৃষ্টি তার দ্বারা সম্ভব হয় না । মানসিক ও আত্মিক জীবনের সাধনা থেকে চরিত্রে যে শ্রী ফুটে ওঠে, তা থেকে তাকে এক রকম বঞ্চিত থাকতেই হয় । জীবনে শ্রী ফোটাতে হলে দ্বিতীয় দিকটির সাধনা আবশ্যক । আর সেজন্য লাইব্রেরি এক অমূল্য অবদান ।
লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড । কারণ, বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব ।(সংক্ষেপিত)

Content added || updated By

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে বাংলায় এম.এ. পাস করেনকর্মজীবনে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। একজন সংস্কৃতিবান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'শিখা' পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । তাঁর লেখায় মননশীলতা ও চিন্তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গদ্যে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব লক্ষণীয় । মূলত গদ্যকার হলেও তিনি বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ সংস্কৃতি কথা বাংলা সাহিত্যের মননশীল প্রবন্ধ-ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সভ্যতা ও সুখ তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ। ১৯৫৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন ।

Content added By

শ্রেণিবদ্ধ -শ্রেণি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সারি সারি সাজানো ।

অভিপ্ৰায় -ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, আকাঙ্ক্ষা ।

সর্ববিদ্যাবিশারদ -সব বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ।

পারদর্শিতা -নৈপুণ্য, পটুতা ।

উদ্ভাবন -আবিষ্কার, গবেষণা করে নতুন কিছু বের করা ।

প্রতিবিম্ব -প্রতিচ্ছায়া, প্রতিচ্ছবি, প্রতিফলিত অবিকল রূপ।

স্বেচ্ছাচারী -যে আপন ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করে ।

স্বেচ্ছাচারী সম্রাট -যে রাজা আপন ইচ্ছা অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করেন । এখানে বাক্যাংশটির বিশেষ অর্থ হচ্ছে - ব্যক্তিগত স্বাধীন রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বই সংগ্রহকারী । যিনি খেয়ালমতো গড়ে তোলেন তাঁর কল্পনার সাম্রাজ্য ।

তাজমহল - সম্রাট শাজাহান যেমন করে তাজমহল তৈরি করে শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছিলেন, তেমনি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব রুচি ও শিল্পীমনের নিদর্শন ।

কাব্যপ্রেমিক - যে কবিতা ভালোবাসে ।

প্ৰতিচ্ছায়া -প্ৰতিচ্ছবি ।

অশোভন -যা শোভন বা সুন্দর নয় ।

জবরদস্তি -জুলুম, পীড়ন, বাড়াবাড়ি ।

মর্জিমাফিক -ইচ্ছা অনুযায়ী, খেয়াল অনুসারে ।
শ্রী -সৌন্দর্য ।

দুষ্কর -দুঃসাধ্য, সহজে করা যায় না এমন ।

বৈদগ্ধ্য -পাণ্ডিত্য ।

চিৎকর্ষ -জ্ঞানচর্চার ফলে মনের উন্নতি ।

পারিপাট্য -শৃঙ্খলা, গোছানো ভাব ।

সৃজন -সৃষ্টি ।

সমবায় নীতি -বহু মানুষ মিলে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বেচ্ছামূলক উদ্যোগে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণের নীতি ।
সমঝদার -বোঝে এমন, রসজ্ঞ।

স্পৃহা -ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ।
বলবত্তর -অধিকতর শক্তিশালী ।
পরার্থ -পরের উপকার ।

সম্প্রদায় -বিশেষ সমাজ ও গোষ্ঠী ।

বিকাশক -যা বিকাশ ঘটায় ।

ভাব বিলাসিতা -ভাবনার বিলসিতা, কাজের চেয়ে ভাবনায় বেশি মনোযোগ ।
 

Content added By

মানবসভ্যতার ক্রম অগ্রগতির ধারায় মানুষের অর্জিত জ্ঞান, মহৎ অনুভব সঞ্চিত হয়ে থাকে গ্রন্থাগারে । এর মাধ্যমে পূর্বপ্রজন্মের জ্ঞান সঞ্চারিত হয় উত্তরপ্রজন্মের কাছে । তাই জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান-অন্বেষণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।
গ্রন্থাগার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহশালা । সব ধরনের জ্ঞানের একত্র সমাবেশ ঘটিয়ে জ্ঞানচর্চার প্রসারে ধারাবাহিক ও স্থায়ী ভূমিকা পালনের জন্য লাইব্রেরির সৃষ্টি । বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার এত বহুমুখী ও বিপুল যে, কোনো এক জনের পক্ষে সব জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয় । তাই এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁর প্রয়োজন ও আগ্রহ অনুযায়ী জ্ঞানচর্চা করতে পারেন । ‘লাইব্রেরি' প্রবন্ধটিতে জ্ঞানলাভ ও পাঠাগারের সম্পর্ক উপস্থাপন করেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। প্রবন্ধটি বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী করে তোলে।

Content added By

বাসা পেলুম কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরে খাজামোল্লা গ্রামে । বাসার সঙ্গে সঙ্গে চাকরও পেলুম। অধ্যক্ষ জিরার জাতে ফরাসি। কাজেই কায়দামাফিক আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর নাম আবদুর রহমান। আপনার সব কাজ করে দেবে- জুতো বুরুশ থেকে খুনখারাবি।' অর্থাৎ ইনি ‘হরফন-মৌলা’ বা ‘সকল কাজের কাজি’।
জিরার সায়েব কাজের লোক, অর্থাৎ সমস্ত দিন কোনো-না-কোনো মন্ত্রীর দপ্তরে ঝগড়া-বচসা করে কাটান। কাবুলে এরই নাম কাজ। ‘ওরভোয়া, বিকেলে দেখা হবে' বলে চলে গেলেন । কাবুল শহরে আমি দুটি নরদানব দেখেছি। তার একটি আবদুর রহমান ।
পরে ফিতে দিয়ে মেপে দেখেছিলুম ছ ফুট চার ইঞ্চি। উপস্থিত লক্ষ করলুম লম্বাই মিলিয়ে চওড়াই। দুখানা হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে আঙুলগুলো দু কাঁদি মর্তমান কলা হয়ে ঝুলছে। পা দুখানা ডিঙি নৌকার সাইজ। কাঁধ দেখে মনে হলো, আমার বাবুর্চি আবদুর রহমান না হয়ে সে যদি আমীর আবদুর রহমান হত তবে অনায়াসে গোটা আফগানিস্তানের ভার বইতে পারত। এ কান ও কান জোড়া মুখ— হ্যাঁ করলে চওড়াচওড়ি কলা গিলতে পারে। এবড়ো-থেবড়ো নাক-কপাল নেই । পাগড়ি থাকায় মাথার আকার-প্রকার ঠাহর হলো না, তবে আন্দাজ করলুম বেবি সাইজের হ্যাটও কান অবধি পৌঁছবে।
রঙ ফর্সা, তবে শীতে গ্রীষ্মে চামড়া চিরে ফেঁড়ে গিয়ে আফগানিস্তানের রিলিফ ম্যাপের চেহারা ধরেছে। দুই গাল কে যেন থাবড়া মেরে লাল করে দিয়েছে- কিন্তু কার এমন বুকেট পাটা? রুজও তো মাখবার কথা নয় । পরনে শিলওয়ার, কুর্তা আর ওয়াসকিট।
ঠোঁট দুটি দেখতে পেলুম না। সেই যে প্রথম দিন ঘরে ঢুকে কার্পেটের দিকে নজর রেখে দাঁড়িয়েছিল, শেষ দিন পর্যন্ত ঐ কার্পেটের অপরূপ রূপ থেকে তাকে বড়ো একটা চোখ ফেরাতে দেখিনি । গুরুজনদের দিকে তাকাতে নেই, আফগানিস্তানেও নাকি এই ধরনের একটা সংস্কার আছে।

তবে তার নয়নের ভাবের খেলা গোপনে দেখেছি। দুটো চিনেমাটির ডাবরে যেন দুটো পান্তুয়া ভেসে উঠেছে।
জরিপ করে ভরসা পেলুম, ভয়ও হলো। এ লোকটা ভীমসেনের মতো রান্না তো করবেই, বিপদে- আপদে ভীমসেনেরই মতো আমার মুশকিল আসান হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন, এ যদি কোনোদিন বিগড়ে যায়? তবে? কোনো একটা হদিসের সন্ধানে মগজ আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে আরম্ভ করলুম।
রহমানকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘পূর্বে কোথায় কাজ করেছ?”
উত্তর দিল, ‘কোথাও না, পল্টনে ছিলুম, মেসের চার্জে। এক মাস হলো খালাস পেয়েছি।'
‘রাইফেল চালাতে পার?'
একগাল হাসল ।
'কী কী রাঁধতে জানো?'
‘পোলাও, কোরমা, কাবাব, ফালুদা—।'
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘ফালুদা বানাতে বরফ লাগে । এখানে বরফ তৈরি করার কল আছে?'
“কিসের কল?”
আমি বললুম, “তাহলে বরফ আসে কোত্থেকে?
বলল, ‘কেন, ঐ পাগমানের পাহাড় থেকে।' বলে জানলা দিয়ে পাহাড়ের বরফ দেখিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখলুম, যদিও গ্রীষ্মকাল, তবু সবচেয়ে উঁচু নীল পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা বরফ দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘বরফ আনতে ঐ উঁচুতে চড়তে হয়?”
বলল, ‘না সায়েব, এর অনেক নিচে বড়ো বড়ো গর্তে শীতকালে বরফ ভর্তি করে রাখা হয়। এখন তাই খুঁড়ে তুলে গাধা বোঝাই করে নিয়ে আসা হয়।'
বুঝলুম, খবর-টবরও রাখে। বললুম, 'তা আমার হাঁড়িকুড়ি, বাসনকোসন তো কিছু নেই। বাজার থেকে সব কিছু কিনে নিয়ে এসো। রাত্তিরের রান্না আজ আর বোধ হয় হয়ে উঠবে না। কাল দুপুরে রান্না কোরো। সকালবেলা চা দিয়ো৷'
টাকা নিয়ে চলে গেল ।
বেলা থাকতেই কাবুল রওনা দিলুম। আড়াই মাইল রাস্তা- মৃদুমধুর ঠান্ডায় গড়িয়ে গড়িয়ে পৌছব। পথে দেখি এক পবর্তপ্রমাণ বোঝা নিয়ে আবদুর রহমান ফিরে আসছে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘এত বোঝা
বইবার কি দরকার ছিল- একটা মুটে ভাড়া করলেই তো হত।'
যা বলল, তার অর্থ এই, সে যে-মোট বইতে পারে না, সে-মোট কাবুলে বইতে যাবে কে? আমি বললুম, ‘দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়ে আসতে।' ভাব দেখে বুঝলুম, অতটা তার মাথায় খেলেনি, অথবা ভাববার প্রয়োজনবোধ করেনি।

বোঝাটা নিয়ে আসছিল জালের প্রকাণ্ড থলেতে করে। তার ভিতর তেল-নুন-লকড়ি সবই দেখতে পেলুম । আমি ফের চলতে আরম্ভ করলে বলল, ‘সায়েব রাত্রে বাড়িতেই খাবেন।'
খুব বেশি দূর যেতে হলো না । লব-ই-দরিয়া অর্থাৎ কাবুল নদীর পারে পৌছতে না পৌঁছতেই দেখি
মসিয়ে জিরার টাঙা হাঁকিয়ে টগবগাবগ করে বাড়ি ফিরছেন ।
কলেজের বড়কর্তা বা বস্ হিসাবে আমাকে তিনি বেশ দু-এক প্রস্থ ধমক দিয়ে বললেন, 'কাবুল শহরে নিশাচর হতে হলে যে তাগদ ও হাতিয়ারের প্রয়োজন, সে দুটোর একটাও তোমার নেই।'
বসকে খুশী করবার জন্য যার ঘটে ফন্দি-ফিকিরের অভাব, তার পক্ষে কোম্পানির কাজ হচ্ছে তর্ক না করা। বিশেষ করে যখন বসের উত্তমার্ধ তাঁরই পাশে বসে ‘উই, সার্তেনমা, এভিদামা, অর্থাৎ অতি অবশ্য, সার্টেনলি, এভিডেন্টলি', বলে তাঁর কথায় সায় দেন। ইংলন্ডে মাত্র একবার ভিক্টোরিয়া আলবার্ট আঁতাৎ হয়েছিল; শুনতে পাই ফ্রান্সে নাকি নিত্যি-নিত্যি, ঘরে ঘরে।
বাড়ি ফিরে এসে বসবার ঘরে ঢুকতেই আবদুর রহমান একটা দর্শন দিয়ে গেল এবং আমি যে তার তম্বীতেই ফিরে এসেছি, সে সম্বন্ধে আশ্বস্ত হয়ে হুট করে বেরিয়ে গেল । তখন রোজার মাস নয়, তবু আন্দাজ করলুম সেহরির সময় অর্থাৎ রাত দুটোয় খাবার জুটলে জুটতেও পারে ।
তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল। দেখি আবদুর রহমান মোগল তসবিরের গাড়ু-বদনার
সমন্বয় আফতাবে বা ধারাযন্ত্র নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। মুখ ধুতে গিয়ে বুঝলুম, যদিও গ্রীষ্মকাল, তবু
কাবুল নদীর বরফ-গলা জলে কিছুদিন ধরে আমার মুখও আফগানিস্থানের রিলিফ ম্যাপের উঁচুনিচুর
টক্করের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারবে।
খানা টেবিলের সামনে গিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে, আমার ভৃত্য আগা আবদুর রহমান এককালে মেসের চার্জে ছিলেন ।
ডাবর নয়, ছোটখাটো একটা গামলাভর্তি মাংসের কোরমা বা পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্বাথে সেরখানেক দুম্বার মাংস— তার মাঝে মাঝে কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে, এক কোণে একটি আলু অপাংক্তেয় হওয়ার দুঃখে ডুবে মরার চেষ্টা করছে। আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক ফুল বোম্বাই সাইজের শামী-কাবাব। বারকোশ থালায় এক ঝুড়ি কোফতা-পোলাও আর তার ওপরে বসে আছে একটি আস্ত মুর্গি-রোস্ট।
আমাকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবদুর রহমান তাড়াতাড়ি এগিয়ে অভয়বাণী দিল- রান্নাঘরে
আরো আছে।
একজনের রান্না না করে কেউ যদি তিনজনের রান্না করে, তবে তাকে ধমক দেওয়া যায়, সে যদি ছ'জনের রান্না পরিবেশন করে বলে রান্নাঘরে আরো আছে তখন আর কি করার থাকে? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। কিন্তু
রান্না ভালো, আমার ক্ষুধাও ছিল, কাজেই গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে কিছু কম খাইনি। তার ওপর অদ্য রজনী প্রথম রজনী এবং আবদুর রহমানও ডাক্তারি কলেজের ছাত্র যে রকম তন্ময় হয়ে মড়া কাটা দেখে, সেই রকম আমার খাওয়ার রকম-বহর দুই-ই-তার ডাবর-চোখ ভরে দেখে নিচ্ছিল।

আমি বললুম, ‘ব্যস! উৎকৃষ্ট রেঁধেছ আবদুর রহমান–।'
আবদুর রহমান অন্তর্ধান। ফিরে এল হাতে এক থালা ফালুদা নিয়ে। আমি সবিনয় জানালুম যে, আমি মিষ্টি পছন্দ করি না ৷
আবদুর রহমান পুনরপি অন্তর্ধান। আবার ফিরে এল এক ডাবর নিয়ে- পেঁজা বরফের গুঁড়োয় ভর্তি । আমি বোকা বনে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এ আবার কি?'
আবদুর রহমান উপরের বরফ সরিয়ে দেখাল নিচে আঙুর। মুখে বলল, “বাগেবালার বরফি আঙুর- তামাম আফগানিস্তানে মশহুর।' বলেই একখানা সসারে কিছু বরফ আর গোটা কয়েক আঙুর নিয়ে বসল ৷ আমি আঙুর খাচ্ছি, ও ততক্ষণ এক-একটা করে হাতে নিয়ে সেই বরফের টুকরোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অতি সন্তর্পণে ঘষে-মেয়েরা যে রকম আচারের জন্য কাগজি নেবু পাথরের শিলে ঘষেন। বুঝলুম, বরফ- ঢাকা থাকা সত্ত্বেও আঙুর যথেষ্ট হিম হয়নি বলে এই মোলয়েম কায়দা। ওদিকে তালু আর জিবের মাঝখানে একটা আঙুরে চাপ দিতেই আমার ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত ঝিনঝিন করে উঠছে। কিন্তু পাছে আবদুর রহমান ভাবে তার মনিব নিতান্ত জংলি তাই খাইবারপাসের হিম্মৎ বুকে সঞ্চয় করে গোটা আষ্টেক গিললুম। কিন্তু বেশিক্ষণ চালাতে পারলুম না; ক্ষান্ত দিয়ে বললুম, 'যথেষ্ট হয়েছে আবদুর রহমান, এবারে তুমি গিয়ে ভালো করে খাও।'
কার গোয়াল, কে দেয় ধুঁয়ো। এবারে আবদুর রহমান এলেন চায়ের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে। কাবুলি সবুজ চা। পেয়ালায় ঢাললে অতি ফিকে হলদে রঙ দেখা যায়। সে চায়ে দুধ দেওয়া হয় না। প্রথম পেয়ালায় চিনি দেওয়া হয়, দ্বিতীয় পেয়ালায় তাও না। তারপর ঐ রকম, তৃতীয়, চতুর্থ- কাবুলিরা পেয়ালা ছয়েক খায়, অবশ্যি পেয়ালা সাইজে খুব ছোট, কফির পাত্রের মত ।
চা খাওয়া শেষ হলে আবদুর রহমান দশ মিনিটের জন্য বেরিয়ে গেল। ভাবলুম এই বেলা দরজা বন্ধ করে দি, না হলে আবার হয়ত কিছু একটা নিয়ে আসবে । আস্ত উটের রোস্টটা হয়ত দিতে ভুলে গিয়েছে।
ততক্ষণে আবদুর রহমান পুনরায় হাজির। এবার এক হাতে থলে-ভর্তি বাদাম আর আখরোট, অন্য হাতে হাতুড়ি । ধীরে সুস্থে ঘরের এককোণে পা মুড়ে বসে বাদাম আখরোটের খোসা ছাড়াতে লাগল ৷ এক মুঠো আমার কাছে নিয়ে এসে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে বলল, ‘আমার রান্না হুজুরের পছন্দ হয়নি।'
‘কে বলল, পছন্দ হয়নি?”
‘তবে ভালো করে খেলেন না কেন?'
আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, 'কী আশ্চর্য, তোমার বপুটার সঙ্গে আমার তনুটা মিলিয়ে দেখো দিকিনি- তার থেকে আন্দাজ করতে পারো না, আমার পক্ষে কি পরিমাণ খাওয়া সম্ভবপর?
? আবদুর রহমান তর্কাতর্কি না করে ফের সেই কোণে গিয়ে আখরোট বাদামের খোসা ছাড়াতে লাগল ।

তারপর আপন মনে বলল, 'কাবুলের আবহাওয়া বড়ই খারাপ। পানি তো পানি নয় ।, সে যেন গালানো পাথর। পেটে গিয়ে এক কোণে যদি বসল তবে ভরসা হয় না আর কোনো দিন বেরুবে। কাবুলের হাওয়া তো হাওয়া নয়- আতসবাজির হল্কা । মানুষের ক্ষিদে হবেই বা কি করে ।’ আমার দিকে না তাকিয়েই তারপর জিজ্ঞেস করল, 'হুজুর কখনো পানশির গিয়েছেন?'
‘সে আবার কোথায় ?'
‘উত্তর-আফগানিস্তান। আমার দেশ- সে কী জায়গা! একটা আস্ত দুম্বা খেয়ে এক ঢোক পানি খান, আবার ক্ষিদে পাবে। আকাশের দিকে মুখ করে একটা লম্বা দম নিন, মনে হবে তাজি ঘোড়ার সঙ্গে বাজি রেখে ছুটতে পারি। পানশিরের মানুষ তো পায়ে হেঁটে চলে না, বাতাসের ওপর ভর করে যেন উড়ে চলে যায় ।
‘শীতকালে সে কী বরফ পড়ে! মাঠ পথ পাহাড় নদী গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যায়, ক্ষেত খামারের কাজ বন্ধ,বরফের তলায় রাস্তা চাপা পড়ে গেছে। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, বাড়ি থেকে বেরনোর কথাই ওঠে না। আহা সে কি আরাম! লোহার বারকোশে আঙার জ্বালিয়ে তার ওপর ছাই ঢাকা দিয়ে কম্বলের তলায় চাপা দিয়ে বসবেন গিয়ে জানালার ধারে। বাইরে দেখবেন বরফ পড়ছে, বরফ পড়ছে পড়ছে, পড়ছে- দু দিন, তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন ধরে। আপনি বসেই আছেন, আর দেখছেন চে তৌর বর্ষ ববারদ- কি রকম বরফ পড়ে।'
আমি বললুম, ‘সাত দিন ধরে জানালার কাছে বসে থাকব ?’
আবদুর রহমান আমার দিকে এমন করুণভাবে তাকালো যে, মনে হলো এ রকম বেরসিকের পাল্লায় সে জীবনে আর কখনো এতটা অপদস্থ হয়নি। ম্লান হেসে বলল, ‘একবার আসুন, জানালার পাশে বসুন, দেখুন। পছন্দ না হয়, আবদুর রহমানের গর্দান তো রয়েছে।'
খেই তুলে নিয়ে বলল, ‘সে কত রকমের বরফ পড়ে। কখনো সোজা, ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলোর মতো, তারি ফাঁকে ফাঁকে আসমান জমিন কিছু কিছু দেখা যায়। কখনো ঘুরঘট্টি ঘন,— চাদরের মতো নেবে এসে চোখের সামনে পর্দা টেনে দেয়। কখনো বয় জোর বাতাস, প্রচণ্ড ঝড়। বরফের পাঁজে যেন সে-বাতাস ডাল গলাবার চর্কি চালিয়ে দিয়েছে। বরফের গুঁড়ো ডাইনে বাঁয়ে উপর নিচে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি লাগায়- হু হু করে কখনো একমুখে হয়ে তাজি ঘোড়াকে হার মানিয়ে ছুটে চলে। কখনো সব ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু শুনতে পাবেন সোঁ-ওঁ-ওঁ- তার সঙ্গে আবার মাঝে মাঝে যেন দারুল আমানের ইঞ্জিনের শিটির শব্দ। সেই ঝড়ে ধরা পড়লে রক্ষে নেই, কোথা থেকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, না হয় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবেন বরফের বিছানায়, তারই উপর জমে উঠবে ছ হাত উঁচু বরফের কম্বল- গাদা গাদা, পাঁজা পাঁজা। কিন্তু তখন সে বরফের পাঁজা সত্যিকার কম্বলের মতো ওম দেয় । তার তলায় মানুষকে দু দিন পরেও জ্যান্ত পাওয়া গিয়েছে।
একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবেন বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সূর্য উঠেছে— সাদা বরফের উপর সে রোশনির দিকে চোখ মেলে তাকানো যায় না। কাবুলের বাজারে কালো চশমা পাওয়া যায়, তাই পরে তখন বেড়াতে বেরোবেন। যে হাওয়া দম নিয়ে বুকে ভরবেন তাতে একরত্তি ধুলো নেই,বালু নেই, ময়লা নেই ছুরির মতো ধারাল ঠান্ডা হাওয়া নাক মগজ গলা বুক চিরে ঢুকবে, আবার বেরিয়ে আসবে ভিতরকার সব ময়লা ঝেঁটিয়ে নিয়ে । দম নেবেন, ছাতি এক বিঘৎ ফুলে উঠবে- দম ফেলবেন এক বিঘৎ নেমে যাবে। এক এক দম নেওয়াতে এক এক বছর আয়ু বাড়বে- এক একবার দম ফেলাতে একশটা বেমারি বেরিয়ে যাবে।
“তখন ফিরে এসে, হুজুর একটা আস্ত দুম্বা যদি না খেতে পারেন, তবে আমি আমার গোঁফ কামিয়ে ফেলব। আজ যা রান্না করেছিলুম তার ডবল দিলেও আপনি ক্ষিদের চোটে আমায় কতল করবেন।
আমি বললুম, 'হ্যাঁ আবদুর রহমান তোমার কথাই সই। শীতকালটা আমি পানশিরেই কাটাব।'
আবদুর রহমান গদগদ হয়ে বলল, ‘সে বড়ো খুশি বাৎ হবে হুজুর।
আমি বললুম, ‘তোমার খুশির জন্য নয়, আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ।’
আবদুর রহমান ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকালো ।
আমি বুঝিয়ে বললুম, 'তুমি যদি সমস্ত শীতকালটা জানালার পাশে বসে কাটাও তবে আমার রান্না করবে কে?'

Content added By

সৈয়দ মুজতবা আলী ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে আসামভুক্ত শ্রীহট্টের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সিকান্দর আলী। সৈয়দ মুজতবা আলীর পৈতৃক নিবাস মৌলভীবাজারে। তিনি সিলেট গভর্মেন্ট হাইস্কুল ও শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেন। পরে ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আফগানিস্তানে কাবুলের কৃষি বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন । কর্মজীবনে তিনি মিশরের আল আজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মহীশূরের বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করেন । তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন । কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখার অভিযোগে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বভারতীর রিডার নিযুক্ত হন। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজস্ব এক গদ্যশৈলীর নির্মাতা। বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তি ও অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে তিনি যে গদ্য রচনা করেছেন, তা খুবই রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো : দেশে-বিদেশে, পঞ্চতন্ত্র, চাচা কাহিনী, ময়ূরকণ্ঠী, শবনম ইত্যাদি। তিনি ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

ও রভোয়া – ফরাসি ভাষার বাক্যবন্ধ। অর্থ : আবার দেখা হবে। নরদানব - মানুষের মতো দেখতে ভয়ঙ্কর জন্তু। এখানে বিশালদেহী মানুষ বোঝানো হয়েছে। আদরার্থে ।

মর্তমান কলা - মায়ানমারের মার্তাবান দ্বীপে উৎপন্ন কলার জাত। রুজ - গাল রাঙানোর প্রসাধনী ।

পান্তুয়া -চিনির রসে ভেজানো ঘিয়ে ভাজা রসগোল্লা জাতীয় মিষ্টি। তাগদ - শক্তি। তন্বী - তিরস্কার। বারকোশ – কাঠের তৈরি কানা উঁচু বড় থালা। পুনরপি - পুনরায়।

ব্রহ্মরন্ধ্র - তালুর কেন্দ্রবর্তী ছিদ্র। বপু – বড় দেহ। তনু – ক্ষীণ দেহ। উত্তমার্ধ — স্ত্রী, সহধর্মিণী।

Content added By

‘প্রবাস বন্ধু' সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে গ্রন্থের পঞ্চদশ অংশ। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের ভূমি, পরিবেশ; সেখানকার মানুষ ও তাদের সহজ-সরল জীবনাচরণ, বিচিত্র খাদ্য ইত্যাদি হাস্যরসাত্মকভাবে এই রচনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখকের আফগানিস্তান ভ্রমণের আংশিক অভিজ্ঞতার পরিচয় আছে এখানে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের সন্নিকটে খাজামোল্লা নামক গ্রামে বাসের সময় আবদুর রহমান নামের একজন তাঁর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন । আফগান আবদুর রহমান চরিত্রের মধ্যে সরলতা, স্বদেশপ্রেম, অতিথিপরায়ণতা ফুটে উঠেছে। আবদুর রহমানের রান্না ও পরিবেশন করা খাবারের মধ্যে আফগানিস্তানের বিচিত্র ও সুস্বাদু খাদ্যবস্তুর পরিচয় পাওয়া যায়। আফগানিস্তানের প্রস্তরভূমি এবং একই সঙ্গে নিকট-প্রতিবেশী এই জনপদের বরফ- শীতল জলবায়ু আকর্ষণীয়। ‘প্রবাস বন্ধু’ গল্পটি আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জীবন ও জগৎ, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাবতে শেখায়।

Content added By

শীতের সকাল। রোদে বসে আমি স্কুলের পড়া করছি, মা কাছে বসে ফুলকপি কুটছেন। সে এসেই বলল, আপনার রান্নার জন্য লোক রাখবেন? আমি ছোটো ছেলে-মেয়েও রাখব ।
নিঃসঙ্কোচ আবেদন। বোঝা গেল সঙ্কোচ অনেক ছিল, প্রাণপণ চেষ্টায় অতিরিক্ত জয় করে ফেলেছে। তাই যেটুকু সঙ্কোচ নিতান্তই থাকা উচিত তাও এর নেই ।
বয়স আর কত হবে, বছর তেইশ। পরনে সেলাই করা ময়লা শাড়ি, পাড়টা বিবর্ণ লাল। সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা, ঈষৎ বিশীর্ণ মুখে গাঢ় শ্রান্তির ছায়া, স্থির অচঞ্চল দুটি চোখ। কপালে একটি ক্ষত- চিহ্ন-আন্দাজে পরা টিপের মতো ।
মা বললেন, তুমি রাঁধুনি ?
চমকে তার মুখ লাল হলো। সে চমক ও লালিমার বার্তা বোধহয় মার হৃদয়ে পৌঁছল, কোমল স্বরে বললেন, বোসো বাছা ৷
সে বসল না। অনাবশ্যক জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি রাঁধুনি । আমায় রাখবেন? আমি রান্না ছাড়া ছোটো ছোটো কাজও করব।
মা তাকে জেরা করলেন। দেখলাম সে ভারি চাপা । মার প্রশ্নের ছাঁকা জবাব দিল, নিজে থেকে একটি কথা বেশি কইল না। সে বলল, তার নাম মমতা। আমাদের বাড়ি থেকে খানিক দূরে জীবনময়ের গলি, গলির ভেতরে সাতাশ নম্বর বাড়ির একতলায় সে থাকে। তার স্বামী আছে আর একটি ছেলে। স্বামীর চাকরি নেই চার মাস, সংসার আর চলে না, সে তাই পর্দা ঠেলে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছে। এই তার প্রথম চাকরি। মাইনে? সে তা জানে না। দুবেলা রেঁধে দিয়ে যাবে, কিন্তু খাবে না ।
পনের টাকা মাইনে ঠিক হলো। সে বোধহয় টাকা বারো আশা করেছিল, কৃতজ্ঞতায় দুচোখ সজল হয়ে উঠল। কিন্তু সমস্তটুকু কৃতজ্ঞতা সে নীরবেই প্রকাশ করল, কথা কইল না ৷
মা বললেন, আচ্ছা, তুমি কাল সকাল থেকে এসো ।
সে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেল। আমি গেটের কাছে তাকে পাকড়াও করলাম । শোন । এখুনি যাচ্ছ কেন? রান্নাঘর দেখবে না? আমি দেখিয়ে দিচ্ছি এসো।
কাল দেখবো, বলে সে এক সেকেন্ড দাঁড়াল না, আমায় তুচ্ছ করে দিয়ে চলে গেল। ওকে আমার ভালো লেগেছিল, ওর সঙ্গে ভাব করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, তবু, আমি ক্ষুণ্ণ হয়ে মার কাছে গেলাম। একটু বিস্মিত হয়েও। যার অমন মিষ্টি গলা, চোখে মুখে যার উপচে পড়া স্নেহ, তার ব্যবহার এমন রূঢ় !
মা বললেন, পিছনে ছুটেছিলি বুঝি ভাব করতে? ভাবিস না, তোকে খুব ভালোবাসবে। বার বার তোর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিলো!
শুনে খুশি হলাম । রাঁধুনি পদপ্রার্থিনীর স্নেহ সেদিন অমন কাম্য মনে হয়েছিল কেন বলতে পারি না ।
পরদিন সে কাজে এল। নীরবে নতমুখে কাজ করে গেল। যে বিষয়ে উপদেশ পেল পালন করল, যে বিষয়ে উপদেশ পেল না নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করল- অনর্থক প্রশ্ন করল না, নির্দেশের অভাবে কোনো কাজ ফেলে রাখল না। সে যেন বহুদিন এ বাড়িতে কাজ করছে বিনা আড়ম্বরে এমন নিখুঁত হলো তার কাজ।
কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে সকলে তো খুশি হলেন, মার ভবিষ্যৎ বাণী সফল করে সে যে আমায় খুব ভালোবাসবে তার কোনো লক্ষণ না দেখে আমি হলাম ক্ষুণ্ণ। দুবার খাবার জল চাইলাম, চার পাঁচ বার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু কিছুতেই সে আমায় ভালোবাসল না। বরং রীতিমতো উপেক্ষা করল। শুধু আমাকে নয় সকলকে । কাজগুলিকে সে আপনার করে নিল, মানুষগুলির দিকে ফিরেও তাকাল না। মার সঙ্গে মৃদুস্বরে দু একটি দরকারী কথা বলা ছাড়া ছটা থেকে বেলা সাড়ে দশটা অবধি একবার কাশির শব্দ পর্যন্ত করল না। সে যেন ছায়াময়ী মানবী, ছায়ার মতোই ম্লানিমার ঐশ্বর্যে মহীয়সী কিন্তু ধরাছোঁয়ার অতীত শব্দহীন অনুভূতিহীন নির্বিকার।
রাগ করে আমি স্কুলে চলে গেলাম। সে কি করে জানবে মাইনে করা রাঁধুনির দূরে থাকাটাই সকলে তার কাছে আশা করছে না, তার সঙ্গে কথা কইবার জন্য বাড়ির ছোটোকর্তা ছটফট করেছে!
সপ্তাহখানেক নিজের নতুন অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর সে আমার সঙ্গে ভাব করল।

বাড়িতে সেদিন কুটুম এসেছিল, সঙ্গে এসেছিল এক গাদা রসগোল্লা আর সন্দেশ। প্রকাশ্য ভাগটা প্রকাশ্যে খেয়ে ভাঁড়ার ঘরে গোপন ভাগটা মুখে পুরে চলেছি, কোথা থেকে সে এসে খপ করে হাত ধরে ফেলল । রাগ করে মুখের দিকে তাকাতে সে এমন ভাবে হাসল যে লজ্জা পেলাম ।
বলল, দরজার পাশ থেকে দেখছিলাম, আর কটা খাচ্ছ গুনছিলাম। যা খেয়েছ তাতেই বোধহয় অসুখ হবে,আর খেয়ো না । কেমন?
ভর্ৎসনা নয়, আবেদন। মার কাছে ধরা পড়লে বকুনি খেতাম এবং এক খাবলা খাবার তুলে নিয়ে ছুটে পালাতাম। এর আবেদনে হাতের খাবার ফেলে দিলাম। সে বলল, লক্ষ্মী ছেলে। এসো জল খাবে ।
বাড়ির সকলে কুটুম নিয়ে অন্যত্র ব্যস্ত ছিল, জল খেয়ে আমি রান্নাঘরে আসন পেতে তার কাছে বসলাম। এতদিন তার গম্ভীর মুখই শুধু দেখেছিলাম, আজ প্রথম দেখলাম, সে নিজের মনে হাসছে ।
আমি বললাম, বামুনদি-
সে চমকে হাসি বন্ধ করল। এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি তাকে গাল দিয়েছি। বুঝতে না পেরেও অপ্রতিভ হলাম ।
কি হলো বামুনদি?
সে এদিক ওদিক তাকাল। ডালে খানিকটা নুন ফেলে দিয়ে এসে হঠাৎ আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। গম্ভীর মুখে বলল, আমায় বামুনদি বোলো না খোকা । শুধু দিদি বোলো। তোমার মা রাগ করবেন দিদি বললে?
আমি মাথা নাড়লাম। সে ছোট এক নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে এত কাছে টেনে নিল যে আমার প্রথম ভারি লজ্জা করতে লাগল ।
তারপর কিছুক্ষণ আমাদের যে গল্প চলল সে অপূর্ব কথোপকথন মনে করে লিখতে পারলে সাহিত্যে না হোক আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান লেখা হয়ে উঠত ।
হঠাৎ মা এলেন। সে দুহাতে আমাকে একরকম জড়িয়েই ধরে ছিল, হাত সরিয়ে ধরা পড়া চোরের মতো হঠাৎ বিব্রত হয়ে উঠল, দুচোখে ভয় দেখা দিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে আমার কপালে চুম্বন করে মাকে বলল, এত কথা কইতে পারে আপনার ছেলে ।
তখন বুঝিনি, আজ বুঝি স্নেহে সে আমায় আদর করেনি, নিজের গর্ব প্রতিষ্ঠার লোভে। মা যদি বলতেন, খোকা উঠে আয়,– যদি কেবল মুখ কালো করে সরে যেতেন, পরদিন থেকে সে আর আসত না। পনের টাকার খাতিরেও না, স্বামীপুত্রের অনাহারের তাড়নাতেও না ৷
মা হাসলেন । বললে, ও ওইরকম। সারাদিন বকবক করে। বেশি আস্কারা দিও না, জ্বালিয়ে মারবে।বলে মা চলে গেলেন। তার দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপ টপ করে ঝরে পড়ল । মা অপমান করলে তার চোখ হয়তো শুকনোই থাকত, সম্মানে, চোখের জল ফেলল! সে সম্মানের আগাগোড়া করুণা ও দয়া মাখা ছিল, সেটা বোধহয় তার সইল না ।
তিন চার দিন পরে তার গালে তিনটে দাগ দেখতে পেলাম। মনে হয়, আঙুলের দাগ। মাস্টারের চড় খেয়ে একদিন অবনীর গালে যে রকম দাগ হয়েছিল তেমনি। আমি ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার গালে আঙুলের দাগ কেন? কে চড় মেরেছে?
সে চমকে গালে হাত চাপা দিয়া বলল, দূর! তারপর হেসে বলল, আমি নিজে মেরেছি! কাল রাত্রে গালে একটা মশা বসেছিল, খুব রেগে-
মশা মারতে গালে চড়! বলে আমি খুব হাসলাম। সেও প্রথমটা আমার সঙ্গে হাসতে আরম্ভ করে গালে হাত ঘষতে ঘষতে আনমনা ও গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ দেখে আমারও হাসি বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ে দেখলাম,ভাতের হাঁড়ির বুদবুদফাটা বাষ্পে কি দেখে যেন তার চোখ পলক হারিয়েছে, নিচের ঠোঁট দাঁতে দাঁতে কামড়ে ধরেছে, বেদনায় মুখ হয়েছে কালো ।
সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, তুমি মিথ্যে বলছো দিদি । তোমায় কেউ মেরেছে। সে হঠাৎ কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, না ভাই, না । সত্যি বলছি না । কে মারবে?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে হলো। তখন কি জানি তার গালে চড় মারার অধিকার একজন মানুষের আঠার আনা আছে! কিন্তু চড় যে কেউ একজন মেরেছে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ঘুচল না । শুধু দাগ নয়, তার মুখ চোখের ভাব, তার কথার সুর সমস্ত আমার কাছে ওকথা ঘোষণা করে দিল। বিবর্ণ গালে তিনটি রক্তবর্ণ দাগ দেখতে দেখতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল । আমি গালে হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম কিন্তু সে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। চুপি চুপি বলল, কারো কাছে যা পাই না, তুমি তা দেবে কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি দিলাম আমি?
এ প্রশ্নের জবাব পেলাম না। হঠাৎ সে তরকারি নামাতে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল । পিঁড়িতে বসামাত্র খোঁপা খুলে পিঠ ভাসিয়ে একরাশি চুল মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল কি একটা অন্ধকার রহস্যের আড়ালে সে যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।
রহস্য বৈকি । গালে চড়ের দাগ, চিরদিন যে ধৈর্যময়ী ও শান্ত তার ব্যাকুল কাতরতা, ফিসফিস করে ছোটো ছেলেকে শোনানো; কারও কাছে যা পাই না তুমি তা দেবে কেন? বুদ্ধির পরিমাণের তুলনায় এর চেয়ে বড় রহস্য আমার জীবনে কখনো দেখা দেয়নি! ভেবেচিন্তে আমি তার চুলগুলি নিয়ে বেণী পাকাবার চেষ্টা আরম্ভ করে দিলাম । আমার আশা পূর্ণ হলো সে মুখ ফিরিয়ে হেসে রহস্যের ঘোমটা খুলে সহজ মানুষ হয়ে গেল ।
বিকালে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, তোমার বরের চাকরি হলে তুমি কী করবে?

তুমি কী করতে বল? হরির লুট দেব? না তোমায় সন্দেশ খাওয়াব ।

ধেৎ তা বলছি না । তোমার বরের চাকরি নেই বলে আমাদের বাড়ি কাজ করছ, তা তো চাকরি হলে
করবে না?
সে হাসল, করব। এখন করছি যে!
তোমার বরের চাকরি হয়েছে।
হয়েছে বলে সে গম্ভীর হয়ে গেল ।
আহা স্বামীর চাকরি নেই বলে ভদ্রলোকের মেয়ে কষ্টে পড়েছে, পাড়ার মহিলাদের কাছে মার এই মন্তব্য শুনে মমতাদির বরের চাকরির জন্য আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তার চাকরি হয়েছে শুনে পুলকিত হয়ে মাকে সংবাদটা শুনিয়ে দিলাম ।
মা তাকে ডেকে পাঠালেন, তোমার স্বামীর চাকরি হয়েছে?
সে স্বীকার করে বলল, হয়েছে। বেশি দিন নয়, ইংরাজি মাসের পয়লা থেকে ।
মা বললেন, অন্য লোক ঠিক করে দিতে পারছ না বলে কি তুমি কাজ ছেড়ে দিতে ইতস্তত করছ? তার কোনো দরকার নেই। আমরা তোমায় আটকে রাখব না। তোমার কষ্ট দূর হয়েছে তাতে আমরাও খুব সুখী। তুমি ইচ্ছে করলে এবেলাই কাজ ছেড়ে দিতে পার, আমাদের অসুবিধা হবে না।
তার চোখে জল এল, সে শুধু বলল, আমি কাজ করব।
মা বললেন, স্বামীর চাকরি হয়েছে, তবু?
সে বলল, তাঁর সামান্য চাকরি, তাতে কুলবে না মা । আমায় ছাড়বেন না । আমার কাজ কি ভালো হচ্ছে না?
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, অমন কথা তোমার শত্রুও বলতে পারবে না মা। সেজন্য নয়। তোমার কথা ভেবেই আমি বলছিলাম । তোমার ওপর মায়া বসেছে, তুমি চলে গেলে আমাদেরও কি ভালো লাগবে?
সে একরকম পালিয়ে গেল। আমি তার পিছু নিলাম। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম সে কাঁদছে। আমায়
দেখে চোখ মুছল ।
আচমকা বলল, মিথ্যে বললে কি হয় খোকা ?
মিথ্যে বললে কি হয় জানতাম । বললাম, পাপ হয় ।
গুরুনিন্দা বাঁচাতে মিথ্যে বললে ?
এটা জানতাম না । গুরুনিন্দা পাপ, মিথ্যা বলা পাপ। কোনটা বেশি পাপ সে জ্ঞান আমার জন্মায়নি। কিন্তু না জানা কথা বলেও সান্ত্বনা দেওয়া চলে দেখে বললাম, তাতে একটুও পাপ হয় না। সত্যি! কাঁদছ কেন?
তখন তার চাকরির এক মাস বোধহয় পূর্ণ হয়নি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার সময়
দেখলাম জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছে কমলা লেবু কিনছে ।

সঙ্গে নেবার ইচ্ছে নেই টের পেয়েও এক রকম জোর করেই বাড়ি দেখতে গেলাম। দুটি লেবু কিনে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে গলিতে ঢুকল। বিশ্রী নোংরা গলি। কে যে ঠাট্টা করে এই যমালয়ের পথটার নাম জীবনময় লেন রেখেছিল! গলিটা আস্ত ইট দিয়ে বাঁধানো, পায়ে পায়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। দুদিকের বাড়ির চাপে অন্ধকার, এখানে ওখানে আবর্জনা জমা করা আর একটা দূষিত চাপা গন্ধ ৷ আমি সঙ্কুচিত হয়ে তার সঙ্গে চলতে লাগলাম। সে বলল, মনে হচ্ছে পাতালে চলেছ, না?
সাতাশ নম্বরের বাড়িটা দোতলা নিশ্চয়, কিন্তু যত ক্ষুদ্র দোতলা হওয়া সম্ভব। সদর দরজার পরেই ছোটো একটি উঠান, মাঝামাঝি কাঠের প্রাচীর দিয়ে দুভাগ করা। নিচে ঘরের সংখ্যা বোধহয় চার, কারণ মমতাদি আমায় যে ভাগে নিয়ে গেল সেখানে দুখানা ছোটো ছোটো কুঠরির বেশি কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। ঘরের সামনে দুহাত চওড়া একটু রোয়াক, একপাশে একশিট করোগেট আয়রনের ছাদ ও চটের বেড়ার অস্থায়ী রান্নাঘর। চটগুলি কয়লার ধোঁয়ায় কয়লার বর্ণ পেয়েছে ।
সে আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল। ঘরে দুটি জানালা আছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই শোবার ঘর করে অন্য ঘরখানার চেয়ে বেশি মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জানালা দুটির এমনি অবস্থান যে আলো যদিও কিছু কিছু আসে, বাতাসের আসা-যাওয়া একেবারে অসম্ভব। সুতরাং পক্ষপাতিত্বের যে খুব জোরালো কারণ ছিল তা বলা যায় না। সংসারের সমস্ত জিনিসই প্রায় এঘরে ঠাঁই পেয়েছে। সব কম দামী শ্রীহীন জিনিস। এই শ্রীহীনতার জন্য সযত্নে গুছিয়ে রাখা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে বিশৃঙ্খলতার অন্ত নেই। একপাশে বড়ো চৌকি, তাতে গুটানো মলিন বিছানা ৷ চৌকির তলে একটি চরকা আর ভাঙ্গা বেতের বাস্কেট চোখে পড়ে, অন্তরালে হয়তো আরও জিনিস আছে। ঘরের এক কোণে পাশাপাশি রক্ষিত দুটি ট্রাংক— দুটিরই রঙ চটে গেছে, একটির তালা ভাঙ্গা । অন্য কোণে কয়েকটা মাজা বাসন, বাসনের ঠিক ঊর্ধ্বে কোনাকুনি টাঙ্গানো দড়িতে খানকয়েক কাপড়। এই দুই কোণের মাঝামাঝি দেওয়াল ঘেঁষে পাতা একটি ভাঙ্গা টেবিল, আগাগোড়া দড়ির ব্যান্ডেজের জোরে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে কয়েকটা বই-খাতা, একটি অল্প দামী টাইমপিস, কয়েকটা ওষুধের শিশি, একটা মেরামত করা আর্সি, কয়েকটা ভাঁজ করা সংবাদপত্র, এই সব টুকিটাকি জিনিস। টেবিলের ঊর্ধ্বে দেওয়ালের গর্তের তাকে কতকগুলি বই ।
ঘরে আর একটি জিনিস ছিল- একটি বছর পাঁচেকের ছেলে। চৌকিতে শুধু মাদুরের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে সে ঘুমিয়ে ছিল । মমতাদি ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে ছেলেটির গায়ে হাত দিল, তারপর গুটানো বিছানার ভেতর থেকে লেপ আর বালিশ টেনে বার করল। সন্তর্পণে ছেলেটির মাথার তলে বালিশ দিয়ে লেপ দিয়ে গা ঢেকে দিল।
বলল, কাল সারারাত পেটের ব্যথায় নিজেও ঘুমোয়নি, আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি। উনি তো রাগ করে— কই, তুমি লেবু খেলে না?
আমি একটা লেবু খেলাম। সে চুপ করে খাওয়া দেখে বলল, মুড়ি ছাড়া ঘরে কিছু নেই, দোকানের বিষও দেব না, একটা লেবু খাওয়াতে তোমাকে ডেকে আনলাম!
আমি বললাম, আর একটা লেবু খাব দিদি।
সে হেসে লেবু দিল, বলল, কৃতার্থ হলাম। সবাই যদি তোমার মতো ভালোবাসত !

ঘরে আলো ও বাতাসের দীনতা ছিল। খানিক পরে সে আমায় বাইরে রোয়াকে মাদুর পেতে বসাল। কথা বলার সঙ্গে সংসারের কয়েকটা কাজও করে নিল । ঘর ঝাঁট দিল, কড়াই মাজল, পানি তুলল, তারপর মশলা বাটতে বসল। হঠাৎ বলল, তুমি এবার বাড়ি যাও ভাই । তোমার খিদে পেয়েছে।

 

 

Content added By

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর অঞ্চলের মালবদিয়া গ্রাম এবং মায়ের বাড়ি একই অঞ্চলের গাঁওদিয়া গ্রাম। ১৯২৬ সালে তিনি মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তারপর গণিতে অনার্স নিয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এসসি ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে অতসীমামী নামক গল্প বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে লেখক হিসেবে তাঁর নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। এ সময় তিনি লেখা নিয়ে এতই মগ্ন থাকেন যে, অসাধারণ এই কৃতী ছাত্রের আর অনার্স পাস করা হয়নি। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি তাঁর বিখ্যাত 'দিবারাত্রির কাব্য' রচনা করেন। এরপর তিনি লেখালেখিকেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা লিখে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। পঞ্চাশটিরও অধিক উপন্যাস তিনি রচনা করেন। এর মধ্যে জননী, চিহ্ন, সহরতলী, অহিংস, চতুষ্কোণ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস । ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর এই মহান লেখক মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

বাছা- বৎস বা অল্পবয়সী সন্তান। পর্দা ঠেলে উপার্জন- এখানে নারীদের অন্তঃপুরে থাকার প্রথাভঙ্গ করে বাইরে এসে আয়-রোজগার করা বোঝাচ্ছে।

অনাড়ম্বর- জাঁকজমকহীন। বামুনদি- ব্রাহ্মণদিদির সংক্ষিপ্ত রূপ। আগে রান্না বা গৃহকর্মে যে ব্রাহ্মণকন্যাগণ নিয়োজিত হতেন তাদের কথ্যরীতিতে বামুনদি ডাকা হতো।

অপ্রতিভ— অপ্রস্তুত। পরদিন থেকে সে আর আসত না— না আসার কারণ আত্মসম্মান। মমতাদি টাকার জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ নিয়েছে সত্য কিন্তু তাকে অসম্মান করলে বা সন্দেহের চোখে দেখলে নিজে অপমান বোধ করে চাকরি ত্যাগের সাহস তার ছিল।

হরির লুট— ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দান করা। সংকীর্তনের পর হরির নামে যেভাবে বাতাসা ছড়ানো হয় ।

Content added By

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরীসৃপ (১৯৩৯) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘মমতাদি’ গল্প। এই গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। স্কুল পড়ুয়া একটি ছেলে যখন দেখে তাদের বাড়িতে মমতাদি নামে এক গৃহকর্মী আসে, তখন সে আনন্দিত হয়। তাকে নিজের বাড়ির একজন বলে ভাবতে শুরু করে ছেলেটি। মমতাদির সংসারে অভাব আছে বলেই মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও তাকে অপরের বাড়িতে কাজ নিতে হয়। এই আত্মমর্যাদাবোধ তার সবসময়ই সমুন্নত ছিল। সে নিজে যেমন আদর ও সম্মানপ্রত্যাশী, তেমনি অন্যকেও স্নেহ ও ভালোবাসা দেবার ক্ষেত্রে তার মধ্যে দ্বিধা ছিল না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি তাই মমতাদির কাছে ছোটো ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। তাকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করে মমতাদি । সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে মমতাদির পাশেও দাঁড়ায় স্কুলপড়ুয়া ঐ ছেলে ও তার পরিবার। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের গৃহকর্মে যাঁরা সহায়তা করে থাকেন তাঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। আত্মসম্মানবোধ তাদেরও আছে। ‘মমতাদি' গল্পটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, সামাজিক শ্রেণি মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না; যে কোনো পেশার যে কোনো মানুষকে দেখতে হবে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার দৃষ্টিতে ।

Content added By

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মৃতি তখন উড়তে শেখা পাখির বাচ্চার মতো, বুঝি তা অনন্ত ভবিষ্যতের অভিসারী। দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাছাইকরা খুনেরা যে হাজার হাজার মেয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করেছিল তাদের বীরাঙ্গনা বলা হচ্ছে এবং তারা সামাজিকভাবে সমাদর পাচ্ছেন। পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা কঙ্কাল আর করোটি সরিয়ে ফেলা হলেও সেগুলো কারও মন থেকে সরে যায়নি। ঢাকায় শহিদ মিনারের চত্বর থেকে শুরু করে বুড়িগঙ্গার বাঁধ পর্যন্ত রাস্তার আশেপাশে দখলদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে যেসব এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছিল সেগুলোর অঙ্গার তখনো যেন কালো কালো আঙুলে শহরের আকাশকে বিঁধছে। এই অবস্থায় ১৯৭১-এর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবসের সমস্ত অনুষ্ঠানে ঐকান্তিকতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আর বীরাঙ্গনাদের সম্মানিত করা হচ্ছে। শহিদদের নামে এলাকায় এলাকায় জয়-জয়কার করা হচ্ছে। একই সঙ্গেই বিশেষভাবে সম্মান জানানো হচ্ছে শহিদদের আত্মীয়-স্বজনকেও।
মহানগরীতে সভা-সমিতির একটা বড় আকর্ষণ শহিদের কোনো প্রিয়জনকে উপস্থিত করা। এই রেওয়াজ সামনে রেখে ঢাকার শহরতলিতে একটা মহল্লার অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপিতে জানানো হয়েছিল সভায় রহমানের মা উপস্থিত থাকবেন। ৭১-এর ২৬শে মার্চের রাতে মহল্লার চব্বিশ পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলে আবদুর রহমান ইয়াহিয়া খানের সাঁজোয়া বাহিনীর বিশাল ঢলের সামনে রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বড় রাস্তার ভাঙাচোরা নানারকম জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি একটা ব্যারিকেডের পেছনে। বলা বাহুল্য, প্রাণ দিয়েছিল। তার প্রৌঢ় মাকে এতদিন মহল্লার সবাই চুপি চুপি সান্ত্বনা জানিয়ে আসছিল। স্বাধীনতার পরে আর সান্ত্বনা নয়। এবার সম্মান বীরের মা হিসেবে পাওনা ।
একটা স্কুলবাড়ির আঙিনায় চেয়ার পেতে সভা । স্কুলের বারান্দায় মঞ্চ। তার সামনের চেয়ারগুলোতে মহল্লার গণ্যমান্য পুরুষেরা। মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে একজন নামকরা লোকের চেয়ারের পাশে সভাপতির চেয়ার, তার পাশেই রহমানের মায়ের জন্য চেয়ার। মঞ্চে টেবিলে একটা সদ্য ধোয়া সুজনির ওপর হারমোনিয়াম আর ফুলদানি। মহল্লার যে সব জোয়ান ছেলে রহমানের সঙ্গে একত্রে নানা রকম সামাজিক রাজনৈতিক কাজ করেছে, তারা ঘোরাফেরা করছে। উনিশ-কুড়ি বছরের দুটি মেয়ে রয়েছে এদের সঙ্গে।

সভা শুরু হলো। মহল্লার একজন বৃদ্ধ কোরআন থেকে পাঠ করলেন। এরপর ‘জাতীয় সংগীত’ সোনার বাংলা গাইলো স্কুলের ছেলেমেয়েরা। সভাপতি ঘোষণা করলেন রহমানের মা আসছেন । সবাই দেখলো কয়েকজন যুবক ছেলের আগুপিছুতে রহমানের মা সভায় ঢুকছেন। একঝলকেই সবাই দেখলো তাঁকে। আপাদমস্তক বোরকায় মোড়া। পায়ে পাতলা চটি, তাদের মধ্যে শীর্ণ দুটি পা। বোরকার বাইরে দুদিকে দুটি নিরলঙ্কার হাত মাঝে মাঝে রহমানের সাথী যুবক ছেলেদের কাঁধে ভর করা । গতি ক্ষিপ্র, বারান্দায় উঠলেন কয়েক লহমার মধ্যে আঙ্গিনায় ঠাসাঠাসি করে বসানো চেয়ারের ফাঁকগুলোকে পেরিয়ে। তাঁকে তরুণীরা চেয়ারে বসিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। প্রধান অতিথি ভাষণ দিলেন সমস্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শহিদ আবদুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে । সভাপতি মহল্লার বনেদী সমস্ত বাসিন্দার পক্ষ থেকে রহমানের মায়ের গৌরবের কথা বললেন একবারে ঘরোয়া ভাষায় ।
বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা রহমানের মা কাঠের পুতুলের মতো চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসে বক্তৃতা শুনলেন। ডান হাতে ধরা রইল মুখের ওপর দুচোখের দুটো ছ্যাঁদাওয়ালা আবরণীর ফালিটি। এরপরে যথারীতি গান ও কবিতা আবৃত্তি হলো। আবদুর রহমানের যুবক সাথীরা দুচার কথা বলে চাচি আম্মাকে সান্ত্বনা জানালো । অবশেষে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হলো রহমানের মাকে
রহমানের মা কোনরকম ভূমিকা না করে বললেন, “রহমাইন্যা চাইছিল দ্যাশটারে স্বাধীন করতে। দ্যাশ স্বাধীন হইছে। এহন আপনারা দ্যাশের দশজনে যদি দ্যাশের মাইনষেরে খাওন পরন থাকন দিবার পারেন, তাইলে আপনারা আপনেগো কাম করবেন। মহল্লার মাইয়্যা ছ্যাওয়ালগো লেহাপড়া শিখানোর এই ইস্কুলটার লাইগ্যা রহমান খাটছে। এই ইস্কুলটা যেন থাহে। আমি আমার রহমাইনারে দিছি। অরে কোলে কইরা বেওয়া হইছিলাম। এতটা ডাগর করছিলাম। আমার আর কিছু নাই । তবু কই । দ্যাশের লাইগ্যা যদি কাজে ডাকেন, আমু । আমি শহিদের মা। আমি রহমানের মা।”
হাততালিতে সভা জমজমাট হয়ে উঠল। এরপরেই রহমানের মা একটা অঘটন ঘটালেন । তিনি তাঁর মুখের ওপর নেমে আসা বোরকার একফালি আবরণীকে এক ঝটকায় মাথার ওপর তুলে দিয়ে সমস্ত সভার দিকে দৃপ্ত নয়নে তাকালেন। তাঁর দারিদ্র্য ও শোকে-দুঃখে শীর্ণ মুখখানিতে অপূর্ব গর্বের দীপ্তি। মহল্লার প্রবীণতমদেরও প্রতি তিনি আজ আর সংকোচ পোষণ করলেন না ৷ পরমূহূর্তেই তিনি তাঁর পাশের তরুণী দুটিকে দুহাতে টেনে নিয়ে বারান্দা থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে কয়েক লহমার মধ্যে ঠাসাঠাসি চেয়ার আর লোক ভেদ করে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুখের আবরণীটি মাথার ওপরেই তোলা রইল ।
 

 

 

Content added By

রণেশ দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের ১২ই জানুয়ারি ঢাকার লৌহজং-এর গাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি জীবনানন্দ দাশের নিকট-আত্মীয় ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তরুণ বয়স থেকেই মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন। এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গঠিত “ঢাকা’ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ'-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে ঢাকার 'পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি'র তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৩ই মার্চ গ্রেফতার হন। পাকিস্তানবিরোধী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি অনেকবার কারাবরণ করেন। সাহিত্য-চর্চায়ও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে, আলো দিয়ে আলো জ্বালা, উপন্যাসের শিল্পরূপ ইত্যাদি । ১৯৯৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

খুনেরা- যারা হত্যা করার জন্য প্রস্তুত। কঙ্কাল— দেহের অভ্যন্তরস্থ অস্থি। করোটি-মাথার খুলি। অঙ্গার - কয়লা। মহল্লা - শহর বা নগরের অংশ।

প্রৌঢ়— যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যবর্তী বয়সপ্রাপ্ত। সুজনি— শয্যার জন্য নক্শা করা বিশেষ চাদর। আপাদমস্তক- পা থেকে মাথা পর্যন্ত।

নিরলঙ্কার হাত-যে হাতে অলঙ্কার পরা নেই। লহমার—মুহূর্তের। আবরণী- এখানে মুখ ঢেকে রাখার বস্ত্রখণ্ড বোঝানো হয়েছে।

Content added By

গল্পটি রণেশ দাশগুপ্তের রহমানের মা ও অন্যান্য গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। বয়স্কা রহমানের মা-ও অংশগ্রহণ করেন। নিজপুত্র রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি এই মহৎকর্মে অংশ নেন ।পরবর্তীকালে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গৃহের অভ্যন্তরে থাকা রহমানের মা প্রকাশ্যে আসেন। তিনি সবার উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্বাধীন দেশে দেশগড়ায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। নারীশিক্ষার জন্য নারী-বিদ্যালয় অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশের জন্য, প্রয়োজন হলে, এই অধিক বয়সেও যে-কোনো কাজ করতে তিনি প্রস্তুত। শেষে রহমানের মা গৃহের অভ্যন্তরে আর ফিরে না গিয়ে মিশে গেলেন জনতার সঙ্গে। চমৎকার এই গল্পটিতে উপস্থাপিত হয়েছে এক শহিদ জননীর সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও দেশপ্রেম । এ গল্পের ভাববস্তু হলো: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ অর্জিত হয়েছে, কিন্তু উন্নয়নমূলক কাজ করে প্রতিনিয়ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

Content added By

প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সব সংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদযাপনের প্রথা প্রচলিত আছে। অবশ্য উদ্যাপনের রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি-প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবু সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হলো নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরানো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি । টেনিসন যখন বলেন :
রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ, রিং, হ্যাপি বেলস্ এ্যাক্রস দি স্নো : দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো, রিং আউট দি ফল্স, রিং ইন দি ট্রু ॥
তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি । কবি রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন :
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক ॥ যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
যাক পুরাতন স্মৃতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক ॥
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
রসের আবেশরাশি
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা । শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ ৷
মায়ার কুজ্‌ঝটিজাল যাক দূরে যাক ।।

তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি। একজন বলেছেন, পয়লা জানুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে, আরেকজন লিখেছেন পয়লা বৈশাখকে মনের মধ্যে রেখে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবটি উভয়ক্ষেত্রেই এক।
পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব, তার অন্যতম জাতীয় উৎসব। এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও গৌরবমণ্ডিত। অবশ্য কালের যাত্রাপথ ধরে এর উদযাপন রীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে, বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন মাত্রিকতা অর্জন করেছে। সুদূর অতীতে এর সঙ্গে কৃষি সমাজের যোগসূত্র ছিল অবিচ্ছেদ্য। প্রাচীন কৃষিসমাজের শীতকালীন নির্জীবতার পর নবজীবনের আবির্ভাবের ধারণার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টি সম্পর্কিত ছিল, একথা ভাবা অসঙ্গত নয় । এক সময় গ্রাম- নগর নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিষ্টান হোক, বাংলা নববর্ষের উৎসবে সোৎসাহে যোগ দিত। পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব, মেলা ও প্রদর্শনী মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবমণ্ডিত হয়ে উঠত। সাড়ে তিনশ' বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের নওরোজ বলে উল্লেখ করেছেন । অবশ্য তারও বহু শতবর্ষ আগে থেকে বাংলার মানুষ নানাভাবে এই দিনটি পালন করে আসছে।
কিন্তু পালা বদলের কথা বলছিলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোর এক পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এদেশের শোষিত ও পরশাসিত জনগণের চিত্তে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল, যদিও সে সময়কার মুসলিম মানসে এর কোনো গভীর বা প্রত্যক্ষ অভিঘাত লক্ষ করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে অবলম্বন করে তার জাতীয়তাবাদী অনুষঙ্গের সঙ্গে যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা যুক্ত হয়েছিল, একটু লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন নিয়ে তৎকালীন নয়া উপনিবেশবাদী, ক্ষীণদৃষ্টি, ধর্মান্ধ, পাকিস্তানি শাসকবর্গ যে মনোভাব প্রদর্শন করেন তা একইসঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক ও ন্যক্কারজনক । তখন এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে একটি প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে পরম উৎসাহ ভরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনাকে তুলে ধরেছে, তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ঘোষণা করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দিনটি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা ও মিঠাই বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই। তার পাশাপাশি আছে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও মেলার আসর, সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভা, বক্তৃতা- ভাষণ ইত্যাদি। তবে যে গ্রামবাংলা ছিল পয়লা বৈশাখের আনন্দানুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র, আজ অর্থনৈতিক কারণে শহরে, বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকায়, পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ-উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই মেকি একথা বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড়ো অংশ কাজ করছে সেকথা মানতেই হবে ।পয়লা বৈশাখকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের আন্তরসত্তার সঙ্গে এর রাখিবন্ধনকে আবার নতুন করে বাঁধতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমাদের আজ বাংলা নববর্ষের মধ্যে সচেতনভাবে নতুন মাত্রিকতা যোগ করতে হবে। বাংলা নববর্ষের উৎসব যে বিশেষভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উৎসব, এর একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র যে অত্যন্ত তাৎপর্যময় আজ সেকথাটা আবার জোরের সঙ্গে বলা চাই। নিজেকে একবার একজন হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন, তাহলেই এর শভিনিস্টিক দিকটি বুঝতে পারবেন। অথচ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য তো তা নয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির সামনে স্বাধীন বাঙলার সূর্য ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিরাজদ্দৌলা শেষবারের মতো লড়াই করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয়কে। আমাদের ঐতিহ্য তো মীর মদন ও মোহন লালের, তিতুমীর ও মঙ্গল পাণ্ডের, গোবিন্দ দেব ও মুনীর চৌধুরীর । তবে কেন এখন এরকম ঘটছে? পাকিস্তানি আমলের ধর্মের নামে নৃশংসতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক, এই হোক আমাদের শুভ কামনা। জয় পয়লা বৈশাখ।

Content added By

কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা আবদুল হালিম চৌধুরী ও মাতা আফিয়া বেগম। কবীর চৌধুরী ১৯৩৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেন। চাকরি ও অধ্যাপনা করে তাঁর কর্মজীবন শেষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি শিক্ষাবিদ প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা : ছয় সঙ্গী, প্রাচীন ইংরেজি কাব্য সাহিত্য, আধুনিক মার্কিন সাহিত্য, সাহিত্য কোষ, স্তদাল থেকে প্রস্ত, পুশকিন ও অন্যান্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ চর্চা, ছোটদের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, ছবি কথা সুর, শহিদের প্রতীক্ষায়। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। কবীর চৌধুরী ২০১১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।

Content added By

নির্জীবতা- প্রাণশূন্যতা, এখানে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী সময়। সোৎসাহ- উৎসাহের সঙ্গে, আগ্রহ সহকারে। গৌরবমণ্ডিত- মহিমাময়, মর্যাদাপূর্ণ।

নওরোজ- নতুন দিন। পারস্য দেশের নিয়ম অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিন। স্বাদেশিকতা—নিজের দেশের প্রতি প্রেম বোঝানো হয়েছে।

জাতীয়তা— স্বজাতিচেতনা সংক্রান্ত। প্রত্যক্ষ অভিঘাত- সরাসরি আঘাত, এখানে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদ- পররাজ্যের ওপর কর্তৃত্ববিস্তাররূপ রাজনৈতিক কূটকৌশল।

উপনিবেশ— জীবিকা নির্বাহের জন্য অথবা স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য দলবদ্ধভাবে বিদেশে যে বসতি স্থাপন করা হয়। ক্ষীণদৃষ্টি— সংকীর্ণ দৃষ্টি।

কৌতূহলোদ্দীপক— যাতে কোনো অজানা বিষয় জানার আগ্রহ বাড়ে। ন্যক্কারজনক— অত্যন্ত নিন্দনীয়, ধিক্কারজনক। হালখাতা— নতুন বছরের হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন খাতা খোলার উৎসব।

বুর্জোয়া বিলাস - মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের শখ। রাখিবন্ধন— শ্রাবণ পূর্ণিমায় প্রিয়জনের ডান হাতে মঙ্গল কামনায় রাখি বেঁধে দেওয়ার উৎসব।

শভিনিস্টিক- আত্মগৌরব মতবাদী ।

Content added By

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত (২০০৮) বাংলাদেশের উৎসব : নববর্ষ নামক গ্রন্থ থেকে রচনাটি সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মোবারক হোসেন। বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উৎসব। কৃষি-নির্ভর এদেশে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ধারণা তৈরি হয়। এ উৎসব শুধু হিন্দুর বা মুসলমানদের কিংবা বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের নয়-এ উৎসব সমগ্র বাঙালির। এ উৎসব শুধু বিত্তবান, মধ্যবিত্ত বা দীন দরিদ্র কৃষকের নয়- এ উৎসব বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী সমস্ত মানুষের। ধর্মীয় সংকীর্ণতার বৃত্ত অতিক্রম করে বাংলা নববর্ষ উৎসব আজ আমাদের জাতীয় চৈতন্যের ধারক- এ অভিমত ব্যক্ত করে লেখক প্রবন্ধটিতে পয়লা বৈশাখের জয়গান গেয়েছেন। ‘পয়লা বৈশাখ' প্রবন্ধটি বাংলাদেশের উৎসব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেবার পাশাপাশি ধর্ম ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ জাতীয় ঐক্যবোধে মিলিত হবার শিক্ষা দেয়।

Content added By

নতুন চাকরি পেয়ে কলকাতা এসেছি। সম্পূর্ণ অস্থায়ী চাকরি। যে-কোনো সময়ে, বিনা-কারণে ও বিনা নোটিশে বরখাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। নিয়োগপত্রে এসব শর্ত দেখেও ঘাবড়াইনি একটুও। বন-বিভাগে চাকরি করতাম ষাট টাকায় এখানে পাব একশো তিরিশ টাকা । দ্বিগুণেরও বেশি। এমন সুবর্ণ সুযোগ কোনো নির্বোধ পায়ে ঠেলে দেয় বলে আমার মনে হয় না। আর যাই হোক, আমি দুপায়ে হাঁটি। জঙ্গলে যারা চার পায়ে হাঁটে, তাঁদের পরিবেশে থেকে আমার বুদ্ধিটা লোপ পেয়ে যায়নি। সত্তর টাকা বেশি পাব— এ কি যেমন- তেমন ব্যাপার! বিয়ে করেছি অল্পদিন। এখন দ্বিগুণ টাকারই দরকার। তাছাড়া জঙ্গল ছেড়ে এসেছি শহরে, হিংসালয় ছেড়ে লোকালয়ে, আঁধার আলোকে । এরকম সভ্যসমাজে আসাটাও একটা মস্ত লাভ । ছেড়ে
চাকরিতে যোগ দিয়েছি গতকাল। আজ দ্বিতীয় দিন, বৃহস্পতিবার। ন'টা না বাজতেই খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি । মেসের খাওয়া। কী খেলাম বলব না, বলতে লজ্জা করে । তাছাড়া খাওয়াটা গৌণকর্ম, নেহায়েতই রান্নাঘরের ব্যাপার । যা মুখ্য তা হচ্ছে আমাদের পোশাক । সাজ-পোশাকই আমাদের সভ্যতার মাপকাঠি কোনোরকমে শাকভাত খেয়ে বেঁচে থাকলেও এ-দেহকে দুরস্ত খোলসে ঢেকে ভদ্রলোক সাজতেই হবে। তাছাড়া উপায় নেই ভদ্রসমাজে বের হওয়ার। আমাদের মতো খুদে অফিসারদের ব্যাপার আরো জটিল । কোট-প্যান্ট পরে, টাই বেঁধে দুরস্ত হওয়া চাই, নয়তো ওপরওয়ালা সায়েবদের সুনজর হবে না কোনোদিন। তাঁদের কথা : ঘোড়ায় চড়ে না হোক, গাধায় চড়েও কেন আমরা তাদের অনুসরণ করব না? অফিসে তাই অনুকরণ ও অনুসরণের প্রতিযোগিতা বেশ উপভোগের হয়ে দাঁড়ায়।
মেসের এক সদস্যের সাহায্য নিয়ে গলগ্রন্থিটা কোনোরকমে বেঁধে কোটটা গায়ে চড়িয়ে দিই । আয়নায় মুখ দেখে ভালো লাগে না। দাড়িগুলোর কালো মাথা দেখা যাচ্ছে। অথচ গতকালই দাড়ি কামিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি সেফটি রেজার বের করে ঐ অবস্থায়ই কয়েক পোঁচ টেনে নিই । কিন্তু শার্টের কলারটায় সাবানের ফেনা লেগে যায়। তোয়ালে দিয়ে সেটা মুছে চুলে চিরুনি চালাই আর-একবার। তারপর জুতোজোড়া পায়ে ঢুকিয়ে আর একদফা আয়নায় মুখ দেখে বেরিয়ে পড়ি।
ন'টা বাজে। পথ সংক্ষেপ করতে গিয়ে একটা ছোট্ট গলিতে ঢুকি। গলি নয় ঠিক। দুই দেয়ালের মাঝখান দিয়ে সরুপথ। গা বাঁচিয়ে একজন যেতে পারে কোনোমতে। মাঝপথে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে হয় আমাকে । একজন বুড়ো ভদ্রলোক আসছিলেন ওদিক থেকে । দেহের

আয়তন তার নিতান্ত ছোটো নয় । তাই কোলাকুলিটা হয়ে যায় ভালোভাবেই। তারপর একজন, আরো এক, আরো একজন। কোলাকুলি সেরে বেরিয়ে যান তারা। কোলাকুলিটা যদিও সকলের সঙ্গে সমান জমে না, তবুও মনে হয় মানুষে মানুষে হানাহানির এ সময়টায় অজানা-অচেনায় এরকম কোলাকুলি বড় দুর্লভ ।
আর মাত্র কয়েক কদম পার হলেই বড় রাস্তা। দেয়াল ছেড়ে সবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি, দেখি এক ভদ্রমহিলা গলিটায় ঢুকে পড়েছেন। আমার সামান্য কয়েক কদমের পথটুকু পার হবার সুযোগ না দিয়ে এগিয়েই আসছেন তিনি। এবার আর উপায় নেই। তাড়াতাড়ি পিছু হেঁটে শেষটায় উপায় করতে হয় আমাকেই ।
দেয়ালে ঠেস্ দেওয়ায় শ্যাওলা লেগেছিল কোটে। রুমাল বের করে ঝেড়ে আমার পথ দেখি আমি । এবার আর সোজাপথে নয়। সোজাপথটাই দেখছি কঠিন বেশি। বেনেপুকুর লেন ঘুরে লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে ইলিয়ট রোডের মোড়ে এসে দাঁড়াই ।
ধর্মঘটের জন্যে ট্রাম বন্ধ। আমাকে যেতে হবে ৮ নম্বর বাসে। এক এক করে কয়েকটা বাস চলে যায়। কতবার হাতল ধরতে গিয়ে পিছিয়ে যাই। সাহসে কুলোয় না। লোকসব বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। নিরাশ হবার পাত্র আমি নই । দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি অন্তত একটা পা রাখবার জায়গাও যদি মিলে যায় ।
একটা বাস এসে থামে। পা রাখবার জায়গা নেই। তবুও সব লোক ছুটোছুটি করছে, কে কার আগে উঠবে। চাকরি ঠিক রাখার কী প্রাণান্ত চেষ্টা। একটা লোক নেমে যায় ড্রাইভারের কুঠরি থেকে। মহাসুযোগ! পাশের কয়েকজনকে টেক্কামেরে চট করে উঠে পড়ি আমি। চাকরি গেলে আমার চলবে না । হঠাৎ আমার বুকে ধাক্কা মেরে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মানুষ, না জানোয়ার !
লোকটা কি গণক নাকি! গণকের মতো ঠিকই তো বলেছে সে! আমি জঙ্গলেই তো ছিলাম অ্যাদ্দিন! লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু সাহস হয় না। ঘাড়টা নুইয়ে গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মেশামেশিটা আগের কোলাকুলির মতো প্রীতিকর হয় না। আমি শেষে ঢুকে অনেকের অসুবিধে করেছি। ঠেলা ধাক্কাটা তাই আমার দিকেই আসছে বেশি করে। পাঁজরের হাড়গুলো চাপ খেতে খেতে ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে। আর দেরি নয়। পরের স্টপে থামতেই আমি নেমে যাই ।
এতক্ষণ দম বন্ধ হয়েছিল যেন। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসকে সজীব করে নিই খোলা বাতাসে । স্যুটটার দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। ভেতরের ঘামে আর ওপরের ঘষায় ইস্ত্রি ভেঙে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এবার পাদুটোকে সম্বল করেই ছুটব ঠিক করলাম ।
কলকাতা এসেছিলাম অনেকদিন আগে একবার। পথ-ঘাট ভালো মনে নেই। পথ চেয়ে পথ চলি । কিন্তু তার চেয়েও বেশি চেয়ে দেখতে হয় পথচারীদের পোশাকের দিকে। এই পোশাক ছাড়া কার কী ধর্ম জানবার উপায় নেই। কারণ ধর্মের কথা গায়ে কিছু লেখা থাকে না। সব ধর্মাপরাধীদের চেহারাই মানুষের চেহারা। আমার চেহারা দেখে কিন্তু কারো বুঝবার যো নেই, আমার ধর্ম কী । কারণ আমার মানুষের শরীরটাকে আন্তঃধার্মিক পোশাকে ঢেকে নিয়েছি । তাই বলে কি আমি নিরাপদ?

আন্তঃধার্মিক পোশাকে মানুষের চেহারা হলেও যে-কোনো দিকের চাকু খাওয়ার ভয় আছে আমার । মুসলমান মোটেই না। আমার বিপদ বরং বেশি। আমাকে হিন্দু ঠাওরালে, আর হিন্দু মুসলমান ঠাওরালেই হলো!
ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে। মন ইতিমধ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। একশো তিরিশ টাকার চাকরিটার ভার ছেড়ে দিই পাদুটোর ওপর । শুধু তাই নয়, মনের বিরুদ্ধে সমস্ত দেহের ভারটাও ।
এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় পা দিয়ে থমকে দাঁড়াই। কাছাকাছি একটা প্রাণীও দেখছি না যে! বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সুমুখের একটা দোতলা বাড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কয়েকজন কী যেন দেখছে রাস্তার দিকে। ওপর থেকে নিচের দিকে চোখ নামাতেই চোখ ফিরে আসে,পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। চিনতে ভুল হয় না। মানুষ! হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত মানুষ। রক্তের রাঙা স্রোত ড্রেনে গিয়ে মিশেছে । নিমেষে পেছন ঘুরে অন্য পথ ধরি। গাড়ির আওয়াজ পেয়েও তাকাই না ফিরে। কিন্তু কে যেন গর্জে ওঠে, ‘ঠায়রো ।’
দুজন সার্জেন্ট রিভলবার হাতে এগিয়ে আসে। আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে তারা। কিন্তু ফাঁসাতে পারে না। নিয়োগপত্রটা পকেটেই ছিল । সেটা দেখিয়ে রেহাই পেয়ে যাই ।
এবার আরেকটা রাস্তা ধরে হাঁটি। হাঁটি সুমুখে পেছনে চেয়ে। মারটা নাকি পেছন থেকেই আসে। এক একজন লোক চলে যায় পাশ কেটে, মনে হয় এক-একটা ফাঁড়া কেটে যায় আমার । আমার সতর্ক চোখদুটো আড়চোখে তাকায় সবার দিকে। কিন্তু তারাও যে সতর্কদৃষ্টি মেলে আমারই দিকে তাকায়! আমাকে-আমার হাত দুটোকেই বোধহয় তাদের ভয়। তাদের ভীত চাউনি দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আমিও আমার অনুগত হাত দুটো ছাড়া আর কারো হাতকে বিশ্বাস করতে পারি না ।
কিছুদূর আগে ডানদিকে একটা পাশগলি। গলির মুখে তিনটে লোক। তাদের পোশাক দেখে চমকে উঠি। তাদের ভাবগতিকও কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ শুরু হয়েছে। আশেপাশে লোকজন নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণী উঁচু-গোড়ালি জুতো পায়ে আসছে গটগট করে। আমার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় । আমি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যাই। গলির মুখের লোকগুলোকে বোঝাতে চাই, আমি তরুণীটির জন্যেই অপেক্ষা করছি। তারই সাথী আমি। কিন্তু তারা বুঝতে চাইলে হয়। আমার যেরকম গায়ের রঙ! অবশ্য এরকম রঙের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের অভাব নেই কলকাতা শহরে ।
আমার পোশাক দেখে লোকগুলো না হয় আমাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঠাওরাল । কিন্তু তরুণীটিকে কী বোঝাব? আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী মনে করবে সে?
আমি উবু হয়ে বাঁ-পায়ের জুতো খুলি। জুতোর ভেতর কাঁকর ঢুকেছে এমনি ভান করে জুতোটা উপুড় করে ঝেড়ে নিই কয়েকবার। তারপর আবার পায়ে ঢুকাই। তরুণীটি আমার কাছে এসে গেছে। জুতোর ফিতে বাঁধা শেষ করে এবার তার পাশাপাশি চলতে শুরু করি। এখন ঠিক মনে হচ্ছে- রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দম্পতি। অন্যের কী মনে হচ্ছে জানি না। আমার কিন্তু ওরকমই মনে হচ্ছে। এক-পা-দুপা করে গলির মুখ পার হয়ে যাই ।

ফাঁড়া কেটে গেছে। আমার নীরব সঙ্গিনী একবার কটমট করে আমার দিকে তাকায়। তার চোখের দিকে চেয়ে আমার মনটা মিইয়ে যায়। কিন্তু তবুও তার সঙ্গ ছাড়তে ভরসা পাইনে। পাশাপাশি হেঁটে আরো কিছুদূর এগিয়ে যাই। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলে সে,
‘আমার পিছু নিয়েছ কেন ?
‘না-না-।' আমি থতমত খেয়ে যাই ।
‘না মানে! বহুক্ষণ ধরে আমি লক্ষ করছি। পুলিশ ডাকব?
‘না-না, মানে-ইয়ে, মানে গুন্ডার ভয়ে’–
‘গুন্ডার ভয়ে!’
“হ্যাঁ, তাই— তাই আপনার সাথে সাথে এলাম ।’
‘অবাক করলে! এক জোয়ান পুরুষ, তাকে রক্ষা করবে মেয়েমানুষ! আচ্ছা কাপুরুষ তো!' অবজ্ঞার হাসি তরুণীটর মুখে ।
কিছুদূর গিয়ে মহিলা বাঁ-দিকে এক গলিতে ঢুকে পড়ে। আমি মোড় নিই ডানদিকে ।
পাশ থেকে একটা হাত এগিয়ে আসছে না আমার দিকে!
‘উহ্ মাগো” বলে লাফ দিয়ে সরে যাই কয়েক হাত। ফিরে দেখি একজন জটাধারী ফকির হাসছে আমার অবস্থা দেখে। এগিয়ে এসে সে বলে, 'ভয় পেলি নাকি? দুদিন খেতে পাইনি। দুটো পয়সা দে।'
রীতিমতো ঘাম দিয়েছে আমাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। তবু হাতে চাকু না-থাকার জন্যে ফকিরটাকে ধন্যবাদ দিই মনে-মনে আর পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে তার দিকে ছুঁড়ে মারি । চৌরঙ্গী এসে পড়েছি। একটা লোক হঠাৎ আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। বলে, 'ফটো তুলবেন? আসুন। এক টাকায় তিন কপি ৷'
লোকটার কথার জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কিন্তু ভুল হয়ে গেল। মানুষের ভয়ে ভীত মানুষের ফটোটা তুলে রাখা উচিত ছিল আমার ।
হঠাৎ কার স্পর্শে শিউরে উঠি ।
চেয়ে দেখি, আমাদের সুভাষ মুচকি হাসছে। সহপাঠী বন্ধুর আলিঙ্গনে বুকের ভেতরটা যেন ভিজে ওঠে। কিন্তু ওর বুকটা শক্ত লাগল না! জামার ওপর হাত রাখি । তাই তো! সুভাষ হেসে বলে, 'হাত দিয়ে দেখছিস কী?
‘দেখছি, মানে-তোর বুকটা শক্ত লাগছে কেন রে?”
“শক্ত লাগছে হুঁহ্ হুঁ! এ জিনিস দেখিস নি কখনো। লোহার তারের গেঞ্জি। একেবারে নয়া আবিষ্কার । ‘নয়া আবিষ্কার ।’
‘হ্যাঁ, এ বর্ম ভেদ করবে চাকু? উঁহু!
সুভাষের জামার ওপর হাত দিয়ে দিয়ে আঁচ করতে পারি, লোহার তার দিয়ে তৈরি হাতাকাটা গেঞ্জি। মন্দ জিনিস নয় । সহসা আঘাত করে কিছু করতে পারবে না।
আমি হেসে বলি, “কিরে চাকু-টাকু লুকানো নেই তো?”

‘নেই তো কী! নিশ্চয়ই আছে। এক্ষুনি তোর বুকে বসিয়ে দেব। তোর রক্ত দিয়ে ফোঁটা-তিলক কেটে কালীপুজো করব।'
‘এখানে কী করিস?'
‘পড়ি আর্ট স্কুলে।’
‘আর্ট স্কুলে! ঠিক আছে। শোন, তোকে একটা ছবি আঁকতে হবে। মানুষের ভয়ে মানুষের চেহারা কেমন হয়, ফুটিয়ে তুলতে হবে সেছবিতে। পারবি তো?”
“তা দেখব চেষ্টা করে।'
আরো দু-এক কথা বলে বিদেয় হই তাড়াতাড়ি । হেঁটে হেঁটে চৌরঙ্গী পর্যন্ত আসি। কিন্তু পা আর চলে না। চলবার কোনো হেতু নেই যে! ভোরে যা খেয়েছি, আর এ-পর্যন্ত এক পেয়ালা চা-ও না । কার্জন পার্কে বসে পড়ি। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব । ভিড় কমলে বাসেই যাব ।
সাড়ে ছ'টার সময় বাসে একটু জায়গা পাওয়া যায়। পঁ-পঁ করতে করতে বাস ছুটছে। এত ভিড়, বাইরের কিছুই দেখা যায় না। বুঝতে পারছি না, কোন রাস্তা ধরে চলছে গাড়ি । বুম্‌-ম্‌-
আবার বুম্-ম্-
ভীষণ শব্দ। কানে তালা লেগে গেছে। শুনতে পাই না কিছু। শেয়ালের ভয়ে খাঁচার মোরগের মতো করছি আমরা । তারপর কোন দিক দিয়ে কেমন করে বাসখানা চলে এল, অত খেয়াল নেই। কয়েকজনের মুখে শুনলাম, বাসের পাদানির ওপর থেকে দুজনকে দুপেয়ে শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে। আর অনেকের হাত-মুখ নাককান ছিঁড়ে গেছে বোমার আঘাতে।
ঘরের কাছে এসেও আর-একবার শিউরে উঠি। অক্ষত দেহে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে ফিরে এসেছি আমি ।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শিথিল শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় ঢেলে দিই। মানুষের মাঝে একদিন চলেই মুষড়ে পড়েছি আমি । আমার সমস্ত রাগ ঘৃণা আজ মানুষের ওপর । চোখ বুজে ভাবছি- পদত্যাগপত্রটা প্রত্যাহার করার এখনো হয়ত সময় আছে। আমার জন্যে বন-
বিভাগের চাকরিটা ভালো । মানুষ তার মনুষ্যত্ব নিয়ে শহরে থাক। আমি বনে গিয়ে আবার বনমানুষ হব।

Content added By

আবু ইসহাক ১৯২৬ সালের ১লা নভেম্বর শরীয়তপুর জেলার শিরঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাস করার পরই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৩ সালে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। সাহিত্য সাধনায় তিনি স্বীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি গ্রামবাংলার চিত্র এবং সেখানকার সমস্যা অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। এদিক থেকে তাঁর সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসটিকে বাস্তব জীবনের সার্থক চিত্রণের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসটি আমাদের সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপন্যাস-সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো : সূর্যদীঘল বাড়ি, হারেম, মহাপতঙ্গ, পদ্মার পলিদ্বীপ ইত্যাদি। আবু ইসহাক ২০০৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

হিংসালয়- হিংস্র প্রাণীর বাসস্থান। গলগ্রন্থি- গলার বন্ধনী। ছাতলা- শ্যাওলা, দেয়ালে জমা পুরানো ময়লা। অ্যাদ্দিন- এতদিন শব্দের কথ্যরূপ। ঠ্যায়রো- দাঁড়াও।

ঠাওরালো- মনে করল । চৌরঙ্গী- চার রাস্তার মিলনস্থল। কলকাতার একটি স্থানের নাম ।

Content added By

ভারত বিভাগের আগে ১৯৪৬ সালে এ অঞ্চলে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে ‘বনমানুষ' গল্পটি লিখিত। এ গল্পের লেখক বন বিভাগে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। তিনি দ্বিগুণ বেতনে কলকাতায় চাকরি করতে আসেন। কলকাতায় এসে প্রথমে তাঁর নিজেকে সভ্য মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু তিনি তখন সাম্প্রদায়িক হানাহানির মুখোমুখি হতে থাকেন। তিনি দেখেন এ শহরের মানুষেরা ধর্মের নামে পরস্পরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। বনের পশু-পাখিরাও এ রকম পরস্পরকে হত্যা করে না। তখন লেখক আবার বন বিভাগের চাকরিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লেখকের কাছে এ শহরের সভ্য মানুষের চেয়ে বনে বসবাসকারী অশিক্ষিত মূর্খ মানুষকে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়। ‘বনমানুষ' গল্পটি সংকীর্ণ ধর্ম-পরিচয়মুক্ত মানবিক বোধসম্পন্ন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে সহায়তা করে; কারণ ধর্ম নিয়ে মানুষে সংঘাত মানুষ পরিচয়টিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেননা জীব হিসেবে মানুষ অন্য সব প্রাণীর তুলনায় জ্ঞান, বুদ্ধি ও সৃষ্টিশীলতায় শ্রেষ্ঠ ।

Content added By

১৩ই এপ্রিল : মঙ্গলবার ১৯৭১
চারদিন ধরে বৃষ্টি। শনিবার রাতে কি মুষলধারেই যে হলো, রোববার তো দিনভর একটানা গতকাল সকালের পর বৃষ্টি থামলেও সারা দিন আকাশ মেঘলা ছিল । মাঝে মাঝে রোদ দেখা গেছে। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি। জামী ছড়া কাটছিল, ‘রোদ হয় বৃষ্টি হয়, খ্যাঁক-শিয়ালির বিয়ে হয়।' কিন্তু আমার মনে পাষাণভার। এখন সন্ধ্যার পর বৃষ্টি নেই, ঘনঘন মেঘ ডাকছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমার জীবনেও এতদিনে সত্যি সত্যি দুর্যোগের মেঘ ঘন হয়ে আসছে। এই রকম সময়ে করিম এসে ঢুকল ঘরে, সামনে সোফায় বসে বলল, ‘ফুফুজান এ পাড়ার অনেকেই চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। আপনারা কোথাও যাবেন না?'
‘কোথায় যাব? অন্ধ, বুড়ো শ্বশুরকে নিয়ে কেমন করে যাব? কিন্তু এ পাড়া ছেড়ে লোকে যাচ্ছে কেন? এখানে তো কোনো ভয় নেই!”
‘নেই, মানে? পেছনে এত কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো—'
‘হল তো সব খালি, বিরান, যা হবার তা তো প্রথম দুদিনেই হয়ে গেছে । জানো,বাবুদের বাড়িতে তার মামার বাড়ির সবাই এসে উঠেছে শান্তিনগর থেকে?
“তাই নাকি? আমরা তো ভাবছিলাম শান্তিনগরে আমার দুলাভাইয়ের বাসায় যাব।' ‘তাহলেই দেখ— ভয়টা আসলে মনে। শান্তিনগরের মানুষ এলিফ্যান্ট রোডে আসছে মিলিটারির হাত থেকে পালাতে, আবার তুমি এলিফ্যান্ট রোড থেকে শান্তিনগরেই যেতে চাচ্ছ নিরাপত্তার কারণে ।যুক্তিটা বুঝে করিম মাথা নাড়ল, ‘খুব দামি কথা বলেছেন ফুফুজান। আসলে যা কপালে আছে তা হবেই। নইলে দ্যাখেন না, ঢাকার মানুষ খামোকা জিঞ্জিরায় গেল গুলি খেয়ে মরতে। আরো একটা কথা শুনেছেন ফুফুজান? নদীতে নাকি প্রচুর লাশ ভেসে যাচ্ছে। পেছনে হাত বাঁধা, গুলিতে মরা লাশ।'
শিউরে উঠে বললাম, ‘রোজই শুনছি করিম। যেখানেই যাই এছাড়া আর কথা নেই । কয়েকদিন আগে শুনলাম ট্রাকভর্তি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হাত আর চোখ বেঁধে, কতো লোকে দেখেছে। এখন শুনছি সদরঘাট, সোয়ারীঘাটে নাকি দাঁড়ানো যায় না পচা লাশের দুর্গন্ধে। মাছ খাওয়াই বাদ দিয়েছি এজন্যে ।’

১০ই মে : সোমবার ১৯৭১
বেশ কিছুদিন বাগানের দিকে নজর দেওয়া হয় নি। আজ সকালে নাশতা খাবার পর তাই বাগানে গেলাম। বাগানে বেশ কটা হাই-ব্রিড টি-রোজের গাছ আছে। এই ধরনের গোলাপ গাছের খুব বেশি যত্ন করতে হয়— যা গত দুমাসে হয়নি। খুরপি হাতে কাজে লাগার আগে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম । মাখনের মতো রঙের ‘পিস্' অর্থাৎ ‘শান্তি’। কালচে-মেরুর ‘বনি প্রিন্স' আর ‘এনা হার্কনেস । ফিকে ও গাঢ় বেগুনি রঙের ‘সিমোন’ আর ‘ল্যাভেন্ডার।’ হলুদ ‘বুকানিয়ার’, সাদা ‘পাস্কালি' ।
বনি প্রিন্স-এর আধফোটা কলিটি এখনো আমার বেড-সাইড টেবিলে কালিদানিতে রয়েছে। কলি অবশ্য আর নেই, ফুটে গেছে এবং প্রায় ঝরে পড়ার অবস্থা। ‘পিস'-এর গাছটায় একটা কলি কেবল এসেছে— যদিও সারাদেশ থেকে ‘পিস' উধাও ।
বাগান করা একটা নেশা। এ নেশায় দুঃখ-কষ্ট খানিকক্ষণ ভুলে থাকা যায়। গত কয়েক মাস ধরে নেশাটার কথা ভাববারই অবকাশ পাই নি। এখন ভয়ানক বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার গরজেই বোধ করি নেশাটার কথা আমার মনে পড়েছে।
১২ই মে : বুধবার ১৯৭১
জামীর স্কুল খুলেছে দিন দুই হলো। সরকার এখন স্কুল-কলেজ জোর করে খোলার ব্যবস্থা করছে। এক তারিখে প্রাইমারি স্কুল খোলার হুকুম হয়েছে, নয় তারিখে মাধ্যমিক স্কুল।
জামী স্কুলে যাচ্ছে না । যাবে না। শরীফ, আমি, রুমী, জামী- চারজনে বসে আলাপ-আলোচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্কুল খুললেও স্কুলে যাওয়া হবে না। দেশে কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা। দেশবাসীর ওপর হানাদার পাকিস্তানি জানোয়ারদের চলছে নির্মম নিষ্পেষণের স্টিমরোলার। এই অবস্থায় কোনো ছাত্রের উচিত নয় বই-খাতা বগলে স্কুলে যাওয়া।
জামী অবশ্য বাড়িতে পড়াশোনা করছে। এবার ও দশম শ্রেণির ছাত্র। রুমী যতদিন আছে, ওকে
সাহায্য করবে। তারপর শরীফ আর আমি- যে যতটা পারি ।
জামী তার দু-তিনজন বন্ধুর সাথে ঠিক করেছে—ওরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে পড়াশোনা করবে। এটা বেশ ভালো ব্যবস্থা, পড়াও হবে, সময়টাও ভালো কাটবে। অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় ওরা হাঁপিয়ে উঠবে না ।

১৭ই মে : সোমবার ১৯৭১
রেডিও-টিভিতে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে প্রোগ্রাম করিয়েও ‘কর্তাদের’ তেমন সুবিধা হচ্ছে না বোধ হয়! তাই এখন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের ধরে ধরে তাদের দিয়ে খবরের কাগজে বিবৃতি দেওয়ানোর কূটকৌশল শুরু হয়েছে। আজকের কাগজে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নাম দিয়ে এক বিবৃতি বেরিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো টিচার, রেডিও-টিভির কোনো কর্মকর্তা ও শিল্পীর নাম বাদ গেছে বলে মনে হচ্ছে না। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সানন্দে এবং সাগ্রহে সই দিলেও বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী যে বেয়নেটের মুখে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আর যে বিবৃতি তাদের নামে বেরিয়েছে, সেটা যে তাঁরা অনেকে না দেখেই সই করতে বাধ্য হয়েছেন, তাতেও আমার সন্দেহ নেই। আজ সকালের কাগজে বিবৃতিটি প্রথমবারের মতো পড়ে তাঁরা নিশ্চয় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইবেন খানিকক্ষণ! এবং বলবেন, ধরণী দ্বিধা হও! এরকম নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণে ভরা বিবৃতি স্বয়ং গোয়েবলসও লিখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। এই পূর্ব বাংলার কোন প্রতিভাধর বিবৃতিটি তৈরি করেছেন, জানতে বড়ো ইচ্ছে হচ্ছে।

২৫ শে মে : মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। বেশ শান-শওকতের সঙ্গে পালিত হচ্ছে ঢাকায়। এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠান করছে। সন্ধ্যার পর টিভির সামনে বসেছিলাম, জামী সিঁড়ির মাথা থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকল, ‘মা শিগগির এস। নতুন প্রোগ্রাম ।’
দৌড়ে ওপরে গেলাম, স্বাধীন বাংলা বেতারে বাংলা সংবাদ পাঠ করছে নতুন এক কণ্ঠস্বর। খানিক শোনার পর চেনা চেনা ঠেকল কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না। সালেহ আহমদ নামটা আগে কখনো শুনি নি। রুমী বলল, “নিশ্চয় ছদ্মনাম।' বললাম, ‘হতে পারে। তবে ঢাকারই লোক এ । এই ঢাকাতেই এই গলা শুনেছি। হয় নাটক, নয় আবৃত্তি।’
এইসব গবেষণা করতে করতে বাংলা সংবাদপাঠ শেষ ।
আজকের প্রোগ্রামেও বেশ নতুনত্ব। কণ্ঠস্বরও সবই নতুন শুনছি। একজন একটা কথিকা পড়লেন - চরমপত্র। বেশ মজা লাগল শুনতে, শুদ্ধ ভাষায় বলতে বলতে হঠাৎ শেষের দিকে এক্কেবারে খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষাতে দুটো লাইন বলে শেষ করলেন।
অদ্ভুত তো। কিন্তু এখানে আলটিমেটামের মতো কিছু তো বোঝা গেল না ।
শরীফ বলল, ‘ঐ যে বলল না একবার যখন এ দেশের কাদায় পা ডুবিয়েছ, আর রক্ষে নেই । গাজুরিয়া মাইরের চোটে মরে কাদার মধ্যে শুয়ে থাকতে হবে, এটা আলটিমেটাম।' ‘কি জানি ৷’
জামী জানতে চাইল, ‘গাজুরিয়া মাইর কি জিনিস?”
রুমী বলল, ‘জানি না । আমার ঢাকাইয়া বন্ধু কাউকে জিগ্যেস করে নেব।'ঐ যে মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতার কথা বলল- ঢাকার ছ’জায়গায় গ্রেনেড ফেটেছে, আমরা তো সাত আটদিন আগে এ রকম বোমা ফাটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করি নি। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি? আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি! সত্যি সত্যি তাহলে ঢাকার আনাচে-কানাচে মুক্তিফৌজের গেরিলারা প্রতিঘাতের ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে শুরু করেছে?
এতদিন জানছিলাম বর্ডারঘেঁষা অঞ্চলগুলোতেই গেরিলা তৎপরতা। এখন তাহলে খোদ ঢাকাতেও? মুক্তিফৌজ! কথাটা এত ভারী যে এই রকম অত্যাচারী সৈন্য দিয়ে ঘেরা অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে মুক্তিফৌজ শব্দটা শুনলেও কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার ঐ অবিশ্বাসের ভেতর থেকে একটা আশা, একটা ভরসার ভাব ধীরে ধীরে মনের কোণে জেগে উঠতে থাকে ।

৫ই সেপ্টেম্বর : রবিবার ১৯৭১
একটা কঠিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে গত দুদিন থেকে শরীফ আর আমি খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি । রুমীকে কি করে বের করে আনা যায়, তা নিয়ে শরীফের বন্ধুবান্ধব নানারকম চিন্তাভাবনা করছে। এর মধ্যে বাঁকা আর ফকিরের মত হলো : যে কোনো প্রকারে রুমীকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। বাঁকা আর ফকির মনে করছে— শরীফকে দিয়ে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে একটা মার্সি পিটিশন করিয়ে তদবির করলে রুমী হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতেও পারে।
রুমীর শোকে আমি প্রথম চোটে ‘তাই করা হোক' বলেছিলাম। কিন্তু শরীফ রাজি হতে পারছে না। যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমী সেটা মোটেও পছন্দ করবে না এবং রুমী তাহলে আমাদের কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। বাঁকা ও ফকির অনেকভাবে শরীফকে বুঝিয়েছে— ছেলের প্রাণটা আগে। রুমীর মতো এমন অসাধারণ মেধাবী ছেলের প্রাণ বাঁচলে দেশেরও মঙ্গল। কিন্তু শরীফ তবু মত দিতে পারছে না । খুনি সরকারের কাছে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে দয়াভিক্ষা করা মানেই রুমীর আদর্শকে অপমান করা, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট করা। গত দুরাত শরীফ ঘুমোয় নি, আমি একবার বলেছি, ‘তোমার কথাই ঠিক। ঐ খুনী সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করা যায় না।' আবার খানিক পরে কেঁদে আকুল হয়ে বলেছি, ‘না, মার্সি পিটিশন করে ৷
এইভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেটেছে দুদিন দুরাত । শেষ পর্যন্ত শরীফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- না, মার্সি পিটিশন সে করবে না। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমিও শরীফের মতকে সমর্থন করেছি। রুমীকে অন্যভাবে বের করে আনার যতরকম চেষ্টা আছে, সব করা হবে; কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয় ।

১১ই অক্টোবর : সোমবার ১৯৭১
শরীফ বলল, ‘সেই যে মাস খানেক আগে কাগজে পড়েছিলাম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের
কথা, তার সম্বন্ধে আজ শুনে এলাম ।' “কী শুনে এলে? কোথায় শুনলে ?
‘ডা. রাব্বির কাছে। রাব্বি- জানো তো, আমাদের সুজার ভাস্তে ।'
শরীফের এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু সুজা সাহেব, তাঁর ভাস্তে ডা. ফজলে রাব্বি ।শরীফ বলল, ‘আজ ফকিরের অফিসে গেছিলাম, ওখানে রাব্বির সঙ্গে দেখা। ওর মুখেই শুনলাম মতিয়ুর রহমানের ফ্যামিলি ২৯ সেপ্টেম্বর করাচি থেকে ঢাকা এসেছে। মতিয়ুর রহমানের শ্বশুর গুলশানের এক বাড়িতে থাকেন। সেইখানে ৩০ তারিখে মতিয়ুরের চল্লিশা হয়েছে। রাব্বি গিয়েছিল চল্লিশায়। মিসেস মতিয়ুর নাকি বাংলা বিভাগের মনিরুজ্জামানের শালী ।'
‘আমাদের স্যার মনিরুজ্জামানের? তার মানে ডলির বোন? দাঁড়াও, দাঁড়াও— এই বোনকে তো দেখেছি ডলিদের বাসায়- মিলি এর নাম। '
ডলির কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ডলি, মনিরুজ্জামান স্যার, ওদের কোনো খোঁজই জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে কোথায় যে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে- কে জানে। ওপারেও যায় নি, গেলে বেতারে নিশ্চয় গলা শুনতে পেতাম। স্বাধীন বাংলা বেতারে বহু পরিচিতজনের গলা শুনি, তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে, কিন্তু গলা শুনে চিনতে পারি। প্রথম যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে সালেহ আহমদের কণ্ঠে খবর শুনি, খুব চেনা চেনা লেগেছিল, দু একদিন পরেই চিনেছিলাম- সে কণ্ঠ হাসান ইমামের ইংরেজি খবর ও ভাষ্য প্রচার করে যারা, সেই আবু মোহাম্মদ আলী ও আহমেদ চৌধুরী হলো আলী যাকের আর আলমগীর কবির। গায়কদের গলা তো সহজেই চেনা যায়- রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল জব্বার, অজিত রায়, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, হরলাল রায়। কথিকায় সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসান, ফয়েজ আহমদ প্রায় সকলেরই গলা শুনে বুঝতে পারি। নাটকে রাজু আহমেদ, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়— এদের সবার গলাই এক লহমায় বুঝে যাই ।

১৬ই ডিসেম্বর : বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ সকাল নটা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ-বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেলে তিনটে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাকিস্তানি আর্মি নাকি সারেন্ডার করবে বিকেলে । সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এলো সবার মুখেই এক কথা। দলে দলে লোক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে। পাকিস্তানি সেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে। পালাতে পালাতে পথেঘাটে এলোপাথাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন । বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময় বেপরোয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লোক জখম করেছে।
মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।'
আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে আসতে। এ.কে.খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে।
জেনারেল নিয়াজী তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল ৪টা ৩১
মিনিটে। যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব? আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য । মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন ।রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মসলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম ।

Content added By

জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩রা মে মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল আলী। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। জাহানারা ইমাম ১৯৪৭ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড ও বাংলায় এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রথম সন্তান রুমী যোগদান করেন। রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে জাহানারা ইমাম সহযোগিতা করেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্যের জোগান, গাড়িতে অস্ত্র আনা-নেওয়া এবং তা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেওয়া, খবর আদান-প্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে তিনি সর্বান্তকরণে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষদিকে রুমী শহিদ হন। জাহানারা ইমাম হন আমাদের শহিদ জননী। মুক্তিযুদ্ধের ওপর স্মৃতিচারণমূলক তাঁর অসাধারণ গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি সর্বত্র সমাদৃত। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো : গজকচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনগুলি ইত্যাদি। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। একাত্তরের ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের শাস্তির দাবিতে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন এই মহীয়সী নারী পরলোকগমন করেন ।

Content added By

জামী - লেখিকার ছোট ছেলে। বিরান— জনমানবহীন, পরিত্যক্ত, ফাঁকা। খুরপি- মাটি খোঁড়ার জন্য ব্যবহৃত একপ্রকার ছোট খন্তা। শরীফ- লেখিকার স্বামী - জামীর ভাই। অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তা- রুদ্ধ বা আটক অবস্থায় কর্মহীনতা। কূটকৌশল- চতুরতা, দুর্বুদ্ধি। বেয়নেট— বন্দুকের সঙ্গিন, বন্দুকের অগ্রভাগে লাগানো একপ্রকার বিষাক্ত ও ধারাল ছোরা। স্তম্ভিত- হতবাক, বিস্মিত গোয়েবলস্ (১৮৯৭-১৯৪৫) - জার্মান বংশোদ্ভূত হিটলারের সহযোগী, রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও মিথ্যা রটনার প্রবর্তক। কথিকা- নির্দিষ্ট ও ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনাত্মক রচনা। চরমপত্র- মৃত্যুর পূর্বসময়ে লিখিত উপদেশ, শেষবারের মতো সতর্ক করে দেওয়ার জন্য প্রেরিত পত্র, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ‘স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র' থেকে এম. আর. আকতার মুকুল কর্তৃক লিখিত হানাদার বাহিনীর অপকীর্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য নিয়ে হাস্যরসাত্মক এই কথিকাগুলো প্রচারিত হতো। এই কথিকাগুলো ‘চরমপত্র' নামে খ্যাত। আলটিমেটাম- চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ। গাজুরিয়া মাইর- গজারি কাঠের মতো শক্ত ও ভারী কাঠের লাঠি দিয়ে মার দেওয়া। মার্সি পিটিশন— শাস্তি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন; লহমায়— মুহূর্তে।

Content added By

জাহানারা ইমাম রচিত একাত্তরের দিনগুলি শীর্ষক দিনপঞ্জির আকারে রচিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ থেকে পাঠ্যভুক্ত অংশটুকু গৃহীত হয়েছে। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সন্তান রুমীকে হারিয়েছেন। এই রচনায় গভীর বেদনার সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে তিনি তাঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা ব্যক্ত করেছেন । পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় প্রথমেই ঢাকার নগর-জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। শিশু-কিশোররা স্কুলে যাবে না। কিন্তু হানাদার বাহিনী জোর করে স্কুল-কলেজ খোলা রাখবে; বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে জোর করে রেডিও-টিভিতে বিবৃতি প্রদান করাবে; আর হত্যা-লুণ্ঠন-অগ্নি সংযোগ তো আছেই— এই ছিল সেই দুঃসময়ে ঢাকার অবস্থা। ‘একাত্তরের দিনগুলি' মুক্তিযুদ্ধে মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক অংশগ্রহণের ইতিহাস তুলে ধরে। সন্তানের প্রতি গভীর মমতা ও সংবেদনশীল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও জাতির প্রয়োজনে সন্তানকে উৎসর্গ করেছেন জাহানারা ইমাম। স্মৃতিচারণমূলক এ লেখা মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় ও সরব অংশগ্রহণের বিবরণ উপস্থাপন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করে তোলে ।

Content added By

চরিত্র পরিচিতি
নূর মোহাম্মদ— দারোগা (বয়স ৪৫)
দলিলুর রহমান— পুলিশের সিপাহী (বয়স ২৫) ঐ
আব্দুল বারেক মণ্ডল- লোক- (বয়স ৩৫)


[দৃশ্য পরিকল্পনা : বাংলাদেশের একটি ছোটো গঞ্জের নদীর ফেরিঘাট। রাত নয়টা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে]

দলিল :একটা পোস্টারের কাগজ এইটার বুকে সাঁটব ?

বারেক :ছোটোবাবুকে বলি । স্যার একটা পোস্টার এই পিপেটাতে লাগিয়ে দিই।

দলিল : মাঝিমাল্লা আর ঘাটের রাহীদের নজরে পড়বে ।

নূর     : কিছু দেখছ, ভালো করে দ্যাখ। বদমায়েশটার পায়ের দাগ। কাঁচা মাটিতে দগদগ করছে । 

দলিল : ফেরিঘাট তো স্যার। দিনেরাতে শয়ে শয়ে রাহী পারাপার করছে। আসামির পায়ের ছাপ নাও হতে পারে ।

নূর     : তুমি একটা বেকুব। আরো দশরকম পায়ের দাগ থাকতে আমি এই একটাকেই পয়েন্ট করলাম কেন? এটা সাধারণভাবে পা                 ফেলে হাঁটা নয়, সাবধানের সঙ্গে হাঁটা। দ্যাখো, এই লাইন ধরে নজর দাও। কী দেখছ? কোনটাতে সামনের আঙ্গুল ডেবে                        আছে,আর কোনটাতে গোড়ালি । আসামি সোজা পথে ঘাট দিয়ে নামেনি । হারামিটা আবার এই পথ দিয়েই ঘাটে আসবে ।

বারেক : নাও তো ফিরতে পারে স্যার!

নূর      : হ্যাঁ, নাও তো ফিরতে পারে, আবার ফিরতেও পারে। আমাদের কাজ হলো সন্দেহ হলেই থমকে দাঁড়াও, কুকুরের নাক দিয়ে                   শুঁকে দ্যাখ যদি কোনো সূত্র পাও । আমার সন্দেহ হয়, কুত্তার বাচ্চা এইখান দিয়েই নদীর ওপারে যাবে। যেতে হবে। ঘাটে                     নামার মতো আর কিনার নাই। আসামির দিলের দোস্তরা সময় মতো এই কিনার ধরে ডিঙি বল আর নৌকাই বল নিয়ে ঘুর                     ঘুর করবে আর ইশারা পেলেই ঘাটে ডিঙি লাগাবে আর ফুস করে পার হয়ে যাবে । এ তোমার মতো আহম্মক লোক নয় । ভিন               কিসিমের মাল । মগজের পোড়ে পোড়ে বুদ্ধি । এ জায়গাটা ছাড়া যাবে না হে ।

দলিল : আমাদের একটা পোস্টার এই কেরাসিন তেলের পিঁপেটার বুকে লাগিয়ে দেব স্যার।

নূর     : কোথায়? হ্যাঁ লাগাও। আচ্ছাসে লেই দিয়ে কাঁচা রক্তের মতো সেঁটে দাও। দেশের মানুষ দেখুক ।

দলিল : দু'হাজার টাকা পুরস্কার, কম হয়েছে স্যার।

নূর     : কেন? 

দলিল : দশ বিশ হাজার টাকার লোভেও ঐ লোকটাকে কেউ ধরিয়ে দিবে না। দেশের এত বড়ো একটা বিপ্লবী।

নূর     : ওসব ভাবনা এখন বাতিল করে কাজে মেজাজ দাও । এইখানে আমি থাকলাম ডিউটিতে। দেখি তোমাদের নয়নের চাঁদ বিপ্লবীর               বাচ্চা কী করে আজ রাতে ডিঙিতে ওঠে

বারেক : আপনি একলাই থাকবেন?

নূর      : আলবৎ। একাই থাকব। চব্বিশ বছর পুলিশের চাকরী করছি, আমাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয় । তোমার ঐ বিপ্লবী দুলাভাই                     একটা মাছ-মারা জালুয়ার ছদ্মবেশ ধরে আসবে। ঘাড়ে জাল, হাতে হুক্কা। শালা, আয়, তুই থাকিস গাছের ডালে আর আমি                     থাকি তোর মগডালে ।

দলিল : লোকটা খুব ধড়িবাজ । আমরাও আপনার সঙ্গে থাকি ।
নূর     : না ।

বারেক : আমাদের কিন্তু সবদিকেই বিপদ।
নূর      : মণ্ডল, তোমার কথাতে বদ গন্ধ ঢুকেছে। বুকে সাহস রেখে ইমানের সঙ্গে কাজ কর। আমরা হলাম হুকুমের টহলদার। আইন-              আদালতের হেফাজতি পুলিশের ইমানের কাছে।

                                         [বারেক এবং দলিল পোস্টার ও আঠা নিয়ে চলে গেল]
নূর     : কে? কে যায়? এই শালা ।
           [একজন লোক লম্বা চুল। মুখে দাড়ি। গ্রামে গঞ্জে এ জাতের লোক পুঁথি কিস্সার গান গায়, কেতাব বিক্রি করে]

লোক : মালিক, ঘাটে যাব, নদ্দীর ওপারে হামার বাড়ি ।

নূর    : আর এক পা ফেলবি না। গুলি দিয়ে ঠ্যাঙ নুলা করে দিব ।

লোক : ইয়া আল্লা! হামি মরে যাব যে! হামার জন্য কাঁদনের কেউ নাই সংসারে ।

নূর     : এই কাঁদিস না । কে তুই ?

লোক : ফকির গরীবুল্লাহ হামার নাম ৷

নূর : এই ফকিরের বাচ্চা, ঘাটে নামিস না । গঞ্জের দিকে ফিরে যা।

লোক : ঘাটে নামিনি মালিক। এই পাড়ে বসে একটা গান ধরব, রসের গান। রসের গান শুনে মাঝিরা যদি দুটা একটা কেতাব কিনে                     লেয়, ভাত খাওয়ার পয়সা হয়ে গেল। তখন ধরেন যে এক শোয়াতে রাত ভোর করে দিনু ।

নূর    : আমি গানটান ভালোবাসি না ।

লোক : না শুনলে ভালোবাসবেন কেমন করে হুজুর । বগাবগির গান মানে যে কলজে পানি করা গান;

                                       [গাইন গাইছে : বগা ফান্দে পইড়া বগি কান্দেরে]

নূর      : এই শালা বগার ভাতিজা। এই তোর গান? গানটার জান কবজ করে দিলি । যা ভাগ, ফিরে যা । এখানে আমার জরুরি কাজ                      আছে।তোর সঙ্গে বেহুদা কথা বলবার সময় নাই। আচ্ছা লোকটা দেখতে কেমন? 

লোক   : দেখিনি হুজুর ।

নূর      : বলবি না?

লোক   : ইয়া আল্লা, মরে যাব যে মালিক । বলছি, হামাদের গাঁয়ে দেখছি।

নূর      : দেখতে জোয়ান?

লোক   : হ্যাঁ, তাগড়া জোয়ান, হানিফ পালোয়ানের মতোন সিনা। বাঘের মতোন লাল ঘোল্লা চোখের মণি। লাঠি, ছোরা, বন্দুক                               সব চালাতে জানে। আর হাতের কব্জি (পিপেতে ঘুষি মেরে) এই রকম লোহার মতোন শক্ত । একবার যদি হাত তুলে তার                        হাত আমি গুলি মেরে ভেঙে দিব। 
নূর      : তার হাত আমি গুলি মেরে ভেঙে দিব।  

লোক   : খবরদার মালিক, খবরদার। ও কাজ ভুল করেও করতে যাবেন না হুজুর। একবার একটা জিদ্দি পুলিশ ডাকাতটাকে ধরতে                      গিয়েছিল, রাইফেল তুলে মারতে যাবে, ব্যস নাই। এক থাপ্পড়ে পুলিশের এই গালের হাড্‌ড়ি ঝুর ঝুর ঝুর ঝুর করে পড়ে গেল ।

নূর       : তারপর? :

লোক    : তারপর আর কী হয়। পুলিশের রাইফেল হাতেই থাকল, এন্তেকাল এসে গেল ।

নূর       : দারোগা সাহেবও এন্তেকাল!

লোক    : না না মালিক । কতক্ষণ কোরবানির কাটা গরুর মতোন ছটফট ছটফট করল,পা দুটা টান করল তারপর মানে যে যন্ত্রপাতি                    বন্ধ। এখন মানে যে একে আপনি কী বলবেন মালিক খতম, রোজকিয়ামত ?

নূর       : চুপ কর। এই লোকটা বেঁচে থাকলে দেশের আমলা পুলিশের জান বাঁচবে কী করে? :

লোক    : বাঁচবে না মালিক। এই লোক থাকলে জোদ্দার কি মালদারের বংশের আর গোরে মোমবাত্তি জ্বলবে না । হুজুর, আপনি তো                    ঘাটের এই ডাহিন দিকে নজর রেখেছেন লোকটা এপথে আসবে বলেই –
নূর       : কেন? :

লোক    : না, মানে যে, ডাহিন দিকে তাকালে যদি বাঁদিক দিয়ে আসে।

নূর       : তখন বাঁদিকে ঘুরে তাকাব ! :

লোক    : ততক্ষণ কি সময় পাবেন মালিক । খোদা না খাস্তা, যদি আসেই, বাঘের মতোন লাফিয়ে আমার মালিকের ঘাড়ে 

নূর        : তখন কী হবে গরীবুল্লাহ? :

লোক     :কী আর হবে মালিক। আপনি মানে যে শুয়ে পড়লেন কতক্ষণ বেদিশা হয়ে পড়ে থাকলেন, বাপদাদার নাম মনে করলেন,                     দেখলেন যে আসমান জমিন ।

নূর        : ভালো বলেছ গরীবুল্লাহ । :

লোক     : মালিক 

নূর       : আল্লার রহমতে যদি ধরতে পারি, সরকারি বখশিশের ভাগ দাবি করবে? :

লোক    : না মালিক । হামি একটা সামান্য জীব। দেশের হাজার হাজার মানুষ হামার গান শুনে খুশি : মনে দু'চার আনা পয়সা দেয়,                      ওতেই হামার দিন চলে যায়। হামি সরকারের পুরস্কার লিয়ে কি করব।

নূর       : তুমি একটা ভালো মানুষের পয়দা হে গরীবুল্লাহ। ঈমান ঠিক রেখে বেঁচে থাক। তোমাদেরমতো লোক দেখতে পাই না । চোর-                   ডাকাত দেখে দেখে পুলিশের রুহু পচে গেছে ।

লোক    : মালিকের উপরি আয়টায় হয় না কিছু?
:
নূর      : হয়, কিন্তু নিই না। আমার বাপের কসম আছে। মাঝে মধ্যে মনটা খিঁচড়ে ওঠে, কী হবে মরা বাপের কথার মূল্য দিয়ে।

             কিন্তু বুকটা ধক্ ধক্ করে। এসব করি না বলেই তো চব্বিশ বছরে চাকরিতে প্রমোশন হলো না ।

লোক   : লোকটাকে ধরতে পারলে দু'হাজার টাকা পুরস্কার পাবেন। বড়ো মেয়ের বিয়া দিতে পারবেন।

নূর      : ধরতে পারলে তো। তুমি যেসব কথা বলছ। লোকটা বুকভরা এত সাহস আর শক্তি কোথায় পায় । তুমি শালা বানিয়ে বানিয়ে                   আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ না তো?

লোক    : মালিক হামি গান বানাই ঠিকই, কিন্তু মানুষ বানাব কোন সাহসে। মানুষ তো বানায় দুনিয়ার সুরত ..
                                           

                                [গান : একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
                                                          এই তো নদীর খেলা]

নূর       : গরীবুল্লাহ, এ তুমি কোন গান ধরলে। বুকটা হু হু করে ওঠে। বাংলার বাদশা পালিয়ে যাচ্ছে, বাংলা পরাধীন, গাও ভাই গাও ।
                                                            [গান চলছে]
বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে তাকে আশা দিবে, কে তাকে ভরসা দিবে, কেমন সুন্দর কথা, যতবার শুনি মনে হয় বুকের মধ্যে ধরে রাখি ।

লোক   : মালিক, হামাদের দেশ তো নদীর দেশ, সবুজ ধানের দেশ। তবুও হামরা এত দুঃখী :কেন মালিক?

নূর      : সব তকদিরের খেলা রে ভাই। কপালে দুঃখ থাকলে সুখ তো পাবে না । :

লোক   : হামি আর কী বলব । আপনার দুঃখ কেউ বুঝল না, হামার জ্বালা কেউ বুঝতে চায় না। হামাদের মগজের মধ্যে দিনরাত কিসব                আলতুফালতু ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে হামাদের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে, হামাদের সাহসকে গোর দিচ্ছে। আর এই সুযোগে যত সব                        জালেম আল্লার নাম ভাঙিয়ে হামাদের শরীল থেকে শোঁ শোঁ করে রক্ত শুষে লিয়ে বিদেশে পাচার করছে মালিক। আপনারা                  এসব রুখতে পারেন না কেন?

নূর      : তুমি শালা একটা উজবুক। বিড়াল হয়ে বাঘের মুখে থাপ্‌পড় দিতে চাও ।
লোক   : হামার বাপজান বলত, গরীবুল্লাহ, বেটা অনাহক যারা তাল ঠুকে, তারা খুব বড় কিসিমের গায়েন নয়। কথাটা ঠিক না বেঠিক                  একবার পরখ করবেন মালিক। হামাদের এই ভাঙা ফুটা শরীল নিয়ে তামাম মানুষ যদি এক জায়গাতে হাজির হতে                              পারতাম,একবার যদি জালেমের লোভের কব্জিতে দাঁত বসাতে পারতাম রক্তের নেশাতে গজরাতে পারতাম, তখন বুঝা যেত                  কারা বিলাই আর কারা বাঘ । যুদ্ধই তো হয় না মালিক, মরণ, বাঁচার লড়াই । হামরা এই নদীর দেশের মানুষ একটা যুদ্ধ চাই                   মালিক,স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ।

নূর       : গরীবুল্লাহ তোমার কপালে ঢের দুঃখ আছে, এসব কথা বলো না ।

লোক   : সেই দুঃখই তো হামি চাহি মালিক। দুঃখের নদীতে আর কতকাল এমন করে ভাসব, তার চেয়ে উঠুক না কেন আসমান জুড়ে                 কালো ম্যাঘ, উথাল পাথাল ঢেউ, আর প্রলয় বাতাস লোক :

                                             [গান : খরবায়ু বয় বেগে
                                                      চারিদিক ছায় মেঘে
                                                          ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো]

নূর       : এই গরীবুল্লাহ, তুমি এ গান পেলে কোথায়? এ তো তোমার স্কুল-কলেজের গান।কিছু পড়ালেখা শিখেছ নাকি ?

লোক : হামার গাঁয়ের একটা ছাত্র শহরে পড়ে, তার মুখে শুনেছি মালিক। সেই ছাত্র এখন জেলখানাতে বন্দি ।

নূর     : কিসের আসামি?

লোক : ঐ আপনার লাটসাহেবের মিটিং যে হলো, তার যে গণ্ডগোল, তারই মধ্যে ছিল ।

নূর     : বেকুবের মতোন এসব হুজ্জতের মধ্যে যায় কেন?

লোক : ও ছেলে মানে যে আগুন দিয়ে তৈরি, অন্যায় কথা সহ্য করতে পারে না। বললে বলে, গারদ ফাটক একদিন সব খান খান করে              ভেঙে ফেলব। মালিক, আপনি তো ব্রিটিশ আমলের ছাত্র। দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনার মনটাতে হাহাকার করতো না ।         

নূর     : করতো না কি গরীবুল্লাহ, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য কত কী করতাম। লাঠি চালাতাম,রক্তের মধ্যে আগুন ধরে যায় এমন সব                গান শিখতাম। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী, তুমি জান নাকি গানটা?

লোক : (গান) কলের বোমা তৈরি করে, দাঁড়িয়ে ছিলাম লাইনের ধারে, লাট সাহেবকে মারব বলে, মারলাম স্বদেশবাসী । 

নূর     : সাবাস গরীবুল্লাহ, আবার গাও ।

লোক  : আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে জগৎবাসী ।

নূর      : ঐখানে গাও, চিনতে যদি না পারিস মা, দেখবি গলায় ফাঁসি ।
                                                       [দু'জনে এক সঙ্গে গান গাইছে]

              এসব বহুত পুরাতন কথা গরীবুল্লাহ, এখন যুগ জামানার ভিন্ন স্বাদ। দেশের মধ্যে নানান রকম কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কখন                   যে কী হয়। এই চাকরি করলে করলে কী হবে, বুঝি গরীবুল্লাহ,কিছু কিছু বুঝি। কিন্তু আমাদের হাত-পা যে বন্দি রে ভাই ।

লোক   : মালিক, একটা কথা ভাবছি আর মনে মনে হাসছি। যে লোকটাকে ধরবার জন্য আপনি এই আলো-আঁধারির রাতে ঘাট পাহারা               দিচ্ছেন, ধরেন যে সেই লোকটা সত্যি সত্যি আপনার কাছে হাজির হলো। আপনি তাকে দেখছেন, সেও আপনাকে দেখছে।                 দেখতে দেখতে আপনার মনের মধ্যে প্রশ্ন হচ্ছে— কে এই লোক? একে তো আমি চিনি, আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত, আমার                  বন্ধু। সে লোকটা আপনাকে বলছে— কী রে নূর মোহাম্মদ, কেমন আছিস? আমি মোয়াজ্জেম হোসেন,আমাকে ধরবার জন্য               গাছে গাছে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়েছিস। আমাকে ধরলেই কি আগুন নিভে যাবে? স্বাধীনতার আগুন কখনো নেভে না। মালিক,                     আপনি যখন ছাত্র ছিলেন তখন কি দেশের জন্য আপনাদের মন কাঁদত?

নূর      : এখনো কাঁদে । যদ্দিন বাঁচব দেশের জন্য কাঁদব। দেশকে ভালোবাসা তো পাপ নয়। যারা স্বাধীনতা, তোমার আমার স্বাধীনতার                জন্য কাজ করছে তাদেরকে আমিও ভালোবাসি গরীবুল্লাহ ।

লোক  : তাহলে আপনি আপনার বন্ধুকে ছেড়ে দিবেন না কেন মালিক? :

নূর     : তুমি আবার ঐ একই কথা বললে হে। বলছি তো আমার হাত-পা সব বন্দি। আমি পাহারাদার, আমি একটা বহুত দিনের                           পুরাতন যন্ত্র ।

লোক  : মালিক, হামরা যদি সেই যন্ত্রটাকে ভাঙতে বলি।

নূর     : পারবে না, অসম্ভব । 

লোক  : কেন অসম্ভব?

নূর      : চুপ কর। একটা ডিঙি আসছে। আমি জানতাম আসতেই হবে। আজ আমার ভাগ্যপরীক্ষা।জীবনের সঙ্গে লড়াই। বিপ্লবীকে                   ধরতে পারলে দু'হাজার টাকা পুরস্কার। আমার বড়মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিব।

লোক   : (গান) আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ....

নূর       : এই গরীবুল্লাহ, তোমার গান বন্ধ কর ।

লোক   : (গান) ছেলে-হারা শত মায়ের অশ্রু ..

নূর      : শালা ফকিরের বাচ্চা, গান বন্ধ কর। তোমার গলা টিপে গানের চৌদ্দ পুরুষকে জবাই করব গরীবুল্লাহ ।

              [ নদীর বুক থেকে এই গানের সুরে শিস আসছে, নূর মোহাম্মদ গরীবুল্লাহর গলা ছেড়ে দিয়েছে ]

নূর      :কে শিস দি [গরীবুল্লাহ নদীর ঘাটে নামছে]

              এই শালা ঘাটে নামিস না। ঘুরে দাঁড়া, গুলি করব।
                              [গরীবুল্লাহ ঘুরে দাঁড়াল]

কে তুমি? ঠিকমতো পরিচয় দাও। কে তুমি?

লোক    : ফকির গরীবুল্লাহ মালিক। শাদুল্লা গায়েনের ব্যাটা |

নূর        : ঝুট । মিথ্যা কথা বলো না। তুমি অন্য লোক ৷

লোক     : অন্য কোন লোক? কে হতে পারি বলুন তো । 

নূর        : তুমি ! আপনি কি সেই লোকটা, আসামি বিপ্লবী ।
 

                                     [লোকটি পরচুলা, দাড়ি আর টুপি খুলল]

লোক     : মিলছে। চাপা মুখ, কালো চোখ, মাথার চুল ছোট, লম্বা সাড়ে পাঁচ ফুট। দু হাজার টাকার পুরস্কার। ডিঙিতে আমার বন্ধুরা শিস                 দিয়েছে ঠিক সময়ে। ঐ যে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠছে। এখন আমি যাব দারোগা সাহেব, যেতেই হবে, আমাদের জরুরি বৈঠক                   আছে।

নূর         : আপনি যাবেন?

লোক      : হ্যাঁ ।

নূর          : আমার তকদির। আপনার তো যাওয়া হবে না ।

লোক      : আপনি আমার বন্ধু । যেতে দিন।

নূর          : না, নূর মোহাম্মদ দারোগা তোমাকে ছাড়বে না ।

                           [লোকটি পিস্তল বের করেছে। নূর মোহাম্মদের হাতেও পিস্তল । মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে]

লোক     : স্বাধীনতার আগুন কখনো নেভে না ।

নূর        : কাছে এসো না গরীবুল্লাহ ।

লোক    : যদ্দিন বাঁচব দেশের জন্য কাঁদব । যারা স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে তাদেরকে আমিও ভালোবাসি ।

নূর        : গরীবুল্লাহ, না। আর এগিয়ে এসো না ।

লোক     : [এগিয়ে আসছে। নূর মোহাম্মদ পিছোচ্ছে : গান ধরেছে ] নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা

নূর        : তোমাকে আমি ছাড়ব না গরীবুল্লাহ, ডিউটি ইজ ডিউটি।

                             [পুলিশ দু'জন আসছে, তাদের কথা শোনা যাচ্ছে]

লোক    : আমি ঐটার পিছনে বসে থাকব ।

নূর       : কেন?

লোক    : পালাব না ।

নূর        : আহ্! 
              [লোকটি পিপেটার পিছনে লুকাল। পুলিশ দু'জন এসেছে]

             দলিলুর রহমান, আব্দুল বারেক মণ্ডল। সব কাজ শেষ করেছ?

বারেক : ভালো করে সেঁটে দিয়েছি স্যার।

নূর      : সাবাস । বিপ্লবী আর পালাতে পারবে না । দলিল, হারিকেনটা নিভিয়ে দাও । দলিল জ্বলুক স্যার। ঐ পিঁপেতে রেখে দিই। :

নূর      : আহ। দরকার হবে না। আকাশে চাঁদ উঠছে। : দলিল এ চাঁদে আলো নাই স্যার ।

নূর      :এখন নাই, মাঝরাতে হবে। থানায় ফিরে যাও তোমরা । :

বারেক : ফিরে যাব? কিন্তু আসামি?

নূর      : আমি একলাই মোকাবিলা করব।

বারেক : স্যার, আসামি খুব জাঁহাবাজ ।

নূর      : হোক। এ্যাটেনশন, এ্যাবাউট টার্ন ।

              [পুলিশ দু'জন যান্ত্রিক নিয়মে চলে গেল, হারিকেনটা জ্বলছে। লোকটি উঠে এল]

লোক   : দারোগা সাহেব ।

নূর      : [হারিকেনটা তুলে নিয়েছে] অমন করে কী দেখছেন? আমার পরচুলা আর টুপিটা । অনেক দূর যেতে হবে।

লোক   : আমার পরচুলা আর টুপিটা । অনেক দূর যেতে হবে।

নূর       : ঠিকমতো পরে নিন ।[লোকটি পরচুলা আর দাড়ি লাগাচ্ছে] খুব সাবধান । আপনার চারদিকে দুশমন। পদে পদে বিপদ

লোক    : ঘরে ঘরে আমাদের বন্ধু ৷

নূর        : আবার কখন দেখা হবে ।

লোক    : একদিন সকালে, যখন আকাশ জুড়ে প্রকাণ্ড লাল সূর্য উঠবে, অথবা এক রাত্রিতে, যখন আকাশ ভরে পূর্ণ চাঁদ হাসবে ।
                                [দু'জনে আন্তরিক উষ্ণতায় করমর্দন করল]
নূর        : আসুন ।

লোক     : হামার নাম ফকির গরীবুল্লাহ ।

নূর        : তুমি বিপ্লবী মোয়াজ্জেম হোসেন, স্বাধীনতার সৈনিক । [লোকটি নদীর ঘাটে নামছে]
                           

                                   [ নদীর বুক থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে গান উচ্চারিত হচ্ছে

                                                 আমার সোনার বাংলা

                                                   আমি তোমায় ভালোবাসি
                                নূর মোহাম্মদ, আব্দুল বারেক, দলিলুর রহমান নীরবে দাঁড়িয়ে আছে]

Content added || updated By

মমতাজউদদীন আহমদ ১৮ই জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মালদহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কলিমউদদীন আহমদ এবং মাতা সখিনা খাতুন। তিনি ১৯৫১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট রামেশ্বরী ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। কিছু সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মূলত নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে খ্যাতিমান। বাংলাদেশের নাট্যশিল্প আন্দোলনের তিনি পুরোধা পুরুষ। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক : স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, পালা, বকুলপুরের স্বাধীনতা, সাত ঘাটের কানাকড়ি; গবেষণা ও প্রবন্ধ : বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০১৯ সালের ২রা জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

গঞ্জ- ব্যবসা বাণিজ্যের স্থান, হাট। কৃষ্ণপক্ষ— চান্দ্রমাসের যে পক্ষে চন্দ্রের ক্ষয় হয়। রাহী- পথচারী, পথিক; নজরে— দৃষ্টিতে; বেকুব - বেয়াকুব, বোকা।

ভিন কিসিমের মাল- ভিন্ন বা অন্য রকমের মানুষ। তেলের পিপে— তেলের ড্রাম। জালুয়া— জেলে, ধীবর। হুক্কা- কাঁসা পিতল দস্তা বা মাটি অথবা নারকেল খোলে তৈরি একপ্রকার নলযুক্ত যন্ত্র যা তামাক খেতে বা ধূমপান করতে ব্যবহৃত হয়। ধড়িবাজ— ফন্দিবাজ, প্রতারক। টহলদার- যে টহল দেয়, প্রহরী। নুলা— বিবশ, বিকল।

বেহুদা- অনর্থক, বাজে। রোজকিয়ামত- মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের দিন, শেষ বিচারের দিন। খাস্তা— নষ্ট, পীড়িত, বিকৃত। বেদিশা- দিকভ্রষ্ট, দিশেহারা।

রুহু— আত্মা, অন্তর তকদির- ভাগ্য, অদৃষ্ট, কপাল। নাহক— অযথা, খামখা, অনর্থক। তামাম— সমগ্র, সমস্ত, সমুদয়। জালেম- জুলুমকারী, অত্যাচারী।

গজরাতে- আক্রোশে বা ভয়ে চাপা গর্জন করা। হুজ্জত- গোলমাল, হাঙ্গামা। জামানা— সময়, কাল, যুগ। জাঁহাবাজ— দুর্দান্ত, দজ্জাল। এ্যাটেনশন- সাবধান হও।

এ্যাবাউট টার্ন- ঘুরে দাঁড়াও।

Content added By

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শতবর্ষের নাটক নামক গ্রন্থ থেকে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' নাটিকাটি সংকলিত ও সম্পাদিত হয়েছে। নাটিকাটি স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়। নাট্যকার এখানে আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যদের মানবতাবোধ এবং দেশাত্মবোধ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন। দারোগা নূর মোহাম্মদ পুরস্কার ঘোষিত স্বদেশী আন্দোলনের আসামিকে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থপুরস্কারের লোভ জয় করে তিনি দেশের স্বাধীনতার ও বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। একজন দারোগা, দুইজন পুলিশ সদস্য এবং একজন বিপ্লবীকে নিয়ে রচিত এ নাটকের প্রতিটি চরিত্রই আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নাটকটি স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়।

Content added By

আর কিছু নয়, গফরগাঁ থাইকা পীর সাহেবেরে নিয়া আস তোমরা । অনেক ভেবে চিন্তে বললেন রহিম সর্দার। তাই করেন হুজুর, তাই করেন! একবাক্যে সায় দিল চাষিরা। গফরগাঁ থেকে জবরদস্ত পীর মনোয়ার হাজিকেই নিয়ে আসবে ওরা। দেশজোড়া নাম মনোয়ার হাজির। অলৌকিক ক্ষমতা- সম্পন্ন ব্যক্তি তিনি । মুমূর্ষু রোগীকেও এক ফুঁয়ে ভালো করেছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে ৷
সেবার করিমগঞ্জে যখন ওলাবিবি এসে ঘরকে ঘর উজাড় করে দিচ্ছিল তখন এই মনোয়ার হাজি -ই রক্ষা করেছিলেন গাঁটাকে। সাধ্য কি ওলাবিবির মনোয়ার হাজির ফুঁয়ের সামনে দাঁড়ায় । দিন দুয়েকের মধ্যে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে গেল ওলাবিবি, দু'দশ গাঁ ছেড়ে। এমন ক্ষমতা রাখেন মনোয়ার হাজি ।
গাঁয়ের লোক খুশি হয়ে অজস্র টাকা পয়সা আর অজস্র জিনিসপত্র ভেট দিয়েছিল তাঁকে। কেউ দিয়েছিল বাগানের শাক-সবজি। কেউ দিয়েছিল পুকুরের মাছ। কেউ মোরগ হাঁস। আবার কেউ দিয়েছিল নগদ টাকা ।
দুধের গরুও নাকি কয়েকটা পেয়েছিলেন তিনি। এত ভেট পেয়েছিলেন যে, সেগুলো বাড়ি নিতে নাকি তিন তিনটি গরুর গাড়ি লেগেছিল তাঁর। সেই সৌভাগ্যবান পীর মনোয়ার হাজি! তাঁকেই আনবে বলে ঠিক করল গাঁয়ের মাতব্বরেরা, চাষি আর
ক্ষেত মজুররা । বললে, চাঁদা দিমু? কিসের লাইগা দিমু? ওই লোকডার পিছে ব্যয় করবার লাইগা?
মতি মাস্টারের কথায় দাঁতে জিভ কাটল জমির মুন্সি । তওবা, তওবা, কহেন কি মাস্টার সাব। খোদাভক্ত পীর, আল্লার ওলি মানুষ। দশ গাঁয়ে যারে মানে, তার নামে এত বড় কুৎসা! ভালা কাজ করলা না মাস্টার, ভালা কাজ করলা না। ঘন ঘন মাথা নাড়লেন জমির ব্যাপারী। পীরের বদ দোয়ায় ছাই অইয়া যাইবা! কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠল মতি মাস্টার। কি যে কও চাচা, তোমাগো কথা শুনলে হাসি পায়।
হাসি পাইবো না, লেখাপড়া শিখা তো এহন বড় মানুষ অইয়া গেছ। মুখ ভেংচিয়ে বললেন জমির
ব্যাপারী। চাঁদা দিলে দিবা না দিলে নাই, এত বাহাত্তরি কথা ক্যান?
কিন্তু, বাহাত্তরি কথা আরো একজনের কাছ থেকে শুনতে হলো তাদের। শোনালো দৌলত কাজির মেজ ছেলে রশিদ । শহরে থেকে কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে বেড়াতে। চাঁদা তোলার ইতিবৃত্ত শুনে সে বলল, পাগল আর কি, পীর আইনা বন্যা রুখবো! এ একটা কথা অইলো?

কথা নয় হারামজাদা! জমির মুন্সি কোনো জবাব দেবার আগেই গর্জে উঠলেন দৌলত কাজি নিজে আল্লাহর ওলি, পীর দরবেশ; ইচ্ছা করলে সব কিছু করতে পারে। সব কিছু করতে পারে তাঁরা । এই বলে নূহ নবি আর মহাপ্লাবনের ইতিকথাটা ছেলেকে শুনিয়ে দিলেন তিনি ।
খবরটা রহিম সর্দারের কানে যেতে দেরি হলো না। দু-দশ গাঁয়ের মাতব্বর রহিম সর্দার। পঞ্চাশ বিঘে খাস আবাদি জমির মালিক। একবার রাগলে, সে রাগ সহজে পড়ে না তাঁর। জমির মুন্সির কাছ থেকে কথাটা শুনে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি, এ্যা! খোদার পীরের ঠাট্টা তামাসা। আচ্ছা, মতি মাস্টারের মাস্টারি আমি দেইখা নিমু। দেইখা নিমু মইত্যা এ গেরামে কেমন কইরা থাহে। অত্যন্ত রেগে গেলেও একেবারে হুঁশ হারাননি রহিম সর্দার। কাজির ছেলে রশিদের নামটা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন তিনি। কাজি বাড়ি কুটুম্ব বাড়ি, বেয়াই বেয়াই সম্পর্ক, তাই।
পীর সাহেবের নূরানি সুরত দেখে গাঁয়ে ছেলে-বুড়োরা অবাক হলো। আহা! এমন যার সুরত, গুণতার কত বড়ো, কে জানে! ভক্তি সহকারে পীর সাহেবের পায়ের ধুলো নিল সবাই। গরিব মানুষ হুজুর! মইরা গেলাম, বাঁচান। হুজুরের পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন জমির ব্যাপারী ।
জমির ব্যাপারী বোকা নন। বোঝেন সব। খোদার মন টলাতে হলে আগে পীর সাহেবের মন গলাতে হবে । পীর সাহেবের মন গললে এ হতভাগাদের জন্যে খোদার কাছে প্রার্থনা করবেন তিনি । তারপরেই না খোদা মুখ তুলে তাকাবেন ওদের দিকে ।
পীর সাহেব এসে পৌঁছলেন সকালে। আর ঘটা করে বৃষ্টি নামল বিকেলে।
বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি । সারাটা বিকেল বৃষ্টি হলো। সারা রাত চললো তার একটানা ঝপঝপ ঝনঝন শব্দ । সকালেও তার বিরাম নেই। প্রতি বছর এ সময়ে শ্রাবণ মাসের ‘ডাত্তর'। কেউ কেউ বলে বুড়ো বুড়ির ‘ডাত্তর’। এই ডাত্তরের আয়ুষ্কাল পনের দিন। এই পনের দিন একটানা ঝড় বৃষ্টি হবে। জোরে বাতাস বইবে। বাতাস যদি বেশি থাকে আর অমাবস্যা কি পূর্ণিমার জোয়ারের যদি নাগাল পায় তাহলে সর্বনাশ! নির্ঘাত বন্যা! ‘খোদা, রক্ষা কর! রক্ষা কর খোদা! রহম কর এই অধমগুলোর ওপর! কান্নায় ভেঙে পড়লেন জমির ব্যাপারী। মনে মনে মানত করলেন। যদি ফসল নষ্ট না হয় তাহলে হালের গরু জোড়া পীর সাহেবকে ভেট দেবেন তিনি। গম্ভীর পীর সাহেব ঢুলে ঢুলে তছবি পড়েন আর খোদার মহিমা বর্ণনা করেন সবার কাছে। খোদার মহিমা বর্ণনা শেষ হলে পীর সাহেবের মহিমা বর্ণনা প্রসঙ্গে অসংখ্য আজগুবি ঘটনার অবতারণা করেন তাঁর সাকরেদরা।
মনে আশা জাগে চাষিদের। আনন্দে চকচক করে ওঠে কোটরে ঢোকা চোখগুলো। ভিড়ের মাঝ থেকে গনি মোল্লা ফিসফিসিয়ে বললেন, কই নাই মনার পো? এই পীর যেই সেই পীর নয়, খোদার খাস পীর! যারা শুনেছে তারা মাথা নেড়ে সায় দিল, হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। আর যারা শোনেনি তারাও সেই মুহূর্তে বিশ্বাস করল কথাটা। পীর সাহেব সব পারেন। কিন্তু, থামাচ্ছেন না, প্রয়োজনবোধে থামাবেন তাই । কিন্তু, মতি মাস্টার বিশ্বাস করল না কথাটা। হেসে উড়িয়ে দিল। বললো, ঝড় থামাবে ওই বুড়োটি? মন্তর পড়ে ঝড় থামাবে?
হ্যাঁ, থামাবে। আলবত থামাবে। আকাশভেদী হুংকার ছাড়লেন গনি মোল্লা। চোখ রাঙিয়ে ফতোয়া দিলেন । এই নাফরমান বেদীনগুলো গাঁয়ে আছে দেইখাই তো গাঁয়ের এই দুরবস্থা।

হ্যাঁ, ঠিক কইছ মোল্লার পো। তাঁকে সমর্থন করলেন বুড়ো তিনজী মিঞা। এই কাফেরগুলোরে গাঁ থাইকা না তাড়াইলে গাঁয়ের শান্তি নাই ।
কিন্তু গাঁয়ের শান্তি রক্ষার চাইতে ‘ঢল’ রোখাটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রকৃতি উন্মাদ হয়ে পড়েছে । ক্ষুব্ধ বাতাস বারবার সাবধান করছে। ঢল হইব, ঢল। পানি ভরা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনজী মিঞা। রক্ত দিয়ে বোনা সোনার ফসল।
হায়রে ফসল !
হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠেন তিনি, খোদা!
মসজিদে আজান পড়ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে। এস মিলাদ পড়তে এস। এস মঙ্গলের জন্য এস। টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে বৃষ্টির ভেতর ভিজে ভিজেই মসজিদের দিকে ছুট দিলেন জমির ব্যাপারী। যাবার সময় ঘরের বৌ-ঝিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, এ রাত ঘুমাইবার রাত নয়। বুঝলা? অজু কইরা বইসা খোদারে ডাক ।
অজুটা সেরে উঠে দাঁড়াতেই কার একটা হাত এসে পড়ল ছকু মুন্সির কাঁধের ওপর। জমির মুন্সির ছেলে ছকু মুন্সি। গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান মানুষ। প্রথমটায় ভয়ে আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, কে? ভয় নাই আমি মতি মাস্টার।
ব্যাপার কি? এ রাত্তির বেলা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে ছকু । মতি মাস্টার বললো, যাও কনহানে?
যাই মসজিদে । ছকু জবাব দিল । ক্যান তোমরা যাইবা না?
না। স্বল্প থেমে মতি মাস্টার বললো। এক কাজ কর ছকু। মসজিদে যাওয়া এহন রাখ। ঘর থাইকা কোদাল নিয়া বাইর অইয়া আয়। যা জলদি কর। কোদাল দিয়া কি অইবো? রীতিমতো ঘাবড়ে গেল ছকু মুন্সি। যা ছকা । কোদাল আন । পেছন থেকে বললো মন্তু শেখ
এতক্ষণে পুরো দলটার দিকে চোখ পড়লো ছকু মুন্সির। একজন দুজন নয়, অনেক। অন্তত জন পঞ্চাশেক হবে। সবার হাতে কোদাল আর ঝুড়ি ।
মতি মাস্টার এত লোক জোটাল কেমন করে ? কাজি বাড়ির পড়ুয়া ছেলে রশিদকে দলের মধ্যে দেখে
আরো একটু অবাক হলো ছকু ।
ব্যাপারটা অনেক দূর আঁচ করতে পারল সে। গতকাল এ নিয়েই কাজি পাড়ায় বুড়ো কাজির সঙ্গে তর্ক করছিল মতি মাস্টার। গত কয়েক বছর কি খোদারে ডাকেন নাই আপনারা? হ্যাঁ, ডাকছিলেন । কিন্তু ফল কি হয়েছে ? ফসল কি বাঁচছে আপনাগো? বাঁচে নাই। তাই কইতে আছলাম কেবল বইসা বইসা খোদারে ডাকলে চলবো না। এ কয়টা গাঁয়ে মানুষ তো আমরা কম নই। সবাই মিলে বাঁধটারে যদি পাহারা দিই, সাধ্য কি বাঁধ ভাঙে?
মতি মাস্টারের কথা শুনে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিলেন বুড়ো কাজি। অশ্রাব্য গালি-গালাজ করেছিলেন তাকে। সে কাল বিকেলের কথা। মসজিদে আজান হচ্ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে, এস মিলাদ পড়তে এস। এস মঙ্গলের জন্য এস।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ছকু। তারপর টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো সে। খপ করে একখানা হাত চেপে ধরলে রশিদ, ছকু।

এই ছকা । ক্ষেপে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু । অগত্যা, কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল ছকু মুন্সি ।
মাইল খানেক হাঁটতে হবে ওদের। তারপর বাঁধ ।
নবীন কবিরাজের পুকুর-পাড়ে এসে পৌঁছতেই জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল একটা । ভয়ে আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়াল ছকু । খোদা সাবধান করছে তাদের। খবরদার যাইও না। যাইও না মাস্টার । থামো, থামো! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ছকু মুন্সি। খোদা নারাজ হইবো, মসজিদে চল সবাই ।
ইস, চুপ কর ছকু । বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে মতি মাস্টার। এখন কথা কইবার সময় না । জলদি চল । আবার চলতে শুরু করল ওরা।
দূরে মসজিদ থেকে দরুদের শব্দ ভেসে আসছে। পীর সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দরুদ পড়ছে তিনজী মিঞা, জমির ব্যাপারী, রহিম সর্দার ও আরো কয়েকশ জোয়ান জোয়ান মানুষ। অসহায়ের মত ঊর্ধ্বে হাত তুলে চিৎকার করছে তারা। হে আসমান জমিনের মালিক! হে রহমানের রহিম! তুমিই সব! তুমি রক্ষা কর আমাদের!
ওদিকে মরিয়া হয়ে কোদাল চালাচ্ছে মতি মাস্টারের দল । এ বাঁধ ভাঙতে দেবে না তারা। কিছুতেই না। তাদের সোনার ফসল ডুবতে দেবে না তারা কিছুতেই । কখনই না ।
ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আকশে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বাজ পড়ছে। সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বইছে। খরস্রোতা নদী ফুলে
ফেঁপে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। অমাবস্যার জোয়ার। নির্ঘাত বাঁধ ভেঙে পড়বে।
হায় খোদা! ঘরের বৌ-ঝিয়েরা করুণ আর্তনাদ করে ফরিয়াদ জানায় আকাশের দিকে চেয়ে। দুনিয়াতে ইমান বলে কিছু নেই, তাই, খোদা রাগ করেছেন। মানুষ গরু সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি । ধ্বংস করে দেবেন এই পৃথিবীটাকে, পাপে ভরা এই পৃথিবী ।
দুরু দুরু বুক কাঁপছে তিনজী মিঞার। চোখের জলে ভাসছেন জমির ব্যাপারী। আর ঢুলে ঢুলে তছবি পড়ছেন ।
হায়রে ফসল!
সোনার ফসল!
এ ফসল নষ্ট হতে পারে না । টর্চ হাতে ছুটোছুটি করছে মতি মাস্টার । কোদাল চালাও! আরো জোরে !
বাঁধে ফাটল ধরেছে। এ ফাটল বন্ধ করতেই হবে।
অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে কোদাল চালাচ্ছে ওরা।
মন্ত্র শেখ চিৎকার করে বললে, আলির নাম নাও ভাইয়া, আলির নাম নাও ।
আলির নামে কাম হইবো শেখের পো ? বললে বুড়ো কেরামত। তারছে একডা গান গাও। গায়ে জোস আইবো ।
মন্তু শেখ গান ধরলো।

গানের শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ বাজ পড়লো একটা কাছে কোথায়। কোদাল চালাতে চালাতে মতি মাস্টারকে আর তার চৌদ্দ পুরুষকে মনে মনে গাল দিতে লাগলো ছকু মুন্সি, খোদার সঙ্গে লাঠালাঠি। হা-খোদা, এই কি জমানা আইছে। খোদা, এই অধমের কোনো দোষ নাই । এই অধমেরে মাপ কইরা দিও । ঝুড়ি মাথায় বিড়বিড় করে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু, হাত-পা গুটাইয়া মসজিদে বইসা বইসা ঢল রুখবো না আমার মাথা রুখবো। তারপর হঠাৎ এক সময়ে মতি মাস্টারের গলার শব্দ শোনা গেল, আর ভয় নাই চাঁদু । আর ভয় নাই। এবার তোরা একটু জিরাইয়া নে! এতক্ষণে হাসি ফুটলো সবার মুখে। শ্রান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁধের ওপর এলিয়ে পড়লো অবশ দেহগুলো । পঞ্চাশটি ক্লান্ত মানুষ । সূর্য তখন পুব আকাশে উঁকি মারছে।
আধো আলো অন্ধকার আকাশ বেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তালে নাচছে সোনালি ফসল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো জমির বেপারী। ডোবেনি। ডুবতে দেননি পীর সাহেব ।
খুশিতে চক্‌চক্ করে উঠলো জমির মুন্সির চোখ দুটো। দৌড়ে এসে পীর সাহেবের পায়ে চুমু খেলেন গনি মোল্লা । ডোবেনি ডোবেনি। ফসল তাদের ডোবেনি। ডুবতে দেননি পীর সাহেব ।
এক মুহূর্তে যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সমস্ত গাঁ-টা। ছেলে বুড়ো সবাই হুমড়ি খেয়ে ধেয়ে আসছে পীর
সাহেবের পায়ে চুমু খাবার জন্যে। ঘুম চোখে তখনও ঢুলছেন পীর সাহেব। স্বল্প হেসে বললেন, খোদার
কুদরতের শান কে বলতে পারে ।
সাকরেদরা সমস্বরে বলে উঠলো, সারারাত না ঘুমাইয়া খোদারে ডাকছেন আমাগো পীর সাব। বাঁধ ভাঙ্গে সাধ্য কি?
পীর সাহেব তখনো হাসছেন। স্বল্প পরিমিত হাসি আপেলের রক্তিমাভার মতো ফেটে ছড়িয়ে পড়ছে মুখের সর্বত্র।

Content added By

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯শে আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। একজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে জহির রায়হান খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার। চারপাশের মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার চিত্র তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজের নানা বৈষম্য ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধেও তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ । হাজার বছর ধরে, বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার হিসেবেও জহির রায়হানের পরিচিতি রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের অল্পকাল পরেই ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ ও শহিদ হন। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।

Content added By

ওলাবিবি- প্রাচীন সমাজে পূজ্য কলেরা রোগের দেবী। তল্পিতল্পা - বিছানাপত্র বা অন্যান্য জিনিসপত্রের বোঁচকা। ভেংচি— উপহাসসূচক বিকৃত মুখভঙ্গি।

বাহাত্তর কথা- বাহাত্তর বছর বয়স্ক শক্তিহীন অকেজো বৃদ্ধের সংলাপ, বাজে কথা । সাকরেদ- শাগরেদ, চেলা, সহকারী । নাফরমান— অবাধ্য, আদেশ অমান্যকারী।

কাফের- সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, ইসলাম-বিরোধী লোক ।

Content added By

নেতৃত্ব, একতা এবং কর্মস্পৃহা সকল প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করতে পারে- জহির রায়হানের ‘বাঁধ’গল্পে সে কাহিনিই বিবৃত হয়েছে । গ্রামের একশ্রেণির মানুষ প্রচণ্ড রকমের দৈববিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে চেয়েছে। বর্ষার ঢল থেকে গ্রাম ও ফসলরক্ষাকারী বাঁধ রক্ষার জন্য জমির মুন্সির নেতৃত্বে তারা পীরের শরণাপন্ন হয়। পক্ষান্তরে মতি মাস্টারের নেতৃত্বে গ্রামের অপর একটি শ্রেণি ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে মাটি কেটে বাঁধকে সংহত ও মজবুত করে। এভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে গ্রামের মানুষ তাদের কষ্টের ও স্বপ্নের ফসল রক্ষা করে। অন্ধবিশ্বাস নয়, যুক্তি, বুদ্ধি ও কৌশল দিয়েই মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে হয়। ‘বাঁধ' গল্পটি আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।

Content added By

সংস্কৃতি বলতে আমরা সাধারণত সাহিত্য শিল্প নৃত্যগীতবাদ্য বুঝে থাকি। এগুলো সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ, তবে এগুলোই সংস্কৃতির সবটা নয়। সংস্কৃতি বলতে মুখ্যত দু'টো ব্যাপার বোঝায় : বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস-সংস্কৃতি। ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, আহারবিহার, জীবনযাপন প্রণালি— এসব বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্গত। আর সাহিত্যে-দর্শনে শিল্পে-সংগীতে মানসিক প্রবৃত্তির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তাকে বলা যায় মানস-সংস্কৃতি। বস্তুগত আর মানস-সংস্কৃতি মিলিয়েই কোনো দেশের বা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা অনেক পুরনো। এই সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মেলে, কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায়, উৎপাদন-পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গোটা উপমহাদেশের সঙ্গে। বাংলাভাষা ইন্দো- ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষা— এই গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাংলার অনেক রীতিনীতিরও মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই এলাকায়। আবার ধান-তেল-হলদি-পান- সুপারির ব্যবহারে মিল পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে। সেলাইছাড়া কাপড় পরার বিষয়েও বেশি মিল ঐ এলাকার সঙ্গে। এর কারণ, বাংলার আদি জনপ্রবাহ ছিল প্রাক-আর্য নরগোষ্ঠীসম্ভূত। পরে এর ওপরে আর্য জনগোষ্ঠী ও তাদের প্রভাব এসে পড়ে। সে প্রভাব এত তীব্র ছিল যে, তাই দেশজ উপকরণে পরিণত হয়। পরে মুসলমানরা যখন এদেশ জয় করলেন, তখন তাঁরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এলেন, তাতে তুর্কি-আরব-ইরান-মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশেল ছিল। সেখান থেকে অনেক কিছু এল বাঙালি সংস্কৃতিতে। তারপর এদেশে যখন ইউরোপীয়রা এলেন, তখন তাঁরা এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ ঘটালেন আরো একটি সংস্কৃতির। এভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক সংস্কৃতি- প্রবাহের দান এসে মিশেছে। আর নানা উৎসের দানে আমাদের সংস্কৃতি হয়েছে পুষ্ট।
বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিতে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন বাংলায় বিভিন্ন রাজত্ব যেমন স্থায়িত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি বাংলার এই বিচ্ছিন্নতার ফলে ধর্মমতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও উদ্ভাবন দেখা দিয়েছে। বাংলার সাহিত্য-সংগীতের

ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য গান ভিত্তি করে লেখা মনসামঙ্গল কাব্যের উদ্ভব পূর্ব-বঙ্গের জলাভূমিতে, পশ্চিম-বঙ্গের রুক্ষ মাটিতে বিকাশ বৈষ্ণব পদাবলীর। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি গানের বিস্তার, শুষ্ক উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়ার, আর বাংলা পশ্চিমাঞ্চলে কীর্তন ও বাউলের। শিল্পসামগ্রীর লভ্যতাও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল । তাই বাংলার স্থাপত্যে পাথরের চেয়ে ইট আর মাটির প্রাধান্য, মৃতফলক এখানকার অনন্য সৃষ্টি।
বাংলার ভাস্কর্যেও মাটির প্রাধান্য, আর সেই সঙ্গে দেখা যায় এক ধরনের সামগ্রীর ওপরে অন্য ধরনের সামগ্রীর উপযোগী শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস ।
অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাংলার মানস-সংস্কৃতি প্রধানত আশ্রয় করেছে সাহিত্য ও সংগীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে। স্বল্প হলেও স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার দান আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতের সাধনার তেমন ঐতিহ্য বাংলায় গড়ে ওঠেনি ।
ফলিত বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্রে— আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বাংলার একটা ভূমিকা ছিল, কিন্তু তাও ছিল সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলার অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল মূলত কারুশিল্পে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই কারুশিল্প বিকশিত হলেও এর প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি । প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয়েছে ইংরেজ আমলে । তবে সে প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব সৃষ্টি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে ধার করা।
বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হতে থাকে খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। এই স্বাতন্ত্র্য দেখা দেয় শাসন-ব্যবস্থায়, সামাজিক জীবনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও লিপির বিকাশ সে স্বাতন্ত্র্যকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। বহিরাগত মুসলমানরা এদেশ জয় করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে। মুসলমান শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে তার বিকাশে সহায়তা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে মুঘলরা বাংলাদেশ জয় করেন। মুঘল আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আগের মতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি, তবে একটা বৃহত্তর পরিবেশের সঙ্গে তখন বাংলার সংস্কৃতির যোগ ঘটে। তারপর আঠারো শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে যোগাযোগের পরিধি আরো বিস্তৃত হয়; বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার যোগ সাধিত হয়।
ঐ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চবর্গের সংস্কৃতির সঙ্গে নিম্নবর্গের সংস্কৃতির কিছু কিছু ভেদ ছিল । কারুশিল্পের ক্ষেত্রে ভেদটা খুব চোখে পড়ে। এর একটা ধারা ছিল উচ্চ শ্রেণির ভোগ্য- রুপোর কাজ, হাতির দাঁতের কাজ, রেশমী ও উঁচু মানের সুতি কাপড়ের শিল্প; অন্য ধারাটা ছিল সাধারণের ভোগ্য— শাঁখের ও পিতলের কাজ, নকশী কাঁথা, পাটি, আলপনা। সমাজে উঁচু পর্যায়ে সংস্কৃত বা ফারসির যে-চর্চা হতো তা নিচু স্তরকে স্পর্শ করে নি। ধ্রুপদী সংগীত ও লোকসংগীত চর্চার মধ্যেও এমনি পার্থক্য ছিল। লোকসাহিত্য ও শিষ্ট সাহিত্যের ভেদও ছিল। তবে বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীত সমাজের প্রায় সকল স্তরকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছিল। এইজন্যে বাংলার মানস-সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রাধান্য সাহিত্য ও সঙ্গীতের।

ইংরেজ আমলে যে নতুন সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে, তার প্রেরণা এসেছিল প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে। পাশ্চাত্য শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের যোগ ঘটেনি, তারা এর বিকাশে এবং এর উপভোগ্যতায়ও অংশ নিতে পারে নি। একালের সাহিত্য-সংগীত-নাটক-চিত্রকলা প্রধানত নগরের সৃষ্টি। এর অর্থ আমাদের মানস-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপ নির্মিত হয় উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মুষ্টিমেয় ইংরেজি শিক্ষিতের হাতে। ঔপনিবেশিক নয়, কিন্তু আগের মতোই শ্রেণিবিভক্ত। তাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সকলের অধিকার সমান নয় এবং এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতিতে অন্য শ্রেণির প্রবেশাধিকার নেই; আবার এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতি অন্য শ্রেণির পক্ষে রুচিকর নয়। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলে এই অবস্থার কোনো বদল আশা করা যায় না ।
আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতিকে এক অর্থে ধর্মমুখী বলা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্য বা মঙ্গলকাব্য, ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা বা নবিজীবনী, কীর্তন বা শ্যামাসংগীত তার উদাহরণ । এমনকি অধ্যাত্ম-তত্ত্বাশ্রিত প্রণয়োপাখ্যানও এর মধ্যে ধরা যায় । তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় । প্ৰথমত, বাংলার সাহিত্য ও সংগীতে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের বক্তব্য একই সঙ্গে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মকলহের পাশাপাশি এক ধরনের সমন্বয়- চেতনা কাজ করেছে- যোগ ও সুফিবাদের সমন্বয় আর বাউল গান তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তৃতীয়ত, এর সবক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বস্তুর চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানবিকতা। বৈষ্ণব কবিতা বা আধ্যাত্মিক প্রণয়কাহিনি তত্ত্বের চেয়ে প্রেমের কাহিনিরূপেই আদৃত হয়েছে, মঙ্গলকাব্যে দেবতার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে মানুষ। অবৈষ্ণব কবি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ লিখেছেন, অমুসলমান কবি লিখেছেন কারবালা-কাহিনি ।
এই মানবিকতাকে যদি বাঙালি সংস্কৃতির একটা মুখ্য প্রকাশ বলে গণ্য করি, তাহলে উনিশ-বিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতিতে সেই মানববাদের বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করি। পুরনো ধারার সংস্কৃতিতে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ আছে। একালের সংস্কৃতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা সরবে শোনা যায়। এই দিক দিয়ে দেখলে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় মানবকল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি সুস্পষ্ট পক্ষপাত ফুটে উঠেছে। আমাদের সংস্কৃতির বিচিত্র রূপ নিয়ে যেমন আমরা গর্ব করতে পারি, তেমনি তার এই ভাববস্তুও আমাদের গৌরবের বিষয়।

Content added By

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. এ.টি.এ.এম. মোয়াজ্জম, মাতা সৈয়দা খাতুন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গবেষক ও প্রাবন্ধিক । তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র, স্বরূপের সন্ধানে, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, পুরোনো বাংলা গদ্য, বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে ইত্যাদি। সাহিত্য ও গবেষণায় কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ প্রচুর সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০২০ সালের ১৪ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

প্রবৃত্তি- অভ্যাস, অভিরুচি। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী- পৃথিবীর ভাষাসমূহকে তাদের উৎপত্তি অনুসারে কয়েকটি পরিবারে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী অন্যতম। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি প্রধান ভাষাগুলো এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। নৃ-তাত্ত্বিক- জাতি গোষ্ঠী সম্পর্কিত। আর্য নরগোষ্ঠী - প্রাচীন ইরাক-ইরান অঞ্চল থেকে আগত জনগোষ্ঠী। মনসামঙ্গল- মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস রচিত কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে সাপের দেবী মনসার বন্দনা করা হয়েছে। বৈষ্ণবপদাবলি- মধ্যযুগে রচিত ভক্তিমূলক কবিতা। কবি জয়দেব বৈষ্ণবপদাবলির বিখ্যাত কবি। আয়ুর্বেদ- দেশজ চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থ। কারুশিল্প - হস্তনির্মিত শিল্প যা একাধারে সুন্দর ও প্রাত্যহিক কাজে লাগে। সপ্তম- অষ্টম শতাব্দী-৬০০-৭০০ শতাব্দী। সুফিবাদ - মুসলিম ধর্মীয় মতবাদ বিশেষ।

Content added By

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের উৎসব (২০০৮) গ্রন্থ থেকে প্রবন্ধটি সংকলিত। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। আদিকাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতিতে যোগ হয়েছে বিশ্বের নানা জাতির সংস্কৃতি। এতে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। তা সত্ত্বেও বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিকে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। আর তা হলো আমাদের লোকসংস্কৃতি । আমাদের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, মাটির ভাস্কর্য, কারুশিল্প, বয়ন শিল্পের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। মূলত ‘আমাদের সংস্কৃতি' প্রবন্ধে উপস্থাপিত হয়েছে বাঙালি ও বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। এ প্রবন্ধ আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি, মানবিকতাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিদ্রোহী ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

Content added By

সাহিত্য বিশাল পরিধির একটি বিষয়। আমরা সামগ্রিকভাবে ‘সাহিত্য' বলি বটে, কিন্তু বিচারের সময়ে গদ্য, পদ্য কিংবা গল্প উপন্যাস কবিতা নাটক ইত্যাদি স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে হৃদয়ঙ্গম করি। সার্বিকভাবে সাহিত্যের রূপ বলতে আমরা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বুঝে থাকি, যেমন- কবিতা, মহাকাব্য, নাটক, কাব্যনাট্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা ইত্যাদি। আর ‘রীতি’ হলো ঐ শাখাগুলো কীভাবে নির্মিত হয়েছে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা ।
কবিতা
ছন্দোবদ্ধ ভাষায়, অর্থাৎ পদ্যে, যা লিখিত হয় তাকেই আমরা 'কবিতা' বলে থাকি। কবিতার প্রধান দুটি রূপভেদ হলো—মহাকাব্য ও গীতিকবিতা। বাংলা ভাষায় মহাকাব্যের চূড়ান্ত সফল রূপ প্রকাশ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদ-বধ কাব্যে । মহাকাব্য রচিত হয় যুদ্ধবিগ্রহের কোনো কাহিনী অবলম্বন করে। ভারতবর্ষ উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন দুটি কাহিনির একটি হলো রামায়ণ আর অন্যটি মহাভারত। মহাভারত সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে—'যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে', এর অর্থ : মহাভারত গ্রন্থে যা নেই তা ভারতবর্ষেও নেই অর্থাৎ ভারতবর্ষে ঘটেনি বা ঘটতে পারে না। মহাভারত আয়তনে বিশাল। রামায়ণ তার তুলনায় ক্ষুদ্র; কাহিনি হলো : পত্নী সীতাকে নিয়ে যুবরাজ রামচন্দ্রের বনবাস, তাঁদের অনুগামী হয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণ; বনবাসে থাকার সময়ে লঙ্কা দ্বীপের রাজা রাবণ তার বোন শূর্পণখার সম্মান রক্ষার জন্য সীতাকে হরণ করে রথে চড়িয়ে আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে লঙ্কায় তার বাগানবাড়িতে বন্দি করে রাখে। সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম ও রাবণের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় সেটিই রামায়ণ-কথা। অর্থাৎ এককথা, মহাকাব্য হলো অতিশয় দীর্ঘ কাহিনি-কবিতা। মহাকাব্যের মূল লক্ষ্য গল্প বলা, তবে তাকে গদ্যে না লিখে পদ্যে লিখতে হয়। এর বাইরে আছে সংক্ষিপ্ত আকারের কবিতা, যা ‘গীতিকবিতা' হিসেবে পরিচিত। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্ৰ কিছু গান ও কবিতা রচনা করলেও তা তাঁর প্রধান সৃষ্টিকর্ম নয়। তিনি বলেছিলেন : ‘বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।' এই মন্তব্য সর্বাংশে সত্য । গীতিকবিতা কবির অনুভূতির প্রকাশ হওয়ায় সাধারণত দীর্ঘকায় হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে যদি দীর্ঘও হয় তাতেও অসুবিধে নেই, যদি কবির মনের পূর্ণ অভিব্যক্তি সেখানে প্রকাশিত হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার আদি নিদর্শন বৈষ্ণব কবিতাবলি ।
যদি গীতিকবিতাকে শ্রেণিবিভাজনের অন্তর্গত করতেই হয়, তাহলে এ রকম শ্রেণিবিভাগ করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় : ভক্তিমূলক (যেমন- রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রামপ্রসাদ, রজনীকান্তের রচনা), স্বদেশপ্রীতিমূলক (যেমন- বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দে মাতরম', রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা-গান), প্রেমমূলক, প্রকৃতিবিষয়ক চিন্তামূলক বা দর্শনাশ্রয়ী কবিতা। শোক-গাথা বা শোক আশ্রয় করে লিখিত কবিতাও এর সমপর্যায়ভুক্ত।
বাংলা কবিতায় বিশেষ দুটি ধারার জনক কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন। প্রথম জন আমাদের সাহিত্যে ‘বিদ্রোহী কবি’ ও দ্বিতীয় জন ‘পল্লিকবি’ হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। নজরুলের কবিতায় যে উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর ও দৃপ্ত ভাবের দেখা মেলে তা পূর্বে বাংলা কাব্যে ছিল না। জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ ও সোজনবাদিয়ার ঘাট জাতীয় কোনো কাব্য পূর্বে কেউ রচনা করেন নি এবং এক্ষেত্রে তাঁর অনুসারীও কেউ নেই ৷
নাটক
বিশ্বসাহিত্যে নাটক সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। তবে মনে রাখা দরকার, নাটক সেকালে পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়ে (তখন তো ছাপাখানা ছিল না) ঘরে ঘরে পঠিত হতো না,নাটক অভিনীত হতো। নাটকের লক্ষ্য পাঠক নয়, নাটকের লক্ষ্য সর্বকালেই দর্শকসমাজ। তার কারণ সাহিত্যের সকল শাখার ভিতরে নাটকই একমাত্র যা সরাসরি সমাজকে ও পাঠকগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে চায় এবং সক্ষমও হয় ।
সংস্কৃত আলঙ্কারিকবৃন্দ নাট্যসাহিত্যকে কাব্যসাহিত্যের মধ্যে গণ্য করেছেন। প্রাচীনকালে সে রকমই প্রথা ছিল। যেমন, শেক্সপীয়রও তাঁর সকল নাটক কবিতায় রচনা করেছেন। সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে কাব্য দুই ধরনের : দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্য। নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য, সেহেতু নাটকের অভিনয় মানুষজনকে দর্শন করানো সম্ভবপর না হলে নাট্যরচনার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয় ।
নাটক সচরাচর পাঁচ অঙ্কে বিভক্ত থাকে : ১. প্রারম্ভ, ২. প্রবাহ (অর্থাৎ কাহিনির অগ্রগতি), ৩. উৎকর্ষ বা Climax, ৪. গ্রন্থিমোচন (অর্থাৎ পরিণতির দিকে উত্তরণ), ৫. উপসংহার।
কাহিনীর বিষয়বস্তু ও পরিণতির দিক থেকে বিচার করলে নাটককে প্রধানত ট্র্যাজেডি (Tragedy বা বিয়োগান্ত নাটক), কমেডি (Comedy বা মিলনান্ত নাটক) এবং প্রহসন (Farce)- এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা যায়। এদের মধ্যে ট্র্যাজেডিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ গণ্য করা হয়। ট্র্যাজেডির ভিতরে দুইটি অংশ ক্রিয়াশীল থাকে : প্লট (Plot বা নাটকের আখ্যানভাগ), চরিত্রসৃষ্টি, সংলাপ, চিন্তা বা জীবনদর্শনের পরিস্ফুটন, মঞ্চায়ন, সমস্ত কিছুর সমন্বয়ে সুরসঙ্গতি। গ্রিক দার্শনিক ও সাহিত্যবেত্তা এরিস্টোটল বলতে চেয়েছেন, রঙ্গমঞ্চে নায়ক বা নায়িকার জীবনকাহিনীর দৃশ্যপরম্পরা উপস্থাপনের মাধ্যমে যে নাটক দর্শকের হৃদয়ের ভয় ও করুণা প্রশমিত করে তার মনে করুণ রসের আনন্দ সৃষ্টি করে, তাই হলো ট্র্যাজেডি।কমেডি বিষয়ে এরিস্টোটলের বক্তব্য এ রকম : মানবচরিত্রের যে কৌতুকপ্রদ দিক কাউকে পীড়ন করে না, ব্যথা দেয় না, হাস্যরস সৃষ্টি করে, তা-ই কমেডির উপজীব্য। এই কৌতুকের জন্ম ইচ্ছার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগের, উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায়ের বা কথার সঙ্গে কাজের অসঙ্গতির মধ্যে। কমেডি আমাদের মানবসুলভ ত্রুটিবিচ্যুতি ও নির্বুদ্ধিতার পরিণাম প্রদর্শন করে অশোভন দুর্বলতার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে আমাদেরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তোলে ।
শ্রেণিবিন্যাসের বিবেচনায় নাটককে বহু শ্রেণিতে বিভক্ত করা সম্ভব। যেমন- ধ্রুপদী (বা ক্ল্যাসিক্যাল) নাটক, রোম্যান্টিক নাটক। অথবা ধরা যাক— কাব্যধর্মী নাটক, সামাজিক নাটক, চক্রান্তমূলক নাটক, ঐতিহাসিক নাটক, পৌরাণিক নাটক, প্রহসন। এসব ব্যতিরেকেও হতে পারে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, চরিতনাটক, উপন্যাসের নাট্যরূপ, সাংকেতিক নাটক, সমস্যাপ্রধান নাটক, একাঙ্কিকা ইত্যাদি । ট্র্যাজেডি ও কমেডি-মোটা দাগে এই দুইটি বিভাজন তো রয়েছেই ।
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে প্রথম যুগান্তকারী প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং দীনবন্ধু মিত্র । মাইকেলের লেখনীতেই সর্বপ্রথম ট্র্যাজেডি, কমেডি ও প্রহসন বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয়। তারপর দীনবন্ধু আবির্ভূত হন সামাজিক নাটক নিয়ে। তাঁর নীলদর্পণ নাটক এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। পরবর্তী সময়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২) একইসঙ্গে নাট্যকার ও অভিনেতা ছিলেন। তিনি পৌরাণিক নাটক (জনা, বুদ্ধদেব) ঐতিহাসিক নাটক (কালাপাহাড়), সামাজিক নাটক (প্রফুল্ল) ইত্যাদি রচনা করেছেন।
এরপর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) ঐতিহাসিক নাটক 'চন্দ্রগুপ্ত' ও 'শাজাহান' বাঙালি দর্শকদের হৃদয় জয় করে নেয়। তাঁর সমসাময়িকগণের মধ্যে অমৃতলাল বসু, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ উল্লেখযোগ্য। আর তার পরেই আবির্ভাব কবি রবীন্দ্রনাথের, যিনি বাংলা নাটকেরও মোড় ঘুরিয়ে দেন নানা দিকে : রক্তকরবী, ডাকঘর, অরূপরতন প্রতীকধর্মী নাটক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী হয়ে রয়েছে।
ছোটোগল্প
রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি কবিতায় যা বলেছিলেন সে-কথাটি ছোটোগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও প্রামাণ্য ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। তিনি লিখেছিলেন :

ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা          ছোট ছোট দুঃখ কথা

                     নিতান্তই সহজ সরল

সহস্র বিস্মৃতি রাশি              প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

                তারি দুচারিটি অশ্রুজল ।

নাহি বর্ণনার ছটা                ঘটনার ঘনঘটা

                নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ

অন্তরে অতৃপ্তি রবে           সাঙ্গ করি মনে হবে

                শেষ হয়ে হইল না শেষ ।

‘শেষ হয়ে হইল না শেষ'-কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ-কথার ভিতরেই বলে দেওয়া হলো যে, ছোটোগল্প কখনোই কাহিনির ভিতরে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে দেয় না- যেমনটা ঘটে উপন্যাসের ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যে ‘ছোটোগল্প' শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসরের বেশি নয়। তার পূর্বে শুধু ‘গল্প’ বলা হতো। বড়ো আকারের গল্প হলে ‘উপন্যাসিকা' কথা চল ছিল, অর্থাৎ ছোট উপন্যাস। সাহিত্যের যত শাখা আছে, যেমন কাব্য মহাকাব্য নাটক উপন্যাস ইত্যাদি, সে-সবের মধ্যে ছোটোগল্পই হচ্ছে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ। ছোটোগল্পেও থাকে উপন্যাসের মতোই কোনো-না-কোনো কাহিনির বর্ণনা, তবে তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নয়, কাহিনির ভিতরে থেকেই বেছে নেওয়া কোনো অংশ থাকে মাত্র ।
ইংরেজি সাহিত্যের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলায় যেমন উপন্যাস লিখিত হয়েছে, ছোটগল্পেরও অনুপ্রেরণা এসেছে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকেই। ‘ছোটোগল্প' বলতে কোন ধরনের কাহিনি বোঝাবে সে বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন ছোটোগল্পকার এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯) মনে করতেন আধ ঘণ্টা থেকে দু-এক ঘণ্টার মধ্যে পড়ে ওঠা যায় এমন কাহিনিই ‘ছোটোগল্প'। ইংরেজ লেখক এইচ. জি. ওয়েল্স্ বলতেন যে ছোটোগল্পের আয়তন এমন হওয়া সঙ্গত যেন ১০ থেকে ৫০ মিনিটের ভিতরে পড়া শেষ হয় । ইংরেজি ভাষায় পো-কে ছোটোগল্পের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তিনি লিখেছেন : In the whole composition there should be no word written of which the tendency, direct or indirect, is not to the one pre-established design. undue brevity is just as exceptional here as in the poem, but undue length is yet more to be avoided.
বলাই বাহুল্য, উপন্যাসে যেমন বিস্তারিতভাবে কাহিনি বর্ণনা থাকে, ছোটোগল্পের পরিধি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন সেখানে সম্ভব নয় এবং অপ্রয়োজনীয়ও বটে। সাহিত্য গবেষক শ্রীশচন্দ্ৰ দাশ যথার্থই বলেছেন: ‘আসল কথা এই যে, ছোটোগল্প আকারে ছোটো হইবে বলিয়া ইহাতে জীবনের পূর্ণাবয়ব আলোচনা থাকিতে পারে না, জীবনের খণ্ডাংশকে লেখক যখন রস-নিবিড় করিয়া ফুটাইতে পারেন, তখনই ইহার সার্থকতা। জীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্যে কেমনভাবে লেখকের কাছে প্রত্যক্ষ হইয়াছে, ইহা তাহারই রূপায়ণ। আকারে ছোটো বলিয়া এখানে বহু ঘটনা- সমাবেশ বা বহু পাত্রপাত্রীর ভিড় সম্ভবপর নহে। ছোটোগল্পের আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয় হওয়া চাই। সত্য কথা বলিতে কি, কোথায় আরম্ভ করিতে হইবে এবং কোথায় সমাপ্তির রেখা টানিতে হইবে, এই শিল্পদৃষ্টি যাহার নাই তাহার পক্ষে ছোটোগল্প লেখা লাঞ্ছনা বই কিছুই নহে।' বাংলা ভাষায় সার্থক ছোটোগল্পকারের অনন্য দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ ।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে ছোটোগল্প বহুপ্রকার হতে পারে। সাধারণত শ্রেণিবিভাগ হিসেবে এগুলোকে
উল্লেখ করা যায় : ১. প্রেমবিষয়ক, ২. সামাজিক, ৩. প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে, ৪. অতিপ্রাকৃত কাহিনী, ৫. হাস্যরসাত্মক, ৬. উদ্ভট কল্পনাশ্রয়ী, ৭. সাঙ্কেতিক বা প্রতীকধর্মী, ৮. ঐতিহাসিক, ৯. বিজ্ঞানভিত্তিক, ১০. গার্হস্থ্য বিষয়ক, ১১. মনস্তাত্ত্বিক, ১২. মনুষ্যেতর প্রাণিজগৎ, ১৩. বাস্তবনিষ্ঠ, ১৪. গোয়েন্দাকাহিনী বা ডিটেকটিভ গল্প, ১৫. বিদেশি পটভূমিকায় রচিত গল্প । আমাদের জন্য গর্বের বিষয় এটাই যে, বাংলা ভাষায় উপরোক্ত সব ক'টি শ্রেণির গল্পই বাঙালি
গল্পলেখকবৃন্দ লিখে গেছেন ও এখনো লিখছেন ।

উপন্যাস
সাহিত্যের শাখা-প্রশাখার মধ্যে উপন্যাস অন্যতম। শুধু তাই নয়, পাঠক সমাজে উপন্যাসই সৰ্বাধিক বহুল পঠিত ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। উপন্যাসে কোনো একটি কাহিনি বর্ণিত হয়ে থাকে এবং কাহিনিটি গদ্যে লিখিত হয়। কিন্তু পূর্বে এমন এক সময় ছিল যখন কাহিনি পদ্যে লেখা হতো; তখন অবশ্য তাকে উপন্যাস বলা হত না। যেমন বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সব ধরনের মঙ্গলকাব্যই ছন্দে রচিত এবং তাতে গল্প বা কাহিনিই প্রকাশিত হয়েছে, তবু তাকে উপন্যাস না বলে কাব্যই বলা হতো—যেহেতু কবিতার ন্যায় তা ছন্দে রচিত হয়েছে। উপন্যাস রচিত হয় গদ্যভাষায়, এই তথ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । ছন্দোবদ্ধ রচনার অনেক পরে যেহেতু গদ্যের আবির্ভাব তাই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেই গদ্যে কাহিনী লেখা হয়েছে, যেমন— গল্প বা ছোটোগল্প, উপন্যাস, রম্যকাহিনি ইত্যাদি। উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য হলো প্লট (Plot)। ঐ প্লট বা আখ্যানভাগ তৈরি হয়ে ওঠে গল্প ও তার ভিতরে উপস্থিত বিভিন্ন চরিত্রের সমন্বয়ে ।
বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ও কালজয়ী (এবং অনেকের মতে এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ) ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উনিশ শতকের পূর্বে বাংলায় কোনো উপন্যাস রচিত হয়নি। ইংরেজি উপন্যাস পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্কিম উপন্যাস রচনায় হাত দেন। তাঁর কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর ইত্যাদি কালজয়ী কথাসাহিত্য। বঙ্কিমচন্দ্রের পরে মহৎ ঔপন্যাসিক বলতে আমরা প্রধানত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বুঝি। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে যেখানে যত বাঙালি রয়েছে তাদের ভিতরে শরৎচন্দ্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পঠিত ও জনপ্রিয়।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে অবশ্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, সমরেশ বসু, শহীদুল্লা কায়সার, আবু ইসহাক, মাহমুদুল হক,জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ বিভিন্ন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক খ্যাতি অর্জন করেছেন । উপন্যাস বহু রকমের হতে পারে। যেমন— ঐতিহাসিক উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, কাব্যধর্মী উপন্যাস, ডিটেকটিভ উপন্যাস, মনোবিশ্লেষণধর্মী উপন্যাস ইত্যাদি।
বঙ্কিমচন্দ্রের সমকালে ঐতিহাসিক উপন্যাস খুব জনপ্রিয় ছিল। তাঁর সমসাময়িক রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁরই মতো বহু ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস রচনা করেছিলেন— যেমন মাধবী-কঙ্কণ, রাজপুত-জীবনসন্ধ্যা, মহারাষ্ট্র-জীবনপ্রভাত ইত্যাদি ।
তবে তাঁর সমসাময়িক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেভাবে বাঙালি পাঠকসমাজকে মন্ত্রমুগ্ধ করে জয় করে নেন, তার সমকক্ষ আর কাউকে দেখা যায় না ।
প্রবন্ধ
আমরা সকলেই অস্পষ্টভাবে বুঝি ‘প্রবন্ধ' কাকে বলে বা কী রকম। গদ্যে লিখিত এমন রচনা যার উদ্দেশ্য পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণাকে পরিতৃপ্ত করা। কোনো সন্দেহ নেই, এ জাতীয় লেখায় তথ্যের প্রাধান্য থাকবে যার ফলে অজ্ঞাত তথ্যাদি পাঠক জানতে পারবে। ধরা যাক, সংবাদপত্রের যাবতীয় খবরাখবর-দেশের, বিদেশের, মহাকাশের ইত্যাদি। সবই গদ্য ভাষায় রচিত এবং যার লক্ষ্য পাঠকের অজানা বিষয় পাঠককে জানানো। গদ্যসাহিত্যের অন্তর্গত হলেও তথ্যবহুল রচনা হলেই তাকে প্রবন্ধসাহিত্যের উদাহরণরূপে গণ্য করা চলবে না, যদি-না লেখাটি সাহিত্য পদবাচ্য হয়। সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ সৃজনশীলতা। লেখকের সৃজনীশক্তির কোনো পরিচয় যদি পরিস্ফুটিত না হয়, তো তেমন কোনো লেখাকে প্রবন্ধসাহিত্যের লক্ষণযুক্ত বলা যাবে না। এ-কারণে খবরের কাগজে প্রকাশিত সমস্ত লেখাই গদ্যে রচিত হলেও তাদেরকে প্রবন্ধসাহিত্যের নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত নয়। তাহলে তো জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত সকল রচনাই প্রবন্ধসাহিত্য বলে গণ্য হতে পারত। তা না হওয়ার কারণ ঐ সৃজনশীলতার অভাব ।
মনে রাখা প্রয়োজন : সাহিত্যের যা চিরন্তন উদ্দেশ্য— সৌন্দর্যসৃষ্টি ও আনন্দদান, প্রবন্ধের সেই একই উদ্দেশ্য। সাধারণত কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে আশ্রয় করে লেখক কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে যে আত্মসচেতন নাতিদীর্ঘ সাহিত্য-রূপ সৃষ্টি করেন তাকেই ‘প্রবন্ধ' নামে অভিহিত করা হয়। প্রবন্ধের ভাষা ও দৈর্ঘ্য নানা রকম হতে পারে ঠিকই, তবে তা গদ্যে ও নাতিদীর্ঘ আকারে লিখিত হয় ।
প্রবন্ধের দুটি মুখ্য শ্রেণিবিভাগ আছে : তন্ময় (objective) প্রবন্ধ ও মন্ময় (subjective) প্রবন্ধ । বিষয়বস্তুর প্রাধান্য স্বীকার করে যে-সকল বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখিত হয় সেগুলোকে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে। এ ধরনের প্রবন্ধ কোনো সুনির্দিষ্ট সুচিন্তিত চৌহদ্দি বা সীমারেখার মধ্যে আদি, মধ্য ও অন্ত-সমন্বিত চিন্তাপ্রধান সৃষ্টি। এ জাতীয় রচনায় লেখকের পাণ্ডিত্য, বুদ্ধি ও জ্ঞানের পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দেখা দেয়।
আরেক শ্রেণির রচনাও সম্ভব যেখানে লেখকের মেধাশক্তি অপেক্ষা ব্যক্তিহৃদয়ই প্রধান হয়ে ওঠে। এদেরকে মন্ময় প্রবন্ধ বলে। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ প্রবন্ধ এই পর্যায়ের। ফরাসি ভাষায় বেল্ লের্ (belle letre) বলে একটি শব্দ আছে, ইংরেজিতেও বেল্ লেই বলে। এর বাংলা নেই। বাংলায় বলা যেতে পারে চারুকথন। বেল্ শব্দের অর্থ-সুন্দর, চমৎকার। আর লেহ্ অর্থ— letter, অক্ষর। বেল্ লের্ মন্ময় প্রবন্ধের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের 'বিচিত্র প্রবন্ধ' বইটির সকল রচনাই এ জাতীয় মন্ময় প্রবন্ধের পর্যায়ভুক্ত। অনেকে এ ধরনের লেখাকে ‘ব্যক্তিগত প্রবন্ধ' বলারও পক্ষপাতী। ‘রম্য রচনা' নামে একটা কথা অনেক দিন যাবত ব্যক্তিগত প্রবন্ধ বোঝাতে চালু হলেও দুটি একজাতীয় লেখা নয়। বেল্-লের্ বোঝাতে ‘রম্য রচনা’ ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ ‘রম্য রচনা' শব্দদ্বয়ের ‘রম্য' শব্দের ভিতরে এমন ইঙ্গিত রয়ে যায় যে, লেখাটি সিরিয়াস বা গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে নয়, অথচ রম্যরচনার বিষয় খুবই গুরুগম্ভীর হতে পারে, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা গুরুগম্ভীর হলে চলবে না ।
বাংলা ভাষায় রচিত প্রবন্ধসাহিত্য আয়তনে বিশাল এবং গুণগত মানে অতি উত্তম। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি তার প্রবহমানতা কখনো ব্যাহত বা বাধাপ্রাপ্ত হয় নি।

Content added By

হায়াৎ মামুদ ২রা জুলাই ১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মৌড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা গেণ্ডারিয়া অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। তাঁর পিতা মুহম্মদ শমসের আলী এবং মাতা আমিনা খাতুন। হায়াৎ মামুদ ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজ (বর্তমানে সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন । কর্মজীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষে অবসর জীবন যাপন করছেন। কবিতা ও গল্প লেখা দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে গবেষণা ও প্রবন্ধ সাহিত্যে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি অর্ধশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : স্বগত সংলাপ, প্রেম অপ্রেম নিয়ে বেঁচে আছি (কাব্যগ্রন্থ), রবীন্দ্রনাথ কিশোর জীবনী, নজরুল ইসলাম : কিশোর জীবনী, প্রতিভার খেলা, নজরুল, বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই, বাংলা লেখার নিয়মকানুন, কিশোর বাংলা অভিধান ইত্যাদি। সাহিত্যক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

Content added By

মেঘনাদ বধ কাব্য - কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত আধুনিক বাংলা মহাকাব্য। রামায়ণ- প্রাচীন ভারতবর্ষে রচিত মহাকাব্য। মহাভারত - প্রাচীন ভারতবর্ষে রচিত মহাকাব্য। যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে— যা মহাভারতে নেই তা ভারতবর্ষের কোথাও নেই— এমন বোঝানো হয়েছে। লঙ্কা দ্বীপ- সিংহল দ্বীপ, বর্তমান নাম শ্রীলঙ্কা। অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)- জন্ম ঢাকায় ১৮৭১-এর ২০শে অক্টোবর এবং মৃত্যু লখনৌ শহরে ১৯৩৪ সালের ২৬শে আগস্ট । ব্রাহ্মণ ছিলেন। ব্যারিস্টারি পাস করে স্বাধীনভাবে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। সংগীত রচনার জন্য বাঙালির সংস্কৃতিজগতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর ভক্তিগীতি ও দেশাত্মবোধক গান অদ্যাবধি জনপ্রিয়। অরূপরতন- রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটক।

এইচ. জি. ওয়েল্‌স্ (১৮৬৬-১৯৪৬) : ইংরেজি ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর স্রষ্টা। একাঙ্কিকা- এক অঙ্কের নাটককে বলা হয়। এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-৪৯) - আমেরিকার কবি, গল্পকার ও সমালোচক। এরিস্টোট্ল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২ অব্দ)- গ্রিক দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। কপালকুণ্ডলা— ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস, উপন্যাসের নামকরণ হয়েছে নায়িকার নামে। কালাপাহাড়—একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দুধর্মবিদ্বেষী এক সেনাপতি, দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২)- বাংলা নাটকের যুগন্ধর পুরুষ। নাট্যরচনার পাশাপাশি অভিনয় ও করতেন। অভিনেতা হিসেবেও অভূতপূর্ব সুনাম অর্জন করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত- প্রাচীন ভারতবর্ষের এক বিখ্যাত নৃপতি, রাজত্বকাল ৩২০ থেকে ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দ, কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩- ১৯১৩) বিখ্যাত নাটক 'চন্দ্রগুপ্ত' ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয়।

চন্দ্রশেখর - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস; জনা— পৌরাণিক নাটক। ডাকঘর- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও গল্পাকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) - কবি, নাট্যকার ও সংগীত রচয়িতা, তাঁর ‘শাজাহান’ ও ‘চন্দ্রগুপ্ত” অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক; দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০ - ৭৩) - বাংলা নাট্যসাহিত্যের যুগস্রষ্টা লেখক, ‘নীলদর্পণ' তাঁর সর্বাধিক খ্যাত নাটক, ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়, ‘সধবার একাদশী' তাঁর বিখ্যাত প্রহসন। রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) — সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বরচিত গানের সুকণ্ঠ গায়ক ছিলেন। তাঁর দেশাত্মবোধক গান বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

রমেশচন্দ্ৰ দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)— কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম বাঙালি কমিশনার। খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। বঙ্গবিজেতা, মাধবীকঙ্কন, জীবন-প্রভাত, জীবন-সন্ধ্যা, সংসার, সমাজ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা' রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস; রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)- পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সমাজ-সংস্কারক, ধর্মসংস্কারক ও বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত। বাংলা গদ্যের প্রস্তুতিপর্বের শিল্পী। বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, গৌড়ীয় ব্যাকরণ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)- আধনিক বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। দৃশ্যকাব্য- প্রাচীন অলংকারশাস্ত্রে নাটককে দৃশ্যকাব্য বলা হয়ে থাকে। নকশীকাঁথার মাঠ— পল্লিকবি জসীম উদ্দীন রচিত আখ্যান কাব্য।

নীলদর্পণ— দীনবন্ধু মিত্রের নাটক, দেশের তৎকালীন শাসনকর্তা ব্রিটিশদের হুকুমে বাধ্যতামূলক নীলচাষ করানোর সমালোচনা করে এই নাটক রচিত হয়েছিল। পৌরাণিক নাটক- ভারতবর্ষীয় পুরাণের কোনো কাহিনী অবলম্বনে রচিত নাটক। প্রফুল্ল- নাট্যকার ও অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা নাটক। প্রহসন- উপন্যাস বা নাটকের রচনাশৈলী অবলম্বনে হাস্যরসাত্মক রচনা। প্লট— গল্প উপন্যাস নাটকের কাহিনী অংশকে প্লট বলা হয়। বনফুল— গল্পকার ও ঔপন্যাসিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম বা লেখক নাম। বন্দে মাতরম - এই দু শব্দের অর্থ জননীকে অর্থাৎ মাকে বন্দনা করি, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে স্বরচিত এই গানটি যুক্ত করেছেন। বিচিত্র প্রবন্ধ— রবীন্দ্রনাথ রচিত একটি প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ। বিষবৃক্ষ- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস। বুদ্ধদেব- পৌরাণিক নাটক। বৈষ্ণব কবিতা— প্রাচীন বাংলাদেশে প্রচলিত গীতিকবিতা ও গান। মঙ্গলকাব্য- বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রচিত এক ধরনের কাহিনী - কাব্য।

মহাভারত— প্রাচীন ভারতবর্ষে দুটি মহাকাব্যের একটি, অন্যটি রামায়ণ, মূল রচনা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়েছিল, কয়েকশত বৎসর পরে বাংলায় অনূদিত হয়। মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত- উনিশ শতকের ঔপন্যাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস মাধবীকঙ্কণ— রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত উপন্যাস। মেঘনাদবধ কাব্য - কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) রচিত আধুনিক বাংলা মহাকাব্য। রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ রচিত সাংকেতিক নাটক রাজপুত জীবনসন্ধ্যা- রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। রামপ্রসাদ সেন (আনু: ১৭২৩-৮১) কবি ও সংগীত রচয়িতা, ভক্তিগীতি রচনার জন্য বিখ্যাত, এঁর গানকে ‘রামপ্রসাদী' আখ্যা দেওয়া হয়। শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-৭১)- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহিদ হন। শাজাহান- নাট্যকার ও কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত নাটক। শূর্পণখা— রামায়ণ মহাকাব্যের কাহিনীতে লঙ্কার রাজা রাবণের বোন। শেক্সপীয়র-(১৫৬৪-১৬১৬) ইংরেজ কবি ও নাট্যকার। শ্রব্যকাব্য- যে কাব্য পড়াও শোনার জন্য রচিত, এর বিপরীতে রয়েছে দৃশ্যকাব্য; শ্রীশচন্দ্র দাস- ‘সাহিত্য সন্দর্শন' গ্রন্থের রচয়িতা, বইটি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা (যেমন গল্প কবিতা উপন্যাস ইত্যাদি) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাগ্রন্থ। সংস্কৃত আলঙ্কারিকবৃন্দ - প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ে পুরনো আমলে যাঁরা আলোচনা করেছেন, বইপত্র লিখেছেন। সীতা- পৌরাণিক চরিত্র, রামচন্দ্রের স্ত্রী, লঙ্কার রাজা রাবণ অপহরণ করে নিয়ে যায়। তার ফলে রাবণের বিরুদ্ধে রাম যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক ‘সীতা' ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়। সোজনবাদিয়ার ঘাট— পল্লিকবি জসীম উদ্দীন রচিত কাহিনীকাব্য। হাসান আজিজুল হক- জন্ম ১৯৩৯ সালে, বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাশিল্পী

Content added || updated By

সাহিত্য নানা ধরনের। অনেক রকম উদ্ভিদ নিয়ে যেমন বাগান তেমনি বিভিন্ন রকম সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সাহিত্য। ‘সাহিত্যের রূপ ও রীতি' প্রবন্ধে অতি সংক্ষেপে বিচিত্র সাহিত্যরীতির পরিচয় আছে। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে সাহিত্যের জগৎ। আবার প্রত্যেকটির কিছু শাখা-প্রশাখা আছে। ‘সাহিত্যের রূপ ও রীতি' প্রবন্ধে সাহিত্যের এই সব রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। কবিতা, নাটক, ছোটোগল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি উপ-শিরোনামে লেখক প্রত্যেকটি রীতির স্বরূপ চারিত্র্য তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধটি মূলত বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের আলোকে সাহিত্যের রূপ, রীতি ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য পাঠে আমাদের উৎসাহিত করে।

Content added By

বাংলা ভাষার একরকম শব্দকে বলা হয় ‘তদ্ভব শব্দ'। আরেক রকম শব্দকে বলা ‘তৎসম শব্দ'। এবং আরেক রকম শব্দকে বলা হয় ‘অর্ধতৎসম শব্দ'। এ-তিন রকম শব্দ মিলে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার শরীর। ‘তৎসম’, ‘তদ্ভব’ পারিভাষিক শব্দগুলো চালু করেছিলেন প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতারা । তাঁরা ‘তৎ’ অর্থাৎ ‘তা’ বলতে বোঝাতেন ‘সংস্কৃত' (এখন বলি প্রাচীন ভারতীয় আর্য) ভাষাকে । আর ‘ভব’ শব্দের অর্থ ‘জাত, উৎপন্ন’। তাই ‘তদ্ভব' শব্দের অর্থ হলো ‘সংস্কৃত থেকে জন্ম নেয়া’, আর ‘তৎসম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সংস্কৃতের সমান' অর্থাৎ সংস্কৃত। বাংলা ভাষার শব্দের শতকরা বায়ান্নটি শব্দ ‘তদ্ভব’ ও অর্ধ-তৎসম'। শতকরা চুয়াল্লিশটি ‘তৎসম’। তাই বাংলা ভাষার শতকরা ছিয়ানব্বইটিই মৌলিক বা বাংলা শব্দ ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিপুল পরিমাণ শব্দ বেশ নিয়মকানুন মেনে রূপ বদলায় মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় অর্থাৎ প্রাকৃতে। পরিণত হয় প্রাকৃত শব্দে। শব্দগুলো গা ভাসিয়ে দিয়েছিলো পরিবর্তনের স্রোতে। প্রাকৃতে আসার পর আবার বেশ নিয়মকানুন মেনে তারা বদলে যায়। পরিণত হয় বাংলা শব্দে । এগুলোই তদ্ভব শব্দ । এ-পরিবর্তনের স্রোতে ভাসা শব্দেই উজ্জ্বল বাংলা ভাষা। তবে তদ্ভব শব্দগুলো সংস্কৃত বা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকেই শুধু আসেনি। এসেছে আরো কিছু ভাষা থেকে। তবে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকেই এসেছে বেশি সংখ্যক শব্দ ।
‘চাঁদ', ‘মাছ’, ‘এয়ো’, ‘দুধ' 'বাঁশি'। এগুলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে নিয়ম মেনে প্রাকৃতের ভেতর দিয়ে এসেছে বাংলায়। ‘চাঁদ' ছিল সংস্কৃতে 'চন্দ্র', প্রাকৃতে ছিল ‘চন্দ’। বাংলায় চাঁদ। ‘মাছ’ ছিল ‘মৎস্য' সংস্কৃতে, প্রাকৃতে হয় ‘মচ্ছ’। বাংলায় ‘মাছ’ ৷ ‘এয়ো’ ছিল সংস্কৃতে ‘অবিধবা’। প্রাকৃতে হয় ‘অবিহবা’। বাংলায় ‘এয়ো’। দুধ’ ছিল সংস্কৃতে ‘দুগ্ধ”; প্রাকৃতে হয় ‘দুদ্ধ'। বাংলায় হয় ‘দুধ'। ‘বাঁশি ছিল ‘বংশী' সংস্কৃতে। প্রাকৃতে হয় ‘বংসী’। বাংলায় ‘বাঁশি’। বেশ নিয়ম মেনে, অনেক শতক পথ হেঁটে এসেছে এ-তীর্থযাত্রীরা। আমাদের সবচেয়ে প্রিয়রা।
আরো আছে কিছু তীর্থযাত্রী, যারা পথ হেঁটেছে আরো বেশি। তারা অন্য ভাষার। তারা প্রথমে ঢুকেছে সংস্কৃতে, তারপর প্রাকৃতে। তারপর এসেছে বাংলায়। এরাও তদ্ভব শব্দ । মিশে আছে বাংলা ভাষায় ।‘খাল’ আর ‘ঘড়া’। খুব নিকট শব্দ আমাদের। ‘খাল' শব্দটি তামিল ভাষার 'কাল' থেকে এসেছে। ‘কাল’ সংস্কৃতে হয় ‘খল্প'। প্রাকৃতে হয় ‘খল্ল’। বাংলায় ‘খাল’। তামিল-মলয়ালি ভাষায় একটি শব্দ ছিল ‘কুটম’। সংস্কৃতে সেটি হয় ঘট। প্রাকৃতে হয় ‘ঘড়’। বাংলায় ‘ঘড়া’।
‘দাম’ আর ‘সুড়ঙ্গ’। প্রতিদিনের শব্দ আমাদের। ‘দাম' শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষার ‘দ্রামে' (একরকম মুদ্রা, টাকা) থেকে। ‘দ্রামে' সংস্কৃতে হয় দ্রম্য’। প্রাকৃতে ‘দম্ম’। বাংলায় ‘দাম’। গ্রিক ভাষায় একটি শব্দ ছিল ‘সুরিং’। শব্দটি সংস্কৃতে ঢুকে হয়ে যায় ‘সরঙ্গ’/সুরুঙ্গ' । প্রাকৃতেও এভাবেই থাকে। বাংলায় হয়ে যায় ‘সুড়ঙ্গ’। ‘ঠাকুর’। বাংলায় শ্রেষ্ঠ কবির নামের অংশ। শব্দটি ছিল তুর্কি ভাষায় ‘তিগির' । সংস্কৃত ও প্রাকৃতে
হয়ে যায় ‘ঠকুর’ । বাংলায় ‘ঠাকুর’।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃত ভাষার বেশ কিছু শব্দ বেশ অটল অবিচল । তারা বদলাতে চায় না । শতকের পর শতক তারা অক্ষয় হয়ে থাকে। এমন বহু শব্দ, অক্ষয় অবিনশ্বর শব্দ, এসেছে বাংলায় । এগুলোকে বলা হয় তৎসম শব্দ। বাংলা ভাষায় এমন শব্দ অনেক। তবে এ-শব্দগুলো যে একেবারে বদলায়নি, তাও নয়। এদের অনেকে পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু আমরা সে-পরিবর্তিত রূপগুলোকে বাদ দিয়ে আবার খুঁজে এনেছি খাঁটি সংস্কৃত রূপ
জল, বায়ু, আকাশ, মানুষ, গৃহ, কৃষ্ণ, অন্ন, দর্শন, দৃষ্টি, বংশী, চন্দ্র এমন শব্দ। এদের মধ্যে ‘বংশী' ও ‘চন্দ্র’র তদ্ভব রূপও আছে বাংলায়। ‘বাঁশি' আর 'চাঁদ'। পুরোনো বাংলায় ‘সসহর’ ছিল, ‘রএণি’ ছিল। এখন নেই। এখন আছে সংস্কৃত শব্দ শশধর’ আর ‘রজনী'। বাংলা ভাষার জন্মের কালেই প্রবলভাবে বাংলায় ঢুকতে থাকে তৎসম শব্দ । দিন দিন তা আরো প্রবল হয়ে ওঠে ৷ উনিশ শতকে তৎসম শব্দ বাংলা ভাষাকে পরিণত করে তার রাজ্যে ।
কিছু শব্দ বেশ রুগ্‌ণ এসেছে বাংলায়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃতের কিছু শব্দ কিছুটা রূপ বদলে ঢুকেছিল প্রাকৃতে। তারপর আর তাদের বদল ঘটেনি। প্রাকৃত রূপ নিয়েই অবিকশিতভাবে সেগুলো এসেছে বাংলায়। এগুলোকেই বলা হয় অর্ধ-তৎসম। ‘কৃষ্ণ' ও 'রাত্রি' বিকল হয়ে জন্মেছে ‘কেষ্ট’ ও ‘রাত্তির' । শব্দগুলো বিকলাঙ্গ । মার্জিত পরিবেশে সাধারণত অর্ধ-তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হয় না । আরো কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর মূল নির্ণয় করতে পারেননি ভাষাতাত্ত্বিকেরা। তবে মনে করা হয় যে বাংলা ভাষার উদ্ভবের আগে যেসব ভাষা ছিল আমাদের দেশে, সেসব ভাষা থেকে এসেছে ওই শব্দগুলো। এমন শব্দকে বলা হয় 'দেশি' শব্দ। এগুলোকে কেউ কেউ বিদেশি বা ভিন্ন ভাষার শব্দের মতোই বিচার করেন। কিন্তু এগুলোকেও গ্রহণ করা উচিত বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হিসেবেই। ডাব, ডিঙ্গি, ঢোল, ডাঙ্গা, ঝোল, ঝিঙ্গা, ঢেউ এমন শব্দ । এগুলোকে কী করে বিদেশি বলি ?

Content added By

বাংলাদেশের বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী, ভাষাবিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক ও কবি হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮শে এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের অন্তর্গত রাড়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী হুমায়ুন আজাদ দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো : কাব্য— অলৌকিক ইস্টিমার, জ্বলো চিতাবাঘ, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু; উপন্যাস— ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সব কিছু ভেঙে পড়ে, গল্প- যাদুকরের মৃত্যু, প্রবন্ধ— নিবিড় নীলিমা, বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র, বাক্যতত্ত্ব, লাল নীল দীপাবলি, কতো নদী সরোবর ইত্যাদি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অন্যান্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালের ১২ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

তদ্ভব শব্দ— তা থেকে উৎপন্ন, প্রাকৃত বাংলা শব্দ, এই শব্দগুলো প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ক্রম পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তর লাভ করেছে

তৎসম শব্দ— তৎসদৃশ, তদ্রুপ, সংস্কৃত শব্দের অনুরূপ বাংলা শব্দ। অর্ধ-তৎসম শব্দ— অর্ধেক তার সমান, তৎসম শব্দের আংশিক পরিবর্তিত রূপ।

প্রাকৃত— প্রকৃতিজাত, স্বাভাবিক, প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষার রূপান্তর বিশেষ। এ-তীর্থযাত্রীরা- এখানে বাংলা ভাষায় আগত শব্দভাণ্ডারকে বোঝানো হয়েছে।

আমাদের সবচেয়ে প্রিয়রা— বাংলা ভাষায় আগত শব্দসমূহ আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে আগত শব্দসমূহকে লেখক সবচেয়ে প্রিয় বলে বিশেষায়িত করেছেন।

অবিকশিতভাবে- বিকশিত নয়, এমন। বিকলাঙ্গ— ত্রুটিযুক্ত অঙ্গ ।

Content added By

হুমায়ুন আজাদের কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী নামক গ্রন্থ থেকে বাঙলা শব্দ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে যে প্রচলিত পাঁচটি ভাগ করা হয়েছে তার তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব ও দেশি শব্দ নিয়েই প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে । কীভাবে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দসমূহ বাংলা ভাষায় এসে বাংলা-ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে— তা অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। ‘বাংলা শব্দ' প্রবন্ধটি মূলত বাংলা শব্দের উৎস ও বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি ভাষাসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক ।

Content added By

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। বিশাল সভা হবে। মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিন জনশূন্য। মালিকের কাছে বলে অহি ও মন্টুও এসেছে বক্তৃতা শুনতে ।
স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিল করে প্রদীপ্ত এসেছে। ও দারুণ উত্তেজিত। শহরের এতসব ঘটনা ওকে প্রতিদিন অন্যরকম করছে। বাড়িতে বাবা ওকে নানা কিছু বুঝিয়ে দেয়। আলী আহমদ নিজেও ছাত্রদের নিয়ে সভা করেন। ওদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। প্রদীপ্ত সেসব কথাও শোনে ।
দূর থেকে অহিকে দেখে ও চিৎকার করে ডাকে। অহি ওকে হাত ইশারায় কাছে আসতে বলে । তারপর তিন জনে জায়গা নিয়ে বসে যায়। স্কুলের ছেলেদের চেয়ে অহির সঙ্গ বেশি প্রিয় মনে হয় প্রদীপ্তর । মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীতের রোদ ওদের বেশ আরাম লাগে। পিঠ রোদে দিয়ে বসেছে। ক্যান্টিনে বসে যারা চা খায় তাদের অনেকে বক্তৃতা করছে। কী আবেগ, কী গমগমে কণ্ঠ। অহির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অথচ কয়েক দিন আগে পল্টনে খাজা নাজিমুদ্দীনের শোনা বক্তৃতাটা ওর শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। বিরক্ত লাগছিল ওর। আজ ওর আনন্দ হচ্ছে।
শুনলে কেমন মন ভরে যায়, না প্রদীপ্ত?
হ্যাঁ।
প্রদীপ্ত প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। মন্টু আস্তে করে বলে, আমরা তো রাস্তার ছেলে, আমাদেরকে কী এসব মানায়?
একশো বার মানায় । প্রদীপ্ত জোরের সঙ্গে বলে ।
সভা শেষে এক বিশাল মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে ওরা হাত ধরে রাখে, পাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক ফাঁকে অহি বলে, জানিস যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' বলি তখন দম একটুও ফুরায় না। মনে হয় একনাগাড়ে হাজার বার বলতে পারি ।

প্রদীপ্ত বলে, ঠিক বলেছেন অহি ভাই ।
হাঁটতে হাঁটতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেল । চল কেটে পড়ি।
ধুৎ, আয় তো ।
অহি মন্টুর হাত ধরে টান দেয় ।
তিনজনে জনস্রোতে মিশে যায়। প্রদীপ্তর মনে হয় ওরা আর বালক নেই । ওর বাবা তো জানেন না যে প্রদীপ্ত স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে চলে এসেছে। আজ বাবাকে গিয়ে ও বলবে, মিছিলে এসে ও বড় হয়ে গেছে। খুব বেশি বড়ো না হলেও অহির সমান তো হয়েছেই, ঐটুকু হতে পেরেই ওর আনন্দ হচ্ছে। ওরা বড়োদের সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে পারছে। প্রদীপ্তর মনে হয় ওর চারদিকে খোলা। যেদিকে খুশি সেদিকেই এগুতে পারে। এখন ওর শুধু ঠিক করা যে ও কোনদিকে যাবে ।
বিকেলে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করে এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্ৰাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সভাতেই ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়।
আর কতদিন পরে অহি?
আজ তো চার তারিখ। আরো ষোলো দিন পরে।
এখনো অনেক দেরি।
দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে যাবে। দেখছিস শহরের মানুষ কেমন মেতে উঠেছে। ডাঙুলি খেলার দিনগুলো বুঝি অনেক বেশি ভালো ছিল। ওর অন্য বন্ধুরা ওর খোঁজে এসেছিল, কিন্তু অহি ওকে যেতে দেয়নি। অহি এখন ওকে বেশি ভালোবাসে। সারা দিন ওরা তেমন সময় পায় না । অহির আগ্রহ বেশি, তাই মন্টু নিজে বেশি কাজ করে ওকে যাবার সুযোগ করে দেয়। অহি যেন ওর মায়ের পেটের ভাই। কেমন প্রাণের টান অনুভব করে।
একুশ তারিখের ধর্মঘট সফল করার জন্য ছাত্রদের যেমন, সাধারণ মানুষেরও তেমনি উৎসাহের অন্ত নেই। পূর্ণ উদ্যমে চলছে প্রস্তুতি । এগারই ও তেরই ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবি সংবলিত ব্যাজ বিক্রি করে একুশ তারিখে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
দেয়ালের লিখনে, পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহর। মানুষের আলোচনার বিষয় একুশে। জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। এদিকে ঐ একই তারিখে গণপরিষদে বসবে পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন । বিশে ফেব্রুয়ারি রাত থেকে সরকার ক্রমাগত একমাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করল। তীব্র প্রতিক্রিয়া। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। ক্ষোভে, আক্রোশে পরিপূর্ণ বুকের কন্দর নিয়ে জেগে রইল মানুষ। অহি ভাবল, আমার মতো রাস্তার ছেলের মৃত্যুর বদলে কি বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে? আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় সারা রাত ।

খুব ভোরবেলা জনশূন্য রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকে অহি। মন্টুকে ডেকেছিল । কিন্তু এত ভোরে ও ঘুম থেকে উঠতে রাজি হলো না। ভোরের বাতাসে ও বড় করে হাই তোলে। শীত লাগছে না। ও ফাঁকা রাস্তায় খানিকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে। শরীর গরম হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলে যে আজ আর ক্যান্টিনে ফিরবে না। ও হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির চত্বরে আসে। বেলা বেশ হয়েছে । ছেলেরা ইতস্তত জটলা করছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা আসছে। স্কুলের ছেলেদের দেখলেই অহি প্ৰদীপ্তকে খুঁজতে থাকে। যত বেলা বাড়ছে, প্রতিবাদে, বিক্ষোভে, স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। একটু পর সভা শুরু হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। অহির অস্থির লাগছে। ওর বুলু দাসের কথা খুব মনে হয়। আজ তো বুলু দাসের কাজ নেই । এখনো কি ঘুমুচ্ছে? সোহাগির সঙ্গে বিয়েটা কি হয়েই গেল?
পরক্ষণে তুমুল স্লোগানে ভেঙে পড়ে এলাকা। দশজন দশজন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে । শুরু হয় গ্রেফতার বরণের পালা। দশজন করে বের হয় আর রাস্তায় অপেক্ষমাণ পুলিশ সবাইকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তোলে । অহি একপাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে । তখন প্রদীপ্ত দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে, অহি ভাই?
আমি তো তোকেই খুঁজছি প্ৰদীপ্ত ।
আমি তো অনেকক্ষণ আগে এসেছি। তোমাকেই খুঁজছিলাম ।
আমরা এখন কী করব অহি ভাই ।
এদের সঙ্গে থাকব । অন্য কোথাও যাব না। দেখছিস না কেমন গ্রেফতার বরণ চলছে।
অহির বুক কাঁপে থরথর করে। দেখতে দেখতে অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে ট্রাক চলে যায় লালবাগ থানায়। এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ওদের চোখ জ্বালা করে। ওরা দৌড়ে পুকুরের পাশে চলে আসে। আঁজলা ভরে পানি তুলে চোখে ঝাপটা দেয়। অনেকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কেউ কেউ ঝাঁপ দেয় পুকুরে। অহি আর প্রদীপ্ত কারো কারো জন্য রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে আসে। চোখ মুছিয়ে দেয় । নিজেদের যন্ত্রণা তেমন নয় । ভুলে যায় সেটুকু। এই যন্ত্রণা এবং উত্তেজনায় ছাত্ররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে
বেলা বাড়ে। সূর্য মাথার ওপর খাড়া। শীতের দুপুর বলে ঝাঁঝালো রোদ নয়। দুটো পর্যন্ত চলে গ্রেফতার বরণের পালা। এর মাঝে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে। ওরা নিজেরা বুঝতে পারে না কীভাবে এখানে এলো। ওরা এখন মেডিকেলের হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে। মন্টু ওদের দেখতে পেয়ে ছুটে আসে।
অহি? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? মা গো তোর কী যে সাহস! আমি তো ভয়েই বাঁচি না ।
অহি ওর কাঁধে হাত রাখে ।
ভয় কী মন্টু? আয় ৷

না, আমি যাব না । আমি এদিকেই থাকি ।
মন্টু ভেতরের দিকে চলে যায় ৷
অহি দেখল এখন আর ছাত্ররা একা নয় । স্রোতের মতো মানুষ এসে মিলিত হয়েছে । শত শত মানুষ ৷ দলবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরোলেই তাড়া করে পুলিশ। বেলা সোয়া তিনটার দিকে এম. এল.এ. ও মন্ত্রীরা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। পরিষদ ভবনের কোণে চৌরাস্তায় মেশিনগান পাতা হয়েছে। তৈরি হয়েছে কাঁটাতারের ব্যারিকেড।
উত্তাল হয়ে ওঠে জনতার স্লোগান। কেউই আর কোনো বাধা মানতে চায় না। মিছিল এগিয়ে আসতে চাইলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাড়া করতে করতে ঢুকে পড়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ । মানুষ ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে । কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জে দমাতে না পেরে পুলিশ গুলি চালায়। পড়ে যায় রফিকউদ্দীন। বুলেটে উড়ে যাওয়া খুলি থেকে ধোঁয়া বেরোয়; গলিত মগজ বেরিয়ে পড়ে। আহত হয় বরকত। ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায় ছেলেরা। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ছেলেরা কাঁদে । মেডিকেল কলেজের ছেলেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের তুলে নিয়ে যায় ।
তখন ফুলার রোডে নিহত অহিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদে প্রদীপ্ত আর মন্টু। রক্ত লেগে যায় মন্টুর শরীরেও। অহির বুক ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। এই প্রথম মন্টু একজনের জন্য বুক উজাড় করে কাঁদছে। বাবা যখন মারা গেছেন ও তা বোঝেনি। মায়ের অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেজন্যও কাঁদেনি। রাস্তায় যতদিন ঘুরেছে তখন কারো জন্য কাঁদার মতো অবস্থাই হয়নি। আজ অহি ওর বুক উজাড় করে দিয়েছে। প্রদীপ্ত বিমূঢ় হয়ে গেছে। ও কখনো মৃত্যু দেখেনি। বিস্ফারিত চোখে শুধু অহিকেই দেখে । নিথর হয়ে গেছে অহি। ওর শরীরটা তখনো গরম। ও বুঝতে পারে কান্না কী? ছোটবেলা থেকে কখনো ওকে এমন করে কাঁদতে হয়নি। ওদের কাঁদার রেশ কমে আসার আগেই বুটের লাথিতে ছিটকে পড়ে ওরা। দেখে দুজন পুলিশ অহির লাশটা ট্রাকে উঠিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রদীপ্ত দেখতে পায় না মফিজুলকে । গুলি মফিজুলের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ও। বুটের লাথি খেয়ে উল্টে পড়ে যাওয়া প্রদীপ্তকে হাত ধরে টেনে ওঠায় মন্টু। প্রদীপ্তর মাথা ঘুরছে। আশেপাশে কোনোকিছু দেখার মতো অবস্থা ওর নেই। ততক্ষণে আর একটি পুলিশ ভ্যান এসে উঠিয়ে নিয়ে যায় মফিজুলের লাশ। ও রেখে যায় রাস্তার ওপর জমাট রক্ত। পুলিশের গাড়ি দেখে মন্টু ভয় পেয়ে প্রদীপ্তকে টেনে গাছের আড়ালে চলে যায়। ও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, মন্টু পানি? মন্টু চারদিকে তাকায়, কোথায় পানি? অবসন্ন কণ্ঠে বলে, যুদ্ধ থামুক । তারপর পানি দেবো ।
পরদিন নয়, তেইশ তারিখের ‘আজাদ' পত্রিকায় বেরুলো একটি সংবাদ । ‘বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব যে চার জনেরও বেশি লোক নিহত হয় । কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহাদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয়। একটি কিশোর বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শুনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পরে জানা যায় যে, বালকটি মেডিকেল কলেজ ও পরিষদের মধ্যে ফুলার রোডে গুলিতে নিহত হয় এবং তাহার লাশ তৎক্ষণাৎ অপসারিত হয়।'

খবরের কাগজে খবরটা পড়ে গুম হয়ে থাকে আলী আহমদ। এমনিতেই দুদিন ধরে তার জ্বর। একুশ তারিখের ঘটনায় টিয়ার গ্যাস এবং লাঠিচার্জে আহত হয়েছে। পায়ে এবং পিঠে আঘাত পেয়েছে । হাঁটতে কষ্ট হয়। মফিজুল তার কাছাকাছি ছিল, পরে ভিড়ে কোথায় ছিটকে চলে যায় টের করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত মফিজুলের কোনো খবর নেই। আলী আহমদ নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না। কাগজে খবরটা পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে প্রদীপ্ত, বাবা এ যে আমাদের অহি, অহিউল্লাহ।
চুপ, আস্তে। শুনতে পারে ।
রান্নাঘরে বসে অহির মা গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। বারবার বলছে, আমার অহির একটা খবর এনে দেন ভাইসাব। আলী আহমদ কথা বলে না । ও দীপু তুমি না বললে অহি তোমার সঙ্গে ছিল ?
প্রদীপ্ত চুপ করে থাকে ।
ওরে আমার অহি রে।
কান্নার সুর ওঠে অহির মায়ের কণ্ঠে। বাড়িতে শোকের ছায়া। অহি নেই এই কথাটা এখন পর্যন্ত অহির মাকে বলছে না কেউ। বলে কী হবে? লাশ কোথায়? লাশের খবর তো ওরা জানে না। মর্গে অহির বিকৃত চেহারাটা প্রথমে চিনতেই পারেনি বুলু দাস । চেনা লাগছে? কে এ? বুলু দাসের শরীর কাঁপে থরথর করে। হ্যাঁ অহি-ই তো? একদম অহি। কোনো ভুল নেই। বুলু ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ওর পায়ের পাতায় হাত রাখে। চেপে বসে যায় তাতে। গন্ধ আসছে তীব্র।কোনোকিছুই বোধে নেই ওর। বুলু স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাইরে থেকে হেড জমাদার চিৎকার করে কী যেন বলছে, বুলুর কানে তা ঢোকে না। ও উবু হয়ে অহির মুখের ওপর ঝুঁকে থাকে। ইচ্ছে হয় বুকে জড়িয়ে ধরতে। প্রচণ্ড ব্যাকুলতায় বুলু দাসের কান্না থেমে যায়। হঠাৎ ওর মনে হয় অহির নিঃশ্বাস বইছে, বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে। বুলুদা হাঁটুতে মুখ গোঁজে। ওর সামনে মর্গের ছোট ঘরটা দিগন্ত-সমান হয়ে যায় ৷
বুলুদা, আমি অহি?
বুলুর ঠোঁট কাঁপে। অহিকে বুকে তুলে নেয় ।
তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বুলুদা?
মায়ের কাছে। ঘরে। একটি ঘর নয়। একজন মা নয় । অনেক মা
আমার মা কেমন আছে বুলুদা?
তোর আর এখন কোনো মা নেই। তুই এখন সব মায়ের ছেলে ।
বুলু দাসের চোখে জল নেই। ও বুক ভরে শ্বাস টানতেই অনুভব করে অহির শরীর থেকে তীব্ৰ জুঁই ফুলের গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। মুহূর্তে অহির শরীর লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে হাতে কোথায় চলে যায় বুলু দাস হদিস করতে পারে না। ও বিমূঢ় হয়ে থাকে। এত লোক অহিকে ভালোবাসে? এত ভালোবাসা অহির জন্য? গর্বে-অহংকারে বুলুর বুক ভরে যায়। ওর কেবলই মনে হয় অহি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে। অহি মরেনি।

Content added By

সেলিনা হোসেন ১৪ই জুন ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এ. কে. মোশাররফ হোসেন, মাতা মরিয়মেন্নেসা বকুল। ১৯৬২ সালে তিনি রাজশাহীর পি.এন.গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর লাভ করেন । কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেলিনা হোসেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারীমুক্তি তাঁর কথাসাহিত্যের মূলগত আখ্যান ৷ তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : হাঙর নদী গ্রেনেড, মগ্ন চৈতন্যে শিস, যাপিত জীবন, চাঁদবেনে, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, গায়ত্রী সন্ধ্যা, দীপান্বিতা ইত্যাদি; গল্পগ্রন্থ : উৎস থেকে নিরন্তর, খোলকরতাল, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ইত্যাদি; শিশু-কিশোর উপযোগ্য রচনা : সাগর, বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা, বর্ণমালার গল্প, জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি, চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ ইত্যাদি। সাহিত্যক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও ফিলিপ্‌স সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ।

Content added By

কর্মপরিষদ — বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গঠিত ছাত্রজোট। বাজ- নির্দেশক চিহ্ন। জল্পনা-কল্পনা- আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা।

আক্রোশ — ক্রোধ, রোষ, হাসপাতালের ইমার্জেন্সি- হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র। গুজব -রটনা, জনরব ছড়ানো ।

Content added By

বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা (১৯৯৪) উপন্যাসের অংশবিশেষ ‘রক্তে ভেজা একুশ'। ভাষা-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মিছিলে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও পথশিশুর অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে এ গল্পে। আন্দোলনে শামিল হয়ে পথশিশু অহি শহিদ হয়েছে এবং সকল মায়ের সন্তান হিসেবে নন্দিত হয়েছে। ‘রক্তে ভেজা একুশত গল্পটি ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পাশাপাশি আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে । একই সঙ্গে উপস্থাপন করে যে, ভাষা আন্দোলন ছিল বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সম্মিলিত আন্দোলন ।

Content added By

আমার শৈশবের অদ্ভুত স্বপ্নময় কিছুদিন কেটেছে জগদলে। জগদলের দিন আনন্দময় হবার অনেকগুলো কারণের প্রধান কারণ স্কুলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। সেখানে কোনো স্কুল নেই । কাজেই পড়াশোনার যন্ত্রণা নেই । মুক্তির মহানন্দ ।
আমরা থাকি এক মহারাজার বসতবাড়িতে, যে-বাড়ির মালিক অল্প কিছুদিন আগেই দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন। বাড়ি চলে এসেছে পাকিস্তান সরকারের হাতে। মহারাজার বিশাল এবং প্রাচীন বাড়ির একতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলাটা তালাবদ্ধ। শুধু দুতলা নয়, কয়েকটা ঘর ছাড়া বাকি সবটা তালাবদ্ধ, কারণ মহারাজা জিনিসপত্র কিছুই নিয়ে যান নি। ঐসব ঘরে তাঁর জিনিসপত্র রাখা ।
ঐ মহারাজার নাম আমার জানা নেই । মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিও বলতে পারলেন না । তবে তিনি যে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিলেন তার অসংখ্য প্রমাণ এই বাড়িতে ছড়ানো। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। সেই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর ছিল নিজস্ব জেনারেটর। দাওয়াতের চিঠি ছেপে পাঠানোর জন্যে মিনি সাইজের একটা ছাপাখানা ।
বাবাকে অসংখ্যবার বলতে শুনেছি— মহারাজার রুচি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আহা, কত বই! কত বিচিত্র ধরনের বই ।
বিকেলগুলিও কম রোমাঞ্চকর ছিল না। প্রতিদিনই বাবা কাঁধে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে বলতেন—চল বনে বেড়াতে যাই । কাঁধে বন্দুক নেয়ার কারণ হচ্ছে প্রায়ই বাঘ বের হয়। বিশেষ করে চিতাবাঘ । বাবার সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত বনে ঘুরতাম। ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম রাতে। ভাত খাওয়ার আগেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত। কত বিচিত্র শব্দ আসত বন থেকে। আনন্দে এবং আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠতাম । একদিন কাঁপুনি দিয়ে আমার এলো জ্বর। বাবা-মা দুজনেরই মুখ শুকিয়ে গেল— লক্ষণ ভালো নয়। নিশ্চয় ম্যালেরিয়া। সেই সময়ে এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়া কুখ্যাত ছিল। একবার কাউকে ধরলে তার জীবনীশক্তি পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিত। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা প্রতিষেধক হিসেবে বায়োকেমিক ওষুধ ছাড়াও প্রতি রবিবারে পাঁচ গ্রেন করে কুইনাইন খাচ্ছি। তার পরও ম্যালেরিয়া ধরবে কেন?

বাবা এই ভয়ংকর জায়গা থেকে বদলির জন্য চেষ্টা-তদবির করতে লাগলেন। শুনে আমার মন ভেঙে গেল। এত সুন্দর জায়গা, এমন চমৎকার জীবন— এসব ছেড়ে কোথায় যাব? ম্যালেরিয়ায় মরতে হলেও এখানেই মরব। তাছাড়া ম্যালেরিয়া অসুখটা আমার বেশ পছন্দ হলো। যখন জ্বর আসে তখন কী প্রচণ্ড শীতই-না লাগে! শীতের জন্যেই বোধহয় শরীরে এক ধরনের আবেশ সৃষ্টি হয়। জ্বর যখন বাড়তে থাকে তখন চোখের সামনের প্রতিটি জিনিস আকৃতিতে ছোটো হতে থাকে । দেখতে বড়ো অদ্ভুত লাগে । এক সময় নিজেকে বিশাল দৈত্যের মতো মনে হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি !
শুধু আমি একা নই, পালা করে আমরা সব ভাইবোন জ্বরে পড়তে লাগলাম ।
একজন জ্বর থেকে উঠতেই অন্যজন জ্বরে পড়ে। জ্বর আসেও খুব নিয়মিত। আমরা সবাই জানি কখন জ্বর আসবে। সেই সময়ে লেপ-কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আগেভাগেই বিছানায় শুয়ে পড়ি।
প্রতিদিন ভোরে তিন ভাইবোন রাজবাড়ির মন্দিরের চাতালে বসে রোদ গায়ে মাখি। এই সময় আমাদের সঙ্গ দেয় বেঙ্গল টাইগার। বেঙ্গল টাইগার হচ্ছে আমাদের কুকুরের নাম। না, আমাদের কুকুর নয়, মহারাজার কুকুর। তাঁর নাকি অনেকগুলো কুকুর ছিল। তিনি সবকটাকে নিয়ে যান, কিন্তু এই কুকুরটিকে নিতে পারেন নি। সে কিছুতেই রাজবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয় নি ।
মা তাকে দুবেলা খাবার দেন। মাটিতে খাবার ঢেলে দিলে সে খায় না। থালায় করে দিতে হয়। শুধু তা-ই না, খাবার দেবার পর তাকে মুখে বলতে হয়— খাও ।
খানদানি কুকুর। আদব-কায়দা খুব ভালো। তবে বয়সের ভারে সে কাবু। সারা দিন বাড়ির সামনে শুয়ে থাকে । হাই তোলে, ঝিমুতে ঝিমুতে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে ।
এক ভোরবেলার কথা। আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। আমি কম্বল গায়ে দিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে আছি। আমার সঙ্গে শেফু এবং ইকবাল । মা এসে আমাদের মাঝখানে শাহীনকে (আমার ছোট ভাই) বসিয়ে দিয়ে গেলেন । আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তার দিকে নজর রাখা, সে যেন হামাগুড়ি দিয়ে চাতাল থেকে পড়ে না যায় ।
মা চলে যাবার পরপরই হিসহিস শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম। যে-দৃশ্য দেখলাম সে-দৃশ্য দেখা জন্য মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। মন্দিরের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে প্রকাণ্ড একটা কেউটে সাপ বের হয়ে আসছে। মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে। ফণা তুলে এদিক-ওদিক দেখছে, আবার মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছে, আবার ফণা তোলে। আমরা তিন ভাইবোন ছিটকে সরে গেলাম । শাহীন একা বসে রইল, সাপ দেখে তার আনন্দের সীমা নেই। সে চেষ্টা করছে সাপটির দিকে এগিয়ে যেতে। আর তখনই বেঙ্গল টাইগার ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপটির ওপর। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে আমরা কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারলাম না কী হচ্ছে। একসময় শুধু দেখলাম কুকুরটা সাপের ফণা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে । বেঙ্গল টাইগার ফিরে যাচ্ছে নিজের জায়গায়। যেন কিছুই হয়নি। নিজের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড সে শেষ করল ।
সাপ কুকুরটিকে কামড়াবার সুযোগ পেয়েছিল কি না জানি না। সম্ভবত কামড়ায়নি। কারণ কুকুরটি বেঁচে রইল, তবে নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল।

দ্বিতীয় দিনে তার চামড়া খসে পড়ল এবং দগদগে ঘা দেখা দিল। এ থেকে মনে হয় সাপ সম্ভবত কামড়েছে। সাপের বিষ কুকুরের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন ভয়াবহ নয় ৷
আরও দুদিন কাটল। কুকুরটি চোখের সামনে পচেগলে যাচ্ছে। তার কাতরধ্বনি সহ্য করা মুশকিল। গা থেকে গলিত মাংসের দুর্গন্ধ আসছে।
বাবা মাকে ডেকে বললেন, আমি এর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। তুমি বন্দুক বের করে আমাকে দাও । বাবা আমাদের চেখের সামনে পরপর দুটি গুলি করে কুকুরটিকে মারলেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবা দুঃখে বেদনায় কুঁকড়ে উঠেছেন। তবু শান্ত গলায় বললেন, যে আমার ছেলের জীবন রক্ষা করেছে তাকে আমি গুলি করে মারলাম। একে বলি নিয়তি ।
কিন্তু আমার কাছে বাবাকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষদের একজন বলে মনে হলো। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না এমন একটি কাজ তিনি কী করে করতে পারলেন। রাগে, দুঃখে ও অভিমানে রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়েছি। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় বসালেন ।
দুজন চুপচাপ বসে আছি। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তক্ষক ডাকছে। বাড়ির চারপাশের আমের বনে হাওয়া লেগে বিচিত্র শব্দ উঠছে।
বাবা কিছুই বললেন না। হয়তো অনেক কিছুই তাঁর মনে ছিল। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেন না। একসময় বললেন, যাও ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি বাবা কেন কুকুরটিকে এভাবে মেরে ফেলেছেন!
কুকুরটি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল ।

Content added By

হুমায়ূন আহমেদ ১৩ই নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা ফয়জার রহমান আহমেদ এবং মায়ের নাম- আয়শা ফয়েজ। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৬৫ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭০ ও ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু সাহিত্য-চর্চার জন্য অধ্যাপনা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি কথা-সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : নন্দিত নরকে, নীল অপরাজিতা, প্রিয়তমেষু, জয়জয়ন্তী, অয়োময়, এলেবেলে ইত্যাদি । তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি । তিনি একুশে পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

অদ্ভুত- চমৎকার, অসাধারণ। মহানন্দ— গভীর আনন্দ, অনেক আনন্দ। আবেশ- ভাবাবেগ, অনুরাগ, এখানে একধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া বোঝানো হয়েছে।

চাতাল— উঠান, শান বাঁধানো বসার জায়গা। তক্ষক- এক ধরনের অত্যন্ত বিষধর সরীসৃপ ।

Content added By

বাংলাদেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ আমার ছেলেবেলা থেকে ‘নিয়তি' নামক গল্পটি সংকলিত হয়েছে । লেখকের ছোটবেলায় বাবার চাকরিসূত্রে জগদলের একটি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে অবস্থানকালীন স্মৃতি এবং তার অনুভূতি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। জমিদারবাড়ির কুকুরটি লেখকের ছোট ভাইকে কেউটে সাপের ছোবল থেকে রক্ষা করে। সাপটিকে মেরে ফেললেও কুকুরটিও সাপের কামড় খায়। সাপের কামড়ের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত কুকুরটির পরবর্তী যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তার বাবা কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলেন। কুকুরের এই নিয়তি তার বালক চিত্তে বেদনার সঞ্চার করে। ‘নিয়তি' গল্পটি মূলত প্রাণির প্রতি সংবেদনশীল ও সহানুভূতিপ্রবণ হওয়ার শিক্ষা দেয়; কেননা প্রকৃতির এই বিশাল জগতে মানুষ, বৃক্ষ ও প্রাণি সবাই পরস্পর নির্ভরশীল।

Content added By

বর্তমান পৃথিবীটা হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির পৃথিবী। কথাটা যে সত্যি সেটা খুব সহজেই প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ আজ থেকে এক যুগ আগে কারো কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে মানুষ বই খুলে দেখত— এখন আর কেউ সেটা করে না । যখন কারো তথ্যের প্রয়োজন হয় সে কম্পিউটারের সামনে বসে, কী-বোর্ডে দুই একটি টোকা দেয়, মাউসে কয়েকবার ক্লিক করে। সঙ্গে সঙ্গে তথ্য চোখের পলকে তার কাছে চলে আসে-তথ্যটি পাশের রাস্তা থেকে এসেছে নাকি পৃথিবীর অন্য পাশ থকে এসেছে সেটা আজকাল কেউ জানতেও চায় না। জানার প্রয়োজনও নেই। কারণ পুরো পৃথিবীটা এখন সবার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এই আসাধারণ ব্যাপারটি ঘটা সম্ভব হয়েছে তথ্য প্রযুক্তির একটা বিপ্লবের কারণে ।
তথ্য প্রযুক্তি নামে সারা পৃথিবীতে যে বিপ্লবটি ঘটেছে তার পিছনে যে যন্ত্রটি কাজ করছে তার নাম ডিজিটাল কম্পিউটার। কম্পিউটারের ভেতরকার ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়া করার জন্যে সম্ভাব্য সব সিগনাল ব্যবহার না করে সুনির্দিষ্ট কিছু সিগনাল বা ডিজিটাল সিগনাল ব্যবহার করা হয় বলে এর নাম ডিজিটাল কম্পিউটার। আমাদের বর্তমান পৃথিবী এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন খুব কম লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে যার জীবনকে কোনো না কোনোভাবে কম্পিউটার স্পর্শ করে নি। হিসেবনিকেশ করতে কম্পিউটারের দরকার হয়, ব্যবসাপাতিতে কম্পিউটার দরকার হয়, এমনকি শিল্প- সাহিত্য বা বিনোদন করতেও আজকাল কম্পিউটারের দরকার হয়। ১৯৭৭ সালে ভয়েজার ১ আর ২ নামে দুটো মহাকাশযান সৌর-জগতে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। সৌরজগৎ পাড়ি দেবার সময় মহাকাশযান দুটো গ্রহগুলোর পাশে দিয়ে গিয়েছে এবং যাবার সময় সেই গ্রহগুলো সম্পর্কে নানা তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছে । ছোটো একটি যন্ত্র হয়েও পৃথিবীর গবেষকদের কাছে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাঠানোর কৃতিত্বটুকু ভয়েজার মহাকাশযানগুলোকে দেওয়া হয়। এই চমকপ্রদ কৃতিত্বটুকুর পিছনে ছিল একটা কম্পিউটার, যেটি ভয়েজার মহাকাশযানকে সৌরজগতের ভেতর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং নিখুঁতভাবে সেই তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কেউ যেন মনে না করে যে, ভয়েজার মহাকাশযানের কম্পিউটার বুঝি ছিল অসাধারণ কোনো কম্পিউটার। বস্তুত সেগুলো ছিল খুবই সাধারণ কম্পিউটার। সত্যি কথা বলতে কি আমরা এখন যে কম্পিউটার ব্যবহার করি তার তুলনায় ১৯৭৭ সালের সেই কম্পিউটার ছিল প্রায় একটা খেলনার মতো। তারপরেও সেটি অসাধ্য সাধন করেছিল, কারণ বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসে যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে প্রোগ্রাম করে কম্পিউটারটিতে পাঠাতেন। কম্পিউটারটিও তাই যখন যেরকম প্রয়োজন সেভাবে তার দায়িত্ব পালন করত । অন্য যে-কোনো যন্ত্র থেকে সে কারণে কম্পিউটার আলাদা এবং এটাই কম্পিউটারের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। একটা কম্পিউটারকে কোন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটা নির্ভর করে মানুষের ওপরে । একজন মানুষ যত সৃজনশীল হবে কম্পিউটারের কাজকর্ম হবে তত চমকপ্রদ ।

কম্পিউটার ব্যবহার করে যে অসংখ্য কাজ করা যায় তার একটি হচ্ছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, যেখানে কম্পিউটারকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। কেউ যেন মনে না করে, এতে শুধু একটা ঘরের কয়েকটা কম্পিউটার কিংবা একটা প্রতিষ্ঠানের কয়েকটা কম্পিউটার জুড়ে দেয়া হয়। আসলে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে বিশাল একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। সেটা ঠিকভাবে করার জন্যে তথ্য বিনিময় বা তথ্য যোগাযোগের নতুন নতুন প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। তার একটি হচ্ছে ফাইবার অপটিক্স, যেখানে চুলের মতো সূক্ষ্ম একটা কাচের তন্তুর ভেতর দিয়ে তথ্য পাঠানো যায়। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে তথ্যটা বৈদ্যুতিক সংকেত হিসেবে যায় না, সেটা যায় আলো হিসেবে। সেই আলো কিন্তু দৃশ্যমান আলো নয়, সেটি অবলাল আলো, আমরা তাই চোখে সেটা দেখতেও পাই না। ফাইবার অপটিক প্রযুক্তির সঙ্গে ব্যবহার করার জন্যে রকমারি প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে এবং সব কিছু মিলিয়ে এখন রয়েছে পৃথিবী জোড়া বিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ।
সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার একসঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর সেটা দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব । কিছু করা হয়েছে, কিছু করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে কী করা যাবে সেটা নিয়ে পৃথিবীর সৃজনশীল মানুষেরা সবসময় চিন্তা করছে। পৃথিবীজোড়া বিশাল নেটওয়ার্কের একটা ব্যবহারের কথা আমরা মোটামুটি সবাই শুনেছি- সেটি হচ্ছে ইন্টারনেট। সাধারণ তথ্যের জন্যে এখন ইন্টারনেটের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের সব খবরাখবর ইন্টারনেট থেকে নেয়। শুধু যে বাস ট্রেন বা প্লেনের সময়সূচি ইন্টারনেটে পাওয়া যায় তা নয়, সেগুলোর টিকেটও ইন্টারনেটে কেনা যায় । পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এখন সত্যিকারের খবরের কাগজ না পড়ে ইন্টারনেটে খবর পড়ে । গবেষণার জার্নাল এখন ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। কেনাকাটার সবচেয়ে বড়ো পদ্ধতি এখন ইন্টারনেট। জিনিসপত্র নিলামে বিক্রি করতে হলে এখন ইন্টারনেটের চাইতে ভালো কোনো উপায় নেই । রেডিও টেলিভিশন ইন্টারনেটে চলে এসেছে, বন্ধুত্ব বা নানারকম সামাজিক কর্মকাণ্ড এখন ইন্টারনেট ঘিরে গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপন বা নির্বাচনি প্রচারণার জন্যে এখন ইন্টারনেটের চাইতে ভালো কোনো উপায় নেই । অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়- সরল কিংবা জটিল, সহজ কিংবা কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ কিংবা তুচ্ছ সব কাজই এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে করা হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যারা ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা জোর কদমে ছুটে চলা পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না, দেখতে দেখতে তারা পিছিয়ে পড়বে।
পৃথিবীজোড়া লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে শুধু যে ইন্টারনেটে তথ্য বিনিময় গড়ে উঠেছে তা নয়, বিজ্ঞানীরা এবং গণিতবিদরা সেটাকে গবেষণার কাজেও ব্যবহার করেন। একটা ছোটো কম্পিউটার ছোটো একটা কাজ করতে পারে কিন্তু লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারকে যদি একসঙ্গে করা হয় তাহলে তারা বিশাল কাজ করে ফেলতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো প্রাইম সংখ্যা এভাবে খুঁজে বের করা হয়েছে। কম্পিউটার যখন ব্যবহার করা হয় না তখন অলস হয়ে বসে না থেকে বিজ্ঞানী কিংবা গণিতবিদদের বড়ো বড়ো সমস্যা সমাধানের কাজে লেগে যেতে পারে। এটি হচ্ছে মাত্র একটি উদাহরণ, আরো অনেক উদাহরণ আছে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ভবিষ্যতে আরো সুন্দর আরো চমকপ্রদ উদাহরণ আসবে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ।

‘কম্পিউটার কথাটি বলা হলেই আমাদের চোখের সামনে কম্পিউটারের যে ছবিটি ভেসে ওঠে তা হলো— টেলিভিশনের মতো মনিটর, কী বোর্ড, মাউস এবং চৌকোণো বাক্সের মতো সি.পি.ইউ । কিন্তু সেটাই কম্পিউটারের একমাত্র রূপ নয়। আজকাল ব্যাটারি চালিত ল্যাপটপ চলে এসেছে, সেটা ব্যাগে নিয়ে চলাফেরা করা যায়। আবার বিশাল আকারের সুপার কম্পিউটার রয়েছে যেটাকে শীতল রাখার জনেই রীতিমতো দক্ষযজ্ঞের আয়োজন করতে হয়। যেরকম বড়ো কম্পিউটার রয়েছে ঠিক সেরকম ছোটো কম্পিউটারও রয়েছে যেগুলো মোবাইল টেলিফোন, ক্যামেরা, ফ্রিজ, ওভেন কিংবা লিফটের মতো দৈনন্দিন ব্যবহারী জিনিসের মাঝে বসানো আছে। আমরা আলাদাভাবে কম্পিউটারকে দেখি না, কিন্তু সেটা আমাদের চোখের আড়ালে অসংখ্য যন্ত্রপাতিকে সচল করে রাখছে। একসময় টেলিফোন ছিল একটা বুদ্ধিহীন কথা বলা এবং শোনার যন্ত্র। এখন আর তা নয়- মোবাইল টেলিফোন রীতিমতো বুদ্ধিমান যন্ত্র । এমন অনেক মোবাইল টেলিফোন আছে যেটা একই সঙ্গে টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, ক্যালকুলেটর, জিপিএস এবং ছোটোখাটো একটা কম্পিউটার । আমরা এটা হাতে নিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারি, যে-কোনো রকম তথ্য সংগ্রহ করতে পারি, তথ্য সংরক্ষণ করতে পারি এবং তথ্য বিনিময় করতে পারি। কিছুদিন আগেও সেটা কল্পবিজ্ঞানের মতো ছিল, এখন পুরোপুরি বাস্তব ।
যারা ইতিহাস পড়েছে তারা জানে, আজ থেকে প্রায় দুই-শ বৎসর আগে পৃথিবীতে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল। যারা সেই শিল্পবিপ্লবে অংশ নিয়েছিল তারা পৃথিবীটাকে শাসন করেছে-অনেক সময় শোষণ করেছে। এ মুহূর্তে শিল্পবিপ্লবের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিপ্লব হচ্ছে যেটাকে আমরা বলছি তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব। বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা এই তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবে অংশ নেবে তারা পরবর্তী পৃথিবীকে শাসন করবে।
আমরা শিল্পবিপ্লবে অংশ নিতে পারি নি বলে বাইরের দেশ আমাদের শাসন-শোষণ করেছে। আমরা আবার সেটা হতে দিতে পারি না। এই নতুন তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবে আমাদের অংশ নিতেই হবে। সেই দায়িত্বটা পালন করতে হবে নতুন প্রজন্মকে, যারা নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে জ্ঞানে- বিজ্ঞানে এবং প্রযুক্তিতে। তারা ঠিকভাবে লেখাপড়া করবে, অন্য সব বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণিত এবং ইংরেজিতেও সমান দক্ষ হয়ে উঠবে, কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচিত হবে। যখন কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পাবে তখন সেটাকে বিনোদনের একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে শেখার একটা মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহার করবে, নিজেদের সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ হিসেবে গড়ে উঠে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে তুলতে সাহায্য করবে।

Content added By

মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্ম ১৯৫২ সালে সিলেট শহরে। তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ আঠারো বছর থেকে তিনি দেশে ফিরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যোগ দেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যে লেখালেখি করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাঁকে ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে আমি তপু, বৃষ্টির ঠিকানা, প্রোজেক্ট নেবুলা, নিঃসঙ্গ গ্রহচারী, নিতু ও তার বন্ধুরা, ক্রমিয়াম অরণ্য ও দীপু নম্বর টু উল্লেখযোগ্য।

Content added By

ডিজিটাল (Digital) : কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক কাজকর্ম করার জন্যে যে বৈদ্যুতিক সংকেত ব্যবহার করা হয় তার নির্দিষ্ট মান রয়েছে। সুনির্দিষ্ট এই মানের একটিকে ০ অন্যদিকে 1 বিবেচনা করে বাইনারি সংখ্যা হিসেবে কম্পিউটারের ভেতরে সকল হিসেব-নিকেশ করা হয়। সম্ভাব্য সব মান ব্যবহার না করে সুনির্দিষ্ট দুটি মান দুটি অঙ্ক (Digit) এর জন্যে রয়েছে। তাই ব্যবহার করার প্রক্রিয়াটিকে সাধারণভাবে ডিজিটাল বলা হয় ।

প্রোগ্রাম : কম্পিউটারকে একটি নির্দেশ দেওয়া হলে সেটি সেই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। এরকম অসংখ্য নির্দেশকে পাশাপাশি সাজিয়ে কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা হয় এবং কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে কম্পিউটার দিয়ে অনেক জটিল কাজ করানো সম্ভব হয়।
অবলাল : আলো একটি তরঙ্গ। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি নির্দিষ্ট মান থেকে কম হলে আমরা দেখতে পাই না। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি আরেকটি নির্দিষ্ট মান থেকে বড়ো হয় তবে সেটাও আমরা দেখতে পাই না। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে বড়ো হওয়ার কারণে যে আলোকে আমরা দেখতে পাই না সেটাকে অবলাল বলে ।

জিপিএস : Global Positioning System (GPS) দিয়ে পৃথিবীর যে কোনো জায়গার : অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে বের করা যায়। মহাকাশে অনেকগুলো কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে। এই উপগ্রহ থেকে পাঠানো সংকেত ব্যবহার করে জিপিএসের মাধ্যমে কোনো কিছুর অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে বের করা হয়।

 

 

Content added By

বর্তমান পৃথিবী হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির যুগ- অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংরক্ষণ আর তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। তথ্য প্রযুক্তির এই বিপ্লবের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে ‘কম্পিউটার' নামের যন্ত্রটি। এটি মানুষের নির্দেশে কাজ করে, তাই একজন মানুষ যতটুকু সৃজনশীল তার কম্পিউটারের কাজ করার ক্ষমতাও ঠিক ততটুকু চমকপ্রদ । দুই শ বছর আগে পৃথিবীতে একটা শিল্পবিপ্লব হয়েছিল, সেই বিপ্লবে যারা অংশ নিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তারাই পৃথিবীকে শাসন করেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে শিল্পবিপ্লবের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটছে— যারা এই বিপ্লবে অংশ নেবে তারাই নতুন পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশকে পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্যে নতুন প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তিতে নিজেদের দক্ষ করে তুলবে সেটি সবারই প্রত্যাশা। ‘তথ্য প্রযুক্তি' প্রবন্ধটি আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তিগতভাবে প্রশিক্ষিত হওয়ার ধারণা দেয়; কারণ বর্তমান পৃথিবী তথ্য প্রযুক্তিতে বিপুল উন্নতি সাধন করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশ ।

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion