নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - NCTB BOOK

পানির আরেক নাম জীবন। শুধু জীবন ধারণের জন্য নয়, দেশের উন্নয়নের জন্যও আমাদের পানির দরকার। নানা উৎস থেকে আমরা পানি পাই। নানা কারণে আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় এই পানির উৎস হুমকির মুখে পড়ছে। এই অধ্যায়ে আমরা এই হুমকিগুলোর কথা জানব এবং কেমন করে তার মোকাবেলা করতে পারব, সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:

  • পানির ধর্ম বর্ণনা করতে পারব।
  • পানির গঠন ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পানির বিভিন্ন উৎস বর্ণনা করতে পারব।
  •  জলজ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা এবং পানির মানদন্ড ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পরিবেশ সংরক্ষণে পানির পুনরাবর্তন ধাপসমূহে পানির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারব।
  •  মানসম্মত পানির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব।
  • পানি বিপুখকরণ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
  •  বাংলাদেশে পানির উৎসে দূষণের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পানিদূষণের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • বাংলাদেশের মিঠা পানিতে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • পানিদূষণ প্রতিরোধের কৌশল ও নাগরিকের দায়িত্ব বর্ণনা করতে পারব।
  • উন্নয়ন কার্যক্রমে পানির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারব।
  •  বাংলাদেশে পানির উৎসে হুমকির প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • পানির উৎস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এবং কৌশল বর্ণনা করতে পারব।
  •  পানি প্রাপ্তি সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার – ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পানিপ্রবাহের সর্বজনীনতা এবং আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি বর্ণনা করতে পারব ।
  • বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার এবং সুস্থ জীবনযাপনে এর প্রভাব বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজ পরিচালনা করতে পারব।
  • পানির সংকটের (গৃহস্থালি/কৃষি/শিল্পে ব্যবহার) কারণ অনুসন্ধান করতে পারব।
  • পানি ব্যবহার ও পানির সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পোস্টার অঙ্কন করতে পারব।
  • পানির উৎসে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ, দূষণ রোধ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করব।
  •  “পানি নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকার” বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করব।
  • পানির অপচয়রোধ এবং কার্যকর ব্যবহারে সচেতন হব।

 

 

Content added || updated By
এসিডিক
ক্ষারীয়
নিরপেক্ষ
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ

পৃথিবীতে যত ধরনের তরল পদার্থ পাওয়া যায়, পানি তার মাঝে সবচেয়ে সহজলভ্য। মানুষের শরীরের শতকরা ৬০-৭৫ ভাগই হচ্ছে পানি। মাছ, মাংস কিংবা শাক-সবজিতে শতকরা ৬০-৯০ ভাগ পানি থাকে। পৃথিবীপৃষ্ঠের শতকরা ৭৫ ভাগই হচ্ছে পানি। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য, তাই পানির আরেক নাম হচ্ছে জীবন। তাহলে পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
 

Content added By

গলনাংক ও স্ফুটনাংক
তোমাদের কি মনে আছে, পানির গলনাংক আর স্ফুটনাংক কত? পানি যখন কঠিন অবস্থায় থাকে সেটিকে আমরা বলি বরফ। যে তাপমাত্রায় বরফ গলে যায়, সেটিই হচ্ছে বরফের গলনাংক। বরফের গলনাংক ০° সেলসিয়াস। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলীয় চাপে যে তাপমাত্রায় তরল পদার্থ বাষ্পে পরিণত হয়, তাকে বলে স্ফুটনাংক। পানির স্ফুটনাংক ৯৯.৯৮° সেলসিয়াস যেটা ১০০° সেলসিয়াসের খুবই কাছাকাছি। তাই সাধারণভাবে আমরা পানির স্ফুটনাংক ১০০° সেলসিয়াস বলে থাকি ।বিশুদ্ধ পানি স্বাদহীন, গন্ধহীন আর বর্ণহীন। তোমরা কি জান পানির ঘনত্ব কত? পানির ঘনত্ব তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। ৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি আর সেটি হচ্ছে ১ গ্রাম/সি.সি বা ১০০০ কেজি/মিটার কিউব। অর্থাৎ ১ সি.সি. পানির ভর হলো ১ গ্রাম বা ১ কিউবিক মিটার পানির ভর হলো ১০০০ কেজি।
 

বিদ্যুৎ বা তড়িৎ পরিবাহিতা
বিশুদ্ধ পানিতে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ পরিবাহিত হয় না, তবে এতে লবণ কিংবা এসিডের মতো তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ দ্রবীভূত থাকলে তড়িৎ পরিবাহিত হয়। পানির একটি বিশেষ ধর্ম হলো এটি বেশির ভাগ অজৈব যৌগ আর অনেক জৈব যৌগকে দ্রবীভূত করতে পারে। এজন্য পানিকে সর্বজনীন দ্রাবকও বলা হয়। পানি একটি উভধর্মী পদার্থ অর্থাৎ কখনো এসিড, কখনো ক্ষার হিসেবে কাজ করে। সাধারণত এসিডের উপস্থিতিতে পানি ক্ষার হিসেবে আর ক্ষারের উপস্থিতিতে এসিড হিসেবে কাজ করে। তবে বিশুদ্ধ পানি পুরোপুরি নিরপেক্ষ অর্থাৎ এর pH হলো ৭, যেটি সম্পর্কে আমরা সপ্তম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা জানব।
 

পানির গঠন
তোমাদের মনে কি প্রশ্ন জেগেছে যে আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য এই পানি কী দিয়ে তৈরি? পানি দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু (চিত্র ২.০১) দিয়ে গঠিত। তাই আমরা রসায়ন পড়ার সময় পানিকে H,O লিখি অর্থাৎ এটিই হলো পানির সংকেত।আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন আমরা জানি যে আমরা যে পানি দেখি সেখানে অনেক পানির অণু একসাথে ক্লাস্টার (Cluster) হিসেবে থাকে।

 

Content added By

তোমরা কি বলতে পারবে আমাদের অতি দরকারি এই পানি আমরা কোন উৎস থেকে পাই? পানির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সাগর, মহাসাগর বা সমুদ্র। পৃথিবীতে যত পানি আছে, তার প্রায় শতকরা ৯ ভাগেরই উৎস হচ্ছে সমুদ্র। সমুদ্রের পানিতে প্রচুর লবণ থাকে এজন্য সমুদ্রের পানিকে লোনা পানিও (Marine water) বলে। লবণের কারণে সমুদ্রের পানি পানের অনুপযোগী, এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কাজেও সমূদ্রের পানি ব্যবহার করা যায় না।পানির আরেকটি বড় উৎস হলো হিমবাহ তুবার স্রোত, যেখানে পানি মূলত বরফ আকারে থাকে। এই উৎসে প্রায় শতকরা ২ ভাগের মতো পানি আছে। উল্লেখ্য যে বরফ আকারে থাকায় এই পানিও কিছু অন্য কাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। ব্যবহার উপযোগী পানির উৎস হলো নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ, পুকুর কিংবা ভূগর্ভস্থ পানি। ভূগর্ভস্থ পানি আমরা নলকুপের মাধ্যমে তুলে আনি। পাহাড়ের উপর জমে থাকা বরফ বা তুষার গলেও বার্ণা সৃষ্টি করতে পারে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে ব্যবহারের উপযোগী পানি মাত্র শতকরা ১ ভাগ।
 

বাংলাদেশে মিঠা পানির উৎস
আমরা আমাদের বাসায় রান্না থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, গোসল কিংবা খাওয়ার পানি কোথা থেকে পাই? মাঠে ফসল ফলাতে কখনো কখনো (যেমন: ইরি ধানের জন্য) প্রচুর পরিমাণে পানির দরকার হয় । এ পানিই বা আমরা কোথা থেকে পাই? আমাদের দেশে ঝর্ণা তেমন একটা না থাকায় মিঠা পানির মূল উৎস হচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, হ্রদ এবং ভূগর্ভের পানি। তবে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ করে আর্সেনিক থাকার বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকার ভূগর্ভের পানি পানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই ঐ সকল এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার পর পরিশোধন করে সেটি পান করতে বাধ্য হয়েছে।
 

 

 

Content added By

তোমরা কচুরিপানা, ক্ষুদিপানা, ওড়িপানা, সিংগারা, টোপাপানা, শাপলা, পদ্ম, শ্যাওলা, হাইড্রিলা, কলমি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম ইত্যাদি নানা রকম জলজ উদ্ভিদের নাম শুনেছ এবং তাদের অনেকগুলো নিজের চোখেও দেখেছ। এরা কোথায় জন্মে জান? এদের বেশির ভাগই পানিতে জন্মে (চিত্র ২.০২) এবং কিছু কিছু আছে (যেমন: কলমি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম) যারা পানিতে আর মাটিতে দুজায়গাতেই জন্মে। অর্থাৎ পানি না থাকলে বেশির ভাগ জলজ উদ্ভিদ জন্মাতই না, কিছু কিছু হয়তো জন্মাতো কিন্তু বাঁচতে পারত না কিংবা বেঁচে থাকলেও বেড়ে উঠতে পারত না। তখন কী হতো? তখন পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটত। তার কারণ, এই জলজ উদ্ভিদগুলো একদিকে যেমন সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখে, অন্যদিকে এদের অনেকগুলো বিশেষ করে শ্যাওলাজাতীয় জলজ উদ্ভিদগুলো জলজ প্রাণীদের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। এসব জলজ উদ্ভিদ না থাকলে মাছসহ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতো। তোমরা জান যে উদ্ভিদগুলো সাধারণত মুলের মাধ্যমে পানি আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে। কিন্তু জলজ উদ্ভিদগুলো সারা দেহের মাধ্যমেই পানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান বিশেষ করে খনিজ লবণ সংগ্রহ করে থাকে।

তাই এদের পুরো দেহ পানির সংস্পর্শে না এলে এদের বেড়ে ওঠাই হতো না।অনেক জলজ প্রাণী বাঁচতেই পারত না, যেটি চিত্র ২.০২; ক্ষুদিপানা, টোপাপানা এবং কচুরিপানা হচ্ছে জলজ উদ্ভিদের উদাহরণ।আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে জলজ উদ্ভিদের কাণ্ড আর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুব নরম হয়, যেটা পানির স্রোত আর জলজ প্রাণীর চলাচলের সঙ্গে মানানসই। পানি ছাড়া শুকনো মাটিতে এদের জন্ম হলে এরা ভেঙে পড়ত এবং বেড়ে উঠতে পারত না এমনকি বাঁচতেও পারত না।তোমরা কি জ্ঞান জলজ উদ্ভিদ কীভাবে বংশবিস্তার করে? জলজ উদ্ভিদগুলো সাধারণত অম্লক্ষ উপারে বংশবিস্তার করে। পানি না থাকলে এই বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হতো। ভাই আমরা বলতে পারি, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জলজ উদ্ভিদগুলোর জন্ম খুবই জরুরি এবং তাদের বেড়ে উঠার জন্য পানির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পানি না থাকলে জলজ উদ্ভিদগুলো জন্মাতে পারত না, জন্মালেও বাঁচতে পারত না, তার ফলে পরিবেশের ভয়াবহ একটি বিপর্যয় ঘটত।


হাজার হাজার জলজ প্রাণীর মাঝে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত জলজ প্রাণী হচ্ছে মাছ। মাছ ধরে পানির বাইরে রেখে দিলে কী হয়? তোমরা সবাই দেখেছ যে মাছ মরে যায়। কেন মরে যায়? কারণ আমরা যেরকম বাতাস বা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারি না, দম বন্ধ হয়ে মারা যাই, মাছের বেলাতেও তাই ঘটে। মাছ অক্সিজেন গ্রহণ করে ফুলকা দিয়ে আর ফুলকা এমনভাবে তৈরি যে এটি শুধু পানি থেকেই অক্সিজেন নিতে পারে, বাতাস থেকে নয়। যদি পানি না থাকত তাহলে কোনো মাছ বাঁচতে পারত না। শুধু মাছ নয়, যেসব প্রাণী ফুলকা দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে শ্বাসকার্য চালায়, তাদের কোনোটাই বাঁচতে পারত না। ফলে পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ত আর আমাদেরও বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত। তোমরা আগের অধ্যায় থেকে জেনেছ যে প্রোটিন আমাদের বেড়ে ওঠার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই আসে মাছ থেকে। কাজেই পানি না থাকলে আমরা প্রয়োজনীয় প্রোটিন পেতাম না, যার ফলে আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কোনো জৈবিক প্রক্রিয়াই ঠিকভাবে ঘটতো না।
 

Content added By

পানি অত্যন্ত মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে নদ-নদীর পানি আমাদের পরিবেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, এটি জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণীর আশ্রয়স্থল (Habitat)। শুধু তা-ই নয়, এই পানি কৃষিকাজে সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়। একইভাবে জাহাজের নাবিকেরা, লঞ্চ, নৌযান বা ট্রলার দিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে, তারা সবাই নদ-নদী বা সমুদ্রের পানিই প্রক্রিয়া করে পান করে, তাদের অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করে থাকে। তাই পানির নির্দিষ্ট মান যদি বজায় না থাকে তাহলে এটি জীববৈচিত্র্য বা পরিবেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর হবে, তেমনি অন্যান্য কাজেও এর ব্যবহার ব্যাহত হবে। এবার তাহলে পানির মানদণ্ড সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া যাক :
পানির মানদণ্ড নির্ভর করে সেটি কোন কাজে ব্যবহার করব তার ওপর। প্রথমে নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা সমুদ্রের পানির মানদণ্ড কেমন হওয়া উচিত সেটা জেনে নিই ।
বর্ণ ও স্বাদ: তোমরা জান যে বিশুদ্ধ পানি বর্ণহীন আর স্বাদহীন হয়, তাই পানিতে বসবাসকারী প্রাণী আর উদ্ভিদের জন্য নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির পানি বর্ণহীন আর স্বাদহীন হওয়াই উত্তম।
 

ঘোলার পরিমাণ
পানি ঘোলাটে হলে সেটি পানিতে বসবাসকারী প্রাণী আর উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তার কারণ, পানি ঘোলা হলে সূর্যের আলো পানির নিচে থাকা উদ্ভিদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, যার ফলে সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে একদিকে পানিতে থাকা উদ্ভিদের খাবার তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে, যেটা তাদের বৃদ্ধিকে কমিয়ে দেয়, অন্যদিকে সালোকসংশ্লেষণের ফলে যে অক্সিজেন তৈরি হতো, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। পানি ঘোলা হলে মাছ বা অন্য প্রাণী ঠিকমতো খাবার সংগ্রহ করতে পারে না।পানি ঘোলা হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক কারণ, অর্থাৎ নদীভাঙন, পলি মাটি ইত্যাদি। আবার মানব সৃষ্ট কারণেও পানি ঘোলা হয়, যেমন তেল, গ্রিজ ও অন্যান্য অদ্রবণীয় পদার্থের উপস্থিতি। পানিতে এসব পদার্থ, বিশেষ করে মাটি আর বালি বেড়ে গেলে তা এক পর্যায়ে নদ-নদীর তলায় জমা হতে থাকে। ফলে নাব্যতা হ্রাস পায় এবং নৌযান চলাচলে অসুবিধা ঘটে। তোমরা সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে নিশ্চয়ই লঞ্চ, স্টিমার ডুবো চরে আটকে পড়ার খবর দেখে থাকবে। কেন এগুলো আটকে পড়ে? নাব্যতা কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।
 

তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি
নদ-নদীর পানিতে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকলে সেটা জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণীর দেহে ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই নদ-নদীর পানি পুরোপুরি তেজস্ক্রিয়তামুক্ত হতে হবে। ময়লা-আবর্জনা নদ-নদীসহ সকল প্রাকৃতিক পানি অবশ্যই ময়লা-আবর্জনামুক্ত হতে হবে। কারণ ময়লা-আবর্জনা থেকে জীবন ধ্বংসকারী সব ধরনের জীবাণু তৈরি হয়।
 

দ্রবীভূত অক্সিজেন
আমাদের নিঃশ্বাসের জন্য যে রকম অক্সিজেনের দরকার হয়, ঠিক সেরকম পানিতে বসবাসকারী প্রাণীদেরও শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেনের দরকার হয়। এই অক্সিজেন তারা কোথা থেকে পায়? তারা এই অক্সিজেন পায় পানিতে দ্রবীভূত হয়ে থাকা অক্সিজেন থেকে। কোনো কারণে যদি এই অক্সিজেন নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কমে যায়, তাহলে জলজ প্রাণীগুলোর সমস্যা হতে থাকে। যদি পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন না থাকে, তাহলে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী বাঁচতেই পারে না। জলজ প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য ১ লিটার পানিতে কমপক্ষে ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকা দরকার।
তাপমাত্রা
তাপমাত্রা পানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে, একদিকে যেমন দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়, অন্যদিকে জলজ প্রাণীর প্রজনন থেকে শুরু করে সব ধরনের শারীরবৃত্তীয় কাজেরও সমস্যা সৃষ্টি হয়।

PH
pH হলো এমন একটি রাশি, যেটি দ্বারা বোঝা যায় পানি বা অন্য কোনো জলীয় দ্রবণ এসিডিক, ক্ষারীয় না নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ হলে pH হয় ৭, এসিডিক হলে ৭-এর কম, আর ক্ষারীয় হলে ৭-এর বেশি। এসিডের পরিমাণ যত বাড়বে, pH-এর মান তত কমে, অন্যদিকে ক্ষারের পরিমাণ যত বাড়ে, pH-এর মানও তত বাড়ে। নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির জন্য pH-এর মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত নদ-নদীর পানি ক্ষারীয় হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে নদ-নদীর পানির pH যদি ৬-৮ এর মধ্যে থাকে, তাহলে সেটা জলজ উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে না। তবে pH-এর মান যদি এর চাইতে কমে যায় বা বেড়ে যায়, তাহলে ঐ পানিতে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মাছের ডিম, পোনা মাছ পানির pH খুব কম বা বেশি হলে বাঁচতে পারে না। পানিতে এসিডের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে, অর্থাৎ pH এর মান খুব কমে গেলে জলজ প্রাণীদের দেহ থেকে ক্যালসিয়ামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ বাইরে চলে আসে, যার ফলে মাছ সহজেই রোগাক্রান্ত হতে শুরু করে।
 

লবণাক্ততা
তোমরা কি জান আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় মিঠা পানিতে আসে কেন? ইলিশ সামুদ্রিক মাছ অর্থাৎ লবণাক্ত পানির মাছ হলেও প্রজননের সময় অর্থাৎ ডিম ছাড়ার সময় মিঠা পানিতে আসে কারণ সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে, যা ডিম নষ্ট করে ফেলে, ফলে ঐ ডিম থেকে আর পোনা মাছ তৈরি হতে পারে না। তাই প্রকৃতির নিয়মেই ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার সময় হলে মিঠা পানিতে আসে। তবে সব মাছের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। কিছু মাছ এবং জলজ প্রাণী লবণাক্ত পানিতেই প্রজনন করতে পারে।
 

Content added || updated By

পানির পুনরাবর্তন
এর আগে তোমরা দেখেছ যে ভূপৃষ্ঠের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগই পানি দ্বারা আবৃত; কিন্তু বেশির ভাগ পানিই (শতকরা ৯৭ ভাগ) লবণাক্ত, তাই সেই পানি সরাসরি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায় না। আমাদের যে শতকরা ১ ভাগ মিঠা পানি (Fresh water) সঞ্চিত আছে, তার একটি অংশবিশেষ করে নদ-নদী, খাল-বিল ও হ্রদের পানি নানাভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত হয়ে চলেছে। এমনকি ভূগর্ভের যে পানি আমরা কূপ বা নলকূপ থেকে পাই এবং খাওয়া থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার করি, সেটিও নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ (যেমন: আর্সেনিক) দিয়ে দূষিত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যদিও আমাদের পানিসম্পদ প্রচুর, কিন্তু ব্যবহার করার উপযোগী পানির পরিমাণ খুবই অল্প আর সীমিত। তাই পানি ব্যবহারে আমাদের অত্যন্ত সাশ্রয়ী হতে হবে এবং একই পানি কীভাবে বারবার ব্যবহার করা যায়, সেটিও চিন্তা করতে হবে।প্রকৃতিতে পানির কি পুনরাবর্তন ঘটছে? হ্যাঁ, ঘটছে। সপ্তম শ্রেণিতে তোমরা পানিচক্রে দেখেছ যে দিনের বেলা সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠের সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিলের পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে বাষ্প ঘনীভূত হয়ে প্রথমে মেঘ পরে বৃষ্টির আকারে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এই বৃষ্টির পানির বড় একটি অংশ নদ-নদী, খাল-বিল ও সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এবং আবার বাষ্পীভূত হয় ও আবার বৃষ্টির আকারে ফিরে আসে। পানির এই পুনরাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পুনরাবর্তন না হলে কী ধরনের সমস্যা হতো বলতে পারবে? এই পুনরাবর্তন না হলে বৃষ্টি হতো না, যার ফলে পুরো পৃথিবী মরুভূমি হয়ে যেত। প্রচণ্ড খরা হতো, ফসল উৎপাদন কমে যেত। বৃষ্টি হলো প্রাকৃতিকভাবে পানির পুনরাবর্তন।আমরা যদি ব্যবহারের পর বর্জ্য পানি সংগ্রহ করে সেটি পরিশোধন করে আবার ব্যবহার করি তাহলে সেটিও কিন্তু হবে এক ধরনের পুনরাবর্তন।

পরিবেশ সংরক্ষণে পানির ভূমিকা
যেহেতু পরিবেশের প্রায় প্রতিটি উপাদান ও প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পানির উপর নির্ভর করে, তাই পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে পানির ভূমিকা অপরিহার্য। পানি না থাকলে গাছপালা জন্মাবে না, ফসল উৎপাদন হবে না। এক কথায় পানি না থাকলে পুরো পরিবেশের সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্বও ধ্বংস হয়ে যাবে।

মানসম্মত পানির প্রয়োজনীয়তা: সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমরা কী করি? হাত-মুখ ধুই। এ কাজ পানি ছাড়া কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়। হাত-মুখ ধোয়া থেকে শুরু করে গোসল, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া এবং সর্বোপরি খাওয়ার জন্য পানি অপরিহার্য। এই পানি যদি মানসম্মত না হয় তাহলে প্রত্যেকটা কাজেই সমস্যা হবে। উদাহরণ দেয়ার জন্য বলা যায় খাওয়ার পানিতে যদি গন্ধ থাকে বা সেটি যদি লোনা হয়, তাহলে কি আমরা সেটা খেতে পারব? না, পারব না। এর বাস্তব প্রমাণ হলো আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নদী আর ভূগর্ভের পানি লোনা হওয়ায় তারা ঐ পানি খেতে তো পারছেই না, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের বেশির ভাগ কাজে ব্যবহারও করতে পারছে না।

তারা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করে তারপর সেটি পান করছে আর অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছে। আবার খাওয়ার পানি যদি মানসম্মত না হয়, বিশেষ করে এতে যদি রোগ-জীবাণু থাকে, তাহলে সেটা থেকে মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। সমুদ্রের লোনা পানি কি কৃষিকাজে বা শিল্প-কারখানায় ব্যবহার করা যায়? না, সেটাও যায় না। তার কারণ সমুদ্রের পানিতে প্রচুর লবণ থাকে, যেটা শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির (যেমন-বয়লার) ক্ষয়সাধন করে নষ্ট করে ফেলে। একইভাবে আমাদের বেশিরভাগ ফসলও লবণাক্ত পানিতে জন্মাতে পারে না। অর্থাৎ লবণাক্ত পানি কৃষিকাজের জন্যও উপযোগী নয়।  এক কথায় বলা যায়, শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে কৃষিকাজ আর দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটা কাজেই মানসম্মত পানির দরকার হয়। তা না হলে একদিকে যেমন মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও দেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন হতে পারে।

 

Content added By

ভূপৃষ্ঠে যে পানি পাওয়া যায় তাতে নানারকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, এমনকি রোগ সৃষ্টি করতে পারে এরূপ জীবন ধ্বংসকারী জীবাণুও থাকে। তাই ব্যবহারের আগে পানি বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। ভূগর্ভের পানি সাধারণত রোগ-জীবাণু মুক্ত, কিন্তু এই পানিতে আর্সেনিকের মতো নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কথা এখন আমরা সবাই জানি। পানি কীভাবে বিশুদ্ধকরণ করা হবে, সেটি নির্ভর করে এটি কোন কাজে ব্যবহার করা হবে, তার ওপর। স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার জন্য অত্যন্ত বিশুদ্ধ পানি লাগলেও জমিতে সেচকাজের জন্য তত বিশুদ্ধ পানির দরকার হয় না। সাধারণত যেসব প্রক্রিয়ায় পানি বিশুদ্ধ করা হয়, সেগুলো হলো পরিস্রাবণ, ক্লোরিনেশন, স্ফুটন, পাতন ইত্যাদি। নিচে এই প্রক্রিয়াগুলো বর্ণনা করা হলো:

পরিস্রাবণ
ষষ্ঠ শ্রেণিতে তোমরা পরিস্রাবণ সম্পর্কে জেনেছ। পরিস্রাবণ হলো তরল আর কঠিন পদার্থের মিশ্রণ থেকে কঠিন পদার্থকে আলাদা করার একটি প্রক্রিয়া। পানিতে অদ্রবণীয় ধুলা-বালির কণা থেকে শুরু করে নানারকম ময়লা-অ্যাবর্জনার কণা থাকে। এদেরকে পরিস্রাবণ করে পানি থেকে দূর করা হয়। এটি করার জন্য পানিকে বালির স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়, তখন পানিতে অদ্রবণীয় ময়লার কণাগুলো বালির স্তরে আটকে যায়। বালির স্তর ছাড়াও খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি কাপড় ব্যবহার করেও পরিস্রাবণ করা যায়। বর্তমান সময়ে আমাদের অনেকের বাসায় আমরা যেসব ফিল্টার ব্যবহার করি, সেখানে আরো উন্নতমানের সামগ্রী দিয়ে পরিস্রাবণ করা হয় ।
 

ক্লোরিনেশন
যদি পানিতে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু থাকে, তবে তা অবশ্যই দূর করতে হবে এবং সেটি করা হয় জীবাণুনাশক ব্যবহার করে। নানারকম জীবাণুনাশক পানি বিশুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে ক্লোরিন গ্যাস (Cl))। এছাড়া ব্লিচিং পাউডার [(Ca(OCl)Cl] এবং আরও কিছু পদার্থ, যার মাঝে ক্লোরিন আছে এবং জীবাণু ধ্বংস করতে পারে, সেগুলো ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশে বন্যার সময় পানি বিশুদ্ধ করার জন্য যে ট্যাবলেট বা কিট ব্যবহার করা হয়, সেটি কী? সেটি হলো মূলত সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড (NaOCl)। এর মাঝে যে ক্লোরিন থাকে, সেটি পানিতে থাকা রোগ-জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে। ক্লোরিন ছাড়াও ওজোন (O,) গ্যাস দিয়ে অথবা অতিবেগুনি রশ্মি দিয়েও পানিতে থাকা রোগ-জীবাণু ধ্বংস করা যায়। বোতলজাত পানির কারখানায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে পানিকে রোগ-জীবাণুমুক্ত করা হয়।

স্ফুটন
পানির স্ফুটনের কথা তোমরা সবাই জান। এ প্রক্রিয়ায় কি পানিকে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব? হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। পানিকে খুব ভালোভাবে ফুটালে এতে উপস্থিত জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। প্রশ্ন হতে পারে, জীবাণুমুক্ত করার জন্য কতক্ষণ পানি ফুটাতে হয়? স্ফুটন শুরু হওয়ার পর ১৫-২০ মিনিট ফুটালে সেই পানি জীবাণুমুক্ত হয়। বাসা-বাড়িতে খাওয়ার জন্য এটি একটি সহজ এবং সাশ্রয়ী প্রক্রিয়া।
 

পাতন
পাতন প্রক্রিয়ার কথা তোমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে জেনেছ। যখন খুব বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়, তখন পাতন প্রক্রিয়ায় পানি বিশুদ্ধ করা হয়। যেমন: ঔষধ তৈরির জন্য, পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পুরোপুরি বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাপ দিয়ে সেটাকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। পরে ঐ বাষ্পকে আবার ঘনীভূত করে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ করা পানিতে অন্য পদার্থ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে ।

 

Content added By

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই পানির প্রায় সব উৎস, বিশেষ করে ভূপৃষ্ঠের পানি, প্রতিনিয়ত নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। এবার আমরা সেই দূষণের কারণগুলো আলোচনা করব।গোসলের পানি, পায়খানার বর্জ্যপানি কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পর সেই পরিত্যক্ত পানি কোথায় যায়, সেটা কি তোমরা জান? বর্জ্যপানির বড় একটি অংশ নর্দমার নলের ভেতর দিয়ে নিয়ে নদ-নদীতে ফেলা হয় এবং সেগুলো পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। এই বর্জ্যপানিতে রোগ-জীবাণু থেকে শুরু করে নানারকম রাসায়নিক বস্তু থাকে, যার কারণে পানি দূষিত হয়। আমাদের বাসায় যেসব কঠিন বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়, সেগুলো আমরা কী করি? সাধারণত বাড়ির পাশে রাখা ডাস্টবিন বা অনেক সময় অবিবেচকের মতো খোলা জায়গায় ফেলে দিই। এসব বর্জ্য পদার্থ ১-২ দিনের মধ্যে পচতে শুরু করে। বৃষ্টি হলে সেই পচা বর্জ্য—যেখানে রোগ-জীবাণুসহ নানারকম রাসায়নিক পদার্থ থাকে, বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নদ-নদী, খাল-বিল বা লেকের পানিকে দুষিত করে।তোমরা সবাই জান, কৃষিকাজে মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সার, জৈব সার আর পোকামাকড় মারার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এসব থেকে কি পানি দূষিত হতে পারে? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। বৃষ্টি হলে অথবা বন্যার সময় কৃষিজমি প্লাবিত হলে কৃষিজমিতে ব্যবহার করা রাসায়নিক আর জৈব সার এবং কীটনাশক বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে।

শিল্প-কারখানা থেকে কি পানি দূষিত হতে পারে? হ্যাঁ, পারে। নদ-নদীর পানিদূষনের সবচেয়ে বড় একটি কারণ হলো শিল্প-কারখানায় সৃষ্ট বর্জ্য। তোমরা কি কেউ বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়েছ? গেলে দেখবে এর পানিতে দুর্গন্ধ এবং এর রং কুচকুচে কালো। এর কারণ হলো, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এক সময় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি দ্রব্য চামড়া তৈরির কারখানা। এই চামড়ার কারখানা থেকে প্রচুর বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ার ফলে এর পানি দূষিত হচ্ছে। সংবাদপত্র আর টেলিভিশনে বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বুড়িগঙ্গার মতো বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদীর পানি টেক্সটাইল মিল, ডাইং, রং তৈরির কারখান, সার কারখানা, কাগজ তৈরির কারখানা ইত্যাদি নানারকম শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থ দিয়ে দূষিত হচ্ছে। নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার বা জাহাজ থেকে ফেলা মলমূত্র আর তেলজাতীয় পদার্থের মাধ্যমেও নদ-নদী আর সমুদ্রের পানি দূষিত হয়। নদীর ভাঙন, ঝড়-তুফান দিয়েও মাটি, ধূলিকণা বা অন্যান্য পদার্থ পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। পরীক্ষাগার থেকে পরিত্যক্ত পানি যেখানে এসিড, ক্ষারসহ নানারকম রাসায়নিক পদার্থ থাকে, সেগুলোও পানিকে দূষিত করে। রাসায়নিক পদার্থ যেমন, আর্সেনিক দিয়ে ভূগর্ভের পানিদূষণের কথা এখন আমাদের সবারই জানা।

 

Content added By

নদ-নদী, ডোবা-পুকুর, খাল-বিল এবং ভূগর্ভের উৎসের পানি দূষিত হলে সেটি উদ্ভিদ, প্রাণী আর মানুষের উপর নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি কখনো কখনো সেগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। পানিদূষণের এই সকল ক্ষতিকর দিকগুলো এবার তাহলে একটুখানি দেখে নেওয়া যাক। তোমরা কি জান, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, সংক্রামক হেপাটাইটিস বি— এসবই পানিবাহিত রোগ? হ্যাঁ, এই সকল জীবন ধ্বংসকারী রোগসহ অনেক রোগ পানির মাধ্যমে ছড়ায়, এমনকি সতর্ক না হলে এই রোগগুলো মহামারী আকারও ধারণ করতে পারে। এসব রোগের জীবাণু নানাভাবে পানিতে প্রবেশ করে, বিশেষ করে মলমূত্র, পচা জিনিস দিয়ে সহজেই এটা ঘটে। সেই পানিতে গোসল করলে, সেই পানি পান করলে, কিংবা সেই পানি দিয়ে খাবার রান্না করলে বা ধোয়াধুয়ি করলে অথবা অন্য যেকোনোভাবে সেই দূষিত পানির সংস্পর্শে এলে সেটি মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হয়। শুধু তা-ই নয়, কিছু কিছু জৈব পদার্থ আছে, যেমন- গোবর, গাছপালার ধ্বংসাবশেষ, খাদ্যের বর্জ্য সেগুলো পচনের সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। তোমরা বল তো এর ফলে জীবনের জন্য পানি কী হতে পারে? বুঝতেই পারছ এর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়। যদি ঐ সকল পদার্থ খুব বেশি থাকে, তাহলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ একেবারে শূন্যে নেমে আসতে পারে। তখন পানিতে বসবাসকারী মাছসহ সকল প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে এক সময় ঐ সকল নদ- নদী, খাল-বিল প্রাণীশূন্য হয়ে পড়বে।

আমেরিকার উত্তর ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ইরি (Erle) নামের একটি হ্রদ আছে, যাকে ১৯৬০ সালের দিকে মৃত হ্ৰদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হলো, ঐ হ্রদের চারপাশে বেশ কয়েকটি ডিটারজেন্ট তৈরির কারখানা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ঐ হ্রদে ফেলার ফলে সেখানে ফসফেটের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। পানিতে ফসফেট আর নাইট্রোজেন খুব বেড়ে গেলে তা প্রচুর শ্যাওলা জন্মাতে সাহায্য করে। এই শ্যাওলাগুলো যখন মরে যায়, তখন পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। যার ফলে মাছসহ সকল প্রাণী মরে গিয়ে একপর্যায়ে ইরি “মৃত” একটি হ্রদে পরিণত হয়।এ ঘটনার পর আমেরিকার সরকার আইন করে বিশুদ্ধকরণ ছাড়া শিল্প-কারখানার বর্জ্যপানি হ্রদে ফেলা নিষিদ্ধ করে দেয়।

ডিটারজেন্ট কারখানাগুলো তারপর থেকে বর্জ্যপানি ফসফরাসমুক্ত করার পরে হ্রদে ফেলা শুরু করে এবং আশ্চর্যজনকভাবে, প্রায় দশ বছর পরে ইরি হ্রদে আবার প্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়তে শুরু করে ।আমাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে এখন কি মাছ পাওয়া যায়? না, পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এর অবস্থা অনেকটাই ইরি হ্রদের মতো। শুধু বুড়িগঙ্গা নদী নয়, আমাদের দেশের অনেক নদ-নদীর পানিই শিল্প-কারখানার সৃষ্ট বর্জ্যপানির কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে, যার কারণে এদের অবস্থা ইরি হ্রদের মতো হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের এখনই সতর্ক না হলে এটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আশার কথা, বুড়িগঙ্গা এবং অন্যান্য নদীর পানি দূষণযুক্ত করার জন্যে নানা ধরনের পরিকল্পনা করে কাজ শুরু হয়েছে।ময়লা-আবর্জনাসহ, শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ মরে গেলে একদিকে যেমন অক্সিজেন স্বল্পতার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি পানিতে প্রচন্ড দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। এতে করে পানিতে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, নৌকাভ্রমণসহ সব ধরনের বিনোদনমূলক কাজে ব্যাঘাত ঘটে।তোমরা আগেই জেনেছ যে অজৈব পদার্থগুলো (যেমন- এসিড, ক্ষার, লবণ পানিতে বসবাসকারী উদ্ভিদ আর প্রাণীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। পানিতে যদি ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ (যেমন: পারদ, সিসা, আর্সেনিক ইত্যাদি) থাকে, তাহলে ঐ পানি পান করলে মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। পারদ, সিসা আর আর্সেনিকের ক্ষতিকর প্রভাব এরকম:

  • পারদ: মস্তিস্ক বিকল হওয়া, ত্বকের ক্যান্সার, বিকলাঙ্গ হওয়া।
  • নিসা: বিস্তৃষ্ণাবোধ বা খিটখিটে মেজাজ, শরীরে জ্বালাপোড়া, রক্তশূন্যতা, কিডনি বিকল হওয়া, পরিমাণে খুব বেশি হলে মস্তিস্ক বিকল হওয়া।
  • আর্সেনিক: আর্সেনিকোসিস, ত্বক এবং ফুসফুসের ক্যান্সার, পাকস্থলীর রোগ।

কৃষিজমিতে ব্যবহার করা অজৈব সার (নাইট্রেট ও ফসফেট) দিয়ে পানি দূষিত হলেও মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন- ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, সিজিয়াম, রেডন প্রভৃতি দ্বারা পানি দুষিত হলে তা একদিকে যেমন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ, অন্যদিকে তেমনি মানুষের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। তেজস্ক্রিয় পদার্থ জীবদেহে নানা প্রকার ক্যান্সার আর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ সৃষ্টি করে। তোমরা কি বলতে পারবে পানিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কীভাবে আসতে পারে? এর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো (১১ মার্চ, ২০১১ সালে) জাপানের ফুকুশিমা শহরে ঘটে যাওয়া তেজস্ক্রিয় দুর্ঘটনা। ঐ দুর্ঘটনায় সুনামির কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় পদার্থ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পানি থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যেও প্রচুর তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে।
এছাড়া পানিতে অদ্রবণীয় বস্তু থাকলে পানি ঘোলাটে হয়; এর ফলে কী ধরনের সমস্যা হয় সেটা ভোমরা আগেই জেনেছ।

 

Content added || updated By

২.৬.১ পানিতে বৈশ্বিক উষ্ণতাৰ প্ৰভাৰ
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি
বৈশ্বিক উষ্ণতা হলো বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, যা বিভিন্ন কারণে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পানির তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে। প্রায় ১০০ বছর আগে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ১° সেলসিয়াস কম ছিল। তোমরা হয়তো ভাবছ, ১০০ বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা মাত্র ১° সেলসিয়াস বেড়েছে, এটি আর এমনকি ব্যাপার! কিন্তু আসলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, তাপমাত্রা অল্প একটু বেড়ে গেলেই মেরু অঞ্চলসহ নানা জায়গায় সঞ্চিত বরফ গলতে শুরু করে। এ বরফ গলা পানি কোথায় যাবে? শেষ পর্যন্ত এই পানি সমুদ্রে গিয়েই পড়বে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর যে সকল দেশ নিচু, সেগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশ হচ্ছে সেরকম নিচু এলাকার একটি দেশ!
 

লবণাক্ততা
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদ-নদী, খাল- বিল, পুকুর, ভূগর্ভস্থ পানি আর হ্রদের পানিতে মিশে যাবে। এর কথায় পানির সকল উৎসই লবণাক্ত হয়ে পড়বে। পানির সকল উৎস লবণাক্ত হলে কী কী অসুবিধা হবে? প্রথমত মিঠা পানিতে বসবাসকারী জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এবং এক পর্যায়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার কারণ, পানির তাপমাত্রা বাড়লে যেরকম পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়, ঠিক সেরকম লবণাক্ততা বাড়লেও দ্রবীভূত অক্সিজেন অনেক কমে যাবে, যার ফলে জলজ প্রাণীরা আর বেঁচে থাকতে পারবে না। জলজ উদ্ভিদের বড় একটি অংশ লবণাক্ত পানিতে জন্মাতেও পারে না, বেড়ে উঠতেও পারে না, যে কারণে পানির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
 

বৃষ্টিপাত
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ সংক্রান্ত কম্পিউটার মডেলিং থেকে ধারণা করা যায়, কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, আবার কোনো কোনো এলাকায়, বিশেষ করে নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে খরা সৃষ্টি হয়, এমনকি বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতেও পরিণত হতে পারে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আর ধরন পরিবর্তন হলে নদ-নদী, খাল-বিলে পানির পরিমাণ এবং প্রবাহ পরিবর্তিত হবে, যা অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কম্পিউটার মডেলিং থেকে এটাও অনুমান করা যায়, কোনো এলাকায় শীতকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, যা থেকে অসময়ে বন্যা হতে পারে।

 

Content added || updated By

বাংলাদেশে বৈশ্বিক উষ্ণতার একটি বড় প্রমাণ হলো, এখন গ্রীষ্মকালে অনেক বেশি গরম পড়ে, এমনকি মাঝে মাঝে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা ৪৭° সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায় যেটি আগে কখনো হয়নি। তাপমাত্রার উপাত্ত থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে গ্রীষ্মকাল ও শীতকাল- দুই সময়েই তাপমাত্রা আগের তুলনায় বেশি থাকে। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মিঠা পানিতে এর প্রভাব কী হবে? তোমরা আগেই জেনেছ যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বাড়লে পৃথিবীতে সঞ্চিত বরফ গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এর প্রভাব বাংলাদেশে অনেক বেশি তীব্র হবে, যার কারণে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে আমাদের দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অংশ পানির নিচে চলে যাবে। সাগরের লবণাক্ত পানি মূল ভূখন্ডে ঢোকার কারণে নদ-নদী, খাল-বিল আর ভূগর্ভের পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে। যার ফলে দেশে মিঠা পানি বলতে আর কিছু থাকবে না। তোমরা হয়তো জান যে, সাতক্ষীরাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় চিংড়ি চাষের জন্য নালা কেটে লবণার পানি মূল ভূখণ্ডে আনা হয়। এ কারণে ঐ সকল এলাকার ভূগর্ভের পানিসহ মিঠা পানির অন্যান্য উৎসও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে খাওয়ার এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার উপযোগী পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বলতে গেলে ঐ সকল এলাকার মিঠা পানির একমাত্র উৎস এখন বৃষ্টির পানি। এমনও দেখা গেছে যে প্রায় ১০-১৫টি গ্রামের মানুষ সবাই মিলে একটি পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে এবং সারা বছর সেই পানি ব্যবহার করছে। 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পানি আনার জন্য গৃহবধূদের অনেক সমর ৭-৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুকুরে ধরে রাখা পানি আনতে হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে প্রায় পুরো বাংলাদেশেই এ অবস্থা হতে পারে।ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশের অংশ বিশেষ (যেমন: মালদ্বীপ, ভারতের কিছু অংশ) বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানির নিচে ডুবে গেছে এবং ঐ সকল দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ “জলবায়ু শরণার্থীতে” পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গিয়ে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ আর গতিপথও পাল্টে যেতে পারে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।


 

Content added By

পানি কীভাবে দূষিত হয় আমরা মোটামুটিভাবে সেটা জেনেছি। পানিদূষণ প্রতিরোধ করতে হলে দূষণের কারণগুলো জেনে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাটাই হবে দূষণ প্রতিরোধের বড় কৌশল। পানিদূষণ প্রতিরোধে কী কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, সেগুলো একটু দেখে নিই।

জলাভূমি: আজকাল আমাদের দেশে জলাভূমি ভরাট করে ঘর-বাড়ি, আবাসন এলাকা, শপিং মল ইত্যাদি তৈরি করা শুরু হয়েছে। তোমরা কি জান যে নিচু জলাভূমি পানি ধারণ করা ছাড়াও যে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে? জলাভূমি একদিকে পানি ধারণ করে যেমন বন্যা নিয়ঋণ করে, অন্যদিকে তেমি ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে, ভূগর্ভে এবং নদীতে বিশুদ্ধ পানি সঞ্চালন করে এবং বন্যপ্রাণীদের সাহায্য করে। বনভূমিও কিন্তু ভূগর্ভে পানি সঞ্চালনে সাহায্য করে এবং একই সাথে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। এগুলো ধ্বংস হলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর দূষণ বেড়ে যায়। জলাভূমি, বনভূমি রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হলে পানির দূষণ অনেক খানি কমে যাবে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন আমাদের দেশেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বৃক্ষরোপণ করে, জলাভূমি, হ্রদ ও সমুদ্রের তীরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে পানির দূষণ রোধে জনসচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছে- সেটি অনেক আশার কথা ।

বৃষ্টির পানি নিয়ন্ত্রণ
শহরাঞ্চলে পানিদূষণের একটি বড় কারণ বৃষ্টির পানির প্রবাহ। তোমরা জান, শহরাঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ বেশিরভাগ এলাকা পাকা হওয়ায় বৃষ্টির পানি এখন এর ভেতর দিয়ে ভূগর্ভে যেতে পারে না। ফলে বৃষ্টির পানি যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা আর অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে নর্দমা আর নালা দিয়ে নদী, জলাশয় বা হ্রদে গিয়ে সেখানকার পানিকে দূষিত করে। কীভাবে এটি বন্ধ করা যায় বাসার ছাদে বৃষ্টির পানি কি সংগ্রহ করা সম্ভব? অবশ্যই এটি সম্ভব এবং খুব সহজেই তা করা যায়। এভাবে সংগ্রহ করা পানি আমরা বাগান বা ফুলের টবে ব্যবহার করতে পারি, এমনকি কাপড়-চোপড় ধোয়া বা পায়খানায় শৌচ কাজেও ব্যবহার করতে পারি। এতে একদিকে যেমন পানির দূষণ বন্ধ হবে, অন্যদিকে তেমনি পানি সরবরাহের উপর চাপও কম পড়বে। তোমরা অনেকেই জান যে ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকালে অনেক এলাকাতে পানির প্রচণ্ড অভাব থাকে। এমনও দেখা গেছে যে কোনো কোনো এলাকায় ৩-৪ দিন একটানা কোনো পানি পাওয়া যায় না। এরকম অবস্থায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করলে পুরো পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সেটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে সরকার, সিটি কর্পোরেশন অথবা নাগরিক সমাজ সবাই নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাসা-বাড়ি ছাড়া অন্যান্য জায়গায় বৃষ্টির পানির দূষণ কীভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে? আমরা কংক্রিটের বদলে কোনো ধরনের ছিদ্রযুক্ত পদার্থ ব্যবহার করতে পারি, যার ভিতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে জমা হতে পারে। গ্রাভেল (Gravel) এরকম একটি পদার্থ, যা কংক্রিটের বদলে ব্যবহার করা যায়। আবার সম্ভব হলে বড় গর্ত বা খাল তৈরি করে সেখানেও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা যায়। পৃথিবীর অনেক বড় শহরেই এ রকম ব্যবস্থা আছে।
 

জনসচেতনতা বৃদ্ধি
তোমরা কি বুঝতে পারছ যে শহরাঞ্চলে পানিদূষণকারী ক্ষতিকর বর্জ্যগুলোর বড় একটি অংশ আসে আমাদের বাসা-বাড়ি থেকে? আমরা অ্যারোসল, পেইন্টস, পরিষ্কারক, কীটনাশক নানারকম ক্ষতিকারক পদার্থ অহরহ ব্যবহার করি এবং ব্যবহারের পর অবিবেচকের মতো খালি কৌটা যেখানে-সেখানে ফেলে দিই বা রেখে দিই, যেগুলো একপর্যায়ে এসে পানি দূষণ করে। এগুলো এভাবে না ফেলে আমরা যদি যথাযথভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলি, তাহলেও কিন্তু পানিদূষণ অনেক কমে যাবে। এসব পদ্ধতিতে দূষণ কমানোর জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য রেডিও-টেলিভিশনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আর সতর্কবার্তা প্রচার করা যেতে পারে। এমনকি তোমরা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা পানির প্রয়োজনীয়তা, অপ্রতুলতা এবং দূষণ প্রতিরোধ বিষয়ে পোস্টার তৈরি করে মানুষকে সচেতন করতে পার। ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
 

শিল্প-কারখানার দ্বারা পানির দূষণ প্রতিরোধ
শিল্প-কারখানার সৃষ্ট বর্জ্যপানি নদীর পানিদূষণের প্রধান একটি কারণ। এই দূষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, সৃষ্ট বর্জ্যপানি পরিশোধন করে তারপর নদীতে ফেলা। এ পরিশোধন কাজের জন্য দরকার বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা (Effluent Treatment Plant : ETP) বা ইটিপি। ইটিপি কীভাবে তৈরি করা হবে, সেটা নির্ভর করে বর্জ্যপানিতে কী ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার ওপর। যেহেতু একেক ধরনের শিল্প-কারখানা থেকে একেক ধরনের বর্জ্যপানি বের হয়, তাই একটি সাধারণ ইটিপি দিয়ে সব কারখানার বর্জ্যপানি পরিশোধন করা সম্ভব নয়। তবে একই ধরনের শিল্প-কারখানা দিয়ে

 

একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলে সব কারখানার বর্জ্যপানি একত্র করে একটি বড় ইটিপিতে পরিশোধন করা যেতে পারে। কৃষিজমি থেকে মাটির ক্ষয়জনিত দূষণ প্রতিরোধ একটি জমিতে বছরের পর বছর ফসল চাষ করলে ধীরে ধীরে তার উর্বরতা নষ্ট হয়, আর উর্বরতা নষ্ট হলে মাটির ক্ষয় অনেক বেড়ে যায়। আমরা যদি জৈব সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়াই, তাহলে সেটি মাটির ক্ষয়রোধ করতে সাহায্য করে। তোমরা কি বলতে পার এটি কীভাবে সম্ভব? মাটিতে জৈব সার থেকে আসা জৈব পদার্থ বেশি থাকে বলে সেটি বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে, বৃষ্টি হলে খুব সহজেই সেটি প্রবাহিত হয়ে যায় না বা মাটির কণা সহজে বাতাসে উড়ে গিয়ে নদীর পানি দূষিত করে না। এতে করে মাটির কণা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ যেমন: কীটনাশক, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের যৌগ ইত্যাদি দ্বারা দূষণও কমে যায়। আবাদি জমির চারপাশে পুকুর খনন করেও পানির দূষণ প্রতিরোধ করা যায়। তোমরা কি জান ক্ষেত থেকে ফসল কাটার পর ফসলের যে অবশিষ্ট অংশ জমিতে থেকে যায়, সেগুলো পানির দূষণ রোধ করে? ফসলের ধরন পরিবর্তন করেও পানিদূষণ রোধ করা যায়। যখন-তখন সার প্রয়োগ না করে ঠিক সময়ে বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের আগ মুহূর্তে সার প্রয়োগ না করে দূষণ প্রতিরোধ করা যায়।
 

উন্নয়ন কার্যক্রমে পানির ভূমিকা
আমাদের দেশ এখনো কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। আর সেই কৃষিকাজে সেচের জন্য দরকার পানি অর্থাৎ পানি ছাড়া কোনোভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঘর-বাড়ি কি পানি ছাড়া তৈরি হয়? না, অসম্ভব। আবার উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ শিল্পে অত্যন্ত উন্নত, এমন কোনো শিল্প কারখানা কি আছে, যেখানে পানির প্রয়োজন নেই? না, নেই। সকল শিল্প-কারখানায় কোনো না কোনো পর্যায়ে পানি ব্যবহার করতেই হয়। তাহলে আমরা বলতে পারি, উন্নয়ন এবং পানি একে অপরের পরিপূরক।

 

Content added By

বাংলাদেশে যে সকল পানির উৎস রয়েছে (নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, হ্রদ) তোমরা কি মনে কর সেগুলো কোনো ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে? হ্যাঁ, আমাদের পানির উৎসগুলো নিশ্চিতভাবেই বেশ কয়েকটি হুমকির মুখে রয়েছে। প্রথমেই বলা যায়, জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে হুমকি। আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যে সকল পানির উৎস রয়েছে (নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, হ্রদ) তোমরা কি মনে কর সেগুলো কোনো ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে? হ্যাঁ, আমাদের পানির উৎসগুলো নিশ্চিতভাবেই বেশ কয়েকটি হুমকির মুখে রয়েছে। প্রথমেই বলা যায়, জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে হুমকি। আমরা ইতোমধ্যে আওতায় নিয়ে আসে এবং বাকি অর্ধেক নর্দমা বা নালা দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। এছাড়া ঢাকার আশপাশের প্রায় সব শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যও নদীতে ফেলা হয়। এর পরিনাম কী? নদী এসব বর্জ্য দিয়ে ভরে উঠছে, নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা ও বালু নদী মরে যাবে। চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশের নদীগুলোরও একই অবস্থা।
 

পানির গতিপথ পরিবর্তন

১৯৭৫ সালে ভারত সরকার ফারাক্কা বাধ দিয়ে গঙ্গার পানির গতিপথ পরিবর্তন করে। ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হয়। পরবর্তীকালে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে আরেকটি চুক্তি হয়। গঙ্গার পানির এই গতিপথ পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে, যা ঐ অঞ্চলকে অনেকটা মরুভূমিতে পরিণত করেছে। শুধু তা-ই নয়, ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতও কাঙ্খিত ফল পায়নি বরং নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছে। এছাড়া ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের পানির গতিপথও পরিবর্তন করে শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার হাওর এলাকাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলে পানিসম্পদে বিপর্যয় নেমে আসবে। সম্প্রতি ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাতেও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বিশাল এলাকা পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে। অতএব এ কথা বলা যায় যে পানির গতিপথ পরিবর্তন পরিবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি।
 

পানি একটি মৌলিক অধিকার

পানি প্রকৃতির এমন একটি দান, যা প্রায় সব জীবের জন্য অপরিহার্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ খাওয়া, গোসল, রান্নাসহ অন্যান্য সকল কাজে পানি ব্যবহার করে আসছে। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা। এর প্রত্যেকটিই পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই পানি হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। আর যেহেতু এটি প্রাকৃতিক সম্পদ, কোনো দেশ বা জাতি এটি সৃষ্টি করেনি, তাই পানির প্রতিটি ফোঁটার উপর পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার রয়েছে। কাজেই আমরা যখন পানি ব্যবহার করি, তখন মনে রাখতে হবে যে আমরা পৃথিবীর সকল মানুষের একটি সম্পদ ভোগ করছি এবং এটি কোনোমতেই অপচয় করা উচিত হয়। অপচয় করার অর্থই হলো অন্যের অধিকার খর্ব করা, যেটি আমরা কিছুতেই করতে পারি না।

 

পানির উৎস সংরক্ষণ ও উন্নয়ন

আমরা সবাই জানি, আমাদের বিশাল একটি পানিসম্পদ আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ব্যবহারযোগ্য পানিসম্পদের পরিমাণ কিন্তু খুবই সীমিত। এ অবস্থায় আমরা যদি পানির উৎস সংরক্ষণে সজাগ না হই, তাহলে একসময় হয়তো ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। যেকোনো ধরনের উন্নয়নকাজে, সেটি শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি বা নগরায়ণ— যা-ই হোক না কেন সবকিছুতেই পানির প্রয়োজন রয়েছে। আবার এই সকল উন্নয়নের কারণে যদি পানির উৎসগুলোই হুমকির মুখে পড়ে যায়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই থমকে যাবে। কাজেই যেখানে-সেখানে শিল্প-কারখানা, নগরায়ণ না করে অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে সেগুলো করতে হবে, যেন কোনোভাবেই পানির উৎসগুলো ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

 

Content added By

তোমরা কি জান, পৃথিবীর সব সাগর-মহাসাগর একটির সাথে আরেকটির সংযোগ আছে? হ্যাঁ, আমাদের সাগর-মহাসাগর বা সমুদ্র— সবগুলোই একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত। আবার পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট নদী এক সময়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ একটি নদী বা সাগর যেখানেই থাকুক না কেন, যে দেশেই এর উৎপত্তি হোক না কেন বা যেখান দিয়েই এটি প্রবাহিত হোক না কেন, আসলে সেগুলো সারা পৃথিবীর সম্পদ। যার অর্থ পানিসম্পদ অবশ্যই একটি সর্বজনীন বিষয়। এটি কোনো জাতি-গোষ্ঠী, দেশ বা মহাদেশের সম্পদ নয়, এটি সবার সম্পদ। বিভিন্ন দেশের মাঝে সৃষ্ট রাজনৈতিক রেষারেষি, উন্নয়ন প্রতিযোগিতা, স্বার্থপর আচরণ এবং অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে পানিসম্পদের এই সর্বজনীনতা অনেক সময়েই মানা হচ্ছে না। তবে জাতিসংঘ ১৯৯৭ সালে বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর ক্ষেত্রে পানির বণ্টন নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি তৈরি করে, যদিও চুক্তিটি এখন পর্যন্ত খুব একটা কার্যকর হয়নি। এছাড়া পানিসম্পদ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।
 

রামসার কনভেনশন
১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে ইরানের রামসারে ইউনেস্কোর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেওয়া জলাভূমি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে রামসার কনভেনশন। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে এই সমঝোতা চুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৭ সালে রামসার কনভেনশন সংশোধন এবং পরিমার্জন করা হয়। আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন (International Water Course Convention) আন্তর্জাতিক আইন সমিতি (The International Law Association) ১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত তাদের ৫২তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ব্যবহার সম্পর্কে একটি কমিটি রিপোর্ট গ্রহণ করে। এটি হেলসিংকি নিয়ম নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন কমিশন আন্তর্জাতিক পানির ব্যবহারের জন্য একটি চুক্তি তৈরি করে, যা ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় কনভেনশন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই কনভেনশন অনুযায়ী একের অধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর পানি কোনো দেশই অন্য দেশের অনুমতি ছাড়া একতরফাভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। এই রীতি অনুযায়ী দেশগুলো ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গভাবে নিজ নিজ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অংশের পানি ব্যবহার করতে পারে, তবে অন্য দেশের অংশে পানিপ্রবাহে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে এই নিয়মগুলো মেনে চলতে দেখছি?

 

 

Content added || updated By