এই নিষ্ঠুর অভিযোগে গফুর যেন বারোধ হইয়া গেল। ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে কহিল, কাহন খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম। কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় সব ধরে রাখলেন? কেঁদে কেটে হাতে পায়ে পড়ে বললাম, বাবু মশাই, হাকিম তুমি, তোমার রাজত্ব ছেড়ে আর পালাব কোথায়? আমাকে পণদশেক বিচুলি না হয় দাও। চালে খড় নেই। বাপ বেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাখার গোঁজাগাঁজা দিয়ে এ বর্ষা কাটিয়ে দেব, কিন্তু না খেতে পেয়ে আমার মহেশ যে মরে যাবে।
উক্তিটিতে অভাগীর সংস্কার ও বিশ্বাসের দিকটি প্রকাশ পেয়েছে।
'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের অভাগী সংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ। ঠাকুরদাস মুখুয্যের সদ্যমৃত বর্ষীয়সী স্ত্রীকে শ্মশানে পুড়তে দেখে অভাগী, যেখানে মুখুয্যের স্ত্রী ছেলের হাতে আগুন পায়। হিন্দুধর্মের সংস্কার অনুসারে অভাগীর বিশ্বাস মুখুয্যের স্ত্রী স্বর্গে যাবে। তাই অভাগী মৃত্যুর পর ছেলের হাতের আগুন প্রত্যাশা করে; যেন সে নিজেও মুখুয্যের স্ত্রীর মতো স্বর্গে যেতে পারে।
সুকুমার সেন সম্পাদিত ‘শরৎ সাহিত্যসমগ্র' গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ' নামক গল্পটি সংকলন করা হয়েছে। গরিব-দুখী নীচু শ্রেণির ছেলে কাঙালী। তার মা অভাগী । প্রতিবেশী উঁচু জাতের বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে অভাগীর ভেতরকার ভাবানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় এ গল্প। মৃতের শবযাত্রার আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা দেখে অভাগীও নিজের মৃত্যু মুহূর্তের স্বপ্ন দেখে। চন্দন, সিঁদুর, আলতা, মালা, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা, অগ্নির ধোঁয়ায় মুখুয্যে বাড়ির গিন্নি স্বর্গে গমন করেছেন। দুখিনী অভাগীও ভাবে তার মৃত্যুর সময় স্বামীর পায়ের ধূলি নিয়ে মৃত্যু শেষে পুত্র মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। মৃত্যুর সময় কাঙালী তার বাবাকে হাজির করতে পারলেও পারেনি কাঠের অভাবে মায়ের সৎকার করতে। ‘অভাগীর স্বর্গ' গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমানবিক জাতিভেদ প্রথা এবং জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ-নির্যাতনের ছবি এঁকেছেন। এ গল্প জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয়।