তোমার অভিজ্ঞতাটি লেখো।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
বুদ্ধের শাসনে শিক্ষার্থী রূপে প্রবেশের প্রথম সোপান হলো প্রব্রজ্যা। সাধারণত প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে হলে পারিবারিক বা গার্হস্থ্য জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম বা বৈরাগ্য জীবন অবলম্বন করতে হয়। বুদ্ধের ধর্মে যাঁরা প্রথম প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে তাঁদেরকে শ্রমণ ও শ্রমণেরী বা শিক্ষামানা ও শিক্ষামানী বলা হয়। প্রব্রজিত মাত্রই গৃহত্যাগী বা সংসারত্যাগী। জাগতিক সংসার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করে নির্বাণ লাভ করাই হলো প্রব্রজ্যা গ্রহণ করার অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই প্রব্রজ্যা গ্রহণের সময় প্রব্রজ্যা প্রার্থী প্রব্রজ্যা প্রদানকারী আচার্যের নিকট প্রার্থনা করেন।
'সংসার আর্বতের যাবতীয় দুঃখ হতে মুক্তির লক্ষ্যে নির্বাণ সাক্ষাৎকরণের জন্য আমি প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত করুন।'
প্রব্রজ্যার অর্থ হলো পাপকর্ম থেকে বিরতি বা বর্জন। পাপ বজ্জিতো বাপাপ কর্ম হতে বর্জিত। মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে বলা হয়েছে, 'পাপকানং মলং পব্বাজেতীতি প্রর্জজ্জিত' অর্থাৎ পাপমল বর্জনে সংকল্পবদ্ধ হন বলে তাকে প্রবজ্জিত বলা হয়। ধর্মপদ গ্রন্থে প্রব্রজ্যা শব্দের অর্থ করা হয়েছে, 'পব্বাজযং অত্তনো মলং তস্মা পৰ্ব্বজিতো'তি বুচ্চতিং'। নিজের পাপমল প্রক্ষালন বা ত্যাগ করেন বলেই প্রব্রজিত। প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান বৌদ্ধদের অত্যন্ত ও প্রয়োজনীয় উৎসব। প্রব্রজ্যা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে বৈরাগ্যময় পথে নিবিষ্ট রেখে সূচারুভাবে ধর্মময় জীবনধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। সকলের পক্ষে প্রব্রজিত জীবনে অবস্থান করা সম্ভব হয় না। কারণ প্রাণী মাত্রই ভোগ অভিলাষী, পারিবারিক বন্ধন সংসার জীবনের ভোগ-ঐশ্বর্য, লোভ-দ্বেষ-মোহে আসক্ত মানুষ সবকিছু ত্যাগ করে সংসার বিরাগী হয়ে প্রব্রজিত জীবন যাপন করা অত্যন্ত দুরুহ। বুদ্ধ সংসারকে মরু কান্তার এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তুলনা করেছেন দুঃখের আগার ও কারাগার হিসেবে। স্ত্রী পুত্রের বন্ধনকে সবচেয়ে কঠিন বন্ধন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুখের কামনা, ভোগের লালসায় মানুষ অবিরাম দুঃখকে বরণ করে চলেছে। এ বন্ধন হতে অল্পসংখ্যক মানুষ মাত্র প্রব্রজ্জিত হতে পারে। সুতরাং মাতা-পিতা, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, ভোগ-ঐশ্বর্য মদিরময় রূপ যৌবনের প্রমত্ততা ত্যাগ করে উন্মুক্ত আকাশতুল্য প্রব্রজ্যা জীবন যাপন করা অত্যন্ত আয়াসসাধ্য। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভের লক্ষ্যে বীর্যবানগণ প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ করে নির্বাণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করে থাকেন। বৌদ্ধ সামাজিক প্রথানুসারে প্রত্যেকে জীবনের যে কোন সময় অন্তত একবার প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। আজীবনের জন্য প্রব্রজ্যা গ্রহণ সম্ভব না হলেও বৌদ্ধ নর-নারীগণ তাদের সন্তানদেরকে কমপক্ষে এক সপ্তাহের জন্য হলেও প্রব্রজ্যা দান করেন, যা বৌদ্ধদের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। সপ্তাহকাল হলে প্রব্রজিত হয়ে তারা বুদ্ধের ধর্মের মৌলিক আদর্শ ও পরিশুদ্ধ শীলময় জীবনযাপন করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন এবং ব্রহ্মচর্য জীবনের উন্নত জীবনাদর্শ কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তাই প্রত্যেক মাতা-পিতার কর্তব্য -উপযুক্ত সময়ে তাদের সন্তানদেরকে প্রব্রজ্যা দিয়ে আদর্শ বৌদ্ধ হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বোত্তম সহায়তা করা। প্রব্রজ্যা দানের মাধ্যমে মাতা-পিতা সন্তানকে ধর্মীয় ও নীতি আদর্শ এবং পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের সুযোগ করে দেন। স্বল্প সময়ের প্রব্রজিত জীবন অনেকক্ষেত্রে হেতু প্রত্যয়ের কারণে পরিশুদ্ধ ব্রহ্মাচর্য মহাজীবন লাভের সুযোগ এনে দেয়। তাই বলা হয় প্রব্রজ্যার অনেক গুণ, মহাগুণ ও অনন্ত গুণ, অপরিমেয় গুণ।
প্রব্রজ্যা গ্রহণের নিয়ম: প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে প্রথমে মাতা-পিতার অনুমতি নিতে হয়। প্রব্রজ্যা গ্রহণের পূর্বেই কেশ শ্মশ্রু ছেদন ও মস্তক মুন্ডন করতে হয়। মুণ্ডিত মস্তকে গৃহীবস্ত্র পরিধান করে ভিক্ষু শ্রামণদের ব্যবহার্য অষ্টপরিষ্কার নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে উপস্থিত হতে হয়। সাধারণত প্রব্রজ্যা প্রার্থীর জ্ঞাতিস্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী বৌদ্ধ সংকীর্তন বাদ্যসহকারে বিহারে উপস্থিত হয়। সাধারণত অষ্টপরিষ্কারগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেয়া হয়। চীবর তিনটি ক্রমান্বয়ে গোলাকার করে মুড়িয়ে মন্দিরের চূড়ার মতো করে সাজাতে হয়। চীবরের চূড়াটি কঠিবন্ধনী দিয়ে বাঁধিতে হয়। তারপর তা ভিক্ষাপাত্রে রাখা হয়। অন্যান্য দ্রব্যগুলোও ভিক্ষাপাত্রে রাখা হয়। অষ্টপরিষ্কার ছাড়াও প্রব্রজ্যা প্রার্থী প্রব্রজ্জিত গ্রহণের সময় বা পরে ব্যবহারের জন্য বিছানাপত্র, ছাতা, সেন্ডেল ইত্যাদি দেয়ার প্রথা রয়েছে।
প্রব্রজ্যা গ্রহণবিধি: বুদ্ধের বিনয় বিধান অনুসারে ৭ বছরের কম বয়সের নির্বোধ ছেলেকে প্রব্রজ্যা দেওয়ার নিয়ম নেই। কারণ, এর চেয়ে কম বয়সের ছেলেদের পক্ষে বুদ্ধ প্রবর্তিত প্রব্রজ্যা শীলের শিক্ষাপদগুলো প্রতিপালন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সর্বোপরি তাদের পক্ষে বিরাগ প্রধান, প্রজ্ঞা প্রধান, বুদ্ধের ধর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আবার প্রব্রজ্যা প্রদানকারী গুরু বা আচার্য যিনি হবেন তাঁকে কমপক্ষে দশ বছরের ভিক্ষু জীবন বা স্থবির ভিক্ষু হতে হয়। তাঁকে দক্ষ, সমর্থ এবং তাঁর উচ্চারণে বিশুদ্ধ হতে হয়। দশ বছরের কম বয়স্ক সুদক্ষ ভিক্ষু ও প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে সরাসরি প্রব্রজ্যা দান করতে পারেন না এবং প্রব্রজ্যা গ্রহণকারীর আচার্য উপাধ্যায়ও হতে পারেন না। তাই প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে একজন স্থবির ভিক্ষুকেই আচার্য হিসেবে ঠিক করে নিতে হয়। তবে প্রব্রজ্যা গ্রহণকালীন যদি একাধিক স্থবির/মহাস্থবির ভিক্ষু উপস্থিত থাকেন তবে বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষু আচার্য বা গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রব্রজ্যা প্রার্থীর মাতা-পিতা প্রদত্ত গৃহী নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয়। তখন থেকে তিনি নতুন নামে শ্রমণ হিসেবে পরিচিত হন।
প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে প্রথমে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করতে হয়। শুদ্ধভাবে সুস্পষ্টরূপে ত্রিশরণ উচ্চারণ করতে হয়। সে সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত গৃহীজন সাধারণ ও সমবেতভাবে পঞ্চশীল গ্রহণ করেন। পঞ্চশীল গ্রহণের পর প্রব্রজ্যা প্রার্থী পুনরায় উৎকুটিক আসনে (পদদ্বয় সমন্বিত করে হাঁটুর ওপর হাত জোড় করে বসা) বসে ভিক্ষুসংঘের নিকট প্রব্রজ্যা শীল প্রার্থনা করেন। প্রব্রজ্যা শীলকে দশশীলও বলা হয়।
প্রব্রজ্যা প্রার্থনা: প্রব্রজ্যা প্রার্থনার সময় প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে নির্দিষ্ট নিয়মে বসতে হয়। এরপর সংগৃহীত অষ্ট পরিষ্কার হতে গোলাকারে সজ্জিত চূড়া সদৃশ চীবরগুলো হাতে নিয়ে (উৎকুটিক আসনে বলতে হয়):
"ওকাস অহং ভন্তে পৰ্ব্বজ্জং যাচ্চামি
দুতিযম্পি অহং ভন্তে পঞ্চজ্জং যাচ্চামি
ততিযম্পি অহং ভন্তে পঞ্চজ্জং যাচ্চামি
বাংলা অনুবাদ:
ভন্তে অবকাশ প্রদান করুন
আমি প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করছি
দ্বিতীয় বারও ভন্তে আমি প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করছি
তৃতীয় বারও ভন্তে আমি প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করছি
এরপর প্রব্রজ্যা প্রার্থনার কারণ ও উদ্দেশ্যে নিচের প্রার্থনাটি করতে হয়:
সব্বদু্য নিস্পরণ নিব্বাণং সচ্ছিকরণথায ইমং কাসাবং গহেত্বা পঞ্চাজেথ মং ভন্তে, অনুকম্পং উপাদায।
দুতিযম্পি সৰ্ব্বদুঃখ নিস্পরণ নিব্বাণং সচ্ছিকরণথায ইমং কাসাবং গহেত্বা পঞ্চাজেথ মং ভন্তে, অনুকম্পং উপাদায।
ততিযম্পি সৰ্ব্বদু্য নিষ্পরণ নির্ব্বাণং সচ্ছিকরণথায ইমং কাসাবং গহেত্বা পক্সাজেথ মং ভন্তে, অনুকম্পং উপাদায।
বাংলা অনুবাদ:
ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্ত্র (চীবরসহ) গ্রহণ করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বার ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্ত্র (চীবরসহ) গ্রহণ করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
তৃতীয়বার ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্ত্র (চীবরসহ) গ্রহণ করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
তারপর প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে দীক্ষাদানকারী আচার্যের হাতে চীবরসহ তুলে দিতে হয়। অতঃপর হাতজোড় করে নিচের প্রার্থনাটি করতে হয়:
দুতিযম্পি সব্বদু্য নিষ্পরণ নির্ব্বাণং সচ্ছিকরণথায এতং কাসাবং দত্বা পঞ্চাজেথ মং ভন্তে, অনুকম্পং উপাদায।
ততিযম্পি সৰ্ব্বদুস্থ নিষ্পরণ নিব্বাণং সচ্ছিকরণথায এতং কাসাবং দত্বা পঞ্চাজেথ মং ভন্তে, অনুকম্পং উপাদায়।
বাংলা অনুবাদ:
ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্ত্র (চীবরসহ) প্রদান করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বার ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্ত্র (চীবরসহ) প্রদান করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
তৃতীয়বার ভন্তে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ ও নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য অনুগ্রহ করে
এই কাষায় বস্তু (চীবরসহ) প্রদান করে আমাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।
অতঃপর, উপাধ্যায় শরীরের বত্রিশ প্রকার অশুভ বিষয় থেকে প্রথম পাঁচটিকে নিয়ে কর্মস্থান ভাবনা দেন। এগুলো
হলো- কেসা, লোমা, নখা, দন্তা, তচো। এটি অনুলোম প্রতিলোমাকারে উচ্চারণ করতে হয়। তারপর চীবর প্রত্যবেক্ষণ ভাবনার মাধ্যমে চীবর গ্রহণ করতে হয়। ভাবনাটি এরূপ পটিসঙ্খা যোনিসো চীবরং পটিসেবামি, যাবদেব সীতস্ম পটিঘাতায় উহুম্স পটিঘাতায়, ডংস-মকস-বাতাতপ-সিরিংসপ সম্মস্থানং পটিঘাতায়, যাবদেব হিরিকোপীনং পটিচ্ছাদনখং।
বাংলা অনুবাদ: সজ্ঞানে মনোযোগ সহকারে স্মরণ করতে আমি এ চীবর পরিধান করেছি। এ চীবর শুধু শীত ও উষ্ণতা নিবারণ, দংশক-মশক-ধুলাবায়ু, রৌদ্র-সরীসৃপ ও বৃশ্চিকাদির আক্রমণ ও দংশন নিবারণ এবং লজ্জা নিবারণের জন্য।
এ ভাবনা গ্রহণের পর গৃহী পোশাক পরিত্যাগ করে চীবর পরিধান করা হয় চীবর পরিধান করে ভিক্ষুসঙ্ঘের সামনে এসে প্রব্রজ্যা শীল বা দশশীল প্রার্থনা করতে হয়।
দশশীল প্রার্থনা (পালি)
ওকাস অহং ভন্তে তিসরণেন সন্ধিং পব্বজ্জা সামনের দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্রহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে।
দুতিযম্পি অহং ভন্তে তিসরণেন সন্ধিং পক্সজ্জা সামনের দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্রহং কতা সীলং দেখ মে ভন্তে।
ততিযম্পি অহং ভন্তে তিসরণেন সন্ধিং পঞ্চজ্জা সামনের দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্নহং কতা সীলং দেথ মে ভন্তে।
বাংলা অনুবাদ: ভন্তে অবকাশপূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি। ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বার ভন্তে অবকাশ পূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি।
ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন।
তৃতীয়বার ভন্তে অবকাশ পূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি। ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন।
দশশীল (পালি)
১. পাণাতিপাতা বেরমণী সিঙ্গাপদং।
২. অদিন্নদানা বেরমণী সিস্থাপদং।
৩. অব্রহ্মচরিযা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৪. মুসাবাদা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৫. সুরা-মেরেয-মজ্জ পমাদষ্ঠানা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৬. বিকালভোজনা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৭. নচ্চ-গীত-বাদিত বিসুকদস্পন বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৮. মালা-গন্ধ-বিলেপন-ধারণ-মন্ডন বিভুসনষ্ঠানা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
৯. উচ্চসযনা মহাসযনা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
১০. জাতরূপ-রজতং পটিগ্রহনা বেরমণী সিদ্ধাপদং।
ইমানি পঞ্চজ্জা সামনের দসসিন্ধা পাদানি সমাদিযামি দুতিযম্পি, ততিযম্পি...।
দশশীল (বাংলা)
১. প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকব-এ শিক্ষাপদ ...।
২. অদত্তবস্তু গ্রহণ (চুরি) করা থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
৩. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকব-এ শিক্ষাপদ ...।
৪. মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
. সুরা এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
৬. বিকেল বেলা ভোজন থেকে বিরক থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
৭. নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্রের উৎসব দর্শন করা থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
৮. মালাধারণ, সুগন্ধিদ্রব্যের প্রলেপ, অলংকার গ্রহণে থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
৯. উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা (অত্যন্ত আরামদায়ক শয্যা) থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ ...।
১০. সোনা-রুপা বা মুদ্রা আদান-প্রদান ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ ..।
উপরোক্ত শ্রামণের দশশীলসমূহের শিক্ষাপদগুলো আমি গ্রহণ করছি এবং যথাযথভাবে পালন করব দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার।
দশশীল গ্রহণের পর প্রব্রজ্যা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। দশশীল হলো প্রব্রজিতদের নিত্য পালনীয় দশটি নিয়ম। এরপর প্রব্রজিত শ্রমণকে নতুন নাম প্রদান করা হয়। প্রব্রজিত ব্যক্তি যতদিন দীক্ষিত অবস্থায় থাকেন, ততদিন এ নামে পরিচিত হন। এ প্রব্রজ্যা দশশীল শ্রমণের বা তারপর আচার্য বা শিক্ষাগুরু তাকে ৭৫ সেখিয়া চারি প্রত্যবেক্ষণ দৈনিক চর্যাসহ শ্রমণের করণীয় ধর্মসমূহ শিক্ষাদান করবেন। প্রব্রজ্যা দান সম্পন্ন হলে উপস্থিত দায়ক-দায়িকাগণ প্রব্রজিতকে অভিবাদন জানিয়ে নানা দ্রব্যসামগ্রী দান করেন। প্রব্রজ্যা কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায় ক্রমান্বয়ে সম্পন্ন করতে হয়, যাতে প্রব্রজ্যা প্রার্থীর কাছে প্রতিটি ধাপের পরিবর্তন সহজে বোধগম্য হয়।
এভাবে প্রব্রজ্যা প্রার্থী তাঁর জীবনের পরিবর্তন যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সমর্থ হন।
প্রব্রজ্যা একপ্রকার বিশুদ্ধ জীবনচর্চার ব্রত। এটিকে মুক্ত জীবনও বলা যায়। ব্রত গ্রহণের জন্য প্রথমে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। কারণ এ জীবন সাধারণ জীবনধারা থেকে ব্যতিক্রম। নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে হয় দৈনন্দিন জীবন। প্রব্রজিতদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এগুলো শারীরিক ও মানসিকভাবে পালন করতে হয়। তাঁদের নৈতিক জীবনযাপন ও সর্বদা কুশল কর্ম সম্পাদনে সচেষ্ট থাকতে হয়। সকল প্রকার পাপকর্ম হতে বিরত থাকতে হয়। নির্বাণ লাভের জন্য উদ্যমী হতে হয়। ফলে প্রব্রজিতের জীবন পঙ্কিলতামুক্ত থাকে। তিনি নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান থাকেন। নির্মল আনন্দের অধিকারী হন। এসব গুণের জন্য সকলের শ্রদ্ধা লাভ করেন। এছাড়া প্রব্রজ্যার অনেক সুফল রয়েছে।
নিচের প্রব্রজ্যার কতিপয় সুফল বর্ণিত হলো-
১. কায়, বাক্য ও মনোদ্ধার সংযত হয়।
২. রাগ, দ্বেষ, মোহ প্রশমিত হয়।
৩. অকুশল কর্মচেতনা বিনাশ হয়। ৪. কুশলকর্ম সম্পাদনে ব্রতী হন।
৫. অল্প লাভে সন্তুষ্ট থাকেন।
৬. জ্ঞান সাধনায় প্রত্যয়ী হন।
৭. ভিক্ষুজীবন গ্রহণে আগ্রহী হন।
৮. দুর্গতির পথ বন্ধ হয় এবং সুগতিপ্রাপ্ত হন।
৯. বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব জানা ও চর্চার সুযোগ হয়।
১০. বিপুল পুণ্য সম্পদের অধিকারী হন।
১১. জীবন নিয়ন্ত্রিত এবং আসক্তিমুক্ত হয়।
১২. নির্বাণ পথের অনুগামী হন।
এছাড়া প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান উদ্যাপনের মাধ্যমে অন্যদেরও ধর্মীয় চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক চেতনাও বিকশিত হয়। প্রব্রজ্যা গ্রহণের পূর্বাহ্ণে আনন্দ শোভাযাত্রা হয়। এ সময় ভক্তিমূলক গান, বুদ্ধকীর্তন ও জয়ধ্বনি করা হয়। সকল বয়সের নারী-পুরুষ শ্রদ্ধাচিত্তে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে অভিনন্দিত করা হয়। আবার যারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, প্রব্রজ্যা ত্যাগের পর তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। এটি হলো কিছুদিন বিশুদ্ধ জীবনাচার অনুশীলনের সম্মাননা বা কৃতজ্ঞতা। সুশৃঙ্খল জীবন গঠনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক বৌদ্ধের জীবনে কিছুদিন হলেও এই প্রব্রজ্যাব্রত গ্রহণ করা উচিত। এই ব্রত গ্রহণ ছাড়া প্রব্রজ্যা জীবনের বিশুদ্ধতা, আদর্শ ও উৎকর্ষ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, সন্তানকে প্রব্রজ্যা দান ব্যতীত বৌদ্ধধর্মের উত্তরাধিকারী হওয়া যায় না। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি চুরাশি হাজার ধাতুচৈত্য ও চুরাশি হাজার বিহার মহা উৎসবের সঙ্গে দান করে ভিক্ষুসঙ্ঘকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- 'মাননীয় সঙ্ঘ। বুদ্ধ শাসনে শ্রেষ্ঠ দাতা কে? কার দান অধিক? উত্তরে ভিক্ষুসংঘ বলেন, 'মহারাজ! আপনিই শ্রেষ্ঠ দাতা। আপনার মতো দান আর কেউ করেননি। আপনার দান সর্বাপেক্ষা অধিক!' এ কথা শুনে সম্রাট অশোক খুবই প্রীতি অনুভব করেন। আত্মপ্রসাদে উৎফুল্ল হয়ে তিনি পুনরায় ভিক্ষুসঙ্ঘকে জিজ্ঞাসা করেন, 'ভন্তে'। আমি বুদ্ধশাসনের উত্তরাধিকারী হতে পেরেছি কি?' তখন ভিক্ষুসঙ্ঘের সম্মতি ক্রমে মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবির বলেন, 'মহারাজ! আপনি ভিক্ষুসঙ্ঘের ভরণ-পোষণের দাতা মাত্র। কেউ যদি ব্রহ্মলোকে পর্বত প্রমাণ স্তূপ করে ভিক্ষুসঙ্ঘকে বিবিধ দানীয়বস্তু দান করে, তিনি উদার দায়ক হন মাত্র, বুদ্ধশাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে যিনি স্বীয় পুত্রকে প্রব্রজিত করে বুদ্ধশাসনে দান করেন, তিনিই কেবল বুদ্ধশাসনের উত্তরাধিকারী হন। এ কথা শুনে সম্রাট অশোক উৎকণ্ঠিত হয়ে বলেন, আমি এত দান করার পরও বুদ্ধশাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারলাম না। অতঃপর তিনি পুত্র-কন্যার সম্মতি নিয়ে তাঁদেরকে প্রব্রজিত করে সঙ্ঘ দান করেন এবং বুদ্ধশাসনের উত্তরাধিকারী হন। বলা বাহুল্য, তাঁর ভিক্ষুপুত্র অর্হৎ মহেন্দ্র স্থবির এবং কন্যা ভিক্ষুণী সংঘমিত্রা শ্রীলংকায় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে বৌদ্ধধর্মকে চিরজীবী করে রেখে গেছেন। প্রব্রজ্যার সুফল সম্পর্কে আরো বলা হয়ে থাকে যে, জম্বুদ্বীপের সর্বত্র বিহার নির্মাণ করিয়ে দান করলে, যে ফল লাভ হয়, তা বুদ্ধশাসনে সন্তানকে প্রব্রজিত করে দান করলে সে ফলের ষোলো ভাগের এক ভাগও হয় না। উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ সে সময় জম্বুদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।
শ্রমণ থেকে ভিক্ষু হওয়ার যে অনুষ্ঠান, তার নাম উপসম্পদা। উপসম্পদা হচ্ছে উচ্চতর নিয়ম-নীতি সম্পাদনের ব্রত। প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় বিষয় সমাপ্তির পর উপসম্পদা দিতে হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ, ঋণগ্রস্ত, রাষ্ট্রীয় দণ্ডপ্রাপ্ত প্রভৃতি ব্যক্তি উপসম্পদার যোগ্য নয়। বিনয় পিটকের অর্থকথা সামন্ত পাশাদিকা অনুসারে আট প্রকার উপসম্পদা ১. সরণ গমন উপসম্পদা, ২. ওবাদ পটিগ্নহন উপসম্পদা, ৩. এহি ভিক্ষু উপসম্পদা, ৪. পঞঞা ব্যাকরণ উপসম্পদা, ৫. গুরুধম্ম পটিয়হন উপসম্পদা, ৬. দুতেন উপসম্পদা, ৭. অর্থ বাচিকা উপসম্পদা এবং ৮. ঐতিচতুত্থ কম্ম উপসম্পদা। বর্তমানে শুধু ঐতিচতুত্থ কম্ম উপসম্পদা প্রচলিত আছে। অন্যান্য উপসম্পদা প্রচলিত নেই, কোনো গৃহী ব্যক্তিকে যায় সরাসরি উপসম্পদা প্রদান করা হয় না। আগে প্রব্রজিত হয়ে শ্রামণধর্মে দীক্ষিত হতে হয়। উপসম্পদার জন্য কমপক্ষে বিশ বছর বয়স হতে হয়। উপসম্পদা প্রার্থীকে মাতা-পিতার অনুমতি নিতে হয়। অতঃপর ভিক্ষুদের ব্যবহার্য অষ্টপরিষ্কার নিয়ে কোনো ভিক্ষুর শরণাপন্ন হতে হয়। সেই ভিক্ষুই সাধারণত তাঁর উপাধ্যায় বা গুরু হন। ভিক্ষুদের উপোসথের স্থান ভিক্ষুসীমায় বসে উপসম্পদা কার্য সম্পন্ন করতে হয়। কোনো বিহারে ভিক্ষুসীমা না থাকলে, যে নদী বা খালে জোয়ার-ভাটা হয়, সেখানেও উপসম্পদা দেওয়া যায়। এখানে নৌকায় বসে বা প্রস্তুতকৃত ওধক সীমায় করণীয় সম্পন্ন করতে হয়। এর নাম 'উদকসীমা'। উপসম্পদার জন্য কমপক্ষে পাঁচজন ভিক্ষুর প্রয়োজন হয়। প্রথমে প্রার্থীকে উপরে বর্ণিত দোষসমূহ আছে কি না জিজ্ঞেস করা হয়। তারপর অভিভাবকের মতামতের কথা জেনে উপসম্পদার অনুমতি প্রদান করা হয়। উপসম্পদা প্রার্থীকে উপসম্পদা প্রদান স্থানে বসে উপস্থিত ভিক্ষুদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উপসম্পদা প্রার্থনা করতে হয়। প্রার্থনাটি নিম্নরূপ:
সঙ্ঘং ভন্তে উপসম্পদং যাচামি, উল্লম্পতু মং ভন্তে সংঘো-অনুকম্পং উপাদায।
দুতিযম্পি সঙ্ঘং ভন্তে উপসম্পদং যাচামি, উল্লম্পতু মং ভন্তে সংঘো-অনুকম্পং উপাদায।
ততিযম্পি সঙ্ঘং ভন্তে উপসম্পদং যাচামি, উল্লম্পতু মং ভন্তে সংঘো-অনুকম্পং উপাদায।
বাংলা অনুবাদ: মাননীয় সঙ্ঘ, আমি উপসম্পদা প্রার্থনা করছি। উচ্চতর মার্গ লাভের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে উপসম্পদা দিন।
দ্বিতীয়বার সঙ্ঘ, আমি উপসম্পদা প্রার্থনা করছি। উচ্চতর মার্গ লাভের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে উপসম্পদা দিন।
তৃতীয়বার সঙ্ঘ, আমি উপসম্পদা প্রার্থনা করছি। উচ্চতর মার্গ লাভের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে উপসম্পদা দিন।
এরপর উপস্থিত সঙ্ঘ সকলের সম্মতি সাপেক্ষে ঐতি চতুর্থ কর্মবাচা পাঠ করে প্রার্থীকে উপসম্পদা প্রদান করেন। কর্মবাচা হলো ভিক্ষুর কর্মনীতির একটি অংশ। এর মাধ্যমে উপসম্পদা লাভকারী ভিক্ষু হিসেবে পরিচিত হন এবং সঙ্ঘের সদস্য হন। উপসম্পদা লাভের পর হতে নিয়মিতভাবে ভিক্ষুসঙ্ঘের জন্য অনুশীলনীয় ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষে বর্ণিত দুইশত সাতাশ শীলসহ অন্যান্য ব্রতাদি পালন করতে হয়। উপসম্পদা প্রদান কালীন কর্মবাচা পাঠের সময় তাকে চারিটি নিষ্পয় বা আশ্রয় এবং চারটি ভিক্ষু শ্রামণদের অকরণীয় কর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত করানো হয়। চারটি নিস্ময় হলো: ১. পিন্ডিযালোপ ভোজনং যাবজীবং উম্মাহ করণিয়ো অর্থাৎ ভিক্ষান্ন দ্বারা জীবন প্রতিপালনে উৎসাহী হতে হবে, ২. পংশুকুলিক চীবরং যাবজীবং উত্সাহ করণিয়ো অর্থাৎপাংশুকুলিক চীবর পরিধান করে জীবন পরিচালনায় যাবজ্জীবন উৎসাহী হতে হবে, ৩. রুদ্ধমূলং সেনাসনং যাবজীবং উস্সাহ করণিয়ো-বৃক্ষমূলে শয্যাগ্রহণে যাবজ্জীবন উৎসাহী থাকা, ৪. পুতিমুত্তং ভেসজং যাবজীবং উত্সাহ করণিয়ো-গোমূত্র, ত্রিফলাদি ঔষধি হিসেবে সেবনে যাবজ্জীবন উৎসাহী থাকতে হবে। চারটি অকরণীয় কর্ম হলো, ২২৭ শীলের মধ্যে চারি পারাজিকা কর্ম থেকে আজীবন বিরত থাকা।
১. ব্যভিচার থেকে বিরতি।
২. পরদ্রব্য অপহরণ থেকে বিরতি।
৩. গর্ভপাত ও মনুষ্য হত্যা থেকে বিরতি।
৪. লাভ-সৎকারের আশায় মিথ্যা কুহুক প্রতারণা ও অলৌকিক ঋদ্ধি প্রদর্শনে বিরতি।
নব উপসম্পদা সম্পন্ন ভিক্ষু আচার্য বা গুরুর কাছে নিয়মিতভাবে ধর্ম বিনয় শিক্ষা করেন। প্রয়োজনে গুরুর অনুমতি সাপেক্ষে উপযুক্ত অন্য আচার্যের অধীনেও শিক্ষা লাভ করতে পারেন। একজন ভিক্ষুকে উপাধ্যায় ও আচার্যের কাছে শিক্ষানুরাগী হয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছর থাকতে হয়। এ সময় তিনি ভিক্ষুদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতিসমূহ চর্চা করেন। পাতিমোক্স নামক গ্রন্থে ভিক্ষুদের নিত্যা প্রতিপাল্য ২২৭টি শীল বা অনুশীলনীয় নীতি বর্ণিত আছে। এগুলো প্রতিটি যথাযথভাবে ভিক্ষুদের জানতে ও পালন করতে হয়।
ধর্মীয় বিধান মতে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদার মধ্যে বহু পার্থক্য আছে। মাতা-পিতা, ভ্রাতা-ভগ্নি, স্ত্রী-পুত্র পরিবার বিশিষ্ট গৃহ ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বনের নাম প্রব্রজ্যা। নিজের পাপমল প্রক্ষালন বা ত্যাগ করেন বলে প্রব্রজ্যা অবলম্বনকারীদের প্রব্রজিত বলা হয়। দশ শীলধারী প্রব্রজিতদের বলা হয় শ্রামণের বা শ্রমণ। শ্রমণের বয়স বিশ বছর পূর্ণ হলে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন বা ব্রতাদি শিক্ষার পর তাঁকে উপসম্পদা দেয়া হয়। শ্রমণ হতে ভিক্ষুত্বে উন্নীত করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয় তাকে বলা হয় উপসম্পদা। বৌদ্ধ সংঘ প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। কোনো ব্যক্তি প্রব্রজ্যা প্রার্থী হলে বুদ্ধ নিজেই তাকে "এহি ভিষ্ণু" বলে সংঘভুক্ত করে নিতেন। ভিক্ষুদেরও বুদ্ধ নির্দেশ দিয়েছিলেন ত্রিশরণ ও দশশীল দিয়ে প্রব্রজিত করিয়ে সংঘভুক্ত করে নেওয়ার। পরবর্তীতে বুদ্ধ আট প্রকার উপসম্পদা গ্রহণের পদ্ধতি উল্লেখ করেন। বর্তমান সময়ে এক প্রকার উপসম্পদা পদ্ধতি প্রচলিত আছে, যার নাম ঐতি চতুত্থ কন্মবাচা উপসম্পদা।
সাত বছর বয়স হলেই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করা যায় কিন্তু পরিপূর্ণ বিশ বছর না হলে একজন শ্রমণ উপসম্পদা গ্রহণ বা ভিক্ষু হতে পারেনা। একজন প্রবীণ বা স্থবির ভিক্ষু যে কোনো কুলপুত্রকে প্রব্রজিত করাতে পারে। সংঘের উপস্থিতি ব্যতীত কোন শ্রমণকে উপসম্পদা দেওয়া যায় না। যে কোনো স্থানে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারে। পবিত্র ভিক্ষু সীমা ব্যতীত উপসম্পদা গ্রহণ করা যায় না। একজন গৃহী বা কুলপুত্র গৃহী অবস্থা থেকে সরাসরি উপসম্পদা নিতে পারে না। তাঁকে আগে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে শ্রমণ হতে হয়। শ্রমণেরা দশশীল প্রতিপালন করে এবং পঁচাত্তর সেখিয়া ধর্ম শিক্ষা করে। উপসম্পদা প্রাপ্ত ভিক্ষুকে ২২৭ শীর পালন করতে হয় এবং বহুবিধ ব্রত পালন করতে হয়। ভিক্ষু মাত্রই সংঘেরসদস্যভুক্ত। এক্ষেত্রে শ্রমণ সংঘভুক্ত সদস্য নয়; শিক্ষার্থী মাত্র। ভিক্ষুদের সংঘকর্মাদিতে যোগ দিতে হয় কিন্তু শ্রমণকে যোগ দিতে হয় না। এক্ষেত্রে শ্রমণ সংঘের সেবক মাত্র।
উপসম্পদার সময় ভিক্ষুসংঘ ঐতি চতুর্থ কৰ্ম্মবাচা পাঠের মাধ্যমে একজন শ্রমণকে উপসম্পদা দান করে। প্রব্রজিত করার সময় শুধু ত্রিশরণসহ দশশীর প্রদান করা হয়।
আরও দেখুন...