ধর্মীয় বই, ইন্টারনেট বা অন্যন্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দলীয়ভাবে পারমী বিষয়ে তথ্যফুল তৈরি করি।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
পারমীর অনুশীলন অত্যন্ত কঠিন। এ প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ কঠোর ধারায় প্রবহমান থাকে। জন্ম-জন্মান্তরের অখন্ডিত ও অবিচ্ছিন্ন স্রোতধারায় চলে এর সাধন প্রক্রিয়া। যাকে দুঃখমুক্তির অভিযানও বলা যায়। এই ব্রতাচার বা পণবদ্ধতা এমন সুকঠিন যে, পারমী পালনকারীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে; কিন্তু কোনো কারণেই আদর্শচ্যুতি ঘটে না। এমনই অনির্বচনীয় আদর্শের অধিকারী হয় পারমী আচার পালনের অভিলাষী ব্যক্তি। তিনি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সুকঠিন দৃঢ়তা অবলম্বন করেন। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পালন করেন তাঁর আরাধ্য কর্ম। জীবন রক্ষার চেয়ে ব্রত রক্ষা করা বা অভীষ্ট অর্জনই পারমী চর্চাকারীর কাছে বড়। এ রকম চিত্তানুভূতি সাধনচিত্ত ছাড়া সাধারণের বোধগম্য নয়।
পারমী অনুশীলনকারীর কঠিন দৃঢ়তার জন্য প্রস্তুতিও প্রয়োজন। বৌদ্ধ দর্শনমতে বহু জন্মের সুকৃতির ফল না থাকলে এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় না। জন্ম-জন্মান্তরের মন ও শরীরের সমন্বিত সাধনার ফলেই মানুষের জীবনে এই প্রস্তুতির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। অত্যন্ত কঠিন-কঠোর এই পথ চলার প্রকৃতি। এটি হলো মুক্তি অন্বেষীর মার্গ বা পথ। এই মুক্তি লাভের পথ সুদীর্ঘ। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণায় পূর্ণ এ পথ। তাই এই সীমাহীন এবং অজ্ঞাত ও অচিন্তিত কষ্টের ভার গ্রহণ করে মুক্তিমার্গ পাড়ি দেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস সত্যিই বিরল। এর জন্য পূর্ব জন্মসমূহের অপরিসীম কুশল কর্ম ও কর্মফলের প্রভাব রয়েছে। এই কুশল কর্মের ক্রমোন্নতি বা উৎকর্ষের ফলে কুশল চর্চাকারীর অন্তরে যখন প্রজ্ঞার উদ্ভব ঘটে, তখন ধারাবাহিক কর্মোন্নতির প্রয়াস ঘটে। এই ধারাবাহিক কর্মোন্নতির প্রয়াসই হলো পারমী; আর যে সত্তার অন্তরে এই পারমী পূরণের বা পালনের অদম্য ইচ্ছার সৃষ্টি হয়, তাঁকে বলা হয় 'বোধিসত্ত্ব'।
জাতক সাহিত্যে বোধিসত্ত্বের পারমী সাধনার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত রয়েছে। পারমী অনুশীলনের প্রকৃতি জ্ঞাতার্থে একটি জাতক কাহিনি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এখানে 'মহাকপি' জাতকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ জাতকের কাহিনিটি অনুধাবন করলে দশ পারমীর প্রকৃতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে দশ পারমীর পূর্ণ উপস্থিতি ও এগুলোর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
বোধিসত্ত্ব পারমী চর্চার কালে বিভিন্ন প্রাণিকুলে জন্ম নিয়েছিলেন। সে সময় প্রাচীন ভারতের কাসী গ্রামে তিনি একবার বানর প্রজাতিতে জন্মগ্রহণ করেন। সেই গ্রামের অদূরেই ছিল এক বন। বানররূপী বোধিসত্ত্ব সেই বনেই বাস করতেন। কাসী গ্রাম থেকে বনে যাতায়াতের সুব্যবস্থা ছিল। সে গ্রামের এক কৃষক একদিন তার কয়েকটি গরুকে জমিতে ছেড়ে দিয়ে নিজে চাষের কাজ করছিলেন। গরুগুলোও ঘাস খাওয়ার জন্য বিস্তীর্ণ জমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজ শেষে যখন বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় হলো, তখন কৃষক তার একটি গরু খুঁজে পেলেন না। ভীষণ চিন্তিত হলেন তিনি। গরুর সন্ধানে তিনি এদিক-সেদিক ছুটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে কৃষক গ্রাম সংলগ্ন হিমালয়ের নিকটবর্তী গভীর বনে নিজের অজ্ঞাতেই ঢুকে পড়লেন। এ সময় মনের ভুলে কৃষক পথও হারিয়ে ফেললেন। দিক ভুলে যাওয়ায় বনে ঘুরতে ঘুরতে কৃষকের সপ্তাহকাল কেটে গেল। অনাহারে ও মানসিক চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন কৃষক। একদিন বনে ঘুরতে ঘুরতে কৃষক একটি ফলবৃক্ষ দেখে তাতে উঠে ফল খেতে লাগলেন। হঠাৎ পা পিছলে তিনি গাছ থেকে পড়ে যান। পড়লেন মাটিতে নয়, গভীর এক অন্ধকূপসদৃশ গহবরে, যা গাছের পাশেই ছিল। জীবনের মায়া ত্যাগ করে উপায়হীনভাবে সেই গহ্বরে কৃষক দশ দিন পার করলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ প্রায় অচেতন হয়ে এলো। এমন সময়ে বোধিসত্ত্ব ঐ গাছের ফল খেতে গিয়ে তিনি গর্তে পতিত কৃষককে দেখতে পেলেন। একজন মানুষের দুরবস্থা বানররূপী বোধিসত্ত্বের মনে অসীম দয়ার উদ্রেক হলো।
বানর মৃত্যুপথযাত্রী সেই কৃষককে বাঁচাতে উদ্যত হলো। বানর এ কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগে নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন হলো। এরপর বানর তার ইচ্ছার বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করল। নিচে বানরের ইচ্ছা বাস্তবায়নের কার্যক্রগুলো অনুক্রমিকভাবে উল্লেখ করা হলো। এতে দশ পারমীর বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখা যায়। যেমন:
১. একজন মানুষকে অসহায় অবস্থায় দেখে বানরের চিত্ত কৃষকের কল্যাণে অনুপ্রাণিত হলো। প্রেম ও করুণায় পূর্ণ হলো তার হৃদয়। মনে হলো, যেন তার নিজের সন্তান কূপে পড়ে আছে। বানরের এ রকম অনুভূতি জাগল।
২. তখন বানর নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সেই কৃষককে উদ্ধার করার সংকল্পবদ্ধ হলো।
৩. এরপর কৃষককে উদ্ধারের জন্য বানর নানা উপায়ে চিন্তা করতে লাগল। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর বানর এই সিদ্ধান্তে এলো যে, কৃষককে পিঠে নিয়ে কূপ থেকে এক লাফে উপরে উঠে আসতে পারলেই তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
৪. তবে এতে বিপদের আশঙ্ক্ষাও কম নয়। কূপ থেকে লাফ দিয়ে যদি প্রয়োজন অনুসারে উপরে উঠতে ব্যর্থ হয়, এতে এই দুর্বলকায় কৃষকের মৃত্যু অবধারিত। তাই এ অভিযানের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বানর কৃষকের ওজনের আনুমানিক পরিমাপের এক খন্ড পাথর তার নিজের পিঠে বেঁধে কয়েকবার গর্ত থেকে লাফ দিয়ে ওঠার পরীক্ষা সেরে নিল। এভাবে পরীক্ষামূলক প্রস্তুতিতে বানরের সামর্থ্য প্রমাণিত হওয়ার পর বানর নিজের পিঠে কৃষককে বেঁধে কূপ প্রান্তে লাফ দিয়ে উঠে এলো। বানরের এ অভিযান সার্থক হলো। কৃষক নির্ঘাত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেল।
৫. বানর জানত যে, কৃষককে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টায় তার নিজেরও মৃত্যু ঘটতে পারে, এতে বানর পিছপা হয়নি। অন্যের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েই বানর এ অভিযান পরিচালনা করেছিল।
৬. কৃষককে নিয়ে বানর কূপ থেকে ওঠার পর ভীষণ পরিশ্রান্ত হলো। কৃষকও ছিল প্রায় অচেতন। এ সময় অচেতন কৃষকের কোলে মাথা রেখে বানর একটু বিশ্রাম নিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কৃষকের সম্বিৎ ফিরে এলো। বানরকে কাছে পেয়ে তার অন্তরে লোভ ও মোহচৈতন্য জাগ্রত হলো। তখন তার চিত্তে অকৃতজ্ঞতাবোধ তীব্র হলো। বিশ্রামে ঘুমন্ত বানরটিকে হত্যা করে মাংস নিয়ে ঘরে যাবার বাসনা হলো কৃষকের। সেরকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক খণ্ড পাথর নিয়ে পরিশ্রান্ত অচেতন বানরের মাথায় আঘাত হানল কৃষক। এতে বানরের মৃত্যু ঘটল না বটে, কিন্তু মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বানর দ্রুত একটি গাছে উঠে পড়ল। বানর অত্যন্ত মনোকষ্ট পেল। কিন্তু কৃষকের প্রতি তার কোনো প্রকার প্রতিহিংসা বা ক্রোধ জন্ম নিল না।
৭. কারণ, কৃষককে বাঁচানোর জন্য সে নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এমনকি বানর তার কায়বাক্যে ও কর্মে কৃষককের প্রতি কোনো প্রকার শত্রুতা বা অসন্তুষ্টি দেখাল না।
৮. কৃষক যে বানরের জীবননাশের চেষ্টা করেছিল, তা বানর সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলল, এবং কৃষকের প্রতি আগের মতো মানসিক সমতা অব্যাহত রাখল।
১. একজন মানুষকে অসহায় অবস্থায় দেখে বানরের চিত্ত কৃষকের কল্যাণে অনুপ্রাণিত হলো। প্রেম ও করুণায় পূর্ণ হলো তার হৃদয়। মনে হলো, যেন তার নিজের সন্তান কূপে পড়ে আছে। বানরের এ রকম অনুভূতি জাগল।
২. তখন বানর নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সেই কৃষককে উদ্ধার করার সংকল্পবদ্ধ হলো।
৩. এরপর কৃষককে উদ্ধারের জন্য বানর নানা উপায়ে চিন্তা করতে লাগল। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর বানর এই সিদ্ধান্তে এলো যে, কৃষককে পিঠে নিয়ে কূপ থেকে এক লাফে উপরে উঠে আসতে পারলেই তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
৪. তবে এতে বিপদের আশঙ্ক্ষাও কম নয়। কূপ থেকে লাফ দিয়ে যদি প্রয়োজন অনুসারে উপরে উঠতে ব্যর্থ হয়, এতে এই দুর্বলকায় কৃষকের মৃত্যু অবধারিত। তাই এ অভিযানের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বানর কৃষকের ওজনের আনুমানিক পরিমাপের এক খন্ড পাথর তার নিজের পিঠে বেঁধে কয়েকবার গর্ত থেকে লাফ দিয়ে ওঠার পরীক্ষা সেরে নিল। এভাবে পরীক্ষামূলক প্রস্তুতিতে বানরের সামর্থ্য প্রমাণিত হওয়ার পর বানর নিজের পিঠে কৃষককে বেঁধে কূপ প্রান্তে লাফ দিয়ে উঠে এলো। বানরের এ অভিযান সার্থক হলো। কৃষক নির্ঘাত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেল।
৫. বানর জানত যে, কৃষককে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টায় তার নিজেরও মৃত্যু ঘটতে পারে, এতে বানর পিছপা হয়নি। অন্যের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েই বানর এ অভিযান পরিচালনা করেছিল।
৬. কৃষককে নিয়ে বানর কূপ থেকে ওঠার পর ভীষণ পরিশ্রান্ত হলো। কৃষকও ছিল প্রায় অচেতন। এ সময় অচেতন কৃষকের কোলে মাথা রেখে বানর একটু বিশ্রাম নিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কৃষকের সম্বিৎ ফিরে এলো। বানরকে কাছে পেয়ে তার অন্তরে লোভ ও মোহচৈতন্য জাগ্রত হলো। তখন তার চিত্তে অকৃতজ্ঞতাবোধ তীব্র হলো। বিশ্রামে ঘুমন্ত বানরটিকে হত্যা করে মাংস নিয়ে ঘরে যাবার বাসনা হলো কৃষকের। সেরকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক খণ্ড পাথর নিয়ে পরিশ্রান্ত অচেতন বানরের মাথায় আঘাত হানল কৃষক। এতে বানরের মৃত্যু ঘটল না বটে, কিন্তু মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বানর দ্রুত একটি গাছে উঠে পড়ল। বানর অত্যন্ত মনোকষ্ট পেল। কিন্তু কৃষকের প্রতি তার কোনো প্রকার প্রতিহিংসা বা ক্রোধ জন্ম নিল না।
৭. কারণ, কৃষককে বাঁচানোর জন্য সে নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এমনকি বানর তার কায়বাক্যে ও কর্মে কৃষককের প্রতি কোনো প্রকার শত্রুতা বা অসন্তুষ্টি দেখাল না।
৮. কৃষক যে বানরের জীবননাশের চেষ্টা করেছিল, তা বানর সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলল, এবং কৃষকের প্রতি আগের মতো মানসিক সমতা অব্যাহত রাখল।
৯. তারপর বানর অনুধাবন করল যে, কৃষক একাকী এ গহিন বনভূমি থেকে বের হওয়ার পথ না-ও চিনতে পারে। তাই বানর গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে চলে, তার মাথার ক্ষতস্থান থেকে যে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, সে রক্ত চিহ্ন দিয়ে কৃষককে পথনির্দেশ করতে লাগল। কৃষকও ভাবতে লাগলো রক্তাক্ত বানরের কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে, এতে তার উদ্দেশ্য সফল হবে। তাই সে রক্তচিহ্ন ধরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে কৃষক একসময় বন থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হলো। বানর কৃষককে বাঁচানোর সংকল্পটি এভাবেই শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে সক্ষম হলো।
১০. কৃষককের বাঁচানোর অভিপ্রায়ের মধ্যে বানরের কোনো প্রকার স্বার্থচিন্তা ছিল না। জাগতিক লাভ ও প্রশংসার মোহ, কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই বানর এ কাজ সম্পাদন করেছিল।
এ জাতকের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতাকে উল্লিখিত অনুক্রমিক ঘটনাগুলো পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে দশ পারমীর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
১. নিজের জীবন দিয়েও কৃষককে বাঁচানোর চেষ্টা বানরের যে নির্মোহ আত্মনিয়োগ, তা-ই 'দান পারমী'।
২. কৃষক পাথর দিয়ে মাথায় আঘাতের পরও বানব যে কৃষকের প্রতি কায়বাক্য ও কর্মে কোনো প্রকার বিদ্বেষ ও অসূয়ার ভাব দেখায়নি এটিই 'শীল পারমী'।
৩. কৃষকের জীবন রক্ষায় বানর কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করেনি এটি 'নৈষ্ক্রম্য পারমী'।
৪. বানর কৃষককে কূপ থেকে উদ্ধারের জন্য উপায় উদ্ভাবনের যে চেষ্টা করেছিল, তা হলো 'প্রজ্ঞা পারমী'।
৫. কৃষকের নিরাপদ উদ্ধারপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বানর কূপ প্রান্তে বারবার লাফ দিয়ে উঠে আসার পরীক্ষা চালিয়ে শেষে যে সাহসের সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তা 'বীর্য পারমী'।
৬. বানর মাথায় আঘাত পেয়ে দারুণ কষ্ট ভোগ করলেও কৃষকের প্রতি তার কোনো ক্রোধ, প্রতিহিংসা বা শত্রুতা ভাব জন্মেনি। এই অহিংস মনোভাব চেতনাই হলো 'ক্ষান্তি পারমী'।
৭. বানররূপী বোধিসত্ত্ব নিজের জীবন বিপন্ন করেও সেই কৃষকের জীবন রক্ষায় উচ্চারিত পূর্ব সংকল্প শেষ পর্যন্ত যে রক্ষা করেছিল সেই একনিষ্ঠ প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাই হলো 'সত্য পারমী'।
৮. কৃষক বানরকে হত্যার চেষ্টা করলেও বানর চিত্ত চঞ্চলতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সে সংযমের সঙ্গে একই ব্রতে শেষ পর্যন্ত অবিচলিত ছিল। এটিই হলো 'অধিষ্ঠান পারমী'।
৯. কূপে পতিত কৃষকের দুর্দশা দেখে বানরের হৃদয় যে করুণা ও প্রেমে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল, তা-ই হলো 'মৈত্রী পারমী'।
১০. বানর তার হত্যাপ্রচেষ্টার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে যে মানসিক ধৈর্য ও স্থিতি অব্যাহত রেখেছিল, তা-ই হলো 'উপেক্ষা পারমী'।
উপরিউক্ত বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পারমীর বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন রীতি থাকলেও এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক গভীর। যেমন মালায় গাঁথা ফুলের মতো। অসংযম ও চিত্ত বিভ্রান্তির কারণে যেকোনো একটি পারমী অনুশীলনে ব্যত্যয় ঘটলে অন্যগুলোর অনুশীলন বা পালন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পারমী শুধু একটি আচরণপ্রক্রিয়া নয়, এটি মানুষের মানসিকতা বিশুদ্ধকরণের এক মহা উপায়ও বটে। তাই জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জনে ও ক্লেশের বিনাশ সাধনে পারমী চর্চার প্রয়োজনীয়তা অনেক। নিজের চিত্তের উদারতা সৃষ্টিতে এবং সর্বজনীন আদর্শিক জীবন গঠনের পারমী একটি অনন্য পন্থা। বিশেষ করে অভেদ কল্যাণমুখী চেতনার জাগরণের জন্য পারমীর অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধধর্মের পরিভাষায় এটি পারমী নামে আখ্যায়িত হলেও এর আচরণগত উৎকর্ষের ফল সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়, মানবিক গুণাবলি আয়ত্ত করার জন্য প্রত্যেকের জীবনে এরকম বিধিবদ্ধ আচরণ থাকা আবশ্যক। কারণ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশানির্বিশেষে নিজ-নিজ মনের বিশুদ্ধতার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। সর্বজনীনভাবে এই ধারা অনুসরণ করলে আমাদের পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। ব্যক্তিজীবন হবে সুন্দর ও শান্তিময়। তাই বলা যায় যে, উন্নত মানবিক ও গুণসম্পন্ন চরিত্র গঠনে পারমী চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জীবনে পারমী একটি অনন্য পালনীয় জীবনবিধি।
বৌদ্ধধর্ম কালের প্রবাহে দুটি ধারায় বিস্তৃত হয়েছে। এর একটি থেরবাদ বা হীনযান; অন্যটি মহাযান নামে পরিচিত। থেরবাদ বলতে আদি বৌদ্ধধর্মের নিয়ম-নীতি অনুসরণকারীদের বোঝানো হয়। অর্থাৎ তথাগত বুদ্ধের সময় বিধিবদ্ধ রীতি ও সংস্কার পালনকারীদের বলা হয় থেরবাদী বা হীনযানী। অন্যদিকে যুগের প্রয়োজনে বৌদ্ধ আদি সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে যারা অনুসরণ করেন, তাদের বলা হয় মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। উভয় চর্চায় বৌদ্ধ দর্শন ও মৌলিক তত্ত্বে কোনো পার্থক্য নেই। যেমন: থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের পারমী বিধি মহাযান বৌদ্ধধর্মেও রয়েছে। তবে থেরবাদে এই পারমীর ধাপ দশটি হলেও মহাযানে এ ধাপ ছয়টি। এগুলো হলো যথাক্রমে-
১. দান পারমী
২. শীল পারমী
৩. ক্ষান্তি পারমী
৪. প্রজ্ঞা পারমী
৫. বীর্য পারমী
৬. ধ্যান পারমী
উল্লিখিত ছয় পারমীর মধ্যে থেরবাদের দশ পারমী বিদ্যমান। অর্থাৎ থেরবাদে অনুশীলনে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, মহাযানের ছয় পারমীর অনুশীলনে সেগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। তাই দৃশ্যত মহাযানে পারমী চর্চা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে মনে হলেও বাস্তবতায় উভয় বৌদ্ধধর্ম দর্শনে পারমীর সকল অনুসরণীয় বিধি বিদ্যমান এবং উভয়ই প্রায় সমরূপ।
আরও দেখুন...