আমরা যে অভিধর্ম পিটক দেখলাম এবং পড়লাম, সেই অভিজ্ঞতাটি নিচে লিখে ফেলি।
অভিজ্ঞতা
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
অভিধর্ম পিটক হলো ত্রিপিটকের তৃতীয় অংশ বা শেষ অংশ। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস অনুসারে প্রথম ও দ্বিতীয় সংগীতিতে বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মবাণীকে 'ধম্মঞ্চ বিনযঞ্চ' ধর্ম ও বিনয় নামে আখ্যায়িত করা হয়। তৃতীয় সংগীতিতে ধর্মকে ভাগ করে সূত্র ও অভিধর্ম নামে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ধর্ম শব্দের সঙ্গে 'অভি উপসর্গ যোগ করে অভিধর্ম পদ গঠিত হয়। 'অভি', 'অতি', 'অধি'প্রভৃতি সমার্থক উপসর্গ। এর অর্থ 'অধিক', 'বেশি', 'অতিরিক্ত বিশিষ্ট' অথবা 'অধিকতর'। সুতরাং অভিধর্ম শব্দের অর্থ বিশিষ্ট ধর্ম, অতিরিক্ত ধর্ম, অধিকতর ধর্ম। আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে সুত্রাতিরিক্ত ধর্মই অভিধর্ম। ধর্ম ও অভিধর্মের আলোচ্য বিষয় প্রায় এক। উভয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। সূত্রপিটকে যা সাধারণভাবে উপদেশিত হয়েছে অভিধর্মপিটকে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সূত্রপিটকে যে ধর্ম লৌকিকভাবে দেশনা করা হয়েছে, তা অভিধর্ম পিটকে অসাধারণভাবে, লোকোত্তরভাবে বা পারমার্থিক উপায়ে আলোচিত হয়েছে।
অভিধর্ম পিটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় চারটি। 'চিত্ত চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণ। সূত্রপিটকের ভাষা ব্যবহারিক যেমন: সত্ত্ব, আত্মা, জীব, জন্ম, মৃত্যু, দেব, ব্রহ্মা, তুমি আমি মানুষ ইত্যাদি। অপরদিকে অভিধর্মের বিষয়বস্তু পরমার্থ সম্পর্কীয় যথা: স্কন্ধ, আয়তন, ইন্দ্রিয়, ধাতু, চ্যুতি, প্রতিসন্ধি, সন্ততি, আত্মা, বল, বোধ্যঙ্গ, নির্বাণ প্রজ্ঞপ্তি ইত্যাদি। অভিধর্ম বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ। বৈজ্ঞানিকভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও প্রমাণের মাধ্যমে অভিধর্মে প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করা হয়। তাই অভিধর্মের মূল আলোচ্য বৌদ্ধ দর্শন ও পরামার্থ সত্য। মূলত অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থগুলোর বুদ্ধের ধর্মের উচ্চতর বিষয়গুলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ সহকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অভিধর্ম পিটক সাত ভাগে বিভক্ত। যথা: ১. ধম্মসঙ্গনী, ২. বিভঙ্গ, ৩. ধাতু কথা, ৪. পুগলপ পঞঞতি, ৫. কথাবন্ধু, ৬. যমক ও ৭. পষ্ঠান।
১. ধম্মসঙ্গনি: ধম্মসঙ্গনী অভিধর্ম পিটকের প্রথম প্রন্থ। ধম্মসঙ্গনি শব্দের মূল অর্থ 'ধর্ম বা গণনা' বা ধর্মের সংক্ষিপ্ত দেশনা। বস্তুতপক্ষে ধম্মসঙ্গনি অভিধর্মের বিশুদ্ধ সারাংশ। ধম্মসঙ্গনি সমগ্র অন্তর্জগত ও বহিজর্গতের যাবতীয় বিষয়কে অর্থাৎ চিত্ত, চৈতসিক ও রূপকে নীতি বা কর্ম ও কর্মফলানুসারে কুশল, অকুশল ও অব্যাকৃতকে শ্রেণিবিভাগ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থে কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক ও নির্বাণ সম্পর্কীয় বিষয়গুলো সুন্দরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সংগৃহীত করা হয়েছে। নামরূপকে কার্যকারণ নীতি অনুসারে কুশল, অকুশল এবং অব্যাকৃত এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ধম্মসঙ্গনির আলোচ্য বিষয়কে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা: ১. চিত্ত চৈতসিকের বিশ্লেষণ, ২. রূপ বা জড় পদার্থের বিশ্লেষণ ও ৩. বর্ণিত বিষয়ের সংক্ষিপ্ত সার বা নিক্ষেপ। উক্ত তিনটি বিভাগকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ১. কুশল ধর্ম, ২. অকুশল ধর্ম, ৩. অব্যাহকৃত ধর্ম এবং ৪. নিক্ষেপ্ত বা সংক্ষিপ্ত বিবরণ। তন্মধ্যে কুশল বিষয়গুলো কুশল ধর্ম, অকুশল চিত্তসমূহ, অকুশল ধর্ম, বিপাক চিত্ত ক্রিয়াচিত্ত এবং রূপ হলো অব্যাকৃত ধর্ম। ধর্মসঙ্গনী গ্রন্থটিকে সর্বমোট চৌদ্দ অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে।
২. বিভঙ্গ: অভিধর্ম পিটকের দ্বিতীয় গ্রন্থ হলো বিভঙ্গ। সর্বাস্তিবাদীদের মতে এটির অপর নাম 'ধর্মস্কন্ধ'। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এটি ধৰ্ম্মসঙ্গনির সমগোত্রীয় হলেও রচনাপদ্ধতি ভিন্ন, ধম্মসঙ্গনির রচনাপ্রণালি বিশ্লেষণমূলক। বিভঙ্গের রচনাপ্রণালি সংশ্লেষণমূলক। বিষয়বস্তুর বিচারে বিভঙ্গকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. সুত্ত ভাজনীয়, ২. অভিধর্ম ভাজনীয় এবং ৩. পঞ্চাপুচ্ছক। বিভঙ্গ গ্রন্থের আঠারটি অধ্যায় আছে। অধ্যায়গুলোর আলোচ্য বিষয় হলো: পঞ্চস্কন্ধ, দ্বাদশ আয়তন, আঠার প্রকার ধাতু (অষ্টাদশ ধাতু), চার আর্য সত্য, দ্বাবিংশতি ইন্দ্রিয়, প্রতীত্যসমুৎপাদ, চার স্মৃতি প্রস্থান, চার সম্যক প্রধান, চার ঋদ্ধিপাদ, সপ্তবোধ্যঙ্গ, আর্য অষ্টঙ্গিক মার্গ, ধ্যান, পঞ্চশীল, চার অপ্রমেয় শিক্ষাপদ, চারি প্রতিসম্ভিদা, জ্ঞান বিভঙ্গ, ক্ষুদ্রবস্তু বিভঙ্গ, (চিত্তের অকুশল অবস্থার দীর্ঘ তালিকা) প্রভৃতি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
৩. ধাতুকথা: অভিধর্ম পিটকের তৃতীয় গ্রন্থ। ধাতুকথা শব্দের অর্ধ ধাতু-সম্পর্কীয় কথা বা আলোচনা। চিত্ত ও চৈতসিকের আলোচনা এ গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে। এতে যোগী বা ধ্যানপরায়ণ ভিক্ষুর মানসিক বৃত্তি বা চিত্ত চৈতসিকের আলোচনা অত্যধিক লক্ষ্য করা যায়। আলোচ্য বিষয়বস্তু হলো: পঞ্চ স্কন্ধ (রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান)। দ্বাদশ আয়তন (চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা, কায়, রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ, মন ও ধর্ম)। আঠার প্রকার ধাতু (চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা, কায়, রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ, চক্ষুবিজ্ঞান, শ্রোত্র বিজ্ঞান, ঘ্রাণবিজ্ঞান, জিহ্বাবিজ্ঞান, কায়বিজ্ঞান, মন, মনোবিজ্ঞান, ধর্ম)। চার প্রকার ধ্যান (প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান এবং চতুর্থ ধ্যান), পঞ্চবল (শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা)। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (সম্যক) দৃষ্টি সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি ইত্যাদি।
৪. পুগ্গল পঞঞত্তি: পুগ্গল পঞঞত্তি বা পুদগল প্রজ্ঞপ্তি। অভিধর্ম পিটকের চতুর্থ গ্রন্থ। এ গ্রন্থের রচনা, সত্য বিশ্লেষণ, বর্ণনা প্রক্রিয়া, বিষয়বস্তুর বিন্যাস প্রভৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অভিধর্ম পিটকের চেয়ে সুত্রপিটকের সঙ্গে অধিক মিল দেখা যায়। অভিধর্ম পিটকের অন্যান্য গ্রন্থে চিত্ত, চৈতসিক, নাম, রূপ ও নির্বাণ প্রভৃতি পরামার্থ সত্য সম্পর্কীয় বিষয়সমূহ যেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেভাবে এতে ধর্মসমূহের নির্দেশ করা হয়নি। পুদাল প্রজ্ঞপ্তি বা পালি পুগ্গল পঞঞত্তি এ শিরোনামটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। পুদগ্লা পুগ্নল শব্দের ব্যবহারিক সত্যানুসারে ব্যক্তি, পুরুষ সত্ত্বা বা আত্মা, পরমার্থ সত্য অনুসারে পুদগলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল চিত্ত সন্ততি মাত্র। 'প্রজ্ঞপ্তি বা পঞ্চতি শব্দের অর্থ 'প্রজ্ঞাপনা, জ্ঞাত করা, দর্শন করা, প্রকাশ করা।' অর্থাৎ যথার্থ বলে নির্দেশ করা। সুতরাং পুদাল প্রজ্ঞপ্তি শব্দের অর্থ হলো, যে পুস্তক ব্যক্তিবিশেষ বা পুদগলের পরিচয় প্রদান করে। এ গ্রন্থে স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, সত্য, ইন্দ্রিয় এবং পুদগল এই ছয় প্রকার প্রজ্ঞপ্তির উল্লেখ দেখা যায়। দ্বিবিধ প্রকার পুদগলের যথাযথ পরিচয় প্রদানই এ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য। গ্রন্থটি দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থের প্রারম্ভে তৎপর একবিধ পুচ্ছাল, বিবিধ ত্রিবিধ, চতুর্বিধ পঞ্চবিধ, ষড়বিধ, সপ্তবিধ, অষ্টবিধ, নববিধ এবং দশবিদ পুদগলের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থটিতে প্রধানত পঞ্চাশ প্রকার পুদগলের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। যার মধ্যে সম্যক সম্বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ, আর্যপুদগল ও তাদের শ্রেণিবিন্যাস, শ্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী, শৈক্ষ, অশৈক্ষ এবং পৃথকজন লোভ চরিত, দ্বেষচরিত, মোহচরিতসহ বহু প্রকার পুদগলের বর্ণনা দেখা যায়।
৫. কথাবন্ধু: অভিধর্ম পিটকের পঞ্চম গ্রন্থ হলো কথাবন্ধু। এটিকে বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কীয় তর্কশাস্ত্র বলা হয়। মূল ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র কথাবন্ধু গ্রন্থের সংকলকের নাম পাওয়া যায়। সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রের অশোকারামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে অধর্মবাদী ভিক্ষুদের বুদ্ধ শাসন থেকে বিতাড়িত করা হয়। সে সময় ভিক্ষু সংঘের নায়ক অর্হৎ মোগলিপুত্র তিষ্য স্থবির বিভাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় এ গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটিতে তেইশটি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায়ে আট থেকে বারোটি করে প্রশ্নোত্তরমালা রয়েছে। মোগলিপুত্র তিষ্য স্থবির এ গ্রন্থে প্রমাণ করতে প্রয়াস পেয়েছেন যে, থেরবাদ বা স্থবিরবাদই বুদ্ধের মূল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটাকে বিভাজ্যবাদও বলা হয়। মিথ্যাদৃষ্টি যুক্তি বা মত খণ্ডন করার জন্যই এ গ্রন্থের রচনা। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উত্থাপিত জটিল দার্শনিক তত্ত্বের প্রশ্নোত্তসমহু সমাধান করা হয়েছে। সম্পন্ন ভিক্ষুদের এভাবে অভিধর্মের কঠিন দুর্বোধ্য দার্শনিক বিষয়গুলোকে এ গ্রন্থে যুক্তি উপমার মাধ্যমে সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রন্থটি ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে পন্ডিতগণ বলেন, এতে এমন কোনো বিষয় যুক্ত করা হয়নি যা ত্রিপিটকের কোথাও না কোথাও দৃষ্টি হয় না। মূল ত্রিপিটকে যা আছে, এতে তা-ই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে মাত্র। এ গ্রন্থটির ভাব, ভাষা ও রচনার বৈশিষ্ট্য ত্রিপিটক সাহিত্যের অন্যতম গ্রন্থ মিলিন্দ প্রশ্নের সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনা করা যায়। বৌদ্ধধর্ম দর্শনের মৌলিক নির্যাস এ গ্রন্থে প্রতিফলিত হওয়ায় এটি ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৬. যমক: এটি পিটকের ষষ্ঠ গ্রন্থ। গ্রন্থখানি বিবিধ প্রকার যমকে বিভক্ত। যেমন: মূল যমক, খন্ধ যমক, আয়তন যমক, ধাতু যমক, সচ্চ যমক, সঙ্গার যমক, অনুশয় যমক, চিত্ত যমক, ধর্ম যমক এবং ইন্দ্রিয় যমক। যমক শব্দের অর্থ হলো যুগল বা জোড়া। যমক বলতে একই বিষয়ে জোড়া প্রশ্নের অবতারণাকে বুঝায়। এ প্রশ্ন দুটিতে কারণ থেকে কারণের সত্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রন্থটি দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। মূল যমকে কুশল এবং অকুশলও তাদের মূল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। খন্ধ বা স্কন্ধ যমকে পঞ্চস্কন্ধের বর্ণনা রয়েছে। ধাতু যমকে অষ্টাদশ প্রকার ধাতুর বিস্তৃত অর্থ বর্ণিত হয়েছে। সত্য যমকে চতুরার্য সত্যের বর্ণনা রয়েছে। সংস্কার যমকে তিন প্রকার সংস্কারের ব্যাখ্যা (কায়সংস্কার, বাক্যসংস্কার এবং মনসংস্কার) রয়েছে। অনুশয় যমকে রয়েছে সাত প্রকার অনুশয়ের দার্শনিক বিচার (কাম, রাগ, পটিঘ, দৃষ্টি, চিকিৎসা, মান, ভবরাগ ও অবিদ্যা) যেগুলোকে অনাগত চিত্তক্লেশ বলা হয়। চিত্ত যমকে চিত্ত ও চৈতসিক সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে। ধর্ম যমকে কুশল ও অকুশল ধর্মের তাৎপর্য বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ইন্দ্রিয় যমকে রয়েছে বারো প্রকার ইন্দ্রিয়ের পরিচেয়।
৭. পষ্ঠান: অভিধর্ম পিটকের সপ্তম গ্রন্থ বা শেষ গ্রন্থ। নামরূপ সম্পর্কীয় যাবতীয় ব্যাপারে পরস্পর সম্পর্ক ও কারণ নির্ণয় করাই এটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পষ্ঠান শব্দের অর্থ হলো মূল কারণ, প্রকৃত কারণ বা প্রধান কারণ। এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ২৪ প্রকার প্রত্যয়। প্রত্যয় শব্দের অর্থ: কারণ, নিদান হেতু। যার সহায়তায় কোনো কাজ সম্পন্ন হয়। নামরূপের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গ্রন্থটিতে সূত্রপিটকের দ্বাদশ নিদানে উল্লেখিত প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিকে ২৪ প্রকার প্রত্যয়রূপে বিভাগ করে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অভিধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নামরূপের অনিত্যতা ও অনাত্মতা। অভিধর্মের পষ্ঠান প্রকরণে এর যথার্থ ও চূড়ান্ত বিশ্লেষণ যথার্থভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। পষ্ঠানে আলোচিত ২৪ প্রকার প্রত্যয় হলো: হেতু, আরম্মন, অধিপতি, অনন্তর, সমনন্তর, সহজাত, অঞ্চম-ঞ্চ নিদয়, উপনিস্সয, পুরোজাত পচ্ছাজাত, আসেবন, কম্ম, বিপাক, আহার, ইন্দ্রিয়, ঝান (ধ্যান), মগ্ন, সম্পযুক্ত বিপপযুক্ত, অখি, নথি, বিগত এবং অবিগত প্রত্যয়। পুনরায় ২৪ প্রকার প্রত্যয়কে আলোচনার সুবিধার জন্য চারটি প্রত্যয়ের সমষ্টিভুক্ত করা হয়। যথা: ১. আলম্বন, ২. উপনিশ্রয়, ৩. কর্ম এবং ৪. অস্তি প্রত্যয়। গ্রন্থটিতে চারটি বিভাগ রয়েছে। যথা: অনুলোম পষ্ঠান, পচ্চনীয় পষ্ঠান, অনুলোম পচ্চনীয় পষ্ঠান এবং পচ্চনীয় অনুলোম পষ্ঠান। সূত্র, বিনয় কিংবা অভিধর্ম পিটকের অন্য কোনো গ্রন্থে প্রত্যয়সমূহের এরূপ বিবিধ প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়নি। অভিধর্ম বিষয়ে সবার জ্ঞানার্জনের জন্য এ গ্রন্থের অধ্যয়ন একান্ত অপরিহার্য।
বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম দর্শনের মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান লাভের জন্য অভিধর্ম পিটকের পঠন-পাঠন একান্ত অপরিহার্য। সূত্র পিটকে যে সমস্ত বিষয় অতি সহজ সরল ও উপমাসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। অভিধর্ম পিটকে তা মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে- অভিধর্ম পিটকের মূল আলোচ্য বা প্রতিপাদ্য বিষয় হলো চিত্ত, চৈতসিক রূপ ও নির্বাণ। অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থগুলিতে এ চারটি বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সূত্র পিটকে চিত্তকে, মন, হৃদয় অন্তকরণ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু অভিধর্ম পিটকে তা মৌলিক হিসেবে চিত্তকে গ্রহণ করা হয়েছে। চিত্ত কী, চিত্তের প্রকারভেদ, ভূমিভেদে চিত্তের অবস্থা, চিত্ত কীভাবে চৈতসিকের রূপ ধারণ করেছে, চৈতসিকের শ্রেণিবিন্যাস ইত্যাদি বিষয়গুলো পারমার্থিক বা লোকোত্তরভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সূত্র পিটকে যা সাধারণভাবে উপদেশিত হয়েছে অভিধর্ম পিটকে তা পারমার্থিক উপায়ে আলোচিত, বিভাজিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে। বৌদ্ধ দার্শনিকের ভাষায় "সূত্রের ভাষা আছে, সে ভাষার তরঙ্গ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, উদান আছে, গাথা আছে, উদ্দীপনা আছে, অপায় আছে, অপায় ভয় আছে, দেব ব্রহ্মা আছে, দেব ব্রহ্মলোকের আকর্ষণ আছে, নির্বাণের সুসমাচার আছে। অভিধর্ম যেন ভাষাহীন-শুধু ছেদন, বিশ্লেষণ, বিভাজন, পর্যবেক্ষণ এবং নৈর্ব্যত্তিক পরম সত্যজ্ঞানের উদ্ভাবন। সঙ্গে সঙ্গে চির চঞ্চল ব্যবহারিক জগতের নিরবশেষ বিলয় সাধন। ভগবান তথাগত প্রবর্তিত ধর্ম মাত্রই মনোবিজ্ঞানসম্মত এবং নীতি প্রধান। ত্রিপটকের সর্বত্র ধর্মকে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে বিশ্লেষণ করবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। অভিধর্মের প্রতিপাদ্য বিষয় অনুসারে যথোপযুক্ত পরিভাষা ও প্রজ্ঞপ্তি দ্বারা পরিজ্ঞেয় বিষয়ের পরিচয় প্রদান ও শ্রেণি বিভাগ করা হয়েছে। অভিধর্ম পিটকে যে নাম রূপের স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে তা সূত্র পিটকে সর্ব সাধারণের উপযোগী করে পুনরায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে সূত্র পিটকের ভাষা ব্যবহারিক বা "বোহারবচন"। যেমন: সত্তা, আত্মা, জীব, জন্ম, মৃত্যু, দেব, ব্রহ্মা, তুমি, আমি, মনুষ্য ইত্যাদি। অপরদিকে অভিধর্মের বিষয়বস্তু পরমার্থ সম্পর্কীয় পরমার্থ বচন। যথা: স্কন্ধ, চ্যুতি, প্রতিসন্ধি, সন্ততি, আত্মা, বল, বোধ্যঙ্গ, নির্বাণ ও প্রজ্ঞপ্তি ইত্যাদি। অভিধর্ম বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ। সূত্র পিটকে বলা হয়েছে যে, প্রাণী হত্যা করা উচিত নয়, এটা অকুশল কর্ম। এটির পরিণাম দুঃখজনক। কেন প্রাণীহত্যা করা অনুচিত- সূত্র পিটকে এটির মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ ও প্রমাণ পাওয়া কঠিন। অভিধর্ম পিটকেই এটির যথাযথ কারণ ও প্রমাণ প্রদর্শিত হয়েছে। এতে কাল্পনিক কোন বিষয়ের অবতারণা করে মূল বক্তব্যকে চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেই। কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের সাহায্যে বক্তব্য বিষয়ের বিশ্লেষণ করাই এটির প্রধান বিশেষত্ব। পূর্বেই বলা হয়েছে অভিধর্মের মূল আলোচ্য বিষয়ে বৌদ্ধ দর্শন ও পরমার্থ সত্য। তাই বুদ্ধের মৌলিক ধর্মদর্শন, উপলব্ধি তথা অবগাহন করার জন্য অভিধর্মের চর্চা ও অনুশীলর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞ বৌদ্ধাচার্যগণ প্রথমে ধর্ম বিনয় শিক্ষা ও অনুশীলন করবার পর অভিধর্ম চর্চা করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ অভিধর্ম বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন ছাড়া বুদ্ধের প্রচারিত গম্ভীর মনস্তাত্বিক ধর্ম-দর্শন উপলব্ধি করা কখনো সম্ভব নয়।
আরও দেখুন...