তোমার জানা বা শুধু নাম শুনেছ, এমন কয়েকটি ধর্মীয় সুত্র বা নীতিকথার নাম লেখো।
সূত্র ও নীতিগাথা হলো ভগবান বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বুদ্ধ তাঁর শিষ্য ও উপাসক-উপাসিকাদের এগুলো দেশনা করেছিলেন। ত্রিপিটকের অন্তর্গত সুত্তপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থে এসব রয়েছে। সূত্র ও নীতিগাথাসমূহে প্রকাশ পেয়েছে বুদ্ধের শিক্ষা বা দর্শনের মর্মবাণী। এগুলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি ইহলৌকিক মঙ্গলও সাধন করে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সূত্র ও নীতিগাথা পাঠ করা হয়। সাধারণত বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, বিপদ, রোগ, শোক এবং অশুভ প্রভাব হতে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য এবং সর্বপ্রকার মঙ্গল কামনা করে সূত্র পাঠ করা হয়। যেমন, রতন সূত্র দুর্ভিক্ষ ও মহামারি হতে রক্ষা পেতে, করণীয় মৈত্রী সূত্র ভূত, যক্ষ প্রভৃতির উপদ্রব হতে রক্ষা পেতে, সুপূব্বাহ্ন সূত্র অশুভ গ্রহের প্রভাব হতে রক্ষা পেতে, বোস্তঙ্গ সূত্র সকল প্রকার রোগ-শোক হতে রক্ষা পেতে ও অঙ্গুলিমাল সূত্র গর্ভযন্ত্রণা হতে মুক্তি পেতে পাঠ করা হয়। ত্রিপিটকে আরও অনেক সূত্র আছে যেগুলো পাঠ করলে নানা রকম বিপদ হতে রক্ষা পাওয়া যায় এবং বহু রকম মঙ্গল সাধিত হয়। এ অধ্যায়ে আমরা করণীয় মৈত্রী সূত্র ও নিধিকণ্ড সূত্র সম্পর্কে জানব।
এক সময় ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে বাস করছিলেন। তখন বর্ষা শুরু হবে। বর্ষাবাসের জন্য ভিক্ষুরা পাহাড়ের গুহা বা বনের মধ্যে সুবিধামতো কোনো স্থান বসবাসের জন্য বেছে নিতেন। হিমালয়ের পাশে বনের মধ্যে একটি স্থানে পাঁচশ ভিক্ষু বর্ষাবাস শুরু করলেন। কাছাকাছি গ্রাম থেকে তাঁরা ভিক্ষান্ন সংগ্রহ ও ভোজন করে পরম সুখে কর্মস্থান ভাবনা করতেন। নির্মল বায়ু সেবন এবং সুখাদ্যে তাঁদের শরীর-মন বেশ ভালো হলো। কিন্তু সমস্যা হলো তাঁদের এ অবস্থানকে কেন্দ্র করে এ স্থানে বসবাসরত কিছু অমনুষ্যের উপদ্রব ও ভয় দেখানোর কারণে তাঁরা বর্ষাবাস ভেঙে শ্রাবস্তীতে ফিরে আসলেন।
বুদ্ধের সাথে ঐ ভিক্ষুদের সাক্ষাৎ হলে বুদ্ধ তাঁদের বললেন যে, বর্ষাবাসের সময় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন ভিক্ষুরা বুদ্ধের কাছে বর্ষাবাসের স্থান ছেড়ে আসার ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে বুদ্ধ বললেন, "ভিক্ষুগণ, তোমরা আবার সে-স্থানে ফিরে যাও। আমি তোমাদেরকে ভয় থেকে পরিত্রাণের উপায় বলে দিচ্ছি”। এই বলে বুদ্ধ তাঁদের করণীয় মৈত্রী সূত্র দেশনা করলেন এবং বললেন, "এই সূত্র শিক্ষা করে বনে ফিরে যাও। প্রতিমাসের আট উপোসথ দিনে এ সূত্র উচ্চস্বরে পাঠ করবে। এ বিষয়ে ধর্মকথা বলবে, প্রশ্নোত্তর করবে, অনুমোদন করবে। সে অমনুষ্যগণ আর ভয় দেখাবে না। তোমাদের উপকারী ও হিতৈষী হবে।"
বুদ্ধের উপদেশ মতো ভিক্ষুরা সেই স্থানে গিয়ে করণীয় মৈত্রী সূত্র পাঠ ও মৈত্রী-ভাবনায় রত হলেন। করণীয় মৈত্রী সূত্র পাঠের প্রভাবে অমনুষ্যদের উপদ্রব বন্ধ হলো। মৈত্রী ও করুণার প্রভাবে তারা আর ভিক্ষুদের কোনো উৎপাত করলো না। অবশেষে ভিক্ষুরা সেখানে বর্ষাবাস শেষ করতে সক্ষম হন। এই সূত্রে নির্বাণ লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণের জন্য করণীয় মৈত্রী ভাবনার নির্দেশনা আছে, তাই সূত্রটির নাম 'করণীয় মৈত্রী সূত্র'। পালিতে এই সূত্রের নাম 'করণীয় মেত্তসুত্তং'।
১. করণীযমখকুসলেন যন্তং সন্তং পদং অভিসমেচ্চ,
সক্কো উজুচ সুজুচ সুবচো চম্স মুদু অনতিমানী।
২. সন্তুস্সকো চ সুভরো চ অল্পকিচ্চো চ সল্লহুকবুত্তি,
সন্তিন্দ্রিযো চ নিপকো চ অল্পগন্তো কুলেসু অননুগিদ্ধো।
৩. ন চ খুদ্দং সমাচরে কিঞ্চি যেন বিষ্ণু পরে উপবদেয্যুং,
সুখিনো বা খেমিনো হোল্ড সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিতত্তা। .
8 যে কেচি পাণভূতত্থি তসা বা থাবরা বা অনবসেসা,
দীঘা বা যে মহন্তা বা মঙ্গিমা রস্পকাণুকা থুলা।
৫ . দিষ্ঠা বা যেবা অদিষ্ঠা যে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে,
ভূতা বা সম্ভবেসী বা সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিতত্তা।
৬. ন পরো পরং নিকুব্বেথ, নাতিমঞ্চেথ কখচি নং কিঞ্চি,
ব্যারোসনা পটিঘসও নাএঞ্চমঞ্চস্স দুদ্ধমিচ্ছেয্য।
৭. মাতা যথা নিযং পুত্তং আযুসা একপুত্তমনুরক্সে,
এবম্পি সব্বভূতেসু মানসং ভাবযে অপরিমাণং।
৮. মেত্তঞ্চ সব্বলোকস্মিং, মানসং ভাবযে অপরিমাণং,
উদ্ধং অধো চ তিরিযঞ্চ অসম্বাধং অবেরং অসপত্তং।
৯. তিষ্ঠং চরং নিসিন্নো বা সযনো বা যাবত বিগতমিদ্ধো,
এতং সতিং অধিষ্ঠেয্য ব্রহ্মমেতং বিহারং ইধমাহু।
১০. দিগ্বিঞ্চ অনুপগস্ম সীলবা দস্পনেন সম্পন্নো,
কামেসু বিনেয্য গেধং ন হি জাতু গল্পসেয্যং পুনরেতীতি।
১. শান্তিময় নির্বাণলাভে ইচ্ছুক, করণীয় বিষয় সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত ব্যক্তি-সক্ষম, সরল বা ঋজু, খুব সরল, সুবোধ, কোমল স্বভাব ও অভিমানহীন হবেন।
২. (তিনি সর্বদা যথালাভে) সন্তুষ্ট, সুখপোষ্য, অল্পে তুষ্ট, সংযত ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞ, অপ্রগল্ভ বা বিনীত এবং গৃহীদের প্রতি অনাসক্ত হবেন।
৩. তিনি এমন কোনো ক্ষুদ্র (নীচ) আচরণ করবেন না, যাতে অন্য বিজ্ঞগণ নিন্দা করতে পারেন। সকল প্রাণী সুখী হোক, ভয়হীন বা নিরাপদ হোক, শান্তি ও সুখ উপভোগ করুক-এরকম মৈত্রীভাব পোষণ করবেন।
৪. সব প্রাণী অস্থির বা স্থির, দীর্ঘ বা বড়, মধ্যম বা হ্রস্ব, ছোট বা স্কুল।
৫. দেখা যায় বা দেখা যায় না, দূরে বা কাছে বাস করে, জন্মেছে বা জন্ম নেবে সেই সকল প্রাণী সুখী হোক।
৬. একে অপরকে বঞ্চনা করো না, কোথাও কাউকেও অবজ্ঞা করো না। হিংসা বা ক্রোধবশত কারো দুঃখ কামনা করো না।
৭. মা যেমন একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন, তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে।
৮. সর্বলোকের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে। জগতের উপরে, নীচে ও চারিদিকে যে সকল প্রাণী আছে, তারা ভেদজ্ঞান-রহিত, বৈরীহীন ও শত্রুহীন হবে।
৯. দাঁড়ানো অবস্থায়, চলমান অবস্থায়, বসা বা শোয়া অবস্থায় এবং না ঘুমানো পর্যন্ত এই স্মৃতি অধিষ্ঠান করবে। একে ব্রহ্মবিহার বলে।
১০. শীলবান ও সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন স্রোতাপন্ন ব্যক্তি মিথ্যা দৃষ্টি পরিত্যাগপূর্বক কাম ও ভোগবাসনাকে দমন করে পুনর্বার গর্ভাশয়ে জন্মগ্রহণ করেন না।
শব্দার্থ: সন্তং শান্ত; সক্কো সক্ষম বা সমর্থ; অভিসমোচ্চ সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত হয়ে; উজু ঋজু বা সরল; সুজুচ সুঋজু বা অতি সরল; সন্তপ্সকো সন্তুষ্ট ব্যক্তি: সুভরো সুখপোষ্য বা সহজে প্রতিপালন বা সাহায্য করা যায়; অল্পকিচ্চো - অল্পকৃত্য বা অল্প কর্তব্যযুক্ত; সল্লহকবুত্তি যে ব্যক্তি সহজে অভাব বোধ করে না এবং অভাববোধ করলে তা সহজে পূর্ণ করে নিতে পারে, অল্পে তুষ্ট; সন্তিন্দ্রিয়ো শান্তেন্দ্রিয়; নিপকো প্রজ্ঞাবান; অল্পগল্পো - অপ্রগল্ড, চঞ্চলতবান, বিনীত, অহংকারহীন, বিবেকবান, লজ্জাশীল, শিষ্ট; অননুগিন্ধো অনাসক্ত; উপবদেয়্যুং নিন্দা করা; খেমিনো যিনি নিরাপত্তা বা শান্তি উপভোগ করেন; পাণভুতথি জগতের প্রাণিকুল; থাবরা – স্থির; অনবসেসা সম্পূর্ণরূপে; তিরিযঞ্চ বক্রভাবে, অসলভাবে; অসম্বাধং ভেদজ্ঞানরহিত; অবেরং - বৈরহীন; অসপত্তং শত্রুতাহীন; তিষ্ঠ দাঁড়ানো; বিগতমিদ্ধো না ঘুমানো পর্যন্ত; অধিষ্ঠেয্য অধিষ্ঠান; নিকুঝেথ - বঞ্চনা; মানসং ভাবয়ে মৈত্রী পোষণ করবে।
আরও দেখুন...