নিধিকণ্ড সূত্রের কোন কোন বিষয় অন্যদেরও কীভাবে চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করবে তার একটি পরিকল্পনা তৈরি কর।
নিধিকণ্ড সূত্রের কোন কোন বিষয় অন্যদেরও চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করবে | কীভাবে উদ্বুদ্ধ করবে |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
ধর্মপদ সূত্র পিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ের দ্বিতীয় গ্রন্থ। এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। ধর্ম পদে ৪২৩টি গাথা এবং ২৬টি বর্গ রয়েছে। এর গাথাগুলির বেশির ভাগ ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। প্রত্যেকটি গাথা স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব রীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মনীষীবৃন্দ ধর্মপদের গাথাসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গ্রন্থটি আজও বিশ্বমানবের চিত্তকে গভীর ও নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করে। অতীতে এ গ্রন্থ সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত এ তিনটি ভারতীয় ভাষাতেই প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়েছে।
'ধর্মপদ'-এর 'ধর্ম' ও 'পদ' শব্দ দুটি বিভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। ধর্মপদের 'ধর্ম' শব্দের অর্থ 'নীতি', 'মূলনীতি', 'বিষয়', 'পুণ্য' এবং 'পদ' শব্দের অর্থ 'কারণ', 'পদক্ষেপ', 'পথ', 'গুচ্ছ', 'শ্লোক' প্রভৃতি। ধর্মপদ গ্রন্থের নাম নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেখা যায়। যেমন: 'পুণ্যের পথ', 'ধর্মের পথ', 'সত্যের পথ' প্রভৃতি।
ধর্মপদের উপদেশ সর্বকালীন এবং বিশ্বজনীন। গ্রন্থটি জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছে। ধর্মপদের অমৃতবাণী মানব কল্যাণ আর বিশ্বমৈত্রীর মূর্ত প্রতীক। বাণীগুলো মানব জীবনকে ক্ষুদ্র সত্তা থেকে মুক্ত করে অসীমের সন্ধানে মহত্ত্বের দিকে নিয়ে যায়। জীবনকে সম্যক উপলব্ধির জন্য নীতিবাক্যসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মপদের আবেদন অনেক প্রাণস্পর্শী। ধর্মপদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ, এটি ভারত উপমহাদেশকে পৃথিবীতে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তনের যুগে সাধারণভাবে প্রচলিত রীতি ও ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধর্মপদ সংকলিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে দান, শীল, ভাবনায় অনুপ্রাণিত করা; ত্রিরত্নের প্রতি শ্রদ্ধা উৎপাদন, ইন্দ্রিয় সংযমের উপকারিতা, চিত্ত শাসনের সুফল ইত্যাদি বিষয় অতি সহজ, সরল ভাষায় ধর্মপদে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে যুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত মানবের স্বরূপ, বৌদ্ধ ভিক্ষুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পাপ-পুণ্যের কার্যকারিতা, মৈত্রীর প্রয়োজনীয়তা এবং বৈরিতার পরিণাম সম্পর্কে মানব সমাজকে সর্তক করে দেওয়া হয়েছে। মূলত ধর্মপদ নামের মধ্যেই রয়েছে গ্রন্থের মূল বক্তব্য। বৌদ্ধ ধর্মের নির্ধারিত পথ অনুসরণ করার জন্যে ধর্মপদ পাঠের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। এ গ্রন্থের নিবেদন হলো ধর্মের মাধ্যমে জনগণের নৈতিক জীবন গঠন করা। মানব মনের সুকুমার বৃত্তির প্রকাশ এবং উন্নত মননশীলতার আদর্শ প্রচার করা।
ধর্মপদে বৌদ্ধ দর্শনের সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপিত হয়েছে। এতে যে কয়টি শ্রেষ্ঠ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: চার আর্যসত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, ক্ষান্তি, বিরাগ, মৈত্রী, সহিষ্ণুতা ও নির্বাণ। চতুরার্য সত্য হলো দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ এবং দুঃখ নিরোধের উপায়। এখানে প্রথম আর্যসত্য দুঃখ বলতে বোঝায় জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, শোক-বিলাপ, অপ্রিয় সংযোগ, প্রিয় বিয়োগ এবং আশার অতৃপ্তিজনিত দুঃখ। বলতে গেলে পঞ্চস্কন্ধরূপ মানব দেহ ধারণই দুঃখ। ধর্মপদের একাদশ অধ্যায়ে দেহকে বলা হয়েছে- কতগুলো পচনশীল উপাদানের সমষ্টি, ব্যাধি ও অশেষ দুঃখ-যন্ত্রণার আগার; রোগ-শোক ও জরা তার নিত্য সঙ্গী। আর তার থেকেই দুঃখের ক্রমাগত সৃষ্টি।
সকল দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা। বেদনা বা অনুভূতি থেকে তৃষ্ণার উৎপত্তি। তৃষ্ণা মানুষকে জন্ম, মৃত্যুরূপে দুঃখ চক্রে আবর্তিত করে, বন্ধনের ভার বৃদ্ধি করে। কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা এবং বিভব তৃষ্ণার মতো, তৃষ্ণাজাল থেকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। তৃষ্ণাজয়ের মধ্যেই পঞ্চস্কন্ধ জয়ের চাবিকাঠি। কিভাবে তৃষ্ণাকে জয় করে জন্ম জরা ব্যাধি মৃত্যু শোক প্রভৃতির উপশম করা যায় তার ইঙ্গিত এ গ্রন্থে আছে।
দুঃখের নিরোধ হলো নির্বাণ। একমাত্র নির্বাণে দুঃখের অস্তিত্ব বিলোপ হয়। নির্বাণ পরম সুখ। এটি উপলব্ধির বিষয় এবং অনির্বচনীয়। ধর্মপদে নির্বাণকে বলা হয়েছে যোগক্ষেম, অব্যাখ্যাত, জাতিক্ষয়, অমৃতপদ এবং সংস্কার উপশমকারী। দুঃখ নিরোধের উপায় হলো- নির্বাণ লাভ করা। শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার পূর্ণতা বিধান ছাড়া নির্বাণ লাভ করা সম্ভব নয়। শীল পালনের দ্বারা কায়-বাক্য-মনের পবিত্রতা সাধন এবং পবিত্র মনে স্মৃতি সাধনায় বিরত থাকলে প্রজ্ঞা উৎপন্ন হয়। প্রজ্ঞা ভাবনার মাধ্যমে তৃষ্ণাক্ষয়ে সকল দুঃখের অন্ত নির্বাণ উপলব্ধি হয়। তাই ধর্মপদের নৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
১. 'অক্কোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে'
যে চ তং উপনযহন্তি বেরং বেরং তেসুপসম্মতি।
বাংলা- আমাকে আক্রোশ করল, আমাকে প্রহার করল, আমাকে পরাজয় করল কিংবা আমার (সম্পত্তি) হরণ করল, যারা এমন চিন্তা পোষণ করে না, তাদের শত্রুতার উপশম হয়।
২. নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তী'ধ কুদাচনং
অবেরেন চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো।
বাংলা- জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না,
মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়; এটাই চিরন্তন ধর্ম।
৩. সারঞ্চ সারতো ঞতা, অসারঞ্চ অসারতো,
তে সারং অধিগচ্ছন্তি, সম্মাসংকল্পগোচরা।
বাংলা- যারা সার বস্তুকে সার এবং অসারবস্তুকে অসাররূপে জানেন,
সেই সম্যক সংকল্পপরায়ন ব্যক্তিরা প্রকৃত সারবস্তু লাভ করতে সমর্থ হন।
৪. অল্পমাদো অমতপদং, পমাদো মজুনো পদং
অপ্রমত্তা ন মীয়ন্তি, যে পমত্তা যথামাতা।
বাংলা- অপ্রমাদ অমৃত লাভের উপায়, প্রমাদ মৃত্যুর পথ,
অপ্রমত্ত ব্যক্তিরা অমর আর যারা প্রমত্ত তারা মৃতস্বরূপ।
৫. ন পরেসং বিলোমানি ন পরেসং কতাকতং,
অত্তনো'ব অবেন্ধেয্য কতানি অকাতানি চ।
বাংলা- পরের বিচ্যুতির প্রতি কিংবা পরের কৃত ও অকৃত কার্যের প্রতি লক্ষ্য করবে না,
নিজের কৃত ও অকৃত কার্যাদির প্রতি দৃষ্টি রাখবে।
৬. মধু'ব মঞ্চতি বালো যাব পাপং ন পদ্ধতি,
যদা চ পচ্চতি পাপং অথ বালো দুস্খং নিগচ্ছতি।
বাংলা- যতদিন পাপ পরিণতি লাভ না করে ততদিন মূর্খ সেটিকে মধুময় মনে করে,
কিন্তু পাপ যখন পরিণত হয় তখন মূর্খকে দুঃখ ভোগ করতে হয়।
৭. ন ভজে পাপকে মিত্তে ন ভজে পুরিসাধমে,
ভজেথ মিত্তে কল্যাণে ভজেথ পুরিসুত্তমে।
বাংলা- পাপী মিত্রের সংসর্গ করবে না, নরাধম ব্যক্তির সংসর্গ করবে না:
কল্যাণমিত্রদের ও পুরুষোত্তমদের সংসর্গ করবে।
৮. যো সহপ্সং সহস্পেন সঙ্গামে মানুসে জিনে
একঞ্চ জেয়্যমত্তানং স বে সঙ্গামজুত্তমো।
বাংলা- যে ব্যক্তি সংগ্রামে সহস্র সহস্র মানুষকে জয় করে তার তুলনায়
যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন, তিনিই সর্বোত্তম সংগ্রামজয়ী।
৯. যো চ বস্সসতং জীবে দুস্সীলো অসমাহিতো,
একাহং জীবিতং সেয়্যো সীলবন্তস্স ঝাযিনো।
বাংলা- যে ব্যক্তি দুশ্চরিত্র ও অসমাহিত হয়ে শতবর্ষ জীবিত থাকে,
তার জীবন অপেক্ষা সচ্চরিত্র ধ্যানী ব্যক্তির এক দিনের জীবনও শ্রেয়।
১০. যো চ বস্সসতং জীবে কুসীতো হীনবীরিযো,
একাহং জীবিতং সেয়্যো বিরিয়মারভাতো দহুং।
বাংলা- যে ব্যক্তি অলস ও হীনবীর্য হইয়া শতবর্ষ বেঁচে থাকে,
তার জীবন অপেক্ষা দৃঢ়পরাক্রম ও বীর্যপরায়ণ পুরুষের একটি দিনের জীবনও শ্রেয়।
১১. ন অন্তলিক্সে ন সমুদ্দমন্ত্রে
ন পববতানং বিবরং পবিস্স,
ন বিজ্ঞতি সো জগতিপ্পদেসো
যথষ্টিতো মুঞ্চেয়্য পাপকম্মা।
বাংলা- অন্তরীক্ষে, সমুদ্রমধ্যে কিংবা পর্বত গুহা যেখানেই প্রবেশ করো না কেন,
জগতে এমন স্থান নেই যেখান থেকে পাপকর্ম (ফলভোগ) হতে মুক্তি পাওয়া যায়।
১২. সক্সে তসন্তি দন্ডন্স সব্বে ভায়ন্তি মজুনো,
অত্তানং উপমং কতা না হনেয়া না ঘাতয়ে।
বাংলা- সবাই দণ্ডকে ভয় করে, মৃত্যুর ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত,
নিজের সাথে তুলনা করে কাউকে আঘাত কিংবা হত্যা করবে না।
১৩. অভাহি অত্তনো নাখো কোহি নাথো পরো সিয়া?
অত্তনা'ব সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং।
বাংলা- নিজেই নিজের নাথ (ত্রাণকর্তা); এছাড়া অপর কে কার নাথ?
সুদান্ত ব্যক্তি আপনার মধ্যেই দুর্লভ আশ্রয় লাভ করেন।
১৪. উত্তিষ্ঠে নপ্তমজ্জেয্য ধম্মং সুচরিতং চরে,
ধম্মাচারী সুখং সেতি অস্মিং লোকে পরহি চ।
বাংলা- উদ্যম করো, প্রমত্ত হয়ো না। উত্তমরূপে ধর্ম আচরণ করো।
ধর্মাচারী ইহলোক ও পরলোকে সুখে অবস্থান করে।
১৫. সঞ্চাপাপপ্স অকরণং কুসলসস উপসম্পদা,
সচিত্তপরিযোদপনং এতং বুদ্ধানসাসনং।
বাংলা- সমস্ত পাপ থেকে বিরতি (শীল), কুশল কর্মের পরিপূর্ণতা (প্রজ্ঞা)
ও স্বীয় চিত্তের পবিত্রতা সাধন (সমাধি)-এটিই বুদ্ধের অনুশাসন।
১৬. আরোগ্য পরমা লাভা সন্তষ্টি পরমং ধনং,
বিস্সাসপরমা জ্ঞাতী নিব্বানং পরমং সুখং।
বাংলা- আরোগ্য পরম লাভ; সন্তোষ পরম ধন; বিশ্বস্ত লোকই পরমাত্মীয় এবং নির্বাণই পরম সুখ।
আরও দেখুন...