রিকেটস : দেহে ভিটামিন 'ডি'-এর সঙ্গে ক্যালসিয়াম শোষিত হয়। এই ভিটামিনের অভাবে রিকেটস রোগ হয়। ভিটামিন অংশে এর বর্ণনা তোমরা পড়েছ।
গলগন্ড : গলগন্ড রোগকে ঘ্যাগ বলে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহে এ রোগের প্রকোপ বেশি। যখন আমাদের রক্তে কোনো কারণে আয়োডিনের অভাব ঘটে তখন গলায় অবস্থিত থাইরয়েডগ্রন্থি ক্রমশ আকারে বড় হতে থাকে। গলা ফুলে যায়। একে গলগন্ড বা ঘ্যাগ বলে। এ রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ :
• থাইরয়েডগ্রন্থি ফুলে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়
• শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হয়।
• গলার আওয়াজ ফ্যাসফেসে হয়ে যায়।
• গলায় অস্বস্তিবোধ হয়, খাবার গিলতে কষ্ট হয়।
• আক্রান্ত ব্যক্তি অবসাদ ও দুর্বলতাবোধ করে।
প্রতিকার
রোগের প্রাথমিক অবস্থায় আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল ও সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
ক্রোটিনিজম
সাধারণত আয়োডিনের অভাবে শিশুদের এ রোগ হয়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর দেহে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয় তা হলো—
• দেহের বর্ধন মন্থর হয়।
• পুরু ত্বক, মুখমণ্ডলের পরিবর্তন দেখা দেয় ।
• পুরু ঠোঁট, বড় জিহ্বা, মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
প্রতিরোধ
খাবারে আয়োডিনযুক্ত লবণ দিয়ে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
রক্তাল্পতা বা এ্যানিমিয়া
লোহা, লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিনের গঠন উপাদান। শিশু ও সন্তান সম্ভবা মায়ের খাদ্যে লোহার ঘাটতির জন্য রক্তাল্পতা দেখা যায়। সাধারণত শিশুদের পেটে কৃমি হলে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে । এর লক্ষণগুলো হলো –
• দুর্বলতাবোধ, মাথা, গা ঝিমঝিম করা।
• বুক ধড়ফড় করা ।
• মাথা ঘোরানো, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠা।
• ওজন হ্রাস ও খাওয়ায় অরুচি দেখা দেয়।
প্রতিকার
লৌহ সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফল, মাংস, ডিমের কুসুম, যকৃৎ ও বৃক্ক ইত্যাদি বেশি করে খাওয়া। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা। রোগ কঠিন আকার ধারণ করলে হৃৎপিণ্ডের দ্রুত রক্ত সঞ্চালন ও হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পানি
পানি জীবন ধারণের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। প্রাণী দেহের ৬০-৭০ ভাগই পানি । দেহ গঠনে পানির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এ পানি অস্থি, মাংস, ত্বক, নখ, দাঁত ইত্যাদি কোষের ভিতরে ও বাইরে থাকে। প্রায় সব খাদ্যেই কম-বেশি পানি থাকে। তবে আমরা আলাদাভাবে পানি পান করে দেহের চাহিদা মেটাই|
দেহ গঠন ছাড়াও পানি দেহের সব অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। পানি ছাড়া দেহের ভিতরে কোনো রাসায়নিক ক্রিয়া হতে পারে না। পানি দেহে দ্রাবক রূপে কাজ করে। বিভিন্ন খনিজ লবণ পানিতে দ্রবীভূত থাকে। পানিতে দ্রবণীয় অবস্থায় খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়া চলে। আবার পানিতে দ্রবীভূত থেকেই খাদ্য উপাদান দেহে শোষিত হয়।
কাজ
• পানির জন্যই রক্ত সঞ্চালন ও তাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
• পানি দেহ থেকে দূষিত পদার্থ অপসারণ করে। যেমন- মূত্র ও ঘাম।
কলেরা ও উদরাময় রোগে মলের সঙ্গে বা বমির সঙ্গে দেহ থেকে হঠাৎ বেশ কিছু পানি বের হয়ে যায়। ফলে দেহে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কলেরা বা উদরাময় রোগ হলে রোগীকে স্যালাইন বা লবণ পানির শরবত খাওয়াতে হবে। এটা কলেরা বা উদরাময়ের সবচেয়ে সহজ চিকিৎসা। এছাড়া আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র কর্তৃক তৈরি খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। প্যাকেটের স্যালাইন পানিতে গুলে রোগীকে খাওয়াতে হয়। সম্প্রতি শস্য স্যালাইন নামক আর একটি খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবিত হয়েছে। ১ লিটার পানি, ৫০ গ্রাম চালের গুঁড়া ও এক চিমটি লবণ মিলিয়ে এ স্যালাইন তৈরি করা হয়।
কাজ : তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে খাবার স্যালাইন বানাতে শিখেছ। এবার তোমরা পুনরায় খাবার স্যালাইন তৈরি করো। স্যালাইন তৈরির সময় তোমরা কী কী সাবধানতা অবলম্বন করবে তা লিপিবদ্ধ করবে। |
শুষ্কতা
কোনো কারণে দেহে পানির পরিমাণ কমে গেলে কোষগুলোতে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। কোষের পানি কমে গেলে অতিরিক্ত পিপাসা হয়, রক্তের চাপ কমে যায়, রক্ত সঞ্চালনে অসুবিধা হয়, বিপাক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। পানির অভাবে দেহের ওজন কমে যায় এবং পেশি ও স্নায়ুকোষ দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের নিচে নেমে গেলে দেহের স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটে, ফলে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
রাফেজ বা আঁশযুক্ত খাদ্য
শস্যদানা, ফলমূল, , সবজির অপাচ্য অংশকে রাফেজ বলে। দেহের ভিতর রাফেজের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। রাফেজ কোনো পুষ্টি উপাদান নয়। তবে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাফেজ পৌষ্টিক নালির ভিতর দিয়ে সরাসরি স্থানান্তরিত হয়। ফল ও সবজির রাফেজ, সেলুলোজ নির্মিত কোষপ্রাচীর। আঁশযুক্ত খাবার থেকে রাফেজ পাওয়া যায়।
খাদ্য নির্বাচন
যে সমস্ত খাদ্যবস্তু দেহের ক্যালরি চাহিদা পূরণ করে, টিস্যু কোষের বৃদ্ধি ও গঠন বজায় রাখে এবং দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলীকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাকে সুষম খাদ্য বলে। অর্থাৎ সুষম খাদ্য বলতে বোঝায় ৬টি উপাদান বিশিষ্ট পরিমাণ মতো খাবার যা ব্যক্তিবিশেষের দেহের চাহিদা মেটায়। বয়স, লিঙ্গভেদ, দৈহিক অবস্থা, শ্রমের পরিমাণ হিসেবে পুষ্টির প্রয়োজনীয় উপাদনগুলো উপযুক্ত পরিমাণে সুষম খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকে। যে শর্ত পালনে খাবার সুষম হয় সেগুলো হলো-
১. প্রতিবেলার খাবারে আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ এই তিনটি শ্রেণির খাবার অন্তর্ভুক্ত করে খাদ্যের ছয়টি উপাদানের অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করা।
২. প্রত্যেক শ্রেণির খাদ্য বয়স, লিঙ্গ ও জীবিকা অনুযায়ী সরবরাহ করা।
৩. দৈনিক ক্যালরি ৬০-৭০% শর্করা, ১০% আমিষ ও ৩০-৪০% স্নেহ জাতীয় পদার্থ থেকে গ্রহণ করা।
সুষম খাদ্য তালিকা
কতগুলো নিয়ম মেনে একটি সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। যথা—
১. প্রথমত খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো ব্যক্তিবিশেষের বয়স, কর্ম ও শারীরিক অবস্থাভেদে যে বিভিন্ন ধরনের হয় সেদিকে লক্ষ রেখে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা।
২. দৈহিক প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যের তাপমূল্য বা ক্যালরি তাপ শক্তির পরিমাণ নিশ্চিতকরণ।
৩. খাদ্যে দেহ গঠনের ও ক্ষয়পূরণের উপযোগী আমিষ সরবরাহ করা।
৪. খাদ্যে যথোপযুক্ত ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানির উপস্থিতি।
৫. বিভিন্ন খাদ্যের পুষ্টিমান ও খাদ্যের শ্রেণিবিভাগ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন। প্রথমে খাদ্যের মূল বিভাগগুলো থেকে খাদ্য বাছাই করা। খাদ্য বাছাইয়ে বৈচিত্র্য থাকা।
৬. খাদ্য তালিকা প্রস্তুতির সময় খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন থাকা।
৭. ব্যক্তি ও পরিবারের আর্থিক সঙ্গতির দিক ভেবে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা।
৮. ঋতু ও আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা।
নতুন শব্দ : আমিষ, শর্করা, স্নেহ, ভিটামিন, সহজ পাচ্যতার গুণক, অ্যামাইনো এসিড, কোয়াশিয়রকর, মেরাসমাস, জেরপথালমিয়া, স্কার্ভি, রিকেট্স, অস্টিওম্যালেশিয়া, প্রথ্রোম্বিন, ক্রোটিনিজম, এ্যানিমিয়া
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা যা শিখলাম-
- বিপাকক্রিয়া চালানোর জন্য যে শক্তি প্রয়োজন তাকে মৌলবিপাক বলে ।
- ভিটামিন ও খনিজ লবণ আলাদা কোনো খাদ্য নয়। এগুলো অন্য খাদ্য উপাদান থেকে পাওয়া যায়।
- পানি দেহের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিপাককৃত খাদ্য উপাদান পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় দেহের সর্বত্র পরিবাহিত হয়।
আরও দেখুন...