দশম অধ্যায়
অসুস্থ বিশ্বের নিরাময়
প্রত্যেক মানুষ তার জীবনে কোনো না কোনোভাবে অসুস্থ হয় । অসুস্থতা কোনো মানুষের জন্য কাম্য নয়, তবুও তা মানুষের জীবনে আসে । আমাদের জীবনে অসুস্থতা কখনো সামান্য, কখনো বড় আকারের, আবার কখনো বা কারো জীবনে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে; এমন কি, তা কারো জীবনে মৃত্যু ডেকে আনে । অসুস্থতা আমাদের জীবনের আনন্দ, শান্তি ও মনের একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়; তার ফলে সৃষ্ট হয় নিরানন্দ- ভাব, বিরক্তি, অধৈর্য, নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব। দীর্ঘ ও গুরুতর অসুস্থতা জীবনে চরম হতাশার জন্ম দেয় । অসুস্থতা মানব জীবনের একাগ্রতা নষ্ট করে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে । তাই সব মানুষই চায় তার অসুস্থতা থেকে নিরাময় বা পূর্ণ সুস্থতা এবং অসুস্থতার দ্বারা সৃষ্ট নিরানন্দ ও বিচ্ছিন্ন জীবন থেকে মুক্তি । কেননা সুস্থ জীবনই হলো সুখী, সুন্দর, আনন্দময় ও শান্তিময় জীবন ।
শুধু মানুষই নয়, মানুষের মতো পৃথিবী এবং এর পরিবেশও নষ্ট বা দূষিত হয়, যেমন পৃথিবীর প্রাণী, প্রকৃতি, পরিবেশ, বাতাস, আবহাওয়া, নদনদী, সাগর ইত্যাদি । এই অসুস্থতা শুধু বাহ্যিক বা দৈহিক নয়, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকেও পৃথিবী অসুস্থতায় ভোগে । দৈহিক অসুস্থতার চাইতে অভ্যন্তরীণ অসুস্থতাই বেশি অস্বস্তিকর । মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে অসুস্থ বলেই পৃথিবী ও অসুস্থ । তাই মানুষের মতো পৃথিবীরও সুস্থতা বা নিরাময় প্রয়োজন । মানুষগুলো সুস্থ হয়ে উঠলেই পৃথিবীরও নিরাময় হবে । মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সুখী-সুন্দর-শান্তিময় জীবনের জন্যে সুস্থতা প্রয়োজন, ঠিক তেমনিভাবে সুন্দর ও শান্তিময় বিশ্বের জন্যে সুস্থ প্রকৃতি ও পরিবেশ অপরিহার্য ।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
পাপ
পৃথিবীর মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও কৃষ্টিগত মূল্যবোধের অবক্ষয় বা ধ্বংস সাধনই হলো পাপ যার অপর নাম মন্দতা বা অসুস্থতা । ঈশ্বর পরম সুন্দর। তিনি ‘অতি সুন্দর’ এক পৃথিবী এবং যাবতীয় সবকিছুই অতি সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু পাপের ফলে মানুষ ও পৃথিবীর সবকিছু কলঙ্কিত হলো এবং সুন্দর পৃথিবীর সবকিছুই কলুষিত হলো । ঈশ্বরের সৃষ্ট সুন্দর ও পবিত্ৰ পৃথিবী মানুষের পাপের ফলে এক অসুস্থ রুগ্ন ও ভগ্ন পৃথিবীতে পরিণত হলো ।
কাজ : দলে ভাগ হয়ে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা, পাপের দিকসমূহ চিহ্নিত করে ও এ থেকে পরিত্রাণের উপায় আলোচনা কর । |
পাপ বা মন্দতা কী
অনেকে মনে করে থাকে যে, পাপ হলো কিছু ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অমান্য করা, লঙ্ঘন করা বা উপেক্ষা করা । ইহুদিরা মনে করত যে, পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মের দ্বিতীয় বিবরণে যে ৬১৩টি ধর্মীয় বিধান রয়েছে, তার কোনো একটি ভঙ্গ করলেই পাপ হয় । অনেক খ্রিষ্টভক্ত মনে করে থাকেন যে, মোশীর কাছে ঈশ্বরের দেওয়া ‘দশ আজ্ঞা'-র যে কোনো একটি আজ্ঞা লঙ্ঘন করলেই পাপ হয় । পুরাতন নিয়মের এই দশ আজ্ঞায় সাতটি আজ্ঞাই নিষেধাজ্ঞা অর্থাৎ সেখানে বলা হয়েছে: নরহত্যা করবে না, চুরি করবে না, মিথ্যা কথা বলবে না, ইত্যাদি । দশ আজ্ঞা অনুসারে মন্দ বা খারাপ কিছু করাই হলো পাপ ।
যীশু পুরাতন নিয়মের দশটি আজ্ঞাকে দুইটি আজ্ঞায় প্রতিস্থাপন করেছেন । তিনি বলেছেন: তোমার ঈশ্বর স্বয়ং প্রভু যিনি, তাঁকে তুমি ভালোবাসবে তোমার সমস্ত অন্তর দিয়ে, তোমার সমস্ত প্রাণ দিয়ে, তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে, আর তোমার সমস্ত মন দিয়ে! আর তোমার প্রতিবেশীকে তুমি নিজের মতোই ভালোবাসবে” (মথি ২২: ৩৭-৩৯; মার্ক ১২: ২৮-৩৪, লুক ১০ : ২৫-২৮)। তাই যীশুর বিধান অনুসারে পাপ বা মন্দতা হলো ঈশ্বর এবং অপরের সাথে প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক না রাখা, নষ্ট করা বা ভেঙ্গে ফেলা । পুরাতন নিয়মের বিধান অনুসারে মন্দ কাজ করা, যীশুর বিধান অনুসারে ভালো না বাসা, কারো সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলাই হলো পাপ । অন্যকথায়, ভালো কাজ না করাই হলো পাপ বা মন্দ । এখানে যীশু পুরাতন নিয়মের ঊর্ধ্বে গিয়েছেন এবং পাপ বা মন্দতা সম্বন্ধে নতুন ধারণা ও শিক্ষা দিয়েছেন ।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক । দয়ালু সমরীয়ের কাহিনীতে পুরাতন নিয়মের দশ আজ্ঞা অনুসারে মনে হতে পারে যে মন্দিরের যাজক এবং সেবক কোনো পাপ করেননি, তারা বরং তাদের ধর্মীয় নিয়ম পালন করেছেন । তাদের পালনীয় ধর্মীয় দায়িত্ব পালন না করলেই তাদের পাপ হতো বলে তারা আহত ব্যক্তির সেবা না করে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন । যীশুর বিধান অনুসারে ভালোবাসার কাজ না করা, বা ভালো না বাসাই হলো পাপ যা তারা করেছেন । অন্যদিকে, সত্যিকার পুণ্যের কাজ করেছিলেন সেই বিজাতীয় সমরীয় লোকটি । তার গভীর ভালোবাসা দিয়ে তিনি আহত ব্যক্তির সেবা করেছিলেন ।
মথি লিখিত মঙ্গলসমাচারের ২৫:৩১-৪৬ অনুসারে অন্যকে, বিশেষভাবে তুচ্ছ ও অবহেলিত মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা হলো পুণ্যের কাজ । অন্যদিকে, তাদের ভালোবাসতে অস্বীকার করা, বা অবহেলা করাই হলো পাপ বা মন্দ- যা ঈশ্বরকে কষ্ট দেয় ।
লুক লিখিত মঙ্গলসমাচারের ১৫:১১-৩২ পদে যীশু পাপের ধারণা আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন । কাউকে ভালোবাসতে অস্বীকার করা, বা কাউকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করাই হলো পাপ যা বড় ছেলে করেছিল । সে তার অনুতাপী ছোট ভাইকে আর ভালোবাসতে চায়নি এবং তাকে নিজের ভাই বলে গ্রহণ করতেও চায়নি।
দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ঐশতত্ত্ববিদ ডি. এস. আমালোরপাভাদাস বলেছেন, “ভালোবাসার সম্পর্ককে দুর্বল করে দেওয়া বা নষ্ট করে দেওয়াই হলো পাপ । ঈশ্বরকে এবং অন্যকে ভালোবাসতে অস্বীকার করাও হলো মন্দতা বা পাপ । স্বার্থপরতা, ‘আমিত্ব ভাব,' অন্যদের সাথে সহভাগিতা করতে অস্বীকার করা, বিচ্ছিন্ন
হয়ে যাওয়া হলো পাপ । তাছাড়া নিজের একাকীত্ব, নিজের কাছে নিজে বন্দী থাকা, নিজের ভগ্নদশা এবং বিপর্যয়, ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন না থাকাটাও পাপ ।
ঐশতত্ত্ববিদ বি. হেয়ারিং-এর মতে, পাপ হলো নিজে থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, নিজের মান-মর্যাদা নষ্ট করা, অন্যের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে হতাশা প্রকাশ ও বাধা সৃষ্টি করা। মানুষের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ক্ষমতা জন্মলগ্ন থেকেই তাকে দেওয়া হয়েছে, যাতে সে তার সৃষ্টিকর্তা, প্রতিবেশী এবং পৃথিবীর সাথে ভালোবাসার একটি খাঁটি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং তাদের সাথে একাত্ম হতে পারে । ভালোবাসার এই সম্পর্ক স্থাপন করতে অস্বীকার করা বা আগ্রহ প্রকাশ না করাই হলো পাপ ।
পাপের পরিণতি
পবিত্র বাইবেলের আদি পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা লক্ষ করি যে, ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে পাপ করার ফলে আদম ও হবা শাস্তি পেয়েছিলেন এবং স্বর্গীয় সুখের এদেন উদ্যান থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন । নোয়ার সময় মানুষ যখন পাপ বা মন্দ কাজে নিয়োজিত হলো, তখন ঈশ্বর মহাজলপ্লাবন দিয়ে তাদের সবাইকে ধ্বংস করলেন (আদিপুস্তক ৭ম অধ্যায়) । পবিত্র বাইবেলের দ্বিতীয় রাজাবলি গ্রন্থে আমরা লক্ষ করি যে, ঈশ্বরের মনোনীত ইস্রায়েল জাতি যখন একমাত্র সত্য ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে অন্য জাতির দেবদেবীর পূজা-অর্চনা শুরু করল, তখন তারা শত্রুদের হাতে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাদের দাসত্ব করল। এখানে আমরা পবিত্র বাইবেল থেকে আরও কিছু কাহিনী উল্লেখ করতে পারি যেখানে দেখতে পাব মানুষ তাদের পাপের ফলে শাস্তি পেয়েছিল।
আমরা এবার অসুস্থ ও ভগ্ন পৃথিবীর কিছু সাম্প্রতিক কাহিনী শুনব। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর একজন বিদেশি স্বেচ্ছাসেবীর অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরা হলো ।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর একজন বিদেশি কলেজ শিক্ষক তার কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে বাংলাদেশে আসেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার জন্যে । তারা দল বেঁধে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় চলে গেলেন । সেখানে তারা দেখতে পেলেন যুদ্ধে চরম ক্ষতিগ্রস্ত দালান কোঠা, হাসপাতাল, ভঙ্গা রাস্তাঘাট, আগুনে পোড়া গ্রামের ঘরবাড়ি, প্রায় জনশূন্য গ্রাম, মাঠ ও প্রান্তর । তারা আরো দেখতে পেলেন যুদ্ধে আহত অনেক মানুষ, অনেক অবিবাহিত নারী, অনেক এতিম শিশু, অনেক সন্তানহারা মাতাপিতা, স্বামীহারা মহিলা । দেশের সর্বত্রই যেন এক জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ, চারিদিকে ব্যথা বেদনা, বঞ্চনা, দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের করুণ চিত্র যা একদল মানুষের লোভ লালসা, চরম ঘৃণা ও যুদ্ধের বিভীষিকার ফল ।
বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার পাশাপাশি ঐ স্বেচ্ছাসেবীও তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই দুঃখ কষ্টে ভারাক্রান্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারা লোকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের দুঃখকষ্ট সরেজমিনে দেখতে লাগলেন; যুদ্ধে পোড়ানো বাড়িঘরগুলো নতুন করে তৈরি করতে লাগলেন, গ্রামের অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্যে অস্থায়ী চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র গড়ে তুললেন, পানীয় জলের জন্যে গ্রামে নলকূপ স্থাপন করলেন। তারা ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখাতে লাগলেন এবং গ্রামের কৃষকদের কৃষিকাজে সাহায্য দিতে শুরু করলেন ।
ধীরে ধীরে কয়েক মাসের মধ্যেই গ্রামে একটা পরিবর্তনের চিহ্ন দেখা গেল । হতাশা ও বেদনাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে একটা আশা জেগে উঠল । জীবন যাত্রা পরিবর্তনের দৃশ্যগুলো স্পষ্টই দৃশ্যমান হলো । তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো, পোশাক-আশাক পরিধানে আরো মার্জিত হলো ও শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রহ বৃদ্ধি পেল । ফলে দেখা গেল, অনেক ছেলেমেয়ে সুন্দর পোশাক আর স্কুল-ব্যাগ নিয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে স্কুলে যেতে শুরু করল । গ্রামের সবার মুখে হাসি ফুটে উঠতে শুরু করল । তাদের হৃদয়-মন এক নতুন উৎসাহ- উদ্দীপনায় ভরে উঠল ।
বিশ্বের ক্ষত বিক্ষত অবস্থা
সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা একই ধরনের একটি ক্ষত-বিক্ষত ও ভগ্ন পৃথিবী দেখতে পাই:
এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং সারা বিশ্ব জগতে মন্দতা আমাদের ঘিরে রয়েছে । ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর কেউ মন্দের এই প্রভাব ও ছোবল থেকে মুক্ত নয় । কী করে আমরা এসব মন্দতা বা পাপের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবো এবং সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপন করব?
বর্তমান বিশ্বের অশান্তি পাপময় চিত্র
যুদ্ধ মানেই পাপ । কারো না কারো পাপের জন্যে যুদ্ধ শুরু হয় । যুদ্ধে কত মানুষ, জীবজন্তু মারা যায়, কত বাড়িঘর, জানমাল, ধনসম্পদ, প্রতিষ্ঠান, জনপদ, গাছপালা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর্থিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়,
নানা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয় । শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেড় কোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছিল । জাপানের হিরোসিমা-নাগাসাকি শহর দুইটিতে আমেরিকার আনবিক বোমার আঘাতে হাজার হাজার মানুষ করুণ মৃত্যুবরণ করে এবং আরও বহু মানুষ আণবিক বোমার বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়ায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করে আসছে ।
তাছাড়া বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মুষ্টিমেয় ধনী লোকের (শতকরা ১০জন) লাগামহীন সম্পত্তি লিপ্সার কারণে কোটি কোটি লোক সর্বহারা হচ্ছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, শহরের বস্তিতে রাস্তার ফুটপাতে অমানবিক জীবনযাপন করছে অগণিত মানুষ, গরিব মানুষের সংখ্যা আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে চলছে । দারিদ্র্যের কষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশু ঘৃণ্য ও পাপময় পতিতা বৃত্তিতে নিয়োজিত হচ্ছে । শক্তিশালী ও ধনশালীদের অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হচ্ছে অগণিত মানুষ । গণপ্রচার মাধ্যমগুলো এবং আকাশ-সংস্কৃতির নৈতিকতাহীন প্রচারের ফলে অনৈতিক জীবন যাপন, যেমন: অবৈধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহ-বিচ্ছেদ, পিতৃ-মাতৃ-পরিচয়হীন এতিম শিশু, পারিবারিক ভাঙ্গন, অসহায় ও পরিত্যক্ত বৃদ্ধ পিতামাতা, ভ্রুণ হত্যা, মানব পাচার, ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে । পৃথিবীর গাছপালা, নদীনালা ও পাহাড়-পর্বত তথা প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচার অবিচারের ফলে বন্যা, পাহাড় ধ্বস, নদীনালার মৃত্যু, নদী-সাগরের জল বিষাক্ত হওয়া, বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তি, বায়ু দূষণ, আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া, সবুজ ভূমি মরুভূমিতে রূপান্তর ইত্যাদি পাপময় অবস্থা বা মন্দতা মারাত্মক আকার ধারণ করছে ।
নিরাময়কারী খ্রিষ্ট
আমরা যখন পাপ করি তখন আমাদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। যার সুস্থ-সুন্দর বিবেক আছে, তার মধ্যে এই উপলব্ধি নিশ্চিতভাবে হবেই । কিন্তু যে ব্যক্তি তার বিবেককে হত্যা করে এর কন্ঠকে রোধ করে দিয়েছে, সে শত পাপ অন্যায় করলেও তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা অনুতাপ আসে না । ঈশ্বরের সাথে মিলন হলো মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য । পাপ করার ফলে মানুষ তার সেই অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যূত হয় এবং ঈশ্বরের মহান ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় । একই সাথে পাপের কারণে সে নিজের অন্তর থেকে, অপরের কাছ থেকে এবং অন্য সব সৃষ্টি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ।
মহান ঈশ্বর কিন্তু পাপী ও দুর্বল মানুষকে কখনো দূরে ঠেলে দেন না । পবিত্র বাইবেল আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, পাপী দুর্বল মানুষকে উদ্ধার করতে করুণাময় ও প্রেমময় ঈশ্বর নিজেই হাত বাড়িয়ে দেন । তাই আদম হবা যখন পাপ করে নিজেদেরকে ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন এবং লুকিয়ে রইলেন, তখন ঈশ্বর নিজেই তাদের খুঁজলেন এবং পৃথিবীতে তাদের জীবন ও বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্যে একজন ত্রাণকর্তাকে পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন । ঈশ্বর তাঁর পুত্র যীশুকে পাঠালেন সেই প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তারূপে । যীশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করে পাপের শক্তিকে নির্মূল করেছেন ও ক্রুশীয় মৃত্যুর গুণে পতিত মানুষকে ঈশ্বরের কাছে ফিরিয়ে এনেছেন (এফিসীয় ২: ১৬) । তাই যোহন তাঁর মঙ্গলসমাচারের শুরুতেই উল্লেখ করেন যে, মানুষের পাপের অন্ধকারে যীশু আসেন তাদের জীবনকে আলোকিত করতে। পাপের অন্ধকারেই আলোর উদ্ভাস । যেন যে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে, তার যেন বিনাশ না হয়, বরং সে যেন লাভ করে শাশ্বত জীবন ৷
যীশু হলেন ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সেতু বন্ধন । তিনি এই জগতে এসেছেন মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলিত করতে, মানুষকে তার ভগ্ন দৈন্য দশা থেকে সুস্থ করে তুলে সমগ্র মানবজাতি ও সৃষ্টির সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে । যীশু তাঁর প্রকাশ্য প্রচার জীবনকালে তাঁর ত্রি-বিধ কর্মধারা তথা: প্রচার, শিক্ষাদান, এবং নিরাময়করণ-এর মধ্যে দুর্বল ও পাপী মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মহান ভালোবাসা ও অপার দয়ার কথাই প্রচার করে গেছেন । খ্রিষ্ট যীশু নিজে সমস্ত মন্দতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর শক্তিতে পাপের শক্তিকে পরাজিত করেছেন । অসুস্থদের সুস্থ করে যীশু প্রকাশ করেছেন যে তিনি মানুষকে দেহ, মন ও আত্মায় সুস্থ করতে চান যেন মানুষ পিতা ঈশ্বরের পূর্ণ সন্তান হতে পারে । অসুস্থতা মানুষকে দুর্বলতা ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় । পিতা ঈশ্বর যীশুকে পাঠালেন মানুষকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে পরিপুর্ণ রূপে জীবন দিতে । তাই যীশু বলেন, “আমি এসেছি, যাতে মানুষ জীবন লাভ করে এবং পরিপূর্ণভাবেই তা লাভ করে” (যোহন ১০: ১০খ)।
পুনর্মিলন সাক্রামেন্ত
বাংলায় ‘সংস্কার’ কথাটির অর্থ হলো মেরামত করা, সংশোধন করা । আমাদের দেহ-মন-আত্মার অসুস্থতা বা মন্দতার অবস্থা সারিয়ে তোলার জন্যে খ্রিষ্ট-মণ্ডলীতে সংস্কারীয় (সাক্রামেন্তীয়) ব্যবস্থা রয়েছে । যীশু তাঁর পুনর্মিলন ক্ষমতা ও নিরাময়কারী ক্ষমতা তাঁর শিষ্যদের সাথে সহভাগিতা করেছেন (লুক ৯: ১,২,৬)। তিনি তাঁর মুক্তিদায়ী ও নিরাময়কারী কাজসমূহ খ্রিষ্টমণ্ডলীর সাক্রামেন্তের মধ্য দিয়ে সম্পাদন করে চলেছেন ।
অনুতাপ ও পুর্নমিলন (পাপস্বীকার) সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পাপের ক্ষমা লাভ করি । রোগীলেপন সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা অসুস্থতা থেকে নিরাময় লাভ করি । আর পবিত্র খ্রিষ্টযাগ (প্রভুর ভোজ)-এর মধ্য দিয়ে যীশু নিজেকে আমাদের জীবনের পরম খাদ্যরূপে দান করেছেন, যেন আমরা দেহ-মন-আত্মায় পূর্ণ সুস্থ-সবল ও সজীব থাকি । পবিত্র খ্রিষ্টযাগ ও মণ্ডলীর মাধ্যমে তিনি তাঁর বাক্য, দেহ ও রক্ত দিয়ে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত মানুষের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মিটান এবং তাদেরকে নতুন জীবন দান করেন ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. অসুস্থতা মানব জীবনের কী নষ্ট করে ?
ক. নিঃসঙ্গতা
খ. একাগ্রতা
গ. সহভাগিতা
ঘ. আন্তরিকতা
২. মানুষ সব সৃষ্টি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে
i. পাপের কারণে
ii. দুর্বলতার কারণে
iii. সহিংসতার কারণে
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
জিম ও জেরী এক সঙ্গে খেলা করার সময় একটি ঘড়ি দেখতে পেল। জিম ঘড়িটি দেখে তাড়াতাড়ি তার পকেটে ঢুকালো । জেরী বলল, ‘অন্যের জিনিস নেওয়া ঠিক নয় । ওটা তুমি রেখে দাও ।’
৩. জেরী কী ধরনের পাপ থেকে জিমকে বিরত থাকতে বলেছে ?
ক. চুরি করা
খ. লোভ করা
গ. হিংসা করা
ঘ. মিথ্যা কথা বলা
৪. জিমের পাপের ফলে যে অবক্ষয় হচ্ছে, তা হলো -
ক. দৈহিক
খ. সামাজিক
গ. নৈতিক
ঘ. অর্থনৈতিক
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. পাপ বলতে কী বোঝায় ? ব্যাখ্যা দাও ।
২. পাপের ফলে বিশ্ব কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ? ব্যাখ্যা দাও ।
৩. পাপের পরিণতি কী হতে পার ? ব্যাখ্যা দাও ।
৪. পাপ থেকে বিরত থাকতে হবে কীভাবে ?
৫. আমাদের দুর্বলতায় ঈশ্বর কীভাবে আমাদের শক্তি দেন ?
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. সাইমন খুই দরিদ্র পরিবারের সন্তান । পিতার রেখে যাওয়া পৈত্রিক ভিটা ছাড়া তার আর কিছুই নেই । পাশের বাড়ির জমিদার রঞ্জন বাবুর কাছ থেকে জমি চাষ করার জন্য টাকা ধার নেয় সে । কিন্তু তার অজ্ঞতা ও অশিক্ষার কারণে রঞ্জন বাবু টিপসই নিয়ে সে পৈত্রিক ভিটাটুকুও নিয়ে যায় । সাইমন তা বুঝতে পারে না । একদিন জমিদার এসে তাকে বলেন, 'তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও । এটা আমার বাড়ি।' সাইমন বলে, ‘আমার বাড়ি ছাড়ব কেন?' জমিদার উত্তর দেয়, ‘এই যে কাগজে লেখা ও তোমার টিপসই । তুমিই এটা লিখে দিয়েছ ।' সাইমনের হঠাৎ মনে পড়ে গেল টাকা ধার নেওয়ার কথা ।
ক. পাপ কী ?
খ. নিরাময়কারী যীশু এ জগতে এসেছেন কেন ?
গ. রঞ্জন বাবুর কাজের মাধ্যমে কী প্রকাশ পায় ?
ঘ. রঞ্জন বাবুর কাজের পরিণতি কী হতে পারে ? তা বিশ্লেষণ কর ।
দীনা মেধাবী তবে চঞ্চল প্রকৃতির । তার চঞ্চলতায় রয়েছে ছলনা। দুষ্টামির ছলে মিথ্যা কথা বলে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে । এমনকি ফাদারের নামে মিথ্যা কথা বলে । সহপাঠীরা ফাদারের কাছে সব কথা বলে এবং মণ্ডলীর সদস্য পদ বাতিল করার আবেদন করে । ফাদার দীনাকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত রেখে অনেক বোঝায়, ঈশ্বরের বাণী শোনায়, ঈশ্বরের মহান ভালোবাসা ও অপার দয়ার কথা বলে । পরামর্শ দেন, প্রার্থনা কর যেন যীশু তোমাকে বোঝার শক্তি দেন । ফাদার তাকে ক্ষমা করে নতুন জীবনের সন্ধান দেখান ।
ক. বাংলার সংস্কার কথাটির অর্থ কী ?
খ. খ্রিষ্টযোগ বলতে কী বোঝায় ? ব্যাখ্যা দাও ।
গ. কার অনুপ্রেরণায় ফাদার দীনাকে কাছে টেনে নিয়েছেন ? বর্ণনা দাও ।
ঘ. ফাদারের অনুপ্রেরণায় দীনা শাশ্বত জীবন পেয়েছে বলে কি তুমি মনে কর ? মূল্যায়ন কর ।
আরও দেখুন...