বাতাস উঠলে এখন টাঙনের পানিতে কাঁপন লাগে না । পানি এখন অনেক নিচে। বালি কেটে কেটে ভারি ধীর স্রোতে এখন শীতের টাঙন বয়ে যায়। পানির তলায় বালি চিকমিক করে, কোথাও কোথাও সবুজ গুল্ম স্রোতের ভেতরে ভাটির দিকে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ ফেরে। চতুর দু-একটা মাছ তির তির করে উজানে ছুটে গেলেও আবার ভাটিতে ফিরে আসে। কিন্তু কাঁপে না পানির স্রোত। এমনকি সাঁকোর ওপর দিয়ে চিনি কলের ভারী আখ-বওয়া ট্রাকগুলো যাবার সময়ও না। সাঁকোর থামগুলো গুম গুম শব্দ করে ওঠে, কিন্তু পানির স্রোত তেমনি ধীর, তেমনি শান্ত। আসমান, কান্দর আর দিগন্তজুড়ে যে শীতের একটা শান্ত ভাব থাকবার কথা সেই ভাবটা টাঙনের স্রোতে আজকাল সব সময় ধরা থাকে।
আর ঐ শান্ত নদীর ধারে বসে থাকবার জন্যেই কিনা কে জানে কপিলদাস ভারি আরামে রোদের দিকে পিঠ মেলে দিয়ে ঝিমোতে পারে । তার চারদিকে নানা শব্দ কিন্তু সে সব তার কানে ঢোকে কি না বোঝা মুশকিল। ধরো, কী রকম গাঁ গাঁ চিৎকার করতে করতে চিনি কলের ট্রাকগুলো ছুটছে, ফার্মের ভেতরে বিনোদ মিস্তিরি খান-দুই ট্রাক্টর ট্রায়ালের জন্য চালু করে রেখেছে—তার ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ শব্দ একটানা সকাল দুপুর রাত ধরে ক্রমাগত হয়ে চলেছে, নদীর ওপারে আবার কোথায় এক রাখাল সারাদিন ধরে একটা বুনো সুর বাঁশিতে বাজিয়ে যাচ্ছে-এ সবই তার কানে ঢুকবার কথা। কিন্তু কপিলদাস চুপচাপ। মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে অল্প-স্বল্প দুলছে, আর সে বসে রয়েছে তো বসেই রয়েছে।
ওদিকে ছাগল ঢুকে যদি সজি ক্ষেত তছনছ করে, কি বিন্দা মাঝির বউ সোনামুখী নগেন হোরোর বোন সিলভীর সঙ্গে ঝগড়া বাধায় কিংবা নদীর ওপারে খোলা কান্দরে খরগোশ তাড়িয়ে নিয়ে আসে কোনো ভিন গাঁয়ের কুকুর এবং সেজন্যে যদি এপারের বাচ্চারা লে লে হই হই করেও ওঠে—কপিলদাস নড়বে না, হেলবে না, কান পাতবে না—কাউকে একটা কথা জিজ্ঞেসও করবে না ।
আসলে কপিলদাস বুড়োর কাছে সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো বলে মনে হয়। মনে হয়, এরকমই হয়ে আসছে দুনিয়ায়। ঝগড়া বলো, ঝাঁটি বলো, জন্ম বলো, মরণ বলো—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো। কত দেখল সে জীবনে। সব কিছুই শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় গিয়ে মিলে যায়। রাগ বল, ক্ষোভ বল, আবার হাসিখুশি মনের ভাব বল, কিংবা সামনে প্রকাণ্ড কান্দর, কি কান্দরের ওপরকার আসমান, আবার তার নিচে টাঙনের স্রোত—সব কিছু, যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা শোনা যাচ্ছে—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা শেষ পর্যন্ত মেলানো। আসলে, তার মনে হয়, সংসারের অনেক ভেতরে শান্ত ধীর এবং নিরবচ্ছিন্ন একটা স্রোত আছে। সব কিছুর ওপর দিয়ে ঐ স্রোত বয়ে যায়। সেখানে কাঁপন নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। সব কিছু সেখানে ক্রমাগত একটার সঙ্গে আরেকটা মিলে যাচ্ছে।
ঠিক এই ধরনের একটা গা-ছাড়া পরিতৃপ্ত ভাব আজকাল তাকে প্রায়ই পেয়ে বসে। আর সেজন্যেই শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ভারি আরামে সে ঝিমোতে পারে। বয়স বেড়ে গেলে সম্ভবত মানুষের এরকম একটা অবস্থা এসে যায় ।
তবে সব সময় ঐ ভাবটা থাকে না ।
আর তখনই পুরনো ঘটনা ছবির পর ছবি সাজিয়ে নিয়ে আসে চোখের সামনে। পুশনা পরবে কি তুমুল নাচ জুড়েছে দেখো কপিলদাস। তার গলায় বাঁধা মান্দল কী রকম শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, মেয়েদের গলায় কেমন শানানো স্বর । কপিলদাস দেখতে দেখতে নিজের যৌবনকালে চলে যায়। একের পর এক ঘটনা মনে পড়তে থাকে তার । আর ঐ রকমভাবে স্মৃতি তার সামনে পুরনো পসরা খুলে বসলে সে ভারি সুখে ঐসব পুরনো ঘটনার মধ্যে বিচরণ করে ফেরে।
একবার সেই যে কি হলো, মহাজনের ধান খামার বাড়ি থেকেই কিষানদের হাতে বিলিয়ে দিলি—মনে আছে সে কথা?
আর মানুয়েল পাদ্রিকে টাঙনের পানিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলি? মনে নাই?
চকিতে সে দেখতে পায় বর্ষায় ভরা টাঙনের পানিতে পাদ্রি তলিয়ে গেল। ঘোলাটে পানির মধ্যে কালো জুতোসুদ্ধ তার পা দুখানি ওপরে উৎক্ষিপ্ত হতে দেখা গেল স্পষ্ট করে। একটু পরই মানুয়েল পাদ্রি আবার ভেসে উঠেছিল। আর সে কি গাল! সাঁতরাতে সাঁতরাতে শাসাচ্ছিল, দেখিস তোর বাপকে বলব, দেখব বিচার হয় কি
না।
সেই ছেলেবেলার কথা। হাপন ছিল যখন সে। তোর তির কী রকম নিখুঁত নিশানায় গিয়ে বিধত, কপিলদাস মনে নাই সে কথা?
হ্যাঁ মনে আছে। কপিলদাস মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজেকে শোনায়—সব মনে আছে ।
কেন মনে থাকবে না । সান্তালের বাচ্চা না সে? দেখ তো খরগোশের পেছনে কে ছুটছে অমন? শুকদেবের ব্যাটা চতুর মাঝি নাকি দিবোদাসের ব্যাটা কপিলদাস? আর ঐ দেখ, কপিলদাসের শিকারি কুকুর কী রকম ছুটে যাচ্ছে তির-খাওয়া শিকারের পেছনে। কপিলদাস মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায় তার কালো রঙের কুকুরটাকে যেটা তার কিশোরকালের সঙ্গী ছিল সর্বক্ষণ। কুকুরটাকে শেষ পর্যন্ত বাঘে খেল ।
কপিলদাস একেক দিন আবার নিজের কাছে গল্প ফাঁদে । দূর থেকে দেখা যায় বুড়ো থেকে থেকে মাথা নাড়াচ্ছে আর ঝুঁকে ঝুঁকে দুলছে। কোন গল্পটা আরম্ভ করবে সে? বাহ্ গল্পের কি আর শেষ আছে—নিজেকেই শোনায় বুড়ো। ধরো, মেলার সেই ঘটনাটা—
মেলার গল্পটাই হঠাৎ মাঝখান থেকে শুরু হয়ে যায়। কেন যে বেছে বেছে মেলার গল্পটাই শুরু হয়—সে এক আশ্চর্য ব্যাপার । গল্প আরম্ভ করলেই সে মেলার ঘটনায় চলে আসে । কিংবা ঐ ধান কাটার ব্যাপারটাই ধরো না কেন। আধিয়ার জোতদারের মাঝখানে পড়ে গেল সাঁওতাল বস্তিটা। গুপীনাথ হুঁ হ্যাঁ করে না, ডাইনে-বাঁয়ে তাকায় না। ওদিকে কে একজন আগুনের কুণ্ডলীর ওপরে আরেক বোঝা নাড়া চাপিয়ে দিয়ে গেল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আর ঐ আগুনের আলোয় গুপীনাথের কপাল চকচক করতে লাগল । কিন্তু সে শাদা চুল ভর্তি মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে তো বসেই আছে ।
সাঁওতালদের তখন কি মুশকিল ভাবো দেখি। মহাজন বসত করবার জায়গা দেয়, আবাদের জমি দেয়, গিরস্তির কাজ দেয়—সেই মহাজনের বিপক্ষে কেমন করে যায়। মহাজন যে সব দেয়। হ্যাঁ, সব দেয়—কিন্তুক পেটের ভাতটা কি সারা বছর দেয়, আঁ? কহ মড়ল, কহ দে, দেয় পেটের ভাতটা? এই রকমের সব বাদানুবাদ। কিন্তুক যদি ভিটেমাটি থেকে তুলে দেয় তাহলে? এই রকমের সব তর্কাতর্কি । ওদিকে গুপীনাথ কিছুই বলে না। মড়ল
হলে বোধ হয় ঐ অবস্থায় কিছু বলা যায় না। কিন্তুক তখন ভারি জাড় হে মড়ল। দেহ দলদল করে কাঁপছে। দূরে দূরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল-হামরা মাহাজনের সঙ্গে নাই, আধিয়ার কিষানের সঙ্গে হামরা।
কে বলেছিল কথাটা? মনে নেই এখন। সে নিজে হতে পারে, মোহন কিস্কু হতে পারে—কিংবা চতুর মাঝিও হতে
পারে। লোকটা যে কে ঠিক মনে নেই। কিন্তু কথাটা ঠিক মনে আছে। তারপর? কপিলদাস আর খেই ধরতে পারে না । বিচার সভার শেষ দৃশ্যটা স্মরণে আসে না। বরং হঠাৎ ধান কাটার দৃশ্যটা
মনের ভেতরে দেখতে পায় সে। কপিলদাস মাঠে নেমেছে, পাশের ক্ষেতে মোহন কিস্কুর বউ টরি-সারা কান্দরের
আর একটা মানুষ দেখা যায় না। ধান গাছের নোয়ানো পাতায়, শিষের গায়ে, তখনও রাতের হিম ফোঁটায়
ফোঁটায় জমে আছে। রোদের তাপ গায়ে লাগে কি লাগে না এমনি কুয়াশা ।
ঐ রকম গল্প বলতে বলতে বেলা ফুরিয়ে যায় এক সময়। রোদের তাপ কমে আসে। ঝাপসা চোখ দুটি মেলে সে তখন আসমানের ধূসর রঙ দেখে। একবার নদীর ভাটি থেকে উঠে আসা শঙ্খচিলের ডাকটাও শুনতে পায় । বাতাসে তখন শীতের কামড়। তার দুহাতের আঙুল ছেঁড়া কোটের বোতাম দুটি খুঁজতে থাকে ।
আর ঐ সময়ই তার চোখে পড়ে যায়। দেখে কজন লোক টাঙনের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাচ্ছে । লোকগুলোকে সে চিনতে চেষ্টা করে। ওখানে এই সময়ে কারা? অমন পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা-কে লোকটা? অনেকক্ষণ ধরে লোকটার নড়া-চড়ার ভঙ্গিটা লক্ষ করে। লক্ষ করতে করতেই মনে পড়ে কদিন আগেও বোধহয় ওদের এইভাবেই দেখেছে সে। ঠিক এইভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন বলাবলি করছিল। সে এক সময় চিনতে পারে। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা লোকটা ম্যানেজার মহাজন ছাড়া আর অন্য কেউ হতে পারে না । কিন্তু এমন সময় ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের কি কাজ? একবার মনে হয় জরিপ হচ্ছে বোধ হয়। একেক সময় ঐ রকম জমিজমার মাপামাপি চলে । ওরা কি জমিজমা মাপতে এসেছে? কই এ রকম কোনো খবর তো তার কানে আসেনি।
একটু পর আর দেখা যায় না কাউকে। দেখতে না পাওয়ায় কৌতূহলটাও আর থাকে না। কপিলদাস তখন গরুর পালের ঘরে ফেরা ঘুণ্টির আওয়াজ কান পেতে শোনে। ফার্মের গরুগুলোর গলায় নতুন ঘুণ্টি বাঁধা হয়েছে নিশ্চয়ই। আজকাল বোধহয় জয়হরির ছোট ছেলেটা ফার্মের গরু চরায়। জয়হরির কী যেন হয়েছিল? জয়হরির কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করে সে। আর ঠিক ঐ সময় কাছে এসে দাঁড়ায় সলিমউদ্দিন। এসেই ডাকে, বুঢ়া দাদা বাড়িত যাবো নাই?
হ্যাঁ যামু, সে জয়হরির কথা স্মরণ করতে না পেরে সলিমউদ্দিনের দিকে মনোযোগ দেয়। ছোঁড়া কোত্থেকে আসছে সেই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে উঠে দাঁড়ায়।
সলিমউদ্দিন তখন কুশিয়ার ক্ষেতে আজ কী কাণ্ডটা ঘটেছে সেই ঘটনার বর্ণনা আরম্ভ করে এবং ঐ আরম্ভের মুখেই সে জানিয়ে দেয়-বুঢ়া দাদা তুমার বস্তিটা আর এইঠে থাকবে নাই, ইবছর এইঠে ধানের আবাদ হবে। কথাটা কেন যে বলে ছোঁড়া বুড়ো ঠিক ধরতে পারে না। কিংবা এমনও হতে পারে যে তার বর্ণনাতেই বোধহয় প্রসঙ্গটা থাকে না ।
কপিলদাসের হঠাৎ খেয়াল হয় লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এখুনি না দেখল। মুহূর্তের মধ্যে কোথায়
উবে গেল অতোগুলো মানুষ ৷ নাকি সে দেখে নি! তার কেবলি মতিভ্রম হতে থাকে । ইদিকে সলিমউদ্দিনের সেই খামারবাড়ির ঘটনাটার বর্ণনা তখনো ফুরোয়নি।
আবার কথাটা নতুন করে বলতে হলো সলিমউদ্দিনকে। বলল, তুমার বসতটা ইবার উঠায় দিবে, এইঠে ইবছর
ট্রাকটর চলিবে।
কপিলদাস এবারও বুঝতে পারে না। তার নিজের হিসাব মেলে না । ট্রাকটর জমিতে চলবে, তাই চলে এসেছে এতকাল । মানুষের বসতের উপর দিয়ে ট্রাকটর চলতে যাবে কেন? ই কেমন কথা? সে অন্ধকারেই ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। বলে, ঠিক শুনিছিস তুই, কহ ঠিক শুনিছিস?
সলিমউদ্দিন এবার সত্যিই বিরক্ত হয়। বলে, মোর কথা বিশ্বাস না হয় আর কাহাকো পুছে দেখ । মুই ইবার
যাউ, তুই বুঢ়া মানুষ, তোর কিছু ফম থাকে না ।
কথাটা বলেই হঠাৎ ছোঁড়া চলে গেল ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপিলদাস মাথা নাড়ায়। আর নিজেকে শোনায়—না, ক্যানে পালাব। তার পা আপনা থেকে বাড়ির পথ ধরে। কোথায় পালাবে সে। এক সময় আবার হাসি পায় বুড়োর, পালাবার কথাটা এল কোত্থেকে? তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল—নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তখন সে বলে, তোর কিছু ফম থাকে না। আর ঐ সময় ট্রাকটরের আওয়াজটা তার কানে এসে ধাক্কা মারে । কী কারণে যে হঠাৎ ধকধক শব্দ করে জেগে উঠল ঘুমন্ত ট্রাকটরটা আন্দাজ করা মুশকিল। বিনোদ মিস্ত্রি একেকদিন এই রকম হঠাৎ ট্রাকটরের এঞ্জিন চালিয়ে দেয়। ট্রাকটরটা সে চোখের সামনে দেখতে পায় যেন। বিশাল বিশাল দুটো ঢাকা ঘুরতে ঘুরতে মাঠের বুকের ওপর দিয়ে চলেছে, পেছনের ধারালো চাকতিগুলো মাটি ফালা ফালা করে দিচ্ছে, গন্ধ বেরুচ্ছে কাটা মাটির ভেতর থেকে। ঐভাবে ট্রাকটরটা চলে আসে একেবারে দীনেশ কিস্কুর বাড়ির সীমানা পর্যন্ত। তারপরই বেশ দিব্যি ঘুরে যায়। বসতই হলো ট্রাকটর চলাফেরা করার শেষ সীমানা। হ্যাঁ, কলের জিনিস ঐ পর্যন্ত আসে। সংসারের সীমানা পর্যন্তই তার আসবার ক্ষমতা, তারপর আর পারে না, এতকাল অন্তত পারেনি। আর এখন সেই কলের জিনিস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে দীনেশ কিস্কুর উঠোনে। ঘরের দেয়ালে ভোঁতা নাক ঢুকিয়ে উল্টো দিকের দেয়াল ফুঁড়ে বেরুবে। দৃশ্যটাকে সে মনের ভেতর দেখতে পায় । আর তাই দেখে সে ভয়ানক অস্থিরতা বোধ করে। ই কী কথা আঁ? ট্রাকটর চলে আসবে সংসারের বুকের ওপর?
কপিলদাস বুড়োর এখন মনে পড়তে থাকে। এই বস্তি উঠে যাবার ব্যাপারটা আকস্মিক নয় একেবারে-তাহলেও, এই কি শেষ পর্যন্ত পরিণতি? বস্তিটস্তি উঠে যাবে আর ট্রাকটর চলতে থাকবে ঘরবাড়ি-ভিটেমাটির উপর দিয়ে। কোথায় একটা মেয়েমানুষের মাথা গরম করে মাতালের দিকে দা উঁচিয়ে তেড়ে যাবার ঘটনা আর কোথায় বাড়িঘর সংসারসুদ্ধ লোপাট করে দেওয়া। কিসের সঙ্গে কিসের জড়ানো। কিন্তু ভাবো তো বসতটা কত পুরনো? মনে আছে তোর, হ্যাঁ বাহে মড়লের ব্যাটা, তোর কি ফম আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ ফম আছে । বিচার বসেছিল ফার্মের অফিস ঘরে। কে একজন সাহেব মানুষ শুধোচ্ছিল। আর সে উত্তর দিচ্ছিল । কবে কোন প্রাচীনকালে এসেছিল একদল মানুষ । সেই দলের মড়ল ছিল শিবোনাথ । শিবোনাথ আবার গুণিন ছিল। কিন্তুক গুণিন হলেই কি সব হয়, আঁ? হয় কখনও? হয় না ।
ঐ পর্যন্ত বলার পর আর বলতে পারেনি—মহিন্দর ধমকে উঠেছিল। পরে জানিয়েছিল, তুই আর হামার সঙ্গে
আসিস না বাপ–তোর কথার কুনো ঠিক নাই। কুন কথাত তুই কুন কথা কহিস বুঝিস না ।
হ্যাঁ মড়ল তুই বুঢ়া মানুষ—তুই কিছু করিবা পারিস না। ঐ দিনই কে যেন বলেছিল কথাটা। কপিলদাস কথাটা নিজেকে শোনালো আরেকবার—তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল, তোর কিছু করার নাই। একবার নয়, ঘুরে ঘুরে কথাটা সে বলেই চলল। আর থেকে থেকে ভারি গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল কয়টা। আর ঐ দীর্ঘশ্বাস তাকে বার্ধক্যের অক্ষমতা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার দেরি হয়ে যায় । ততক্ষণে ঠাণ্ডায় পা দুখানি অসাড় হয়ে উঠেছে। উঠোনের আগুনের কাছে বসে বসে সে হাত-পা সেঁকে কিছুক্ষণ । মহিন্দরের বউ বিন্নী থালায় করে ভাত দিয়ে যায় । আগুনের তাতে ততক্ষণে আরাম লাগছে কপিলদাসের। ভাতের পাশে এক টুকরো পোড়া মাংস দেখতে পেয়ে সে খুশি হয়। নাতিদের শুধোয় কী শিকার পেয়েছিল তারা। মহিন্দরের ছেলে শিকারের গল্পটা আরম্ভ করে বোধহয়—কিন্তু তার গল্পের দিকে বুড়ো আর মনোযোগ দিতে পারে না ।
দাদা, বড় জঙ্গত নাকি বাঘ থাকে?
নাতির প্রশ্ন শুনে একটু সজাগ হতে হয় বুড়োকে। ঠিক মনে করতে পারে না । প্রাণনগরের জঙ্গলে কি বাঘ আছে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে। তারপর মাথা নাড়ায়, নাই রে–শুকদাস, ঐঠে বাঘটাগ নাই। কিন্তুক ছিল এক সময় । নাতিরা ঘন হয়ে বসে। কপিলদাস ভাত খাওয়ার কথা ভুলে যায় তখন। সে গল্প আরম্ভ করে ।
গল্প মানে তো নিজের কথা। সাঁওতাল কিশোর ছেলের যে ব্যাপারে সবচাইতে আকর্ষণ সেটাই সে ধীর স্বরে বর্ণনা করতে থাকে। তার কালো রঙের কুকুরটার কথা আসে। তার ঘরে খুঁজলে তিরের চোঙা দুটো এখনো পাওয়া যাবে—সেই চোঙায় বাছা বাছা তির জমানো থাকত। একবার তির দিয়ে একটা বাঘ গেঁথে ফেলেছিল। ভাগ্যিস সে তখনো বাঘ কী জিনিস জানত না। বনবিড়াল ভেবে নিশানা করে তির ছেড়ে দিয়েছে আর অমনি কী ডাক! ভয় পেয়ে পড়িমরি করে কী রকম দৌড়েছিল সেই ঘটনাটা সে বলে এবং বলবার সময় দৌড়ের বর্ণনাটাই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। বুড়ো মানুষের গুনগুন গুনগুন ধীর স্বরের একঘেঁয়েমিতে বিরক্তি লাগে বাচ্চাদের। শুকদাস অস্থির হয়ে ডাকে, দাদা বাঘটার কী হইল?
ও, হ্যাঁ, বাঘটা। কপিলদাসকে একটু ভেবে নিতে হয়। তির খেয়ে বিকট চিৎকার করে উঠবার পর বাঘটার যে কী হয়েছিল কোনোভাবেই মনে পড়তে চায় না। তখন গল্পটা সে বানাতে আরম্ভ করে। তার বর্ণনায় তখন কৌতুক আসে। বাঘের ল্যাজ ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসবার ব্যাপারটা সে রঙ চড়িয়ে বলতে চায়। কিন্তু বাঘটা টেনে নিয়ে আসবার সময় কি রকম কষ্ট হচ্ছিল সে কথাটাই ঘুরেফিরে বলতে থাকে সে।
শীতের রাত, ততক্ষণে সবারই ঘরে গিয়ে শোবার কথা । কিন্তু কেউ শুতে যাচ্ছে না সেটা সে লক্ষ্য করে। দেখে,
ইতিমধ্যে মহিন্দর, দীনদাস এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যাচ্ছে
কোনো শলাপরামর্শ হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা যে কী, কিছুই অনুমান করা যায় না ।
ও হ্যাঁ, বাঘটার যেন কী হয়েছিল? কপিলদাস কিশোর দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাজ ধরে টানবার প্রসঙ্গে ফিরে আসে। ঐ রকম যখন টেনে আনছিল তখনো কিন্তু বাঘটা বেঁচে ছিল—হ্যাঁ। ঘা খাওয়া বাঘ কিন্তু ভয়ংকর জিনিস।
এই পর্যন্ত বলে থামতে হয়। ঘা খাওয়া বাঘের ভয়ংকরতা কীভাবে বোঝাবে সেজন্যে তাকে ভাবতে হয়। আর ঐ সময় মহিন্দরদের কাছে একটি লোককে আসতে দেখে সে গল্পের কথা ভুলে যায় । উঠে গিয়ে দাঁড়ায় মহিন্দর আর দীনদাসের কাছে।
নিজের ছেলে মহিন্দর বিরক্ত হয়—বলে, তুই এখুন যা তো বাবা, বুঢ়া মানুষ তুই ইসবের কী বুঝিস ! কপিলদাস বুড়ো এবার সত্যিই দমে যায়। নিজের জন্ম দেয়া ছেলে যদি এই রকম করে বলে, তো সে কী করবে। তাকে পিছিয়ে আসতে হয়। হ! মড়ল তুই তো বুঢ়া মানুষ, তুই কিছু করিবা পারিস না। কথাটা ঘুরেফিরে কেউ যেন তার কানের কাছে বারবার করে বলতে থাকে। সে কিছুই করতে পারে না, তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মানুষের জটলাটা দেখে। ততক্ষণে জায়গাটা বেশ একটুখানি সমাবেশ মতো হয়ে উঠেছে। দেখে, দীনদাস হাত নেড়ে নেড়ে কী বলে চলেছে। তারপর আবার মহিন্দর আরম্ভ করল। তার কথা শেষ হতে না হতেই ওদিক থেকে আবার ভায়া মাঝি আরম্ভ করল।
ভারি ধীর নোয়ানো স্বর। শান্তভাবে পরামর্শ হচ্ছে যেন। রাগ নেই। জ্বালা নেই। কারো দুচোখ ধকধক করে জ্বলে উঠছে না, কেউ চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছে না। কপিলদাসের ভারি অবাক লাগে গোটা ব্যাপারটা দেখে। অবাক লাগে, কিন্তু কিছু বলে না সে। বরং নিজেকে সরিয়ে আনে। কয়েক পা পিছিয়ে আসে সে। কিন্তু ঐ কয়েক পা সরে আসতে অনেকটা সময় লেগে যায় তার। কানের কাছে তখনও সে শুনছে—তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল, তোর কিছুই করার নাই । যেখান থেকে উঠে এসেছিল সেইখানে সে ফিরে যায় । শুধুই যথাস্থানে ফিরে যাওয়া, শুধুই মেনে নেওয়া—তার কেবলই মনে হতে থাকে ।
বাচ্চারা লোকসমাগম দেখেই সম্ভবত উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে। মেয়ে-বউরা এখানে সেখানে ইতস্তত দাঁড়িয়ে। বাচ্চারা একত্র হলে যা হয়—ততক্ষণে খুনসুটি, দাপাদাপি এবং হাসাহাসি এইসব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। পাথরের ওপর ঘষে ঘষে তীরে শান দেওয়া তখনো হচ্ছে। মহিন্দরের ছেলে ডাকল, দাদা তারপর বাঘটার কী হইল?
ও, সেই গল্প। কপিলদাসের মনে পড়ে একটু আগে শিকারের গল্প বলতে বলতে সে উঠে গিয়েছিল। তখন
আগুনের আলো কিশোর মুখের ওপর চমকাচ্ছে, কে একজন কঞ্চি দিয়ে আগুনটা আরেকটুখানি উস্কে দিল ।
আর ঐ ঘটনার কারণেই কি না কে জানে, কপিলদাস গল্পটা আবার আরম্ভ করে দিল। হ্যাঁ, বাঘটার ল্যাজ ধরে
টানতে টানতে আসছিল সে। ভারী ওজন হয় বাঘের। আর বাঘটা ওদিকে তখনও কিন্তু মরেনি। নাহ্, বাঘটা
বোধহয় মরেই গিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ে ।
কপিলদাস সৎ হয়ে উঠতে চায় বাচ্চাদের কাছে। গল্প বানানো বাদ দেয়। তার স্পষ্ট মনে পড়ে তখন । বাঘটার গায়ে বিকট গন্ধ ছিল, তিরটা ঠিক বুকের মাঝখানে গিয়ে গেঁথেছিল, একেবারে এদিক থেকে ওদিক বেরিয়ে গিয়েছিল। রক্ত তখনও বেরুচ্ছিল গলগল করে। আর ঐ সময়, বিকেল বেলায়, প্রাণনগরের জঙ্গলের ধারে একটা লোক ছিল না চারদিকে কোথাও । সে চিৎকার করে বাবাকে ডাকছিল, বন্ধুদের ডাকছিল । আর ঠিক তখন হঠাৎ তার পাশের ঝোঁপ থেকে কি একটা জানোয়ার লাফ দিয়ে বেরিয়েই বাঁয়ে ছুটতে শুরু করে দিল। ঐ জানোয়ারটা দেখেই সে—
এ পর্যন্ত বলেই সে থামে। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাবে বলে ইতস্তত করে। আহা কেমন করে বলবে যে
শেয়াল দেখে সে ভয়ানক ভয় পেয়ে পালিয়েছিল। তারপর, তারপর কী হইল? বাচ্চারা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলে সে হঠাৎ হেসে ওঠে।
কপিলদাস তখন নিজের আলাদা অস্তিত্ব আর অনুভব করতে পারে না। তীরে শান দেবার সময় কী রকম করে পাথরের ওপর ঘষতে হয়—তাই দেখায়। একজনের হাত থেকে বাঁশিটা টেনে নিয়ে ফুঁ দিয়ে একটা বহু পুরনো সুর বাজায় । কী বাজালো আঁ, কী বাজালো দাদা? প্রশ্ন হলে সে ভাঙা ভাঙা গলায় গানটা গায়
ফকির বুলে ঢুলুক বাজে
ভালুক নাচে ঝাম,
হাইয়ারে হালমাল কই গেলু রে-এ-এ।
গানটি শুনে বাচ্চারাও গাইতে শুরু করে দেয়।
বুড়োর ভীমরতি হয়েছে ভেবে মেয়েরা কেউ কেউ মনোযোগ দেয় বাচ্চাদের জটলার দিকে। বড়রা যেখানে সভা বসিয়েছে সেখান থেকেও কে একজন চিৎকার করে গোলমাল বন্ধ করতে বলে। কিন্তু বাচ্চাদের থামাবে কে? মহিন্দরের ছেলে ধনুকের জন্যে বাঁশের ছিলা তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। কপিলদাস তার হাত থেকে কেড়ে নিলো ধনুকটা। বলল, দেখ, কেমন করে ছিলা পরাতে হয় ধনুকে।
বাচ্চারা তখন ঘিরে দাঁড়ায় বুড়োর চারদিকে। কপিলদাস হাঁটু ভেঙে ধনুকের এক মাথা ধরে ঝুলে পড়ে ধনুকটা নোয়ায়। তারপর বাঁ হাতে ছিলার ফাঁসটা ধনুকের মাথায় ঢোকাতে চায়। কিন্তু প্রথমবারেই পারে না।
ডান হাতটা তার ভীষণভাবে কাঁপতে থাকে। বাচ্চারা বুড়োর কাণ্ড দেখে সমস্বরে বলে, পারব নাই দাদা—তুই পারব নাই। কিন্তু পারে সে। ঐ কাঁপা কাঁপা হাতেই সে ছিলা পরিয়ে দেয় ধুনকের। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছিলা টেনে ধনুকের একটা টঙ্কার তোলে। ভারি সুন্দর টানটান আওয়াজ হয় তাতে। এরপরও বুড়ো থামে না। একটা শানানো তির নেয় হাতে এবং তিরটা ধনুকের ছিলায় বসিয়ে তাক করে। সামনের দিকে একবার, একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে । বুড়ো ভয় দেখিয়ে মস্করা করে যেন। বাচ্চারা তাতে হই হই করে ওঠে। আর ঐ রকম হই হই শুনেই সম্ভবত কপিলদাস তিরটা দু আঙুলের ফাঁকে চেপে ছিলা ধরে টানে । টেনে ধনুকের নিশানা করে অন্ধকারের দিকে । মহিন্দরের ছেলে বলে ওঠে, দাদা তিরটা ছুটে যাবে, দাদা মোর তিরটা ছুটে যাবে। কিন্তু কপিলদাস নাতির মিনতি শুনতে পায় কি না বোঝা যায় না। সে সত্যি সত্যি তিরটা ছেড়ে দেয়। আর বাতাস কাটা শব্দ করে তিরটা অন্ধকারের দিকে ছুটে যায়।
চারদিকে মানুষের বসত। মেয়েরা বুড়োরা কাণ্ড লক্ষ করে হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠে। সভার মানুষদের মধ্য থেকেও কয়েকজন এগিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে বুড়ো কপিলদাস আর একটা তির হাতে তুলে নিয়েছে। সবাই যখন নিষেধ করছে তখন সে দ্বিতীয় তিরটাও সামনের অন্ধকারের দিকে নিশানা করে ছুড়ে দিয়েছে। এবং ঐ কাণ্ড ঘটে যাওয়ায় ব্যাপারটা আর ছেলেমানুষি তামাসার পর্যায়ে থাকে না। দূর থেকে মহিন্দর চিৎকার করে ওঠে, বিন্নি গালাগাল করতে আরম্ভ করে। কিন্তু বুড়ো তখন হাসছে কেমন দেখো, যেন সে কিশোরকালে ফিরে গিয়েছে। জীবনে প্রথম নিশানা ভেদ করার যে খুশি—সেই খুশি পেয়ে বসেছে তাকে। সে শান দেয়া আরও একখানা তির হাতে তুলে নিয়েছে তখন। ওদিকে পেছন থেকে দীনদাস চিৎকার করে বলছে—ধর বুঢ়াটাকে, ধরে কাঢ়ে লে ধেনুকখান-সেই চিৎকার বুড়োর কানে পৌঁছায় না। কেউ পেছনে তাকে ধরতে আসছে কিনা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে কপিলদাস বুড়ো দুহাতে তির-ধনুক নিয়ে সামনের অন্ধকারের দিকে চলতে থাকে। বিমূঢ় মানুষজনের চোখের সামনে দিয়েই সে অনায়াসে অন্ধকার, গাছপালা, কৈশোর এবং আদিম উল্লাসের মধ্যে চলে যায়। আর সেখান থেকে সে তার তৃতীয় তিরটা সঠিক নিশানায় ছুড়বার জন্যে তৈরি হতে থাকে ।
[সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]
কথাসাহিত্যিক শওকত আলী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম খোরশেদ আলী সরদার এবং মায়ের নাম মোসাম্মত সালেমা খাতুন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরে। ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। অভাব অনটনের মধ্যেই চালিয়ে যান নিজের লেখাপড়া। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে এমএ পাস করেন। সাংবাদিকতা, শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন ধরনের পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর সর্বশেষ তিনি সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জীবনকে নিবিড়ভাবে অবলোকন করা এবং বিচিত্র জীবনপ্রবাহকে শিল্পাবয়ব প্রদান শওকত আলীর সাহিত্যভাবনার মূল প্রবণতা। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রচনায়। তিনি ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে এবং ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হন। শওকত আলীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : 'পিঙ্গল আকাশ', ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন', ‘উত্তরের ক্ষেপ’, ‘লেলিহান সাধ' প্রভৃতি । ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫এ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।
মুর্মু - সাঁওতাল গোত্রবিশেষ। মুর্মু শব্দের অর্থ নীল গাভি; যা এই গোত্রের গোত্র-চিহ্ন তথা টোটেম। কথিত আছে একবার এক অরণ্যভূমিতে কিছু লোক কাজ করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। একসময় তাদের সর্দার ঘুমিয়ে পড়ল। সেই বনে ছিল একটি হিংস্র নীল গাভি । গাভিটি এসে পায়ের চাপা দিয়ে সর্দারকে মেরে ফেলল । ঘুম থেকে উঠে লোকেরা তখন গাভিটিকে হত্যা করল । সেই থেকে মৃত ব্যক্তির গোত্রের নাম বা পদবি হলো মুর্মু। এই গোত্রের একাধিক উপগোত্রও রয়েছে।
টাঙন - পাহাড়ি জলাধারবিশেষ। এ গল্পে ঠাকুরগাঁও শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টাঙন নদী
বোঝানো হয়েছে।
কান্দর - খাত বা নিচু স্থান । সাধারণত খালের অংশবিশেষ ।
পুশনা পরব - বিশেষ পুজোর আয়োজন। পৌষ-সংক্রান্তিতে এই পুজো উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হয়।
হাপন - বালক ।
মান্দল - মাদল; এক ধরনের তালবাদ্য।
পসরা - পণ্যসম্ভার; বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত দ্রব্য।
ভাঁট - এক ধরনের বুনো ফুলবিশেষ ।
নাগরদোলা - ওপর থেকে নিচের দিকে ঘুরতে পারে এমন পাল্কির মতো। এতে ছোট ছোট খোপ থাকে। তাতে মানুষ বসে আর এই খোপগুলোকে যন্ত্রের সাহায্যে কিংবা হাত দিয়ে টেনে ওপর থেকে নিচে ঘুরিয়ে আনে।
জাড় - শীত, ঠান্ডা ৷
আধিয়ার - বর্গাদার। যারা একটি নির্দিষ্ট শর্তে অন্যের মালিকানাধীন জমিতে হাল চাষ করে এবং উৎপাদিত ফসলের অংশ শর্ত মোতাবেক মালিককে প্রদান করে।
জোতদার - ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার সূত্র ধরে কৃষকদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে এক মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তনি বা ইজারা নিত। এরাই জমির চাষ তদারকি এবং খাজনা আদায়ের কাজ করত। ফলে উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষক বহন করলেও ফসলের অর্ধেক চলে যেত জোতদারের হাতে ।
গিরস্তি - গৃহস্থ কাজ
মড়ল - মোড়ল । গোষ্ঠী প্রধান । নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
ঘুন্টি - ঘণ্টাবিশেষ । গবাদিপশুর গলায় পরানো হয় এমন ছোট ঘণ্টা ।
কুশিয়ার ক্ষেত - আখ ক্ষেত।
পুছে দেখ - জিজ্ঞেস করে দেখ ।
ফম থাকা - স্মরণ থাকা। মনে থাকা ।
আলোচ্য গল্পটি শওকত আলীর ‘লেলিহান সাধ' (১৯৭৭) গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে। কপিলদাস মুর্মু এক বৃদ্ধ সাঁওতাল । ভূমির অধিকার নিয়ে সাঁওতালদের রয়েছে রক্তে রঞ্জিত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। ভূমি তাদের অস্তিত্বেরই অপর নাম । তাই নিজেদের বসতবাটি থেকে উন্মূলিত হবার আশঙ্কা যখন তীব্রতর রূপ ধারণ করে । তখন বয়সের ভারে ঝিমিয়ে পড়া, অন্য সবার কাছে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মানুষ কপিলদাস অমিত সাহসে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ কাজ হিসেবে শেষ লড়াইটা লড়বার জন্য নিজেকে সে সময়ের হাতে তুলে দেয়। তরুণদের ভয় দ্বিধাকে অমূলক প্রমাণিত করে একাই সে আত্মত্যাগী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাটির কাছাকাছি থাকা এক প্রবীণের এই অনিঃশেষ সংগ্রামশীলতার নান্দনিক রূপায়ণ ঘটেছে এই গল্পে । সমগ্ৰ গল্পজুড়েই লেখক স্থবির দশায় আক্রান্ত কপিলদাসের অতীতের স্মৃতিকথা, বীরত্বগাথা- যার কতকটা সত্য কতকটা কল্পনা— এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। আর সেইসঙ্গে কপিলদাসের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন; যার মূল সুর হলো : ‘হা মড়ল তুই বুঢ়া মানুষ— তুই কিছু করিবা পারিস না।' এরূপ চিন্তার বিপ্রতীপে অবস্থিত কেবল শিশুরা। তাদের কাছে কপিলদাস এবং তার গল্প— দুয়েরই বিশেষ আকর্ষণ ও গুরুত্ব রয়েছে। এই উৎসাহ কপিলদাসকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সে তার বয়সকে অতিক্রম করে যায়; অনেকটা খেলার ছলেই জড়বৎ কপিলদাস আকস্মিকভাবে গতিপ্রাপ্ত হয়। তার হাতে উঠে আসে তির-ধনুক। একের পর এক তির তার হাত থেকে ছুটে যেতে থাকে শত্রুকে লক্ষ করে। কপিলদাস নিজে কেবল একটি চরিত্র থাকে না; হয়ে ওঠে জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের এক আপসহীন যোদ্ধা। কপিলদাসের আশ্রয়ে লেখক আমাদের জানিয়ে যান লড়াইয়ের কোনো বয়স নেই। উন্মূলিতপ্রায় মানুষগুলো কোনো কিছুর পরোয়া না করেই তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এই আশাবাদের দ্যোতনা জাগিয়ে গল্পকার রচনাটি সমাপ্ত করেন। সাঁওতালি কথনভঙ্গি, শব্দ যোজনা এবং যথোপযুক্ত প্রেক্ষাপট সৃজন এই রচনার শিল্পসাফল্যকে বহুগুণ বর্ধিত করেছে।
আরও দেখুন...