প্যারিসের এক রেস্তোরায় খাবার খেতে গিয়ে শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁর খাতার কাগজে এঁকে বুঝিয়ে ছিলেন তিনি কী কী জিনিস খাবেন। সিদ্ধ খাবেন না ভাজি-তাও এঁকে বুঝিয়ে দিলেন। মদ খাবেন না, সেটাও আঁকলেন। এভাবেই ইংরেজি না জানা হোটেল বয়কে তিনি খাবারের অর্ডার দিয়েছিলেন।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
মানুষ আদিকালের সেই গুহাজীবন থেকে শুরু করে কত দিক থেকে কতভাবে জয় করতে শিখল পৃথিবীকে। মানুষ কোথা থেকে শুরু করে আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে! শুধু প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক নিয়েই তো মানুষের চলবে না। মূল সমস্যা হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। আদিম মানুষ যখন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় জীবন ও জীবিকার জন্য সংগ্রাম করত এবং হিংস্র পশুদের আক্রমণের ভয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকত। মুক্তির উপায় হিসেবে জাদু বিশ্বাস নিয়ে পাহাড়ের গায়ে বিচিত্র আঁচড় কেটে ছবি এঁকে সংঘবদ্ধ হয়ে সেইসব প্রতিকূলতাকে জয় করেছে। কিন্তু কেন মানুষ ছবি এঁকেছিল? সেই রহস্যের কথা আমরা এখন জানব।
১৮৭৯ সালের কথা। স্পেনের উত্তরাঞ্চলে সাউটুলা নামে এক জমিদার বাস করতেন। তাঁর জমিদারি বেশ বড়ো। সেখানে ছিল অনেক পাহাড়। এখানে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন একটি গুহার। গুহার মধ্যে সন্ধান চালিয়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা এ খেয়ালের বশে একদিন খনন কাজ আরম্ভ করে দিলেন। ভাবলেন গুহার মধ্যে খুঁজে যদি সেই আদিম মানুষদের হাড়গোড় আর পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যায়। যথারীতি খুঁজতে শুরু করে দিলেন। সাথে তার পাঁচ বছরের ছোটো মেয়ে। সে অবশ্য অতসব বোঝে না। সে বেরুলো বাবার হাত ধরে একটুখানি ঘুরে আসতে।
গুহায় ঢুকে বাবা হাড়গোড় আর হাতিয়ার খুঁজতে লেগে গেলেন। কিন্তু ওইটুকু মেয়েটির এসব ব্যাপার ভালো লাগল না। সে একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে গুহার মধ্যে একটু-আধটু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল গুহাটার এক জায়গায়। আর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠল বাবা, ষাঁড়! ষাঁড়। মেয়ের চিৎকার শুনে বাবা ছুটে এলেন, ভাবলেন গুহার মধ্যে সত্যিই কি ষাঁড় বেরিয়েছে?
না। ঠিক ষাঁড় নয়। তবু ঠিক ষাঁড়ের মতোই। ষাঁড়ের ছবি। ছোটো এই মেয়েটির আবিষ্কারের কথা জানাজানি হয়ে গেল। বড়ো বড়ো পন্ডিতেরা ওই আলতামিরা গৃহায় গিয়ে হাজির। তারপর চলল প্রায় ষোলো বছর ধরে পন্ডিত মহলে ওই ষাঁড়ের ছবি নিয়ে এক তর্ক-বিতর্ক, গবেষণা। আদিম মানুষের আঁকা প্রথম যে ছবি আবিষ্কার হয়েছিল তার বয়স প্রায় বিশ হাজার বছর। স্পেনের আলতামিরা, ফ্রান্সের লামুতে এবং লাসকো পর্বতগুহায় পাওয়া গেছে এর অস্তিত্ব। জীবনযাপন ও জীবনধারণের তাগিদে তারা ছবি আঁকাও শিখেছে। তারা মনের ভাব প্রকাশ করেছে ইশারায়, বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে। এমন সময় ১৮৯৫-এ স্পেনে আবিষ্কার হলো আরও একটি গুহা। সেখানের গুহার দেয়ালে আবিষ্কৃত হলো তাদের অনেক আঁকা-জোকা। কারা আঁকল এসব ছবি? নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন যুগের মানুষেরা। সেই আদিম মানুষেরাই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রথম ছবির ব্যবহার শুরু করেছিল।
ফ্রান্স, স্পেন, উত্তর-আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের আরও অনেক আদিম মানুষের আঁকা গুহাচিত্র পাওয়া গিয়েছে। আর পণ্ডিতেরা আনুমানিক হিসেব করে বলেছেন কোনো কোনো ছবির বয়স খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ পর্যন্ত হওয়া সম্ভব।
এই গল্পটির মধ্য থেকে আমরা জানতে পারলাম ভাব প্রকাশের প্রথম বাহন হিসেবে আদিম মানুষ ছবিকেই বেছে নিয়েছিল।
আজকের পৃথিবীর বুকে নানান দেশ, নানান দেশে নানান ধরনের মানুষ আবার তাদের ভাষাও ভিন্ন ভিন্ন। একজন মানুষের পক্ষে কখনো জানা সম্ভব হয়ে উঠে না ঐসব ভাষা। কিন্তু সেই দেশের জীবন, পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে যদি কোনো ছবি আঁকা হয় তাহলে অতি সহজেই সেই ছবি দেখে সেই দেশ সম্পর্কে জানা যাবে।
মনে কর আমাদের দেশে কোনো উৎসব উপলক্ষে জাপান, চীনসহ আরও অনেক দেশের শিশুরা সমবেত হয়েছে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়ত আমরা সবাই সবার সাথে করতে পারব। কিন্তু নিজ নিজ দেশের পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, জীবনযাপন, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো যদি আমরা নিজ নিজ ভাষায় ব্যক্ত করি তাহলে ভাষা না জানার কারণে তা জানতে পারব না। যদি আমরা নিজের দেশের পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবন ও সংস্কৃতির বিষয়ে ছবি আঁকি তাহলে সেই ছবির বর্ণনার মাঝে আমরা প্রতিটি দেশের সার্বিক একটা চিত্র প্রত্যেকের ছবির মাঝে ফুটে উঠবে সেই দেশের পরিচয় ও জীবনধারা।
তাই একমাত্র ছবি বা চিত্রকলার ভাষা দিয়ে পৃথিবীর যে কোনো দেশ, যে কোনো জাতি, যে কোনো মানুষের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ আমরা সহজেই বুঝতে পারি আর এ কারণেই বলা যেতে পারে চিত্রকলাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাষা।
কাজ: চিত্রকলা যে আন্তর্জাতিক ভাষা দশটি বাক্যে তা প্রকাশ কর। |
আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত কত শিল্পী কত শত ছবি এঁকেছে। গুহাচিত্রের সেইসব শিল্পীর নাম যেমন আমাদের অজানা রয়ে গেছে। তেমনি পরবর্তী সময়ে কত দেশে কত শিল্পী ছবি এঁকেছে। সেইসব শিল্পীর মাঝ থেকে কেউ কেউ তাঁদের শিল্পসৃষ্টি দিয়ে জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন। এই উপমহাদেশেও অনেক বরেণ্য শিল্পী শিল্পসৃষ্টি করে চিত্রকলার ইতিহাসে আসন করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দলাল বসু প্রমুখ। তেমনি আমাদের দেশের পথিকৃৎ শিল্পীদের মধ্যে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস.এম সুলতান, আনোয়ারুল হক। তাঁদের পরবর্তী সময়ে যে সকল স্বনামধন্য শিল্পী এ যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, মুর্তজা বশীর, মুস্তাফা মনোয়ার, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল বাসেত, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।
পৃথিবীতে যে সকল শিল্পী তাঁদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্য দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের জীবন ও তাঁদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে এবারে আমরা জানব।
ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে ভিঞ্চি নামক একটি ছোটো শহরে ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে আনচিআনো নামক গ্রামে লিওনার্দোর জন্ম হয়। পিতা পাইরো দ্য ভিঞ্চি একজন বিশিষ্ট বিত্তশালী। তাঁর মাতার নাম ক্যাটরিনা। অটুট স্বাস্থ্য ও রূপের অধিকারী ছিল এই শিশু। পিতা পাইরো পুত্রের উন্নতির জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতেন। বিপুল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে লিওনার্দো প্রতিপালিত ও বেড়ে উঠেছেন। দুঃখের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়নি কখনও। যে সময় লিওনার্দোর জন্ম হয়েছিল তখন ইতালির রেনেসাঁস বা নবজাগরণ। এই সময় ইউরোপে এক বৈপ্লবিক যুগ আরম্ভ হয়েছিল।
অশ্বারোহণ, সংগীত, চিত্র, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, স্থাপত্য ও গণিতশাস্ত্রে ছিল লিওনার্দোর গভীর অনুরাগ। ভিঞ্চি তাঁর ছবির নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আকাশে উড়ন্ত পাখিদের গতি, ভারসাম্য ও দিক পরিবর্তন লক্ষ করে তিনি বর্তমান যুগের উড়োজাহাজের আকৃতিবিশিষ্ট এক যন্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। অঙ্কনে মানবদেহের সৌন্দর্য সৃষ্টিতে যথাযথ উপায় খুঁজে পেতে মৃতদেহ কেটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতেও বাদ রাখেন নি। শিল্পকলার ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য দিক দিয়ে তাঁর যে গবেষণা ছিল তা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের বহু আবিষ্কারে ভূমিকা রেখেছে। নানা বিষয়ে অসংখ্য অঙ্কন তিনি রেখে গেছেন।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকে তিনি প্রচুর গবেষণা করেছেন। তাঁর চিন্তাচেতনার ফসলের সূত্র থেকেই পরবর্তীকালের আকাশযান, স্থলযান ও জলযানের জন্ম, যা আধুনিক বিশ্বের বিস্ময়।
তাঁর জগৎবিখ্যাত শিল্পকর্মের মধ্যে মোনালিসা একখানি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। ছবিটি এখন লুভ্যর প্রাসাদ মিউজিয়ামের সম্পত্তি। এর দৈর্ঘ্য তিন ফুট, প্রস্থ দুই ফুট। এই মহিলা ইতালির ফাঞ্চোস্কো দেল জকন্দো নামক এক ব্যক্তির পঁচিশ বছর বয়স্কা পত্নী। তাঁর মুখের সেই রহস্যময় হাসি আজও আমাদের কৌতূহলী করে। এছাড়াও তাঁর আরও বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যাডোরেশন অব দ্য কিংস, ভার্জিন অব দ্য রকস, ম্যাডোনা, শিশু ও সেন্ট অ্যানি। ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে ২রা মে, ৬৭ বছর বয়সে এই মহান শিল্পী মহাপ্রস্থন করেন।
কাজ: লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কি শুধু চিত্রশিল্পী? তাঁর আর কী কী পরিচয় আছে- সকলে ৬টি বাক্যে লিখে দেখাও। |
১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সের নিকটবর্তী ক্যাসেল ক্যাপরিজ নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে মাইকেল এঞ্জেলোর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে চিত্রকলা ভাস্কর্য স্থাপত্য ও কলাবিদ্যার প্রতি পুত্রের আকর্ষণ লক্ষ করে পিতা পুত্রকে ১৩ বছর বয়সে গিরল্যান্ডো এর নিকট শিল্পশিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। এখানে তিনি মাত্র তিন বছর শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। গিরল্যান্ডো এর নিকট আগমনের পূর্ব থেকেই ভাস্কর্যে, মাইকেল এঞ্জেলোর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। এখানে ভাস্কর্য, চিত্র ও স্থাপত্য বিষয়েও তিনি জ্ঞান লাভ করেন।
মানুষের ছবি আঁকায়, ভাস্কর্য সৃষ্টিতে এবং তার নিখুঁত সুন্দর লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। মাইকেল এঞ্জেলোর জীবন লিওনার্দোর ন্যায় সুখে অতিবাহিত হয়নি। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে তিনি শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, অর্থ ও যশ অর্জন করেছিলেন। শিল্পী জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে শেষ জীবন পর্যন্ত দুঃখই পেয়েছেন। তবুও নিজের সৃষ্টির উপর গভীর আত্মবিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর। মানবদেহের মাংসপেশীর গড়ন, গতি-প্রকৃতির আসল রূপ দেখার জন্য শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো তিনিও মৃতদেহকে কেটে দেখেছেন। সে অভিজ্ঞতার ফল তার আঁকা ছবি বা ভাস্কর্যে নজর দিলে সহজেই বোঝা যায়।
শিল্পকর্মে তিনি মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ বা অংশ যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। মাইকেল এঞ্জেলো ছবির চেয়ে ভাস্কর্য কর্মকেই অধিক পছন্দ করতেন এবং ভাস্কর্য কর্মের জন্যই তিনি অধিক বিখ্যাত। মূর্তিগুলি ধাতু ও প্রস্তরে নির্মিত হতো। তাঁর পিয়েটা ভাস্কর্য জগতে এক অবিনশ্বর সৃষ্টি। এই মূর্তিটি এখন রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জার সম্পত্তি। ডেভিড মূর্তিটি ফ্লোরেন্সের একাডেমিতে আছে। বন্ড স্লেভআছে ল্যুভর মিউজিয়ামে।
শুধু ভাস্কর্য সৃষ্টিতেই নয়, চিত্রাঙ্কনেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ভ্যাটিক্যানের সিসটাইন চ্যাপেলের ছাদে এবং দেয়ালের গায়ে মাইকেল এঞ্জেলো যে ফ্রেসকো এঁকেছিলেন তাঁর সে কাজগুলো আজও সকলে বিস্ময় নিয়ে দেখে। এখানের চিত্রকলার সুন্দর রূপ দিতে তিনি ভাস্কর্যের আকার-আকৃতি ও কলাকৌশল ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ মূর্তি নির্মাণের মতো সেখানেও তেমনি মানবদেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। মাইকেল তাঁর কাজে পূর্বের প্রচলিত নিয়মকানুন, ধ্যানধারণা সব বদলে দিলেন। তাঁর শিল্পকর্মে সৃষ্টি করলেন নতুন চমক। তাঁর এ রকম শিল্পকর্মগুলো অতুলনীয় এবং রূপলাবণ্য ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। আদমকে জীবন দানের চিত্রটি সিসটাইন চ্যাপেলের ছাদে আঁকা রয়েছে তাতে আছে আশ্চর্যজনক দরদ সৃষ্টির পরিচয়। পরবর্তীকালে লাস্ট জাজমেন্ট ছবিটি এঁকেছিলেন।
মাইকেল এঞ্জেলো ছিলেন চিরকুমার। সাধু-সন্ন্যাসীদের ন্যায় জীবনযাপন করেছিলেন। শেষ বয়সে শিল্পী মাইকেল অত্যন্ত খিটখিটে হলেও জনসাধারণ তাঁর প্রতিভার জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করত।
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি এঞ্জেলো বিখ্যাত পিয়েটা মূর্তির পায়ের কিছু অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৭ তারিখ ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়। তখন পূর্ণজ্ঞানে একটা উইল করার কথা বলেন। তাতে লেখা হয় 'আমার আত্মা ঈশ্বরের জন্য রইল, দেহ রইল পৃথিবীর জন্য' বেলা পাঁচটায় এই মহান শিল্পী ৮৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
র্যাফেল আরবিনো নামক একটি পার্বত্য শহরে ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে গুড ফ্রাইডে তিথিতে রাত্রি ৯টায় জন্মগ্রহণ করেন। রাফায়েলের পিতা জিওভানি সানতিও ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ। রাফায়েল পিতার কাছেই ছবি আঁকার প্রথম অনুশীলন আরম্ভ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি পিতার আঁকা ছবির উপর তুলি চালানোর অধিকার লাভ করেন। পিতা জিওভানি পুত্রের ষোলো বছর বয়সে তাঁকে তৎকালীন খ্যাতিমান শিল্পী পেরুজীনোর নিকট প্রেরণ করেন। মাত্র তিন বছরে সেখানে তাঁর একাগ্রতা এবং অধ্যবসায়ের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পীসমাজে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। রাফায়েলের সর্বোচ্চ মূল্যবান উদ্ভাবন হলো ছবি আঁকার বিষয়বস্তু সঠিকভাবে সাজানো। একমাত্র তাঁর শিল্পকর্মে এ মূল্যবান উপায়টি দেখা যেত। আর কারো চিত্রকলায় যা দেখা যায় না।
রাফায়েল ছিলেন একজন অতি সুদর্শন পুরুষ। চরিত্রেও তেমনি ভদ্রতা, নম্রতা, বিনয়, শালীনতা ও পরোপকারী ছিলেন। একবার যিনি এই শিল্পীর সংস্পর্শে আসতেন তিনিই আনন্দিত হতেন। যৌবনের প্রথমে যশ ও অর্থ দুই তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু যশ বা অর্থের মোহ তাঁর স্বভাবকে কখনও প্রভাবিত করতে পারেনি। রাফায়েল ও লিওনার্দোর দুই মহান শিল্পীই ছিলেন পরম কৌতূহলপ্রবণ। বিশ্বের রহস্য উদঘাটনে একজন ছিলেন গবেষক অপরদিকে রাফায়েল ছিলেন সত্য অনুসন্ধানে যত্নশীল।
রেনেসাঁস যুগে লিওনার্দো, মাইকেল এঞ্জেলো ও রাফায়েল এই তিন মহান শিল্পী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছবি আঁকা আরম্ভ করেন। তাঁরা আলোছায়া ও পরিপ্রেক্ষিত অনুশীলন করে পরবর্তী রেনেসাঁস চিত্ররীতির মধ্যে নতুন দীপ্তি দান করেছিলেন।
তাঁর বিখ্যাত শিল্প সৃষ্টির মধ্যে প্রান্তরে উপবিষ্ট ম্যাডোনা ছবিটি সৌন্দর্যের অতুলনীয় সৃষ্টি। রাফায়েলের সাধক জীবন সম্বন্ধে একটি সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। রোম নগর যখন রাফায়েলের জয়গানে মুখরিত তখন তাঁর শত্রুপক্ষ তাঁকে হত্যা করার জন্য ঘাতক নিযুক্ত করেছিল। রাফায়েল ঘরের দরজা খোলা রেখেই মাতৃমূর্তি ছবিটি তখন আঁকছিলেন। ঘাতকদ্বয় ছবি আঁকা দেখে তাদের উদ্দেশ্য ভুলে যান। শিল্পীও তাঁর স্বভাবসুলভভাবে খুব যত্ন ও আপ্যায়ন করে তাদের নিকট ছবির ব্যাখ্যা করতে থাকেন। ঘাতকদ্বয় রাফায়েলের ব্যবহারে এতই অভিভূত হন যে তাদের পাপ উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে প্রস্থন করেন।
১৫২০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে গুড ফ্রাইডে তিথিতে (জন্মদিনে) এই মহান শিল্পী পরলোকগমন করেন।
কাজ: রাফায়েলের স্বভাব ও প্রকৃতি নিয়ে দশটি বাক্যে সকলে লিখে দেখাও। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. সিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি জন্মগ্রহণ করেন কত সালে?
ক) ১৪৫২ সালে
খ) ১৪৪২ সালে
গ) ১৫৫০ সালে
ঘ) ১৪৮০ সালে
২. কোন শিল্পী চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে সমান দক্ষ ছিলেন?
ক) লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
খ) রাফায়েল
গ) মাইকেল এঞ্জেলো
ঘ) পল সেজান
৩. প্রান্তরে উপবিষ্ট ম্যাডোনা ছবিটি কার আঁকা?
ক) ভ্যানগঘ
খ) রাফায়েল
গ) মাতিস
ঘ) মাইকেল এঞ্জেলো
৪. আদিম মানুষের আঁকা প্রথম ছবিটি আবিষ্কর হয়েছিল- আনুমানিক তা প্রায়-
ক) ১০ হাজার বছর আগে
খ) ২০ হাজার বছর আগে
গ) ৩০ হাজার বছর আগে
ঘ) ৪০ হাজার বছর আগে।
৫. আলতামিরা গুহাটি কোথায়?
ক) ফ্রান্সে
খ) স্পেনে
গ) জার্মানে
ঘ) জাপানে
সংক্ষেপে উত্তর দাও।
১. চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলার পক্ষে তোমার মতামত দাও।
২. তিনি শুধু চিত্রশিল্পীই নন একাধারে বহু আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারক-শিল্পী সম্পর্ক যা জান লেখো।
৩. শুধু চিত্রকলাই নয় ভাস্কর্যেও ছিলে সমান পারদর্শী-শিল্পীর নাম ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
8. ছবি আঁকার বষয়বস্তু যথাযথভাবে সাজানো-এ মূল্যবান উদ্ভাবন কোন শিল্পী করেছিলেন? তাঁর সম্পর্কে লেখো।
Read more