স্বাস্থ্যসেবা আমাদের সবার জন্য কোন কোন সময়ে অপরিহার্য একটি বিষয়, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিষয়টি সকলের জন্য সব সময় অত্যাবশ্যক। জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের বিশেষ আগ্রহ আছে। এটি সাধারণত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী বিষয় সমূহের কারণ ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করে। শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবাদানকারীদের একার পক্ষে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় উদ্ভূত স্বাস্থ্য সমস্যা বা ৰাধা অতিক্রম করে সমাধান করা কখনোই সম্ভব নয়। মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয় তখন আরোগ্য লাভের জন্য হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়। আর স্বাস্থ্যসেবা এবং জনস্বাস্থ্যের মূলনীতিই হল মানুষ যাতে রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা পড়ে ভুলতে পারে তার ব্যবস্থা করা। এছাড়াও জনস্বাস্থ্যের মূল কাজই হচ্ছে কমিউনিটি লেভেলে একটি অবিচ্ছিন্ন সুন্দর স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরি করা, যাতে পুরো দেশের জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস ও সুস্বাস্থ্যের নির্ভুল জায়গা নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সকল কর্মীকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান, রোগ প্রতিরোধ ও জনগনের স্বাস্থ্য উন্নয়নে দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারন করে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমর
জনস্বাস্থ্য বলতে কোনো একটি এলাকার সব শ্রেণির জনগণের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকাকে বোঝায়। সেই জন্য জনস্বাস্থ্য বিষয়টির মধ্যে শুধু স্বাস্থ্যের কথা বলা হয় না। এর মধ্যে রয়েছে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ, রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থা, পুষ্টি, পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানীয় জল, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। তাই, কেবল মাত্র নিজের নয়, এলাকার সমস্ত মানুষের এবং পরিবেশের সুস্থ থাকাটাও জনস্বাস্থ্যের আওতায় পড়ে ।
উইকিপিডিয়া মতে “জনস্বাস্থ্য হল সমাজ, সংগঠন, সরকারি এবং বেসরকারি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মিলিত চেষ্টা এবং তথ্যাভিজ্ঞ পছন্দের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, জীবনকাল বৃদ্ধি ও মানব স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিজ্ঞান ও কলা।" জনগণের স্বাস্থ্য ও তার ঝুঁকির দিকগুলো বিশ্লেষণ করা জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয়।
জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বঃ জনস্বাস্থ্য বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সেবাদানের মান উন্নত এবং জীবন দীর্ঘায়িত করার জন্যে ব্যপক ভুমিকা রাখে । স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধের মাধ্যমে ব্যক্তিরা একটি সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে তাদের সুদীর্ঘ জীবন কাটাতে পারে। বছরের বেশি সময় ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে কাটাতে পারে। জনস্বাস্থ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্য সমস্যা সনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং রোগের বিস্তার এড়াতে যথাযথভাবে ভুমিকা রাখে। জনস্বাস্থ্যের একটি মৌলিক গুণ হল এর প্রতিরোধমূলক অবস্থা। কারণ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক বেশি কার্যকর এবং অনেক কম ব্যয়বহুল। জনস্বাস্থ্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচি, প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জনগনকে সচেতনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে এবং সরকারী স্বাস্থ্যনীতিতে অসামান্য অবদান রাখে। এই ধরনের পদক্ষেপ জনগণের স্বাস্থ্য এবং জীবনকাল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উন্নয়নশীল ও উন্নত-উভয় ধরনের দেশেই স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং বে-সরকারি সংগঠনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টায় জনস্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যম যেটি বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো পরিচালনা করে এবং কাজ করে।
জনস্বাস্থ্যের প্রকৃতিঃ জনস্বাস্থ্য-এর মূল প্রকৃতি হলো :
১। বিভিন্ন রোগীর রোগ তদারকি এবং স্বাস্থ্যকর আচরণ নিশ্চিত করা,
২। গোষ্ঠী ও জনসাধারনের উৎসহদানের মাধ্যমে রোগ, আঘাত এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা।
৩। রোগকে চিকিৎসা ছাড়া সহজ কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিরোধ করা। যেমন: উদাহরণস্বরূপ, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মত সাধারণ কাজটি দিয়েই অনেক সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার, টিকাদান কন্ডোম বিতরণ প্রচলিত প্রতিরোধমূলক জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীর উদাহরণ।
বাংলাদেশে আয়তনের দিক থেকে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। সাথে রয়েছে সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় নিম্ন লিখিত স্বাস্থ্য সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছেঃ
যে রোগগুলো একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না, অর্থাৎ ছোঁয়াচে না তাদের অসংক্রামক ব্যাধি (Noncommunicable diseases, or NCDs) বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত শারীরিক অবস্থা বা রোগ যেটা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না। দুনিয়াজুড়ে অসংক্রামক ব্যাধি এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদূরোগ ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধি এখন মরণ ঘাতক। অসংক্রামক ব্যাধি আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের জোরালো পারিবারিক ইতিহাস থাকে । এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান (Environmental factors) যেমন পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। এই দুয়ে মিলে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এ ধরনের রোগে। ফলে সারা পৃথিবীজুড়ে অনেক মানুষ কম বয়সে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, ফলে পারিবারিক ব্যয় বাড়ছে। সময়মতো সচেতন হলে বংশ পরম্পরায় থাকা এসব রোগ প্রতিরোধ করা সহজ। অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগ, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিসঅর্ডারস, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবেশগত স্যানিটেশন, অপুষ্টি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সমস্যা, পেশাগত স্বাস্থ্য সমস্যা, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, সড়ক পথের দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবা ইত্যাদি।
অসংক্রামক ব্যাধির প্রকারভেদঃ
সাধারণত চার ধরনের অসংক্রামক ব্যাধি আছে এবং সেগুলো হলো:
১। হৃদরোগ (cardiovascular diseases) যেমন হৃদযন্ত্রের বৈকল্য (heart attacks) এবং উচ্চ রক্তচাপ জনিত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (stroke); ২ ক্যান্সার, ৩।দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোপ (chronic respiratory diseases) যেমন দীর্ঘকাল স্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের বিশেষত ফুসফুসের বাধাগ্রস্থতার রোগ এবং ৪। হাঁপানি এবং বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস
সংক্রামক ব্যাধি (Communicable diseases) সংক্রামক রোগ বলতে সেই সব রোগ বোঝায়, যেসব রোগ একজন থেকে আর একজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ছড়িয়ে পড়া শুধু মানুষ থেকে মানুষ নয়, পশু পাখি থেকে মানুষে, পশু পাখি থেকে পশু পাখির মাঝে, কিংবা মানুষ থেকে পশু পাখির মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বর্তমানে সংক্রামক রোগ এর প্রকোপ অনেকাংশে কমে এসেছে। বরং অসংক্রামক জীবন ঘাতী রোগ মহামারী আকারে দেখা দিচ্ছে। সংক্রামক রোগের মধ্যে রয়েছে- যক্ষ্মা, এইচআইভি, টিটেনাস, ম্যালেরিয়া, হাম, রুবেলা, কুষ্ঠ, কোভিড-১৯, ডায়রিয়া, ফাইলেরিয়া, ফুড পয়জনিংইত্যাদি।
সংক্রামক রোগের কারণগত শ্রেণিবিভাগ: ১। ব্যাকটেরিয়াল: যক্ষ্মা, ধনুস্টংকার, টাইফয়েড, কলেরা। ২। ভাইরাল: ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা, রোটা ভাইরাল ডায়রিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, এইডস, হাম, রুবেলা।
৩। ছত্রাক জনিত: বিভিন্ন চর্মরোগ, ছত্রাক জনিত ফুসফুস সংক্রমণ, মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্ক আবরন সংক্ৰমণ, মহিলাদের শ্বেতপ্রদর ইত্যাদি। ৪। প্রোটিন জনিত: ম্যাড কাউ, ক্রুজফিল্ড জ্যাকব
সংক্রমণ ঝুঁকি
১।ডায়াবেটিস রোগী, ২।জন্মগত স্বপ্ন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সংক্রমণ ঝুঁকি বেশি। তাকিছু রোগেও শরীর এর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যেমন এইডস, যক্ষ্মা, কালাজ্বর, ক্যনসার। ৪।তাছাড়া অতি ছোট শিশু এবং অতি বৃদ্ধদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ১০০ টির মত প্রজাতি রোগ হুড়ায়।এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে মশা থেকে ২০টির মত রোগ ছড়ায়।পুরো পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের আক্রমণে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তাদের মধ্যে মশাবাহিত রোগে মারা যান সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ (সূত্রঃ বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ২০ অগাস্ট ২০২১)। মশাবাহিত রোগ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২০শে অগাস্ট পালিত হয় বিশ্ব মশা দিবস। মশার একটিমাত্র কামড় একজন মানুষের জন্য মরণঘাতি হয়ে উঠতে পারে। রোগসৃষ্টিকারী বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী বহন করায় মশার কামড়ে সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে(সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, ২৮ আগষ্ট, ২০২১)। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মশাবাহিত পাঁচটি রোগের কথা জানা যায়। যথা-ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিস। নিন্মে এই পাঁচটি মশাবাহিত রোগ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:
ম্যালেরিয়া
মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে পুরোনো রোগ। ম্যালেরিয়া রোগটি স্ত্রী এনোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে হয়। এ রোগটির জন্য দায়ী প্লাজমোডিয়াম গোত্রভুক্ত কিছু পরজীবী। বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার এবং ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ফাইলেরিয়া
কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি এবং ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোপ হুড়ায়। ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একে স্থানীয়ভাবে গোদ রোগও বলা হয়।
ডেঙ্গু
এডিস মশার দুইটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি এবং অ্যালবোপিকটাস, মুলত ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু ছড়ায়। এডিস মশা পাত্রে জমা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়, ফলে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবও এ সময়ে বেড়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে থাকে। তাঁর পেটে ব্যথাও হতে পারে। শরীরে বিশেষ করে মাংসপেশীতে তাঁর ব্যথা হয়। ক্ষরের ৪/৫ দিন পার হচ্ছে শরীরজুড়ে র্যাশ বা ঘামাচির মত লালচে দানা দেখা দেয়। সাথে বমি ভাব, এমনকি বমিও হতে পারে।
চিকুনগুনিয়া
'এডিস অ্যাজিস্টাই' মশার কামড়ের মাধ্যমে শরীরে রোগের জীবাণু প্রবেশের দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ চোখে পড়া শুরু হয়। জ্বর, মাথাব্যথা, ত্বকের র্যাশ, বমিভাব ও বমি ইত্যাদি ছাড়াও শরীর ব্যথা, বিশেষত, হাড়ের জোড়ে ব্যথা হওয়া এর বিশেষ লক্ষণ। রোগ সেরে যাওয়ার পরও এই জোড়ের ব্যথা সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরব্যাপী জোগাতে পারে।
জাপানিজ এনসেফালাইটিস
"কিউলেক্স" নামক মশার মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ। যার প্রকোপ সবচাইতে বেশি এশিয়া মহাদেশে, বিশেষত জাপানে। এর উপসর্গ হল জ্বর ও মামাব্যথা। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আড়াইল জনের মধ্যে একজনের দেখা দেয় খিঁচুনি, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং 'প্যারালাইসিস' বা অসাড়তা।
বাংলাদেশে অপুষ্টি একটি মারাত্মক জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত। দারিদ্র্য, খাদ্য ঘাটতি, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং নানা রকম কুসংস্কার ছাড়াও বিভিন্ন আর্থ-সমাজিক কারণে দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ, গৰ্ভৱতী ও প্রসুতি মহিলা এবং বাড়ন্ত শিশুরা সহজেই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার খাদ্য তথা পুষ্টি উপাদানের অভাবের ফলে বিভিন্ন বয়সের লোকদের মধ্যে নানা রকম অপুষ্টিজনিত রোগ দেখা দেয়। এ সমস্ত রোগের মধ্যে রয়েছে- ১। আমিষ শক্তির ঘাটতিজনিত অপুষ্টি (প্রোটিন এনার্জি ম্যালনিউট্রিশন) ক) ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোপ, এ কোয়াশিয়রকর বা গা ফোলা রোগ, ২। রাতকানা (নাইট ব্লাইন্ডনেস), ৩। মুখের বা ঠোঁটের কোনায় মা (এঙ্গুলার ভাষাটাইটিস), ৪। রিকেটস, ৫। রক্তাল্পতা, নিউট্রিশনাল এনিমিয়া)
অপুষ্টিজনিত এই রোগগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোগঃ সাধারণত এক বৎসরের নীচের বয়সী শিশুদের মধ্যেই এ রোগের প্রকোপ বেশী দেখা যায়। এ রোগ হলে শরীর ক্রমশঃ রোগা হয়ে শীর্ণকায় বা হাড্ডিসার বা কঙ্কালসার হয়ে যায়। কোয়াশিয়রকর/পা ফোলা রোগঃ এক থেকে তিন বৎসর বয়সী শিশুদের মধ্যেই কোয়াশিয়রকর রোপটি বেশী দেখা যায়। শিশুর যখন মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে অন্য খাবার খেতে শুরু করে তখনই সাধারণত এ রোগটি বেশী হয়। একটি শিশু মায়ের দুধ খাওয়া অবস্থায় আরেকটি শিশুর জন্ম হলে প্রথম শিশুটি স্বভাবতই মায়ের দুখ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে একদিকে মায়ের দুধের উৎকৃষ্ট আমিষ থেকে বঞ্চিত হয়, অপরদিকে দারিদ্রতার কারণে নিম্ন মানের অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ এবং শিশুর ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের দরুণ ঐ শিশুর খাদ্যে মারাত্ম জামিষের ঘাটতি হয়। এরকম অবস্থাতেই শিশুটি কোয়াশিয়রকর রোগে আক্রান্ত হয়।
রাতকানা রোগ (Night Blindness) : রাতকানা শিশুদের একটি প্রধান রোগ। বাংলাদেশের ব্যপক সংখ্যক শিশু রাতকানায় ভোগে। ৬ মাস থেকে ৬ বৎসর বয়সী শিশুদের মধ্যে রাতকানার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
মুখের বা ঠোঁটের কোনায় ঘা (Angular Stomatitis): বাংলাদেশে শীতকালে বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলে অনেকেরই ঠোঁটের কোনায় এবং জিহব্বায় ঘা হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণ হল-ঠোঁট লাল হয়ে ফেটে যায়; মুখের বা ঠোঁটের দুই কোনায় ঘা হয় এবং হা করা যায় না,জিহব্বায় ঘা হয়, লাল হয়ে ফুলে যায়, ব্যথা হয় এবং খেতে অসুবিধা হয়।
রিকেটসঃ বাংলাদেশে রিকেটস রোগের প্রকোপ খুব কম। ঘনবসতি বা বস্তি এলাকায় সেখানে মানুষ সূর্যের আলো কম পায় এবং সাথে সাথে ভিটামিন 'ডি' এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যও কম খায়, সে এলাকায় বিশেষতঃ ছোট শিশুদের রিকেটস রোগ বেশী হয়।
রক্তসল্পতা (Anaemia) : রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলেই রক্তসল্পতা রোগ হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ জন লোকই রক্তসল্পতায় ভোগে। গর্ভবতী, প্রসূতি মহিলা এবং ছোট শিশুরাই এ রোগের সহজ শিকার। এ রোগের ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, কর্মক্ষমতা লোপ পায় এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগ সহজেই দেহকে আক্রমন করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ।বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণ জনিত অসুখ বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্রা ১৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তারা বলছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে (সূত্রঃবিবিসি নিউজ, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। পরিবেশ দূষনের প্রকারভেদঃ পরিবেশ দূষণের বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যেমন বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ ইত্যাদি। এর সবগুলোর ফলেই কোন না কোনভাবে মানুষবিভিন্ন রোগের শিকার হচ্ছে। এসব দূষনের ফলে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি বা সমস্যাগুলো হয় তা নিন্মরুপঃ
১. শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি: আমাদের দেশে সাধারণত দূষণের শিকার হয় দরিদ্র নারী এবং শিশুরা।কারণ তাদের বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করে, যেখানে সীসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে এর ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে ।
২. গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি: দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এসব এলাকার দূষিত বায়ু এবং পানির কারণে তার নিজের এবং গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হয়।
৩. বায়ু দূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি: রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দুষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকার কারণে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ হয়। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়।
৪. ক্যান্সার ও হৃদরোগ: দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
৫. পানি দূষনের ফলে সৃষ্ট রোগ: পানিবাহিত রোগ সংক্রমণের মূল কারণ হলো দূষিত পানি, শিল্প কলকারখানার বর্জ্য দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা । এ দূষিত পানি মানব শরীরে প্রবেশ করে পানিবাহিত রোগ ছড়ায়। যেমন— ডায়রিয়া, কলেরা, চর্মরোগ, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস এবং হেপাটাইটিস ।কলেরাও একটি মারাত্মক রোগ। দূষিত জীবাণুযুক্ত পানি পান করলে এ রোগ হয়। পাতলা পায়খানার সঙ্গে প্রচুর বমি হয়। সলমনেলা টাইফি এবং প্যারাটাইফি নামক পানিবাহিত জীবাণুর কারণে যে রোগটি হয় তাকে টাইফয়েড বলে। জন্ডিস একটি পানিবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। এটি লিভারকে নষ্ট করে ফেলতে পারে। জন্ডিসের ফলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
৬. শব্দ দূষণে সৃষ্ট রোগ: গবেষণায় দেখা গেছে অতিরিক্ত শব্দ দূষনের কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ক্রুটির তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যার তৈরি হতে পারে।
৭. খাদ্য দূষণে সৃষ্ট রোগঃ খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারায়। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যার তৈরি হয়। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারেরও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরনের দুষিত খাবার খেলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
অসংক্রামক রোগে মৃত্যুঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-২০২১ জরিপ মতে ২০২০ সালের চেয়ে দেশে ব্রেন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত মৃত্যু দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ব্রেন স্ট্রোকের পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুও। ২০২০ সালে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন মারা গেছে। ২০১৯ সালে এ রোগে মারা যান ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন।মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি ২০২০ সালে ৮ হাজার ২৪৮ জন মারা গেছেন করোনাভাইরাসের কারণে। লিভার ক্যানসারেও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৯ হাজার ৮৫০ জন। ২০১৯ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ২১ হাজার ৩৭৪ জনের।‘শুধু ধুমপানজনিত কারণে দেশে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিন শ মানুষের। এসব রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি ও ব্যবস্থা না নিলে ২০৪০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়াবে। ৬ বৎসরের নীচের শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ শিশু প্রতি বছর রাতকানায় ভোগে এবং প্রায় ৩০,০০০ শিশু প্রতি বছর পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়, যাদের প্রায় অর্ধেকই আবার আমিষ শক্তি অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম বছরই মারা যায়।
মশাবাহিত রোগে মৃত্যু হার: পুরো পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের আক্রমণে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তাদের মধ্যে মশাবাহিত রোগে মারা যান সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা যান ১৫৪ জন। (সূত্রঃ বিবিসি বাংলা, ২০ আগষ্ট, ২০২১)।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু-আক্রন্ত হয়ে মৃত্যুর হার দশমিক ২ শতাংশেরও কম। মৃত্যুহারের দিক দিয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যু হার মোট মৃত্যুর প্রায় ৫ শতাংশ। যা সাধারণ মানুষের তুলনায় ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুসংখ্যা শতকরা দশমিক ৫ শতাংশ। (সূত্রঃ বাসস রিপোর্ট, ২৫ আগষ্ট, ২০১৯)
অন্যান্য কারণে মৃত্যু সূচক
১। বাংলাদেশের স্থূল মৃত্যুহার হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে নবজাতক/শিশু মৃত্যুহার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এখনো আশঙ্কাজনক। প্রতি হাজারে মাতৃ মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
২। বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন। প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে আঘাতজনিত মৃত্যুর মধ্যে এটাই প্রধান কারণ।
৩। আর ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে প্রতিদিন ১৪ জন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে
৪। শিশুদের মধ্যে পানিতে ডুবে মরার হার সবচেয়ে বেশি (প্রতিদিন ৪০ জন)
৫। নয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। তবে ১০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আঘাতজনিত মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আত্মহত্যা।
৬। মাতৃ মৃত্যুর মাত্রা ১০০ জন্মের প্রায় ১ জন হয়েছে। (সূত্রঃ বাংলানিউজটোইয়েন্টিফোর.কম, ২০১২ )
রোগতাত্ত্বিক অনুশীলনে প্রধানতঃ সংক্রামক ব্যাধি বিস্তারে তিনটি বিষয়কে একত্রে রোগ সৃষ্টির ও সংক্রমণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যথাঃ
১। রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান (Agent): ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবি, ছত্রাক ইত্যাদি।
২। পোষকঃ (Host): যেমন: মানুষের দেহ, প্রানীর দেহ ইত্যাদি।
৩। পরিবেশ (Environment): যেমন: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্য অসচেতন জঙ্গোষ্ঠী প্রভৃতি।
এর দ্বারা রোগ সংক্রমণের পরম্পর সম্পর্কিত প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়েছে। সংক্রমণের ধারা নিন্মলিখিত ভাবে প্রদর্শন করা হয়।
১। স্পর্শ: বেশ কিছু রোগ স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। যেমন স্কেবিস, ছত্রাক জনিত চর্ম রোগ ইত্যাদি।
২। যৌন সংস্পর্শ: এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, হেপাটাইটিস (বি, সি), হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ইনফেকশন যেটি জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ, লিমফো গ্রানুলোমা ভেনেরিয়াম, শ্যাাংক্রয়েড ইত্যাদি ।
৩। খাদ্য ও পানীয়: টাইফয়েড, পোলিও মায়েলাইটিস, হেপাটাইটিস (এ, ডি), কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, বিভিন্ন কৃমি সংক্রমণ
৪। বায়ু বাহিত: যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, মেনাওজাইটিস, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ব্রংকিওলাইটিস, মাম্পস, রুবেলা, বসন্ত, হাম, করোনা ভাইরাস রোগ
৫। ভেক্টর বাহিত: মশা: ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসিস। মাছি: উদরাময়, আমাশয়, ক্রিমি সংক্রমণ, কালাজ্বর, চ্যাগাস ডিজিস, স্লিপিং সিকনেস, চোখের কৃমি (deer fly)।
আমরা ইতিমধ্যে সংক্রামক রোগ, কারণগত শ্রেণিবিভাগ, ছড়ানোর মাধ্যম, ঝুঁকি এবং সংক্রামক রোগ সৃষ্টি ও সংক্রমণের কারণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এই পর্যায়ে উদাহরনস্বরুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংক্রামক রোগ নিয়ে আলোচনা করব। যেমন: এইডস।
এইডস-এর পরিচয়ঃ এইডস হচ্ছে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত একটি মারাত্নক যৌনবাহিত সংক্রমক রোগ । এ রোগ কতগুলো উপসর্গ ও লক্ষণের সমষ্টি । এইডস্ ইংরেজী চারটি শব্দের সমন্বয়। এর পূর্ণরূপ হচ্ছে
এ: অ্যাকুয়ার্ড- যা অর্জিত হয়েছে, বংশানুক্রমে বা উত্তরাধিকারসূত্রে সংক্রামিত হয়নি
আই: ইমিউন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
ডি: ডেফিশিয়েন্সি- কম, যথেষ্ট নয়
এস: সিনড্রোম- বিভিন্ন জটিলতা ও একটি বিশেষ অসুখের লক্ষণ
এইচআইভি এর সংক্রমণের কারণ
১। এইচআইভি/এইডস এর দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে অসুরক্ষিত শারীরিক সম্পর্কের ফলে
২। মায়ের দ্বারা: যদি জন্ম দেওয়ার সময় এইচআইভি ভাইরাস মায়ের দেহে থেকে থাকে তাহলে সেই ভাইরাস বাচ্চার শরীরেও আসতে পারে। যদি জন্ম দেওয়ার পরে কোন কারণে মায়ের ভেতরে থাকা এইচআইভি ভাইরাস চলে আসে তাহলে সেই বাচ্চাকে স্তন্যপানের দ্বারাও বাচ্চার মধ্যে আসতে পারে।
৩। ইনজেকশন: কোন এইচআইভি/এইডস এর রোগীর দেহে ব্যবহৃত করা সুচ কোন অন্য ব্যক্তির শরীরে ব্যবহার করলেও এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৪। শল্য চিকিৎসাশাস্ত্র: শল্য চিকিৎসা শাস্ত্র অর্থাৎ সার্জিকেল ইন্সট্রুমেন্ট যা সার্জারি করার জন্য ব্যবহার করা হয়, যদি এইচআইভি /এইডস এর রোগীদের শরীরে ব্যবহার করা ইন্সট্রুমেন্ট যদি ভালো করে না ধুয়েঅন্য কোন রোগীর শরীরে ব্যবহার করা হয় তাহলে এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৫। সংক্রামিত রক্ত: এইচআইভি/ এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বিনা পরীক্ষা করে যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে তার থেকেও এইচ আই ভি / এইডস হতে পারে।
৬। শ্লেষ্মা আবরণ: শ্লেষ্মা আবরণ যা শরীরের ভেতরের অঙ্গ ঘিরে রাখে এবং সকল ক্যাভিটির সবচেয়ে উপরের স্তর তাতে যদি এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত লেগে যায় তাহলে ওই ব্যক্তির এইচআইভি/এইডস হতে পারে।
এইডস রোগের লক্ষন
১। শরীরের ওজন দ্রুত হ্ৰাস পাবে,
২। দুই (২) মাসেরও বেশি সময় ধরে পাতলা পায়খানা,
৩। ঘন ঘন জ্বর হবে অথবা রাতে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হবে,
৪। শুকনা কাশি হওয়া
এইডস এর সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই। আবার এইডস আক্রান্ত ব্যাক্তি অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে সে রোগের লক্ষণ দেখা যাবে। কারো মধ্যে উপরের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে তার এইডস হয়েছে। তবে, কোন ব্যক্তির এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই বিলম্ব না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে করণীয়
এইচআইভি সংক্রমণ কিভাবে হয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এইডস প্রতিরোধ করতে হবে। এইডস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারেঃ
১। কোন কারণে রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কি না সেটা অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে।
২। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
৩। যেকোনো যৌনরোগে আক্রান্ত হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৪। প্রতিবারই ইনজেকশনের নতুন সূঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
৫। এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মায়ের ক্ষেত্রে, সন্তান গ্রহণ, গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তবে জিডোভুডিন ওষুধ ব্যবহার করে এই সম্ভাবনা কিছুটা কমানো যায়, এবং তা করলে মায়ের দুধও বাচ্চাকে দেওয়া যেতে পারে (কারণ মার দুধ না পেলে গরিব ঘরে জন্মানো বাচ্চার মৃত্যুসম্ভাবনা আরো বেশী)।
১। সংক্রামক রোগ জীবাণুর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ করা এবং রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
২। সুষম খাদ্য গ্রহণ করা
৩। নিরাপদ পানি ব্যবহার করা এবং হাত জীবাণুমুক্ত রাখা
৪। ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকা জরুরি
৫। বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে পারে এমন আবর্জনা যেমন- কৌটা, টায়ার, ফুলের টব ইত্যাদি পরিষ্কার রাখতে হবে। কারণ এতে জমে থাকা পানিতে ডেলু এবং ম্যালেরিয়া রোগের বাহক মশা ভিম পাড়ে।
৬। হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু, রুমাল বা হাত দিয়ে সুখ ঢাকা, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
৭। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা ও রোগীকে সেবা দেওয়ার সময় ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম পরিধান করা।
১। পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের ভালো একটি উপায় হল পানিতে জীবাণুর বিস্তার রোধ করা।
২। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর মলমূত্র পানিতে না ফেলা।
৩। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিসপত্র পানিতে না ধোয়া।
৪। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ও মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকা। কারণ বৃষ্টির সময় উক্ত ময়লা আবর্জনা ও মলমূত্র পানিতে গিয়ে পানি দূষিত হয়।
৫। খাবার আগে এবং পায়খানা ব্যবহারের পরে ভালো করে হাত ধোয়া।
৬। পানি ফুটিয়ে পান করা।
৭। সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাটিন ব্যবহার করা।
১।যাদের পরিবারে অসংক্রামক ব্যাধি জনিত রোগ আছে, তাদের উচিত হবে তাদের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া। শৈশব থেকেই এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
২।ওজন বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড বা কোমল পানীয় গ্রহণ, ধূমপান —ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। তাই এগুলো বর্জনীয়।
৩। ছেলেবেলা থেকে কায়িক শ্রম, ব্যায়াম ও খেলাধুলায় উৎসাহী করা
৪। কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে বেশি।
৫। ইদানীং বলা হচ্ছে স্তন ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসারসহ কিছু ক্যানসারেরও পারিবারিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। আর স্থূলতা, ওজনাধিক্য প্রতিরোধ করা গেলে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে এ ধরনের ক্যানসারকেও প্রতিরোধ করা যায়।
৬। পরিবারে মা-বাবার ডায়াবেটিস থাকলে তাদের তরুণী কন্যাসন্তানের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ও ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের পরিবারের মেয়েদেরও হতে হবে সচেতন। মুটিয়ে যাওয়া এবং কায়িক শ্রমের অভাব এই ঝুঁকি বাড়াবে। তাই তাদের উচিত সন্তান নেওয়ার আগেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা ও খাদ্যাভ্যাস পাল্টানো। পাশাপাশি নিয়মিত নিজেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।
৭।৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করা, চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করা, রক্তচাপ মাপা উচিত। মাত্রা বর্ডার লাইনে হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৮।উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কি না দেখতে হবে। এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের সামান্য উপসর্গকেও উপেক্ষা করা যাবে না। মেয়েরা গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই রক্তের শর্করা দেখে নেয়া উচিত।
৯।থাইরয়েডের সমস্যা পরিবারে থেকে থাকলে তা-ও দেখে নেওয়া ভালো।
১০।মা-খালাদের স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে নিজের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিম্নমিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে আলট্রাসনোগ্রাম বা ম্যামোগ্রাফি করা উচিত
১১। কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলতে হবে। লাল মাংস (গরু-খাসি) কম খাওয়া, বেশি আঁশযুক্ত খাবার ও ফলমুল খাওয়া।
১২।এ ছাড়া কিছু জিনগত রোগ আছে, যেমন থ্যালাসেমিয়ার জিন বংশগতভাবে সন্তানেরা শেষে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই তার যথাযথ স্ক্রিনিং, রোগ নির্ণয় প্রয়োজন। বড় হলে প্রয়োজনে যেন ব্যবস্থা নেওয়া যায় এ জন্য সচেতন হতে হবে। এ ধরনের পরিবারে নিজেদের মধ্যে বিয়ে না হওয়াই ভালো। 'কাজিন ম্যারেজ' পরবর্তী প্রজন্মের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে।
এমনকি বিয়ে-শাদির সময় জীবনসঙ্গীও এ ধরনের জিনের বাহক কি না তা জেনে নেওয়া ভালো।
মাতৃ মৃত্যুর প্রতিরোধের জন্য চারটি উপাদান অপরিহার্য।
১। প্রথমত, জন্মপূর্ব যত্ন কোনো মহিলা সন্তানসভ্যতা হলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং নিরীক্ষণের জন্য মায়েদের কমপক্ষে চারটি প্রসবকালীন চেক করতে যেতে হবে।
২। দ্বিতীয়ত, এই সময় ডাক্তার, সেবিকা এবং ধাত্রীদের জরুরি অবস্থা যেনো উপস্থিতি থাকে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করার এবং অন্যান্য জটিলতার সনাক্ত করা।
৩। তৃতীয়ত, মাতৃ মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো মোকাবেলার জন্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখা ও যত্নশীল হতে হবে যেমন রক্তক্ষরণ, ক্ষত, অনিরাপদ গর্ভপাত, উচ্চ রক্তচাপ রোপ এইসব সমস্যা হলে যেন ছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এবং
৪I অবশেষে, প্রসবের পর ছয় সপ্তাহ জন্মাত্তর যত্ন।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির উদ্দেশ্য, সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধ ও সীমিতকরণের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, বিপর্যয়কর চিকিৎসা ব্যয় হতে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। যেহেতু বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে গেছে, যা জাতীয স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই রাষ্ট্রের উচিত ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য' এই মৌলিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। এর পাশাপাশি নিন্ম লিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে।
১। কার্বন নিঃসরণ: কার্বন এর মাত্রাধিক্যতা, বিশাল নির্গমন আমাদের শহরগুলোকে অনেক বেশি অনিরাপদ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে গড়ে তুলেছে। সরকারকে স্বপ্রণোদিত হয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। কারখানা গুলোকে শহরের প্রধানতম সড়ক এবং বসতির বাইরে নিয়ে যেতে হবে এবং কারখানার জন্যেও আলাদা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
২। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রোপার ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম।
৩। পর্যাপ্ত হাসপাতাল স্থাপন: আমাদের দেশের অঞ্চলগুলো পরিকল্পনার সময়ই এমন ভাবে সাজাতে হবে যেনো, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর বসবাসরত পরিধির জন্য একটি করে হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ এবং পর্যাপ্ত কর্মীর সংখ্যা সেখানে বিদ্যমান থাকে।
৪। পরিকল্পনাবিদগণের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান: জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নগর পরিকল্পনাতে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দেখতে চাইলে পরিকল্পনাবিদগণের হাতে অবশ্যই পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্ৰদান করতে হবে এবং একই সঙ্গে কাজের তদারকি করার সুযোগ দিতে হবে।
৫। এসডিজি ও নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্য: এসডিজির ৩ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, “সকল বয়সী মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে” এবং ১১ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, “অন্তৰ্ভূক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাত সহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তুলতে হবে।”তাই নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা সাজালে সর্বোপরি, শত শত প্রাণ রক্ষা পাবে ।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক ধরনের কাজ আছে যেগুলো একটি অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
১। কোন কমিউনিটির সাস্থ্য সমস্যা নির্দিষ্ট করার জন্য জনগনের স্বস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা।
২। স্বাস্থ্য সমস্যা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ সমুহ নির্নয় ও অনুসন্ধান করা,
৩। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে জনগনকে জানানো, শিক্ষাদান এবং ক্ষমতায়ন করা,
৪। স্বাস্থ্য সমস্যা নির্দিষ্টকরন ও সমাধানের জন্য জনগনের অংশগ্রহণ কার্যকর করা,
৫। ব্যক্তিগত ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য সহায়ক নীতিমালা প্রনয়ন করা,
৬। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী আইন-কানুন প্রয়োগ করা,
৭। জনগনকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংযুক্ত করা এবং অন্য কোনোভাৰে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্ভব না হলে তখন স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা প্রদান করা,
৮। জনস্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবার জন্য দক্ষ কর্মীবাহিনীর নিশ্চয়তা প্রদান করা,
৯। ব্যক্তগত ও গনভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার কার্যকারিতা, সহজলভ্যতা ও মানের মুল্যায়ন করা এবং
১০। বিভিন্ন গবেষনার মাধ্যমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অনুসন্ধান ও স্বাস্থ্য সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে বের করা।
১। সামাজিক ও অর্থনৈনিক পরিবেশ,
২। প্রাকৃতিক পরিবেশ,
৩। ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আচারন,
৪। শিক্ষা
৫। সামাজিক সহায়তা নেটওয়ার্ক,
৬। স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা ও
৭। জেন্ডার বা লিঙ্গ বৈষম্য
১। সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা;
২। সমতার ভিত্তিতে সেবা গ্রহীতা কেন্দ্রিক মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার সহজ প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ও বিস্তৃত করা;
৩। রোগ প্রতিরোধ ও সীমিতকরনের জন্য অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে সেরা গ্রহনে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করা।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সরকারি খাতে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে৷ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন অধিদপ্তর নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে থাকে। যথা-
১। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর,
২। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর,
৩। নার্সিং ও মিডওয়াইফারী অধিদপ্তর
৪। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর
পুষ্টি ও জনসংখ্যা ধাতঃ সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষে স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে টেকসই উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাভ (এইচএনপি) সেক্টরের মূল লক্ষ্য। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এনজিওঃ স্বাস্থ, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবায় গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে এনজিও সমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তারা মূলত: পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য অধিক্ষেত্রে কাজ করে থাকে । সাম্প্রতিককালে এনজিওসমূহ তাদের সেবার পরিধি বাড়িয়েছে এবং শহরে প্রাথমিক সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কাজ করছে।
ঔষধ নীতিঃ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত পুন: গঠনের ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ঔষধ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষতিকর, মূল্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় ঔষধ বাজার থেকে অপসারণ করা এবং স্বাস্থ্য সেবার সকল স্তরে প্রয়োজনীয় ঔষধ ন্যায্য মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
অর্জনঃ
১। ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি সাফল্যজনকভাবে রূপায়নের ফলে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিকাল খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
২। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) সমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু সূচক যেমন: শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, শিশু ও মায়েদের টীকা দেওয়া, ভিটামিন 'এ'-এর ঘাটতি দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যের পরিধির মধ্যে রয়েছে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা, কমিউনিটি, ব্যক্তি এবং সমাজ। এই ক্ষেত্রেগুলোতে সাধারণত জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পেশাদারদের বহু-শ্রেনীর দল নিয়ে গঠিত যারা স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য কাজ করে। জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য পেশার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ ১। পরিবেশগত স্বাস্থ্য, ২। সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য, ৩। মহামারীবিদ্যা, ৪। বিশ্ব স্বাস্থ্য, এবং ৫। স্বাস্থ্য নীতি এবং ব্যবস্থাপনা।
জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিহ হল এমন একটি অবস্থা যেখানে রেডিওলজিক্যাল, পানি বা পয়ঃনিষ্কাশন সম্পর্কিত জীবানুগুলো বিভিন্ন প্রকার এবং পরিমাণে জৈবিক, রাসায়নিক বা শারীরিক পদার্থ রয়েছে যা মানুষের অসুস্থতা, ব্যাধি বা অক্ষমতার কারণ হতে পারে। এর মধ্যে প্যাথোজেন, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, বিষাক্ত রাসায়নিক এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।
১। কীটপতঙ্গ (যেমন ইঁদুর এবং মশা)
২। বর্জ্য জল এবং পয়ঃনিষ্কাশন
৩। বর্জ্য পদার্থের আধার
৪। সংক্রমণ এজেন্টের সংস্পর্শে আসা যেকোনো কিছু (যেমন ক্লিনিকাল বর্জ্য এবং শার্পস)
৫। রাসায়নিক পদার্থ বা পণ্য (যেমন অ্যাসবেস্টস বা বিষাক্ত ধোঁয়া) দ্বারা নিঃসরণ বা বিচ্ছুরণ।
রোগ তত্ত্ব হচ্ছে কোন রোগের প্রাদূর্ভাবের বিস্তারিত কারণ নির্নয় সম্পর্কীয় বিজ্ঞান। যখন কোনো জনগোষ্ঠীকে সাওস্থ্য সম্পর্কিত অবস্থা ও ঘটনাবলীর বিস্তৃতি ও কারণ সম্মন্ধে অধ্যয়ন ওবং উক্ত সমস্যা সমাধানে জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে মহামারির হাত হতে রক্ষা করা সম্ভব হয় তখন উক্ত জ্ঞানকে রোগ তত্ত্ব বিজ্ঞান বলা হয়।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভূমিকা রাখে। যেমন:
১। ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে,
২। নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে
৩। চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে
৪। শহরের কলকারখানার বর্জ্য, গ্রামাঞ্চলের ময়লা-আবর্জনা, কাঁচা পায়খানা, মলমূত্র যাতে খাল-বিল ৰা নদীর পানিতে না মেশে সে দিকে জনসাধারণকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫। প্লাস্টিক ও পলিখিন দ্রব্য যেখানে-সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে
৬। টয়লেট ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতনতা একে অন্যের পরিপুরক। আমাদের অনস্বাস্থ্যে পরিবেশের প্রভাব এক তাৎপর্যপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদের অবশ্যই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। পরিবেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলে আমাদের জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে। এ ছাড়া পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পতিত হবে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় সমর্থিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
জনস্বাস্থ্যের প্রচার এবং বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিস্তার রোধ করা আধুনিক সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এইডস, ক্যান্সার, হৃদরোগ বা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচারাভিযান জরুরিভাবে প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রচারাভিযানের ক্ষেত্রে যোগাযোগের কৌশল এবং বিশেষজ্ঞ দক্ষ কর্মীরা জনগণের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে সহায়তা করে। জনস্বাস্থ্যকে লক্ষ্য করে প্রচারাভিযান চালালে জনসাধারণের আসন্ন স্বাস্থ্য হুমকি প্রতিরোধ করতে এবং ভালো স্বাস্থ্যের অভ্যাস গ্রহণ করতে সহায়তা করে। সাধারণত, এই প্রচারাভিযানগুলো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে (অর্থাৎ লক্ষ্য শ্রোতাদের) সম্ভাব্য স্বাস্থ্য হুমকি এবং তাদের ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন করে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এই প্রচারাভিযান গুরুত্তর স্বাস্থ্য হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত অনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ক্যাম্পেইন সমস্ত বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। যেমন:
১। বিশ্ব নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিস দিবস (World Neglected Tropical Disease (NTD) Day) - ৩০ই জানুয়ারী
২। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস (World TB Day)- ২৪শে মার্চ ।
৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস (World Health Day) - ৭ই এপ্রিল।
৪। বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস (World Malaria Day)- ২৫শে এপ্রিল।
৫। বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ (World Immunization week ) - ২৪-৩০শে এপ্রিল।
৬। বিশ্ব ভাষাকমুক্ত দিবস (World no tobacco day) -৩১ই মে ।
৭। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস (World blood donor day) - ২৪শে জুন।
৮। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস (World hepatitis day)- ২৮শে জুলাই।
৯। বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস (World patient safety day) ১৭ই সেপ্টেম্বর।
১০। বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ (World antimicrobial awarness week ) - ১৮ - ২৪ নভেম্বর।
২০। বিশ্ব এইডস দিবস (World AIDS Day)- ১লা ডিসেম্বর।
আরও দেখুন...