ফুলের চাষ
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষ হয় না। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হয়ে থাকে। সম্প্রতি রজনীগন্ধা, গোলাপ ও গ্লাডিওলাসের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বেলি, জুঁই, চামেলি, গন্ধরাজ, অপরাজিতা, শেফালি, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি নানা ধরনের ফুল জন্মে । বাণিজ্যিকভাবে এসব ফুলের চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব । আমরা এবার শুধু গোলাপ ও বেলি ফুল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব ।
গোলাপ চাষ
গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয়। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বহুজমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে এবং দিন দিন গোলাপের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে । গোলাপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ।
জাত সমূহ
পৃথিবীজুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো। জাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গোলাপ সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি এবং মিশ্র রঙের হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রানী এলিজাবেথ (গোলাপি), ব্ল্যাক প্রিন্স (কালো), ইরানি (গোলাপি), মিরিন্ডা (লাল), দুই রঙা ফুল আইক্যাচার চাষ করা হয় । বংশবিস্তার গোলাপের বংশ বিস্তারের জন্য অবস্থাভেদে শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও চোখ কলম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় । নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বীজ উৎপাদন করে তা থেকে চারা তৈরি করা হয় ।
জমি নির্বাচন
গোলাপ চাষের জন্য উর্বর দোআঁশ মাটির জমি নির্বাচন করা উত্তম। ছায়াবিহীন উঁচু জায়গা যেখানে জলাবদ্ধতা হয় না, এরূপ জমিতে গোলাপ ভালো জন্মে । জমি তৈরি নির্বাচিত জমি ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল করতে হবে। এরপর মাটি কুপিয়ে ৫ সেমি উঁচু করে ৩ মি x ১ মি আকারের বেড বা কেয়ারি তৈরি করতে হবে । এভাবে কেয়ারি তৈরির পর নির্দিষ্ট দূরত্বে ৬০ সেমি x ৬০ সেমি আকারের এবং ৪৫ সেমি গভীর গর্ত খনন করতে হবে । গর্তের উপরের মাটি ও নিচের মাটি আলাদা করে রাখতে হবে । চারা রোপণের ১৫ দিন আগে গর্ত করে খোলা রাখতে হবে। এ সময়ে গর্ভের জীবাণু ও পোকামাকড় মারা যায় ।
সার প্রয়োগ
প্রতি গর্তের উপরের মাটির সাথে ছকে প্রদত্ত সারগুলো মিশিয়ে গর্তে ফেলতে হবে । এরপর নিচের মাটির সাথে ৫ কেজি পচা গোবর, ৫ কেজি পাতা পচা সার ও ৫০০ গ্রাম ছাই ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তের উপরের স্তরে দিতে হবে। এভাবে গর্ত সম্পূর্ণ ভরাট করার পর ১৫-২০ দিন ফেলে রাখলে সারগুলো পচবে ও গাছ লাগানোর উপযুক্ত হবে । বর্ষাকালে যাতে গাছের গোড়ায় বৃষ্টির পানি জমে না থাকে, সে জন্য নালা তৈরি করতে হবে ।
চারা বা কলম রোপণ
আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময় । তবে পৌষ মাস পর্যন্ত চারা লাগালে বেডের গর্তের মাঝখানে ক্ষুদ্রাকৃতির গর্ত খুঁড়ে চারা লাগাতে হয় । প্রথমে পলিথিন ব্যাগ বা মাটির টব থেকে চারা বের করে দুর্বল শাখা, রোগাক্রান্ত শিকড় ইত্যাদি কেটে ফেলতে হয়। চারা লাগিয়ে গোড়ায় শক্তভাবে মাটি চেপে দিতে হবে । চারা রোপণের পর চারাটি একটি খুঁটি পুতে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে । চারা লাগিয়ে গোড়ায় পানি দেওয়া উচিত । ২-৩ দিন ছায়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয় ।
পরিচর্যা
ক) আগাছা দমন : গোলাপের কেয়ারিতে অনেক আগাছা হয় । আগাছা তুলে ফেলতে হবে ।
খ) পানি সেচ : মাটির আর্দ্রতা যাচাই করে গাছের গোড়ায় এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন মাটিতে রসের ঘাটতি না হয় ।
গ) পানি নিকাশ : গোলাপের কেয়ারিতে কোনো সময়ই পানি জমতে দেওয়া উচিত নয় । কারণ গোলাপ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না ।
ঘ) ডাল-পালা ছাঁটাইকরণ (Prunning ) : গোলাপের নতুন ডালে বেশি ফুল হয়। তাই পুরাতন ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করা প্রয়োজন । প্রতিবছর গোলাপ গাছের ডালপালা ছাঁটাই করলে গাছের গঠন কাঠামো সুন্দর ও সুদৃঢ় হয় এবং অধিক হারে বড় আকারের ফুল ফোটে ।
ঙ) ফুলের কুড়ি ছাঁটাই : অনেক সময় ছাঁটাই করার পর মূলগাছের ডালে অনেক কুঁড়ি জন্মায় । সবগুলো কুঁড়ি ফুটতে দিলে ফুল তেমন বড় হয় না । তাই বড় ফুল ফোটার জন্য মাঝের কুঁড়ি রেখে পাশের কুঁড়িগুলো ধারালো চাকু দিয়ে কেটে দিতে হয় ।
কাজ : শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের নিকটস্থ একটি ফুলের বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ পরিদর্শন শেষে গোলাপ ফুলের চাষ পদ্ধতির ধাপগুলো দলীয়ভাবে পোস্টারে লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা
গোলাপ গাছে যেসব পোকা দেখা যায় তন্মধ্যে রেড স্কেল ও বিটল প্রধান ।
ক) রেড স্কেল : এ পোকা দেখতে অনেকটা মরা চামড়ার মতো । গরমের সময় বর্ষাকালে এর আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হয় । এ পোকা গাছের বাকলের রস চুষে খায় । ফলে বাকলে ছোট ছোট কালো দাগ পড়ে । প্রতিকার না করলে আক্রান্ত গাছ মারা যায় । গাছের সংখ্যা কম হলে দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আক্রান্ত স্থানে ব্রাশ করলে পোকা পড়ে যায়। ম্যালাথিয়ন বা ডায়াজিনন জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায় ।
খ) বিটল পোকা : শীতকালের শেষে এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় । এ পোকা গাছের কচি পাতা ও ফুলের পাপড়ি ছিদ্র করে খায় । সাধারণত রাতের বেলা আক্রমণ করে । আলোর ফাঁদ পেতে এ পোকা দমন করা যায় । ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায় ।
রোগ ব্যবস্থাপনা
গোলাপ গাছে অনেক রোগ হয় । তন্মধ্যে কালো দাগ পড়া রোগ, ডাইব্যাক ও পাউডারি মিলডিউ প্রধান ।
ক) কালো দাগ পড়া রোগ : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। রোগাক্রান্ত গাছের পাতায় গোলাকার কালো রঙের দাগ পড়ে। আক্রান্ত গাছের পাতা ঝরে গিয়ে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায়। চৈত্র থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত এ রোগের আক্রমণ ঘটে। এ রোগের প্রতিকারের জন্য গাছে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোড়ায় যেন পানি জমে না থাকে সে দিকে খেয়াল করতে হবে। এ ছাড়া ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায় । আক্রান্ত পাতাগুলো কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হয় ।
খ) ডাইব্যাক : ডাল ছাঁটাইয়ের কাটা স্থানে এ রোগ আক্রমণ করে। এ রোগ হলে গাছের ডাল বা কাণ্ড মাথা থেকে কালো হয়ে নিচের দিকে মরতে থাকে। এ লক্ষণ ক্রমে কাণ্ডের মধ্য দিয়ে শিকড় পর্যন্ত পৌঁছে এবং সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত কাগু বা ডালের বেশ নিচ থেকে কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। ডাল ছাঁটাইয়ের চাকু জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ডাল ছাঁটাই করা উচিত । কর্তিত স্থান স্পিরিট দিয়ে মুছে দিতে হবে ।
গ) পাউডারি মিলডিউ : এটি একটি ছত্রাক জনিত রোগ। শীতকালে কুয়াশার সময় এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পাতা, কচিফুল ও কলিতে সাদা পাউডার দেখা যায়। ফলে কুঁড়ি না ফুটে নষ্ট হয়ে যায় । এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত ডগা বা পাতা তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে । এছাড়া থিওভিট বা সালফার, ডাইথেন এম-৪৫ যে কোনো একটি পানিতে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায় ।
ফুল সংগ্ৰহ
ফুল ফোটার পূর্বেই গাছ হতে ফুল সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহের পর ফুলের ডাটার নিচের অংশ পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখলে ফুল ভালো থাকে । মাঝে মাঝে ফুলে পানির ছিটা দেওয়া ভালো ।
বেলি ফুল চাষ
বাংলাদেশের অধিকাংশ উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ফুলের তোড়া, ফুলের মালাতে সুগন্ধীফুল হিসাবে বেলির কদর আছে । উৎসব ও অনুষ্ঠানে বেলিফুল ব্যবহৃত হয় । এটি একটি অর্থকরী ফুল।
জাত
তিন জাতের বেলি ফুল দেখা যায় । যথা :
১। সিঙ্গেল ধরনের ও অধিক গন্ধযুক্ত।
২। মাঝারি আকার ও ডবল ধরনের।
৩। বৃহদাকার ডবল ধরনের
বংশ বিস্তার : বেলি ফুলে গুটি কলম, দাবা কলম ও ডাল কলম পদ্ধতির মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয় ।
জমি চাষ ও সার প্রয়োগ
বেলে মাটি ও ভারী এঁটেল মাটি ব্যতীত সব ধরনের মাটিতে বেলি ফুল চাষ করা যায় । জমিতে পানি সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকা ভালো । জমি ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরা ও সমান করতে হবে। জমি তৈরির সময় জৈব সার, ইউরিয়া, ফসফেট এবং এমওপি প্রয়োগ করতে হবে । প্রায় ১ মিটার অন্তর চারা রোপণ করতে হবে । চারা লাগানোর পর ইউরিয়া প্রয়োগ করে পানি সেচ দিতে হবে।
কলম বা চারা তৈরি
গ্রীষ্মের শেষ হতে বর্ষার শেষ পর্যন্ত বেলি ফুলের কলম বা চারা তৈরি করা যায় । চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি হতে হবে । চারা লাগনোর জন্য গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটি রোদ লাগিয়ে, জৈব সার ও কাঠের ছাই গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। এরপর প্রতি গর্তে বেলির কলম বসাতে হবে। বর্ষায় বা বর্ষার শেষের দিকে কলম বসানোই ভালো। তবে সেচের ব্যবস্থা ভালো হলে বসন্তকালেও কলম তৈরি করা যায়।
টবে চারা লাগানো
জৈব পদার্থ যুক্ত দোআঁশ মাটিতে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার পরিমাণমতো মিশিয়ে টবে বেলি ফুলের চাষ করা যায় । টব ঘরের বারান্দা বা ঘরের ছাদে রেখে দেওয়া যায় ।
পরিচর্যা
ক) সেচ দেওয়া : বেলি ফুলের চাষে জমিতে সবসময় রস থাকা দরকার। গ্রীষ্মকালে ১০-১২ দিন পর পর, শীতকালে ১৫-২০ দিন পর পর ও বর্ষাকালে বৃষ্টি সময়মতো না হলে জমির অবস্থা বুঝে ২-১ টি সেচ দেওয়া দরকার।
খ) আগাছা দমন : জমি বা টব থেকে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। খড় কেটে কুচি করে জমিতে বিছিয়ে রাখলে সেচের প্রয়োজন কম হয় এবং আগাছাও বেশি জন্মাতে পারে না ।
গ) অঙ্গ ছাঁটাইকরণ : প্রতিবছরই বেলি ফুলের গাছের ডাল-পালা ছাঁটাই করা দরকার। শীতের মাঝামাঝি সময় ডাল ছাঁটাই করতে হবে। মাটির উপরের স্তর থেকে ৩০ সেমি উপরে বেলি ফুলের গাছ ছাঁটাই করতে হবে । অঙ্গ ছাঁটাইয়ের কয়েকদিন পর জমিতে বা টবে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা
বেলি ফুল গাছে ক্ষতিকারক কীট তেমন দেখা যায় না । তবে মাকড়ের আক্রমণ হতে পারে । এদের আক্রমণে পাতায় সাদা আস্তরণ পড়ে, আক্রান্ত পাতাগুলো কুঁকড়ে যায় ও গোল হয়ে পাকিয়ে যায় । গন্ধক গুঁড়া বা গন্ধক ঘটিত মাকড়নাশক যেমন- সালট্যাফ, কেলথেন ইত্যাদি পাতায় ছিটিয়ে মাকড় দমন করা যায় । বেলি ফুলের পাতায় হলদে বর্ণের ছিটে ছিটে দাগযুক্ত এক প্রকার ছত্রাক রোগ দেখা যায় । ট্রেসেল-২ প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায় ।
ফলন
ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গাছে ফুল ফোটে । ফলন প্রতি বছর বাড়ে। লতানো বেলিতে ফলন আরও বেশি হয় । সাধারণত ৫-৬ বছর পর গাছ কেটে ফেলে নতুন চারা লাগানো হয় ।
কাজ : “গোলাপ ও বেলি ফুলের চাষ করে বেকারত্ব দূর করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব”-এ বিষয়ের উপর শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিবে । |
ফলের চাষ
বাংলাদেশে নানা ধরনের ফল জন্মায়। এ দেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত । আমরা কলা ও আনারস চাষ সম্পর্কে জানব।
কলা চাষ
কলা বাংলাদেশের সব জেলায়ই কম বেশি জন্মে । তবে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ এসব জেলায় কলার ব্যাপক চাষ হয় । বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে কলার চাষ হয় যা থেকে বছরে ছয় লক্ষাধিক টন কলা পাওয়া যায় । কলা ভিটামিন ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ । অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলায় ক্যালরির পরিমাণও বেশি । বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই কলার চাষ হয়ে থাকে । কলা কাঁচা অবস্থায় তরকারি হিসাবে এবং পাকা অবস্থায় ফল হিসাবে খাওয়া হয় । রোগীর পথ্য হিসাবে কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ।
কলার জাত
বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে যেসব কলার জাত চাষ করা হয় সেগুলো হচ্ছে অমৃতসাগর, সবরি, চাপা, মেহেরসাগর, কবরী ইত্যাদি । এ ছাড়াও কলার আরও অনেক জাত আছে যেমন : এঁটে কলা, বাঙলা কলা, জাহাজি কলা, কাচকলা বা আনাজি কলা ইত্যাদি। তবে বারি কলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে তিনটি উন্নত জাত চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে । এর মধ্যে বারিকলা-২ জাতটি কাঁচকলার ।
কলার উৎপাদন প্রযুক্তি : কলার উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো হচ্ছে মাটি ও জমি তৈরি, রোপণের সময় ও চারা রোপণ, সার প্রয়োগ পদ্ধতি, অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা ইত্যাদি ।
মাটি ও জমি তৈরি
উর্বর দোআঁশ মাটি কলা চাষের জন্য ভালো। জমিতে প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এবং পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকবে । গভীরভাবে জমি চাষ করে দুই মিটার দূরে দূরে ৫০ সেমি x ৫০ সেমি x ৫০ সেমি আকারের গর্ত খুঁড়তে হবে। চারা রোপণের প্রায় একমাস আগে গর্ত করে গর্তে গোবর ও টিএসপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত পূর্ণ করতে হবে ।
চারা রোপণের সময়
বছরে তিন মৌসুমে কলার চাষ করা হয় বা কলার চারা রোপণ করা হয় যথা :
১ । আশ্বিন-কার্তিক
২। মাঘ-ফাল্গুন
৩। চৈত্র-বৈশাখ
কলার চারা নির্বাচন
কলার চারাকে তেউড় বলা হয় । দুই রকমের তেউড় দেখা যায় । যথা :
১। অসি তেউড় (Sword Sucker )
২। পানি তেউড় (Water Sucker )
১। অসি তেউড় : কলা চাষের জন্য অসি তেউড় উত্তম। অসি তেউড়ের পাতা সরু, সুচালো এবং অনেকটা তলোয়ারের মতো । গোড়ার দিকে মোটা এবং ক্রমশ উপরের দিকে সরু হতে থাকে।
২। পানি তেউড় : পানি তেউড় দুর্বল। এর আগা-গোড়া সমান থাকে। কলা চাষের জন্য এই চারা উপযুক্ত নয় । এ দুই ধরনের চারা ছাড়াও সম্পূর্ণ মূলগ্রন্থি বা তার ক্ষুদ্র অংশ থেকেও কলা গাছের বংশবিস্তার সম্ভব । তবে এতে ফল আসতে কিছু বেশি সময় লাগে । ফলন্ত ও অফলন্ত দুই ধরনের গাছেরই মুলগ্রন্থি চারা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
চারা রোপণ
চারা রোপণের জন্য প্রথমত অসি তেউড় বা তলোয়ার তেউড় নির্বাচন করতে হবে । খাটো জাতের ৩৫-৪৫ সেমি আর লম্বা জাতের ৫০-৬০ সেমি দৈর্ঘ্যের তেউড় ব্যবহার করা হয়। অতঃপর নির্দিষ্ট গর্ভে যাতে প্রয়োজনীয় গোবর ও টিএসপি সার দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে সেখানে চারা লাগাতে হবে । লক্ষ রাখতে হবে যেন চারার কাণ্ড মাটির ভিতরে না ঢুকে ।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
কলা গাছে ব্যবহৃত সারের নাম ও গাছ প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো :
সারের নাম | গাছ প্রতি পরিমাপ |
ইউরিয়া | ৫০০-৬৫০ গ্রাম |
টিওএসপি | ২৫০-৪০০ গ্রাম |
এমওপি | ২৫০-৩০০ গ্রাম |
গোবর/ আবর্জনা সার | ১৫-২০ কেজি |
প্রয়োগ করার সময়
চারা রোপণের ১ মাস পূর্বে গর্ত করে গোবর/আবর্জনা সার ও ৫০% টিএসপি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । রোপণের ২ মাস পর বাকি ৫০% টিএসপি, ৫০% এমওপি ও ২৫% ইউরিয়া গাছের গোড়ার চারদিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । এর ২ মাস পর বাকি ৫০% এমওপি ও ৫০% ইউরিয়া এবং ফুল | আসার সময় বাকি ২৫% ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে ।
পরিচর্যা
সেচ ও নিকাশ
কলার জমিতে আর্দ্রতা না থাকলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে । শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচ দেওয়া দরকার । বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নালা কেটে দিতে হবে । কারণ কলাগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না ।
অতিরিক্ত চারা কাটা
ফুল বা মোচা আসার পূর্ব পর্যন্ত গাছের গোড়ায় যে তেউড় জন্মাবে তা কেটে ফেলতে হবে । মোচা আসার পর গাছ প্রতি ১টি তেউড় রাখা ভালো ।
খুঁটি দেওয়া
কলাগাছে ছড়া আসার পর বাতাসে গাছ ভেঙে যেতে পারে । সে ক্ষেত্রে বাঁশ বা গাছের ডাল দিয়ে খুঁটি বেঁধে দিতে হবে ।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
কলাগাছ ফল ও পাতার বিটল পোকা, রাইজম উইভিল, থ্রিপস এসব পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে । ডায়াজিনন ৬০ ইসি পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায় ।
রোগ ব্যবস্থাপনা
কলা ফল চাষের সময় প্রধানত তিনটি রোগের আক্রমণ দেখা যায় । যথা-
১। পানামা রোগ
২। সিগাটোগা
৩। গুচ্ছ মাথা রোগ ।
১। পানামা রোগ : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের আক্রমণে গাছের পাতা হলদে হয়ে যায়। পাতা বোটার কাছে ভেঙে ঝুলে যায় এবং কাণ্ড অনেক সময় ফেটে যায়। আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে মরে যায় অথবা ফুল-ফল ধরে না। রোগের প্রতিকার হিসাবে রোগমুক্ত গাছ লাগাতে হবে, রোগক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে এবং প্রতিরোধী জাত রোপণ করতে হবে। এ ছাড়া টিল্ট-২৫০ ইসি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যাবে । চিত্র : পানামা রোগক্রান্ত কলাগাছ
২। সিগাটোগা : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ । এ রোগের আক্রমণে পাতার উপর গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় বাদামি রঙের দাগ পড়ে। আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতা ঝলসে যায় ও সমস্ত পাতা আগুনে পোড়ার মতো দেখায়। ফলে ফল ছোট হয় এবং ফলন কম হয়। রোগের প্রতিকার হিসাবে আক্রান্ত গাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩। গুচ্ছ মাথা রোগ : এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ । জাব পোকার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় । ম্যালাথিয়ন বা অন্য যে কোনো অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগে জাব পোকা দমন করে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায় । চিত্র : সিগাটোগা রোগাক্রান্ত কলাপাতা
কাজ : শিক্ষার্থীরা কলার বিভিন্ন রোগের নাম, রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিবে। |
ফসল সংগ্ৰহ
১। চারা রোপণের পর ১১-১৫ মাসের মধ্যে সব জাতের কলা সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
২ । ধারালো দা দিয়ে কলার ছড়া কাটতে হবে ।
ফলন
ভালোভাবে কলার চাষ করলে গাছ প্রতি প্রায় ২০ কেজি বা প্রতি হেক্টরে প্রায় ২০-৪০ টন কলা উৎপাদিত হবে ।
আনারস চাষ
বাংলাদেশে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ করা হয় । সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং টাঙ্গাইলের মধুপুরে ব্যাপক আনারসের চাষ হয়। ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, দিনাজপুর জেলাতেও প্রচুর আনারস জন্মে । তবে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার (জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি) তৈরির কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই আনারসের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাণিজ্যিক ফল হিসাবেও আন্তর্জাতিক বাজারে আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। বর্তমানে বাংলাদেশে এটি একটি অর্থকরী ফসল । আনারস রপ্তানিপণ্য হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ অবদান রাখছে ।
আনারসের জাত : বাংলাদেশে আনারসের তিনটি জাত দেখা যায়। যথা : হানিকুইন, জায়েন্ট কিউ ও ঘোড়াশাল ।
আনারসের উৎপাদন পদ্ধতি : আনারসের উৎপাদন পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হলো
মাটি ও জমি তৈরি
দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি আনারস উৎপাদনের জন্য ভালো । জমি চাষ ও মই এমনভাবে দিতে হবে যাতে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল হয় এবং জমিতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে। চারা রোপণের জন্য চাষকৃত জমিতে ১৫ সেমি উঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। এক বেড থেকে আর এক বেডের দূরত্ব হবে ৫০-১০০ সেমি। পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষ করার জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যা বেশি খাড়া নয় । পাহাড়ের ঢালু জমি কোনোক্রমেই চাষ বা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করা যাবে না, শুধু আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করে চারা রোপণের উপযোগী করতে হবে।
চারা নির্বাচন ও তৈরি
আনারস গাছের বংশবিস্তার অঙ্গজ পদ্ধতিতেই হয়ে থাকে। আনারস গাছে সাধারণত চার ধরনের চারা উৎপন্ন হয় যাদেরকে সাকার বা তেউড় বলা হয় । সাকার বা তেউড়ের বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো :
চারা রোপণ
মধ্য আশ্বিন হতে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত এই এক মাস আনারসের চারা রোপণের সঠিক সময় । সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা রোপণের সময় আরও এক / দেড় মাস পিছানো যায় । সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেমি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সেমি বজায় রেখে চারা রোপণ করতে হবে ।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : ১। সার প্রয়োগ পদ্ধতির প্রথম কাজ হলো পরিমাণ নির্ধারণ । আনারসের জন্য গাছ প্রতি নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
সারের নাম | গাছ প্রতি সারের পরিমাণ (গ্রাম) |
পচা গোবর ইউরিয়া টিএসপি এমওপি জিপসাম |
২৯০ - ৩১০ ৩০-৩৬ ১০-১৫ ২৫-৩৫ ১০-১৫ |
২। (ক) গোবর, টিএসপি ও জিপসাম বেড তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।
(খ) ইউরিয়া ও এমওপি (পটাশ) চারার বয়স ৪-৫ মাস হলে ৫ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
শুষ্ক মৌসুমে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে । বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিকাশের জন্য নালা কেটে দিতে হবে । চারা অতি লম্বা হলে ৩০ সেমি রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে । আনারসের জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। আনারস ফসলে তেমন কোনো ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগ সহজে আক্রমণ করে না । তাই বালাই ব্যবস্থাপনা আলোচনা করা হলো না ।
ফল সংগ্রহ
চারার বয়স ১৫/১৬ মাস হলে মাঘ মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সময়ে আনারসের ফুল আসা শুরু করে । জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত সময়ে আনারস পাকে । গাছ থেকে আনারসের বোঁটা কেটে সংগ্রহ করতে হবে ।
ফলন
প্রতি হেক্টরে হানিকুইন ২০-২৫ টন এবং জায়েন্ট কিউ ৩০-৪০ টন ফলন দিয়ে থাকে ।
কাজ : শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের নিকটস্থ একটি ফলের বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ পরিদর্শন শেষে আনারস চাষ পদ্ধতির ধাপগুলো দলীয়ভাবে পোস্টারে লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে । |
আরও দেখুন...