গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধরা এ ধর্মের অনুসারী। বুদ্ধ দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর ধর্মবাণী প্রচার করেন। এ সময় তিনি শিষ্য ও অনুসারীদের নিকট ধর্মীয় রীতিনীতি, উপদেশ ও বাণী দেশনা করেছেন। এসব ধর্মবাণী যে সমস্ত গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে তার নাম ত্রিপিটক। ত্রিপিটক বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ।
তোমরা আগের শ্রেণিতে ত্রিপিটকের তিনটি অংশের কথা জেনেছ। সেই তিনটি হলো- ১. বিনয় পিটক, ২. সূত্র পিটক ও ৩. অভিধর্ম পিটক।
ত্রিপিটক পালি ভাষায় রচিত। বুদ্ধের শিষ্যরা তাঁর উপদেশসমূহ মুখস্থ করে রাখতেন। তখন লিখন পদ্ধতির খুব বেশি প্রচলন ছিল না। সে কারণে বুদ্ধবাণী ত্রিপিটকে শিষ্য পরম্পরা মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল।
ইতোপূর্বে তোমরা বিনয় পিটক ও সূত্র পিটক সম্বন্ধে জেনেছ। অভিধর্ম হলো ত্রিপিটকের তৃতীয় ভাগ। এখন আমরা অভিধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস এবং অভিধর্ম পিটকের অন্তর্গত গ্রন্থগুলোর বিষয়বস্তু সংক্ষেপে জানব।
ত্রিপিটক সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পূর্বের পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। এতে দেখা যায়, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ প্রধানত ধর্ম ও বিনয় এই দুই ভাগে বিভক্ত। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিন মাস পর প্রথম সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ধর্ম (সুত্ত) ও বিনয়ের সঙ্ঘায়ন হয়েছিল। এর একশত বছর পর যশ স্থবির কর্তৃক দ্বিতীয় সংগীতি আহবান করা হয়। এতেও আগের মতো ধর্ম(সুত্ত) ও বিনয়ের সঙ্ঘায়ন হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে তৃতীয় সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ বিনয়, সূত্র ও অভিধর্ম এই তিন ভাগে বিভক্ত করে পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক রচিত হয়। এ সময় অভিধর্ম পিটকের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
সম্রাট অশোকের পুত্র থের মহেন্দ্র সিংহলে ধর্ম প্রচারে গমনকালে এ ত্রিপিটক সঙ্গে নিয়ে যান। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সিংহলের রাজা বট্রগামিনীর রাজত্বকালে ত্রিপিটক প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়।
নবাঙ্গ সথুসাসন
ত্রিপিটকের মধ্যে অনেক জায়গায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের নয়টি অঙ্গ বা ত্রিপিটকের নয়টি বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নয়টি বিভাগকে ‘নবাঙ্গ সথুসাসন' বলা হয়। এই বিভাগ ত্রিপিটকের সম্পূর্ণ গ্রন্থকে বা কোনো বিশেষ বিশেষ গ্রন্থকে বোঝায় না। এই বিভাগ হলো বিষয়বস্তু অনুযায়ী ত্রিপিটকের বিভাজন। নবাঙ্গ সথুসাসনের নয়টি ভাগের নাম হলো : সুত্ত, গেয্য, বৈয্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অভূতধৰ্ম্ম ও বেদল্ল।
অভিধর্মের উৎপত্তি
অভিধর্ম ত্রিপিটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়। অভিধর্মকে ত্রিপিটকের হূৎপিণ্ড বলা হয়।
মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ প্রথমে অন্যান্য ধর্মবাণী ঘোষণা করলেও অভিধর্ম বিষয়ে দেশনা করতে চাননি। কারণ সাধারণ মানুষ ও দেবগণ জটিল দর্শন ও মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করতে পারবে না। সে কারণে প্রথম সূত্র ও বিনয় বিষয়ে দেশনা করেন।
বুদ্ধ কালজ্ঞ, সর্বজ্ঞ ও ত্রিলোক জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভ করার পর সপ্ত স্থানে বুদ্ধ অধিগত জ্ঞান ও ধর্মের তাৎপর্য চিন্তা করেন। ষষ্ঠতম সপ্তাহ দিবসে অভিধর্ম পিটকের ছয়টি গ্রন্থ নিয়ে চিন্তা করেন। সপ্তম সপ্তাহে সপ্তপ্রকরণ অভিধর্ম সম্পন্ন করেন।
এরপর বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তিনি তিন মাসব্যাপী মাতৃদেবী দেবতাদের প্রথম অভিধর্ম দেশনা করেন।
তাবতিংস দেবলোক থেকে মর্ত্যে এসে মানবকল্যাণে অভিধর্ম দেশনা করেন। এভাবেই অভিধর্মের উৎপত্তি হয় ।
অভিধর্ম পিটক কী?
তোমরা পূর্বেই জেনেছ, অভিধর্ম ত্রিপিটকের তৃতীয় ভাগ। এটি ত্রিপিটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পালি সাহিত্য মতে, ধর্ম ও অভিধর্মের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। শুধু ধর্মের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলোকে অধিক গুরুত্ব দানের জন্য ‘অভি’ উপসর্গটি যুক্ত করা হয়েছে। অভিধর্ম শব্দের অর্থ বিশিষ্ট ধর্ম, অতিরিক্ত ধর্ম, অধিকতর ধর্ম। তাই বলা হয় সূত্রাতিরিক্ত ধর্মই অভিধর্ম। বিশেষত চিত্ত, চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণ—এ চারটি বিষয়ে সূক্ষ্মভাবে আলোচনা করা হয়েছে অভিধর্ম পিটকে ।
অভিধর্ম পিটকে যেসব গ্রন্থ রয়েছে সেগুলোর নাম ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা দরকার। অভিধর্ম পিটকে মোট সাতটি গ্রন্থ আছে। এ সাতটি গ্রন্থের সমষ্টিকে সপ্তপ্রকরণ বলা হয়। যথা : ১. ধম্মসঙ্গনি, ২. বিভঙ্গ ৩. ধাতুকথা ৪. পুগ্গল পঞ্ঞত্তি ৫. কথাবন্ধু ৬. যমক ৭. পঠান।
প্রতিটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো-
১. ধম্মসঙ্গনি: এর অর্থ ধর্মের সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা। এটি অভিধর্ম পিটকের সারাংশ। এতে চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয়, জড় পদার্থের বর্ণনা আছে। বিশেষ করে কুশল ও অকুশল চিত্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। ধর্মসঙ্গনির বিষয়বস্তু দর্শনতাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমূলক।
২. বিভঙ্গ: এ গ্রন্থের বিষয়ও দর্শনতাত্ত্বিক । এতে স্কন্ধ, ধাতু, ইন্দ্রিয়, তথা আমাদের শরীর ও মনের বিশদ ব্যাখ্যা আছে। পঞ্চস্কন্ধ হলো রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। এর বিষয়বস্তু অতি চমৎকার।
৩. ধাতুকথা: ধাতুকথা শব্দের অর্থ ‘ধাতু’ সম্পর্কীয় কথা। বৌদ্ধধর্ম দর্শনের বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ের তত্ত্বমূলক ব্যাখ্যা গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। তাই এটি বৌদ্ধধর্মের অন্যতম দর্শনশাস্ত্র। এতে ধ্যানপরায়ণ ভিক্ষুর মানসিক বৃত্তি সম্পর্কিত আলোচনা আছে। এছাড়াও পঞ্চস্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, ধ্যান প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে।
৪. পুগ্গল পঞ্ঞত্তি: ‘পুগ্গল' শব্দের অর্থ ব্যক্তি, যা দ্বারা মানুষকে বোঝায়। ‘পঞ্ঞত্তি’ হলো প্রজ্ঞপ্তি, প্রকাশ বা পরিচয়। বিভিন্ন প্রকার পুরুষের যথার্থ পরিচয় তুলে ধরাই এ গ্রন্থের বিশেষত্ব। এ গ্রন্থে স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, সত্য, ইন্দ্রিয় এবং পুদ্গল এই ছয় প্রকার প্রজ্ঞপ্তির উল্লেখ আছে ।
৫. কথাবন্ধু: এটি অভিধর্মের পঞ্চম গ্রন্থ। একে বৌদ্ধধর্ম দর্শন সম্পর্কিত তর্কশাস্ত্র বলা হয়। তৃতীয় সংগীতি শেষে মোগ্গলিপুত্ত তিষ্য স্থবির কথাবন্ধু রচনা করেন। মূলত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মিথ্যাদৃষ্টি খণ্ডনই এ গ্রন্থ রচনার প্রধান উদ্দেশ্য। কথাবন্ধু তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত। পালি ত্রিপিটক সাহিত্যে কথাবন্ধু গ্রন্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মোগলিপুত্র তিষ্য স্থবির এই গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন থেরবাদ বা স্থবিরবাদই বুদ্ধের মূল নীতি। এটাকে বিভজ্যবাদও বলা হয়। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কথাবন্ধু একটি অতি মূল্যবান গ্রন্থ।
৬. যমক: ‘যমক’ শব্দটি জোড়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । গ্রন্থটিতে স্বপক্ষীয় ও প্রতিপক্ষীয় প্রশ্নের সহজ সমাধান রয়েছে। এতে কুশল, অকুশল ও তাদের মূল সম্পর্কে আলোচনা আছে। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে রচিত এবং দশ প্রকার যমকে বিভক্ত। যেমন- মূল যমক, খন্ধ যমক, চিত্ত যমক, সচ্চ যমক ইত্যাদি।
৭. পঠান: ‘পট্ঠান' শব্দের অর্থ মূল কারণ বা প্রকৃত কারণ। এর বিষয়বস্তু প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কিত। বিশেষত নামরূপ বা শরীর ও মনের অনিত্যতা ও অনাত্মা সম্পর্কে আলোচনাই এ গ্রন্থে গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন- ১. আলম্বন ২. ধর্মনিশ্রয় ৩. কর্ম এবং ৪ অস্ত্রি। নির্বাণ ব্যতীত সমস্ত জাগতিক বস্তুর কার্যকারণ নির্ণয় করাই এর প্রতিপাদ্য বিষয় ।
অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থগুলো ধর্ম ও দর্শনের মৌলিক ধারণা ও জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক। বৌদ্ধদর্শন ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব গ্রন্থ পাঠ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
১. অভিধর্ম পিটক ত্রিপিটকের ___ বিভাগ ৷
২. বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ___ পর প্রথম সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়।
৩. কথাবথুকে বৌদ্ধধর্ম দর্শন সম্পর্কিত ___ বলা হয়।
৪. মোগ্গলিপুত্ত তিষ্য স্থবির ___ রচনা করেন।
৫. যমক শব্দটি ___ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৬. পট্ঠান শব্দের অর্থ ___ বা ___।
বাম | ডান |
---|---|
১. সাধারণ মানুষের মুখের ২. বুদ্ধের শিষ্যরা তাঁর উপদেশসমূহ ৩. বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পর ৪. বুদ্ধ কালজ্ঞ, সর্বজ্ঞ ও ৫. ধাতুকথা বৌদ্ধধর্মের ৬. ধর্মসঙ্গনির বিষয়বস্তু | ১. প্রথম সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। ২. অন্যতম দর্শনশাস্ত্র । ৩. ভাষা ছিল পালি । ৪. মুখস্থ করে রাখতেন। ৫. ত্রিলোক জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। ৬. চিত্ত হলো মানুষের মন। ৭. দর্শনতাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমূলক। |
১. ত্রিপিটক কয় ভাগে বিভক্ত ও কী কী ?
২. নবাঙ্গ সথুসাসন বলতে কী বোঝ?
৩. অভিধর্ম পিটককে সপ্তপ্রকরণ বলা হয় কেন ?
৪. পঞ্চস্কন্ধ কী কী?
৫. অভিধর্ম পিটকের চারটি প্রধান আলোচ্য বিষয় কী কী?
৬. কখন ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করা হয়?
১. অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থগুলোর নাম লিখে যেকোনো দুটি গ্রন্থের বর্ণনা দাও।
২. ধর্মসঙ্গনি ও বিভঙ্গ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ৷
৩. পুগ্গল শব্দের অর্থ কী? এ গ্রন্থের বিশেষত্ব কী ?
৪. কথাবন্ধু গ্রন্থ কে রচনা করেন? এ গ্রন্থের বিশেষত্ব কী?
৫. পঠান শব্দের অর্থ কী? এ গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা কর।
৬. যমক কাকে বলে? যমক গ্রন্থের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লেখ ।
আরও দেখুন...