দশে মিলে করি কাজ

সপ্তম শ্রেণি (দাখিল) - জীবন ও জীবিকা - NCTB BOOK

পল্লবী ও তার দলের কৃতিত্ব: কার্যকর যোগাযোগ

পল্লবীরা একটা কলোনিতে থাকে। তাদের এখানে সাতটা বাড়ির পর একটু করে খোলা জায়গা। স্কুল থেকে ফিরে সারাটা বিকেল তারা ওখানেই কাটায়। কখনও দাঁড়িয়াবান্ধা, কখনও বৌচি, কখনও বা সাত চাড়া। টিমের সবাই না থাকলে চলে হৈহৈ রৈরৈ আড্ডা। তাই এই জায়গাটুকুই তাদের প্রাণ। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ওরা দেখল, রাজমিস্ত্রি কাজে লেগেছে, পাশের বাড়ির সঙ্গে জোড়া দিয়ে বাউন্ডারি টেনে দিচ্ছে জায়গাটায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ভ হয়ে গেল। সবাই মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল, ঘটনাটা কেন ঘটছে, কে কে এর সঙ্গে জড়িত, কী লাভ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির, কীভাবে তাদের খেলার জায়গা ফিরিয়ে আনা যায় ইত্যাদি নিয়ে। এক এক করে সবার মতামত ও বুদ্ধিগুলো জেনে নিল পল্লবী। সবার পরামর্শগুলোর ভালো-মন্দ দেখে নিয়ে ওরা ঠিক করল, আগে মূল তথ্য দরকার। তাই মূল ঘটনার তথ্য আবিষ্কারের দায়িত্ব দিল শিবু, প্রভা আর লিটনকে।

এক দিনের মধ্যেই তথ্য চলে এল পল্লবীর কাছে, পাশের বাড়ির টাকাওয়ালা মালিক ক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে ঐ ফাঁকা জায়গা দখল নিচ্ছে! খুদে গোয়েন্দারা পড়ল মহা বিপদে! কীভাবে লড়াইটা করা যায়, আলোচনা করতে লাগল। সবাই মিলে ঠিক করল, এর আগে এলাকার ডাস্টবিন সমস্যাটা যেহেতু কমিশনার সমাধান করে দিয়েছিলেন, সুতরাং এই বিষয়টাও তারা এলাকার কমিশনারকে জানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ, ভাগ্য ভালো, কমিশনার সেদিন বিকেলে তার বাড়িতেই ছিলেন এবং সবাই মিলে তাকে তাদের যুক্তি ও অধিকার বোঝাতে সক্ষম হলো। তিনি কয়েকজন লোক নিয়ে দেখতে এলেন এবং মিস্ত্রিদের কাজ বন্ধ করতে বললেন। এতেই ঘটে গেল লঙ্কাকান্ড। টাকাওয়ালা বাড়ি থেকে বের হয়ে কমিশনারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু করে দিলেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি খারাপ দেখে পল্লবী ও তার দল ছুটে গিয়ে আশপাশের বাড়িগুলো থেকে গণ্যমান্য কয়েকজনকে এনে এখানে জড়ো করে ফেলল। তমুল হৈচৈ শেষে সালিশের তারিখ পড়ল। পল্লবী ও তার দল সেই তারিখে কীভাবে তাদের দাবি পেশ করবে তার পরিকল্পনা করলো।। পাশাপাশি তাদের যৌক্তিক/ নির্দোষ চাহিদার বিষয়ে পাড়ার মুরব্বিদের ভালোমতো বোঝানোর কাজটাও সেরে নিল। বিচারের রায় হলো ওদের পক্ষেই! উঠে গেল বাউন্ডারি। উন্মুক্ত হলো পল্লবীদের উড়ে বেড়ানোর জায়গাটুকু!

পল্লবীরা খেলার জায়গা উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? 
পল্লবী ও তার দলের কী কী দক্ষতা সমস্যাটির সমাধানে ভূমিকা রেখেছে? 

পল্লবী ও তার দলের বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের ফসল হিসেবে তাদের খেলার জায়গাটুকু তারা ফেরত পেয়েছে। দলের সবার কিছু বিশেষ গুণ ছিল যা তাদের জয়ী হতে সাহায্য করেছে। আমরা এখন যেই শতকে বাস করছি, সেখানে এখন একটা থিম ব্যাপকতা পাচ্ছে, তা হলো- 'Communication is Power' অর্থাৎ 'যোগাযোগই শক্তি'। যেকোনো সমস্যা সমাধানেই যোগাযোগ হলো বড় শক্তি। আমরা গল্পে দেখেছি পল্লবী ও তার দলের কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতার প্রভাব কীভাবে তাদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা রেখেছে। সমস্যা সমাধানে তাদের দলের সদস্যরা এই রকম আরও যেসব দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছে, সেগুলোর কেতাবি নামের সঙ্গে চলো পরিচিত হই-

ক. বিশ্লেষণধর্মী চিন্তন / Analytical Thinking

শুরুতেই তারা কোনোরকম হৈচৈ না করে ঘটনাটা কেন ঘটছে, কে কে এর সঙ্গে জড়িত, কী লাভ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির, কীভাবে তাদের খেলার জায়গা ফিরিয়ে আনা যায় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করল অর্থাৎ সমস্যাটা বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেছে এবং এগুলোর সম্ভাব্য উত্তরগুলো নিয়ে আলোচনা করে কী করতে হবে তা ঠিক করেছে।

খ. সহযোগীধর্মী চিন্তন / Collaborative Thinking

পল্লবী এককভাবে সমস্যা সমাধানের কথা ভাবেনি। আমরা দেখেছি, সে তার দলের সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে সবার মতামত নিয়েছে, নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। কমিশনার ও পাড়ার মুরব্বিদের সঙ্গে জনসংযোগ রক্ষা করেছে।

গ. প্রতিফলিত চিন্তা / Reflective Thinking

দলের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর তারা তাদের আগের দিনের আলোচনায় যেসব অনুমান করেছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখল, এরপর তারা ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া অন্য একটি সমস্যার সমাধান কীভাবে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঐ মুহূর্তে তাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করল।

ঘ. দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনা/ Conflict Management

গল্পে এই কাজটি করেছেন পাড়ার মুরব্বিরা। তারা উভয় পক্ষের মতামত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শুনেছেন এবং মূল দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। পল্লবীর দলের সদস্যরাও তাদের দ্বন্দ্বের কারণটা সুন্দরভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল

ঙ. মূল্যায়ন Evaluating or Apprising

গল্পে পল্লবীও তার দল এলাকার কমিশনার ও পাড়ার মুরব্বিদের কাছে নিজেদের পক্ষের যুক্তিগুলো পরিষ্কারভাবে উত্থাপন করেছে, অপর পক্ষ থেকে কী কী যুক্তি আসতে পারে সেগুলো ভেবেছে, নিজেদেরকে পরিস্থিতি অনুযায়ী উত্তরের জন্য প্রস্তুত রেখেছে এবং প্রতিটি উদ্যোগে তারা বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথাৎ ভালো-মন্দ ও প্রভাব ইত্যাদি ভেবে কাজ করেছে।

কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতার অনুশীলন

ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা জেনেছিলাম, যোগাযোগ দক্ষতা হলো নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করা এবং অন্যের দেওয়া তথ্য সঠিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা; অন্যের কথা মনোযোগের সঙ্গে এবং সক্রিয়ভাবে শোনার দক্ষতা। আমরা আরও জেনেছিলাম- আমরা একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে থাকি। কখনও লিখিতভাবে, কখনও মৌখিকভাবে, আবার কখনও শরীরী ভাষায়। আমরা যখন কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারি, তখন তা হয় কার্যকর যোগাযোগ। কার্যকর যোগাযোগে কোনোভাবেই ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে না। কেননা, এই ধরনের যোগাযোগ অন্যকে দোষারোপ করা বা আঘাত করে কথা বলার প্রবণতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত।

আমাদের প্রায় সবার মধ্যেই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা থাকে। কিন্তু আমরা হয়তো সবাই প্রয়োজন অনুযায়ী সেই সক্ষমতাগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে জানি না। ফলে অনেক সময় ছোট ছোট সমস্যারও সমাধান করতে পারিনা। তাই আমরা যদি আমাদের এই সক্ষমতাগুলো সক্রিয় উপায়ে কাজে লাগাতে চাই, তাহলে কার্যকর অনুশীলনের মাধ্যমে তা আয়ত্ব করা সম্ভব।

এখানে দুটি পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। চলো আমরা দলগতভাবে আলোচনা করে এগুলোর কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করি।

সমস্যা ১

শিপ্রা সব বিষয়েই একটু খামখেয়ালি এবং উদাসীন। সে গত পরশু স্কুল থেকে বাসায় না ফিরে তার এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে চলে যায়। তার বাবা নেই, তবে আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। মা তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় অস্থির হয়ে উঠেন। শিপ্রা রাত নটায় বাড়ি ফিরে এলে মায়ের সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মা খেপে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি শিপ্রাকে আর স্কুলে যেতে দেবেন না। শিপ্রাও খেপে গিয়ে বলে, সে আর কোনোদিন স্কুলে যাবে না। বান্ধবীদের সাথেও কোনো যোগাযোগ রাখবে না।

শিপ্রার বন্ধু হিসেবে আমরা কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারি?

[সম্ভাব্য উদ্যোগ: আগ্রহ নিয়ে উভয়ের কথা শোনা; পড়াশোনা বন্ধ করে দিলে তার প্রভাব কী হতে পারে নিয়ে আলোচনা করা; শিপ্রার আচরণ কীভাবে পরিবর্তন করা যায়; মা কীভাবে শিপ্রাকে সহযোগিতা করতে পারেন, ইত্যাদি]

 

 

 

 

 

সমস্যা ২

সজীব খুব মেধাবী শিক্ষার্থী। কিন্তু আজকাল সে লেখাপড়ায় ভীষণ অমনোযোগী হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ বাসায় থাকে, শুধু টিভি দেখে, মোবাইল ফোন, টিভি অথবা কম্পিউটারে গেম খেলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে একেবারেই কথা বলে না। বাসায় মেহমান এলে তাদের সঙ্গে কথা বলে না। সে খাবার খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেও প্রচণ্ড রেগে যায়। বাড়িতে ছোট বোনের সঙ্গেও অকারণে দুর্ব্যবহার করে। গোসল ও খাওয়ার কোনো নিয়ম মানছে না। সজীবের বাবা অনেকভাবেই তাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। স্কুল থেকেও তার নামে আজকাল অভিযোগ আসছে। পাশেই স্বপনদের বাড়ি। স্বপন সজীবের সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। সজীবের মা প্রায়ই স্বপনদের বাড়িতে এসে সজীবের ব্যাপার নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশ করেন এবং কান্নাকাটি করেন।

প্রতিবেশী হিসেবে এই পরিস্থিতিতে কীভাবে আমরা সজিব ও তার পরিবারকে সহায়তা করতে পারি?

 

 

 

 

 

 

 

আমাদের মনে রাখতে হবে, যেকোনো কাজ করতে গেলে কোনো না কোনো সমস্যা সামনে আসবেই। সমস্যার সবটাই একবারে সমাধান হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। এ জন্য সমস্যাগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিতে হয়। একেকটা সমাধান পরে জোড়া দিয়ে পুরোটার সমাধান করা সম্ভব হয়। আমরা যখন কোনো গাণিতিক সমস্যার সমাধান করি, তখনও এভাবে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। জীবনের সমস্যাগুলো সব গাণিতিক নিয়মের মধ্যে না পড়লেও সেই জ্ঞানের প্রয়োগে সফলতা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

তবে অনেক সময় দেখা যায়, কেউ সমস্যায় পড়লে তাকে আমরা এড়িয়ে চলি। 'চাচা আপন প্রাণ বাঁচা' ধরনের মানসিকতা প্রদর্শন করি। আমরা ভুলে যাই যে আমরা সামাজিক জীব। অথচ একবারও ভেবে দেখি না, ‘অন্ধের দেশে কানা রাজা হয়ে কী লাভ?' আমরা প্রায়ই ক্লাস নোট অন্যকে দিতে চাইনা বা লুকিয়ে রাখি, কেউ পড়া না পারলে বা না বুঝলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করি। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে একা সফল হওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সত্যিকারের সাফল্য।

দলগত কাজ

সমস্যা ১ ও সমস্যা ২ এর জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের রিহার্সেল হিসেবে কয়েকটি কথোপকথনের দৃশ্য সাজাও।

দলে ভাগ হয়ে শিপ্রা ও সজীবের সঙ্গে কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রিপ্ট বানাও এবং তা ভূমিকাভিনয় করে দেখাও।

ক. শিপ্রা ও তার মায়ের সঙ্গে কথোপকথন
মায়ের সাথে আলোচনা

[আগ্রহ নিয়ে উভয়ের কথা শোনা; পড়াশোনা বন্ধ করে দিলে তার প্রভাব কী হতে পারে নিয়ে আলোচনা করা; শিপ্রার আচরণ কীভাবে পরিবর্তন করা যায়; মা কীভাবে শিপ্রাকে | সহযোগিতা করতে পারেন, ইত্যাদি।]

 

শিপ্রার সাথে আলাপ

 

 

 

একসঙ্গে উভয়ের সাথে কথোপকথন

 

 

 
খ) সজীব ও তার পরিবারের সঙ্গে কথোপকথন
মায়ের সাথে আলোচনা

 

 

 

বাবার সাথে আলোচনা

 

 

 

সজীবের সঙ্গে আলোচনা

 

 

 

 

সমস্যার সমাধান করা

ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা সমস্যা কী; কীভাবে সমস্যা চিহ্নিত করতে হয়; চিহ্নিত সমস্যার তালিকা থেকে কোন সমস্যাটি অগ্রগণ্য বা প্রথমে সমাধানযোগ্য; কীভাবে সমাধানের উপায় অন্বেষণ করতে হয়; কীভাবে সমস্যা সমাধানে প্রয়াস নিতে হয় তা জেনেছি এবং তার ওপর কিছু অনুশীলনও করেছি। এখানে আমরা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

আমাদের চারপাশে পথ চলতে গিয়ে আমরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি। সেগুলো হতে পারে ব্যক্তিগত পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা। সমস্যা যে ধরনেরই সমস্যা হোক না কেন তা থেকে উত্তরণের উপায় বের করার জন্য মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকগণ নানা ধরনের গবেষণা করে আসছেন। সম্প্রতি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সলিউশন ফ্লুয়েন্সি (Solution Fluency) নামক একটি পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানে ছয়টি ধাপের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো 'সিক্স ডি' নামে পরিচিত।

১ম ধাপ: সংজ্ঞায়ন / Define

সমস্যাটি কী তা খুঁজে বের করতে হবে। এর সমাধান করা হলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে কি না, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে নিজের কাছে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করতে হবে। এমনও হতে পারে, আমরা যেটাকে সমস্যা ভাবছি তা আদৌ কোনো সমস্যাই না। এ কারণে শুরুতেই যে বিষয়ে নিয়ে সমস্যা অনুভব করছি, তার ধরন ও বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রভাবে কী কী ক্ষতি হচ্ছে, সমাধান হলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে তা চিন্তা করে দেখে একটি পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে।

২য় ধাপ: আবিষ্কার করা / Discover

যে সমস্যাটি আমাদের সামনে এসেছে, তার মূল উৎস কী তা খুঁজে বের করতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে সমস্যাটি তৈরি হলো বা কোন কারণে এ রকম একটি সমস্যার সৃষ্টি হলো তা আবিষ্কার করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সমস্যার পিছনে কারা দায়ী তা বের করতে হবে এই ধাপে।

৩য় ধাপ: স্বপ্ন দেখা / Dream

এই ধাপে আমাদেরকে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য সমাধান ভাবতে হবে। অর্থাৎ সমাধানের উপায়গুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে। যেকোনো সমস্যা সমাধানে প্রখর কল্পনাশক্তি বা স্বপ্ন দেখার দক্ষতা থাকতে হয়। একবার আইনস্টাইনকে এক মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার ছেলেটাকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী করতে হবে?"

আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওকে রূপকথা পড়ে শোনান। আর আমার চেয়েও বড় বিজ্ঞানী যদি বানাতে চান, তবে তাকে আরও বেশি করে রূপকথা শোনান!' সৃজনশীল চিন্তা দিয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বা সমাধান কল্পনা করতে পারা একটি বিশেষ গুণ। এই ধাপে আমাদের সেই কাজটিই করার চেষ্টা চালাতে হবে।

৪র্থ ধাপ: নকশা করা / Design

তৃতীয় ধাপে সমস্যা সমাধানের যে উপায়গুলো কল্পনা করা হয়েছে, সেগুলো যুক্তি দিয়ে যাচাই-বাছাই করে তার মধ্য থেকে একটি গ্রহণযোগ্য উপায় বেছে নিতে হবে। উক্ত উপায়টি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি নকশা বা পরিকল্পনা করতে হবে। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে, উপায়টি যেন সবচেয়ে সহজ ও সুবিধাজনক হয় । কেননা, যে উপায়ের বাস্তবায়ন আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, সেটির নকশা করতে গেলে আরও নতুন সমস্যা তৈরি হতে পারে।

৫ম ধাপ: উম্মুক্ত করা / Deliver

নকশা করা হয়ে গেলে পুরো বিষয়টির রূপরেখা বা অবয়ব মেলে ধরতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জন্য। পুরো অবয়ব (স্টোরিলাইন) উন্মুক্ত করা হলে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই নতুন করে আমাদের চোখে ধরা পড়তে পারে। নকশা বা পরিকল্পনার কোথাও কোনো ঘাটতি (গ্যাপ) আছে কি না তা একসঙ্গে সবটা দেখলে বের হয়ে আসবে। তখন সেগুলোকে আমরা নিখুঁতভাবে পুনরায় ছক এঁকে নিতে পারব।

৬ষ্ঠ ধাপ: আলোচনা-সমালোচনা করা / Debrief

এই ধাপে তৈরি করা নকশার সঙ্গে আমাদের আগের কোনো সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতার তুলনা করে দেখতে হবে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ কোনো শিক্ষা (learning) থাকলে তা এখানে সমন্বয়ের চেষ্টা করতে হবে। আগের সমস্যায় নেওয়া পদক্ষেপ ও বাস্তবায়নের কৌশলের সঙ্গে বর্তমানের নকশা পাশাপাশি রেখে দুটোর আলোচনা সমালোচনা করে দেখতে হবে। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ ও কার্যকর হবে।

এভাবেই আমরা যেকোনো সমস্যাকে ছয়টি ধাপের পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এর সমাধানের চেষ্টা চালাতে পারি।

প্রজেক্ট ওয়ার্ক

নিজেদের বিদ্যালয় বা পরিবার বা নিজেদের বিল্ডিং বা পাড়া বা এলাকার কোনো একটি সমস্যা খুঁজে বের করো। উক্ত সমস্যাটি সমাধানের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করো। সমস্যার সমাধানের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়নের পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ করো। সমস্যার সমাধান করে পুরো ঘটনা বা অভিজ্ঞতার | বর্ণনা (স্টোরিলাইন) উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন লেখো।

যেভাবে কাজটি করবে

• এলাকা বা পাড়াভিত্তিক ছয়টি দলে বিভক্ত হয়ে যাও। 

• ষষ্ঠ শ্রেণির জীবন ও জীবিকা পাঠ্যপুস্তকের ‘দশে মিলে করি কাজ' অধ্যায়টি ভালোভাবে পড়ে দলের সবাই মিলে আলোচনা করে ভালোভাবে বুঝে নাও; প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তা নাও। 

• ছোট পরিসরের কোনো সমস্যা যা তোমাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব, এ রকম একটি বেছে নাও । 

• সলিউশন ফ্লুয়েন্সির ধাপগুলো অনুসরণ করে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নাও । 

• ছয়টি দল ছয়টি সমস্যা নিয়ে কাজ করবে, একই সমস্যা নিয়ে একের অধিক দল কাজ করবে না। 

• সমস্যা খুঁজে বের করা ও সমাধানের জন্য প্রয়োজন হলে শিক্ষক, বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, পরিবার বা এলাকার অভিজ্ঞ লোকজনের সহায়তা নিতে পারো। 

• কাজটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করে একটি অভিজ্ঞতার গল্প লিখতে পারো। 

• গল্পে সমস্যার আগে ও পরের ছবি তুলে বা এঁকে যুক্ত করতে পারো।

• পুরো ঘটনার ফ্লোচার্ট আঁকতে পারো।

• তোমাদের নিজেদের স্বাধীন চিন্তা, অভিরুচি ও সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে কাজটি করতে পারো।

                                           প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সংকেত

• নিজেদের শ্রেণিকক্ষে খাবার পানি না থাকা

• নিজেদের শ্রেণিকক্ষে বিন না থাকা

• নিজেদের শ্রেণিকক্ষে ডিসপ্লে বোর্ড না থাকা

• টিফিন পিরিয়ডে স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা না থাকা

• বিদ্যালয়ে খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকা

• প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থার অভাব

• বিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থীর বুলিং করার প্রবণতা বা কোনো শিক্ষার্থী বুলিং এর শিকার হওয়া

• রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা পড়ে থাকা

• বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া

• এলাকার প্রচলিত কোনো কুসংস্কারের বলি হওয়া

• স্কুলে আসা যাওয়ার পথে সহপাঠী বা স্কুলের অন্য কোনো শিক্ষার্থী দ্বারা হেনস্তা হওয়া

• বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে কারও খারাপ আচরণ করার অভ্যাস ইত্যাদি

একটি শিশু যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে সাদা কাগজের মতো প্রায় শূন্য দক্ষতা নিয়ে জন্মায়। এরপর ধীরে ধীরে নানা অভিজ্ঞতা আর সমস্যা পাড়ি দিতে দিতে একসময় অনেক ধরনের দক্ষতা অর্জন করে। যেকোনো দক্ষতা অনুশীলন বা চর্চার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধান দক্ষতাও অনুশীলনের মাধ্যমেই শানিত করা সম্ভব। তাই আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য নিয়মিত চর্চা অব্যাহত রাখব।

১.। কার্যকর যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের কোন কোন দক্ষতা তোমার মধ্যে আছে এবং কোন কোন দক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন তার একটি তালিকা প্রস্তুত করো।

২.। এই অধ্যায়ে আমরা যা যা করেছি......... (√ টিক চিহ্ন দাও)

কাজসমূহকরতে পারিনি। (১)আংশিক করেছি (৩)ভালোভাবে করেছি (৫)
'পল্লবী ও তার দল' –এই কেসস্টাডিটি বিশ্লেষণ করা   
কেসস্টাডির মাধ্যমে কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতার অনুশীলন করা   
সমস্যা ১ এর কথোপকথন স্ক্রিপ্ট তৈরি করা   
সমস্যা ২ এর কথোপকথন স্ক্রিপ্ট তৈরি করা   
প্রজেক্ট ওয়ার্ক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা   
প্রজেক্ট ওয়ার্ক কার্যক্রমের প্রতিবেদন জমা দেওয়া   
মোট স্কোর: ৩০আমার প্রাপ্ত স্কোর :
আমার অভিভাবকের মন্তব্য:
শিক্ষকের মন্তব্য:

এই অধ্যায়ের যেসব বিষয় আমাকে আরও ভালোভাবে জানতে হবে তা লিখি-

 

 

যে কাজগুলোর নিয়মিত চর্চা আমাকে চালিয়ে যেতে হবে সেগুলো লিখি-

 

 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion