ধর্মগ্রন্থে ধর্মের কথা থাকে, মানুষের কল্যাণের কথা থাকে। ঈশ্বরের মাহাত্ম্য, দেব-দেবীর উপাখ্যান, সমাজ ও জীবন সম্পর্কে নানা উপদেশমূলক কাহিনী প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের বিষয়বস্তু। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে আমাদের কল্যাণ হয়। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি আমাদের ধর্মগ্রন্থ। বেদ আমাদের আদি ধর্মগ্রন্থ। এ অধ্যায় থেকে আমরা সংক্ষেপে পুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডী সম্পর্কে জানব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা -
হিন্দুধর্মের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে পুরাণ অন্যতম। 'পুরাণ' শব্দটির অর্থ হচ্ছে পুরাতন বা প্রাচীন। কিন্তু এখানে পুরাণ শব্দটিকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। পুরাণ হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক শ্রেণির ধর্মগ্রন্থ। সেখানে সৃষ্টি ও দেবতাদের উপাখ্যান, ঋষি ও রাজাদের বংশ, পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিচিতি, তীর্থমাহাত্ম্য, দান, ব্রত, তপস্যা, আয়ুর্বেদ (চিকিৎসাশাস্ত্র) প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে। পুরাণ বলতে একটিমাত্র গ্রন্থ বোঝায় না। পুরাণ বহু গ্রন্থের সমষ্টি। সুতরাং পুরাণকে শুধু মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব পুরাণসমূহেরও রচয়িতা। গল্প বলার ছলে পুরাণগুলো রচিত। মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। পুরাণে গল্প শোনানো হয়েছে। সে গল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মজীবন ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। মানুষকে কল্যাণকর সুন্দর জীবন সম্পর্কে গল্পের মাধ্যমে উপদেশ ও নীতি শিক্ষা প্রদান পুরাণের মূল বিষয়বস্তু। পুরাণের সংখ্যা অনেক। তবে প্রধান প্রধান পুরাণের সংখ্যা আঠার। এই আঠারটি পুরাণ হচ্ছে-(১) ব্রহ্ম পুরাণ (২) পদ্ম পুরাণ (৩) বিষ্ণু পুরাণ (৪) শিব পুরাণ বা বায়ু পুরাণ (৫) ভাগবত পুরাণ (৬) নারদ পুরাণ (৭) মার্কণ্ডেয় পুরাণ (৮) অগ্নি পুরাণ (৯) ভবিষ্য পুরাণ (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (১১) বরাহ পুরাণ (১২) লিঙ্গ পুরাণ (১৩) স্কন্দ পুরাণ (১৪) বামন পুরাণ (১৫) কূর্ম পুরাণ (১৬) মৎস্য পুরাণ (১৭) গরুড় পুরাণ (১৮) ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। এ পুরাণগুলো অনুসরণে কিছু উপ-পুরাণও রচিত হয়েছে। যেমন- বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ।
পুরাণের মধ্যে তিনজন দেবতার মাহাত্ম্য বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এঁরা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব।
একক কাজ: পুরাণসমূহের নাম লেখ। |
নতুন শব্দ: মার্কণ্ডেয়, ব্রহ্মবৈবর্ত, বরাহ, স্কন্দ, বামন, কূর্ম, গরুড়।
পুরাণ নানা বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট। শাস্ত্রে পুরাণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-
সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরাণি চ।
বংশানুচরিতঞ্চৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্।। (বায়ুপুরাণ)
অর্থাৎ পুরাণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত। সর্গ মানে সৃষ্টি। কীভাবে জীব -জগতের সৃষ্টি হলো, গল্পের আকারে তা পুরাণে আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিসর্গ মানে পুনরায় সৃষ্টি। জীব জগতের সবকিছুর বিনাশ হওয়ার পর আবার নতুন করে সবকিছু সৃষ্টি হয়। একেই বলে প্রতিসর্গ। দেবতা ও ঋষিদের বর্ণনাই হলো বংশ। একেকবার সৃষ্টির পর তা ধ্বংস হয় এবং তার স্থলে নতুন 'সৃষ্টি' জেগে ওঠে। প্রতিটি সৃষ্টির আদি পুরুষ হলেন মনু।
এভাবে চৌদ্দজন মনুর কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। এক মনু থেকে আরেক মনুর কালের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে বলা হয় মন্বন্তর। আর বংশানুচরিত হচ্ছে দেবতা, ঋষি বা বিখ্যাত রাজাদের জীবনচরিত। এ ছাড়া পুরাণে রয়েছে বর্ণাশ্রম ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ, দান, পূজা, ব্রত ও তীর্থস্থানের বর্ণনাসহ অনেক বিষয়। মোটকথা, পুরাণের মধ্যে সেকালের ধর্ম এবং জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। আমাদের ধর্ম এবং জীবনে পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম। কত গল্প, কত উপাখ্যান, কত উপদেশ, জীবনের উত্থান ও পতনের কত কথা যে পুরাণে রয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না।
একক কাজ: পুরাণের বিষয়বস্তুসমূহ চিহ্নিত কর। |
নতুন শব্দ: সর্গ, প্রতিসর্গ, মন্বন্তর, বর্ণাশ্রম।
আমাদের প্রাত্যহিক এবং সামাজিক জীবনে পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন ঐতিহ্যে পুরাণগুলো ধর্মশাস্ত্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। পৌরাণিক ধর্মমতে সত্য, অহিংসা, ক্ষমা, শান্তি ও ত্যাগ মানুষকে শ্রেষ্ঠতম আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। আর এসব গুণকে উপজীব্য করেই নানা গল্প, উপাখ্যানের মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করার উপদেশাবলি রয়েছে পুরাণশাস্ত্রে। সে সমস্ত উপদেশ আমাদের নীতিবোধকে জাগ্রত করে। ধর্মের পথে চলতে সহায়তা করে। সবসময় ঈশ্বরকে স্মরণ করা আমদের কর্তব্য। তাহলে পাপ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। পুণ্যপথে থাকলে মৃত্যুর পর আমরা স্বর্গের বিষ্ণুলোকে গমন করতে পারব। চিরন্তন বৈদিক আদর্শ, একেশ্বরবাদ, লৌকিক আচারনিষ্ঠা, জাতিভেদের সংস্কার থেকে মুক্তি প্রভৃতি পুরাণে আলোচনা করা হয়েছে। দক্ষযজ্ঞ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, মহিষাসুর বধ সহ কত বর্ণাঢ্য জীবনের উত্থান-পতনের কথা যে পুরাণে বর্ণিত রয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। সেসব বীরত্বপূর্ণ কাহিনী আমাদের জীবনকে সুন্দর ও পরিপাটি করে গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা দেয়।
একক কাজ: পুরাণের শিক্ষার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে কী কী পদক্ষেপ নেবে? |
নতুন শব্দ: চিরন্তন, একেশ্বরবাদ, দক্ষযজ্ঞ, অশ্বমেধ, বর্ণাঢ্য।
শ্রীশ্রীচণ্ডী হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটি স্বতন্ত্রভাবে রচিত হয়নি। শ্রীশ্রীচণ্ডী হচ্ছে মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি অংশ। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮৩ থেকে ১৫ পর্যন্ত ১৩টি অধ্যায়ের নাম চণ্ডী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের এ অংশটির নাম ছিল দেবীমাহাত্ম্য। চণ্ডীতে সাতশত মন্ত্র আছে, তাই এর আরেক নাম সপ্তশতী। মহাভারতের অংশ হয়েও গীতা যেমন পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে, তেমনি শ্রীশ্রীচণ্ডীও মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ হয়েও বিষয়বস্তু ও রচনার গুণে আলাদা গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের কাহিনি, দেবী মহামায়া, দেবী দুর্গা, দেবী অম্বিকা ও দেবী কালিকার উদ্ভব ও মহিমা বর্ণিত হয়েছে। দুর্গাপূজা ও বাসন্তী পূজার সময় বিশেষভাবে চণ্ডী পাঠ করা হয়। গীতার মতো চণ্ডীও একটি নিত্যপাঠ্য গ্রন্থ।
পুরাণ মতে সর্বপ্রথম রাজা সুরথ বসন্তকালে দেবীর আরাধনা শুরু করেন। এজন্য এ পূজার নাম হয় বাসন্তীপূজা। বর্তমানে শরৎকালে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় এটি মূলত অকাল বোধন। অপহৃত সীতাকে উদ্ধার করতে রাবণের সাথে যুদ্ধ করার আগে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে এ পূজার আয়োজন করেছিলেন। কালক্রমে শরতের এ পূজাই বর্তমানে অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে এবং শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিতি লাভ করেছে। শরতের আগমনীবার্তা নিয়ে মর্ত্যে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিথিতে দেবী অবস্থান করেন আমাদের পৃথিবীতে।
দলীয় কাজ: শ্রীশ্রীচণ্ডীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখ। |
নতুন শব্দ: বোধন, চরিত।
পুরাকালে চৈত্র বংশে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন। একবার তিনি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রাজ্যচ্যুত হন। তখন রাজা সুরথ রাজ্য ছেড়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধা নামে এক মুনির আশ্রমে এলেন। তাঁর মনে জেগে রইল হারানো রাজ্যের জন্য দুঃখবোধ আর প্রজাদের জন্য মমতা। একই সময়ে সেই বনে এলেন সমাধি নামক এক বৈশ্য। ব্যবসা করে তিনি প্রচুর ধনসম্পদ করেছেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও পুত্রগণ তা অসৎ পথে ব্যয় করতে চায়। তিনি বাধা দিয়েছেন বলে তাঁর স্ত্রী ও পুত্ররা তাঁকে অপমান করেছে। তিনি মনের দুঃখে বনে চলে এসেছেন। কিন্তু তাঁকে যারা অপমান করেছে, কষ্ট দিয়েছে, তিনি তাদের ভুলতে পারছেন না। সংসার ছেড়ে এসেও তাদের জন্য তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন এই কষ্ট, কেন এই অন্তরের টান?
রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য দুজনে দুজনের মনের কথা জানলেন। দুজনেই সমব্যথী। দুজনে একসাথে গেলেন মেধা মুনির কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, কেন এমন হয়? তখন মুনি বললেন, এটা জগতেরই নিয়ম। এর নাম মায়া। আর এই মায়া মহামায়ার প্রভাব। তবে প্রসন্ন হলে মহামায়া মানুষের মঙ্গল করেন এবং মুক্তিও প্রদান করেন।
রাজা সুরথ তখন মহর্ষি মেধার কাছে জানতে চান, কে এই মহামায়া, কী তাঁর স্বরূপ? মেধা বলতে লাগলেন, এই জগৎ মহামায়ার মূর্তি হলেও তিনি নিত্য, তিনি চিরন্তন। তাঁর ধ্বংস নেই। তিনি আমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। মেধা মুনি আরও বলেন যে, একই দেবী মহামায়া, দুর্গা, অম্বিকা ও কালিকা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। অসুর বা দৈত্যদের বিনাশ করে শান্তি স্থাপন করেছেন। দেবতারা তাঁকে স্তুতি করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মেধা মুনির কাছে থেকে দেবীর এ মাহাত্ম্য ও দেবীর পূজাপদ্ধতি শিখে নেন। এরপর তারা দুজনে মিলে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করতে থাকেন। দেবী প্রসন্ন হন। দেবীর কৃপায় রাজা সুরথ তার রাজ্য ফিরে পান। আর সমাধি বৈশ্য দেবীর কাছে কিছুই চান না। ধনসম্পদের মোহ তাঁর দূর হয়ে গেছে। তিনি চান দুঃখ থেকে মুক্তি, চান অন্তরের শক্তি। দেবীর কৃপায় সমাধি বৈশ্য শান্তি ও মুক্তি লাভ করেন।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। (চণ্ডী ৫। ৩২,৩৩,ও ৩৪)
অর্থাৎ যে দেবী সকল জীবে শক্তি রূপে অধিষ্ঠিতা, তাঁকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
একক কাজ: রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য যে কারণে ঘর ছেড়েছেন সে কারণগুলো চিহ্নিত কর। |
নতুন শব্দ: প্রসন্ন, মায়া, চিরন্তনী।
শ্রীশ্রীচণ্ডী বা মহামায়া দেবতাসহ মানবকুলকে তিনি দেবতাদের নানা বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনী বর্ণনা করা হলো। বহুকাল পূর্বে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে একবার ভীষণ যুদ্ধ বাধে। তখন দেবরাজ ইন্দ্র, আর দৈত্যরাজ মহিষাসুর। দানবেরা দেবতাদের পরাজিত করল। মহিষাসুরের খুব আনন্দ। বসল স্বর্গের সিংহাসনে।
স্বর্গহারা দেবতারা দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে প্রথমে গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা দেবতাদের দুঃখের কথা শুনলেন। বিষ্ণু ও শিব যেখানে বসে কথাবার্তা বলছেন, সেখানে গিয়ে উভয়কে বন্দনা করে দেবতাদের দুঃখের কথা জানালেন। ব্রহ্মার মুখে এমন মর্মান্তিক কথা শুনে বিষ্ণু আর মহেশ্বর প্রথমে ব্যথিত হলেন, তারপর ক্রুদ্ধমূর্তি ধারণ করলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবসহ অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে ভয়ঙ্কর তেজ বের হলো। সেই তেজ একত্রিত হয়ে এক দিব্য নারীমূর্তির সৃষ্টি হলো। ইনিই দেবী দুর্গা। তারপর দেবগণ তাঁকে নানান অসত্র ও অলঙ্কার দান করলেন। এভাবে দুর্গা দেবী অপূর্ব সাজে সেজে উঠলেন। তখন গিরিরাজ হিমালয় দেবীর বাহনের জন্য দিলেন সিংহ। দেবতাগণ আনন্দে জয়ধ্বনি দিলেন, মুনিরা দেবীস্তব করলেন। অসুররা দেবীর সেই ভীষণ গর্জন শুনে তাঁর অভিমুখে তাড়াতাড়ি দ্রুতবেগে চলল। তারপর শুরু হলো দেবতা ও অসুরদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ। মহিষাসুরের সেনাপতি চিক্ষুর ও চামরসহ চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। দেবী দুর্গা কিন্তু একা। তাতে কী? রণে মত্ত মহাশক্তিমান দেবীর নিঃশ্বাসে লক্ষ লক্ষ সৈন্য সৃষ্টি হলো। তখন একে একে চিক্ষুর, চামরসহ প্রায় সকলেই দেবীর অস্ত্রাঘাতে নিহত হলো। তারপর যুদ্ধে নামেন মহিষাসুর নিজে। দেবী দুর্গা আর মহিষাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। অবশেষে দেবী শূলাঘাতে মহিষাসুরকে বধ করেন। দেবতারা তাঁদের স্বর্গরাজ্য আবার ফিরে পান।
ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতা দেবী দুর্গার স্তব করতে লাগলেন।
একক কাজ: মহিষাসুর বধ কাহিনীর শিক্ষা চিহ্নিত করে তোমার প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রভাব বর্ণনা কর। |
নতুন শব্দ: ব্রহ্মলোক, ক্রুদ্ধমূর্তি, চতুরঙ্গ, গিরিরাজ।
আরেকবার শুম্ভ নামের এক অসুর দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ দখল করে নেয়। সে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের অধীশ্বর হয়ে বসে। তার ভাই নিশুম্ভ, সেনাপতি চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ প্রতিষ্ঠা করে ত্রাসের রাজত্ব। আবার দেবতারা দেবীর স্তব করে দেবীকে প্রসন্ন করেন। এবার দেবীর ক্রোধ থেকে আবির্ভূত হন দেবী অম্বিকা। ফলে তাঁর শরীর কালো হয়ে যায়। তিনি পরিচিত হন কালিকা নামে। এই কালিকা বা অম্বিকার কাছে শুম্ভ, নিশুম্ভ, রক্তবীজ, চণ্ড ও মুণ্ড পরাজিত ও নিহত হয়।
দেবতারা পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরে পান। এভাবে শুধু স্বর্গের দেবতাদেরই নয়, সমগ্র জীব-জগতের কল্যাণ সাধন করেন মহাদেবী মহামায়া।
দলীয় কাজ: কালিকা বা অম্বিকার হাতে নিহত অসুরদের একটি তালিকা তৈরি কর। |
নতুন শব্দ: অধীশ্বর, ত্রাস, অম্বিকা, কালিকা, রক্তবীজ।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রথম চরিতে শ্রীবিষ্ণু মধু-কৈটভকে বধ করে শান্তি স্থাপন করেছেন। মধ্যম চরিতে দেবতাদের তেজ থেকে সৃষ্ট দেবীদুর্গা মহিষাসুরসহ অসুরদের হত্যা করেছেন। দেবতারা ফিরে পেয়েছেন তাঁদের স্বর্গরাজ্য। উত্তর চরিতে শুম্ভ নিশুম্ভসহ অসুরদের বধ করেছেন দেবী অম্বিকা বা দেবী কালিকা। দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। উল্লিখিত এ কাহিনি দুটি থেকে আমরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা পাই।
শ্রীশ্রীচণ্ডী আমাদের শক্তি ও সাহস যোগান। দেবী দুর্গা অন্যায়কে দমন করেছেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীর এই শিক্ষা অনুকরণ করে আমরাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। স্বর্গচ্যুত দেবতাগণের ঐক্যই তাঁদের আবার স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়েছে। দেবতাদের সম্মিলিত তেজ বা শক্তিই হচ্ছে মহামায়া শ্রীশ্রীচণ্ডী। এখানে একতাই শক্তির প্রমাণ মেলে। পাশাপাশি নারীশক্তির উত্থান ঘটেছে। হিন্দুধর্মে নারীকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডী অর্থাৎ দেবীদুর্গা মাতৃশক্তিরূপে অধিষ্ঠিত। তিনি নারীশক্তির প্রতীক। মায়ের মতো করুণাময়ী।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর বন্দনার মাধ্যমে শত্রুর কবল থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। সকল প্রকার দুঃখ- দুর্গতির অবসানকল্পে তাঁর আরাধনা করা হয়। সকল প্রকার দুর্গতিনাশিনী বলেই তিনি শ্রীদুর্গা। দেবীকে আমরা এই বলে প্রণাম করি:
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্থ তে।।
'তুমি সকল প্রকার কল্যাণদায়িনী। তুমি মঙ্গলময়ী, তুমি সর্বপ্রকার অভীষ্টপূর্ণকারিণী। তুমি জগতের শরণভূতা, তুমি ত্রিনয়না, তুমি গৌরী, তুমি নারায়ণী। হে দেবী, তোমাকে প্রণাম করি।'
দেবী দুর্গা শরণাগতকে রক্ষা করেন। তিনি সকল প্রকার মঙ্গল সাধন করেন। আমরাও দেবীর এ আদর্শ অনুসরণ করব। শরণাগতকে রক্ষা করব। অসহায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। মনের ভিতরে বসবাসকারী পশুর শক্তিকে বিনাশ করব। সমাজে গড়ে তুলব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, গড়ে তুলব আদর্শ মূল্যবোধ ও সুন্দর সমাজ।
দলীয় কাজ: 'শ্রীশ্রীচণ্ডীর শিক্ষাই ব্যক্তির অসুরশক্তিকে বিনাশ করতে পারে।' উদাহরণসহ যুক্তি দাও। |
নতুন শব্দ: অভীষ্টপূর্ণকারিণী, শরণভূতা, ত্রিনয়ন, গৌরি, দুর্গতিনাশিনী।
শূন্যস্থান পূরণ কর:
১. পুরাণ শব্দের অর্থ ………………………………।
২. চণ্ডী হচ্ছে ……………………………… পুরাণের একটি অংশবিশেষ।
৩. বাসন্তী পূজার সময় ……………………………… পাঠ করা হয়।
8. সুরথ ……………………………… বংশের রাজা ছিলেন।
৫. যা দেবী ……………………………… শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
ডান পাশ থেকে শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে বাম পাশের সাথে মিল কর:
বাম পাশ | ডান পাশ |
১. পুরাণে মানুষের জন্য ২. শ্রীশ্রীচণ্ডীর অপর নাম ৩. মহামায়া সকলকে ৪. দেবতাদের তেজঃপুঞ্জ হতে ৫. হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থের নাম হচ্ছে | সপ্তশতী বেদ কল্যাণকর জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে এক দিব্য নারীমূর্তির সৃষ্টি হয় শ্রী গৌরাঙ্গ বিপদ থেকে রক্ষা করেন |
নিচের প্রশ্নগুলোর সংক্ষেপে উত্তর দাও:
১. ধর্মগ্রন্থের ধারণাটি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।
২. পুরাণের মূল শিক্ষা কীভাবে কাজে লাগাবে ব্যাখ্যা কর।
৩. রাজা সুরথ কেন রাজ্যহারা হলেন?
8. মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে লেখ।
নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
১. পুরাণ পাঠের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা কর।
২. পুরাণ শুধু একটি বিষয় নিয়েই রচিত হয়নি কথাটি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা কর।
৩. শ্রীশ্রীচণ্ডীর শিক্ষা কীভাবে সমাজের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করা যায়- বুঝিয়ে লেখ।
8. শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠের মাহাত্ম্য সমাজ জীবনের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. পুরাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য কয়টি?
ক. পাঁচ
খ. বার
গ. আঠার
ঘ. একুশ
২. স্বর্গ কথাটির অর্থ কী?
ক. সুখ
খ. শান্তি
গ. পুণ্য
ঘ. সৃষ্টি
৩. ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয় -
i. ঈশ্বরের বাণী ও মাহাত্ম্য
ii. সমাজ জীবনের জন্য মঙ্গলজনক উপদেশ
দেবদেবীর কাহিনী
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
সৌমি প্রতিদিন শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করে। এতে সারাদিন তার মন ভালো থাকে। তাছাড়া সে মনে করে চণ্ডী পাঠ করার ফলে তার ও পরিবারের মঙ্গল হয়।
8. সৌমির পঠিত গ্রন্থে কার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে?
ক. দুর্গা
খ. লক্ষ্মী
গ. সরস্বতী
ঘ. শীতলা
৫. সৌমি প্রতিদিন শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করে। কারণ এর মাধ্যমে -
i. ঈশ্বরভক্তির নিদর্শন রয়েছে
ii. বিপদ থেকে পরিত্রাণের পথপ্রদর্শক
iii. ধর্ম রক্ষিত হয়।
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১। সঞ্জয় দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলেও সন্তানবৎসল। সে সামান্য ব্যাপারেই রাগান্বিত হয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তার স্বার্থে আঘাত লাগলে মারধর পর্যন্ত করে। অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ কেড়ে নেয়। এসকল কারণে সকলেই তাকে অপছন্দ করে। অথচ প্রচুর দানধ্যান করে বলে তাকে ত্যাগ করতে পারে না। তারই ছেলে দেবজিৎ আবার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে অমায়িক ও দয়ালু এবং পরোপকার ও সমাজসেবামূলক কাজ করতে ভালোবাসে। দেবজিৎ বাবার অনৈতিক কর্মকাণ্ড একেবারেই পছন্দ করে না। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করে বলে প্রায়ই বাবার সাথে দ্বন্দ্ব হয়।
ক. শ্রীশ্রীচণ্ডীতে কতগুলো মন্ত্র আছে?
খ. শ্রীশ্রীচণ্ডী কীভাবে পুরাণের অন্তর্গত?
গ. সঞ্জয়ের চরিত্রের সাথে মহিষাসুরের চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. 'শ্রীশ্রীচণ্ডীর শিক্ষা দেবজিৎ-এর চরিত্রে অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে'-কথাটি মূল্যায়ন কর।
Read more