ধর্মগ্রন্থ তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে। উপাখ্যানের মাধ্যমে সেই শিক্ষার প্রয়োগের দৃষ্টান্তও দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী শ্রেণিতে আমরা ধর্মীয় উপাখ্যানের সাথে নৈতিক শিক্ষার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। সত্যবাদিতা, ক্ষমা, জীবসেবা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ভ্রাতৃপ্রেম ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষার ধারণা এবং এ সম্পর্কিত দৃষ্টান্তমূলক উপাখ্যান ও তার শিক্ষা সম্পর্কে জেনেছি। এখন আমরা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা – এ নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা এবং প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় উপাখ্যান ও তার শিক্ষা সম্পর্কে জানব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
'সততা' মানব চরিত্রের একটি বিশেষ মহৎগুণ। 'সৎ' শব্দ থেকে 'সততা' শব্দের উৎপত্তি। এ গুণ যাঁর থাকে তিনি সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে থাকেন। 'সততা' আসলে কোন একক গুণ নয়। কতকগুলো গুণের সমষ্টি মাত্র। এসব গুণের মধ্যে আছে সত্যনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, স্পষ্টবাদিতা, সদাচার, লোভ হীনতা প্রভৃতি। কোন অন্যায় বা অবৈধ কাজ না করার নামই 'সততা'। যিনি সত্যের পূজারী, সত্য কথা বলেন, সৎ পথে চলেন, কখনো সত্যকে গোপন করেন না, মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেন না তিনি 'সততা' গুণে গুণান্বিত। সততা ধর্মের অঙ্গ। সততাই মানুষকে অন্য মানুষের নিকট বিশ্বস্ত করে তুলে। সততার গুণেই মানুষ সমাজে মহান বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। সততাই মানুষকে পৌছে দিতে পারে তার সফলতার দ্বারপ্রান্তে। সততা মানব জীবনে শান্তি ও স্বস্তি এনে জীবনকে করে তোলে আলোকিত ও মহিমান্বিত। যে সকল গুণ মানুষকে মহৎ, পুণ্যবান ও আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তাদের মধ্যে সততার গুরুত্ব সর্বাধিক। সততা মানুষকে নিয়ে যায় মর্যাদার পথে, গৌরবময় স্থানে। সততা মানব চরিত্রের অলঙ্কার। সততার বিপরীত অসততা। অসৎ ব্যক্তি কখনো সমাজের মঙ্গল সাধন করতে পারেনা। কারণ তার মন কালিমা লিপ্ত। সে অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। সে সমাজে হিংসা-দ্বেষ ছড়িয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করে থাকে। যার ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তি বিঘ্নিত হয়। এ ধরণের মানুষকে সকলেই ঘৃণা করে।
একক কাজ: সততা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কী? |
পরবর্তী পাঠে আমরা সততা সম্পর্কে একটি উপাখ্যান বর্ণনা করব।
ছেলেটির নাম তৃণীর। গ্রামের এক দরিদ্র মাতা পিতার একমাত্র সন্তান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতা মাতাকে হারিয়ে সে অনাথ হয়ে পড়ে। অর্থাভাবে পড়ালেখা তেমন করতে পারেনি। গ্রামে কাজ কর্মের খুবই অভাব। তাই একদিন সে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে কাজের সন্ধানে। শহরে এসে হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকানে এসে দোকানদারকে বলল, "কাকু, আমি খুব তৃষ্ণার্ত। আমাকে এক গ্লাস জল দেবেন?"
দোকানদারের নাম দয়াল বসাক। তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, "এখানে বস, তোমার নাম কী? কোথায় থাক?" দোকানদারের কথায় সে বসল এবং বলল, "আমার নাম তৃণীর। অনেক দূরের গ্রাম থেকে এসেছি কাজের সন্ধানে।" দোকানদার তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে আলাপচারিতা সেরে কী যেন ভেবে হঠাৎ বললেন, "তুমি এখানে একটু বসে থাক। আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।" তৃণীরকে দোকানে বসিয়ে দোকানদার বেরিয়ে গেল। তৃণীর দোকানে বসে দোকান পাহাড়া দিতে লাগল। কিন্তু অনেক সময় হয়ে গেল দোকানদার ফিরে আসছেনা। এখন সে কী করবে? দোকান ফেলে কোথাও যেতেও পারেনা। এরই মধ্যে কয়েকজন ক্রেতাও এসেছে শাড়ী কিনতে। শাড়ীর গায়ে দাম লেখা ছিল। তাই শাড়ী বিক্রি করতে তৃণীরের কোন অসুবিধা হল না। কারণ বাবার সাথে তৃণীর ছোট বেলায় হাটে বাজারে কাপড় বেচা কেনা করেছে। সারাদিনে সে বেশ কয়েকটি কাপড় বিক্রি করল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। কিন্তু দোকানদারের দেখা নেই। উপায়ান্তর না দেখে তৃণীর দোকান বন্ধ করে সেখানে রাত কাটাল।
দলগত কাজ: তৃণীর দোকান ত্যাগ করে চলে গেল না কেন? |
পরের দিনও দোকানদার এলেন না। তৃণীর আর কী করে? সে দোকান খুলে বসে রইল। সারাদিন দোকানে সে কাপড় বিক্রি করে কাটাল। দোকানদার সেদিনও ফিরে এলেন না। এভাবে দিন যায়, মাস যায়। কিন্তু দোকানদার আর ফিরে এলেন না। উপায়ন্ত না দেখে তৃণীর দোকান চালাতে লাগল। আর দোকানদারের জন্য অপেক্ষায় রইল। ব্যবসায়ী মহলে তার যথেষ্ট নামডাকও হয়েছে। সকলেই তাকে সম্মান করে। তার চারটি দোকান, অনেক কর্মচারী কাজ করে। সে দোকানগুলোর দেখাশুনা করে। কর্মচারীদের বেতন দেয়, দোকানের হিসেব পত্র দেখে। সে এখন খুবই ব্যস্ত।
একদিন তৃণীর দোকানের গদিতে বসে আছে। এমন সময় দেখে এক বৃদ্ধ লোক লাঠিতে ভর করে তার দোকানের সামনে এসে তৃণীরকে খুঁজছে। তার পরনে ছেঁড়া ময়লা কাপড়। শরীর খুবই দুর্বল ও রুগ্ন। দেখে তাকে ভিক্ষুক বলেই মনে হয়। কিন্তু তৃণীর তার দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারল। সে তাড়াতাড়ি গদি থেকে নেমে তার কাছে গেল। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কাকু, আমাকে চিনতে পরেননি? আমি তৃণীর। আমি এতদিন ধরে আপনার দোকান পাহাড়া দিয়ে আসছি। দোকান ছেড়ে কোথাও যাইনি। দোকানের আয় দিয়ে আরও ব্যবসা বাড়িয়েছি। আপনার কোন ক্ষতি হতে দেইনি। আপনি এসেছেন তাই এবার আমার ছুটি। আপনি আপনার দোকান বুঝে নিন।" বৃদ্ধ দোকানদার তৃণীরের সততায় মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। তিনি বললেন, "না তৃণীর, আমার আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। এ সবই তোমার। আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমি ছাড়া এ জগতে আমার কেউ নেই।"
তিনি বললেন, "সেদিন তোমাকে দোকানে রেখে বাইরে গিয়ে সংবাদ পেলাম আমার স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়। তাই দ্রুত বাড়ি চলে যাই। গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী মারা গিয়েছে। তার কয়েকদিন পর ছেলে মেয়ে দু'টোও মারা যায়। তারপর সংসারের ঝামেলার মধ্যে আর থাকতে ইচ্ছে করল না। আশ্রমে আশ্রমে থাকি, তাই তোমার আর কোন খোঁজ খবরও নিতে পারিনি। কিছু হারিয়েও আমি ঈশ্বরের কৃপায় ভালো আছি। হঠাৎ তোমার নামটা মনে পড়ল, তাই ছুটে এলাম। তোমাকে খুঁজে পাব একথা ভাবিনি। তোমাকে এ অবস্থায় দেখে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারব না। তুমি আমার দোকান রক্ষা করেছ, আবার আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছ এবং দোকান আমাকে দিতেও চেয়েছ। এটা কয়জন করে? তুমি মানুষ নও, তুমি দেবতা। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি আরও অনেক বড় হবে।" তৃণীর বলল, "কাকু আপনি আমার পিতার মত। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে দোকান ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমি সে বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি। এটাই আমার সান্ত্বনা। আমি এর বেশি আর কিছু চাই না।" দয়াল বসাক বললেন, "বাবা তৃণীর! তুমি যা করেছ, তা কয়জন করে? সকলেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যকে ঠকাতে চায়। আর তুমি আমার সেই ছোট দোকান শুধু রক্ষাই করনি, তার আয় থেকে উন্নতি করে আরো ব্যবসা বাড়িয়েছ। এ সবই তোমার। এটাই তোমার পুরস্কার। তুমিই এর প্রকৃত মালিক।" কিন্তু তৃণীর তার গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেও দয়াল বসাক আর তাকে ছাড়েননি।
উপাখ্যানের শিক্ষা: জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলার জন্য সততা একটি উৎকৃষ্ট পথ। সততা না থাকলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। সততা মানুষকে ভালমন্দের পার্থক্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সৎ মানুষকে সকলেই শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এ বিশ্বে যত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা সকলেই সততার ধারক ও বাহক। সততার জন্য তাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। সত্য প্রকাশ করাই তাঁদের জীবনের ব্রত।
সৎ-এর বিপরীত হল অসৎ। যিনি অসৎ তিনি সত্যকে গোপন করেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায় বিচার করেন না। সাময়িকভাবে তিনি সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও তা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। কারণ মিথ্যা ক্ষণস্থায়ী। মানুষ তাকে কখনো ভালোবাসেনা, শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। সকলেই তাকে ঘৃণা করে, এড়িয়ে চলতে চায়। কেউ তাকে বিশ্বাস করে না।
তাই আমরা কখনো অসৎ পথে চলব না, অন্যায় কাজ করব না। সকলে সৎপথে চলব, সত্য কথা বলব এবং উপাখ্যানের তৃণীরের মত সততার সাথে সকল কাজ করব। সবসময় মনে রাখব যে, 'সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা'।
একক কাজ: তোমার মতে কেন সততাকে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলা হয়? |
আমরা আমাদের পরিবারে ও সমাজে নানা রকমের কাজ করে থাকি। আমাদের মধ্যে যারা শিক্ষার্থী, তাদের কাজ হবে ভালো করে লেখাপড়া করা এবং জ্ঞান অর্জন করা। যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের নিজেদের কাজ যত্নের সঙ্গে করতে হয়।
যার যে-কাজের দায়িত্ব, তাকে সে-কাজ করতে হবেই। একেই বলে কর্তব্য। আর কর্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও গভীর মনোযোগ থাকাকে বলে কর্তব্যনিষ্ঠা। সুতরাং 'কর্তব্যনিষ্ঠা' শব্দটির মানে হলো নিজের করণীয় কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ। কর্তব্যনিষ্ঠা একটি নৈতিক গুণ এবং ধর্মের অঙ্গ।
পড়ালেখা করে জ্ঞান অর্জন করা শিক্ষার্থীর কর্তব্য। আমি শিক্ষার্থী। আমি মন দিয়ে পড়ালেখা করলাম না। তার ফল কী হবে? আমি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারব না। প্রকৃত জ্ঞানও অর্জন করতে পারব না। তাই কর্তব্য পালন না করলে নিজের ক্ষতি হয়।
সমাজেও মানুষকে নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করতে হয়। সে কর্তব্য পালনে কেউ অবহেলা করলে, তাতে গোটা সমাজেরই ক্ষতি হয়। মোটকথা, কর্তব্যনিষ্ঠা ব্যক্তির চরিত্রকে উন্নত করে, তার মঙ্গল করে এবং এতে সমাজেরও উপকার হয়। কারণ ব্যক্তি নিয়েই তো সমাজ।
মহাভারত থেকে কর্তব্যনিষ্ঠার একটি উপাখ্যান সংক্ষেপে বলছি:
অনেক অনেক কাল আগের কথা। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে গিয়ে থাকত। পড়ালেখা শেষ করে নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেত। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহকে নিজেদের বাড়ির মতোই মনে করত। গুরুও শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। এমনি এক শিক্ষার্থী ছিলেন আরুণি। তাঁর গুরু ছিলেন ঋষি ধৌম্য। তখন বর্ষাকাল। বর্ষার জলের তোড়ে মাঠে ঋষি ধৌম্যের একখন্ড জমির আল ভেঙে গিয়েছিল। ঋষি ধৌম্য আরুণিকে বললেন 'যাও জমিটার আল বেঁধে এসো।' আরুণি মাঠে গেলেন জমির আল বাঁধতে। কিন্তু জলের কী তীব্র বেগ!
কিছুতেই আরুণি আল বাঁধতে পারলেন না। তখন নিজেই শুয়ে পড়ে জলের তোড় ঠেকালেন। এদিকে দিন পেরিয়ে নামল সন্ধ্যা। ঋষি ধৌম্যের অন্য শিক্ষার্থী সব ফিরে এসেছেন। কিন্তু আরুণির দেখা নেই। চিন্তিত ঋষি ধৌম্য। তিনি অপর দুই শিষ্য উপমন্যু আর বেদকে নিয়ে গেলেন সেই জমির কাছে। আরুণির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতেই আরুণি ওঠে এলেন। জানালেন, তিনি নিজে শুয়ে পড়ে জমির ভেতর জল ঢোকা বন্ধ করেছেন। আরুণিকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, আরুণি তা যত্নের সঙ্গে পালন করেছেন। আরুণির কাজের প্রতি এই যে মনোযোগ, এরই নাম কর্তব্যনিষ্ঠা।
ঋষি ধৌম্য খুব খুশি হলেন। আরুণিও তার কর্তব্যনিষ্ঠার গুণে বিখ্যাত হয়ে রইলেন। আমরাও আরুণির মতো হব। অর্জন করব কর্তব্যনিষ্ঠার মতো নৈতিক গুণ।
উপাখ্যানের শিক্ষা
কর্তব্যনিষ্ঠা ব্যক্তির চরিত্রকে মহৎ করে। তার মঙ্গল করে। আরুণির কর্তব্যনিষ্ঠা তাঁর চরিত্রকে মহৎ করেছে। তিনি কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য গুরুদেবের প্রিয়পাত্র হয়েছেন। সকলের কাছে সম্মানিত হয়েছেন। স্থাপন করেছেন কর্তব্যনিষ্ঠার এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। আমরাও আরুণির মতো কর্তব্যনিষ্ঠ হব।
একক কাজ: উপাখ্যানের আলোকে তোমার গুরুজনের প্রতি যে সকল দায়িত্ব পালন করবে তার একটি তালিকা তৈরি কর। |
সাধারণত ত্যাগ বলতে কোনো কিছু বর্জন বা পরিহার করা বোঝায়। কিন্তু বিশেষভাবে ত্যাগ বলতে বোঝায় নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া। নিজের সুখ বা লাভের চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ভোগ বা সুখের ইচ্ছা পরিহার করাকেই ত্যাগ বলে। ত্যাগ মানবচরিত্রের একটি বিশেষ নৈতিক গুণ। ত্যাগ ধর্মেরও অঙ্গ। ত্যাগী ব্যক্তি সমাজে আদরণীয় হয়। তাঁকে সকলে শ্রদ্ধা করে। ত্যাগ ছাড়া ধর্ম হয় না। ভোগের কোনো শেষ নেই। যতই ভোগ করা যায়, ভোগের লালসা ততই বেড়ে যায়। ভোগের ইচ্ছাই মানুষকে লোভী করে তোলে। আর এই লোভ মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সমাজে ডেকে আনে হানাহানি, হিংসা ও বিদ্বেষ। ত্যাগ মানুষকে করে মহান, সমাজে এনে দেয় শান্তি। হিন্দুধর্মের গ্রন্থসমূহে তত্ত্ব, তথ্য ও উপাখ্যানে ত্যাগের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।
তিতিক্ষাও ত্যাগের মতো আরেকটি বিশেষ গুণ। তিতিক্ষা বলতে বোঝায় সহিষ্ণুতা। তিতিক্ষাও ধর্মের অঙ্গ। নৈতিকতা গঠনে তিতিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিতিক্ষা সমাজে শান্তি আনয়ন করে। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে গড়ে তোলে সৌহার্দ্যের মনোভাব। তিতিক্ষা না থাকলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত অনিবার্য। সকলে মিলে, পরস্পর পরস্পরের মতের ও চিন্তার প্রতি সহিষ্ণু হয়েই মানুষ সমাজ গঠন করেছে। সহিষ্ণু না হলে সুষ্ঠুভাবে সামাজিক কাজকর্ম করা অসম্ভব। তাই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা না থাকলে ব্যক্তিজীবনেও উন্নতি করা যায় না। জীবনে সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ত্যাগের পাশাপাশি সহিষ্ণুতা বা তিতিক্ষার কথা একই সাথে উচ্চারিত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ত্যাগ ও তিতিক্ষা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিতিক্ষা না থাকলে ত্যাগের ফলও বিনষ্ট হতে পারে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে তিতিক্ষার অনেক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্রের ত্যাগ-তিতিক্ষার কাহিনী একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শ্রীরামচন্দ্র রামায়ণের প্রধান চরিত্র। তিনি বিষ্ণুর অবতার। তিনি ত্রেতাযুগে মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মানুষ হয়েও চরিত্রগুণে দেবতার স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। শ্রীরামচন্দ্র সেই দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। মহাবীর হয়েও তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল। মহত্ত্ব, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রভৃতি ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণ।
অযোধ্যার রাজা দশরথ। তাঁর তিন রানি। বড় রানি কৌশল্যা, মেঝো রানি কৈকেয়ী, আর ছোট রানি সুমিত্রা। কৌশল্যার পুত্র রাম, কৈকেয়ীর পুত্র ভরত, আর সুমিত্রার দুই পুত্র লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
একক কাজ: তোমার জানা একজন ত্যাগী ব্যক্তির নাম এবং তাঁর ত্যাগের একটি দিক উল্লেখ কর। |
নিয়মানুসারে পিতার অবর্তমানে বড় ছেলে যুবরাজ হতো। তারপর সে-ই লাভ করত রাজপদ ও ক্ষমতা। রামের ক্ষেত্রেও তাই হওয়াই স্বাভাবিক। রাম তখন পঁচিশ বছরের যুবক। রাজা দশরথ বৃদ্ধ হয়েছেন। রামকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করবেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। কিন্তু বাধা এল বিমাতা কৈকেয়ীর কাছ থেকে। রাজা দশরথ একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কৈকেয়ীর সেবাযত্নে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। রাজা দশরথ খুশি হয়ে তাকে দুটি বর দিতে চাইলেন। কিন্তু কৈকেয়ী বললেন, 'মহারাজ, আমি এখন কিছুই চাই না। আমি সময় মতো চেয়ে নেব।'
এখন যেন সেই সময় উপস্থিত হলো। কৈকেয়ী মন্থরার পরামর্শ মতো রাজা দশরথের নিকট এমন দু'টি বর প্রার্থনা করলেন, যা রাজা দশরথের জন্য হৃদয়বিদারক। কৈকেয়ী চাইলেন, এক বরে রাম চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনে যাবে, আর এক বরে তার পুত্র ভরত রাজা হবে। রাজা দশরথের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কৈকেয়ীর কথায় তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়ে রইলেন। রামকে আনা হলো দশরথের কাছে। দশরথ রামকে সব বৃত্তান্ত বললেন। তিনি পিতার সত্য রক্ষা করতে বনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি রাজ্য ত্যাগ করে, রাজপোশাক পরিত্যাগ করে বল্কল পরিধান করলেন।
রাম সীতার সাথে দেখা করতে গেলেন। সীতা রামের সাথে বনে যেতে চাইলে সীতার কষ্ট হবে ভেবে তাঁকে সঙ্গে নিতে চাইলেন না। কিন্তু সীতা কোনো কথাই শুনলেন না। তিনি যাবেনই রামের সাথে। এদিকে লক্ষ্মণও কারো বাধা না মেনে রামের সাথে বনে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। শেষে রামের সঙ্গে সীতা ও লক্ষ্মণ বনে রওনা হলেন। রাম বনে যাওয়ার প্রাক্কালে নিজের ধনরত্ন এমনকি নিজের হাতিটি পর্যন্ত দান করে দিলেন। বনে যাওয়ার সময় সকলে যখন ভেঙে পড়েছে, রাম তখন হাসিমুখে সমস্ত কষ্ট সহ্য করেছেন। তিনি পিতাকে বললেন, মাতার প্রতি দৃষ্টি রাখতে। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতে।
রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ পায়ে হেঁটে চলতে চলতে অনেক পথ অতিক্রম করে চিত্রকূট পর্বতে এলেন। রাজার দুলাল সেখানে পর্ণকুটির নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। এখানে রাজভোগ নেই, খাদ্য বনের ফলমূল আর বন্য মৃগ। ভরত শ্রীরামচন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু ত্যাগী রাম ফিরে যাননি। শ্রীরামচন্দ্রের পুরো জীবনটাই ত্যাগ-তিতিক্ষার। শ্রীরামচন্দ্রের ত্যাগ-তিতিক্ষা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
উপাখ্যানের শিক্ষা: মহাপুরুষদের ত্যাগ-তিতিক্ষার দৃষ্টান্তমূলক কাহিনী আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। ত্যাগ-তিতিক্ষার গুণে মানুষ দেবতার স্তরে উন্নীত হতে পারে। যে সকল নৈতিক গুণ মানুষকে সমাজে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সেগুলোর মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষা অন্যতম। ত্যাগ-তিতিক্ষা মানুষকে নিয়ে যায় মর্যাদার পথে, গৌরবময় স্থানে। ত্যাগ-তিতিক্ষা মানবচরিত্রের অন্যতম মহৎ গুণ। ত্যাগী মানুষকে সকলেই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
নতুন শব্দ: সদাচার, সত্যনিষ্ঠা, গুণান্বিত, উপায়ান্তর, মৃত্যুশয্যা, প্রজাবৎসল, তিতিক্ষা, মনোরঞ্জন, সহিষ্ণুতা, একাগ্রতা।
সততা, সত্যবাদিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, একাগ্রতা, ত্যাগ তিতিক্ষা, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানুষের বিশেষ গুণগুলো যার মধ্যে থাকে তাকেই মানুষ সৎ মানুষ বলে জানি। সৎ মানুষ কখনো কারো ক্ষতি করতে পারে না। সে তার আলোকিত জীবন দিয়ে সকলের মনের অন্ধকার দূর করে।
সমাজের অশান্তি দুর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করে থাকে। স্নেহ-দয়া, মায়া-মমতা দ্বারা সকলের মঙ্গল করতে চেষ্টা করে। সমাজ থেকে যাতে অন্যায়-অবিচার দূর হয়, সবল যাতে দুর্বলের উপর অত্যাচার করতে না পারে, সে ব্যাপারে তারা সকলকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে। সমাজে যখনই সৎ মানুষের আবির্ভাব হয়, তখনই সমাজ হয়ে ওঠে শান্তির আধার, মঙ্গলের মোক্ষধাম। সুতরাং আমাদের সকলের মঙ্গলের জন্য সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, দেশের উন্নতি ও শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য সকলকে সৎ জীবনের অধিকারী হতে হবে। সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে সকলের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ইত্যাদি গড়ে তুলতে হবে। আর এভাবেই শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন সম্ভব হবে।
সুতরাং বলা যায় সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সৎ জীবন পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে সৎ, সুজন বা দুর্জন ইত্যাদি কোন গুণাবলি নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে না। জন্মের পর পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গুণের সমাবেশ ঘটে। মানুষ প্রবৃত্তির দাস। মানুষের মনে দু'ধরণের প্রবৃত্তি রয়েছে। সৎ প্রবৃত্তি ও অসৎ প্রবৃত্তি। সৎ প্রবৃত্তির ফলে মানুষ যে কাজ করে তাকে সৎ কাজ বলা হয় আর অসৎ প্রবৃত্তির মানুষ সব সময় অসৎ কাজ করে। সৎ কাজের ফলে ব্যক্তি সৎ মানুষরূপে চিহ্নিত হয়। সকলে তাকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। আর এসব গুণাবলি অর্জনে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান। পরিবারের কর্তাব্যক্তি যদি সদ্গুণের অধিকারী হন তাহলে অন্যান্য সদস্যরাও সদ্গুণের অধিকারী হয়। যেহেতু পরিবারকে বলা হয় সমাজের প্রথম স্তর। সুতরাং সে স্তরকে সুন্দর, সুদৃঢ় করতে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে ধৈর্য, সংযম, সহনশীলতা, ক্ষমা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণাবলি অর্জনের সাথে সাথে হিংসা, দ্বেষ, লোভ, লালসা প্রভৃতি অসৎ আচরণগুলো বর্জন করে সৎ ও ন্যায়ের পথে নিজে চালিত করতে হবে।
একক কাজ: সততা ও সৎ জীবন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কী? কয়েকজন সৎ মানুষের নাম লিখ? |
নতুন শব্দ: আন্তরিকতা, স্পষ্টবাদিতা, সদাচার, সত্যনিষ্ঠা, গুণান্বিত, উপায়ান্তর, মৃত্যুশয্যা, সিংহদরজা, বিসর্জন, প্রজাবৎসল, তিতিক্ষা, কীর্তিত, মনোরঞ্জন, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, দ্বেষ।
শূন্যস্থান পূরণ কর:
১. তিতিক্ষার অপর নাম …………..।
২. ভোগে মানুষের ………….. বৃদ্ধি পায়।
৩. অপরের কষ্ট দূর করার এক নাম ………….. ।
8. ত্যাগ মানুষের মনে ………….. এনে দেয়।
৫. অন্যের প্রতি ………….. হিন্দুধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ডান পাশ থেকে শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে বাম পাশের সাথে মিল কর:
বাম পাশ | ডান পাশ |
১. নৈতিকতা গঠনে ২. তিতিক্ষা না থাকলে ৩. ত্যাগী মানুষ | ত্যাগ হয় না সর্বদা শ্রদ্ধেয় সততার গুরুত্ব অপরিসীম নিজেকে সমৃদ্ধশালী করাবার |
নিচের প্রশ্নগুলোর সংক্ষেপে উত্তর দাও
১. সততা বলতে কী বোঝায়? সততার দুটি উদাহরণ দাও।
২. লক্ষ্মণ রামসীতার সাথে বনে গেলেন কেন?
৩. কৈকেয়ী রাজা দশরথের কাছে বর দুটি প্রার্থনা করলেন কেন?
নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও
১. ত্যাগ-তিতিক্ষা কাকে বলে? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।
২. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ত্যাগ-তিতিক্ষা কীভাবে শান্তি আনতে পারে- ব্যাখ্যা কর।
১. স্বয়ং বিষ্ণু কোন যুগে রাম অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন?
ক. সত্যযুগ
খ. দ্বাপরযুগ
গ. ত্রেতাযুগ
ঘ. কলিযুগ
২. ত্যাগ ও তিতিক্ষা আদর্শে প্রভাবিত ব্যক্তি সর্বদাই -
i. পরিশ্রমী
ii. সহিষ্ণু
iii. দয়ালু
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
১। সৃজনশীল প্রশ্ন
নীলরতন ও মনোরমার বেশ সুখেই সাংসারিক জীবন কাটাচ্ছিল। বেশ কয়েকবছর হলো তাদের কোনো সন্তানাদি হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছে তাদের সন্তান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্য তাদের দুজনের মধ্যে একটা হতাশা বিরাজ করছে। বাড়ির কর্মচারী দীননাথ ব্যাপারটি লক্ষ করে। সে দরিদ্র। তার দুটি সন্তান। দীননাথ স্ত্রীকে রাজি করিয়ে তার একটি সন্তানকে মনোরমার কোলে তুলে দেয়। মনোরমা নীলরতনের সংসারে শান্তির আবহ ফিরে আসে।
ক. রামায়নের প্রধান চরিত্র কে?
খ. তিতিক্ষার মাধ্যমে সমাজে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়- ব্যাখ্যা কর?
গ. দীননাথের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে রামচন্দ্রের কোন দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. মনোরমা ও নীলরতনের সংসারে সুখের আবহের মূলে রয়েছে দীননাথের ভূমিকা-তোমার পঠিত উপাখ্যানের আলোকে মূল্যায়ন কর।
Read more