ধর্মের আদর্শ অনুসরণে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জন

তৃতীয় শ্রেণি (প্রাথমিক স্তর ২০২৪) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

ধর্মের আদর্শ অনুসরণে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জন

নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির পরিচয়

আমরা সমাজে বাস করি। আমাদের কিছু নিয়ম ও নীতি মেনে চলতে হয়। তাতে অন্য মানুষের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এ সকল নীতি মেনে চলা আমাদের নৈতিক গুণ। এই গুণের ফলে আমরা আমাদের বড়োদের শ্রদ্ধা করি। তাতে তারা খুশি হয়ে আমাদের আদর-স্নেহ করেন।

আমরা মানুষ। আমাদের আশেপাশে কেউ বিপদে পড়লে আমাদের খারাপ লাগে। আমরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। এটা হলো আমাদের মানবিক গুণ। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের সুখে-দুঃখে সহমর্মী হয়ে আমরা আরও অনেক ভালো কাজ করি। যেমন, আমরা অসহায় ও গরিব লোকদের সাহায্য করি। এগুলো আমরা করি আমাদের মানবিক গুণের কারণে।

হাদিসে আখলাক শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। আখলাক শব্দের অর্থ হলো চরিত্র। আখলাক দুই প্রকার – আখলাকে হামিদা ও আখলাকে যামিমা। আখলাকে হামিদা হলো প্রশংসনীয় চরিত্র। আর আখলাকে যামিমা হলো নিন্দনীয় চরিত্র। আখলাকে হামিদা হলো আমাদের নৈতিক ও মানবিক গুণ।

আখলাকে হামিদার উদাহরণ হলো সহমর্মিতা, উদারতা, দেশপ্রেম, সত্যবাদিতা, সততা, শ্রদ্ধা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরোপকার, ত্যাগের মনোভাব ইত্যাদি। আমরা সর্বদা এই গুণগুলো অনুসরণ করব।

আখলাকে যামিমা ক্ষতিকর। এর উদাহরণ হলো মিথ্যা কথা বলা, অন্যের সমালোচনা করা, মারামারি করা, গালি দেওয়া, কাউকে না বলে তার কিছু নিয়ে যাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস পেয়ে ফেরত না দেওয়া ইত্যাদি। আমরা সর্বদা এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকব।

মহানবি (স.) বলেছেন,

বাংলা উচ্চারণ: ইন্নামা বুয়িসতু লিউতাম্মিমা মাকারিমাল আখলাক অর্থাৎ-"আমি উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতাদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি"।

তাই আমরা উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য সর্বদা চেষ্টা করবো। মহানবি (স.) এর আদর্শগুলো আমাদের জীবনে ধারণ করব। আব্বা আম্মার কথা শুনব। সহপাঠীদের সাহায্য করব। মেহমানের সাথে সুন্দর ব্যবহার করব। মানুষের সেবা করব। জীবে দয়া করব। সবসময় সত্য কথা বলব। সৎ পথে চলব। মিথ্যা কথা বলব না। পাপ কাজ করব না। সবাইকে সালাম দেবো

ক) নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি কী তা বলি ও তালিকা করি। কাজটি জোড়ায় করি।

খ) বাড়িতে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অনুসরণ করে কি কি কাজ করি তা লিখি। কাজটি একা করি।

সহমর্মিতা

আমাদের আপনজনদের মধ্যে কেউ বিপদে পড়লে আমাদের খারাপ লাগে। আমরা তাদের প্রতি সহমর্মী হই ও তাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। তাদের অনেকেই দুঃখ- কষ্ট, বিপদ-আপদ ও অভাব-অনটনে পড়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তাদের এই কষ্টকে অনুভব করে তাদের সাথে সমব্যথী হওয়াই হলো সহমর্মিতা। তাহলে সহমর্মিতার উদ্দেশ্য হলো মানুষের দুঃখ-কষ্টে দরদি হওয়া, তাদের দুঃখ-কষ্ট নিজের ভেতর অনুভব করে বিপদ-আপদে সাহায্য করা।

সহমর্মিতার মাধ্যমে অসহায় মানুষের সমস্যার সমাধান হয়। সমাজে সকল মানুষের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। ইসলামে তাই সহমর্মিতার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহানবি (স.) বলেছেন, 

ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ

বাংলা উচ্চারণ: ইরহামু মান ফিল আরদি ইয়ারহামুকুম মান ফিস সামাই

বাংলা অর্থ: পৃথিবীতে যারা রয়েছে তোমরা তাদের প্রতি সহমর্মী হও। তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি (মহান আল্লাহ) তোমাদের প্রতি সহমর্মী হবেন।

মহানবি (স.) ইয়াতিম ছিলেন। তিনি ইয়াতিম শিশুদের প্রতি সহমর্মী ছিলেন এবং নিজের সন্তানের মতোই তাদের ভালোবাসতেন। এক ইদে নামাজ শেষে তিনি ঘরে ফিরছিলেন। এমন সময় দেখলেন, মাঠের এক কোণে বসে একটি শিশু কাঁদছে। রাসূল (স.) ছেলেটির কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শিশুটি বলল, আমার আব্বা-আম্মা নেই। তিনি পরম আদরে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। মুহাম্মদ (স.) তাঁর স্ত্রী হজরত আয়েশাকে (রা.) ডেকে বললেন, হে আয়েশা! ইদের দিনে তোমার জন্য একটি উপহার নিয়ে এসেছি। এই নাও তোমার উপহার। ছেলেটিকে পেয়ে দারুণ খুশি হলেন হজরত আয়েশা (রা.)। দেরি না করে মুহূর্তেই তাকে গোসল করিয়ে জামা পরালেন। তারপর তাকে পেট ভরে খেতে দিলেন। রাসূল (স.) ছেলেটিকে বললেন, আজ থেকে আমরাই তোমার পিতা-মাতা। নবিজি (স.) এর কথা শুনে ছেলেটি খুশি হলো।

খলিফা হজরত উমর (রা.) এক রাতে প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতে মদিনার লোকালয়ে বের হলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি একটি ক্ষুধার্ত পরিবারকে দেখতে পেলেন। পরিবারের ক্ষুধার্ত বাচ্চারা কান্নাকাটি করছিল। তাদের মা শূন্য হাঁড়িতে পানি গরম করছিলেন। শিশুরা কেন কান্নাকাটি করছে খলিফা তা জানতে চান। শিশুদের মা বললেন, আমাদের ঘরে কোনো খাবার নেই। ক্ষুধায় বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। শূন্য হাঁড়িতে পানি গরম করছি। তারা তাতে মনে করবে খাবার রান্না করছি। এভাবে খাবারের অপেক্ষায় থেকে তারা একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। একথা শুনে খলিফা খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি সরকারি গুদাম থেকে খাবার নিয়ে এসে ঐ পরিবারকে দিলেন।

আমরাও দুঃখি মানুষের প্রতি সহমর্মী হবো। তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসব। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে যারা অভাব-অনটনে রয়েছে তাদেরকে সাহায্য করব। আমাদের সহপাঠীদের সাথেও ভালো ব্যবহার করব। তাদেরকে যে কোনো সমস্যায় সহযোগিতা করব। তাদেরকে সব সময় হাসিখুশি রাখব, তাদের সাথে ভাই-বোনের মতো আচরণ করব। এভাবে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করব।

ক) নিচের বাম ও ডানপাশের তথ্যগুলো দাগ টেনে মিল করি। কাজটি একাকী করি।

বামপাশডানপাশ
১) কেউ বিপদে পড়লে১) মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
২) দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ ও অভাব- অনটনে২) সমস্যার সমাধান হয়।
৩) সহমর্মিতার মাধ্যমে অসহায় মানুষের৩) হওয়াই হলো সহমর্মিতা।
৪) অন্যের কষ্টকে অনুভব করে সমব্যথী৪) যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি সহমর্মী হবেন।
৫) তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি সহমর্মী হও৫) আমাদের খারাপ লাগে

খ) বিষয়বস্তু পড়ি। মহানবি (স.) ও হজরত উমর (রা.) এর সহমর্মিতার গল্পটি আলোচনা করি ও নিজের ভাষায় লিখি। কাজটি জোড়ায় করি।

শুরু

 

 

 

মধ্যভাগ

 

 

 

শেষভাগ

 

 

 

গ) আমাদের আশেপাশের অভাবী লোকদের জন্য কী ধরনের সহমর্মিতামূলক কাজ করব তা নিচের সহমর্মিতা গাছের নির্দিষ্ট স্থানে লিখি।

উদারতা

উদারতা মানুষের একটি মানবিক গুণ। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে উদার বলা হয়। উদারতা হলো অন্যের কথা, কাজ ও চিন্তা-ভাবনার প্রতি সহনশীল হওয়া। মানুষকে ক্ষমা করা এবং পরোপকারী হওয়াও উদারতা।

মহানবি (স.) কথায়, কাজে ও ব্যবহারে উদার ছিলেন। তিনি সবসময় অন্যের সাথে উদার মনে মিশতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর মধুর কথায় সবাই মুগ্ধ হতো। তাঁর সাহাবি হজরত আনাস (রা.) বলেন, "আমি ১০ বছর রাসূল (স.) এর খেদমত করেছি। আমার কোনো কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি, এমন কেন করলে বা এমন করনি কেন?"

মহানবি (স.) ভিন্ন ধর্মের লোকদের প্রতিও উদারতা দেখিয়েছেন। তিনি তাদেরকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। একবার এক অমুসলিম ব্যক্তি মসজিদে নববীতে প্রস্রাব করে দিলে কোনো কোনো সাহাবি রেগে যান। মহানবি (স.) সাহাবিগণকে বললেন, লোকটিকে প্রস্রাব করতে দাও এবং তার প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও।

মহানবি (স.) এর সাহাবিগণও ছিলেন উদার ও পরোপকারী। একবার এক ব্যক্তি জনৈক সাহাবিকে একটি ছাগলের মাথা হাদিয়া দেয়। তিনি দেখলেন যে, তার প্রতিবেশী অধিক অভাবী। তাই তিনি মাথাটি প্রতিবেশীকে দিয়ে দেন। প্রতিবেশী মাথাটি না রেখে তার চাইতে অধিক অভাবী অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে দেন। এভাবে ছাগলের মাথাটি সাত ঘর ঘুরে পুনরায় প্রথম সাহাবির ঘরে ফিরে আসে।

আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উদারতার গুণ অনুসরণ করব। কেউ যদি আমাদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় এবং তা সময়মত পরিশোধ করতে না পারে তাহলে আমরা তার সাথে রাগ না করে তাকে সময় দেবো। এটাও উদারতা। অন্যের বিপদে সাহস জোগাব, ক্ষুধার্তকে খাবার দেবো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেবো, অন্ধকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করব, অন্যের সাথে হাসিমুখে কথা বলব, বয়স্ক বা দুর্বলদের সাহায্য করব, দানশীল হবো, কথা ও কাজে নম্রতা ও বিনয় প্রদর্শন করব, সবার সাথে সহনশীল আচরণ করব।

ক) মহানবি (স.) ও সাহাবিদের উদারতার ঘটনা থেকে কী শিখলাম তা লিখি। কাজটি একাকী করি।

খ) দৈনন্দিন জীবনে উদারতার গুণ অবলম্বন করে কি কি কাজ করব তার একটি তালিকা করি। কাজটি দলগতভাবে করি।

গ) বন্ধুরা মিলে যেসব উদারতামূলক কাজের তালিকা করেছি তা একত্র করি। এবার এসব কাজ ভূমিকাভিনয় করে দেখাই। কাজটি দলগতভাবে করি।

দেশপ্রেম

দেশপ্রেম হলো নিজের দেশকে ভালোবাসা। নিজের দেশকে ভালোবেসে এর উন্নয়নের জন্য নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা।

মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) নিজের জন্মভূমিকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজের জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যান। যাবার সময় তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বারবার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, "হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার কাছে কতই না প্রিয়! আমার স্বজাতি যদি আমাকে নির্যাতন করে বের করে না দিতো, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।"

হিজরতের পর মদিনাকে তিনি নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মদিনাকে ভালোবাসতেন। মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়নের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন যাতে অশান্ত মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

চিত্র: জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন দেশপ্রেমের প্রতীক

আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আগে পরাধীন ছিল। দেশকে ভালোবেসে দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। যারা শহিদ হয়েছেন তাঁদের জন্য আমরা দু'আ করবো। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাঁদেরকে সম্মান করব। দেশের মানুষকে ভালোবাসব। দেশের কল্যাণে কাজ করব। দেশের উন্নয়নের জন্য যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব। আমরা শিক্ষার্থী। পড়ালেখা করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমরা ভালোভাবে পড়ালেখা করব। তাহলে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারব। আমাদের বাড়িতে যারা লেখাপড়া জানেন না তাদের লেখাপড়া শেখাব। সকল ভালো কাজে সহযোগিতা করব। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করব। দেশের প্রকৃতি ও জীবজগতকেও আমরা ভালোবাসব। এদের যত্ন নেবো। আমরা গাছ লাগাব। ফুল ও সবজির বাগান করব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে বড়দের সঙ্গে অংশ নেবো।

ক) বিষয়বস্তু ভালোভাবে পড়ি। নিচের শূন্যস্থানে সঠিক শব্দ বসাই। কাজটি একাকী করি।

১) দেশপ্রেম হলো নিজের দেশকে_______________ 1

২) মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) নিজের____________ ভালোবাসতেন।

৩) স্বাধীনতার জন্য____________ মানুষ তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

৪) পড়ালেখা করা আমাদের প্রধান___________________

৫) প্রকৃতি ও জীবজগতকেও আমরা_________________

খ) মহানবি (স.) ও অন্যদের দেশপ্রেমের ঘটনা আলোচনা করি। ইসলামে দেশপ্রেম সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ লিখি। কাজটি জোড়ায় করি।

___________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

গ) ইসলামের আদর্শ অনুসরণ করে দেশের জন্য কী ধরনের কাজ করব তা নিচের ছকে লিখি। কাজটি দলগতভাবে করি।

ঘ) ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশকে ভালোবেসে যেসব কাজ করব তা ভূমিকাভিনয় করে দেখাই। কাজটি দলগতভাবে করি। শিক্ষাবর্ষ 

 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion