প্রতিদিন আমরা নানা রকমের কাজ করি। এর মধ্যে কিছু কাজ কেবল নিজের প্রয়োজনে করি। আবার কিছু কাজ করি অন্য কারোর জন্য। আমাদের যে কাজগুলো অন্য কাউকে আনন্দিত করে বা অন্যের উপকার করে সেগুলোকে আমরা ভালো কাজ বলতে পারি।
ছক ৩.১: আমার যতভালো কাজ
|
১.
|
২.
|
৩.
|
8.
|
৫.
|
এবারে দলে/জোড়ায় আলোচনা করে সবার কাজের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো পাঁচটি কাজ বেছে নাও। এই ভালো কাজগুলোতে তোমাদের কোন কোন মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে তা খুঁজে বের করে নিচের তালিকাটি সম্পূর্ণ করো। (তোমাদের সুবিধার জন্য একটি করে দেখিয়ে দেওয়া হলো।)
ছক ৩.২: ভালো কাজে আমরা
আমাদের কাজ
| মূল্যবোধ |
১. একটা অসুস্থ বিড়ালকে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করেছি।
| জীবসেবা, সহানুভূতিশীলতা |
২.
| |
৩.
| |
8.
| |
৫.
| |
৬.
|
এই যে ভালো কাজগুলো তোমরা করেছ, এর মধ্য দিয়ে তোমাদের মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ এবং হিন্দুধর্মের মহামানবদের জীবন থেকে আমরা এ রকম অনেক মূল্যবোধের শিক্ষা পাই। তার মধ্য থেকে কয়েকটি মূল্যবোধ এবং কয়েকজন আদর্শ মানুষের জীবন সম্পর্কে এবারে জেনে নিই।
সৎ চিন্তা করা, সৎ কাজে নিযুক্ত থাকা, সত্যকে গোপন না করা, মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দেওয়া, কোনো অন্যায় বা অবৈধ কাজ না করা, কারো জিনিস অন্যায়ভাবে গ্রহণ না করাই হচ্ছে সততা। সততাই মানুষকে অন্য মানুষের নিকট বিশ্বস্ত করে তোলে। সততা মানবজীবনে শান্তি ও স্বস্তি এনে জীবনকে করে তোলে আলোকিত। মানুষকে নিয়ে যায় মর্যাদার পথে, গৌরবময় স্থানে। সততা ধর্মের অঙ্গ এবং একটি নৈতিক গুণ।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একসময়ে দ্রোণাচার্য কৌরবদের সেনাপতি হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়লে তাকে বধ করার জন্য পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। দ্রোণাচার্য এভাবে যুদ্ধ করলে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন হবে। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝলেন, কৌশল ছাড়া গতি নেই। তাই তিনি ভীমকে বললেন, পাণ্ডবমিত্র রাজা ইন্দ্রবর্মার হাতি অশ্বত্থামাকে বধ করে সেটা প্রচার করতে। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণাচার্য অস্ত্র ত্যাগ করলে অর্জুন যেন সেই সুযোগে তাঁকে বধ করেন। কিন্তু অর্জুন বললেন, হে মাধব, আমাকে ক্ষমা করুন। ছলনার আশ্রয় নিয়ে গুরুকে বধ করার পাপ আমি করতে পারব না। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, তোমার একমাত্র লক্ষ্য অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা। তুমি কেবল সেটিই করো।
ভীম গদা দিয়ে হাতি অশ্বত্থামাকে বধ করে দ্রোণাচার্যকে জানান, আমি এই গদা দিয়ে অশ্বত্থামাকে বধ করেছি। কিন্তু দ্রোণাচার্য তার কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, একমাত্র ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মুখে শুনলেই আমি একথা বিশ্বাস করব। কারণ যুধিষ্ঠির ধার্মিক এবং সৎ। তিনি কখনও মিথ্যা বলেন না। কিন্তু সকলের অনুরোধে যুধিষ্ঠিরও তখন সততা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। তিনি দ্রোণাচার্যকে বললেন, "অশ্বথামা হতঃ ইতি গজঃ।" 'ইতি গজঃ কথাটি তিনি এত আস্তে বললেন যেন দ্রোণাচার্যর কানে তা না পৌঁছোয়। তাতে সত্য বলাও হলো আবার উদ্দেশ্যও সিদ্ধি হলো। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে শোকবিহ্বল দ্রোণাচার্য তপস্যায় বসলেন। পুত্রের আত্মাকে খুঁজতে পিতার আত্মা দেহ ছেড়ে স্বর্গে প্রবেশ করল। এই সুযোগে দ্রৌপদীর বড় ভাই, পাণ্ডব সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুন্ম তলোয়ার দিয়ে দ্রোণাচার্যর প্রাণহীন দেহ থেকে মাথা কেটে ফেলেন। যুধিষ্ঠির শোক ও অনুতাপে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। তিনি জীবনে এই একবার মাত্র সততাভ্রষ্ট হয়েছেন। দ্রৌপদী বললেন, পান্ডবেরা পাশাখেলায় পরাজিত হলে কৌরবেরা যখন আমার বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হয়েছিল, দ্রোণাচার্য তখন নিশ্চুপ ছিলেন। তাই প্রাণদণ্ডের শাস্তিই তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু এই সাম্বনায়ও যুধিষ্ঠিরের সততা থেকে ভ্রষ্ট হওয়ার অনুতাপ গেল না।
সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা কখনও মাটি স্পর্শ করত না। কিন্তু দ্রোণাচার্যের সাথে ছলনা করার কারণে সেদিন থেকে যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা সকলের মতো মাটি ছুঁয়েই থাকছে। ধর্মনিষ্ঠার বলে যুধিষ্ঠির জীবন্ত অবস্থায় স্বর্গে গিয়েছেন। স্বর্গের সবচেয়ে সম্মানজনক আসনে বসেছেন। কিন্তু কোনো অর্জন তাঁর এই সততাভ্রষ্ট হওয়ার পাপ মুছতে পারেনি। তাই স্বর্গারোহণের পরেও তাঁকে একদিনের জন্য নরক দর্শন করতে হয়েছে। তাই সবারই উচিত সততার সঙ্গে জীবন কাটানো।
ছক ৩.৩: একজন সৎমানুষের ৫টি বৈশিষ্ট্য
১. |
২.
|
৩.
|
8.
|
৫.
|
'সাহস' শব্দের অর্থ ভয়শূন্যতা বা নির্ভীকতা। 'সৎ' শব্দের অর্থ সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা। সুতরাং সৎসাহস হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের জন্য অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। নিজের জীবনে ঝুঁকি আছে জেনেও কল্যাণকর কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, দেশ বা অন্যের মঙ্গলের জন্য সাহস প্রদর্শন করাকেই বলে সৎসাহস।
যদি কোনো সবল ব্যক্তি দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে তখন সৎসাহসী নির্ভয়ে দুর্বলের পাশে দাঁড়ান। তাকে রক্ষা করেন। সৎসাহস মানুষের একটি বিশেষ নৈতিক গুণ। সৎসাহস ধর্মের অঙ্গ। হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থে আমরা অনেক সৎসাহসী চরিত্রকে পাই। আমরা মহাভারত থেকে বীরযোদ্ধা অভিমন্যুর সৎসাহসের উপাখ্যান জানব।
হস্তিনাপুর নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে কুরুবংশের রাজারা রাজত্ব করতেন। এই বংশের একজন রাজা ছিলেন বিচিত্রবীর্য। তাঁর ছিল দুই পুত্র- ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র বড় কিন্তু তিনি ছিলেন জন্ম থেকে অন্ধ। তাই ছোট ভাই পাণ্ডু রাজা হলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী। তাঁদের দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রভৃতি নামে শতপুত্র এবং দুঃশলা নামে এক কন্যা ছিল। কুরুবংশের নাম অনুসারে এদের বলা হয় কৌরব।
অন্যদিকে পাণ্ডুর দুই স্ত্রী- কুন্তী ও মাদ্রী। কুন্তীর পুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং মাদ্রীর পুত্র নকুল ও সহদেব। পান্ডুর নাম অনুসারে এদেরকে বলা হয় পাণ্ডব। রাজ্যের অধিকার নিয়ে কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
পিতামহ ভীষ্মকে দুর্যোধন কৌরব পক্ষের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তাছাড়া অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, অঙ্গরাজ কর্ণ এরাও কৌরবপক্ষে যোগ দেন। অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
যাদবরাজ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিপুল সংখ্যক নারায়ণী সেনাকে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করতে পাঠান। আর নিজে যোগ দেন পাণ্ডবপক্ষে। তবে তিনি সরাসরি যুদ্ধ করেননি। তিনি ছিলেন অর্জুনের রথের সারথি।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে অর্জুন কৌরবদের এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছিলেন। তখন দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের - সঙ্গে পরামর্শ করে চক্রব্যূহ রচনা করেন। চক্রব্যূহ হচ্ছে চক্রাকারে সৈন্য সাজানো। এতে ঢোকার এবং বের হওয়ার একটিমাত্র পথ থাকে। এই ব্যূহ ভেদ করা খুব কঠিন। ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষের বড় বড় যোদ্ধা এই ব্যূহ ভেদ করতে পারলেন না। শ্রীকৃষ্ণের বোন সুভদ্রা এবং অর্জুনের পুত্র ছিলেন অভিমন্যু। অভিমন্যু তখন মাত্র ষোলো বছরের বালক। তাছাড়া তিনি ব্যূহতে প্রবেশের কৌশল জানতেন কিন্তু বের হওয়ার কৌশল জানতেন না। শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করবেন না। অর্জুন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত। আবার কেউ একজন এগিয়ে না গেলেও পাণ্ডবদের পরাজয় হবে। অর্জুন বাদে অন্যান্য পান্ডরেরা অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে মানা করতে থাকেন। কারণ তারা জানতেন একবার চক্রবৃহ্যে প্রবেশ করলে অভিমন্যুর মৃত্যু অবধারিত। অভিমন্যু নিজেও তা জানত কিন্তু অসীম সাহসী অভিমন্যু পরাজয় ঠেকাতে এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। বাধ্য হয়ে তখন যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে বললেন, তুমি যাও চক্রব্যূহ ভেদ করো। আমরা সৈন্যদল নিয়ে তোমাকে বের করে আনব।
সাহসী অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করে ভিতরে ঢুকলেন। তাঁর তীরের আঘাতে কৌরবদের বিপুল সেনা নিহত হলো। নিহত হলো মহাবীর শল্যের ভাই, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণসহ অনেক যোদ্ধা। তখন দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা ও শকুনি এই সাত মহাযোদ্ধা অভিমন্যুর সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। তাঁরাও সাতবার পরাজিত হলেন। এরপর এই সাতজন যোদ্ধা একসাথে চারদিক থেকে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। এই মিলিত আক্রমণে অভিমন্যুর অস্ত্র, রথ সব ধ্বংস হলো। তখন তিনি রথের চাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেন। অবশেষে যুদ্ধ করতে করতে নির্ভয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন সৎসাহসী অভিমন্যু।
ছক ৩.৪: সৎসাহস
|
'বিবেকবোধ' কথাটির মানে বিচার-বিবেচনা করার বোধ। ন্যায়-অন্যায়কে আলাদা করে সেই অনুযায়ী আচরণ করার ক্ষমতা। একটি ছোট্ট শিশু কেবল নিজের প্রয়োজন, সুবিধা-অসুবিধাটুকু বোঝে। অন্য কারোর কথা ভাবার বোধ তার মধ্যে তৈরি হয় না। কোনটা ভালো-কোনটা মন্দ, কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত- তাকে বারেবারে বুঝিয়ে দিতে হয়। কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন সে নিজেই উচিত-অনুচিতের তফাৎ করতে পারে, কেবল নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অন্যের কথাও ভাবতে শেখে তখন আমরা তাকে বিবেকবান মানুষ বলি।
মহাভারতের উজ্জ্বল চরিত্র যুধিষ্ঠিরকে আমরা একজন বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পাই। তার বিবেকবোধের পরিচয় পাওয়া যায় এ রকম অনেক কাহিনি আছে। সেগুলোর মধ্য থেকে একটা তোমাদের শোনাই।
যুধিষ্ঠির তখন হস্তিনাপুরের রাজা। তিনি অভিমন্যু ও উত্তরার ছেলে পরীক্ষিৎকে রাজা করে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ তিনি জেনেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। দ্রৌপদী আর বাকি পাণ্ডবরা নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি, সকল অলংকার, দামি পোশাক সবকিছু ত্যাগ করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী হলেন। যাত্রাপথে তাদের একটি কুকুরের সাথে তাদের দেখা হয়। কুকুরটিও এই ছয় জনের সঙ্গী হলো। পর্বত-মরুভূমি অতিক্রম করে তাঁরা বহু দীর্ঘ পথ হাঁটতে লাগলেন।
পথে দ্রৌপদী দেহত্যাগ করলেন। এরপর একে একে সহদেব, নকুল, অর্জুন এবং সবশেষে ভীমও মারা গেলেন। বাকি থাকলেন কেবল যুধিষ্ঠির ও তাঁর অনুগত কুকুরটি। যুধিষ্ঠির তাঁর যাত্রা চালিয়ে যান। অবশেষে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র রথে চেপে যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নেমে আসেন। যুধিষ্ঠির তখন কুকুরটিকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু ইন্দ্র তাতে বাধা দেন। বলেন, যাঁর সাথে কুকুর থাকে তিনি স্বর্গে যেতে পারেন না। কিন্তু যুধিষ্ঠির বলেন, আমার ভাইয়েরা আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু কুকুরটি আমার সঙ্গে সবসময় ছিল। তাকে এখানে রেখে একা স্বর্গে চলে যাওয়া মহাপাপের কাজ হবে। যুধিষ্ঠির কুকুরটিকে রেখে স্বর্গে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর কথা শুনে ধর্মদেবতা কুকুরের রূপ ছেড়ে নিজের রূপে দেখা দিলেন। যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তোমার থেকে বড় স্বর্গে আর কেউ নেই।
স্বর্গে গিয়ে যুধিষ্ঠির দেখলেন, তাঁর ভাইয়েরা বা দ্রৌপদী কেউই সেখানে নেই। তিনি জানতে পারলেন, এঁরা সবাই নরকে অবস্থান করছেন। তিনি স্ত্রী আর ভাইদের অবস্থা দেখার জন্য নরকে যান। সেখানে তাদের করুণ অবস্থা দেখে যুধিষ্ঠিরও আর স্বর্গসুখ ভোগ করতে চাননি। তিনি সকলের সঙ্গে থেকে নরকের দুঃখভোগ করাকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন। শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির সবাইকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গে ফিরে এলেন।
ছক ৩.৫: বিবেকবোধ
যুধিষ্ঠিরের বিবেকবোধের পরিচয় | ব্যাখ্যা | নিজের জন্য শিক্ষা |
|
|
|
'সৌজন্যবোধ' কথাটির অর্থ ভদ্রতা বা শিষ্ট আচরণ। এই ভদ্রতা ভাণ করে আসা নয়। সৌজন্যবোধ-সম্পন্ন মানুষ ছোট-বড়, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ না করে সবাইকে আন্তরিকভাবে সম্মান করেন। সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করেন। তিনি অন্যের কাজে সামান্যতম উপকৃত হলেও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেন না। ভুল করলে দুঃখ প্রকাশ করতে লজ্জিত হন না। অন্যায় করে ফেললে ক্ষমা প্রার্থনা করতে কুণ্ঠিত হন না। মূলত মানুষের মধ্যকার সৌজন্যবোধ অনেকগুলো সদ্গুণের সমাবেশে তৈরি হয়।
এবারে আমরা পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে সৌজন্যবোধের একটি কাহিনি জানব।
ভক্ত ধ্রুবর ছেলে উৎকল তখন পৃথিবীর রাজা। উৎকলও বাবার মতন ধর্মপ্রাণ। তাঁর দান ধ্যান যজ্ঞের সীমা ছিল না। প্রজাপালক রাজা হিসেবে তিনি সবার প্রিয় ছিলেন। প্রতিদিন অতিথি-অভ্যাগতদের দান করে, খাবার খাইয়ে তারপর তিনি নিজে খাবার গ্রহণ করতেন। তারপরে বসতেন রাজসভায়। তাঁর আচরণে কোনো বিরক্তি নেই। সদাই হাসিমুখ।
রাজার রাজসভা আলো করে থাকতেন অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, মরীচি, লোমশ, দুর্বাসা, বৃহস্পতি, শুক্র প্রভৃতি বড় বড় মুনি-ঋষিরা। এমন যে দানবীর রাজা, তাঁকেও একদিন মহাসংকটে পড়তে হলো। সেদিন যজ্ঞকর্ম শেষ করতে অনেক দেরি হয়েছে। শেষ বেলায় ক্লান্ত শরীরে রাজা এসে বসলেন সিংহাসনে। এমন সময়ে এক কঙ্কালসার দেহের ব্রাহ্মণ এলেন। তাঁর পরনে সামান্য কাপড়, একমাথা রুক্ষ চুলের জটা। তিনি এসে রাজাকে রীতি অনুযায়ী আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু ক্লান্ত রাজা ব্রাহ্মণকে যথাবিধি সমাদর করতে পারলেন না। তাঁর উচিত ছিল সিংহাসন থেকে উঠে এসে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানো, তাঁর সেবার উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু তিনি সেসবের কিছু না করে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালেন মাত্র।
তাতে ব্রাহ্মণ গেলেন দারুণ রেগে! গর্জন করে বললেন, শিব আমার গুরু। শ্রীকৃষ্ণ আমার ঈশ্বর। তোমার সভায় আমি প্রার্থী হয়ে আসিনি। এসেছিলাম সাধুদর্শনে। কিন্তু তোমার এতই দম্ভ হয়েছে যে, আমার প্রতি যথাযথ সৌজন্য দেখাতে ভুলে গেলে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, রোগ-ব্যাধি তোমায় গ্রাস করবে, তুমি শ্রীহীন হবে। তোমার দন্ত চূর্ণ হবে।
এই নিদারুণ কথা শুনে রাজা চমকে উঠলেন। সামান্য অবহেলায় কত বড় সর্বনাশ! সভার সমস্ত মুনিঋষিরাও চমকে উঠলেন। রাজার এত পুণ্যকর্ম কি একদিনের অশিষ্ট আচরণের কারণে বিফলে যাবে। তাঁরা সবাই মিলে ব্রাহ্মণের কাছে করুণা ভিক্ষা করলেন। এই অভিশাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলেন।
রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণকে সমাদর করে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। সাধ্যমতো সেবা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করলেন। ব্রাহ্মণ রাজাকে শাপমুক্তির উপায় জানিয়ে বিদায় নিলেন।
ছক ৩.৬: যেখানে যেমন সৌজন্যবোধ প্রকাশ করতে হয়
পরিস্থিতি | উপযুক্ত সৌজন্যমূলক আচরণ | আত্মমূল্যায়ন |
শ্রেণিকক্ষের একজনের কথা বলার সময়ে
| ||
বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময়ে
| ||
কারোর সঙ্গে ধাক্কা লাগলে
| ||
না বুঝে কারোর ক্ষতি করে। ফেললে
| ||
মতের মিল হয় না এমন কারোর সঙ্গে আলাপকালে
|
উপরের তালিকার যেগুলো তুমি মেনে চলো সেগুলোতে গোল, যেগুলো মেনে চলো না সেগুলোতে তিনকোণা আর যেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করো সেগুলোতে চারকোণা চিহ্ন দাও।
আমরা দেখলাম, আমাদের ধর্মগ্রন্থে অনেক সুন্দর সুন্দর কাহিনি আছে। সেগুলোর ভাবার্থ অনুসরণ করে আমরা নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হতে পারি। তেমনি আমাদের হিন্দুধর্মের ইতিহাসে অনেক মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁরা তাঁদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানবিক মূল্যবোধ, জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
তাঁদের জীবন থেকেও আমরা নিজেকে সার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা নিতে পারি।
এখানে আমরা এমন কয়েকজন আদর্শ মানব-মানবীর জীবন সম্পর্কে জানব যাঁদের অনুসরণ করে আমরাও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হতে পারি।
আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে যাজ্ঞবন্ধ্য নামে এক খ্যাতিমান ঋষি ছিলেন। একদিন সরষু নদীতে স্নান করতে নেমে জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হঠাৎ তাঁর মনে হল, আর মাত্র কয়েকটি দিন বাঁচবেন তিনি। অথচ তখনও একটি বই লেখা বাকি। সম্পত্তিরও কোনো বিলিবণ্টন হয়নি। যাজ্ঞবন্ধ্য চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরলেন।
তাঁর দুই স্ত্রী কাত্যায়নী আর মৈত্রেয়ী। তিনি স্ত্রীদের ডেকে বললেন- আমার মৃত্যু আসন্ন। এবার গৃহত্যাগ করে। বানপ্রস্থে যাবার সময়। যা-কিছু সম্পত্তি আছে তা তোমাদের দুজনকে ভাগ করে দিতে চাই। কাত্যায়নী বয়সে বড়। তাঁর কয়েকটি সন্তানও আছে। মৈত্রেয়ী তরুণী। তিনি আপন মনে থাকেন। তিনি সংসারধর্ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মবিদ্যারও অনুশীলন করতেন। তাঁর জানার আগ্রহ ছিল অদম্য। তার মধ্যে একটা উদাস ভাব ছিল। কীসে তার আসক্তি বোঝা যায় না। যেন এমন কিছুর প্রত্যাশায় আছেন, কোনোদিন যার নাগাল পাওয়া যাবে না। তিনি যাজ্ঞবন্ধ্যের সঙ্গে ব্রহ্মবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পেতেন। মৈত্রেয়ী কোনো সম্পত্তি নিতে রাজি হলেন না।
যাজ্ঞবন্ধ্য তাঁকে কিছুটা ভূমি নেওয়ার অনুরোধ জানালে মৈত্রেয়ী প্রশ্ন করলেন, ভূমি পেলে কি আমি অমর হতে পারব?
যাজ্ঞবন্ধ্য জবাব দিলেন, না। মৈত্রেয়ী বলল, তাহলে ভূমি নিয়ে আমি কী করব? যাজ্ঞবল্কা যতবারই কিছু দিতে চাইলেন ততবারই মৈত্রেয়ী তা প্রত্যাখ্যান করলেন। যা দিয়ে মানুষ অমর হয় না এমন কোনো কিছুরই তার প্রয়োজন নেই। তিনি যাজ্ঞবন্ধ্যের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে কেবল অমরত্বের সন্ধান চান।
মৈত্রেয়ী বলেন, শুধু আপনার আশ্রমের ধন-সম্পদ কেন, যদি ধন ধান্যে পরিপূর্ণ সমগ্র পৃথিবী আমার হয়, তবে কি আমি সেসব দিয়ে অমৃতত্ব লাভ করতে পারব? এই ধন-সম্পদ দিয়ে অনেক যাগ-যজ্ঞ করলেই কি আমি অমর হতে পারব?'
মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন শুনে যাজ্ঞবন্ধ্য অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উত্তর দিলেন, 'ধনী লোকের জীবন যেমন, তোমার জীবনও সেরকম হবে। বিত্ত দ্বারা কখনো অমৃতত্ব লাভ করা যায় না।' যাজ্ঞবন্ধ্য আরও বললেন, 'মানুষ পার্থিব ভোগসুখের সঙ্গে মিশে গেলে তাঁর অমৃতের মধুর আস্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। কারণ, মানুষ মরণশীল। সেই চির নিশ্চিত মৃত্যু এসে মানুষের সকল ভোগসুখের অবসান ঘটায়। তাই বিত্ত দ্বারা কখনই অমৃতত্ব লাভের সম্ভাবনা নেই।'
যাজ্ঞবন্ধ্যের উত্তর শুনে মৈত্রেয়ী এই দার্শনিক সত্য উপলব্ধি করলেন যে, বিত্তের দ্বারা অমৃতত্বের আশা নেই। মৃত্যু তাঁকে মুক্তি দেবে না। যদি অমৃতত্বের সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে ধন তুচ্ছ, বিত্ত তুচ্ছ, তুচ্ছ এই গৃহসংসার। মোহজালে পতিত মানুষের পরম সত্য লাভ হয় না।
মৈত্রেয়ী স্বামীকে বিমর্ষ বদনে বলেন, "যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্?” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২/৪) অর্থাৎ যা দিয়ে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব না, তা দিয়ে আমি কী করব? এই অসার ধন-সম্পদ দিয়ে আমার কী হবে? আপনি যে ধন লাভ করে এই বিষয়-সম্পত্তি পরিত্যাগ করেছেন, আপনি যে জ্ঞানে জ্ঞানী হয়েছেন, দয়া করে আমাকে সে সম্বন্ধে উপদেশ দিন, আমাকে অমৃতত্ব লাভের সন্ধান দিন।'
মৈত্রেয়ীর কথা শুনে যাজ্ঞবল্ক্য সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত বাদ দিলেন। তিনি মৈত্রেয়ীর কাছে অমৃতত্বের ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, 'পতি যে পত্নীর প্রিয় হয়, তার কারণ পতিকে ভালোবেসে পত্নীর আত্মা সুখী হয়। পুত্র-কন্যাকে স্নেহ করে পিতা-মাতা আত্মিক সুখ অনুভব করেন, তাই সন্তানও পিতা-মাতার স্নেহে নিজ নিজ আত্মিক সুখ অনুভব করে। একারণে সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার প্রতি অনুরক্ত থাকে। মানুষ আসলে সম্পদকে ভালোবাসে না। সম্পদ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারে বলেই তা লোকের প্রিয় হয়। পতি বলো, পুত্র বলো, পত্নী বলো, দেবতাদের কথাও যদি বলো, সবাই নিজের আত্মার সুখের জন্যই অন্যের প্রিয় হয়ে ওঠে। আত্মাই মানুষের মুখ্য প্রীতির বস্তু। এছাড়া ধন, জন, বিত্ত, স্বর্গ- সব কিছুই গৌণ।'
ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবন্ধ্যের উপদেশ শুনে মৈত্রেয়ী তৃপ্ত হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন অমৃতের সাগর দূরে নয়। একেবারে নিজের অন্তরের ভেতরে। আত্মাই পরম অমৃত। অবশেষে মৈত্রেয়ী অমৃতের সন্ধান পেলেন।
ছক ৩.৭: অমৃতের সন্ধানে
আমি যা শিখেছি | মানবকল্যাণে যেভাবে কাজে লাগাব |
|
|
১৫-১৬ শতকের আধ্যাত্মিক গুরু সমাজ সংস্কারক শ্রীচৈতন্য। অনুসারীদের মতে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার। শ্রীচৈতন্যর ধর্মীয় আন্দোলনের ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়। হিন্দুধর্ম সংস্কারে তাঁর ভূমিকা অনন্য সাধারণ।
শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে। তাঁর পিতার নাম পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী।
জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর জীবনে অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা ছিল। একে একে তাঁদের আটজন কন্যা অকালে মৃত্যুবরণ করে। তারপর একটি পুত্রসন্তান হয়। তাঁর নাম বিশ্বরূপ। তিনি যৌবনেই ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। কথিত আছে, একদিন শচীদেবী ভগবানের চিন্তায় বিভোর হয়ে গঙ্গাস্নান করছিলেন। এমন সময় একটি তুলসীপাতা ভেসে এসে তাঁর নাভি স্পর্শ করে। এ ঘটনার কিছুদিন পর তাঁর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। এই পুত্রের নাম রাখেন বিশ্বম্ভর। গৌর বর্ণের জন্য তাঁকে গৌর, গৌরচন্দ্র, গৌরাঙ্গও বলা হয়। তবে তাঁর ডাক নাম নিমাই। পরবর্তীকালে এই নিমাই-ই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বা চৈতন্যদেব নামে খ্যাত হন।
নিমাইয়ের বয়স যখন ১০-১১, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মা শচীদেবী কনিষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। বালক নিমাই ছিলেন খুবই চঞ্চল ও দুরন্ত। তবে তিনি যেমন দেখতে সুন্দর ছিলেন, তেমনি ছিলেন খুব মেধাবী । তাঁর মেধা এবং রূপের কারণে সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন। বিষ্ণু পণ্ডিত নিমাইকে হাতেখড়ি দেন। নিমাই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। বালক নিমাই পড়াশোনার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাই অল্পকালের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ, অলংকার, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী। যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই লোকজনকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি পণ্ডিত নিমাই হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেন। এ সময় তিনি নিজেই একটি টোল খুলে ছাত্র পড়াতে লাগলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মা শচীদেবী পন্ডিত বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে দেন। সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী ছেলের বিয়েতে অনেক পণ নিতে পারতেন। কিন্তু শচীদেবী কোনো পণ নেননি।
সে সময় কেশব মিশ্র নামে কাশ্মীরে এক বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। তিনি কাশী, কাঞ্চী, দ্রাবিড়, নালন্দা প্রভৃতি স্থানের পন্ডিতদের শাস্ত্রবিচারে পরাজিত করে নবদ্বীপে আসেন। নবদ্বীপে এসে তিনি সেখানকার পন্ডিতদের শাস্ত্রবিচারে আহ্বান জানান। তিনি সগর্বে ঘোষণা করেন, 'হয় তর্ক বিচার করুন, না হয় জয়পত্র লিখে দিন।' তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা সবাই জানতেন। তাই তাঁর আহ্বানে নবদ্বীপের পণ্ডিত-সমাজ ভীত হয়ে পড়েন। তখন তরুণ পণ্ডিত নিমাই দিগ্বিজয়ী পন্ডিত কেশব মিশ্রের সম্মুখীন হন। গঙ্গাতীরে দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। নিমাইয়ের অনুরোধে কেশব মিশ্র তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে শতাধিক শ্লোকে গঙ্গাস্ত্রোত্র রচনা করেন। আর নিমাই তখন শুরু করেন শ্লোকগুলোর সমালোচনা। তিনি কোন শ্লোকে কোথায় কী ভুল আছে তা ব্যাখ্যা করেন। নিমাইয়ের সমালোচনা শুনে উপস্থিত পন্ডিতগণ বিস্মিত হন। কেশব মিশ্রও তাঁর ভুল স্বীকার করেন। এ ঘটনার পর নবদ্বীপে নিমাইয়ের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আরো বেড়ে যায়।
কিছুদিন পর নিমাই একবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে আসেন। নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে শুনলেন, স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী সর্পদংশনে মারা গেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর মধ্যে সংসার-বিমুখতা দেখা দেয়। তিনি অত্যন্ত ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন। এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মা শচীদেবী সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতে সনাতন পন্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের আবার বিয়ে দেন।
কয়েক বছর সুখেই কাটে। ২২ বছর বয়সে যুবক চৈতন্য তাঁর মৃত পিতার আত্মার সদ্গতি কামনায় পিন্ডদানের জন্য গয়ায় যান। সেখানে প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক ও সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে নিমাই একাকী সাক্ষাৎ করেন। তিনি ঈশ্বরপুরীর নিকট কৃষ্ণনামে দীক্ষা নেন। এতে তাঁর মনে বিরাট পরিবর্তন আসে। নবদ্বীপে ফিরে অধ্যাপনা, সংসারধর্ম সব ছেড়ে দেন। শুধু কৃষ্ণনাম করেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ, অদ্বৈতাচার্য প্রমুখ। তাঁরা তাঁর প্রধান পার্ষদ। তবে নিত্যানন্দ ছিলেন সবচেয়ে কাছের।
অনুসারীদের নিয়ে নিমাই বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, এমনকি গ্রামের পথে পথে কৃষ্ণনাম প্রচার করতে থাকেন। এতে অবশ্য অনেকে ক্ষুব্ধ হন। অনেকে বাধাও দেন। জগাই-মাধাই নামে মাতাল দুই ভাই একদিন নিমাই ও নিত্যানন্দকে আক্রমণ করেন। কিন্তু নিমাই প্রেমভক্তি দিয়ে সবাইকে আপন করে নেন। তাঁরা সকলে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিমাইয়ের এ প্রেমভক্তির ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
এদিকে সংসারের প্রতি নিমাইয়ের মন একেবারেই উঠে যায়। তিনি সংসার ত্যাগ করার কথা ভাবেন। তারপর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের এক গভীর রাতে তিনি মা, স্ত্রী এবং ভক্তদের ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন। কাটোয়ায় গিয়ে তিনি কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন। তখন তাঁর নতুন নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য।
শ্রীচৈতন্য তাঁর প্রেমভক্তির ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। পুরী, দাক্ষিণাত্য, বৃন্দাবন, কাশী প্রভৃতি স্থান ঘুরে তিনি জীবনের শেষ ১৮ বছর পুরীর নীলাচলে অতিবাহিত করেন। মাতৃভক্ত শ্রীচৈতন্য মায়ের অনুরোধে নীলাচলে থেকে জীবনের শেষ অবধি মায়ের খবরাখবর নেন। এ সময় শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট প্রমুখ বিশিষ্ট বৈষ্ণব পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেম দিন দিন আরও বাড়তে থাকে। পথে পথে তিনি 'কোথা কৃষ্ণ, দেখা দাও, দেখা দাও' বলে ঘুরে বেড়াতেন। শ্রীচৈতন্য প্রায়ই কৃষ্ণনামে উন্মাদ হয়ে থাকতেন। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আষাঢ় মাসে একদিন তিনি দিব্যভাবাবেশে আবিষ্ট হয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সবাই বাইরে উন্মুখ হয়ে বসে থাকেন। তারপর দরজা খুলে তাঁকে আর দেখা যায়নি। ভেতরে শুধু জগন্নাথদেবের মূর্তি। ভক্তদের ধারণা, শ্রীচৈতন্য জগন্নাথদেবের দেহে লীন হয়ে গেছেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান নিয়ে বহু পণ্ডিতের বহু গবেষণা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সর্বসম্মত মীমাংসা হয়নি।
শ্রীচৈতন্য সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ মানেননি। তিনি সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা, সকল প্রকার ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সমস্ত সংকীর্ণতার ওপরে উঠে যেভাবে শ্রীচৈতন্য অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মানুষে মানুষে সমভাবের কথা বলেছিলেন। সেকালে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
তাঁর প্রেমভক্তির ধর্মে উচ্চ-নীচের কোনো স্থান ছিল না। তিনি সকলের প্রতি সমানভাবে স্নেহ ও ভালোবাসা বিতরণ করেছেন। তিনি সকলের সঙ্গে এক সারিতে বসে আহার গ্রহণ করেছেন। এভাবে তিনি হিন্দুসমাজকে নানা অবক্ষয় থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভেদ, হানাহানিকে বহুলাংশে দূর করতে পেরেছিলেন।
শুধু হিন্দু নয়, তাঁর প্রেমভক্তির কাছে মুসলমান, খ্রিষ্টান ইত্যাদি জাতিভেদও ছিল না। সবাইকে তিনি প্রেম দিয়ে আপন করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছেন:
যেই ভজে, সেই বড়, অভক্ত হীন ছাড়।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার।।
উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরভিমান।
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।
শ্রীচৈতন্যের অনুসারীদের প্রতিদিন কৃষ্ণবিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করতে হতো। এ কারণে সেসময়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল। পরবর্তীতে নারীশিক্ষায় শ্রীচৈতন্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। উনিশ শতকে বাংলার সম্ভ্রান্ত গৃহে মেয়েদের পড়ানোর জন্য বৈষ্ণবীরা আসতেন। বৈষ্ণবসমাজে নারীকে মর্যাদা দেওয়া হতো। এমনকি মেয়েরাও দীক্ষাদানের অধিকার পেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও চৈতন্যের প্রভাবই কাজ করেছে। চৈতন্যের প্রিয় ছিল কৃষ্ণনাম এবং কৃষ্ণবিষয়ক পদকীর্তন। আবার বৈষ্ণবের নিত্যকৃত্য ছিল কৃষ্ণকথা পাঠ ও শ্রবণ। তার ফলে চৈতন্যদেবের সময়ে এবং তাঁর পরবর্তী বাংলার বৈষ্ণব পদাবলি হয়ে উঠেছিল আধ্যাত্মিকতার ঐশ্বর্যে মন্ডিত।
ধর্মকে কেন্দ্র করে শ্রীচৈতন্য সেকালের বাঙালি জীবনে যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন তা দলে/জোড়ায় খুঁজে বের করে ইনফোগ্রাফিক পোস্টারের মাধ্যমে সকলের সামনে উপস্থাপন করো।
শ্রীচৈতন্যর জীবন থেকে পাওয়া যে শিক্ষাটি তুমি তোমার জীবনে প্রয়োগ করতে চাও তা লিখে রাখো।
ছক ৩.৮: অমৃত-জীবন
|
বামাক্ষ্যাপা ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ সাধক। তিনি তান্ত্রিক মতে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর সাধনার স্থল ছিল তারাপীঠ। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তারাপীঠের অবস্থান। এখানে আরও অনেক তন্ত্রসাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। যেমন- আনন্দনাথ, কৈলাসপতি প্রমুখ। তারাপীঠ হিন্দুদের একটি বিশেষ তীর্থস্থান।
তারাপীঠের কাছে অটলা গ্রাম। ১৮৩৭ সালে শিবচতুর্দশী তিথিতে সেখানে বামাক্ষ্যাপা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং মা রাজকুমারী দেবী।
বামাক্ষ্যাপার আসল নাম বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পরে তারামায়ের সাধনায় তাঁর ক্ষ্যাপামি বা একরোখা ভাব দেখে সবাই তাঁকে বামাক্ষ্যাপা বলেই ডাকতেন। পিতা সর্বানন্দ খেত খামারে কাজ করতেন। এতে যে সামান্য আয় হতো, তাতেই তাঁর সংসার কোনো রকমে চলে যেত।
সর্বানন্দ ছিলেন বড়ই ধর্মভীরু ও সরল প্রকৃতির মানুষ। অল্প বয়সে দীক্ষা নিয়ে তিনি তারামায়ের সাধনায় ডুবে যান। স্ত্রী রাজকুমারীও ছিলেন ধর্মপ্রাণা এবং ভক্তিমতী। এমন বাবা মায়ের সন্তান হয়ে বামাচরণও তারামায়ের ভক্ত হন। 'জয় তারা জয় তারা' বলে তিনি মাটিতে লুটোপুটি খান। বামাচরণের সরলতা ও আপনভোলা ভাব অন্যের চোখে ছিল পাগলামি।
প্রথাগত লেখাপড়ার প্রতি বামাচরণের মন ছিল না। কোনোরকমে পাঠশালা শেষ করেন তিনি। উচ্চ বিদ্যালয়ে আর যাওয়া হয়নি।
বামাচরণ সুমিষ্ট স্বরে গান গাইতে পারতেন। একদিন তারামায়ের মন্দিরে গানের আসর বসেছে। বেহালা বাজাচ্ছেন পিতা সর্বানন্দ। সর্বানন্দ এক সময়ে বামাচরণকে কৃষ্ণ সাজিয়ে দিলেন। আর বামা নেচে নেচে মিষ্টি কণ্ঠে গান গাইতে লাগলেন। গাঁয়ের মানুষ বামার কৃষ্ণরূপ দেখে আর গান শুনে পরম আনন্দ পেলেন।
একদিন বামাচরণ জেদ ধরেন শ্মশানে যাবেন। পিতা সর্বানন্দ কিছুতেই থামাতে পারেন না। অবশেষে বামাচরণকে নিয়ে তিনি শ্মশানপুরীতে গেলেন। মহাশ্মশান দেখে বামার মনে ভাবান্তরের সৃষ্টি হয়। তিনি শ্মশানভূমিকে ভালোবেসে ফেলেন।
এই ঘটনার পর বামা যেন কেমন হয়ে গিয়েছেন। সত্যি সত্যি তিনি ক্ষ্যাপায় পরিণত হন। এ ক্ষ্যাপামি তাঁর গভীর ধর্মনিষ্ঠার জন্য। শ্মশানভূমির সাথে, তারামায়ের সাথে তাঁর নিবিড় ভাব গড়ে উঠল। শুরু হলো বামাচরণের শ্মশানলীলা। সে সময়ে শ্মশানে ছিলেন তন্ত্রসাধক ও বেদজ্ঞ মোক্ষদানন্দ। আরও ছিলেন ব্রজবাসী কৈলাসপতি। কৈলাসপতি বামাকে দীক্ষা দেন আর মোক্ষদানন্দ দেন সাধনার শিক্ষা। শুরু হলো মহাশ্মশানে বামাচরণের তন্ত্রসাধনা।
এরপর হঠাৎ একদিন পিতা সর্বানন্দের মৃত্যু হয়। বামাচরণের বয়স তখন ১৮ বছর। সংসারের কথা ভেবে মা রাজকুমারী ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। বামাকে কিছু একটা করতে বলেন। বামা একের পর এক কাজ নেন। কিন্তু কোথাও মন বসাতে পারেন না। তাঁর কেবল তারামায়ের রাঙা চরণের কথা মনে পড়ে। একবার এক মন্দিরে ফুল তোলার কাজ নেন। কিন্তু রক্তজবা তুলতে গিয়ে মনে পড়ে যায় তারামায়ের চরণযুগলের কথা। আর অমনি তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন। কখনোবা ভাবে বিভোর হয়ে গান ধরেন, এক মনে গাছতলায় বসে থাকেন। ফলে তাঁর কোনো কাজই বেশিদিন টেকে না। এভাবেই তিনি বামাক্ষ্যাপা নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বামাক্ষ্যাপার এই ক্ষ্যাপামি চলতেই থাকে। তারামায়ের সাধনায় তিনি মন-প্রাণ সপে দেন এবং এক সময় সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর সিদ্ধিলাভের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন নাটোরের মহারানি অন্নদাসুন্দরী তাঁর কথা জানতে পারেন। তারাপীঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তখন ছিল নাটোরের রাজপরিবারের। রানির নির্দেশে বামাক্ষ্যাপাকে তারাপীঠের পুরোহিত নিয়োগ করা হয়।
বামাক্ষ্যাপা ছিলেন খুবই সহজ সরল এক আত্মভোলা মানুষ। খাদ্য-অখাদ্য, পূজা মন্ত্র কোনো কিছুই তিনি মানতেন না। 'এই বেলপাতা লে মা, এই অন্ন লে মা, এই জল লে মা, এই ফুল ধূপ লে মা- এই ছিল বামার পূজা। বামা তারামায়ের ভক্ত হলেও নিজের মাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। মা রাজকুমারী মারা যাওয়ার পর তাঁর দেহ তারাপীঠে আনা হয়। বামা তখন দ্বারকা নদীর ওপারে তারাপীঠ শ্মশানে। বর্ষাকালে নদীতে প্রচন্ড ঢেউ। তাই ভয়ে কেউ মৃতদেহ ওপারে শ্মশানে নিতে চাইছে না। এপারেই দাহ করার আয়োজন করছে। কিন্তু মায়ের আত্মার সদাতির জন্য তারাপীঠের শ্মশানেই তাঁকে দাহ করা দরকার- এ কথা ভেবে বামাক্ষেপা মা-তারার নাম নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। এপারে এসে মায়ের শরীর নিজের সঙ্গে বেঁধে সাঁতরে ওপারে গেলেন এবং শ্মশানে মায়ের দেহ দাহ করলেন।
বামাক্ষ্যাপা লোকশিক্ষার জন্য বলতেন:
১। ধর্ম অন্তরের জিনিস। বেশি আড়ম্বর করলে নষ্ট হয়।
২। মায়াকে জয় করতে পারলেই মহামায়ার কৃপা পাওয়া যায়।
৩। তারা মায়ের করুণা পেলেও মোক্ষ লাভ হয়।
৪। গুরু, মন্ত্র আর ভগবান এঁদের মধ্যে পার্থক্য ভাবতে নেই। তোমরাও ভাববে না, তোমাদের মঙ্গল হবে।
৫। কলিযুগে মুক্তিসাধনা আর হরিনাম ছাড়া জীবের গতি নেই।
৬। দিনরাত যে কালীতারা, রাধাকৃষ্ণ নাম করে, পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
তন্ত্রসাধনায় অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে বামাক্ষ্যাপা ১৯১১ সালে পরলোক গমন করেন।
ছক ৩.৯: সহজ জীবন
|
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন নামকরা উকিল, ছিলেন সুপণ্ডিতও। তিনি অনেক ভাষা জানতেন। বিবেকানন্দের মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণা সুগৃহিণী।
বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছেলেবেলায় তাঁর আর একটি নাম ছিল বীরেশ্বর। তবে আদর করে সবাই তাঁকে 'বিলে' বলে ডাকতেন। বিলে ছিলেন খুব দুরন্ত ও একরোখা, ছিলেন একটু অন্য রকম। উদার দৃষ্টিভঙ্গি, জীবে দয়া- এসব ছিল তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। জাত-পাত ভেদ তাঁর ভালো লাগত না। তাঁর পিতার মক্কেলদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রসহ বিভিন্ন জাত ধর্মের লোক ছিলেন। বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁদের সবার জন্য আলাদা আলাদ হুঁকা ছিল তামুক সেবনের জন্য। প্রতিটি হুঁকার গায়ে নাম লেখা থাকত। নরেন্দ্রনাথ একদিন সব হুঁকায় মুখ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় পিতা বিশ্বনাথ এসে পড়েন। তিনি ছেলেকে বলেন, 'এ কী হচ্ছে, নরেন?' নরেন্দ্রনাথ বললেন, 'আমি সব হুঁকা টেনে দেখলাম, কই আমার তো জাত গেল না!' ছেলের এই অদ্ভুত কথা শুনে পিতা হেসে ফেললেন। প্রভাত যেমন সমস্ত দিনের ইঙ্গিত দেয়, এই ঘটনাও তেমনি সেদিন ভবিষ্যতের সর্বজীবে সমদর্শী বিবেকানন্দের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
নরেন্দ্রনাথ লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলেন। পাশাপাশি খেলাধুলা ও গানবাজনায়ও পারদর্শী ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন সত্যবাদী, তেমনি ছিলেন নির্ভীক। একদিন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক পড়াচ্ছেন। বিলে তখন কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তা দেখে শিক্ষক রেগে যান। তিনি তাঁদের পড়া জিজ্ঞেস করেন। বিলে ছাড়া আর কেউ পড়া বলতে পারেননি। কারণ, বিলে পড়াও শুনছিলেন আর কথাও বলছিলেন। তাই শিক্ষক বিলে বাদে অন্যদের দাঁড়াতে বললেন। তবে তাদের সঙ্গে বিলেও উঠে দাঁড়ালেন। শিক্ষক বললেন, 'তোমাকে দাঁড়াতে হবে না।' উত্তরে বিলে বললেন, 'কেন, আমিও তো কথা বলেছি। অপরাধ তো আমিও করেছি।' বিলের এই সততা ও সাহসিকতায় শিক্ষক খুব খুশি হলেন।
বিলে দরিদ্রদের খুব ভালোবাসতেন। তাই তাঁদের দেখলেই দৌড়ে ঘরে যেতেন। ঘরে জামা কাপড়, খাবার দাবার যা পেতেন এনে তাদের দিতেন। বিলে ছিলেন তাঁর খেলার সঙ্গিদের দলনেতা। সুযোগ পেলেই তিনি সঙ্গিদের নিয়ে 'ধ্যান- ধ্যান' খেলায় মেতে উঠতেন। কখনো একা-একাই ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। ধ্যান করাটা তাঁর একটা প্রিয় খেলা ছিল।
নরেন্দ্রনাথ এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আইন ও দর্শন বিষয়েও তিনি অনেক পড়াশোনা করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিএ পাস করেন। এর পরপরই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ফলে তাঁদের পরিবার অনেক অর্থসংকটে পড়ে। মা এবং ছোট ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির সন্ধান করেন, কিন্তু সুযোগ হয় না। অবশেষে কলকাতার অ্যাটর্নি অফিসে বই অনুবাদের কাজ করে কিছু আয় রোজগার করতে থাকেন।
এ সময়ে নরেন্দ্রনাথের মনে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে চিন্তা করেন। ঈশ্বর কি আছেন? তাঁকে কি দেখা যায়? এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই তাঁর মনে জাগে। তিনি অনেককে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসও করেছেন। কিন্তু কারো উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এমন সময় একদিন তাঁর দেখা হয় মহাসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কলকাতার দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে থাকেন। নরেন্দ্রনাথ একদিন চলে যান সেখানে। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন, 'আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?' শ্রীরামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলেন, 'হ্যাঁ, দেখেছি; যেমন তোকে দেখছি। চাইলে তোকেও দেখাতে পারি।'
সাধক শ্রীরামকৃষ্ণকে নরেন্দ্রনাথের ভালো লাগল। তাঁর প্রতি কেমন যেন একটা ভক্তির ভাব জেগে উঠল। তাই তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন। একসময় শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট তিনি ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নেন। নরেন্দ্রনাথ হন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। তখন তাঁর নাম হয় বিবেকানন্দ। পরবর্তীকালে ভক্তরা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ বা শুধু স্বামীজী বলেই ডাকতেন।
বিবেকানন্দ গৃহত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু ভারতবর্ষ এবং তার মানুষকে ত্যাগ করেননি। তাই তিনি বেরিয়ে পড়লেন পথে পথে। নিজের চোখে দেখতে চাইলেন ভারতবর্ষের মানুষের অবস্থা। তিনি সারা ভারতবর্ষ ঘুরলেন। দেখলেন, সারা দেশে কেবল দারিদ্র্য আর দারিদ্র্য। কেবল অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কার। দেশবাসীর এই দুরবস্থা দেখে তিনি খুব ব্যথিত হলেন। তিনি এই অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর দারিদ্র্যের কারণ জানতে চাইলেন। কীভাবে এসব থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করা যায়, সে কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
দেশে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। পরাধীন দেশ। তিনি বুঝতে পারলেন, পরের শাসনে দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই দেশকে বাঁচাতে হবে। দেশকে জাগাতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। পরাধীন দেশ কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। দেশের দারিদ্র্য দূর করতে হবে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করতে হবে। সব মানুষকে ভালোবাসতে হবে। জীবনীশক্তির উৎস হচ্ছে ধর্ম। এই ধর্ম হচ্ছে দেবতাজ্ঞানে মানুষের সেবা। এই ধর্মমন্ত্রে সবাইকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। তবেই দেশের উন্নতি হবে।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বিবেকানন্দ আমেরিকায় যান। ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা দেন। বিবেকানন্দ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, 'হিন্দুধর্ম পৃথিবীর সকল ধর্মকে সমান সত্য মনে করে। সব ধর্মের লক্ষ্যই এক। নদীসমূহ যেমন এক সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সকল ধর্মেরই লক্ষ্য এক ঈশ্বর লাভ। তাই বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।' বিবেকানন্দের এই বক্তৃতায় সবাই অত্যন্ত মুগ্ধ হন। ধর্মসভার বিচারে তিনি হন শ্রেষ্ঠা বক্তা। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইট বলেছিলেন, 'ইনি এমন একজন মানুষ, যাঁর পান্ডিত্য আমাদের সমস্ত অধ্যাপকের মিলিত পাণ্ডিত্যকেও হার মানায়।'
ধর্মসভায় বক্তৃতার পর সারা আমেরিকায় বিবেকানন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসে বক্তৃতার জন্য। তিনিও হিন্দু ধর্ম-দর্শন, বিশেষত বেদান্তদর্শন সম্পর্কে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেন। তারপর যান ইউরোপ। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশ ঘুরে বেড়ান এবং বক্তৃতা দেন। তিনি বেদান্ত দর্শনের মূল তত্ত্ব তুলে ধরেন। বেদান্তের মূল কথা হচ্ছে, 'জীব ও ব্রহ্মে কোনো পার্থক্য নেই; জীবই ব্রহ্ম।' তাই ব্রহ্মজ্ঞানে জীবসেবা করতে হবে। তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেন যে, হিন্দুধর্ম কেবল মূর্তিপূজা করে না, সকল দেবতার পূজার মধ্য দিয়ে এক ঈশ্বরেরই আরাধনা করে। তাঁর বক্তৃতা থেকে ইউরোপের মানুষ হিন্দুধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে নতুন করে জানতে পারেন। অনেকে তাঁর পরম ভক্ত হয়ে যান। তাঁদের মধ্যে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিবেকানন্দের আদর্শে এতটাই উদ্বুদ্ধ হন যে, নিজের জন্মভূমি আয়ারল্যান্ড ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন। বিবেকানন্দের কাছে তিনি দীক্ষা নেন, তখন তাঁর নাম হয় ভগিনী নিবেদিতা।
প্রায় চার বছর পৃথিবী ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। দেশের মানুষ তাঁকে মহাসমাদরে গ্রহণ করে, বিশাল সংবর্ধনা দেয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি দেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে বলেন। সমস্ত কুসংস্কার পরিত্যাগ করতে বলেন। সবাইকে বিভেদ ভুলে এক হতে বলেন। তিনি বলেন, 'শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি। সৎ হওয়া আর সৎ কর্ম করা ধর্মের অঙ্গ।' বিবেকানন্দ অথর্ববেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, 'অসত্য নয়, সত্যেরই জয়; একমাত্র সত্যের মধ্যদিয়েই ঈশ্বর লাভের পথ প্রসারিত হয়।'
বিবেকানন্দ ধর্মে ধর্মে বিভেদ মানতেন না, বিশ্বাস করতেন না জাতিভেদ প্রথা। বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতাকে তিনি প্রবলভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি ঘৃণা করতেন হিংসা, কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামিকে। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি সকলকে অমৃতের সন্তান বলে মনে করতেন। তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসতেন। তিনি মনে করতেন জীবনযাপন পদ্ধতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পার্থক্য থাকলেও সকল ধর্ম, গোত্র ও বর্ণের মানুষ সমান। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনি বলতেন- নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর সকলেই আমাদের ভাই। এদের সেবাই পরম ধর্ম।
বিবেকানন্দ দারিদ্র্য দূর করা এবং দরিদ্রদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কথা ভাবতেন। তিনি বলতেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। তাই সবার আগে মানুষের দারিদ্র্য ঘোচাতে হবে। তিনি বলেছেন, 'অন্ন চাই! অন্ন চাই! দরিদ্রদের মুখে অন্ন জোগাতে হবে। আগে অন্ন, তারপর ধর্ম।' তাঁর মতে, আত্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরে বিশ্বাস এ দুটিই উন্নতি লাভের উপায়। যুবকদের আগে সুস্থ শরীর গঠন করতে হবে। তারপর ধর্ম চর্চা করবে। দুর্বল শরীরে ধর্মচর্চা হয় না, কোনো কাজই হয় না। এজন্য তাদের গীতা পড়ার আগে ফুটবল খেলতে হবে। তাতে সুস্থ শরীর গঠিত হবে। তখন তারা গীতা আরো ভালো বুঝবে।
বিবেকানন্দ অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি বলতেন- দেশের জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, সবাইকে সমানভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই একটি উন্নত জাতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নিজে মানুষ হওয়া এবং অন্যকেও প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করা- এটিই হওয়া উচিত মানব জীবনের উদ্দেশ্য।
বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বর অবস্থান করেন। সুতারং জীবসেবার চেয়ে বড় ধর্ম নেই। সে কারণে তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেছেন-
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
তাঁর এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামে-গ্রামে, নগরে-নগরে স্থাপিত হয়েছে শত-শত সেবাশ্রম, সেবাকেন্দ্র ও বিদ্যাশ্রম। এসবের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সেবা ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এখনো হচ্ছে
বিবেকানন্দ জীবসেবার কথা শুধু মুখেই বলতেন না, স্বয়ং কাজ করেও দেখিয়েছেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় একবার মহামারি আকারে প্লেগ দেখা দেয়। তখন তিনি দার্জিলিংয়ে ছিলেন। প্লেগের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং গুরুভাইদের নিয়ে রোগীদের সেবায় কাজ করেন।
সমাজে নারীর দুর্দশা নিয়েও বিবেকানন্দের ভাবনা ছিল। বৈদিক যুগের মৈত্রেয়ী, গার্গী প্রমুখ বিদুষী নারীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সেই যুগে নারীরা যদি এত শিক্ষালাভ করতে পারে, তাহলে এ যুগের নারীরা পারবে না কেন?' তাঁর মতে যে জাতি নারীদের সম্মান দেয় না, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। নারীদের অবস্থার উন্নতি না করে বিশ্বের মঙ্গলসাধন করা সম্ভব নয়। তাই বিবেকানন্দ নারীদের উন্নয়নের ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলেন, 'মেয়েদের প্রত্যেকেই এমন কিছু শিখুক যাতে প্রয়োজন হলে তাদের জীবিকা তারা অর্জন - করতে পারে। শিল্প-ব্যবসা-কৃষি শেখার ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার ও সুযোগ মেয়েদের থাকতে হবে।' - তিনি নারীকে শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখতেন। তাই তিনি বলতেন- শক্তিকে বাদ দিয়ে বিশ্বের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। তাঁর মতে প্রত্যেক পুরুষের কাছে স্ত্রী ছাড়া অন্য সব নারীই মায়ের মতো হওয়া উচিত।
বিবেকানন্দ সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য রাজা রামমোহন রায়ের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বিধবাবিবাহের প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগরকে তিনি মহাবীর বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বিধবাদের পুনর্বিবাহের পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হয়ে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকারও পরামর্শ দেন। বাল্যবিবাহকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি নারীদের সন্ন্যাস গ্রহণেরও পক্ষপাতী ছিলেন।
বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেব রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মানবসেবার আর্দশ প্রচারের জন্য রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বেলুড়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে এটি অবস্থিত। সাধারণভাবে এটি বেলুড় মঠ নামে পরিচিত। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশনও প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা রয়েছে। পৃথিব্যাপী রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে শত শত মানুষকে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সেবার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, আপৎকালীন সাহায্য প্রদান ইত্যাদি।
বিবেকানন্দ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সেবা প্রদান করতেন। একবার কলকাতায় প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তখন রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন মুসলমান বালক এসেছিল থাকার জন্য। এদের কী করা হবে জানতে চাইলে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, মুসলমান বালকেরা অবশ্যই থাকবে। শুধু তাই নয়, তাদের খাওয়া দাওয়া এবং ধর্মচর্চায় যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
বিবেকানন্দ কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। তাই বিশ্রামের অভাবে অল্প বয়সেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই বেলুড় মঠে তিনি দেহত্যাগ করেন।
স্বামী বিবেকানন্দের কয়েকটি বাণী:
১. ধর্ম এমন একটি ভাব যা পশুকে মানুষে এবং মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।
২. আমার ঈশ্বর কোনো দূর গ্রহ-উপগ্রহের অধিবাসী নয়, অজ্ঞতাবশত যাকে আমরা মানুষ বলি সেই আমার ঈশ্বর।
৩. পরধর্ম বা পরমতের প্রতি শুধু দ্বেষভাবশূন্য হলেই চলবে না, আমাদেরকে ঐ ধর্ম বা মতকে আলিঙ্গনও করতে হবে; সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি।
৪. সৎ হওয়া এবং সৎ কাজ করা এর মধ্যেই সমস্ত ধর্ম। যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে সেই ঠিক ঠিক ধার্মিক।
৫. মানুষের মহত্ত্বের পরিচয় তার চরিত্রে, বৃত্তিতে নয়।
৬. অপরকে ভালোবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বর ও নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ। অভেদ দর্শনই ধর্ম, ভেদ দর্শনই পাপ।
৭. ওঠো, জাগো, আর ঘুমিয়ো না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘোচাবার শক্তি তোমাদের নিজেদের ভেতরে রয়েছে- একথা বিশ্বাস করো, তাহলে শক্তি জেগে উঠবে।
৮. যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারা যায়, সেই হচ্ছে শিক্ষা।
৯. হৃদয় ও মস্তিষ্ক দ্বারাই চিরকাল যা-কিছু বড় কাজ হয়েছে, টাকার দ্বারা নয়।
১০. ভেবো না তোমরা দরিদ্র, ভেবো না তোমরা বন্ধুহীন; কে কোথায় দেখেছে- টাকায় মানুষ করেছে! মানুষই চিরকাল টাকা করে থাকে। জগতের যা কিছু উন্নতি, সব মানুষের শক্তিতে হয়েছে, উৎসাহের শক্তিতে হয়েছে, বিশ্বাসের শক্তিতে হয়েছে।
১১. বিশ্বাসই হলো মানবসমাজ ও সব ধর্মের সবচেয়ে বড় শক্তি।
১২. দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞান, কাতর- এরাই তোমার দেবতা হোক, এদের সেবাই পরম ধর্ম বলে জানবে। দরিদ্র দেবো ভব। মূর্খদেবো ভব।
১৩. যার নিজের ওপর আস্থা তথা বিশ্বাস নেই তাঁর ঈশ্বরেও বিশ্বাস নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের একটি করে এমন বাণী, ভাবনা ও কাজ নির্দিষ্ট করো যা তোমরা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চাও। এবারে নিচের ছকটি পূরণ করো।
ছক ৩.১০: জ্যোতির্ময় বিবেক
বাণী
| ভাবনা
| কাজ
|
|
|
|
|
|
|
ছক ৩.১১: সামাজিক সমস্যা
|
এবারে দলে/জোড়ায় প্রত্যেকের তালিকা থেকে বাছাই করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যাকে চিহ্নিত করো। তারপরে খুঁজে দেখো স্বামী বিবেকানন্দ এই সংকট সমাধানের কী পথ দেখিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো পথের আলোকে এই সময়ে প্রয়োগযোগ্য একটি সমাধান খুঁজে বের করো।
ইনফোগ্রাফিক পোস্টার, মাল্টিমিডিয়া ইত্যাদি যে-কোনো মাধ্যমে দলে/জোড়ায় তোমাদের কাজটি উপস্থাপন করো।
গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আদর্শের প্রচারক ও হিন্দুসমাজের একজন সংস্কারক হিসেবে সুপরিচিত। তিনি ১৮৪৭ সালের ১ মার্চ মাসে গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিচাঁদ ঠাকুর জাতপাত ও নারীপুরুষের মধ্যে সাম্যমূলক মতুয়া মতবাদের প্রবর্তক ছিলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাতার নাম শান্তিদেবী ঠাকুর।
গুরুচাঁদ ঠাকুর পাঠশালা পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন পদ্মবিলা গ্রামের দশরথ বিশ্বাসের কাছে। এরপর মল্লকান্দি গ্রামের গোলক কীর্তনীয়ার কাছে তিনি সংস্কৃত শেখেন। ফারসি ভাষা শেখেন আড়কান্দি গ্রামের মকুব মিয়ার মক্তবে। এরপর নিজ গৃহে নানা শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের কন্যা সত্যভামা দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
খুব অল্প বয়সই তিনি পিতা হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া আর্দশ প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সাথে নানা ধরনের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত হন। মতুয়া আদর্শের যেসব দিক তিনি বিশেষভাবে প্রচার করতেন, তা হলো- নারীপুরুষ নির্বিশেষে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়া, সংসার-জীবনের সাথে ধর্মাচার পালন করা, কোনো রকম জাতিভেদ না করা, ধর্মীয় পোষাক ও সাজসজ্জা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা, কঠোরভাবে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া ইত্যাদি।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সামাজিক সংস্কারের মূল লক্ষ্য অনগ্রসর হিন্দুসমাজের কল্যাণ। তাঁর প্রথম আন্দোলন নমঃশূদ্র নামক জাতির সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৮৭২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাঙালি কৃষিজীবী হিন্দুদের একটি বড় অংশকে সরকারী খাতায় চণ্ডাল হিসেবে অভিহিত করে। গুরুচাঁদ ঠাকুর শাস্ত্রীয় তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হন, এই পদবি সঠিক নয়। তাঁর নেতৃত্বে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সরকারের কাছে লিখিত আবেদনও করা হয়। শেষে সরকারি খাতায় নমঃশূদ্রদের চন্ডাল পরিচয় বাদ দিয়ে নমঃশূদ্র লেখা হয়। নমঃশূদ্র জাতিরা তাদের আত্মমর্যাদা ফিরে পায়।
পুরুচাঁদ ঠাকুরের দ্বিতীয় আন্দোলন গণশিক্ষা-বিষয়ক। মানুষকে সমভাবে শিক্ষাদানের সুযোগ দেওয়ার জন্য এই আন্দোলন। কিন্তু সেসময়ে কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ও শ্রমজীবী হিন্দুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। মনে করা হতো, এদের সন্তানেরা লেখাপড়া শিখলে সমাজে জীবিকার সংকট দেখা দেবে। গুরুচাঁদ ঠাকুর এর বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি মনে করেন, লেখাপড়া শেখা সকলের মৌলিক অধিকার। তাই গ্রামে গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের কাছে তিনি ছুটে যান। তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এবং লেখাপড়া শেখায় উদ্বুদ্ধ করেন। ১৮৮১ সালে বাগেরহাট জেলার দত্তডাঙ্গা গ্রামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ও আসাম প্রদেশের থেকে প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিনিধি সেখানে যোগ দেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর সম্মেলনে সভপতিত্ব করেন। শিক্ষাগ্রহণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তিনি সেখানে তুলে ধরেন। ফলে মানুষের মাঝে একটি চেতনা সৃষ্টি হয়। লোকজন টাকা দিয়ে, জমি দিয়ে, শ্রম দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে এগিয়ে আসেন। এভাবে গুরুচাঁদ ঠাকুরের অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগে সেসময়ে প্রায় ১৮২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরী হয়। যার অধিকাংশই ছিল পাঠশালা বা প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি নিজে এর তদারকি করে গণশিক্ষার কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের তৃতীয় আন্দোলন নারীসমাজের মুক্তির আন্দোলন। সেসময়ে অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হতো। আবার, অল্প বয়সে কেউ বিধবা হলে দ্বিতীয় বার তার বিবাহের সুযোগও ছিল না। এটাই ছিল সামাজিক রীতি। বিধবা বিবাহের প্রাসঙ্গিক আইন বা বিদ্যাসাগর মহোদয়ের সামাজিক আন্দোলন সত্ত্বেও এই রীতি থেকে সমাজ বেরিয়ে আসতে পারেনি। বাল্যবিবাহও রোধ করাও সম্ভব হয়নি। গুরুচাঁদ ঠাকুর এব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। যার ফলে অনগ্রসর হিন্দুসমাজে ব্যাপকভাবে বিধবাবিবাহ চালু হয়। বাল্যবিবাহও রোধ হতে শুরু করে।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের চতুর্থ আন্দোলন সামাজিক অনুষ্ঠানে অপচয় রোধ করা। সেসময়ে পিতা-মাতার শ্রাদ্ধ অথবা বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে অনেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। নিজের শেষ সহায়-সম্বল পর্যন্ত অনেকে বিক্রি করে অর্থ জোড়াড় করতেন। এর উদ্দেশ্য নিজের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং সমাজের কর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। এক্ষেত্রে গুরুচাঁদ ঠাকুর কঠোরভাবে নির্দেশ দেন- যার যতটুকু সামর্থ্য সেই অনুসারে ব্যয় করতে হবে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই নির্দেশানার পর শ্রাদ্ধ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অপচয় রোধ হয়।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের পঞ্চম আন্দোলন অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা। সে-সময়ে অনগ্রসর কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ও অন্যান্য শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্মানজনক সরকারি চাকরি প্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। গুরুচাঁদ ঠাকুর এটাকে মনে করতেন মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাই তিনি এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলেন। অনগ্রসরদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরি প্রাপ্তির বিষয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হয়। ডক্টর সি এস মিড নামক একজন খ্রিষ্টান মিশনারি এ ব্যাপারে তাঁকে বিশেষ সহযোগিতা করেন। ফলে অনগ্রসরদের জন্য যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরি প্রাপ্তির দরজা খুলে যায়।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠ আন্দোলন হিন্দুদের পেশাগ্রহণকে বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা। সুনির্দিষ্ট পেশা সুনির্দিষ্ট জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে- গুরুচাঁদ ঠাকুর এই মতের সমর্থক ছিলেন না। যোগ্যতা ও প্রয়োজন অনুসারে মানুষ তার পেশাকে পরিবর্তন করেতে পারে- তিনি এই মতের সমর্থক। অর্থাৎ একজন কৃষিজীবী বা শ্রমজীবী প্রয়োজনে ব্যবসায়ীও হতে পারে। অথবা ভিন্ন পেশার লোক প্রয়োজনে কৃষিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এতে সামাজিক কোন প্রতিবন্ধকতা থাকা উচিত নয়। এব্যাপারে সমাজের মানুষকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন। কোন প্রতিবন্ধকতা আসলে সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি তা সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্তও নেন। ফলে তাঁর এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুসমাজের লোকজনদের মধ্যে পেশাপরিবর্তনে চেতনা সৃষ্টি হয়। শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী মানুষেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হয়ে সফল হয়।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সপ্তম আন্দোলন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান বিষয়ক আন্দোলন। অনগ্রসর শ্রেণির মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে আনতে তিনি সমবায় ভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেন। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে ধর্মগোলা নামক একটি সংগঠন ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এর ফলে বছরের বিশেষ সময়ে অর্থসংকটে পড়া মানুষ উপকৃত হয়।
কবিগান ও ধুয়াগানকে (বাউল গানকে অনেক সময় এ নামে ডাকা হয়) গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর আদর্শ প্রচারের কাজে ব্যবহার করেন। সে সময়ের অসংখ্য লোককবিকে তিনি পৃষ্ঠপোষণ করেন। গুরুচাঁদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন কবিয়াল ছিলেন তারকচন্দ্র সরকার। এছাড়া হরিবর সরকার, মনোহর সরকার, অশ্বিনী সরকার প্রমুখরা বড় বড় কবিয়াল। তখনকার হিন্দুসমাজে গুরুচাঁদের আদর্শকে গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে তাঁরা সক্ষম হন।
গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর আদর্শ প্রচারের জন্য ওড়াকান্দি গ্রামে একটি ছাপাখানা তৈরী করেন। নানা ধরনের ধর্মীয় গ্রন্থ সেখান থেকে ছাপা হতো। ১৯০৭ সালে সেখানে নমঃশূদ্র সুহৃদ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশিত প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অনগ্রসর হিন্দুসমাজের দুঃখকষ্টের কথা এবং তা দূর হওয়ার কঠিন সংগ্রামের কথা নিয়মিতভাবে করতে শুরু করে।
ওড়াকান্দিকে একটি তীর্থস্থানে পরিণত করার ব্যাপারেও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তিনি এখানে বড়ো আয়তনের একটি হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মতুয়াদের কেন্দ্রীয় হরিমন্দির হিসেবে ভক্তদের কাজে যা বিবেচিত। বেশ কয়েকটি দিঘিও এখানে খনন করা হয়। একটি দিঘির নাম দেওয়া হয় 'কামনা-সাগর'। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভক্ত হরিচাঁদের জন্মতিথি উপলক্ষে ওড়াকান্দি ধামে আসেন। কামনা সাগরের জলে অবগাহন করে পুণ্য লাভ করেন- এই বিশ্বাস নিয়ে তার সেখানে অবগাহন করেন।
এই মহান ধর্মপ্রচারক ও সমাজসংস্কারক গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৯৩৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পরলোক গমন করেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের বিশেষ কয়েকটি বাণী:
১। খাও বা না খাও তাতে কোনো দুঃখ নাই।
ছেলেপিলে শিক্ষা দাও এই আমি চাই ।।
২। বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা করো সার।
বিদ্যা ধর্ম, বিদ্যা কর্ম, অন্য সব ছার।।
৩। নরাকারে ভূমণ্ডলে যত জন আছে।
এক জাতি বলে মান্য পাবে মোর কাছে।
৪। যথা ধর্ম তথা জয় এক বাক্য সার।
ধর্মপথে যে চলিবে ক্ষয় নাই তার।।
৫। দুষ্ট বুদ্ধি করি ঠিক ওজন না দিলে।
বাণিজ্য হইবে ধ্বংস যাবে রসাতলে।।
৬। পবিত্রতা সত্যবাক্য মানুষে বিশ্বাস।
তিন রত্ন যার আছে হরি তার বশ।।
৭। পরদোষ ছেড়ে সদা নিজ দোষ কও।
আত্মগুণ ফেলে রেখে হরিগুণ গাও ।।
৮। হরিনামে ডঙ্কা মারো শঙ্কা করো কারে।
শ্রীহরি সহায় হয়ে সাথে সাথে ফেরে।।
৯। যার দল নাই, তার বল নাই।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এমন একটি বাণী নির্ধারণ করো যা অনুসরণ করে তুমি অপরের কল্যাণ করতে পারো। কীভাবে করবে তা বুঝিয়ে লেখো।
ছক ৩.১৩: মানবকল্যাণে গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাণী
যে বাণীটি অনুসরণ করব | যেভাবে করব |
|
|
স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরীর জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বাণীগ্রামে। পিতার নাম প্রতাপ মিত্র চৌধুরী এবং মাতার নাম শচী দেবী। তাঁদের কোল আলোকিত করে ১৯ মে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেয় এক শিশু। গুরুর নির্দেশমতো বাবা এই শিশুর নাম রাখলেন অদ্বৈত।
গ্রামের স্কুলে অদ্বৈতর শিক্ষাজীবন শুরু। তিনি বাণীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অদ্বৈত ছিলেন বিনয়ী, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কোনো কমতি ছিল না। তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় বাসন্তী পূজার রামনবমী তিথিতে প্রথম মহামন্ত্র পান অমৃতলাল গোস্বামীর কাছ থেকে। অধ্যাত্ম ও শিক্ষা যেন একসাথে চলতে থাকে অদ্বৈতের শৈশব থেকে। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাণীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অদ্বৈত সংস্কৃত ও গণিত বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। গ্রামের শিশু- কিশোরদের নিয়ে তিনি নাটকও মঞ্চস্থ করেন।
সংস্কৃত ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। সংস্কৃতে পাণ্ডিত্য অর্জনের পাশাপাশি পৈতৃক কবিরাজি পেশাতে তিনি যশ-খ্যাতির সাক্ষর রাখেন। মানুষের দৈহিক উন্নতির পাশাপাশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য তিনি বাড়িতে গড়ে তোলেন আর্যচতুষ্পাঠী।
তিনি বাড়ির শ্রীশ্রী রাজরাজেশ্বরী মন্দির অঙ্গনে তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞের প্রবর্তন করেন এবং শারদীয় উৎসবে তন্ত্রধারকের আসনে থেকেও পূজায় নিয়োজিত থাকতেন।
অদ্বৈত নিয়মিত যোগচর্চা তথা গভীর ধ্যানের জন্য রাতের অন্ধকারে গহীন অরণ্যে চলে যেতেন। তিনি বলতেন, যা মনন করলে ত্রাণ পাওয়া যায়, তা-ই মন্ত্র। গভীর ধ্যানে ডুবে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ আদেশ পাওয়া যায়। সাধনার বলে অদ্বৈত হয়ে ওঠেন শিবকল্পতরু শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী। লাভ করলেন অমৃতকুম্ভ তথা পূর্ণ জ্ঞান। তিনি বিবাহবন্ধনে আর আবদ্ধ হলেন না। তাঁর একান্ত অভিলাষ ছিল গৃহত্যাগ করে পরিব্রাজক সাধুরূপে নির্জন বনে চলে যাওয়ার। কিন্তু পিতা তাঁকে সংসারে থাকতে বাধ্য করেন এবং গুরু স্বামী জগদানন্দ তাঁকে ঐসময় নিবৃত্ত করেন। কিন্তু তাঁর গুরুদেব জগদানন্দের সাথে তিনি সবসময় পরিব্রাজকের সঙ্গী হয়ে অনেক তীর্থ পরিক্রমা করেন। গুরুদেব তাঁকে বিদুৎ সন্ন্যাস প্রদান করেন। এই সন্ন্যাসের অর্থ হচ্ছে ফলত্যাগ করে মনে-প্রাণে সন্ন্যাস গ্রহণ করা। তাঁর কাছে ধর্ম সত্য, ঈশ্বর পরম সত্য। তাঁর মতে, সত্য দিয়ে পরম সত্যে পৌঁছানোর জন্যই তৈরি হয়েছে এত রকমের মত, এত ধরনের পথ। যারা সৎপথে গতিমান, তাদেরকে তিনি আর্য বলে উল্লেখ করেছেন। স্বামী অদ্বৈতানন্দ বলতেন, কর্ম যার ধর্ম, সেই তো সৎ। তার আচরণকে বলা হয় সদাচার। আমাদের দেহ মন বুদ্ধি ভোগ-মলিন। সদাচারে দেহ নিষ্পাপ হয়, মন শান্ত হয়, বুদ্ধি মার্জিত হয়। দেশ ও দশের মঙ্গল কর্মকে তিনি ধর্ম বলতেন, বলতেন এরকম কর্মই যজ্ঞ।
পিতা প্রতাপচন্দ্রের দেহাবসানের পর ছোট ভাইয়ের ওপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে, মনে-প্রাণে সন্ন্যাস গ্রহণ করে পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়েন তীর্থভ্রমণে। তিনি আসামে দেবী কামখ্যাকে দর্শন করেন। হিমালয়ের মহাতীর্থ কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, অমরনাথ, হরিদ্বার, হৃষিকেশে ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ করেন কন্যাকুমারী, রামেশ্বর সেতুবন্ধ, পণ্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম, শৃঙ্গেরী মঠ এবং গঙ্গাসাগর সঙ্গম।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, লক্ষ্ণৌ, অযোধ্যা, চিত্রকুটধাম দর্শন করেন। ভারতের সমস্ত তীর্থদর্শন শেষে বিদেহী গুরুর নির্দেশে তিনি জঙ্গল কোকদন্ডীর পরিত্যক্ত পাহাড়ি ভূমিতে ঋষিধাম প্রতিষ্ঠার কাজে মনোযোগ দেন, যা আজ অসংখ্য ভক্তের একটি সুন্দর আশ্রম। ১৯৫৪ সালে এদেশের ভক্তদের কথা ভেবে সনাতনী ঋষিদের আদর্শ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রবর্তন করলেন আকাশবৃত্তির মাধ্যমে ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলা। আকাশবৃত্তি মানে হলো ভগবানের অপার অনুগ্রহে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই মেলা প্রবর্তনের পর থেকে প্রতি তিন বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী ভারতের চারটি স্থানে কুম্ভমেলা হয়। এগুলো হলো-হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক ও উজ্জয়িনী। তিন বছর পর চক্রাকারে চারটি স্থানে কুম্ভমেলা বসে। সে হিসাবে এক একটি স্থানে ১২ বছর পরপর এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। একমাত্র বাংলাদেশের ঋষিধামেই তিন বছর পরপর এই মেলার আয়োজন হয়। এতে দেশ- বিদেশের অনেক সাধু ভক্তরা অংশগ্রহণ করেন। স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরীর ঋষিকুম্ভের মাঙ্গলিক আয়োজন এবং তাঁর সামগ্রিক কর্মকান্ডে মুগ্ধ হয়ে চট্টগ্রামের নন্দনকাননস্থ তুলসী ধাম আখড়ার মোহন্ত শ্রী জয়রাম দাস তাঁর সাথে দেখা করেন। পরে ১৯৬১ সালে ওই তুলসী ধামের মোহন্তের পূর্ণ দায়িত্ব স্বামী অদ্বৈতানন্দকে অর্পণ করেন।
চট্টগ্রামসহ দেশ ও দেশের বাইরে তাঁর অনেক শিষ্য রয়েছে। তাঁর শিষ্যবর্গের মধ্যে নতুন চন্দ্র সিংহ (কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ১৯৭১ সালে নিজ ইষ্ট দেবী কুন্ডেশ্বরীর সামনে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের হাতে শহীদ হন), যোগেশ চন্দ্র সিংহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর শিষ্যবর্গের অনেকেই দেশ-বিদেশে স্বামী অদ্বৈতানন্দের ভাবাদর্শ প্রচারে মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করে মানবসেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ভারতের বারাসাত, উত্তর চব্বিশ পরগণা (গুমা), কাকদীপ, উজ্জয়িনী, হরিদ্বার, আমেরিকার ক্যার্লিফোনিয়াসহ আরো অনেক জায়গায় স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরীর অদ্বৈত আশ্রম, মঠ, মিশন ও কেন্দ্র রয়েছে। তাঁর এই আশ্রম, মঠ, মিশন ও কেন্দ্রগুলোতে সেবামূলক কাজের মধ্যে অনাথ আশ্রম, সংস্কৃত কলেজ, অনাথ স্কুল, গীতা শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, যোগ শিক্ষা, ধর্মীয় আলোচনা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ বিবিধ কর্মমুখী শিক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, বনায়ন ও কৃষি কর্মসূচি, দুঃস্থদের মাঝে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান, বিবাহ ও অন্তিম সৎকারসহ বিবিধ আর্তমানবতামূলক কাজ, প্রকাশনা, পাঠাগার ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণমূলক কার্যক্রম, মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে।
স্বামী অদ্বৈতানন্দ ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬ সালে ইহলীলা ত্যাগ করেন।
তাঁর প্রণীত দশমহাবিদ্যা, গীতায় গুরুশিষ্য, পার্থিব শিবলিঙ্গ রহস্য, শালগ্রাম তত্ত্ব, ধর্ম প্রবেশিকা, উপাসনা পদ্ধতি গ্রন্থসমূহ সাধন জগতের অমূল্য সম্পদ।
স্বামী অদ্বৈতানন্দর কিছু বাণী
১। কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিনটি নরকের দ্বার। কটুবাক্য প্রয়োগকারীকেও অন্যের কাছে ছোট হতে হয়। কর্কশভাষী মানুষ চিরদিনই অনাদরের পাত্র।
২। যাঁর কাজ উৎকৃষ্ট তিনিই গুরুস্থানীয়, তিনিই ব্রাহ্মণ। তাঁকে সম্মান করতে হবে, সবার আগে আসন দিতে হবে।
৩। আত্মজ্ঞান লাভে আমাদের সাধনা, আর্য ঋষিদের পদাঙ্ক অনুসারী আমরা। নিজে মুক্ত হয়ে অন্যকে মুক্ত করাই আমাদের কাজ। বহুত্বের মাঝে একত্ব ভাবনাই আমাদের মোক্ষম ভাবনা। আমরা সকলের, সকলকে সাথে নিয়েই চলব। কোনো দল-উপদল সৃষ্টি করতে আমরা আসিনি। বহুজনের সুখ বিধান ও বহুজনের হিত কামনা আমাদের ব্রত।
৪। আমরা দোষদর্শী। পরের গুণ না দেখে কেবল দোষ খুঁজে বেড়াই। দোষচর্চায় হৃদয় কলুষিত হয়।
৫। যাকে দান করা হবে তার মধ্যে আছেন নারায়ণ। দান করবে শ্রদ্ধার সঙ্গে, সামর্থ্য অনুসারে। দান করবে সন্তর্পণে। যাবতীয় ধন ঈশ্বরের। অতএব দান করবে বিনম্রভাবে। দান করে যেন অহংকার না আসে।
৬। কর্মযোগীর নিষ্ঠা কর্মে, জ্ঞানযোগীর নিষ্ঠা জ্ঞানে। দুটো পথ অভিন্ন। অনাসক্তির পথ। এই পথই রাজপথ।
হক ৩.১৪: অনুসরণীয় পথ
|
ফ্রান্সের প্যারিস শহর। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের মোসেস মরিস আলফাসা এবং মিশরীয় মাথিল্ডে ইসমালুনের এক কন্যা সন্তান জন্মে। শিশুটির নাম রাখা হয় রাঞ্চে রাচেল মীরা আলফাসা। বড় হয়ে ভারতের পুদুচেরি, পূর্বের পন্ডিচেরিতে অরবিন্দ আশ্রমে আসার পর তাঁর নাম হয় শ্রীমা।
শৈশবকাল থেকেই শ্রীমার মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব জেগে উঠে। তাঁর বয়স যখন মাত্র চার বছর, তখনই তিনি মাঝে মাঝে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো শৈশবেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। শুধু পড়াশোনা নয়, পার্থিব কোনো কিছুর প্রতিই শ্রীমার কোনো আসক্তি ছিল না। সারাক্ষণ তিনি ঈশ্বরের চিন্তায় বিভোর থাকতেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন।
প্যারিস শহরের বাইরে ছিল এক প্রকাণ্ড বন। শ্রীমা সময় পেলেই সেখানে গিয়ে গাছতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর উপর দিয়ে নির্ভয়ে পাখি উড়ে যেত, তাঁর শরীরে বসত, খরগোশ লাফাত, কাঠবিড়ালীরা ছোটাছুটি করত। এমনিভাবে প্রকৃতি, গাছপালা ও পশু-পাখির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্বামী বিবেকানন্দের রাজযোগ সম্পর্কিত বই পড়ে তাঁর মনে ভারতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং ধর্ম জানার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। এরপর তিনি ফরাসি ভাষায় ভাগবত গীতা ও অন্যান্য হিন্দুধর্মীয় বই পড়েন। এতে তাঁর মনে পরিবর্তন আসে। তিনি আলজেরিয়ার ক্লেমসেন শহরে যান। সেখানে তেঁও নামে এক বিখ্যাত পণ্ডিতের কাছে হঠযোগ ও গুপ্তবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন।
দেশে ফিরে শ্রীমা আরো গভীরভাবে ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন হন। তিনি উপলব্ধি করেন ঈশ্বর জ্যোতির্ময় এবং তাঁর সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক আছে। একবার তিনি স্বপ্নে এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে দেখতে পান। তিনি শ্রীমাকে বলেন, 'ওঠো, আরও উপরে ওঠো। সকলকে ছাড়িয়ে উপরে ওঠো, কিন্তু সকলের মাঝে ব্যাপ্ত করে দাও নিজের আত্মাকে।'
শ্রীমা এবার ভারতীয় দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব পড়তে শুরু করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, নিরাকার নির্গুণ ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই রূপ পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব স্থান ভারতবর্ষে আসার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বামী পল রিশারকে নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন।
ভারতবর্ষে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা ২৯ মার্চ পুদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে উপস্থিত হন। সেখানে ঋষি অরবিন্দকে দেখে শ্রীমার স্বপ্নে দেখা সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের কথা মনে পড়ে। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন বিধিনির্দিষ্ট এক বিশেষ দিব্যকর্ম করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছেন। মহাযোগী শ্রীঅরবিন্দের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তিনি উপলব্ধি করেন, অরবিন্দের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্যেই আছে তাঁর আত্মার মুক্তি। সারা পৃথিবীর মধ্যে পুদুচেরির আশ্রমকেই তাঁর কাছে স্বর্গ মনে হলো। এই শান্ত তপোবনের মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর সকল সাধানার সিন্ধি, তাঁর আত্মার চূড়ান্ত সার্থকতা। তাই তাঁরা দুজনেই আশ্রমে থেকে যান। শ্রীঅরবিন্দের নিকট দীক্ষা নেন। তাঁর সাধনকর্মের সহযোগী হয়ে ওঠেন। তখন আশ্রম থেকে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় 'আর্য' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তাঁরা দুজনেই এই পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে অরবিন্দকে সাহায্য করতে লাগলেন।
কিন্তু এ যাত্রায় শ্রীমা বেশি দিন ভারতে থাকতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তাঁদের প্যারিসে ফিরে যেতে হলো। এতে শ্রীমা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে পরমাত্মা ও জীবাত্মার বিচ্ছেদের মতো মনে হতে লাগল।
এভাবে কেটে গেল প্রায় পাঁচ বছর। ইতোমধ্যে যুদ্ধ থেমে গেছে। অরবিন্দের কাছ থেকে তিনি ভারতবর্ষে আসার - আহ্বান পান। তাঁর মন উদ্বেল হয়ে ওঠে। আর বিলম্ব না করে তিনি ভারতবর্ষের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল তিনি পুদুচেরিতে ফিরে আসেন। তাঁর মন শান্ত হয়। গুরুদেবের নির্দেশমতো তিনি নিয়মিত যোগ সাধনা শুরু করেন। ইউরোপীয় বেশভূষা ত্যাগ করে ভারতীয় যোগিনীর বেশ ধারণ করেন। তাঁর পরনে তখন দেশি শাড়ি। খাদ্যদ্রব্যও দেশীয়। আমিষের পরিবর্তে নিরামিষ। পরে অবশ্য শ্রীঅরবিন্দের নির্দেশে মা ইউরোপীয় পোশাকও পরতেন। কারণ অরবিন্দ বলতেন, ইন্দ্রিয় ও মনকে জয় করতে পারলে বাইরের পোশাক- পরিচ্ছদে কিছু যায় আসে না।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ নভেম্বর শ্রীঅরবিন্দ পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করেন। সেদিন থেকেই একটি ঘরে তিনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন। ফলে আশ্রমের সমস্ত দায়িত্বভার পড়ে শ্রীমার ওপর। শ্রীমাও সর্বান্তঃকরণে সে ভার গ্রহণ করেন। তিনি পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পদ ও অর্থ পেয়েছিলেন। তা দিয়ে তিনি আশ্রমের খরচ চালাতেন। দিন দিন আশ্রমে লোকজন বাড়তে থাকে। শ্রীমাও অতিশয় যোগ্যতার সঙ্গে সকলের ভরণ-পোষণ করেন। কর্মফলের প্রতি সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে তিনি পরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে লাগলেন। খাদ্য, কৃষি, শিল্প, গো-পালন প্রভৃতি বিভাগ খুলে শ্রীমা আশ্রমটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে তোলেন।
শ্রীমা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আধ্যাত্মিক সাধনা করতে হলে শরীরকে সুস্থ রাখতে হয়। এজন্য যোগব্যায়াম প্রয়োজন। তাই তিনি আশ্রমে একটি ব্যায়ামাগার গড়ে তোলেন। আশ্রমবাসীদের চিকিৎসার জন্য তিনি একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। এ হাসপাতালে সকলকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু হয়।
শ্রীঅরবিন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমা আশ্রমে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম দেয়া হয় 'ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব এডুকেশন'। এখানে আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্বের সব দেশের শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করতে পারে। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঋষি অরবিন্দ বিদ্যালয়ের শাখা আছে। এর মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে।
আশ্রমের একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হলো, এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। আশ্রমে যাঁরা থাকেন তাঁদের সকলকেই কাজ করতে হয়। ছোট-বড় কাজে কোনো পার্থক্য নেই। ধর্মীয় গোঁড়ামি বলতে কিছু নেই। আশ্রমের সকলকে শ্রীমা সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। মায়ের মতোই তিনি সকলের সুখ-দুঃখের খবর রাখতেন। শুধু তাই নয়, আশ্রমের গাছপালা ও পশু-পাখির প্রতিও মায়ের ছিল গভীর ভালোবাসা। আশ্রমে নতুন অতিথি এলে তিনি সকলকে বুঝিয়ে দিতেন, কেউ যেন এদের প্রতি অসম্মান না করে। কেউ যেন গাছের পাতা বা ফুল না ছেঁড়েন বা অকারণে গাছের ডাল না ভাঙেন।
মা সবসময় কাজ নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। দিনরাত শুধু কাজ আর কাজ। কাজই যেন ছিল তাঁর জীবন। আজীবন তিনি সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন।
মা শুধু একজন জ্ঞানতপস্বিনী বা যোগিনীই ছিলেন না। তাঁর মধ্যে প্রচন্ড সৌন্দর্যবোধও ছিল। এক নিবিড় সৌন্দর্যবোধের দ্বারা তিনি বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে চমৎকার সামঞ্জস্য সাধন করে চলতেন। তিনি চাইতেন মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি বাইরের প্রকৃতির মতো সুন্দর হয়ে উঠুক। এভাবে তিনি আশ্রমটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমিরূপে গড়ে তুলেছিলেন।
শ্রীমার এক অভাবনীয় পরিকল্পনা ছিল শ্রীঅরবিন্দের নামে অরোভিল নগর প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৬৫ সালে শ্রীমা বিবৃতি দেন যে, "অরোভিল একটি সর্বজনীন শহর হতে হবে যেখানে বর্ণ, রাজনীতি ও জাতীয়তা নির্বিশেষে সকল দেশের নারী ও পুরুষ শান্তি ও প্রগতির সঙ্গে বাস করতে সক্ষম হবে।" পরের বছর ভারত সরকার কর্তৃক অরোভিলের ধারণাটি ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় উত্থাপন করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদিত হয়। এর দু'বছর পর প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ শহরটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন জড়ো হন। পৃথিবীর ১২৪টি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ দেশের কিছু মাটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সবার জন্মভূমির মাটি একটি শ্বেত মার্বেলে তৈরি পদ্ম আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। এটি বর্তমানে অরোভিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে সংরক্ষিত আছে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের জন্মদিনে অরোভিল নগরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে ৪৯টি দেশের প্রায় আড়াই হাজার মানুষ অরোভিলে বাস করে। শ্রীমার আদর্শকে শিরোধার্য করে সেখানকার অধিবাসীরা সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন।
শ্রীমা টেনিস খেলা থেকে শ্যুটিং নানান দক্ষতা আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন, গানও জানতেন। এছাড়া ভালো অর্গান বাজাতে পারতেন। প্রতি বছরের শেষ দিন রাত ১২ টার পর তিনি অর্গান বাজিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেন। বিভিন্ন রচনায় তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা ও কবিত্বশক্তিরও পরিচয় পাওয়া যায়।
মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রম এক আদর্শ স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অরবিন্দ আশ্রম গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও অরবিন্দ আশ্রম রয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শ্রীমা ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকতে বলেছিলেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।
ছক ৩.১৫: শ্রীমার শিক্ষা
শ্রীমা মহীয়সী ছিলেন কারণ:
|
১.
|
২.
|
৩.
|
8.
|
৫.
|
মন্দির/আশ্রমের ও ঠিকানা | |
সমাজ/মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রম | |
| |
| |
| |
| |
| |
|
মন্দির/আশ্রমের ও ঠিকানা | |
সুপারিশসমূহ | |
| |
| |
| |
| |
| |
| |
| |
|
আরও দেখুন...