পঞ্চশীল
এই অধ্যায়ে যা আছে-
শীল
চিত্র-১০: বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে ছেলে-মেয়েসহ পিতা-মাতা শীল গ্রহণ করছেন
সজীব ও সুবল দু'জনই বন্ধু এবং একই বিদ্যালয়ে পড়ে। একই এলাকায় তারা বসবাস করে। প্রতিদিন বিকালে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলাধুলা করে। একদিন খেলা শেষে সজীব সুবলকে বলল, আগামী শুক্রবার আমি মা-বাবা ও ভাই-বোনের সাথে বিহারে যাব। ভিক্ষুর নিকট শীল সম্পর্কে দেশনা শুনব। তুমিও এসো। সুবল বলল, 'আচ্ছা! আমি সকালে আসব।' সুবল কথামত সকালে সজীবের বাড়িতে আসে। সজীবের পিতা-মাতাকে প্রণাম নিবেদন করে। তারা একসাথে বিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বিহারে উপস্থিত হয়ে তারা আহার ও পুষ্প পূজা করে। ত্রিরত্ন বন্দনা করে। ভিক্ষুকে বন্দনা করে পঞ্চশীল গ্রহণ করে। এরপর পূজনীয় ভিক্ষু তাদের শীল সম্পর্কে দেশনা শুরু করেন এবং বলেন, 'শীল' শব্দের অর্থ হচ্ছে চরিত্র, স্বভাব, নিয়ম-নীতি, শৃংখলা ও সংযম ইত্যাদি। কায়িক, বাচনিক ও মানসিক সংযমকেও শীল বলা হয়। শীল সমস্ত কুশল কর্মের আদি বা প্রথম। শীল মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। শীলকে মানব জীবনের রক্ষাকবচও বলা হয়। গৌতম বুদ্ধ সুন্দর ও সুশৃংখল জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে শীল পালনের নিয়ম প্রবর্তন করেছেন। যাঁরা শীল পালন করেন তাঁদেরকে শীলবান বলা হয়। ফুলের সৌরভ কেবল বাতাসের অনুকূলে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু শীলবান ব্যক্তির যশ-খ্যাতি বাতাসের অনুকূল-প্রতিকূল সবদিকে প্রবাহিত হতে পারে। শীল পালনে জীবন সুন্দর হয়। ত্রিপিটকে নানা প্রকার শীলের উল্লেখ আছে। যেমন: পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশশীল এবং পাতিমোক্ষ শীল। গৃহী বৌদ্ধরা প্রতিদিন পঞ্চশীল পালন করেন। উপাসক-উপাসিকাগণ অমাবস্যা, অষ্টমী ও পূর্ণিমা তিথিতে অষ্টশীল পালন করেন। অষ্টশীলকে উপোসথ শীলও বলা হয়। শ্রমণ ও শ্রমণীগণ প্রতিদিন দশশীল পালন করেন। এজন্য দশশীলকে 'প্রব্রজ্যা শীল' বলা হয়। ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীগণ পাতিমোক্ষ শীল পালন করেন। শীল পালনের সুফল অনেক। বুদ্ধ বলেছেন, "শীলে সুগতি ও ভোগ সম্পদ লাভ হয়। শীল স্বর্গ লাভের সোপান বা সিঁড়ি। শীল নির্বাণ লাভে সহায়ক। তাই প্রত্যেকের বিশুদ্ধভাবে শীল পালন করা উচিত।"
ভিক্ষুর দেশনা শুনে সজীব ও সুবল খুবই প্রীত হলো এবং তারা শীল পালনে উদ্বুদ্ধ হয়। এরপর তারা ভিক্ষুকে বন্দনা নিবেদন করে বাড়িতে ফিরে যায়।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-১৯: একক কাজ
শূন্যস্থান পূরণ: সঠিক শব্দ দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করি
ক) শীল সমস্ত - . . . . . . . . . . . . . . . . . কর্মের আদি।
খ) শীল মানব জীবনের অমূল্য . . . . . . . . . . . . . . . . .
গ) . . . . . . . . . . . . . . . . .প্রতিদিন পঞ্চশীল পালন করেন।
ঘ) অষ্টশীলকে . . . . . . . . . . . . . . . . .শীলও বলা হয়।
ঙ) শ্রমণ ও শ্রমণীগণ প্রতিদিন . . . . . . . . . . . . . . . . .পালন করেন।
চ) ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীগণ . . . . . . . . . . . . . . . . . শীল পালন করেন।
পঞ্চশীল
'পঞ্চশীল' শব্দটি 'পঞ্চ' ও 'শীল' শব্দ দু'টি যোগে গঠিত। 'পঞ্চ' অর্থ পাঁচ আর শীল শব্দের অর্থ হলো নিয়ম বা নীতি। বুদ্ধ নির্দেশিত পাঁচটি নিয়ম বা নীতিকে পঞ্চশীল বলে। মহাকারুণিক বুদ্ধ গৃহীদের জন্য পঞ্চশীল প্রবর্তন করেন। গৃহীরা প্রতিদিন পঞ্চশীল পালন করেন। তাই পঞ্চশীলকে নিত্যপালনীয় শীলও বলা হয়। পঞ্চশীল পালন করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় বা স্থানের প্রয়োজন হয় না। কায়ো, মনো, বাক্যে সবসময় সর্বত্র পঞ্চশীল পালন করা যায়।
পঞ্চশীল গ্রহণের নিয়ম
কুশল চিত্তে পঞ্চশীল পালন করা উচিত। পঞ্চশীল গ্রহণের পূর্বে হাত, মুখ, পা ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হয়। এরপর হাতজোড় করে হাঁটু ভেঙ্গে নতজানু হয়ে বসে পূজনীয় ভিক্ষুর কাছে পঞ্চশীল প্রার্থনা করতে হয়। ভিক্ষু পঞ্চশীল প্রদান করেন এবং গৃহীরা তা সমস্বরে মুখে মুখে উচ্চারণ করেন। তবে নিজে নিজেও পঞ্চশীল গ্রহণ করা যায়।
পালিতে পঞ্চশীল প্রার্থনা
ওকাস, অহং ভন্তে তিসরণেনসহ পঞ্চসীলং ধম্মং যাচামি, অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে। দুতিযম্পি, ওকাস, অহং ভন্তে তিসরণেনসহ পঞ্চসীলং ধম্মং যাচামি, অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে। ততিযম্পি, ওকাস, অহং ভন্তে তিসরণেনসহ পঞ্চসীলং ধম্মং যাচামি, অনুগহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে।
ভিক্ষু: যমহং বদামি তং বদেথ।
শীলগ্রহণকারী: আম ভন্তে।
[পাঠ করার সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
ক) একজন প্রার্থনা করলে অহং ভন্তে আর বহুজনে প্রার্থনা করলে ময়ং ভন্তে বলতে হবে। অনুরূপভাবে একজনের ক্ষেত্রে 'যাচামি' আর বহুজনের ক্ষেত্রে 'যাচাম' উচ্চারণ করতে হবে।
খ) পালি উচ্চারণের সময় অ-কারন্ত হলে আ-কারন্ত করে উচ্চারণ করতে হয়।
গ) পালিতে 'য' এর উচ্চারণ বাংলা 'য়' এর মতো হয়।]
পঞ্চশীল প্রার্থনার বাংলা অনুবাদ
ভন্তে! অবকাশ প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বার, ভন্তে! অবকাশ প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন।
তৃতীয়বার, ভন্তে! অবকাশ প্রদান করুণ। আমি ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে শীল প্রদান করুন।
ভিক্ষু: আমি যা বলছি তা বলুন।
শীলগ্রহণকারী: হ্যাঁ ভন্তে, বলছি।
এরপর শীলগ্রহণকারী ভিক্ষুর মুখে মুখে ত্রিশরণ আবৃত্তি করবেন।
ত্রিশরণ: পালি
বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।
ধম্মং সরণং গচ্ছামি।
সংঘং সরণং গচ্ছামি।
দুতিযম্পি, বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।
দুতিযম্পি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি।
দুতিযম্পি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি।
ততিযম্পি, বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।
ততিযম্পি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি।
ততিযম্পি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি।
ভিক্ষু: সরণা গমনং সম্পন্নং।
শীল প্রার্থনাকারী: আম ভন্তে।
ত্রিশরণ: বাংলা
আমি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি।
আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি।
আমি সংঘের শরণ গ্রহণ করছি।
দ্বিতীয়বার-আমি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি।
দ্বিতীয়বার-আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি।
দ্বিতীয়বার-আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি।
তৃতীয়বার-আমি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি।
তৃতীয়বার-আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি।
তৃতীয়বার-আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি।
শরণে গমন বা শরণ গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
শীল প্রার্থনাকারী: হ্যাঁ ভন্তে
এরপর ভিক্ষু পঞ্চশীল প্রদান করবেন এবং শীল গ্রহণকারী তা মুখে মুখে বলবেন।
পঞ্চশীল: পালি
পাণাতিপাতা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি।
অদিন্নাদানা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি।
কামেসু মিচ্ছা চারা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি।
মুসাবাদা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি।
সুরা-মেরেয-মজ্জ পমাদানা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি।
পঞ্চশীল: বাংলা
আমি প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
আমি অদত্তবস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
আমি ব্যভিচার থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
আমি মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
আমি সুরা এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-২০: দলগত কাজ
ভূমিকাভিনয়: একজন ভিক্ষু, অন্যরা দায়ক-দায়িকা হয়ে পঞ্চশীল গ্রহণ প্রক্রিয়া ভূমিকাভিনয় করে দেখাই।
পঞ্চশীলের গুরুত্ব
পঞ্চশীল হত্যা, অদত্তবস্তু গ্রহণ, ব্যভিচার, মিথ্যাকথা বলা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ প্রভৃতি হতে মানুষকে বিরত রাখে। এই পাঁচটি অকুশল বা মন্দ কর্ম মানুষের জীবনকে কলুষিত করে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। তাই এই পাঁচটি অকুশল কর্ম থেকে বিরত থাকা একান্ত উচিত। পঞ্চশীলের প্রথম শীল শুধু প্রাণীহত্যা থেকে বিরত রাখে না, সকল প্রাণীকে ভালোবাসতেও উদ্বুদ্ধ করে। সকল প্রাণী দণ্ডকে ভয় পায়। আঘাত করলে কষ্ট পায়। আমি যেমন আমার জীবনকে ভালবাসি, তেমনি সকল প্রাণী নিজ জীবনকে ভালোবাসে। জীবন সকলের নিকট প্রিয়। তাই আমাদের যেকোনো প্রাণীকে হত্যা বা আঘাত করা থেকে বিরত থাকা উচিত। দ্বিতীয় শীল অদত্তবস্তু গ্রহণ হতে বিরত থাকার পাশাপাশি অপরকে দান দিতেও উদ্বুদ্ধ করে। আমার জিনিস হারিয়ে গেলে বা কেউ নিয়ে গেলে আমি যেমন কষ্ট পাই, তেমনি অন্যরাও কষ্ট পায়। তাই অদত্তবস্তু গ্রহণ বা চুরি করা উচিত নয়। তৃতীয় শীল কেবল ব্যভিচার থেকে বিরত রাখে না, অপরের প্রতি নৈতিক আচরণ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষাও দান করে। যে ব্যক্তি অনৈতিক কাজ করে তাকে সকলে ঘৃণা করে। অনৈতিক কাজের জন্য সে শাস্তি ভোগ করে। তাই অনৈতিক কাজ করা উচিত নয়। চতুর্থ শীল মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সর্বদা সত্য কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করে। মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না, সর্বত্র নিন্দিত হয়। তাই মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। পঞ্চম শীল মাদকদ্রব্য গ্রহণ হতে বিরত থাকার পাশাপাশি সৎ জীবনযাপনেও অনুপ্রাণিত করে। মাদকদ্রব্য মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও হিতাহিত জ্ঞান নষ্ট করে। শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে। এ কারণে শরীর সুস্থ রাখা এবং সৎ জীবনযাপনের জন্য মাদক গ্রহণ হতে বিরত থাকা উচিত।
বলা যায়, পঞ্চশীল মানুষের জীবনকে সুন্দর করে। মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে। পারিবারিক ও সমাজ জীবনে শান্তি ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করে। অতএব, মানব জীবনে পঞ্চশীলের গুরুত্ব অপরিসীম।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-২১: একক কাজ
ধারণা চিত্র: সঠিক শব্দ দিয়ে খালিঘর পূরণ করি
অংশগ্রহণমূলক কাজ-২২: জোড়ায় কাজ
বাক্য লিখন: পঞ্চশীল পালনের ফলে নিজ জীবনে যেসব পরিবর্তন এসেছে সে সম্পর্কে ৫০টি বাক্য লিখি
১. |
২. |
৩. |
৪. |
৫. |
আরও দেখুন...