পরিচ্ছেদ ২.২ :
স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমল ও পরবর্তী ঘটনাবলি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ২২শে ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং সরকার প্রধানের দায়িত্বতার গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক পুনর্গঠন, ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারতের মিত্রবাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠানো, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ইত্যাদি তাঁর শাসন আমলের উল্লেখযোগ্য অর্জন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির চক্রান্তে কতিপয় বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে বিদেশে অবস্থানরত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতীত পরিবারের সকল সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
বিধ্বস্ত দেশ গঠন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন চারদিকে ছিল স্বজন হারানোর বেদনা, কান্না, হাহাকার আর ধ্বংসযজ্ঞ। অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, কলকারখানা, নৌবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ছিল বিধ্বস্ত। রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল অর্ধশূন্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ছিল না কোনো সামরিক-বেসামরিক বিমান। ত্রিশ লাখ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, গ্রাম-গঞ্জের লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ, সর্বোপরি সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের চাহিদা পূরণ ও আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।সুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়েই শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমল ।যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন ছাড়াও ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলের উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ নিম্নরূপ :
নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করা : ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। ১০ই এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি ১২ই অক্টোবর খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদে পেশ করে। ৪ঠা নভেম্বর উক্ত সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত ও ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তা বলবত হয়। এই সংবিধানের মূলনীতি হলো- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সংবিধানে সার্বজনীন ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার, ন্যায় বিচারসহ জনগণের সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার স্বীকৃত হয়। গণপরিষদ : ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধু 'বাংলাদেশ গণপরিষদ' নামে একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশবলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্য বলে পরিগণিত হন। ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-কানুন পাস ও কার্যকর করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
পরিত্যক্ত কারখানা জাতীয়করণ : স্বাধীনতার পর আদমজীসহ বিভিন্ন কলকারখানার পাকিস্তানি অবাঙালি শিল্পপতিরা বাংলাদেশ ত্যাগ করলে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে সেগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এনে বাংলাদেশের সম্পদে পরিণত করেন। কারখানা জাতীয়করণের ফলে শ্রমিকরা রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক অবস্থানে চলে আসেন । প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ: পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকগণ সরকারের কাছ থেকে যৎসামান্য বেতন-ভাতা পেতেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি : বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ- -খুদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিটি ১৯৭৪ সালে একটি গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির রূপরেখা উপস্থাপন করে। এভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
রিলিফ প্রদান ও রেশনিং প্রথা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং মানুষজনকে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত কম্বল, খাদ্যদ্রব্য ও অর্থ সাহায্য কণ্টন করেন। এছাড়া শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ব্রুয় করার জন্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সহায়-সম্বলহীন মানুষকে সাহায্যের জন্যে এটা ছিল এক অসাধারণ মানবিক পদক্ষেপ।
১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক।
নতুন অর্থনৈতিক পাঁচসালা পরিকল্পনা : বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্যে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে এবং প্রণীত হয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বকেয়া সুদসহ কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করে দেওয়া হয়।
শোষণহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে 'দ্বিতীয় বিপ্লবের' কর্মসূচি : মুক্তিযুদ্ধের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ যখন ব্যস্ত, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও তেলের মূল্যবৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে বন্যায় দেশে খাদ্যোৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। এসবের ফলে দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে মজুদদার, দুর্নীতিবাজ এবং ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী তৎপর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সরকার জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি।নির্বাচনে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্য হবেন। সংবিধান প্রণয়ন করাই হবে গণপরিষদের মূল লক্ষ্য। ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি' গঠন করা হয়। একজন নারী সদস্য এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ নেতা) সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও আগ্রহী ব্যক্তিগণের কাছ থেকে সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব আহ্বান করে।
১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে খসড়া সংবিধান বিল আকারে পেশ করা হয়। ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে তা কার্যকর হয়। গণপরিষদে সংবিধানের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই সংবিধান শহিদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।" এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় নয় বছর (১৯৪৭-১৯৫৬) আর ভারতের লেগেছিল প্রায় তিন বছর (১৯৪৭-১৯৪৯)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকার মাত্র দশ মাসে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হয়। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় জাতির জনকের এটা এক অসাধারণ অবদান।
১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত। এ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যাবলি নিম্নরূপ :
১৯৭২ সালের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। সংবিধানটি দুষ্পরিবর্তনীয়। এ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি – জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ লিপিবদ্ধ রয়েছে। এগুলোকে রাষ্ট্রের মূল তত্ত্ব - হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মেটানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পিত হয়। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সরক্ষণ এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জীবন ধারণের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, বাক-স্বাধীনতার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মচর্চার অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের অধিকার ইত্যাদি সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধানে বাংলাদেশকে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় সংসদ সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। এ সবিধানে বাংলাদেশকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' নামে পরিচিত। 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ- সংবিধানের এ ঘোষণা দ্বারা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [সূত্র: সংবিধানের প্রাধান্য ৭ (১)] সংবিধানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা প্রদান করা হয়। সংবিধান পরিপন্থী কোনো আইনকে অসাংবিধানিক বলে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে সংবিধানের মর্যাদা ও প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখতে পারবে। এ সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৭৭ নং অনুচ্ছেদে 'ন্যায়পাল' পদ সৃষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়স্ক যে কোনো নাগরিক 'এক ব্যক্তি এক ভোট'-এ নীতির ভিত্তিতে সর্বজনীন ভোটাধিকার মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এ সংবিধানে রাষ্ট্রীয়, সমবায় এবং ব্যক্তিগত মালিকানা নীতি স্বীকৃত। বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষ বিশিষ্ট হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার এ পর্যন্ত সতেরবার সংশোধন করেছে। তন্মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, জেনারেল এরশাদের সপ্তম সংশোধনী এবং খালেদা জিয়ার ত্রয়োদশ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালির জাতীয় জীবনে ঘটে এক নির্মম, নিষ্ঠুর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী ও উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মদদে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতারএবং শোষণহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন দল নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে। গণমানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নতুন একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এটিকে জাতির পিতা "দ্বিতীয় বিপ্লব' বলে অভিহিত করেন।
পররাষ্ট্রনীতি : পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পদার্পণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলাদেশ শান্তিতে বিশ্বাস করে, কারও প্রতি বৈরী আচরণ সমর্থন করবে না।' তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়'-এ নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হবে। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং পুনর্গঠনে সহযোগিতা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করেন। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে ১৪০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করাসহ নানাভাবে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। অন্যান্য বন্ধুভাবাপন্ন দেশ ও খাদ্যদ্রব্য ও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে।
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ফেরত যাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অবিস্মরণীয়। ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলকে অপপ্রচারের সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে ফিরে যায়। বিশ্ব ইতিহাসে বিদেশি সৈন্যদের এত দ্রুত স্বদেশে ফিরে যাবার নজির বিরল। এতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় প্রথম ভাষণ প্রদান করেন। এছাড়া বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এবং ওআইসি এর সদস্যপদ লাভ করে। বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি' শাস্তি পদকে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানের মর্যাদা লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের হাল ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশি- বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। এর মধ্যেও স্বপ্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পটভূমি
সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। সংবিধানের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য প্রতিফলিত হয়। ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এতে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। অস্থায়ী সংবিধান আদেশের বিভিন্ন দিক হলো এই আদেশ বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ। এটি অবিলম্বে বলবৎ হবে। এটি সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার থাকবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন সরকারপ্রধান। রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রপ্রধান।
একটি সংবিধান প্রণয়ন করে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ 'বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ' নামে একটি আদেশ জারি করেন। এ আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালেরমহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের, বাড়ি নম্বর-৬৭৭ নিজ বাসভবনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত কোনো সদস্যই ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। এমনকি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ১০ বছরের নিষ্পাপ শিশু রাসেলও। একটি আধুনিক ও শোষণ-দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে 'দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন, ঠিক তখন দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি মহলের সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের মতো "দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নেও সফল হবেন। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই ১৫ই আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটি নৃশংস ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। এটি ঘটেছিল গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এ হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। ১৫ই আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে কতিপয় কলঙ্কময় অধ্যায় (১৫ই আগস্ট-৩রা নভেম্বর ১৯৭৫) ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে সামরিক শাসন জারি করে এবং ২২শে আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে। ২৪শে আগস্ট জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। ৩১শে আগস্ট এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৫ই আগস্টের হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স' নামে সংবিধান ও আইনের শাসনবিরোধী একটি অধ্যাদেশ জারি করে। ১৫ই আগস্টের হত্যার সঙ্গে জড়িত জুনিয়র সেনা অফিসাররা ব্যারাকে ফিরে না গিয়ে বঙ্গভবনে বসে দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা (চেইন অব কমাণ্ড) ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন। ৩রা নভেম্বর তাঁর নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ৫ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
জেলখানায় পৈশাচিক হত্যাকান্ড (৩রা নভেম্বর ১৯৭৫)
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খুনিচক্র সেনাসদস্যরা দেশত্যাগের পূর্বে খন্দকার মোশতাকের অনুমতি নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে সেখানে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আর একটি কলঙ্কময় অধ্যায়ের। এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড দেশের জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ঘটনা মোশতাকের পতন ত্বরান্বিত করে। খুনিরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। এ হত্যাকাণ্ড ছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও নীলনক্সার বাস্তবায়ন। ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকান্ড একই গোষ্ঠী সংঘটিত করে। উভয় হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ ধ্বংস ও দেশকে নেতৃত্বশূন্য করে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা।
আরও দেখুন...