চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিবেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানাবিধ কারণে চিংড়ির পুকুর দূষিত হয় এবং চিংড়ির স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে থাকে। চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় পুকুর বা খামারের জলজ পরিবেশ, চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ও চিংড়ির মধ্যে একটি দুর্বল ভারসাম্য অবস্থা বিদ্যমান থাকে। কোনো কারণে এ ভারসাম্য অবস্থার বিপর্যয় ঘটলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর প্রভাব বৃদ্ধি পায় ও চিংড়ি রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে। পানিই চিংড়ির জীবনধারণের একমাত্র পরিবেশ এবং পরিবেশের সাথেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বাস করে। তাই পুকুরের জলজ পরিবেশগত অবস্থা যত ভালো হবে চিংড়ির স্বাস্থ্যও তত ভালো থাকবে।
জলজ পরিবেশের পারিপার্শ্বিক চাপ, রোগজীবাণু এবং চিংড়ির দেহের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে জন্য চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বা নিয়ামক কাজ করে। এখন পর্যন্ত যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
চিংড়ির স্বাস্থ্যের ওপর জলীয় পরিবেশের গুণাগুণের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ চিংড়ির জন্য যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য হবে জলজ প্রাণী হিসেবে চিংড়ির জীবনধারণ তত বেশি পীড়নমুক্ত হবে। কারণ পরিবেশগত পীড়ন চিংড়িকে অধিকতর সংবেদনশীল করে তালে। পুকুরের জলীয় পরিবেশ খারাপ হলে মাছ ও চিংড়ি দ্রুত মারা যায় । সে তুলনায় অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী প্রাণী বা পুষ্টির অভাবজনিত কারণে চিংড়ির মড়ক হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় ।
নিচের প্রবাহ চিত্রের মাধ্যমে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা যায়।
চিত্র-৪.১: রোগাক্রান্ত চিংড়ি
চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষার উপযোগী পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ নিচের সারণিতে দেয়া হলোঃ
ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ | সহনশীল মাত্রা |
---|---|
তাপমাত্রা | ২৫-৩১° সে |
স্বচ্ছতা | ২৫-৩৫ সেমি |
পিএইচ | ৭.৯ |
নাইট্রাইট | <০.০০২ পিপিএম |
হাইড্রোজেন সালফাইড | <০.১ পিপিএম |
ম্যাগনেসিয়াম | ১০-১২ পিপিএম |
খরতা | ৪০-২০০ পিপিএম |
লবণাক্ততা | ৩-৪ পিপিটি |
দ্রবীভূত অক্সিজেন | ৫-৭ পিপিএম |
মুক্ত অ্যামোনিয়া | ০.০২৫ পিপিএম |
নাইট্রেট | ২০ পিপিএম |
ক্যালসিয়াম | ১০-১২ পিপিএম |
লৌহ | ০.০২ পিপিএম |
ফসফরাস | ০.১৫ পিপিএম |
পানির উপরোক্ত ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণের পরিবর্তন হলেই চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষাকারী পরিবেশ বিনষ্ট হয় এবং পরিবেশগত পীড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাছের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়ে যায়। এজন্য চিংড়ি চাষের সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে চিংড়ির জন্য অনুকূল পরিবেশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
পোনা অবস্থায় কিংবা দেহ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থায় চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে পারে। চিংড়ি জীবিত থাকা অবস্থায় রোগাক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ চিংড়ি মৃত হলে লক্ষণগুলো সঠিকভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। রোগাক্রান্ত চিংড়ি সনাক্তকরণের সাধারণ লক্ষণসমূহ নিচে দেয়া হলো-
পরিবেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রোগ সনাক্তকরণ: পুকুরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেও রোগাক্রান্ত বিষয়ে পূর্বাভাস করা যায়। হঠাৎ পুকুরের পানির রঙের পরিবর্তন ঘটলে বা পানির তাপমাত্রা ৩২° সে. এর উপরে আসলে গলদা চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দিনের বেলায় পানির উপর দিয়ে চিংড়ি দ্রুত সাঁতার কাটলে বুঝতে হবে পুকুরে অক্সিজেনের অভাব ঘটেছে।
চিংড়ি, রোগজীবাণু ও পরিবেশগত পীড়নের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ায় চিংড়ির শরীরে সৃষ্ট অস্বাভাবিক অবস্থাকে রোগ বলা হয়। পুকুরের জলজ পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে চিংড়ির রোগবালাই সৃষ্টি হয়। এসব রোগের ধরন, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু সমূহের প্রজাতি, প্রকৃতি ও আক্রমণের ধারা অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই রোগের লক্ষণও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রকৃতি অনুযায়ী চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা কারণ সমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) ব্যাকটেরিয়া (খ) ভাইরাস, (গ) ছত্রাক, ও (ঘ) পরজীবী।
ব্যাকটেরিয়া খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুবীক্ষণিক জীব। এদের শরীরের ব্যাস সাধারণত ০.০০১ মিমি এর মতো হয়ে থাকে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে এদের দেখা যায় না। জলে, স্থলে, বাতাসে সর্বত্রই এরা বিদ্যমান। চিংড়ির পেশীকোষে সাধারণত প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। তবে এদের গায়ে, পায়ে, ফুলকা ও খাদ্যনালীতে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এসব ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চিংড়ির দেহে বিভিন্ন প্রকার রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নবর্ণিত ব্যাকটেরিয়াসমূহ চিংড়িতে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
১. ভিব্রিও ব্যাকটেরিয়া এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া চিংড়ির রক্তে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয় । ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে চিংড়ি মারা যায়।
২. সিউডোমেনাস ব্যাকটেরিয়া এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ফলে চিংড়ির দেহের রং পরিবর্তিত হয়।
৩. কাইটিনাভেরাস ব্যাকটেরিয়া: এরা চিংড়ির খোলস ও ক্যারাপেসকে আক্রান্ত করে। এদের আক্রমণের ফলে চিংড়ির খোলসে অসংখ্য কালো কালো দাগ দেখা যায়।
৪. ফিলামেন্টাস ব্যাকটেরিয়া: চিংড়ির উদর, খোলস, শিরোবক্ষ ও পুচ্ছ পাখনা (Telson) অঞ্চলে এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমন করে থাকে। ফুলকা আক্রমন হলে চিংড়ির শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটে ফলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: এককোষী অনুজীবদের একটি বিরাট জগৎ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া আণুবীক্ষনিক জীব যা খালি চোখে দেখা যায় না। চিংড়ির দেহে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এই ব্যাকটেরিয়া চরম ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টি করে। রোগ সৃষ্টিকারী প্রধান ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিসমূহ হলোঃ Vibrio parahaemolyticus, Vibrio harveyi, Vibrio vulnificus, V. damsela, Aeromonas spp., Flavobacterium spp, Vibrio alginolyticus প্রভৃতি। গলদা চিংড়িতে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ গুলো হলোঃ Filamentous bacterial disease, Necrotising Hepatopancreatitis (NHP), Mycobacteriosis, Chitinolytic bacterial shell disease, Rickettsial infection প্রভৃতি।
ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ভাইরাস আকারে অনেক ছোট। ভাইরাস সাধারণত ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। বাংলাদেশে মাঝে মাছে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। সাধারণত চীনা "ভাইরাস" এবং সিস্টেমিক এক্টোডারমাল ও মেসাডোরমাল ব্যাকিউলা ভাইরাস সংক্ষেপে সাদা ভাইরাস নামে পরিচিত। এরা চিংড়ির গায়ে সাদা দাগের সৃষ্টি করে। এছাড়া মনোডন ব্যাকিউলো ভাইরাস ও ই-টাইপ ব্যাকিউলা ভাইরাস এর কারণেও চিংড়িতে ভাইরাস রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নমানের খাদ্য প্রয়োগ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দূষিত মাটি ইত্যাদির কারণে ভাইরাসজনিত রোগ ছড়াতে পারে। এই রোগের ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকা, লেজের অংশ অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। অনেক সময় কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ভাইরাস আক্রমণের ফলে ব্যাপক হারে চিংড়ি মারা যেতে থাকে।
ভাইরাসজনিত রোগ: ভাইরাস এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈবকণা বা অনুজীব যা জীবিত কোষের ভিতরে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। চিংড়ি চাষের সমস্যাগুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। চিংড়ি চাষে ভাইরাসের আক্রমনে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং আমাদের দেশে ভাইরাসের কারনে চিংড়ির ব্যাপক মহামারী দেখা যায়। চিংড়ির ক্ষেত্রে প্রধান ভাইরাস জনিত রোগ গুলো হলোঃ White Spot Syndrome Virus (WSSV), Yellow head virus (YHV), Baculovirus penaei (BP), Monodon Baculovirus (MBV), Infectious Myonecrosis Virus (IMNV), Hepatopancreatic Parvovirus (HPV) ।
সাধারণত ফুসেরিয়ান, স্যাপ্রোলোনিয়া, লেজিনিডিয়াম, হেলিপস ও সাইলেপিডিয়াম নামক ছত্রাক দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ছত্রাক সাধারণত চিংড়ির ফুলকায় আক্রমণ করে থাকে। ফলে চিংড়ি শ্বাসকষ্টে মারা যায়।
ছত্রাকজনিত রোগ: ছত্রাক প্রধানত চিংড়ির লার্ভা পর্যায়ে বেশি আক্রমন করে। এছাড়া সাধারণত চিংড়ির ফুলকাতেও আক্রমন করে। ছত্রাক সাধারণত চিংড়ির ফুলকাতে আক্রমন করে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে। যার ফলে চিংড়ি মারা যায়। প্রধান সংক্রামক প্রজাতিগুলো গুলোঃ Lagenidium callinectes, L. marina Sirolpidium spp. Pythium spp. Fusarium solani, Fusarium incarnatum প্রভৃতি।
বিভিন্ন প্রকার পরজীবী চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে থাকে। এসব পরজীবী চিংড়ির খোলস, ফুলকা ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে থাকে। এসকল পরজীবী এককোষী বা বহুকোষী হয়ে থাকে। বহুকোষী পরজীবীর মধ্যে ট্রিমাটোডা (trematode) নেমাটাডা (nematode) সিস্টোভা (cestode) জাতীয় কৃমি দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
চিংড়িতে প্রোক্রিসটোনেলা (Prochristonelia), প্যারাক্রিটোনেলা (Parachristonelia) এবং রেনিবুলবাস পিনাইর (Renibulbus Penacl) ধরনের সিস্টোড বা ফিতাকৃমি দেখা যায়। এছাড়া চিংড়িতে তিন ধরনের উকুন (Shrimp fluke) দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে অপারকলিডি (Opercolidae), মাইক্রোফলিডি (Microphollidae) ও একিনোস্টোমাটিভাস (Echinostomatidas)। এককোষী প্রোটোজোয়া দ্বারাও চিংড়ি আক্রান্ত হয়। এক্টোকমেনসেল প্রোটোজোয়া, প্রোটোজোয়া কমেনসেলস, এপোস্টোম সিলিয়েট, গ্রেগারিন, মাইক্রোন্তোরিডিয়া প্রভৃতি এককোষী প্রাণী দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
পরজীবীঘটিত রোগ; বিভিন্ন প্রকার এককোষী ও বহুকোষী পরজীবী আছে যারা চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে। এই পরজীবীগুলো চিংড়ির ত্বকের সাথে লেগে থেকে ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফুলকাতে আক্রমণ করে, চিংড়ির ওজন কমিয়ে দেয় এবং অবশেষে মৃত্যু ঘটায়। Block/ Brown gill disease হয়ে থাকে Zoothamnium, Epistylis, Vorticella প্রোটোজোয়ার জন্য, Gregarine disease হয়ে থাকে অ্যানিলিড পরজীবী Nematopsis spp. এর জন্য এবং Cotton shrimp এর জন্য দায়ী Agmasoma sp.
এছাড়াও পরিবেশ দূষণ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে পারে। নিচে চিংড়ির রোগর কারণসমূহ ও রোগ সৃষ্টির বিভিন্ন উপাদানের বর্ণনা দেওয়া হলো।
রোগের কারণ | রোগ সৃষ্টির অন্তর্নিহিত উপাদান |
---|---|
ক) সংক্রমন | ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস ছত্রাক পরজীবী |
খ) পরিবেশ দুষণ | অক্সিজেনের অভাব মাত্রা অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া মাত্রা অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি জৈব তলানী হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন হঠাৎ লবণাক্ততার পরিবর্তন কীটনাশকের ব্যবহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের আধিক্য |
গ) পুষ্টিহীনতা | প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব সুষম খাদ্যের অভাব অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ |
ঘ) ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি | পোনা বা জুভেনাইল উৎপাদনে ত্রুটি আহত বা ক্ষতযুক্ত পোনা পরিবহন জনিত পিড়ন বা ত্রুটি পোনা প্রতিপালনে ত্রুটি পুকুর প্রস্তুতিতে ত্রুটি। |
গলদা চিংড়ির চাষে এবং বাণিজ্যিকভাবে সফলতা অর্জনের জন্য চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ির রোগ প্রতিকার বা চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। তাই চিংড়ির রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই উত্তম। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমেও রোগবালাই এর আক্রমণ থেকে চিংড়িকে রক্ষা করা সম্ভব। সাধারণত সম্ভাব্য রোগবালাই হতে চিংড়িকে রক্ষা করার জন্য পূর্বাহ্নেই যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলা হয়। রোগবালাই প্রাদুর্ভাবের কারণসমূহ বিশেষণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইদানিংকালে চিংড়ি চাষের প্রসার লাভ করছে। চিংড়ি চাষের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে যে সকল সাধারন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় সে সকল রোগ ও তাদের প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো-
কারণ: ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ
লক্ষণ : মজুদের ৩-৪ মাস পর অ্যান্টেনা, সন্তরণপদ খণ্ডিত অথবা খসে পড়তে থাকে।
প্রতিকার : সাময়িকভাবে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে,
সম্ভব হলে পানি পরিবর্তন করতে হবে, এবং
পিএইচ পরীক্ষা করে প্রয়োজনে ২৫০-৩০০ গ্রাম/শতাংশ হারে ডালোমাইট প্রয়োগ করতে হবে।
কারণ : পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে। পানির পিএইচ, লবণাক্ততা বা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে খোলস পাল্টায় না এবং শক্ত হয়ে যায়।
লক্ষণ : খোলস স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে শক্ত থাকে,
বয়সের তুলনায় চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি কম হয়।
প্রতিকার : পুকুরের জলজ পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে,
হঠাৎ পরিবেশের যে কোন পরিবর্তন, যেমন- পানির উচ্চতা বৃদ্ধি অথবা পরিমানমত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
কারণ : পরিবেশগত যে কোনো প্যারামিটারের তারতম্যের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। বিশেষ করে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে এটা বেশি হতে দেখা যায়।
লক্ষণ: করাত ও ক্যারাপেস অংশে ধূসর রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর দেখা যায়।
প্রতিকার : পুকুরের পানি পরিবর্তন করতে হবে,
স্বাদু পানির সরবরাহ বৃদ্ধি করা, এবং
পানির গভীরতা বৃদ্ধি করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
গলদা চাষের মাঝামাঝি সময়ে প্রায়ই এ রোগ দেখা যায়।
কারণ : পানিতে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া
পানিতে অ্যামোনিয়া ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব থাকলে এ রোগ হতে পারে, এবং
অনেকদিন পানি পরিবর্তন না করা।
লক্ষণ : খোলস নরম হয়ে যায়,
পা লম্বা ও লেজ ছোট হয়, ও
দেহ ফাঁপা হয়ে পঞ্জের মত হয়।
প্রতিকার : পুকুরে ২-৩ মাস অন্তর শতাংশ প্রতি ০.৫ কেজি হারে চুন প্রয়োগ
খাবারে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
কারণ: খাদ্যে ভিটামিন বি-কমপেক্স, ফ্যাটি অ্যাসিড, আমিষ ও খনিজ দ্রব্যের অভাব,
লক্ষণ : দেহ নরম থাকে এবং রং নীলাভ হয়ে যায়,
উল্লেখ্য যে, সুস্থ চিংড়ি রান্না করলে রং লাল হয়।
প্রতিকার : খাদ্যের সঙ্গে ৫০ মিলি গ্রাম/কেজি হারে ভিটামিন প্রিমিক্স প্রয়োগ।
কারণ : খোলস পরিবর্তন না করা ও চিংড়ির চলাফেরার গতি কমে যাওয়া,
লক্ষণ : চিংড়ি ধরার পর সারা দেহে সবুজ শেওলা দেখা যায়।
প্রতিকার : পানি বাড়িয়ে দিতে হবে এবং পরিমাণমত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
কারণ : জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি, অক্সিজেনের পরিমাণ কম, পোনার মজুদ ঘনত্ব বেশি।
লক্ষণ : চিংড়ির ফুলকায় পশম বা উলের মত আবরণ পড়ে, ফুলকায় ফোটা ফোটা দাগ, সন্তরণ পদ ও উপাঙ্গ খসে পড়া, কালো বর্ণ ধারণ করা।
প্রতিকার: কিউপ্রাস ক্লোরাইড ২ পিপিএম/লিটার দ্রবণে ৩-৪ দিন চিংড়িকে ধৌত করা।
কারণ : ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ
লক্ষণ: ফুলকায় কালো দাগ ও পচন, ফুলকায় জৈব পদার্থ জমে থাকা।
প্রতিকার : ফাংগাসে আক্রান্ত হলে অ্যাজালামোইসিনে গোসল করানো, ফিলামেন্টাস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে ফিউরাজলিডন দ্রবণে গোসল করানো।
পলদা চিংড়ি চাষে চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিংড়ির রোগ চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট জটিল এবং ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে চিংড়ির রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই শ্রেয়। রোগবালাই প্রাদুর্ভাবের কারণসমূহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নিচে রোগ প্রতিরোধের উপায়সমূহ বর্ণানা করা হলো-
চিংড়ি চাষে পরিবেশের উপর নিবিড় নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা যাতে পারিবেশিক পীড়ন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিংড়ির সুস্থ ও সবল স্বাস্থ্যের জন্য এসব প্রভাবক অনুকূল মাত্রায় থাকলে রোগ প্রতিরোধের সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
পরিবেশের উপর নিবিড় নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকগুলোর উপর লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন-
গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থাপনা চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক ঘনত্বে ও সঠিক পদ্ধতিতে চিংড়ির পোনা মজুদ করা প্রয়োজন, যাতে পুকুরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ সহনশীল মাত্রায় বজায় থাকে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এজন্য, সুস্থ ও সবল পোনা সংগ্রহ করে তা ঘের বা পুকুরে মজুদ করা উচিত। এছাড়া ব্যবস্থাপনাজনিত পীড়ন নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে পোনা স্থানান্তরের সময় হাত দিয়ে পোনাকে স্পর্শ না করা, পোনা নাড়াচাড়া না করা, অধিক ঘনত্বে পোনা পরিবহন না করা এবং অধিক গরমে বা তাপমাত্রায় পোনা স্থানান্তর, পরিবহন ও পুকুরে মজুদ না করা প্রভৃতি বিষয় গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার।
চিংড়ি খামারে বা পুকুরে অবাঞ্ছিত মাছ ও প্রাণির প্রবেশ রোধ করে পুকুরকে বহিরাগত রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা যায় । এজন্য পুকুরের আগমন ও নির্গমন নালা প্রয়োজনমত বন্ধ রাখা, পুকুরের পাড় বন্যার কবল থেকে রক্ষা করা, পুকুরে ক্ষতিকারক পাখি বসতে না দেয়া এবং কাপড় চোপড় না ধোয়া প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার।
বহিরাগত রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে জলাশয় কে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে পোনা সংগ্রহের জাল, পরিবহন পাত্র, চিংড়ি ধরার জাল প্রভৃতি ব্যবহারের পূর্বে ও পরে জীবাণুনাশক উপকরণ যারা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নিয়মিত পুকুর পর্যবেক্ষণ করা এবং কোনো কারণে মৃত বা রোগাক্রান্ত চিংড়ি তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণ করা যাতে খামারের অন্য চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে না পারে। এছাড়া লক্ষণ অনুযায়ী রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
চিংড়ির প্রয়োজনীয় পুষ্টিসাধন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বজায় রাখার জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চিংড়ির মোট দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা, খাদ্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করা এবং সময় মত খাবার দেয়া প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ রাখা আবশ্যক। এ ছাড়াও নিয়মিত জাল টেনে চিংড়ির বৃদ্ধির হার এবং স্বাস্থ্য ও রোগবালাই পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে খামারের উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়াও পুকুরে খাদ্য প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে বড় আকারের গলদা চিংড়ি পুকুর থেকে সরিয়ে ফেললে ভাল ফল পাওয়া যায়। কারণ অপেক্ষাকৃত বড় চিংড়ি খাদ্য প্রতিযোগিতায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে এবং ছোট আকারের চিংড়ি কাংখিত মাত্রায় বড় হতে পারে না।
রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের তুলনামূলক সুবিধা
ক্রম | রোগ প্রতিরোধ | রোগ প্রতিকার |
---|---|---|
১ | তুলনামূলক সহজ | তুলনামূলক জটিল |
২ | আর্থিকভাবে লাভজনক | আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি |
৩ | চিংড়ির গুণগতমান ভালো থাবে | গুণগতমান খারাপ হয় |
৪ | পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব | ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব হয় না |
৫ | রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কম | রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার বেশি |
৬ | পরিবেশ সহনীয় | পরিবেশ সহনীয় নয় |
৭ | টেকসই | টেকসই নয় |
গলদা চিংড়ির রোগ দমনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের মধে সাধারণ চুন, লবণ, পটাশ বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রিন, মিথিলিন ব্লু, ফর্মালিন, তুঁতে, বিভিন্ন ধরনে এন্টিবায়াটিক প্রভৃতির ব্যবহার সর্বাধিক।
পুকুরে রোগমুক্ত পরিবেশ রক্ষার জন্য ও পানিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পর্যাপ্ততা সৃষ্টির জন্য এবং বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে চুন ব্যবহার করা হয়। বাজরে বিভিন্ন ধরনের চুন পাওয়া যায়। কার্যকারিতা ও মূল্য বিবেচনায় পুকুরে সাধারণত পাথুরে চুন ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন ধরনের বাহ্যিক পরজীবী দমনের জন্য সাধারণত খাওয়ার লবণ (table salt, NaCl) ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পিপিএম, পিপিটি বা শতকরা দ্রবণ হিসেবে লবণ জলে চিংড়িকে গোসল (bath) করানো বা চুবানো (dip) হয়। পিপিএম (parts per million) অর্থ দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বা নিযুতাংশ। এক পিপিএম সমান এক লিটার পানিতে এক মিলিগ্রাম দ্রব্য। পিপিটি (parts per thousand ) অর্থাৎ হাজার ভাগের এক ভাগ বা সহস্রাংশ অর্থাৎ এক পিপিটি হচ্ছে ১ লিটারে ১ সিসি বা ১ এমএল এর সমপরিমাণ।
পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দেখতে বেগুনি রঙের। জীবাণু মুক্তকারী দ্রব্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াজনিত ও বহিঃপরজীবীজনিত রোগ দমনে পটাশ বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গনেট ব্যবহার করা হয়। বাজারে ঔষধের দোকানে এই দ্রব্যটি সাধারণত পটাশ নামে পরিচিত। পটাশ সহজে পানিতে দ্রবণীয় এবং অল্পতেই পানি গাঢ় বেগুনি রঙের হয়ে যায়।
এটা এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য বা কেলাসিত অবস্থার থাকে। শুষ্ক অবস্থায় পিঙ্গল বর্ণের ছোট ছোট কণা বা পাউডারের মতো দেখতে। বিভিন্ন ছত্রাক, বাহ্যিক পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া দমনে ম্যালাকাইট গ্রিন ব্যবহার করা হয়। এটা সহজেই পানিতে দ্রবণীয় এবং অল্পতেই পানি পাঢ় সবুজ বর্ণের হয়।
গাঢ় নীল বর্ণের রাসায়নিক দ্রব্য যা কঠিন অবস্থায় পিঙ্গল বর্ণের থাকে। এই পদার্থ সহজেই পানিতে দ্রবণীয়। সাধারণত চিংড়ির ফুলকা রোগ দমনে মিথিলিন ব্লু ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত ৰাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ৪০% ফরমালডিহাইডের দ্রবণ ফরমালিন হিসেবে পরিচিত। এককোষী বহিঃপরজীবী ও মনোজেনেটিক ট্রিমাটোড দমনে ফর্মালিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জীবাণুনাশক হিসেবেও ফর্মালিন ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তুঁতে নীল রঙের স্ফটিকাকার দ্রব্য। এই দ্রব্য সাধারণ মুদি বা ঔষধের দোকানে পাওয়া যায়। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে তুঁতের প্রবণ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়।
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য সাধারণত কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় । আমাদের দেশে সচরাচর টেট্রাসাইক্লিন ( অক্সিটেট্রাসাইক্লিন), ব্যবহার করা হয়। চিংড়ির রোগ দমনে খাদ্যের সাথে মিশিয়ে এসব ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।
সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর অধিক এবং লাভজনক উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। ভালো ব্যবস্থাপনার পরও চাষকালীন সময়ে গলদা চিংড়ি চাষের পুকুরে বেশ কিছু কারিগরি সমস্যা দেখা দিতে পারে যার কারণে ব্যাপক হারে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। মাছ ও চিংড়ি চাষের পুকুরের এরূপ কিছু সাধারণ কারিগরি সমস্যা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
পুকুর শুকানো অথবা বিষ প্রয়োগ করার পরও অনেক সময় পুকুর বা ঘেরে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ থেকে যেতে পারে। এছাড়াও বর্ষাকালে পানির সাথে বা অন্য যে কোনা সময় বাইরে থেকে শোল, টাকি, কৈ, শিং, মাগুর, চান্দা, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ পুকুরে প্রবেশ করতে পারে। এতে ব্যাপকভাবে মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন বিঘ্নিত হবে এবং খামার পরিচালনায় লোকসান হতে পারে।
প্রতিকার: পাখি, জাল, বৃষ্টির পানির স্রোত বা মানুষের মাধ্যমে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ প্রবেশ করে। তাই এ সমস্ত উৎস থেকে সতর্ক থাকতে হবে । নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উল্লিখিত সমস্যার প্রতিকার করা যেতে পারে।
অতিরিক্ত শেওলার জন্য পানির রং ঘণ সবুজ বা নীল হয়ে যায়। ফলে রাতের বেলায় পানিতে অক্সিজেন কমে যায় এবং দিনের বেলায় পিএইচ মান বেড়ে যায়। এ ছাড়া শেওলা মরার পর পুকুরের তলায় জমা হয় এবং পঁচে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মাছ ও চিংড়ি পানির উপরিতলে খাবি খায় এবং কখনও কখনও ব্যাপক হারে মারা যায়।
প্রতিকার:
তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে পুকুরে বা ঘেরে অগভীর নলকূপের পরিষ্কার ঠান্ডা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা গেলে ভাল হয়। সে সাথে পুকুরে বা ঘেরে খাদ্য ও সার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়াও কিছু সিলভার কার্পের চারা পোনা ছেড়ে জৈবিকভাবে অতিরিক্ত উদ্ভিদকণার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা যায়।
অতিরিক্ত লৌহ অথবা লাল শেওলার জন্যে পানির উপর লালস্তর পড়তে পারে। ফলে সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশ করতে পারে না। এজন্যে পুকুরে খাদ্য ও অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়।
প্রতিকার:
ধানের খড় বা কলাপাতা পেঁচিয়ে দড়ি বানিয়ে পানির উপর থেকে টেনে তুলে ফেলা যায়।
বিভিন্ন কারণে ঘের বা পুকুরের তলদেশে অ্যামোনিয়া সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চতর পিএইচ এ অ্যামোনিয়া চিংড়ির জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটন বেড়ে গেলে পানির পিএইচ দ্রুত উপরে উঠে আসে। ফলে ব্যাপক সংখ্যায় মাছ ও চিংড়ি মারা যায়। চিংড়ির ফুলকায় কালো দাগ পড়লে বুঝতে হবে নাইট্রোজেন বর্জ্য ও অন্যান্য রাসায়নিকের মাত্রা বেশি। অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে রক্ত পরিবহনতন্ত্র দ্রুত আক্রান্ত হয়।
প্রতিকার:
মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখা, সম্ভব হলে ৩০-৫০% পানি বদল ও পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অনেক পুকুরেই আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং এপ্রিল-মে মাসে এ সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দেয়। সাধারণত ভোর রাতের দিকে মাছ ও চিংড়ি পানির উপর ভেসে উঠে খাবি খেতে থাকে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাওয়ার কারণে এটা ঘটে। অক্সিজেন স্বল্পতা যদি খুব বেশি ও দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে মাছ ও চিংড়ি দুর্বল হয় পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
প্রতিকার :
প্রাথমিক অবস্থায় সাময়িকভাবে সার ও খাদ্য প্রয়োগে বন্ধ রেখে বাঁশ পিটিয়ে বা সাঁতার কেটে পানিতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে। বিপদজনক অবস্থায় পুকুরে পরিষ্কার নতুন পানি সরবরাহ বা স্যালো টিউবওয়েলের মাধ্যমে একই পুকুরের পানি ছিটানারে ব্যবস্থা করতে হবে। তবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা চলতে থাকলে বড় মাছ ও চিংড়ি ধরে বিক্রি করা যেতে পারে।
সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, উদ-বিড়াল সরাসরি খেয়ে ফেলে এবং মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে।
প্রতিকার:
এ সমস্ত প্রাণী নিয়ন্ত্রণে কায়িক মাধ্যমই সবচেয়ে ভালো। উদ- বিড়াল নিয়ন্ত্রণে চুন ভর্তি ডিমের খোসা পুকুরের পাড়ে রেখে দিলে এদের উৎপাত কমে যায়। বাঁশের চাটাই ব্যবহার করে সহজেই কাঁকড়া মারা যায়। সাধারণভাবে ব্যাঙ যে সমস্ত অঞ্চলে ডিম দেয় যেমন- পানি ও পাড়ের সংযোগ স্থলের ঘাস দূর করে ফেলতে হবে। এছাড়াও যে সমস্ত পুকুরের আশেপাশে জঙ্গল থাকে সেখানেই এসব প্রাণির উপদ্রব বেশি হয়। তাই ঘের বা পুকুরের চারপাশ আগাছা জঙ্গলমুক্ত রাখতে হবে। পুকুরের পাড়ে ঘন ফাঁসের পুরাতন জাল দিয়ে বেড়া বা বেষ্টনী দেয়া যেতে পারে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ সমস্যা। প্রায় সব চাষিই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করে থাকেন। ফলে এসব খাদ্যের একটা বড় অংশ তলায় জমা হয়ে পানির পরিবেশ নষ্ট করে ফেলে। এতে মাছ ও চিংড়ি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
প্রতিকার:
খাদ্য প্রয়োগের পূর্বে খাদ্যের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। মাঝে মাঝে খাদ্য প্রয়োগ স্থানের মাটিতে জমে থাকা অতিরিক্ত কাদা অপসারণ করতে হবে।
বৃষ্টি ধোয়া পানিতে পুকুর ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশ করতে পারে না এবং প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও মাছের ফুলকা নষ্ট হয়ে মাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকার :
বৃষ্টি ধোয়া পানির প্রবেশ রোধ করার জন্য সমতল ভূমি থেকে পুকুরের পাড় উঁচু রাখতে হবে। ঘোলাত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি শতাংশ পানিতে ১ কেজি করে পোড়া চুন বা জিপসাম ২ কেজি হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অতিরিক্ত খাদ্য ও জৈব পদার্থ পুকুরের তলায়ে জমা হয়ে তলার মাটি কালো দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে চাষ করা পুকুরে বা ঘেরে এ সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দেয়। এর ফলে বিষাক্ত গ্যাস তলায় জমা হয়ে মাছ ও চিংড়ির মড়ক দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও চিংড়ির দেহ কালো হয়ে বাজার মূল্য হ্রাস করে।
প্রতিকার :
গলদা চিংড়ি ছাড়ার পূর্বে তলার অতিরিক্ত কালো কাদা তুলে ফেলতে হবে। চাষকালীন সময়ে চিংড়ির মড়ক দেখা দিলে দ্রুত পানি বদল, মজুদ ঘনত্ব হ্রাস এবং সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
চিংড়ি চাষের এটি একটি বড় সমস্যা। স্বভাবগত কারণে চিংড়ি স্বজাতিভুক প্রাণী। যখন এদের খাদ্যাভাব দেখা দেয় তখন এরা অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল আকৃতির চিংড়িগুলোকে ধরে খায় ফলে চিংড়ি আহরণের সময় মজুদের তুলনায় অনেক কম চিংড়ি আহরিত হয়।
প্রতিকার:
মজুদকালীন সময়ে পুকুরে সমান আকৃতির পিএল বা জুভেনাইল মজুদ করতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত সার ও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করে পুকুরে খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
বৃষ্টির পর অনেক সময় মাছ ও চিংড়ি পানির উপর ভেসে খাবি খেতে পারে। পানির পিএইচ কমে যাওয়ার ফলে এটা ঘটে থাকে। পিএইচ কমে গেলে ক্ষতিকর হাইড্রোজেন সালফাইডের বিষক্রিয়া বেড়ে যায় ফলে অনেক সময় চিংড়ির মড়ক হয়ে থাকে।
প্রতিকার:
বৃষ্টির পরপরই পানির পিএইচ পরিমাপ করতে হবে। প্রতিবার ভারী বৃষ্টির পর শতাংশ প্রতি ৭৫-৮০ গ্রাম হারে পোড়া চুন বা ডলোমাইট প্রয়োগ করতে হবে।
অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে রাতের বেলায় চিংড়ি পাড়ের কাছাকাছি এমনকি পাড়ের উপর চলে আসতে পারে। ফলে শিয়াল বা অন্য কোনো নিশাচর রাক্ষুসে প্রাণী দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হতে পারে।
প্রতিকার :
অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করা। তবে পুকুরের পানির পরিবেশ ভালো থাকলে এ অবস্থা দেখা যায় না। পাড় ঘেঁষে মশারীর জাল দিয়ে বেড়া প্রদান করা যেতে পারে।
গলদা চিংড়ির চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচালিত হয়। প্রতিটি ব্যবসার ন্যায় চিংড়ির চাষের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। চিংড়ি চাষির ঝুঁকিপূর্ণ দিকসমূহ হলো-
১। বন্যা,
২। অতিরিক্ত খরা,
৩। চিংড়ির বাজারদর,
৪। শীতকালীন ঝুঁকি,
৫। রোগব্যাধি,
৬। মাছ চুরি, ও
৭। বিষ প্রয়োগ।
চিংড়ি চাষির ঝুঁকিপূর্ণ দিকসমূহ বিবেচনায় উদ্ভুত সমস্যাদি নিম্নোক্তভাবে সমাধান করা যেতে পারে-
আরও দেখুন...