রাগ
হিন্দুস্তানি সংগীতে রাগের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা শুনলে শ্রোতার মনোরঞ্জন হয় তাকে রাগ বলে। অবশ্য এ থেকে সংগীতে রাগের পূর্ণ চিত্র প্রকাশ হয় না। রাগ বলতে স্বর সমষ্টি দ্বারা গঠিত মনোরঞ্জনকারী এবং আরোহী ও অবরোহীর একটি বিশিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি রক্ষাকারী রচনাকে বোঝায়। প্রাচীন সংগীত শাস্ত্রে স্বর ও বর্ণ
দ্বারা বিভূষিত জনচিত্তের রঞ্জক ধ্বনি বিশেষকে রাগ বলা হয়েছে। স্বপ্ন এবং বর্ণের পারিভাষিক ব্যাখ্যায় বর্ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে গাওয়ার প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকেই বর্ণ বলে। বর্ণ চার প্রকার যথা স্থায়ী বর্ণ, আরোহী বর্ণ, অবরোহী বর্ণ এবং সঞ্চারী বর্ণ।
স্থায়ী বর্ণ
একই স্বরকে বার বার উচ্চারণ করাকে স্থায়ী বর্ণ বলে।
আরোহী বর্ণ ষড়জ থেকে নিষাদ পর্যন্ত পর পর স্বরগুলো গাওয়া হলে তাকে আরোহী বর্ণ বলে।
অবরোহী বর্ণ
নিষাদ থেকে বড়জে ফিরে আসাকে অবরোহী বর্ণ বলে।
সারী ব যে বর্ণে আরোহ ও অবরোহের মিশ্রণ ঘটে অর্থাৎ একত্রে মিলিত হয় তাকে সঞ্চারী বর্ণ বলে। যেকোনো গায়কের গায়কীর মধ্যে এই চারটি বর্ণ উপস্থিত থাকে। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রত্যক্ষ রাগের মধ্যে
নিশ্চিতরূপে আরোহ ও অবরোহ থাকা আবশ্যক।
সংগীতশাস্ত্রে রাগের দশটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- গ্রহ, অংশ, মন্ত্র, তার, ন্যাস, অপন্যাস, অম্লত্ব, বহুত্ব, ধাড়বড় ও উদ্ভব।
বর্তমানকালে রাগের গড়নে যেসব লক্ষণ মেনে চলা হয় তা নিম্নে দেওয়া হলো: ১। রাগ রচনার জন্য কোনো ঠাট থেকে স্বর নিতে হবে।
২। কোনো রাগেই 'সা' স্বরটি বর্জিত হবে না।
৩। কোনো রাগেই মধ্যম (ম) ও পঞ্চম (প) স্বর এক সঙ্গে বর্জিত হবে না। অর্থাৎ ম ও প এর অন্তত একটি
থাকতে হবে।
৪। রাগে কমপক্ষে পাঁচটি স্বর থাকতে হবে। তবে পাঁচটি স্বর সপ্তকের একই অঙ্গে থাকলে চলবে
না। পূর্বাঙ্গ এবং উত্তরাঙ্গে কমপক্ষে দুইটি করে স্বর থাকতে হবে।
৫। রাগের রঞ্জকতা গুণ থাকতে হবে। ৬। রাগে কোনো বিশেষ রসের অভিব্যক্তি থাকবে।
৭। রাগে আরোহী এবং অবরোহী দুটোই থাকতে হবে এবং তা বিশেষ নিয়ম পদ্ধতি মেনে চলবে। ৮। রাগে বাদী, সমবাদী, অনুবাদী, বিবাদী (রাগ বিশেষে), বর্জিত (রাগের নিয়মমাফিক) স্বর থাকবে এবং
জাতি, পকড়, সময়, অঙ্গ, আলাপ বা বিস্তার, তান, বোলতান, বাঁট, সরগম, প্রভৃতি প্রদর্শিত হবে। ১৯ রাগের জাতি, বিভাগ, আরোহ ও অবরোহ স্বর ব্যবহারের ওপর নির্ভর করবে। যেমন: সম্পূর্ণ, ঘাড়ব, উদ্ভব এরূপ ৯টি জাতিভেদ আছে।
১০। কোনো রাগের আরোহ বা অবরোহে একই স্বরের শুদ্ধ ও বিকৃত রূপ পাশাপাশি অর্থাৎ পর পর লাগবে না। যেমন রে রে অথবা গগ স্বর। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন: রাগ ললিত।
ঠাঁট ও রাগের তুলনা
ঠাট
১। সত্তকের স্বর থেকে ঠাট উৎপন্ন হয়।
২। ঠাটের সাত স্বর ক্রমানুসারে হতে হবে।
রাগ
১। আশ্রয় রাগ বা জনক রাগ (ঠাটবাচক) থেকে রাগের সৃষ্টি হয়।
২। রাগে স্বরের ব্যবহার জাতি অনুসারে হয়ে থাকে।
৩। ঠাট পাওয়া বা বাজানো যায় না।
৪। ঠাটে রক্ষকতা দরকার নেই।
৫। ঠাটে সাত স্বরের কম বা বেশি হবে না।
৩। রাগ পাওয়া বা বাজানো যায়।
৪। রাগে রক্ষকতা আবশ্যক। ৫। রাগের জাতি অনুসারে স্বর ব্যবহার হয়। পাঁচটির
৬। ঠাটে আরোহী ও অবরোহীর প্রয়োজন হয় না।
কম ঘরে রাগ হয় না। ৬। রাগে আরোহী ও অবরোহী দুইটিরই প্রয়োজন।
৭। ঠাটে বাণী, সমবাদী, অনুবাদী, বিবাদী, | (রাগ বিশেষে) ও বর্জিত স্বর এবং অঙ্গ, জাতি, পকড়, সময়, বিস্তার, তান, বোলতান, বাট, সরগম ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন নেই।
৭। রাগে বাদী, সমবাদী, অনুবাদী, বিবাদী (রাগ বিশেষে) ও বর্জিত স্বর নির্দিষ্ট থাকে এবং অঙ্গ, জাতি, পকড়, সময়, বিস্তার, স্তান, বোলতান, বাঁট, সরগম ইত্যাদি আবশ্যক।
৮। ঠাটে (স্মর কাঠামোতে প্রদর্শিত স্বর অনুযায়ী রাগের নাম অনুসারে ঠাটের নামকরণ করা হয়।
৮। রাগের নামকরণ স্বতন্ত্রভাবে করা হয়।
সপ্তক
সাধারণভাবে সপ্তক বলতে সাতটি স্বরের সমষ্টিকে বোঝায়। সপ্তক তিন প্রকার মন্ত্র সত্তক, মধ্য সপ্তক ও তার সপ্তক। মন্ত্র, মধ্য, তার সপ্তককে যথাক্রমে উদারা, মুদারা ও তারা সপ্তকও বলা হয়।
মন্ত্র সন্তকের যেকোনো একটি স্বর মধ্য সপ্তকে দ্বিগুণ উঁচুতে অবস্থান করে। আবার, মধ্য সপ্তকের যেকোনো একটি স্বর তার সপ্তকে দ্বিগুণ উঁচুতে অবস্থান করে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের কণ্ঠস্বর তিন সপ্তক অবধি ব্যবহার হয়। তবে সমবেত যন্ত্রসংগীতে, কর্ড ব্যবহারে ও রাগ আলাপে অতিরিক্ত আরও দুইটি সপ্তকের ব্যবহার হতে পারে যা অতি মন্ত্র ও অভি তার নামে চিহ্নিত।
আলাপ
রাগের চলন অনুযায়ী স্বর বিন্যাসই হচ্ছে আলাপ যা গীত আরম্ভের পূর্বে রাগের আবহ সৃষ্টি করার জন্য পরিবেশন করা হয়। আলাপ অর্থ কথোপকথন। আর কথোপকথনের মাধ্যমেই হয় পরিচয়। তাই রাগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয়ের প্রক্রিয়াকেই আলাপ বলা যায়। আলাপের মাধ্যমেই রাগের রূপ প্রকাশ পায় এবং এতে শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। রাগের বাণী সমবাদী স্বরকে ঘিরে অনুবাদী স্বরসমূহের সহযোগিতায় আলাপ আবর্তিত হতে থাকে। বাদী সমবাদীকে ঘিরে আলাপ অংশ রাগের পরিচয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবাদী স্বর রাগ বিশেষে আলাপের সাথে সংযুক্ত হয়ে রাগের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পারে। আলাপ প্রক্রিয়া স্বরের (সরগম) মাধ্যমে, বাণী বা পদ সহযোগে নোম তোম (ধ্রুপদ অঙ্গের পরিবেশনায় ) অথবা আ-কার ইত্যাদিভাবে করা যায়। আলাপ দুই প্রকার। যথা- নিবন্ধ আলাপ বা নোমুতোম আলাপ ও অনিবন্ধ আলাপ বা আকার আলাপ ।
নিবন্ধ বা নোম্-তোম্ আলাপ
নোম্-তোম্ আলাপ রাগের ধ্রুপদ শৈলী পরিবেশনে করা হয়। ধ্রুপদ গানের শুরুতে বেশি দীর্ঘ সময় ধরে এই নোম- তোম্ আলাপ করা হয়ে থাকে। বাণী বা পদের পরিবর্তে নে, তে, তেরি, চারু, নোম, তোম, তানা, দৃষ দেরে না, ইত্যাদি বর্ণ, অলংকার, মীড়, কর্ণ, গমক প্রভৃতিতে ভূষিত করে রাগের রূপ প্রকাশ করা হয়। ধ্রুপদে বাণী ও তাল সহযোগেও বিভিন্ন লয়ে আলাপ করা যায়।
অনিবন্ধ বা আ-কার আলাপ
রাগ পরিবেশনের শুরুতে কণ্ঠসংগীতে পদ বা বাণী উচ্চারণ না করে রাগে ব্যবহৃত স্বরগুলোকে আ-কার দ্বারা
সংক্ষেপে রাগের রূপ প্রকাশ করা হয়। আবার ভাল সহযোগে বাণী বা পদের এক ঘেয়েমী কাটাতে অথবা
সরগম প্রক্রিয়ার মাঝে মাঝে আ-কার আলাপ করা হয়।
বোলবিস্তার
বোল অর্থ কথা বা বাণী। বোলবিস্তার অর্থ কথার আলাপ। রাগ শুরু হওয়ার পরে ভালের ঠেকার সঙ্গে বিভিন্ন লয়ে বাণীর সাহায্য বা বাণীর অনুভূতিগুলো রাগের সুরের সাথে মিশিয়ে প্রকাশ করা যায় তাকে বোলবিস্তার বলা হয়। বোলবিস্তারে বন্দিশের মধ্যে যে সব শব্দ থাকে তা ব্যবহার করতে হবে। বন্দিশের বাইরের শব্দ নয়।
স্বরবিস্তার:
তাল সহযোগে রাগের পরিবেশন করার সময় বাণী বা আ-কারের পরিবর্তে কখনও কখনও সরগম সহযোগে
রাগের ভাব প্রকাশ করা হয়, থাকে স্বরবিস্তার বলে। স্বরবিস্তার বা সরগম করার সময় রাগের আবহ বা ঢংটি সরগম উচ্চারণের সাথে সাথে প্রযুক্ত হয়। বাদ্যযন্ত্র, যেমন- সরোদ, সেতার, বেহালা, বাঁশি, সানাই ইত্যাদিতে রাগ পরিবেশনার সময় ভাল ছাড়া এবং তাল সহযোগে বিস্তার করা হয়। তাল ছাড়া বিস্তারের সময় অনিবদ্ধভাবে লয় বা ছন্দ ব্যবহার করা হয়।
তান
বিস্তারের গতি দ্রুত ও অবিচ্ছিন্নভাবে সমাবিষ্ট হলে এরকম অলংকারিক ক্রিয়াকে জ্ঞান বলে। বিস্তার এবং তানের মধ্যে তুলনাগত গতির সাথে স্বর প্রয়োগের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। বিস্তারের সময় স্বরগুলোকে ধীর গতিতে ব্যবহার করা হয় এবং প্রতিটি স্বর স্পষ্ট ও স্থিরভাবে পেয়ে বা বাজিয়ে রাগ-রূপের বিন্যাস করা হয়। কিন্তু তানের সময় স্বরগুলোকে তালের সাথে সামস্যপূর্ণ করে দ্রুততর ও অবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করা হয়।
তানের প্রধান উদ্দেশ্য গানের বৈচিত্র্য বাড়ানো এবং কণ্ঠস্বরকে মার্জিত করা। যন্ত্রসংগীতে তানের প্রক্রিয়াকে "তোড়া বলা হয়। আধুনিককালে তান ত্রিয়া সরগম ও আ-কার উভয়ভাবেই করা হয়। তানের অনেক প্রকার আছে যাকে তানের জাতি বলা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ১। শুদ্ধতান বা সপাট তান ২। কূটতান ৩। মিশ্রতান ৪। বোলতান ৫ অলংকারিকতান ৬। গমকতান ৭। ছুটতান ইত্যাদি।
শুদ্ধতান বা সপটিতান
তান পরিবেশন করার সময় স্বরগুলোকে সরল গতিতে প্রকাশ করাকে শুদ্ধতান বলা হয়। শুদ্ধতানকে সপাট তানও বলা হয়। যেমন- রাগ ইমন এ সপাটতান নিয়ে গম ধনিসা।
কূটতান তান পরিবেশনের সময় স্বরগুলোকে বক্র গতিতে প্রকাশ করাকে কূটতান বলা হয়। কূট অর্থ জটিল। কূটতান অসংখ্য প্রকার হতে পারে। যেমন- সারে সাথ ধরে পথ সারে সারে সাথ রেগ সারে রেসা। এখানে সা রে গুগ তিনটি স্বরের মধ্যে তানের জটিল ক্রিয়া দেখানো হয়েছে।
মিশ্রতান শুদ্ধ ও কূটতানের মিশ্রণে মিশ্রতান উৎপন্ন হয়। যেমন- রাগ ইমন-এ মিশ্র তাননিরে গম পথ পম পম গল্প রেগ মগ ধপ নিনি ধপ মগ রেসা।
বোলতান
বোল শব্দের অর্থ হচ্ছে কথা বা গানের ভাষা। ভাষাকে অর্থাৎ গানের বাণীকে তানের মতো করে পরিবেশন করলে তাকে বোলতান বলা হয়। যেমন- রাগ ভূপালীতে বোলতান। সারে গপ ধ ধ সাসা ধ রে সাস
অলংকারিকতান
বর্ণ বা অলংকারযুক্ত তানকে অলংকারিকতান বলা হয়। যেমন- রাগ ভূপালীতে অলংকারিক তান: সারে পরে গল্প গপ ধপ ধ
উপরিউক্ত তানের লেখা দেখে জটিল মনে হলেও তা আসলে অলংকারিক। এখানে সারেগ রেগন গপধ পধসা
অলংকারটির ঢং বা ছন্দ অবিচ্ছিন্নভাবে করা হয়েছে।
গমকতান
তান পরিবেশনের সময় স্বরগুলোকে গমকযুক্ত করা হলে তাকে গমকতান বলা হয়।
উচ্চ স্বর থেকে দ্রুত নিম্ন স্বরের দিকে বা নিম্ন স্বর থেকে দ্রুত উচ্চ স্বরের দিকে উল্লম্ফন বা ছুটে আসাকে ছুটতান বলা হয়।
আরও দেখুন...