পর্যায় সারণিতে অবস্থিত 11৪টি মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে ধারণা থাকলে রসায়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় বুঝতে সুবিধা হয়। কিছু কিছু মৌলিক পদার্থ একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে। তাই, একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে পদার্থসমূহকে একই গ্রুপে রেখে সকল মৌলিক পদার্থের জন্য একটি ছক তৈরি করার চেষ্টা বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরেই করে আসছিলেন। বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে এই ছকের বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে, যা আজকে আধুনিক পর্যায় সারণি (Periodic Table) হিসেবে পরিচিত। সুতরাং, এই পর্যায় সারণি বিজ্ঞানীদের এক অসামান্য অবদান। এই অধ্যায়ে পর্যায় সারণির ধারণা ও পর্যায় সারণিতে অবস্থিত মৌলসমূহ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
৬.১ পর্যায় সারণির ধারণা ও পটভূমি
পদার্থ ও তাদের ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধারণার সম্মিলিত প্রকাশ হচ্ছে পর্যায় সারণি। এই পর্যায় সারণি একজন বিজ্ঞানীর কোনো একক প্রচেষ্টা বা গবেষণার ফলে তৈরি হয়নি, এটি অনেক বিজ্ঞানীর অনেক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে আধুনিক পর্যায় সারণিতে রূপ নিয়েছে। নিচে এই আধুনিক পর্যায় সারণি তৈরি হওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
1989 সালে বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে (Lavoisier) কিছু মৌলিক পদার্থসমূহকে ধাতু ও অধাতু এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এই মৌলিক পদার্থগুলো হচ্ছে- অক্সিজেন (০), নাইট্রোজেন (N), হাইড্রোজেন (H), ফসফরাস (P), মার্কারি (Hg), জিঙ্ক (Zn), সালফার (S), ইত্যাদি। সুতরাং, বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ের সময় পরবর্তী কালে বিজ্ঞানী ডোবেরাইনার (Dobereineir) একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে এরকম মৌলিক পদার্থসমূহকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুযায়ী তিনটি করে মৌল দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি লক্ষ করেন যে, দ্বিতীয় মৌলের পারমাণবিক ভর প্রথম ও তৃতীয় মৌলের পারমাণবিক ভরের যোগফলের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি হয় এবং একে 'ডোবেরাইনারের সূত্র' বলা হয়। এভাবে, ক্লোরিন (CI), ব্রোমিন (Br), এবং আয়োডিন (1) কে প্রথম ত্রয়ী মৌল হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন।
এরপর, 1829 সাল পর্যন্ত যে সকল মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব মৌলের জন্য ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড (John Newland) একটি সূত্র প্রদান করেন যা 'নিউল্যান্ড অষ্টক সূত্র' নামে পরিচিত। এই সূত্র অনুযায়ী তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করেন যে, যখন মৌলসমূহকে পারমাণবিক ভর কম থেকে বেশি অনুযায়ী সাজানো হয়, তখন এখানে একটি মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তার অষ্টম মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এরপর 1869 সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ (Mendeleev) সকল মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম পর্যালোচনা করে একটি পর্যায় সূত্র প্রদান করেন যা মৌলসমূহের ধর্মগুলোর সঙ্গে তাদের পারমাণবিক ভর সম্পর্কিত। সূত্রটি এরকম: "মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়"। এ সূত্র অনুযায়ী তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত 63টি মৌলকে তিনি সাজিয়ে ছিলেন। মৌলসমূহকে 12টি আনুভূমিক সারি (horizontal) এবং ৪টি খাড়া কলাম (vertical) -এর একটি ছকে তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধি অনুসারে সাজান এবং দেখেন যে, একই কলামের সকল মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই রকম। আবার, একই সারির প্রথম থেকে শেষ মৌল পর্যন্ত মৌলসমূহের ধর্মের ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হয়। এই ছকটির নাম দেওয়া হয় পর্যায় সারণি (Periodic table)।
মেন্ডেলিফের এই পর্যায় সারণির গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের মধ্যে রয়েছে কিছু মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা। উল্লেখ্য, তখন মাত্র 63টি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছিল। ফলে পর্যায় সারণির কিছু ঘর ফাঁকা রয়ে যায় এবং পরবর্তী কালে এই ফাঁকা ঘরগুলোর জন্য মেন্ডেলিফ যে সব মৌল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেগুলো প্রমাণিত হয় বা মিলে যায়।
মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির সাফল্য যেমন- রয়েছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন- পারমাণবিক ভর অনুযায়ী মেন্ডেলিফ তার পর্যায় সারণিতে যেভাবে মৌলসমূহকে বসিয়েছিলেন, সেই নিয়ম অনুযায়ী কম পারমাণবিক ভরের মৌল অধিক পারমাণবিক ভরের মৌলের আগে বসার কথা। কিন্তু এ নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেমন- মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে আর্গন (Ar) -এর পারমাণবিক ভর 40 হওয়া সত্ত্বেও কম পারমাণবিক ভরের (39) পটাশিয়াম (K) -এর আগে বসিয়েছিলেন। এটা করা হয়েছিল শুধু একই গ্রুপের মৌলসমূহের ধর্মের মিল করানোর জন্য। এছাড়া হাইড্রোজেনকে পর্যায় সারণিতে সঠিক অবস্থান দিতে পারেননি।