প্রথম পরিচ্ছেদ পারিবারিক কৃষি খামারের ধারণা ও গুরুত্ব

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - কৃষি শিক্ষা - পারিবারিক খামার | NCTB BOOK

পারিবারিক খামার
বাংলাদেশের কৃষক পরিবার কৃষি খামারের মাধ্যমেই শস্য, শাকসবজি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মৎস্য উৎপাদন করে থাকে । আকার অনুযায়ী খামার বাণিজ্যিক ও পারিবারিক হয়ে থাকে । বাণিজ্যিক কৃষি খামার আবার বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র হয়ে থাকে । বাণিজ্যিক খামারের জন্য বেশি পরিমাণ মূলধন ও লোকবল প্রয়োজন হয় । কিন্তু পারিবারিক খামারের জন্য কম মূলধন প্রয়োজন । পারিবারিক কৃষি খামার পরিবারের ভরণপোষণ মিটিয়ে কখনো কখনো কিছু অতিরিক্ত আয় করে থাকে । বর্তমানে কৃষক পারিবারিক কৃষি খামার থেকে আয় করার চিন্তা মাথায় রেখে খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করছে । মূলত পরিবারের সদস্য দ্বারাই পারিবারিক কৃষি খামার পরিচালিত হয় ।

পারিবারিক কৃষি খামারের গুরুত্ব

১। পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটায় ।

২। অতিথি আপ্যায়নে ভূমিকা রাখে ।

৩। পরিবারের বেকার সদস্যদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে ।

৪। পরিবারের সদস্যদের অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার হয় ।

৫। পরিবারের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয় ।

৬। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে কৃষি জমির উর্বরতা বাড়ানো যায় ।

৭। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে আগাছা, ফসলের বর্জ্য ও উপজাতসমূহের সঠিক ব্যবহার করা যায় ।

৮। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মলমূত্র ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপন্ন করে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায় ।

৯। পরিকল্পিত পারিবারিক কৃষি খামার জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ।

১০। কৃষকের জীবন যাত্রার মান উন্নত করে ।

পারিবারিক শাকসবজি ও পোল্ট্রি খামার

পারিবারিক শাকসবজি খামার
প্রধানত পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য এই খামার তৈরি হলেও পারিবারিক ক্ষুদ্র আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই খামারের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে । এই খামার বাড়ির আশে পাশে খালি জায়গা, উঁচু ভিটা, মাঝারি নিচু জমিতেও করা যায়। অভিজ্ঞ কৃষকের পরামর্শ নিয়ে ঋতুভিত্তিক সারা বছরের চাষ পরিকল্পনা করলে প্রায় সারা বছরেই এই খামার থেকে ফসল পাওয়া যেতে পারে । যা তার পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পরেও কিছু আয়ও করতে পারে। পারিবারিক নিবিড় পরিচর্যায় আগাম ফসল উৎপাদন করতে পারলে উচ্চ বাজার মূল্য পাওয়া যেতে পারে। এখন সারা বছরই কোনো না কোনো শাকসবজি উৎপাদন হয়ে থাকে । যা সবার চাহিদা মেটাতে পারে। রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক সার ব্যবহার না করেও ফসল উৎপাদন করা যায় । এতে শাকসবজি নিরাপদ ও সুস্বাদু হয় ।

পারিবারিক পোল্ট্রি খামার
পোল্ট্রি বলতে গৃহপালিত পাখি যেমন, হাঁস, মুরগি, কবুতর, তিতির, কোয়েল ইত্যাদিকে বোঝায় । তিতির ও কোয়েল আমাদের দেশের নিজস্ব পোল্ট্রি না হওয়ায় তেমন জনপ্রিয় নয়। এদেশের কৃষক পারিবারিক পোল্ট্রি খামারে হাঁস, মুরগি ও কবুতর পালন করে আসছে। গৃহপালিত পাখি পালন এ দেশের কৃষকের কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতীতকাল থেকে কৃষক তার খামারে দেশি জাতের হাঁস, মুরগি ও কবুতর পালন করে আসছে । সাধারণত কৃষক তার খামারে ৫-১৫টি হাঁস-মুরগি পালন করে থাকে। এই প্রচলিত খামারে কোনো উন্নত বাসস্থান বা খাদ্যের ব্যবস্থা থাকে না। হাঁস-মুরগি নিজেরা বাড়ির আশেপাশে চরে খাদ্য শস্য ও পোকা-মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। এতে পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা মেটে এবং উদ্বৃত্ত ডিম ও মুরগি বাজারে বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয়ও হয়ে থাকে। এখানে বাণিজ্যিক বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। দেশি জাতের হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদন ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে তারা পারিবারিক খামারে উন্নত জাতের হাঁস ও মুরগি পালন করে আসছে যারা বছরে ২৫০টির মতো ডিম দেয়। এই পারিবারিক খামারে তারা অধিক মাংস উৎপাদনশীল ব্রয়লার মুরগিও পালন করে আসছে।

এসব পারিবারিক খামারে ৫০-৩০০টি পর্যন্ত উন্নত জাতের ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগি বা হাঁস পালন করতে দেখা যায়। যেসব কৃষক জমির অভাবে শস্য, গরু, ছাগল ও মাছ চাষ করতে পারে না তারা সহজে পারিবারিক হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন করতে পারে । সফলভাবে পারিবারিক পোল্ট্রি খামার পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ থাকা উচিত । বিশেষ করে পোল্ট্রির জাত, বাসস্থান, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং টিকাদান কর্মসূচি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক ।

পোল্ট্রির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বলতে পোল্ট্রিকে সুস্থ রাখার জন্য রোগ প্রতিরোধ ও অসুস্থ পাখির চিকিৎসাকে বোঝায় । পোল্ট্রির ক্ষেত্রে চিকিৎসা থেকে রোগ প্রতিরোধই শ্রেয়- কথাটি অধিক প্রযোজ্য। কারণ কোনো পোল্ট্রি খামারে রোগ দেখা দিলে চিকিৎসা না করে কখনো ব্যবসা লাভজনক করা যায় না । তাই পারিবারিক পোল্ট্রি খামার পরিচালনার সময় নিম্ন লিখিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে ।

  •  সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান বাচ্চা দ্বারা খামার শুরু করা ।
  •  বন্যামুক্ত উঁচু স্থানে খামার করা ও খামারের আশপাশে পরিষ্কার রাখা ।
  • খামারের চারদিকে মাঝে মধ্যে জীবাণুনাশক স্প্রে করা ।
  • খামারের পানি নামার জন্য নর্দমার ব্যবস্থা করা
  • সম্ভব হলে খামারের চারদিকে বেড়া দেওয়া ।
  • ঘরের মেঝে ও মুরগির লিটার শুকনা রাখা ।
  •  পোল্ট্রির ঘর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি করা ।
  • ঘরে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা ।
  • খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার রাখা ।
  •  সুষম খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা ।
  •  হাঁস, লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির জন্য পৃথক পৃথক টিকাদান কর্মসূচি মেনে চলা ।
  • খামার কর্মীর শরীর ও পোশাক পরিচ্ছন্ন থাকা ।

মহামারী আকারে রোগ দেখা দিলে সকল পাখিকে ধ্বংস করে মাটি চাপা দিতে হবে । রোগ নিরাময়ে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে ।

পারিবারিক গবাদিপশুর খামার

হাঁস-মুরগির মতো গবাদিপশু পালনও এদেশের পারিবারিক কৃষি খামারের বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশে গৃহপালিত গবাদিপশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া অন্যতম । বাংলাদেশের সর্বত্রই পারিবারিক খামারে গরু ও ছাগল দেখা যায় । কিন্তু মহিষ ও ভেড়া সর্বত্র দেখা যায় না । ধনী খামারির পক্ষে গরু ও মহিষ পালন করা সম্ভব । কিন্তু দরিদ্র ও ভূমিহীনদের জন্য ছাগল পালন করা সহজ । বাংলাদেশে পারিবারিকভাবে ছাগল পালন খুবই লাভজনক । কারণ ছাগলের মাংসের চাহিদা ব্যাপক থাকায় এর বাজার মূল্য অনেক বেশি । ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দ্রুত প্রজননের উপযুক্ততা লাভ করে । এরা একসাথে ২-৩টি বাচ্চা প্রসব করে । পুরুষ ছাগল ৮ মাস বয়সে বাজারজাত করা যায় ।

আমাদের দেশি গাভী দৈনিক ১.০-১.৫ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। তাই পারিবারিক দুগ্ধ খামারে দেশি গরু দ্বারা পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানো যায় কিন্তু কোনো বাড়তি আয় করা যায় না। আমাদের চাহিদার তুলনায় দুধের সরবরাহ খুব কম হওয়ায় পারিবারিক গরুর খামারে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। হলস্টেইন, ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের সংকর গাভী দৈনিক ১৫-২০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে । তাই বাংলাদেশের পারিবারিক খামারগুলোতে এ ধরনের উন্নত জাতের সংকর গাভী পালন করা দরকার । বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক উন্নত জাতের গাভীর পারিবারিক খামার করে সফলতা পেয়েছে। পারিবারিক খামারে গাভীর সংখ্যা ২-৫টি পর্যন্ত হয়ে থাকে । গাভীর সংখ্যা এর অধিক হলে তা বাণিজ্যিক খামারের রূপ নেয় এবং এর ব্যবস্থাপনার জন্য জনবল নিয়োগ করতে হয় । সফলভাবে পারিবারিক পশু খামার পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। বিশেষ করে পশুর জাত, উৎপাদন ক্ষমতা, বাসস্থান, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং টিকাদান কর্মসূচি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার ।

গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বলতে পশু খামারের রোগ প্রতিরোধ ও অসুস্থ পশুকে চিকিৎসা প্রদান করাকে বোঝায়। পশুর চিকিৎসা থেকে রোগ প্রতিরোধের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ খামারে রোগ দেখা দিলে চিকিৎসা করে পশুকে উৎপাদনে আনতে অনেক সময় লাগে । তাই গবাদিপশুর খামার পরিচালনার সময় রোগ না হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে ।

  • উঁচু স্থানে খামার করা ও খামারের চারিদিক পরিষ্কার রাখা
  • খামারে সাধারণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা
  • খামারের আঙ্গিনায় নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করা
  • খামারের পানি নামার জন্য নর্দমার ব্যবস্থা করা
  • গোয়াল ঘর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে তৈরি করা
  • খামারে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকা
  • বন্য পশুপাখি খামারে ঢুকতে না দেওয়া
  • খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার রাখা
  • সুষম খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা
  • পশুকে নিয়মিত গোসল করানো
  • মৃত পশুকে মাটি চাপা দেওয়া
  • গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার জন্য পৃথক পৃথক টিকাদান কর্মসূচি মেনে চলা
  • পশুর রোগে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে ।
কাজ : শিক্ষার্থীরা যেকোনো একটি খামার পরিদর্শন করবে এবং খামারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখবে ।

পারিবারিক মৎস্য খামার

পারিবারিক মৎস্য খামারের ধারণা ও গুরুত্ব
আমদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেকের বাড়িতেই পুকুর আছে । এই পুকুরগুলো গৃহস্থালির কাজে পানির উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এসব পুকুরে সাধারণত সনাতন পদ্ধতিতে কিছু মাছ চাষও করা হয়। যেমন- পোনা মাছের খাবার হিসাবে বাড়ির যে উদ্বৃত্ত ভাত ও অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য থাকে তা দেওয়া হয় । ফলে এসব পুকুরে উৎপাদন অনেক কম । অথচ এসব পুকুরে পরিকল্পনামাফিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষের আওতায় আনতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব । এই উৎপাদিত মাছ পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করা যায় । আবার বাড়ির আঙ্গিনায় বা পিছনে কিছুটা জায়গা থাকলে সহজেই একটি মিনি পুকুর খনন করা যায়। এবং এই মিনি পুকুরকেও পারিবারিক মৎস্য খামার হিসাবে গণ্য করে মাছ চাষ করা যায় । এসব পারিবারিক মৎস্য খামারগুলো বাড়ির মহিলাদের দ্বারাও পরিচালনা করা সম্ভব । মহিলারা এসব কাজ করার ফাঁকে কিছুটা সময় পুকুরে মাছ চাষের জন্য ব্যয় করলে একদিকে যেমন সহজেই পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ হবে অন্যদিকে সংসারে বাড়তি আয়ও সম্ভব হবে। আবার পারিবারিক মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিবারের বেকার সদস্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে ।

পারিবারিক খামারে চাষ উপযোগী মাছ
নিচে পারিবারিক খামারে চাষ করা যায় এরকম অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন কয়েকটি মাছের বর্ণনা দেওয়া হলো:-

ক) দেশি মাছ
চাষযোগ্য দেশি মাছের প্রজাতির মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ চাষের জন্য খুব উপযোগী । দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র এ মাছগুলো পাওয়া যায়। তবে খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দিঘিসহ বদ্ধ পানিতে এরা ডিম পাড়ে না । বর্ষাকালে (মে-জুলাই) এ সকল মাছ স্রোতযুক্ত নদীর কম গভীর অংশে ডিম ছাড়ে । প্রণোদিত বা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হ্যাচারিতে এদের পোনা উৎপাদন করা যায় । চাষকালীন সময়ে এ সব মাছ সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ফিশমিল, খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি গ্রহণ করে। পর্যাপ্ত খাবার পেলে কাতলা মাছ বছরে ২-৩ কেজি পর্যন্ত হয় । রুই ও মৃগেল মাছ বছরে ১কেজি ওজনের হতে পারে। দুই বছর বয়সে এসকল মাছ ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয় ।

খ) বিদেশি মাছ
আমাদের দেশের পরিবেশে সহজে খাপ খায়, দ্রুত বাড়ে ও হ্যাচারিতে সহজে পোনা তৈরি করা যায় এমন কিছু বিদেশি মাছ চাষের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে আনা হয়েছে । এধরণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মাছ হচ্ছে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, কার্পিও, থাইসরপুঁটি, তেলাপিয়া বা নাইলোটিকা ও থাইপাঙ্গাশ । এসব মাছ দেশি কার্প জাতীয় মাছের সাথে সহজেই মিশ্র চাষ করা যায় ।

আমার পরিচালনার বিভিন্ন ধাপ
অনেকগুলো ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খামার পরিচালনা করা হয়। খামার পরিচালনার বিভিন্ন ধাপগুলো হচ্ছে-

ক) খামারে পোনা মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা (পুর এজি) : পুকুরের আগাছা পরিষ্কার, রাক্ষুসে ও অপ্রয়োজনীয় মাছ সূরীকরণ, পাড় মেরামত, চুন প্রয়োগ, সার প্ররোগ, পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা এবং পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা ।

খ) পোনা মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা : পোনার প্রজাতি নির্বাচন, ভালো পোনা বাছাইকরণ, পোনা শোধন, পোনার পরিমাণ নির্ধারণ, পোনা পরিবহন এবং গোনা অভ্যস্তকরণ ও ছাড়া

গ) পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা : নিয়মিত সার প্রয়োগ, সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ, মাছের বৃদ্ধি পরীক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং মাছ ধরা ও বিক্রয় আমার পরিচালনার বিভিন্ন উপকরণ
খামার পরিচালনার বিভিন্ন পর্যারে বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন। খামার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ভিত্তিক উপকরণ সমূহের চাহিদা নিচে দেওয়া হলো :

   
 ব্যবস্থাপনার পর্যায়  উপকরণের চাহিদা
 মজুদ পূর্ব বা পুকুর প্রস্তুতি  দা, কোদাল, মাছ মারার বিষ (যেমন-রোটেনন), চুন, সার (জৈব ও অজৈব), বালতি, ড্রাম, মাটির চাড়ি, মগ, সেক্কিডিক্স
 মজুদকালীন  মাছের রেণু, হাড়ি বা পলিথিন ব্যাগ, খাবার লবণ, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, pH কাগজ, থার্মোমিটার
 মজুদ পরবর্তী  জৈব ও অজৈব সার, মাটির চাড়ি, বাঁশের টুকরা, সেক্কিডিক্স, সম্পুরক খাদ্য, বালতি, মগ/বাটি, খাদ্যদানি, চুন/জিপসাম, দা/কাঁচি, ব্যালেন্স, পাহারা দেওয়ার জন্য টর্চ, জাল (ধর্ম জাল, ঝাঁকি জাল, বেড় জাল)

মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
মাছ চাষকালীন সময়ে রোগাক্রান্ত হতে পারে। তাই মাসে একবার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত । মাছের রোগের সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে মাছের স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়, ফুলকার স্বাভাবিক রং নষ্ট হয়ে যায়, দেহের উপর লাল/কালো/সাদা দাগ পড়ে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় বা কম খায়, মাছের দেহ অতিরিক্ত খসখসে অনুভূত হয় । চাষকালীন মাছের কয়েকটি সাধারণ রোগ হচ্ছে ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, লাল ফুটকি রোগ, ফুলকা পচা রোগ এবং মাছের উকুন । খামারের পুকুরে মাছ রোগাক্রান্ত হলে মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে । প্রাথমিক ভাবে পুকুরের অবস্থা ভেদে শতক প্রতি ০.৫-১.০ কেজি চুন প্রয়োগ করা যায় ।

পুকুরের কিছু সাধারণ সমস্যা ও প্রতিকার

১। মাছ ভেসে উঠা ও খাবি খাওয়া (পানিতে অক্সিজেনের অভাব)
পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদার উপস্থিতি, জৈব পদার্থের পচন, বেশি সার প্রয়োগ, ঘোলাত্ব, মেঘলা আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পানিতে অক্সিজেনের অভাব হয় এবং এ সমস্যা দেখা যায় । এর ফলে মাছ ও চিংড়ি মারা যায় । অক্সিজেনের অভাবে মৃত মাছের মুখ “হা” করা থাকে ।

প্রতিকার ব্যবস্থা: পানিতে সাঁতার কেটে বা পানির উপর বাঁশ পিটিয়ে পুকুরের পানি আন্দোলিত করে অথবা হররা টেনে পুকুরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। বিপদজনক অবস্থায় পুকুর পরিষ্কার নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে অথবা পাম্প দিয়ে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।

২। পানির উপর সবুজ স্তর
অতিরিক্ত সবুজ শেওলা উৎপাদনের ফলে এ সমস্যা দেখা যায়। এর ফলে মাছের শ্বাস কষ্ট হয় ও মাছ পানির উপর খাবি খেতে থাকে। শেওলা পচে পরিবেশ নষ্ট হয় । মাছ ও চিংড়ির মৃত্যু হয়।

প্রতিকার ব্যবস্থা: পাতলা সুতি কাপড় দিয়ে তুলে ফেলা যায়। সার ও খাদ্য দেওয়া সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে । প্রয়োজন হলে কিছু পানি পরিবর্তন করতে হবে । কিছু বড় সিলভার কার্প ছেড়ে জৈবিক ভাবে নিয়ন্ত্ৰণ করা যেতে পারে ৷

৩। পানির উপর লাল স্তর
লাল শেওলা অথবা অতিরিক্ত আয়রনের জন্য এ সমস্যা দেখা যায় । এর প্রভাবে পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না । মাছ ও চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যায় । আবার পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতিও হয় ।

প্রতিকার ব্যবস্থা: শতাংশ প্রতি ১২-১৫ গ্রাম কপার সালফেট বা তুঁতে ছোট ছোট পোটলায় বেঁধে পানির উপর থেকে ১০-১৫ সেমি নিচে বাঁশের খুটিতে বেঁধে রাখলে বাতাসে ও পানিতে ঢেউয়ের ফলে তুঁতে পানিতে মিশে শেওলা দমন করে । খড়ের বিচালি বা কলাগাছের পাতা পেঁচিয়ে পানির উপর টেনে বা পাতলা সুতি কাপড় দিয়ে তুলে ফেলা যায় ৷

৪ । ঘোলা পানি
বৃষ্টি ধোয়া পানি পুকুরে প্রবেশের ফলে পানি ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে । পাড়ে ঘাস না থাকলেও এমনটি দেখা যায় । এর ফলে পানিতে সূর্যের আলো ঢুকে না, ফুলকা নষ্ট হয়ে যায় ও প্রাকৃতিক খাদ্য কমে যায় ।

প্রতিকার ব্যবস্থা: পুকুরে চুন (১-২ কেজি/শতক), জিপসাম (১-২ কেজি/শতক) বা ফিটকারী (২৪০-২৪৫ গ্রাম/শতক) প্রয়োগ করা যায় ।

৫। পুকুরের তলদেশের কাদায় গ্যাস জমা হওয়া
পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদার উপস্থিতি এবং বেশি পরিমাণ লতাপাতা ও আবর্জনার পচনের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় । এতে করে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ মারা যায় ।

প্রতিকার ব্যবস্থা: পুকুর শুকনো হলে অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে। হররা টেনে তলার গ্যাস দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে ।

পারিবারিক মৎস্য খামার স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবারের মাছের চাহিদা মেটানো এবং সে সাথে সম্ভব হলে বাড়তি কিছু মাছ বাজারে বিক্রি করে পরিবারের সচ্ছলতা বৃদ্ধি করা। এছাড়াও পারিবারিক খামারের মাধ্যমে পরিবারের বেকার সদস্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে ।

নতুন শব্দ: ক্ষুদ্র আয়, হররা

 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion