ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রাচীনপন্থীদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি প্রবল হয়ে উঠে। এদের হিংসা-বিদ্বেষ গোটা সমাজজীবনকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ভুলে দিশাহারা হয়ে পড়ে। ঠিক এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ই মে পতিতপাবন প্ৰভু জগদ্বন্ধুর আবির্ভাব হয়। তাঁর পিতা দীননাথ চক্রবর্তী এবং মাতা বামাদেবী।
পণ্ডিত দীননাথ চক্রবর্তী বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়া গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ন্যায়রত্ন উপাধি পেয়েছিলেন। প্রভু জগদ্বন্ধু দেখতে ছিলেন খুব সুন্দর। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কাঁচা সোনার মতো।
জগদ্বন্ধুর বয়স যখন মাত্র চৌদ্দমাস তখন তাঁর মা মারা যান। দীননাথ তখন এই ছোট শিশুটিকে নিয়ে তাঁর নিজের গ্রাম গোবিন্দপুরে ফিরে আসেন। তখন জগদ্বন্ধুর লালনপালনের ভার পড়ে তাঁর জেঠতুত বোন দিগম্বরী দেবীর ওপর। জগদ্বন্ধুর বয়স যখন পাঁচবছর তখন তাঁর বাবাও মারা যান। এর কয়েক মাস পর চক্রবর্তী পরিবার চলে আসে ফরিদপুরের শহরতলী ব্রাহ্মণকান্দায়। জগদ্বন্ধু ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ করেন পাবনা জেলা স্কুলে। পাবনা শহরের উপকণ্ঠে ছিল এক প্রাচীন বটগাছ। তার নিচে থাকতেন এক বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ। লোকে তাঁকে ‘ক্ষ্যাপাবাবা বলে ডাকত। একদিন তাঁর সাথে জগদ্বন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। জগদ্বন্ধুর সাথে তাঁর ভাব জমে যায়। জগদ্বন্ধু তাঁকে ‘বুড়ো শিব’ বলে ডাকতেন। জগদ্বন্ধু অবসর পেলেই সেই বটগাছের নিচে গিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতেন।
কিছুদিনের মধ্যে শহর ও শহরতলিতে তাঁর এক তরুণ ভক্তদল গড়ে ওঠে। প্রভু জগদ্বন্ধু একদিন ভক্তদের ছেড়ে তীর্থ ভ্রমণে বের হন। তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থান ও গ্রামগঞ্জে হরিনাম বিলিয়ে উপস্থিত হন শ্রীধাম বৃন্দাবনে। সেখানে তাঁর সাধনা চলতে থাকে গভীর থেকে গভীরে। বৃন্দাবনে কিছুকাল থেকে তিনি ফিরে আসেন ফরিদপুরে। ফরিদপুরের উপকণ্ঠে ছিল বুনোবাগদি, সাঁওতাল প্রভৃতি শ্রেণির বাস । তখনকার সমাজপতিদের দৃষ্টিতে তারা ছিল ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য। এদের অনেকেই একটু সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে এবং দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক সেই সময় জগদ্বন্ধুর কৃপাদৃষ্টি পড়ে এসব হতদরিদ্র ও অসহায় লোকদের ওপর। তিনি বাগদিদের সর্দার রজনীকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেন। রজনী বলেন, ‘আমরা নিচু জাতি। সবাই আমাদের ঘৃণা করে আর তুমি আমাকে বুকে টেনে নিলে!' প্ৰভু বললেন, “মানুষের মধ্যে কোনো উঁচু নিচু নেই। সবাই সমান।
সবাই আমরা ঈশ্বরের সন্তান। ভগবান মানুষের মধ্যেই আছেন। মানুষের মধ্যে কখনও বর্ণগত ও জাতিগত বৈষম্য হতে পারে না। ছোট বড় ভেদাভেদ শুধু তার গুণ ও কর্মের মাধ্যমে। তোমরা সবাই শ্রীহরির দাস। আজ থেকে তোমার নাম হরিদাস মোহন্ত।” তাঁর ভক্ত হরিদাস মোহন্ত অল্পদিনের মধ্যেই প্রভুর কৃপায় প্রসিদ্ধ পদকীর্তনীয়া রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় হরিনাম কীর্তনের এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়। প্রভু একদিন ভক্তদের নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছেন। ফরিদপুর শহরের এক জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় এসে তিনি বলেন, “এখানেই আমি শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠা করতে চাই।” সেই সময় শ্রীরামকুমার মুদি নামে এক ভক্ত শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন। প্রভুর নির্দেশেই ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন। বহু গুণীজন ও ভক্ত অনুরাগীর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এ পবিত্র তীর্থভূমি শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন।
এই শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনেই শুরু হয় প্রভুর গম্ভীরা লীলা। ১৯০২ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলে প্রভুর গম্ভীরা লীলা। এ সময় তিনি ছিলেন মৌনী। এর তিন বছর পর ১৯২১ সালে এই শ্রীঅঙ্গনেই প্ৰভু ইহলীলা সংবরণ করেন।
প্রভু জগদ্বন্ধুর জীবনে দুটি দিক রয়েছে। একটি তাঁর আধ্যাত্মিক দিক। অন্যটি সমাজে পিছিয়ে পড়া অসহায় মানুষের জন্য তাঁর বন্ধুরূপ প্রকাশ। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। অসহায় নিষ্পেষিত জীবকে উদ্ধারের জন্য তিনি এবং তাঁর ভক্তরা সর্বত্র হরিনাম কীর্তন প্রচার করেন। প্রভুর আগমন বার্তা এবং হরিনাম কীর্তনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে মহানাম সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায় গঠনে শ্রীপাদমহেন্দ্ৰজী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মহানাম সম্প্রদায় মানবতার পাঁচটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যথা : (১) চুরি না করা (২) হিংসা না করা (৩) সত্যবাদী হওয়া (৪) আত্মসংযমী হওয়া এবং (৫) অন্তরে ও বাহিরে শুচি বা পবিত্র থাকা। প্রভু জগদ্বন্ধু শ্রীশ্রী হরিকথা, ত্রিকাল, চন্দ্রপাত গ্রন্থসহ বহু কীর্তন রচনা করেছেন।
শিক্ষা : প্রভু জগদ্বন্ধুর জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, সব মানুষ সমান, কেউ উঁচু-নিচু নয়। কোনো মানুষই ঘৃণ্য বা অস্পৃশ্য নয়। তিনি তাঁর প্রেম ভক্তি দিয়ে ম্লেচ্ছ, চণ্ডাল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে মানব ধর্মে দীক্ষিত করেন। আমরাও তাঁর মতো সকল মানুষকে ভালোবাসব। কারো মনে আঘাত দিব না। কারণ মানুষকে আঘাত দিলে সে আঘাত নিত্যানন্দকে বা ভগবানকে দেয়া হয়। পিতামাতা হচ্ছেন পরম গুরু। তাঁদেরকে কষ্ট দিব না। তিনি শিক্ষা গ্রহণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই আমরাও জগদ্বন্ধুর কথা মেনে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করব। কাজের মধ্যে সর্বদা হরিনাম করব। পরচর্চা ও পরনিন্দা করব না। এই শিক্ষাগুলো আমরাও আমাদের জীবনে মেনে চলব।
আরও দেখুন...