বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এর অবদান অপরিসীম। আমাদের দেশে হিউম্যান রিসোর্স বিভাগটি একদিকে অবহেলিত, অন্যদিকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। নিচে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো-
→ পৃথক হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের অভাব (Lack of separate human resource department) : যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই হিউম্যান রিসোর্স একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপর প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করে। তাই হিউম্যান রিসোর্সের সুষ্ঠু ব্যবহার ও পরিচালনার জন্য আলাদা হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো পৃথক বিভাগ নেই। তাই হিউম্যান রিসোর্স পরিচালনায় অদক্ষতা রয়ে যাচ্ছে।
→ দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপকের অভাব (Lack of efficient human resource manager): বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেরই পেশাগত দক্ষতা কম। এমনকি অনেকের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। এমতাবস্থায় হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা আধুনিক উপায়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। এর ফলে দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপক গড়ে ওঠছে না এবং প্রতিষ্ঠানে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
→ প্রেষণার অভাব (Lack of motivation ) : কর্মীদের কাজে উৎসাহিত করার জন্য প্রেষণা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। প্রেষণা প্রতিষ্ঠানের সকলকে কাজে উৎসাহিত করে এবং কার্য সন্তুষ্টি বাড়ায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের প্রেষণা দানের ভালো ব্যবস্থা নেই। ফলে কর্মীদেরকে দিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজ করানো যায় না। এটি হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য বড় সমস্যা।
→ প্রতিকূল কার্য পরিবেশ (Unfavorable work environment) : বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানেই কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন কার্য বিন্যাস, যন্ত্র বিন্যাস প্রভৃতিতে সমস্যা রয়েছে। এর ফলে কর্মীরা মনোযোগের সাথে কাজ করতে পারে না। এটি হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমস্যা।
→ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব (Lack of proper training center): বাংলাদেশে হিউম্যান রিসোর্স বা ব্যবস্থাপকদের সুষ্ঠুভাবে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। এর ফলে নির্বাহী থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় না। তাই দেশে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপক ও পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী গড়ে ওঠেনি।
→ শ্রমিক অসন্তোষ (Labour unrest): বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মধ্যে কোথাও কোথাও অশুভ শক্তির প্রভাব রয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থ অর্জনের জন্য শ্রমিকদের প্ররোচিত করে। এছাড়াও মালিকপক্ষের সাথে বিরোধ, সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন, শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় আচরণ ও খারাপ শিল্প সম্পর্কের কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানে সবসময় শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই থাকে। ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
→ সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব (Lack of proper policy): বাংলাদেশে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব রয়েছে। নীতিমালা হলো কতিপয় নির্দেশিকা যাতে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ দিকনির্দেশনা থাকলে প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সহজ হয়। ফলে কার্য সম্পাদনে সৃষ্ট সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যায় ।
→ জবাবদিহিতার অভাব (Lack of accountability): বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানেই কার্যে ব্যর্থতার জন্য কঠোর জবাবদিহিতা নেই । ফলে ব্যবস্থাপক ও কর্মী উভয়ের মধ্যে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এটি হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য একটি সমস্যা।
→ শাসনের মনোভাব ( Rulling attitude): বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকগণ কর্মীদের প্রতি সহনশীল মনোভাব পোষণ না করে শাসনের মনোভাব পোষণ করেন। অর্থাৎ, কর্মীদেরকে সবসময় তারা শাসন করতে চান। এতে কর্মীদের মধ্যে বিরূপ স্বীকারোক্তি। মনোভাব সৃষ্টি হয়। ফলে, হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় ।
→ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি (Corruption and nepotism): বাংলাদেশে কর্মী নির্বাচন, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, বদলি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দেখা যায়। কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে সুষ্ঠু হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
→ প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা মূল্যায়ন (Evaluation of training effectiveness) : আমাদের দেশে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঝে মাঝে নির্বাহী ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে বাংলাদেশের হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থায় তেমন উন্নতি হচ্ছে না।
→ বিশেষায়ণের অভাব (Lack of specialization): হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি দক্ষতার সাথে সম্পাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শিদের নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। অদক্ষ ব্যবস্থাপকগণও এ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। ফলে বিশেষায়ণের অভাবে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
→ আধুনিক কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগে অনীহা (Apathy in application of modern technology and system): উন্নত দেশগুলোতে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কলাকৌশল প্রয়োগ করে ব্যবস্থাপনায় উন্নতির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কার্যাবলিতে আধুনিকতার তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না।
সুতরাং, হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত করতে হলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। হিউম্যান রিসোর্সই হলো প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি। তাই তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না।
বর্তমানে বিশ্বায়নের সুবাদে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ, বাণিজ্য এবং পরিবহনের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি চলে আসছে। এ পর্যায়ে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকে যথাযথভাবে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা, ভিন্ন সংস্কৃতির কর্মী ও হিউম্যান রিসোর্সের কার্যকর মিশ্রণ জরুরি হয়ে ওঠেছে। এর ফলে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে তা হলো-
→ হিউম্যান রিসোর্স উন্নয়নের চাপ (Pressure to develop the human resource): বিশ্বায়নে হিউম্যান রিসোর্স উন্নয়নে কখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়, কখনো বা সুফল বয়ে নিয়ে আসে। উন্নত জীবন ও অধিক বেতনের আশায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মেধাবী হিউম্যান রিসোর্স উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমায়। ফলে সে দেশের হিউম্যান রিসোর্সের উন্নয়ন হয়। তবে বঞ্চিত হয় কম পুঁজির অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ। আবার বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শাখা বিস্তারের কারণে সেসব দেশে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটে। এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স উন্নয়নের ওপর চাপ চলে আসে, যা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
→ কর্মশক্তি বৈচিত্র্য (Work force diversity): বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় যেমন অবাধে সারা পৃথিবীতে পুঁজির বিচরণ ঘটে তেমনটি ঘটে হিউম্যান রিসোর্সের ক্ষেত্রেও। বৈশ্বিক শিল্প বাণিজ্যে নানা ধর্ম-সংস্কৃতি-চিন্তা- আদর্শের চলক একসাথে জড়ো হয়। হিউম্যান রিসোর্সের দল, উপদল, গোত্র ভেদে তাদের চাহিদা, রুচি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পার্থক্য দেখা দেয়। এতসব মতভিন্নতাকে সুসংগঠিত করে সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিতভাবে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য একটি চালেঞ্জিং কাজ। ভিন্ন সামাজিকতা ও সংস্কৃতির এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সামাজিকতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়।
→ ক্ষমতায়ন (Empowerment) : হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে কর্মীদের অংশগ্রহণ, সঠিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনো প্রকার বৈষম্য না করে অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতমূলক অথবা নেতিবাচক মনোভাব না দেখিয়ে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মীদের কাজের দায়িত্ব ও পদোন্নতি দিতে হবে। পাশাপাশি হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বায়নের সাথে তাল মেলানোর জন্য সাম্প্রতিক জ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, কর্মপ্রক্রিয়া ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠানের কর্মীবাহিনীকে সঠিক সময় এবং উপায়ে সরবরাহ করতে হবে। তবে এতে সফল হওয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
→ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য (Language and cultural diversity): বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমশক্তি একত্রে কাজ করে। এতে বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি- ধর্মের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটে। এ জাতীয় বৈচিত্র্যতাকে মোকাবেলা করার জন্য হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকে উদার হতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাকে বিভিন্ন দেশ ও ভাষা- সংস্কৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।
→ পরিবর্তন (Change): বিশ্বায়নের ফলে প্রতিনিয়ত দেশের শিল্প-বাণিজ্যের পরিবর্তন ঘটছে। এসব পরিবর্তনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও প্রযুক্তির উন্নয়ন। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর সম্পদ ব্যবহার করার জন্য সেসব দেশে শিল্প কারখানা গড়ে তুলছে। পণ্যসামগ্রীর অবাধ প্রবাহের ফলে ভোক্তাদের রুচি ও চাহিদায় পরিবর্তন ঘটেছে। তাই হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকেও এসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কর্মীদের যোগ্য করে গড়ে তোলা হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ।
তাই বলা যায়, হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। এ প্রভাব ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনেরই আছে। তাই নেতিবাচক প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বায়নের সুফলকে কাজে লাগাতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির প্রচলন, কৌশলগত মৈত্রী স্থাপন, সর্বনিম্ন ব্যয়ে সর্বোত্তম মানের পণ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং যোগ্য ও দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স গড়ে তোলার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানের উপায় (Ways to Solve the Problems of Human Resource Management in Bangladesh)
বাংলাদেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বেশ অনুন্নত। ফলে এগুলোর হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাও ততটা উন্নত হয়নি। বাংলাদেশের হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা সমাধান করতে হলে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় বর্ণনা করা হলো-
→ হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ চালুকরণ (Start human resource department) : প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করতে হবে। এরপর এ বিভাগের দায়িত্বে একজন দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপক নিয়োগ করতে হবে। তিনি প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ও নীতির সাথে সমন্বয় করে সুষ্ঠুভাবে হিউম্যান রিসোর্সকে পরিচালনা করবেন।
→ শ্রম অসন্তোষ দূরীকরণ (Remove labour unrest): কর্মীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠানটি চালিত হয়। তাই তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ও হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়। তাই শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে এমন সব কারণ দূর করতে হবে। বিশেষ করে তাদের ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
→ দীর্ঘমেয়াদি হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন ( Longterm human resource planning): প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তেমনি হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনারও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাংলাদেশে যোগ্য হিউম্যান রিসোর্স গঠন করার জন্য এরূপ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
→ হিউম্যান রিসোর্সের উন্নয়ন (Development of human resource): প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সবাইকে বিভিন্ন উপায়ে উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পেশাগত জ্ঞানের অভাব পূরণ করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া প্রেষণার মাধ্যমে কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।
→ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি (Creating harmonious relation): বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের সাথে ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক ভালো থাকে না। শ্রমিকরা ব্যবস্থাপনাকে অনেক সময় ভুল বোঝে। ব্যবস্থাপনাও শ্রমিকদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করে। সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন করে উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এগুলো বড় বাধা। শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা উভয়ের এ ধরনের আচরণ পরিহার করে উভয়পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
→ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন (Preparing specific policy) : হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে হলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে তা অনুসরণ করতে হবে। নীতিমালা হলো দিকনির্দেশনা বা গাইডলাইন। হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সহজ হবে।
→ কর্মস্থল ত্যাগের হার হ্রাসকরণ (Reduce labour turnover): সুযোগ-সুবিধার অভাবে কর্মীরা এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। আবার নতুন কর্মী সেই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। এই অবস্থাকে শ্রমের আবর্তন বলে। শ্রমের আবর্তন বা স্থানান্তর বন্ধ না করলে দক্ষ হিউম্যান রিসোর্স প্রতিনিয়ত অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। কর্মস্থল ত্যাগের হার হ্রাস করতে হবে।
→ স্বজনপ্রীতি পরিহার (Avoidance of nepotism): প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী নিয়োগ, নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতিসহ সবক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। ন্যায়নীতি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মী নির্বাচন ও বিনিয়োগ করতে হবে। অন্যথায়, যোগ্য হিউম্যান রিসোর্স খুঁজে পাওয়া যাবে না।
→ দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন গঠন (Establishing responsible trade union): প্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা খুবই জরুরি। এজন্য সুষ্ঠু শিল্পীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে । তাছাড়া ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে বহিশক্তির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে ।
→ আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার (Avoiding of bureaucratic attitude): হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপকদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করতে হবে। কর্মীদের সাথে আলাপ- আলোচনায় বসতে হবে। এতে কর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়বে এবং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের সক্রিয় ও স্বেচ্ছামূলক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
→ ন্যায্য মজুরি (Fare wages) : কর্মীরা যাতে জীবন ধারণের জন্য ন্যায্য ও যুক্তিযুক্ত মজুরি পায়, হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাকে সেভাবে মজুরি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কর্মীরা যেন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে এমন মজুরি কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।
→ যথাযথ প্রশিক্ষণ (Proper training) : প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া কার্য বিশেষায়ণের প্রতিও জোর দিতে হবে। এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কার্য সম্পাদনের মাত্রা ও সম্পাদিত কাজের মান উন্নত হবে।
→ সেবার মান উন্নয়ন (Development of service standard): প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে রেশনশপ, ন্যায্যমূল্যের দোকান, কল্যাণ কমিটি, সমবায় বিপণি প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি কর্মীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর হিউম্যান রিসোর্স উন্নয়নের জন্য এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের লক্ষ্যই অর্জন করা যাবে।
আরও দেখুন...